পাঠক মিত্র
নবজাগরণের এক বিস্মৃত নাম–অক্ষয়কুমার দত্ত
রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের নামের সাথে সবার যতটা পরিচিতি আছে অক্ষয়কুমার দত্ত নামের সাথে তুলনামূলক সেই পরিচিতি এখনো পর্যন্ত সেভাবে নেই। যদিও কোনোভাবেই সে তুলনা চলে না । আসলে তাঁকে নিয়ে চর্চা করার মত তথ্য হয়তো সেভাবে সামনে আসেনি বা থাকলেও তা নজরে আসেনি । এ বছর রামমোমনের সার্ধদ্বিশতবর্ষে এবং 2020 সালে বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবর্ষে যেটুকু আয়োজন চোখে পড়েছে, 2020 তেই অক্ষয়কুমার দত্তের দ্বিশতবর্ষ প্রায় একেবারেই অনালোচিত ছিল বলে বলা যায় । ওই বছর অতিমারি করোনাকাল বলে এড়িয়ে যাওয়া যদিও কোনো যুক্তি হতে পারে না । তবে 2020 তে প্রকাশিত ‘বিস্মৃত অবিস্মৃত অক্ষয়কুমার দত্ত’ বইটি হাতে আসার পর মনে হয়েছে যা একেবারে নিরাশ করেনি । পাঠ্যবইয়ে অক্ষয়কুমার দত্তের যেটুকু পরিচয় তা ব্রাহ্ম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিচালিত ‘তত্ত্ববোধিণী’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে । কিন্তু উক্ত বইটিতে তাঁর সম্পর্কে নানা তথ্যপূর্ণ বিষয় লেখক একত্রে তুলে ধরেছেন, আর সেই তথ্য একটি কথাই বলে, যে-সকল মুক্ত মনের চর্চায় এ দেশে নবজাগরণ এগিয়েছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম মানুষ হলেন অক্ষয়কুমার দত্ত ।
রাজা রামমোহন রায়ের হাত ধরে এ দেশে নবজাগরণের যে পথ তৈরি হয়েছিল সেই পথে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু মানুষ তদানীন্তন কুসংস্কারযুক্ত ধর্মকে কিছুটা সংস্কার করে তার একটা আধুনিক ধারা সৃষ্টি করেছিলেন । সেই সময়ের বিচারে সেই মানুষগুলো মুক্তমনা হলেন । তাঁরা গোঁড়ামিকে সরিয়ে ধর্মীয় ভাবধারাতে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন । ঠিক এর পরবর্তী সময়ে বিদ্যাসাগর এলেন, সমাজকে ধর্মীয় ভাবধারা থেকে মুক্ত করতে চাইলেন । তাঁর এই কাজের সাথে আর একজনের নাম করতেই হয় যিনি হলেন অক্ষয় কুমার দত্ত । বিদ্যাসাগরের সামাজিক আন্দোলনের যিনি একজন সক্রিয় সমর্থকই শুধু ছিলেন না , তিনি বিদ্যাসাগরের সাথে এবং পথেই হেঁটেছিলেন ।
বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয়কুমার দত্ত– এই দুটি মানুষ উনবিংশ শতাব্দীতে যখন ধর্মীয় গোঁড়ামিতে ব্রাহ্মণ্যবাদের পরাকাষ্ঠে সমাজ আবদ্ধ হয়ে আছে, তখন তাঁরা সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হাঁটলেন কি করে । অথচ এই দুজন পাশ্চাত্য থেকে শিক্ষা নিয়ে আসেন নি । শুধু তাই নয়, অক্ষয়কুমার দত্ত কোনো প্রথাগত ডিগ্রি অর্জন করেন নি । অল্প বয়সে সাংসারিক জোয়াল কাঁধে নিয়েও নিজের চেষ্টায় আপ্রাণ জানার চেষ্টা করেছেন । অনুসন্ধিত্সু মনে বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে ধর্মকে, শাস্ত্রকে যাচাই করার সাহস