তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
(পঞ্চাশ বছরের ওপর সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা। অবশ্য সহস্রাধিক সুরারোপিত গানেরও রচয়িতা যেসব ইউটিউবার মেয়ে নিয়মিত আপলোডও করে চলেছে ইউটিউব চ্যানেলে। কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়। প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় কোভিড পরিস্থিতিতে লেখা ইংরেজি ভাষায় ‘ইটস মাই আইল্যান্ড ‘ প্রকাশের অপেক্ষায়। স্বউদ্যোগে প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস ‘অন্তরালোকে ‘ নিজের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ও মাকে নিয়ে লেখা। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিরক্তি ‘অনন্ত জীবন ‘ উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত। এই উপন্যাসও মূল রচনা ইংরেজিতে। বঙ্গানুবাদও লেখককৃত। পেশায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত একটি কলেজের অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক হলেও লেখকসত্ত্বাকে প্রথম পরিচয় বলে ভাবতে পছন্দ। )
মূলাংশ
(মরজগতে মানুষ চলেছে অমরত্বের সন্ধানে। অনাদি অতীত থেকে তার এই যাত্রারম্ভ। অনন্ত জীবন তারই এক প্রকাশ। তাই অমৃতের অধিকার নিয়ে সুরাসুরে এত অশান্তি, কারণ অমৃত নাকি অমর করে। অমরত্বের ব্যাখ্যা আবার দ্বিধাবিভক্ত, দৈহিক অমরত্ব এবং আধ্যাত্মিক অমরত্ব। দানব ও সর্বসাধারণ বোঝে প্রথম মতবাদটিকেই। কোনটি সঠিক? সবাই ছোটবেলায় হারিয়ে যায় মানুষের মেলাতে, সেখানে সে বন্ধু খুঁজে পায় যাকে সে তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়, বোঝাতে চায় মানুষ ও বিশ্বজগতের উদ্দেশ্যবিধেয়। যে তাকে চেনে সে বোঝে সব। শৈবাঙ্কন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে অস্বীকার করে চলে যায় স্পিতি ভ্যালিতে। সেখানে সে আবিষ্কার করে সর্বজনীন ভাষা যাতে বাক্যালাপ চালাতো সনাতন মুনি-ঋষিরা কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, নদী-জঙ্গল, পাথর-প্রান্তর এবং অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে। স্পিতি ভ্যালির পটভূমিকায় স্পিতি নদী ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ এবং মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে সে খুঁজতে থাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ত্বের ব্যাখ্যা। কী পেল সে শেষ পর্যন্ত ? )
অধ্যায়: দুই
সে তার খুব ছোটবেলাতে মেলায় হারিয়ে গিয়েছিল।
তাদের বাড়ি থেকে মেলাপ্রাঙ্গণ খুব একটা দূরে ছিল না বলেই মনে আছে। ঘন্টাখানেকের পথও হবে কিনা সন্দেহ। কিসের মেলা অত আর এখন খেয়াল নেই। তবে সেই মেলাতে অনেক অনেক মানুষ আর দোকানপাট। কত কত রকমারি দ্রব্যের পসরা সাজিয়ে বসেছিল বিক্রেতারা, আর ক্রেতারাও সেজেগুজে রঙবেরঙের জামাকাপড় পরে সেখানে হাজির ছিল। মেলাতো কত রকমেরই হয়, প্রাচীন কাল থেকে মানুষ মেলার আয়োজন করে আসছে। কোন মেলা কোন অঞ্চলকে ভিত্তি করে তৈরি হয়, পরে হয়তো তা স্থায়ী হয়ে যায় এবং হয়তো সে এমনই বিশেষত্ব অর্জন করে যে দেশকালের গণ্ডি পেরিয়ে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তার কলেবর বৃদ্ধি পেতে পেতে কোনদিন সে আন্তর্জাতিক মেলার মর্যাদা পায়। এ তো গেল বড় মেলার কথা, এছাড়া আছে ছোট ছোট বহু মেলা যারা স্থানীয়ভাবেই সীমাবদ্ধ থাকে। যে মেলায় হোক না কেন, মেলার প্রধান বিশেষত্ব হল প্রচুর লোকের ভিড়, হৈ-হট্টগোল, সারি সারি দোকানপাট, ক্রেতা-বিক্রেতার আনাগোনা, বিনোদনের বিপুল সম্ভার। এক কথায় তাই বলে সবাই, মেলা হল মানুষের মিলনস্থল। নানা বর্ণের, নানা ধর্মের, নানা ভাষার, নানা জাতির, নানা স্বভাবের, নানা চেহারার মানুষ।