তপোপ্রিয়
গোস্বামীবাবুর দু’টি ছেলে আর দু’-তিনটি মেয়ে। পুরো নাম জ্ঞানেন্দ্র গোস্বামী, মাঝখানে মোহন বা প্রসাদ হয়তো ছিল। একেবারে সাংসারিক যেসমস্ত মানুষকে সদাসর্বদা দেখা যায় লোকের ভিড়ে চোখের সামনে তেমনই একজন মানুষ।জমিজমা ও বিষয়-আসয় সম্পর্কে টনটনে জ্ঞান, চেহারায় স্পষ্ট সেই ছাপ। তার নিজস্ব জমিজায়গা তো ছিলই, উপরন্তু অন্যের জমিটমিতেও বোধহয় ভাগে চাষবাসের কাজ করত এবং সেই সূত্রেই মায়ের সঙ্গে তার পরিচয় ও আমাদের বাড়িতে তার যাতায়াত। অথবা অন্য কোন কারণেও তার সঙ্গে মায়ের পরিচয় ঘটতে পারে, তবে যাই হোক না কেন মানুষ হিসেবে সে আমাদের সেসময়কার দুরবস্থার জন্য সহানুভূতিশীল ছিল। চারপাশে সবাই তখন শত্রুভাবাপন্ন, অল্প যে কয়েকজন আমাদের সহমর্মী ছিল তাদের মধ্যে গোস্বামীবাবু একজন। নিজেরটা ষোলোআনা বুঝে নিলেও অন্যের ক্ষতি চাইত না। বেশ দশাসই চেহারা, যেমন লম্বা তেমনই স্বাস্থ্যবান। পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে আসা সমস্ত লোকেদের মত তাকেও এই নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চাপ ছিল, তা সত্ত্বেও তাকে মোটামুটি অবস্থাপন্নই বলা যেত। জমির ফসল, পুকুরের মাছ, পোষা গরুর দুধ ছাড়াও ছিল হাঁস-মুরগি ডিম ও মাংসের জন্য। স্বভূমি থেকে উৎখাত সমস্ত পরিবারেরই এমন চেহারা, কারো একটু বেশি কারো কিছু কম। বাজারে নিত্য যাওয়ার উপায় ছিল না অনেক কারণেই, তার একটি প্রধান কারণ ছিল সপ্তাহে সোম আর শুক্র ছিল হাটবার। অন্য দিনগুলিতে সকাল বা বিকেলের দিকে হয়তো মাছ-সবজি বিক্রেতারা আসত তবে ক্রেতার সংখ্যা ছিল মুষ্টিমেয়। প্রধান কারণ এই যে সবাই নিজের বাড়ির সবজি বা অন্যান্য খাদ্যপকরণের ওপরই বেশি নির্ভরশীল থাকত। নিয়ম করে রোজ বাজার যাওয়ার সময়ও হত না অনেকের, তাছাড়া হাতে নগদ টাকাও ছিল না বেশি লোকজনের। একটা ডাকঘর ছিল, ওখানেই টাকা জমাট কিছু মানুষ, ব্যাংক-ট্যাঙ্কের কোন চিহ্ন বা ধারণাও ছিল না।
সেসব তো অন্য গল্প, গোস্বামীবাবুর কথাতেই ফিরে আসা যাক। তার বাড়ি ছিল যেখানে সে জায়গাটার নাম আলগামুড়া। নামকরণের বিষয়টি ব্যাখ্যা করা দরকার। মুড়া শব্দটির মানে হতে পারে কোন স্থান বা অঞ্চল, আর আলগা কথাটি মানে বিচ্ছিন্ন। তাহলে পুরো শব্দটির মানে দাঁড়ালো বিচ্ছিন্ন এক এলাকা। কার্যত আলগামুড়া ছিল একটি দ্বীপের মত এলাকা যার চারপাশ ঘেরা জলাজমিতে, বর্ষার আগমনে সেই স্থান মূল ভূখণ্ড থেকে দ্বীপের মতোই আলাদা হয়ে থাকে। এমনিতেও অন্য সময় ওখানে যাতায়াত করতে হয় এক বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে। আমাদের বাড়ির পিছনদিকে পুকুরপাড়ে দাঁড়ালে দেখা যেত ওই অঞ্চলের এদিকটা জলাজমির পর ধনুকাকৃতির, গাছপালায় ঘেরা এক দ্বীপভূমির মত। মায়ের প্রায়ই যাতায়াত ছিল সেখানে নানা সূত্রে। সেসব অন্য কাহিনী।