দেখিয়েছিলেন। মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তি তাঁকে যতদূর নিয়ে যেতে চেয়েছে অসংকোচে তিনি ততদূর গিয়েছেন । আসলে সমসাময়িক পাশ্চাত্যের যে-সব বিজ্ঞান দর্শন তাঁর মুক্তবুদ্ধির কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে তিনি সেগুলিকে গ্রহণ করেছেন, চর্চা করেছেন এবং সৃজনশীলভাবে যথাসাধ্য প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন । তাই পাশ্চাত্য শিক্ষার যে ঢেউ আছড়ে পড়েছিল সেই ঢেউয়ে এ দেশের নুড়ি-পাথর ধুয়ে পরীক্ষা করার সাহস দেখিয়েছিলেন । যে সাহসে তিনি খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানকে, খুঁজে পেতে চেয়েছেন সত্যকে । তাই ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে থেকেও তিনি সেই সমাজের উপাসনার কোনো অর্থ নেই বলে এক বীজগণিতের নিয়মে যুক্তি দিয়েছিলেন ( পরিশ্রম =শস্য; পরিশ্রম + প্রার্থনা = শস্য; এ সমীকরণ দুটির মধ্যে বিয়োগ করলে, প্রার্থনা =0 হয়)।
প্রথমদিকে ব্রাহ্মসমাজী হয়েও অক্ষয়কুমার দত্ত খোঁজেননি ঈশ্বরের সাথে মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ । তিনি মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ খুঁজেছেন বাহ্যবস্তুর সাথে । এ ব্যাপারেে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘আমি খুঁজিতেছি ঈশ্বরের সহিত আমার সম্বন্ধ, আর, তিনি খুঁজিতেছেন বাহ্যবস্তুর সাথে মানব প্রকৃতির কি সম্বন্ধ । আকাশ পাতাল প্রভেদ ।’ পরে অক্ষয়কুমার দত্ত ব্রাহ্ম ধর্মের অন্যতম তাত্ত্বিক প্রবক্তা হয়ে উঠেছিলেন । তখন ব্রাহ্মসমাজ বেদ-বেদান্তকে অভ্রান্ত বলে বিশ্বাস করত । কিন্তু অক্ষয়কুমার দত্ত এর প্রতিবাদ করেছেন তাঁর যুক্তি দিয়ে । যে যুক্তির জন্য তিনি বিজ্ঞানে নির্ভরশীল হয়েছিলেন । সে সময়ে তিনি একমাত্র মানুষ যিনি বেদ, উপনিষদ, ধর্ম সবকিছুই বিজ্ঞান নির্ভর চিন্তার দ্বারা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন । তাঁর মতে ধর্মের ভিত্তি কোনো গ্রন্থ হতে পারে না । বেদ সম্পর্কে তিনি যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, ‘মানুষের বিজ্ঞানচেতনা জাগরণের বহু পূর্বেই বেদ রচিত । তাই বেদ মানুষের অজ্ঞানতাপ্রসূত চিন্তাই বহন করে । এ কারণে এই গ্রন্থ আধুনিক চিন্তা সম্পন্ন মানুষের ধর্মবোধের নিয়ামক হতে পারে না ।’ শুধু তাই নয় অক্ষয়কুমার ধর্মাচরণের নামে যেকোনো কুৎসিৎ, উদ্দাম মানসিকতার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার চেষ্টাকে ধিক্কার জানিয়েছেন । তাই এমন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রবক্তাদের উদ্দেশ্যে বলতে পেরেছেন, ‘সমুদয় ধর্মসম্প্রদায়ীরা চিরকালই বুদ্ধিশক্তিকে ভয় করিয়া আসিয়াছেন ।…জ্ঞানব্রত উপনিষদ বক্তারাও তাহাতে বর্জিত নন ।’ এ কথার প্রমাণে কঠোপনিষদের বিখ্যাত এক শ্লোক উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন । শ্লোকটি–‘এই যে আত্মজ্ঞান, ইহা তর্কে পাওয়া যায় না ‘ । যা দেখিয়ে বলেছেন, ‘বুদ্ধি ও ধর্মনীতি বিষয়ে অধিকার থাকাতেই মানুষের মনুষ্যত্ব জন্মিয়াছে । বিশুদ্ধ বুদ্ধি তত্ত্বলাভের একমাত্র সোপান । বুদ্ধিবিচার ব্যতিরেকে তত্ত্বনিরূপণ করা আর চক্ষু-কর্ণ ব্যতিরেকে দেখিতে বা শুনিতে পাওয়া উভয়ই তুল্য ।’ যাঁর চিন্তা এরূপ তাঁর সমস্ত ভাবনার বাহক জ্ঞানবিজ্ঞান হবে এটাই স্বাভাবিক । তাই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর পত্রিকাটি ধর্মপ্রচারের বাহক না হয়ে জ্ঞানবিজ্ঞানের নতুন নতুন চিন্তার বাহক হয়ে দাঁড়ায় । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর গোঁড়া ব্রাহ্মসমাজী হয়েও অক্ষয়কুমারের যুক্তি ও জ্ঞানের কাছে তিনি বাধা হয়ে ওঠেন নি । এমনকি অব্রাহ্ম বিদ্যাসাগরের যুক্তিপূর্ণ লেখনী ও পরামর্শ থেকে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে, তেমন অক্ষয়কুমারের জ্ঞানচর্চা আরো সাবলীল হয়েছে । তাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, অক্ষয়কুমার আমাদের ব্রাহ্মসমাজের জ্ঞান মার্গের প্রহরীরূপে দণ্ডায়মান ছিলেন ।
যে জ্ঞান মার্গে চলতে চলতে তিনি শাস্ত্রের ব্যাখ্যা দিলেন,’ যে নক্ষত্রের মনোবৎ দ্রুতগামী কিরণপুঞ্জ পৃথিবীর মন্ডলে উপনীত হইতে দশ লক্ষ বৎসরের অতীত হয় তাহাও আমাদের শাস্ত্র । আবার যে অতিসূক্ষ্ম শোণিত বিন্দু আমাদিগের হৃদয়াভ্যন্তরেই সঞ্চরণ করিতেছে, তাহাও আমাদিগের শাস্ত্র ।–বিশুদ্ধ জ্ঞান আমাদের আচার্য । —ভাস্কর ও আর্যভট্ট এবং নিউটন ও লাপ্লাস যা কিছু যথার্থ বিষয় উদ্ভাবন করিয়াছেন, তাহাও আমাদের শাস্ত্র; গৌতম ও কণাদ এবং বেকন ও কোঁত যে কোনও প্রকৃতিতত্ত্ব প্রচার করিয়াছেন তাহাও আমাদের শাস্ত্র ।’
এই জ্ঞান মার্গে অক্ষয়কুমার তাঁর চিন্তা ও মননজগতকে উত্তরণের এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যার বড় প্রমাণ হল তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার সর্বশ্রেষ্ঠ মৌলিক সৃষ্টি ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ । একশো বিরাশিটি সম্প্রদায় নিয়ে গবেষণার কাজ করেছিলেন । এই গবেষণায় বুঝতে চাইলেন যে বহু সম্প্রদায়ে বিভক্ত হিন্দুধর্মের নানা স্থানীয় দেবদেবীর উদ্দেশ্যে দেশ-কাল ভেদে পালনীয় নানা আচার আচরণ ইত্যাদির সাথে সাথে এই ধর্মের দার্শনিক বুনিয়াদ সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে কি । এ কাজে বেকনীয় অভিজ্ঞতাবাদী দর্শনের বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি, মিলের আরোহবাদী যুক্তিপ্রণালী ও ডারউইনের তত্ত্ব ব্যবহার করে ভারতীয় ভাববাদবিরোধী অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদ ব্যক্ত করেছেন, এমনকি এও প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন ভারতীয় দর্শনের ও দার্শনিক চিন্তার বেশিরভাগই ইহলৌকিক, নিরীশ্বরবাদী ধারণায় পূর্ণ । এই পথে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করে তাঁর মত ব্যক্ত করেছিলেন, ‘ সব ধর্মই মানবতার শত্রু ‘ । যে মানুষটির ঘরে কেবলমাত্র নিউটন আর ডারউইনের ছবি স্থান পেয়েছে, দেবতা বলতে যিনি এঁদের মানেন বলে ব্যক্ত করেছিলেন তিনিই ত ধর্ম নিয়ে বলতে পারেন এমন কথা । যার প্রতিধ্বনি পরবর্তীকালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘পথের দাবী’ উপন্যাসে সব্যসাচীকে দিয়ে বলালেন, ‘সমস্ত ধর্মই মিথ্যা—-আদিম যুগের কুসংস্কার, বিশ্ব মানবতার এতবড় শত্রু আর নেই ।’
অক্ষয়কুমার দত্ত নিজের জীবনে বিজ্ঞানভিত্তিক মানসিকতায় যেমন সকল অতিপ্রাকৃত শক্তিকে অস্বীকার করেছেন, তেমন শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর সেই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন চেয়েছিলেন । তাই তিনি শিক্ষা প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রকৃত জ্ঞানলাভপূর্বক কুসংস্কার বিমোচন ব্যতিরেকে মনের ভাব সংশোধিত হয় না, প্রকৃত বিষয় শিক্ষা করিলে স্বদেশীয় লোকের কৌতূহল উদ্দীপ্ত হইয়া অবাস্তবকে বিষয়ে অশ্রদ্ধা ও বাস্তবিক বিষয়ের জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবল হইবে ।’
তিনি সেই জ্ঞান চেয়েছেন যা শিখলে- ‘বুদ্ধি মার্জিত হয়, ভ্রম ও কুসংস্কার দূরীভূত হয়, এবং জগতের প্রকৃত নিয়ম প্রণালী অবগত হয়ে কর্তব্য-অকর্তব্য নির্ণয় করা সম্ভব হয়, তাই প্রকৃত জ্ঞান । যা শিখলে নিজের ও জনসমাজের সর্ববিধ শ্রীবৃদ্ধি সাধন করতে সমর্থ হওয়া যায়, সেই রূপ জ্ঞান শিক্ষা করাই কর্তব্য ।’
এই জ্ঞান অর্জনের জন্য ভাষার ভূমিকা নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন,’ভাষা শিক্ষা প্রকৃত জ্ঞান শিক্ষা নয়, জ্ঞান শিক্ষার উপায় মাত্র । ভাষা জ্ঞানরূপ ভান্ডারের দ্বার স্বরূপ । সেই দ্বার উদ্ঘাটন করিয়া জ্ঞানভান্ডারে প্রবেশ করিতে হয় ।’ এই জ্ঞানভাণ্ডারে প্রবেশ করতে সংস্কৃত ভাষায় নয়, তিনি জোর দিতে চেয়েছেন ইংরাজি, ফরাসী অথবা জার্মান ভাষার উপর । কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘ভ্রম, কল্পনা, কুসংস্কার সংস্কৃতশাস্ত্রের সর্বস্থানে ওতোপ্রতোভাবে ব্যস্ত রহিয়াছে ।…উক্ত তিনটি ভাষার একটিতে অধিকার থাকিলে সংস্কৃতশাস্ত্রের মধ্যে যেটুকু প্রকৃত জ্ঞান আছে তার শত সহস্রগুণ অক্লেশে একত্র প্রাপ্ত হওয়া যায় । –প্রকৃত জ্ঞান যাঁরা লাভ করতে চাইবেন, তাঁদের পক্ষে সংস্কৃত শিক্ষা করিয়া কালক্ষেপ ও আয়ুক্ষয় করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই ।’ তাই সংস্কৃত শিক্ষা জ্ঞান চর্চার বাহন হিসেবে ‘ইহার দিন গিয়াছে’ বলে ব্যক্ত করেছেন । বিদ্যাসাগর ইউরোপের আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে ও ইংরেজি শিক্ষা চালু করতে যে ধরনের যুক্তি তাঁর ‘Notes on Sanskrit College’-এ তুলে ধরেছিলেন, তার প্রতিধ্বনি অক্ষয়কুমার দত্তের কথায় পাওয়া যায় ।