মেলায় তারা সবাই একত্র হয়, একে অন্যের সঙ্গে মিশে যায় স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বা পরিচিতি হারিয়ে সাময়িকভাবে। মেলাপ্রাঙ্গণে যে মানুষগুলিকে দেখে অন্য কোন মানুষ তাদের প্রথম দর্শনে কেবল মানুষ বলেই ভাবে, পরে হয়তো ঘনিষ্ঠ হলে পর তাদের নিজস্ব স্বভাবচরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে, মেলাতে উপস্থিত থাকে কেবলই মানুষ, তার বর্ণ-জাতি-ধর্ম ইত্যাদি উহ্য রেখে।
খুব ছোট ছিল সে যদিও দিনটা তার বেশ মনে আছে। বাবা সেদিন দিনে-দিনেই কাজ থেকে বাড়ি চলে এসেছিল। মা যেন কী একটা কাজে ব্যস্ত ছিল। বাবাকে এমন হঠাৎ বাড়ি ফিরতে দেখে অবাক। তারও বেশ আনন্দ হয়েছিল। কী যেন খেলছিল উঠোনের কোন অংশে, বাবাকে দেখে ছুটে চলে এল। বাবা রোজই কাজ সেরে বাড়ি ফেরে রাত করে। তার চোখ তখন ঘুমে জড়িয়ে আসতে থাকে। বাবার সঙ্গে অনেক গল্প করার ইচ্ছে থাকলেও করা হয় না। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে পর দেখে বাবা কাজে বেরিয়ে গেছে। তখন তার নিজের ওপরই বেশ রাগ হয়, রাতে বাবাকে পেয়েও ঘুমিয়ে পড়ার জন্য।
বাবার গলা পেয়ে মা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,
‘হঠাৎ এখন চলে এলে ?’
বাবা তাকে কোলে তুলে নিয়েছিল। ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে উত্তর দেয়,
‘আজ ওকে নিয়ে মেলায় যাব ভাবলাম। তুমিও যাবে, চল।’
শুনে তার যা আনন্দ হয়েছিল সেই স্মৃতি এখনও অক্ষয়। মাকেও দেখা গিয়েছিল উল্লসিত হতে। আলমারি থেকে নতুন কাপড় বার করে সেজেগুজে নিল। তাকেও তুলে রাখা জামাকাপড় পরিয়ে দিল। তারপর একটু কিছু খেয়ে নিতে বলল সবাইকে। বাবা অরাজি না হয়েও জানাল,
‘বেশি কিছু খাওয়ার দরকার নেই। মেলায় গিয়ে কিনে খাওয়া যাবে।’
সে তখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। হাতেখড়ি হয়েছে সদ্য সদ্য। সরস্বতী পুজোর পুরুতঠাকুর মায়ের অনুরোধে তাকে স্লেট-পেন্সিলে প্রথম লিখিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকে সারাদিন মা কাজের ফাঁকে তাকে পড়াশুনা করায়। বাল্যশিক্ষা বই কিনে এনে দিয়েছে বাবা বাজারের দোকান থেকে। সেখানে মা তাকে পড়ায়, ‘অ-য় অজগর আসছে তেড়ে।’ আর মা মুখস্থ করায় কবিতা, ‘পাখিসব করে রব রাতি পোহাইল।’ কাঠের ফ্রেমঘেরা কালো স্লেটের ওপর মা চক দিয়ে লিখে রাখে, ‘অ-আ ……ক-খ,’ সে তাতে হাত বুলিয়ে যায়, আবার সেই শিক্ষা অনুযায়ী সে অক্ষরগুলি না দেখে লেখার চেষ্টা করে মায়ের সামনে। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি। তারপর হঠাৎ এই মেলায় যাওয়া। জীবনে সেই প্রথম তার এত জন সমাগমে হাজির হওয়ার অভিজ্ঞতা। এত মানুষের ভিড় দেখে সে অবাক হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীটা এত বড় ? এই এত এত মানুষ তারা সবাই এখানে এই মেলাতে থাকে ? মেলাতে এত লোকের জায়গা হয় কী করে ? আর কত কত জিনিসপত্রের পসরা ! জগতে এত জিনিসও আছে ? এত জিনিসপত্র দিয়ে কী করে মানুষ ? পেল কোথায় এসব ? কাদের জন্য এতসব জিনিস সাজিয়ে রাখা হয়েছে মেলাতে ?
মেলাপ্রাঙ্গণের ভিড় আর জাঁকজমক তাকে বিস্ময়াভিভূত করে দিয়েছিল। যা দেখে তাতেই তার চোখ আটকে থাকে। বাবা কোল থেকে তাকে চলতে দিয়ে মাকে বলল,
‘নিজের পায়ে চলতে শিখুক।’
‘পারবে কি ?’
মায়ের গলায় ছিল দ্বিধা। বাবা বলেছিল,
‘একদিন না একদিন পারতেই হবে। আজ থেকেই শুরু হোক সেটা।’
তবে হাতটা ধরে রেখেছিল বাবা, আর চলছিল কিছুটা মন্থর পায়ে যাতে তার পক্ষে চাপের না হয়ে যায়। সে হাঁটছিল, হাঁটতে নিজের পায়ে ভালোই লাগছিল, কিন্তু মেলার নানান আয়োজনে চোখ আটকে যাওয়ার জন্য থেমে থেমে যাচ্ছিল আর তাতে হোঁচট খেতে হচ্ছিল।মা তার অবস্থা দেখে আশঙ্কা প্রকাশ করলেও বাবা ছিল নির্বিকার।
মেলা মানে মিলনস্থল। সব মানুষ যেখানে এসে মেশে। সব নদী যেমন মেশে সমুদ্রে। এও ঠিক তেমন, জনসমুদ্র। নদীরা যখন সমুদ্রে মেশে তাদের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় হারিয়ে যায়। এখানে এই জনসমুদ্রেও মানুষ তার পরিচয় হারিয়ে ফেলে। অন্যকথায়, প্রতিটি মানুষ মেলায় এসে হারিয়ে যায়। কোন মানুষকেই আর আলাদা করে চেনার উপায় থাকে না।
বিচিত্র এক জনসমাবেশ এই মেলা। এখানে নাগরদোলা, সার্কাস, রাইড সবই আছে। একপ্রান্তে জাদুকর জাদুবিদ্যাও দেখাচ্ছে। পৃথিবীর সমস্ত জাতি-উপজাতি-জনগোষ্ঠী এখানে এসে হাজির। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান। এই মেলাতে রয়েছে পৃথিবীর সমস্ত বস্তুর প্রতিভূ একেকটি সংস্করণ। পাহাড়-নদী-জঙ্গল-সমুদ্র-মরুভুমি কী নেই এখানে ? আবার মাথার ওপর একটি আকাশও বর্তমান, কখনও তা তারকাখচিত, কখনও চন্দ্রালোকে উদ্ভাসিত, কখনও বা সূর্যবিকশিত। পৃথিবীতে যত মানুষ বা প্রাণি বা গাছপালা ছিল, আছে বা আসবে তাদের সবারই একেকটি প্রতিরূপ এখানে উপস্থিত। এমনই সংযুক্তিপ্রভাব মেলাতে। সেই মেলাতে গিয়েই সে হারিয়ে গিয়েছিল, একেবারে ছোট্টবেলায়। আর সেই থেকে হারিয়েই থেকেছিল। কিভাবে হারিয়ে গেল ? তার নিজেরও সেটা ধারণায় নেই। বাবা-মা সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও ঘটেছিল ব্যাপারটা। মজার কথা হল এই যে মেলাতে হারিয়ে গেলেও বাবা-মা তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এমন নয়। এই হারিয়ে যাওয়া বড়োই বিচিত্র। বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা মেলা ভার। হারিয়ে যায় যেজন মেলাতে সে কিন্তু চেনা পরিবেশ, চেনা লোকজনকে হারিয়ে ফেলে না। তারা সব তার পাশে যেমন থাকা দরকার তেমন থাকলেও সে নিজে মেলাতে হারিয়ে যায়। এ কেমন বিভ্রম কেউ বোঝে না, যে হারায় সে তো নয়ই। কেবল যে হারিয়ে গেল সে কোন্ পথে জনসমুদ্রে ঢুকেছিল তার কোন হদিশ আর পায় না। সে সেই থেকে মেলাপ্রাঙ্গণেই ঘুরতে থাকে, সেখান থেকে বার হওয়ার রাস্তাগুলি সব হারিয়ে যায়। চোখের সামনে হাতের কাছে থাকলেও সে বুঝতে পারে না। তার কোন দোষ নেই। বুঝবে কী করে সে ? মেলাতে পথ তো আর একটা-দুটো নয়, অজস্র পথের সমাহার চারপাশে। হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ পথ। খুব কম লোকই আসল পথটি চিনতে পারে বা দৈবাৎ পেয়ে যায় যা তাকে মেলা থেকে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করতে পারে। সেই পথ চিনে নেওয়ার চোখ থাকে না সবার, তা বহু সাধ্য-সাধনায় অর্জন করতে হয়। সেই ধৈর্য বা অধ্যবসায় ক’জনের থাকে ? এ বহু কষ্টসাধ্য তপস্যার ফলশ্রুতি। তা যে করতে পারে না সে আজীবন মেলাতে ঘুরেই যায়, যে পথই বাছাই করুক না কেন বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পথ ভেবে তা তাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আবার মেলারই কেন্দ্রবিন্দুতে এনে হাজির করে। এভাবে সে মেলার গোলকধাঁধাতে ঘুরতেই থাকে ঘুরতেই থাকে, বাইরে যাওয়ার পথ আর চিনে নিতে পারে না। তার জীবন তারপর শেষ হয়ে যায় একদিন। সে বুঝতেও পারে না যে সারাজীবন ধরে একটি মেলার জনসমুদ্রে সে অনর্থক ঘোরাঘুরি করে মরল। অনেকে আবার জীবনের শেষলগ্নে এসে টের পায়, কী বেকার ঘোরাঘুরি করে গেছে জন্ম থেকে। তখন তার হাহাকার জাগে অন্তরে, তার মনে আবার জীবনের সূচনালগ্নে যাওয়ার বাসনা হয়। মরিয়া হয়ে সে ভাবে, তাকে আরও বেশিদিন বেঁচে থাকা উচিত।অনন্ত জীবনের মোহ এভাবেই হৃদয়ে বাসা বাঁধে। সেই অনন্ত জীবনকে সে সাদা ভাষায় অমরত্ব বলে বোঝে। জীবনের শেষ লগ্নে এসে যে সব মানুষ এমন অপার্থিব কল্পনাবিলাসের মোহগ্রস্ত হতে পারে এমন নয়। তার এই মোহ যেকোন লগ্নে অন্তরে অঙ্কুরিত হতে পারে। এই মোহ বা বাসনার উৎস কিন্তু অনেক কিছু পাওয়া হল না জীবনে অথচ পাওয়া উচিত ছিল বা পেতেই হবে এমন অদম্য মানসিকতালব্ধ। মানুষের মেলায় হারিয়ে গেল যেজন, এমনকি যে বুঝল না হারিয়ে গেছে সে পর্যন্ত চায় এমন অনন্ত জীবন যাতে সে অনন্তকাল ধরে সেই মেলাপ্রাঙ্গণে অবুঝ ঘোরাঘুরি করে যেতেই থাকে। তার সমস্ত আনন্দ সে ভাবে ওখানেই পাওয়া যাবে। প্রকৃতপক্ষে মেলায় যে আসে সে যদি না বুঝতে পারে যে সে হারিয়ে গেছে তো সে ভাবে, এ মেলা যেন কখনও না শেষ হয়, আর মেলায় যেন সে অনন্তকাল ধরে থেকেই যেতে পারে। একবার যে মেলায় আসে তার মেলাপ্রাঙ্গণ ছেড়ে চলে যাওয়ার কোন ইচ্ছেও থাকে না। এর ব্যতিক্রম এতটাই মুষ্টিমেয় যে ধর্তব্যের মধ্যে আসার উপযুক্ত নয়। প্রত্যেকেই চায় চিরদিন যেন সে মেলাতে থেকেই যেতে পারে, এমনি মেলার আকর্ষণ। সে যে বোকার মত নিজেকে হারিয়ে বসে আছে মেলার গোলকধাঁধায় কে আর তা বোঝে ? সে