এমনকি সরল বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান ও ভূগোলকে মানুষের বোধগম্য করতে তিনি অসীম দক্ষতার সাক্ষ্য রেখেছিলেন যখন বাংলা ভাষা তখনও অবিকশিত । শুধু তাই নয় বাংলাভাষা তখন সবে ছন্দবদ্ধ পদ্যের বন্ধন থেকে অপরিণত গদ্যের রূপে জন্ম নিয়েছে । তাঁর বাংলা ভাষায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে, তেমন বাংলা ভাষার নিজস্বতা হয়েছে বলিষ্ঠ । নিজের পরিভাষায় সহজ বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার পথকে তিনিই প্রথম প্রশস্ত করেছিলেন । তাঁর পরিভাষার কয়েকটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায় । বিজ্ঞানের ইংরাজি শব্দের যে পরিভাষা করেছেন তার কয়েকটি হল– মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, তড়িৎ, জ্যোতির্বিদ্যা, সুমেরু, কুমেরু, জোয়ার, সৌরজগৎ, জড়, পরিমিতিবোধ, ধ্রুবতারা, গ্রহণ, রামধনু ইত্যাদি ।
শিক্ষাপদ্ধতি কেমন হবে তাও তিনি বলেছেন । তিনি চেয়েছেন অন্তত পনের বছর বয়স পর্যন্ত বিনা বেতনে সার্বজনীন শিক্ষালাভের ব্যবস্থা হওয়া উচিত । দুবছর শিশুদের অন্তর্নিহিত গুণ বিকাশের পরিবেশে খেলাধুলার আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠার জন্য বিদ্যালয় চেয়েছেন । তিনি মনে করতেন ছয় থেকে পনেরো বছর পর্যন্ত যখন মধ্যস্তরের শিক্ষাকাল তখন বিদ্যালয়ের পরিবেশ হবে প্রাকৃতিক এবং তার চারিদিকে থাকবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও মনীষীদের সৃষ্টি । আর সিলেবাস এমন হবে যাতে ছাত্রদের মধ্যে কোনোভাবেই অন্ধ অনুকরণের মানসিকতা সৃষ্টি না হয় । উচ্চ শিক্ষার বয়স হবে কুড়ি থেকে বাইশ বছর । এমনকি পাশাপাশি টেকনিক্যাল ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার কথাও বলেছিলেন । আর সব বিদ্যালয়ের ভার সরকারের নেওয়া উচিত বলে মনে করতেন ।
সেই সময়ে দাঁড়িয়ে অক্ষয়কুমার দত্ত’র সমস্ত কর্ম ও চিন্তা এমনই স্বাতন্ত্রবোধের দ্বারা চিহ্নিত ছিল । যুক্তি, বিচারবোধ, বিজ্ঞানমনস্কতা তাঁর চিন্তাপ্রক্রিয়ার সাথে এমনভাবে মিশেছিল যা আজকের সময়ে অক্ষয়কুমার দত্ত আমাদের বিস্মৃতির অতলে চলে গেলে নিজেদের আধুনিক বলার সাহসটা হয়তো আর বেঁচে থাকে না । তাই নবজাগরণের ইতিহাসে রামমোমনের উত্তরসূরী বিদ্যাসাগরের পাশাপাশি অক্ষয়কুমার দত্তের জীবনী চর্চা সেভাবে না হলে আমরা সম্পূর্ণ হতে পারি না । অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পর্কে সেই চর্চার জন্য পীযূষকান্তি সরকারের ‘বিস্মৃত অবিস্মৃত অক্ষয়কুমার দত্ত’ এই বইটি একটি আকর গ্রন্থ হয়ে উঠেছে । লেখকের দশ-বারো বছরের নিরলস অনুসন্ধানে সমৃদ্ধ পুষ্ট ফসল প্রথম খন্ডে প্রকাশিত এই বইটি অবশ্যই অক্ষয়-চর্চার এক অক্ষয় মাইলফলক ।
বিস্মৃত অবিস্মৃত অক্ষয়কুমার দত্ত
পীযূষকান্তি সরকার
কবিতিকা, মেদিনীপুর- 721102
মূল্য– চার’শ টাকা