শুধুই ভাবে, এই মেলাতে জনসমাবেশে সামিল হয়ে থাকাই আমার মূল উদ্দেশ্য, পরমার্থ। হবে না-ই বা কেন ? এত বৈচিত্রের সমাহার মেলাতে যে যত থাকা যায় ততই মনে হয় আরও থেকে যাই। আর যে একবার আসে মেলাতে সে ভাবে চিরটা কাল থেকেই যাব, থেকে যেতে হবে যেকোন মূল্যে, তার জন্য তার যত চেষ্টা যত কাজকর্ম যত কৌশল আর যাবতীয় উদ্যম। অনন্ত জীবন, সাদা বাংলায় অমরত্ব, তাই তার একমাত্র লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য কত যে উপায়ের আশ্রয় নেয় মানুষ ! মাঝেমধ্যে এমন কাজ করে বসে যা করার কোন যুক্তি বা কারণ নেই, এমনকি যা করা একেবারেই অনুচিত। মেলাতে থেকে যাওয়ার অদম্য নেশায় যে কোন পন্থা অবলম্বন করে মানুষ, বৈধ-অবৈধ অথবা ন্যায়-অন্যায়, কিছুই তার করতে বাধে না। ভাবে সবাই, ঢুকে পড়েছি যখন মেলাতে থেকেই যেতে হবে, চলে যাব না কিছুতেই, চলে যেতে পারি না।
সে যে মেলাতে হারিয়ে গিয়েছিল তার জন্য তার বাবাকে অনেকটাই দায়ী করা যায়। কারণ মেলা কী বস্তু সে জানত না, বাবাই তাকে মেলাতে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। আসলে এমনই নিয়ম বা নিয়তি, অধিকাংশ লোকই একা একা মেলাতে হারিয়ে যায় খুব কম ক্ষেত্রে। তাকে মেলাতে নিয়ে আসে তার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুবান্ধব। যারা নিয়ে আসে তাদেরকে সঙ্গে করেই সে মেলাতে হারিয়ে যায় এবং হারিয়ে থাকে। এমনকি ব্যাপারটা বোঝেও না এমনই বিধির বিধান। আসলে ওই যে বলে না, নির্বন্ধ দেখেও কিছু দেখতে পায় না। তার বাবার যদি তাকে নিয়ে মেলাতে আসার শখ না হত তাহলে তার হারিয়ে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ছিল না। সে তো জানতই না, জগতে মেলা বলে কোন বস্তু আছে এবং সেখানে এত জনসমাবেশ ঘটে। না জানলে তার এমন কী ক্ষতি হত ? কী ক্ষতি হয় মানুষের যদি প্রত্যেকেই না কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী হয় ? বা যদি না কেউ জগতে সবার দৃষ্টান্ত হতে পারে অথবা রাবণের মত দশটি মাথার অধিকারী না হয় তার কি বেঁচে থাকা অনর্থক হয়ে যায় ? যদি কেউ পথপ্রদর্শক না হয়ে অনুসরণকারী হয়ে নীরবে মুছে থাকে পৃথিবী কি তাকে তার বুক থেকে মহাকাশে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ? সে পরে ভেবে দেখেছে, বাবা সেদিন তাকে মেলাতে বেড়াতে নিয়ে না গেলেও তার বেঁচে থাকা বিপর্যস্ত হত না। কপালগুণে দোষটা কি তাহলে তার বাবার ? না, বাবার যে কোন দোষ ছিল সেটাও সে মনে করে না। বাবা তার কাজটা করেছিল স্বাভাবিক প্রেরণায়। তার জন্য বাবাকে দোষ দেওয়া সত্যিই উচিত হবে না। কিন্তু মেলাতে যাওয়ার পর যে কাজটা করেছিল বাবা সেটা কি ঠিক ছিল ?
মেলাতে নিয়ে যাওয়ার পর বাবার ইচ্ছে হয়েছিল তাকে স্বাবলম্বী করে দেওয়ার। তাই তাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে মাকে বলেছিল বাবা,
‘একে নিজের পায়ে চলতে দাও।’
ওখানেই যদি থেমে যেত বাবা তো কথা ছিল, কারণ তাকে স্বাধীন পায়ে হাঁটতে দিলেও হাতটি ধরে রেখেছিল তার। পরে যা করল সেটা দুঃসাহসিক। ততক্ষণে তারা মেলার মধ্যে অনেকটা সময় কাটিয়ে ফেলেছে। একনাগাড়ে হেঁটেছে অনেকটা পথ। মা বলল একসময়,
‘কোথাও দু’দন্ড থেমে একটু বিশ্রাম নিলে হত না ? বাচ্চামানুষ, কম তো হাঁটল না।’
‘তা অবশ্য ঠিকই বলেছ। চল, দেখি কোথায় বসা যায়।’
বাবা দ্বিমত করল না। আর খানিকটা হাঁটার পরই কতগুলি দোকানের পারস্পরিক পিঠ ছোঁয়াছুঁয়িতে যে একচিলতে ফাঁকা জায়গা পাওয়া গেল একটা পাকুড় গাছ ছিল সেখানে। গাছটা পাকুড় না হয়ে দেবদারুও হতে পারে। অনেকদিন আগের কথা, গাছটা আর চোখ বুজলে তেমন স্পষ্ট দেখা যায় না মনের বিগত পৃষ্ঠায়। কেমন আবছা ভুতুড়েমার্কা তার অবয়ব। যাই হোক. গাছটা রাম না রহিম, মাটি কি পবন, জল কি হুতাশন তাতে কিছু যায়-আসে না। সে কথা বলুক আর দেখা দিক বা না দিক তাও কোন চিন্তার কারণ নয়। আসল কথা হল, ওই দোকানগুলির পারস্পরিক অবস্থানপ্রসূত স্থানটিতে শীতল ছায়া ছিল, যা রৌদ্রতাপিত মেলাটির অন্তহীন ও সীমান্তবিহীন পথেঘাটে যাঁহাতক উদ্ভ্রান্ত ঘোরাঘুরির অবিশ্রাম বর্ণবিন্যাসে এতটুকু বিচ্যুতি, সান্ত্বনা পুরস্কারস্বরূপ। অথবা কোন সুযোগের সুবর্ণখচিত প্রাপ্তি। মেলাতে এমন শীতল ছায়া অনেক লুকিয়ে থাকে, কেউ দেখে কেউ দেখে না। বাবা-মায়েরা দেখিয়ে দেয়, বন্ধুরা দেখিয়ে দেয়। সেই সূবর্ণরঞ্জিত সুশীতল ছায়াতে প্রাণের আরাম চিহ্নিত থাকে, তাকে গ্রহণ করাও ভাগ্যের ব্যাপার। কেউ পেয়েও চায় না, কেউ চেয়েও হারায়। বড়কথা, খোঁজে না কেউ, অজান্তে হাতে এলেও অবজ্ঞা করে। একেই বলে ললাটলিখন, ললাট কার কেজানে, সেখানে কে লেখে তাই বা কেজানে। যাই হোক, বাবা কিন্তু তেমন একটা ছায়া খুঁজে পেয়েছিল আর মায়ের সঙ্গে তাকে নিয়ে সেখানে বিশ্রামের জন্য বসেছিল। বাবা আর মা অনেক কথাই দুজনে বলাবলি করছিল, আর সে ছিল চুপচাপ, আসলে মেলার বিশালতা তাকে বিহ্বল করে দিয়েছিল এতটাই যে কী দেখে গেল এতক্ষণ সেসব গুছিয়ে ভাবতে গিয়ে ভাবনার চালচিত্র এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। একসময় বাবা বলল,
‘আমি এবার কী ভাবছি জান ? ভাবছি ওকে মেলায় একা ছেড়ে দেব। দেখি, ও কী করে কোথায় যায়।’
শুনে মা আঁতকে উঠল। প্রায় সরবে আশঙ্কা প্রকাশ করল,
‘পাগল নাকি ! যদি হারিয়ে যায় কী হবে ? কোথায় পাব ?’
‘হারাবে না। মেলা যতই বড় হোক কোথাও খোলা নয়। মেলা থেকে তাই কেউ হারিয়ে যায় না।হারালেও মেলার মধ্যেই থাকে। জগতের এটাই নিয়ম।’
বাবার গলা ছিল শান্ত আর অচঞ্চল। মা কিন্তু যুক্তিটা মানতে নারাজ ছিল। পাল্টা যুক্তি সাজাবার চেষ্টা করল তাই,
‘অগুন্তি মানুষ এখানে। এত লোকের ভিড়ে কোথায় চলে যাবে তার কি কোন ঠিক আছে ?’
‘এটাই তো আশার কথা। যদি বা হারিয়েও যায় মানুষের মধ্যেই থাকবে। ভিড়টা যদি মানুষের না হত তো দুশ্চিন্তা ছিল।’
বাবা তার সিদ্ধান্ত থেকে হটে যাওয়ার ইচ্ছে দেখাল না। মায়ের আশঙ্কাপীড়িত মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝাল,
‘ওকে যদি না একা ছেড়ে দাও তো কোনদিন স্বাধীন চলাচলের ক্ষমতা পাবে না। মেরুদন্ড শক্তসবল হতে গেলে স্বাধীনতা দরকার। যদি না ওকে মানুষের ভিড়ে একা চলেফিরে বেড়াবার সুযোগ দিই তো ও পরগাছা হয়ে যাবে। লতানে গাছ হয়ে বেঁচে থাকা মানুষের শোভা পায় না।’
বাবা যা করব বলত করতই, মা প্রতিবাদ জানাতে জানাতে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিত। সবসময়ই এমনটা ঘটত, তার ব্যতিক্রম কিছু হল না এবারও। ছায়ার আরাম ছেড়ে বেরিয়ে বাবা তাকে একা ছেড়ে দিল মেলার আদিগন্ত মানুষের ভিড়ে। মা হতাশ মুখ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর সে যে কী করবে বুঝতে না পেরে হাঁটতে লাগল কোন দিক দিশা না ঠিক করে। একটু সময়ের মধ্যেই রাশি রাশি মানুষের ভিড় তাকে গ্রাস করে নিল। আর সে হারিয়ে গেল মেলার মধ্যে। এত এত মানুষ, কাউকেই সে চেনে না। সবাই যদি অচেনা হয় কাকে সে কী বলবে ? তার খুব ভয় হতে লাগল, নিজেকে অসহায় মনে হল। একজন কেউ চেনা লোক থাকবে না কেন ? যদি না থাকে তো কী করা উচিত ? এরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আর উদ্দেশ্যবিহীন চলতে চলতে তার দেখা হল কোটিকল্পের সঙ্গে। আলাপ হয়ে গেল কিভাবে নিজেই সে বুঝল না। কেবল এটুকু বুঝল, চেনা লোকেরা আসলে অচেনা লোকেদের আড়ালে গোপন থাকে।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)