গোস্বামীবাবুর দুঃখ ছিল তার বড় ছেলেটিকে নিয়ে, জন্ম থেকেই তার দু’টি পা এতোই দুর্বল যে সে চলাফেরা করত বসে বসে। কিন্তু তার সেই ছেলে যে কতটা বুদ্ধিমান আর বিবেচক মায়ের কাছে আমাদের বাড়ি এলে সেইসব কথা জানাতো সে বেশ ঘটা করে। তার সমস্ত বৈষয়িক কাজেকর্মে সে পরামর্শ করত ওই ছেলের সঙ্গেই। এমনিতে ভদ্রলোক কতটা বৈষয়িক ও বাস্তবিক ছিল তার প্রমাণ তার এক স্মরণীয় উক্তি যা মা নানা প্রসঙ্গে হামেশাই উত্থাপন করত। তার সেই উক্তিটি ছিল, ‘মাটি হইল খাঁটি, সোনা হইল আধা, অতিরিক্ত কাপড় যে কেনে সে হইল গাধা।’ ব্যাখ্যার কি দরকার আছে ? তবুও বলাই যাক। সংসারে জমিজমার মূল্য সর্বাধিক, সোনাদানা জমানো তার চেয়ে কম বোকামি হলেও একেবারে ফেলনা নয়, তবে যে নিম্নতম প্রয়োজনের বেশি জামাকাপড় কেনে সে একেবারেই বোকা।
তখন সে সপ্তাহে এক-দু’বার নানা সূত্রে আমাদের বাড়ি আসত। তারপর হঠাৎ অনেকদিন তার আর কোন দেখাসাক্ষাৎ নেই। লোকের মুখে মা শুনতে পেল, গোস্বামীবাবুর পুরো পরিবার নাকি কী এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত এবং প্রায় মরণাপন্ন। এর চেয়ে বিশদে আর কোন খবর পাওয়া গেল না। মা দুঃখ করত, এমন নির্বিরোধী মানুষটির এমন বিপদ ঘটল বলে। দেখতে দেখতে কেটে গেল কয়েকমাস। একদিন আবার ভদ্রলোক এক সন্ধেতে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। তার চেহারা অনেক ভেঙে গেছে। বোঝাই যাচ্ছিল যে কিছু একটা সংকট কাটিয়ে উঠেছে সে। মা তাকে বসাল বেশ যত্ন করে, তারপর অনিবার্য প্রশ্ন, কী হয়েছিল। উত্তরে গোস্বামীবাবু যে গল্প শুনিয়েছিল তা সেই সন্ধেবেলার সেরা বিনোদন, আর সেই গল্প আজও মনে ভাসে। সে জানালো যে তার গোটা পরিবারকে নাকি তার কোন এক শত্রু ভাবাপন্ন ব্যক্তি বাণ মেরেছিল কোন তান্ত্রিকের সাহায্যে। পরিবারের সমস্ত সদস্যরা তার প্রভাবে আক্রান্ত হয়ে মরতে বসেছিল। তাদের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কারণ খাবার দেখলেই বমি করে ফেলত সবাই, খাওয়া তো দূরের কথা। ডাক্তার-বদ্যি দেখিয়ে কোন লাভই হয়নি, কোন ডাক্তার ধরতেই পারল না অসুখটা কী। ধরতে পারার কথাও নয়, চিকিৎসাবিজ্ঞান তো তন্ত্রমন্ত্র, জাদুটোনা বিশ্বাসী করে না। মোটকথা হল এই যে, মাসখানেক এইভাবে কাটানোর পর পরিবারের সমস্ত সদস্যরা বিছানা নিল এবং বুঝে গেল যে সবারই মৃত্যু আসন্ন।
বাণ মারার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতেই হয়। বাণ মানে মৃত্যুবাণ, মারণ-উচাটন-বশীকরণ করে যেসব তান্ত্রিক তাদেরই কাজ এটি। এটা আসলে ব্ল্যাক ম্যাজিকের আওতাভুক্ত। আমার সেই ছেলেবেলার দিনগুলিতে যেসব মানুষজনরা ছিল তারা সবাই এমন আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক বিষয়সমূহকে দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য ঘটনা বলেই ভাবতে অভ্যস্ত ছিল। রাতে চলাফেরা করতে গিয়ে নানা স্থানে নানা পরিবেশে ভূত-প্রেতের দর্শন কে না পেয়েছিল ? তারা জাঁকিয়ে সেইসব গল্প শোনাত যা ছিল সেসময়ের সেরা বিনোদনের অঙ্গ। টিভি বা সিনেমা কিছুই তো আর ছিল না।
মা জিজ্ঞেস করল, ওই মহা সংকট থেকে কিভাবে উদ্ধার ঘটল। গোস্বামীবাবু তখন জানালো তাদের রক্ষা পাওয়ার কাহিনী। আমাদের অঞ্চলের থেকে দশ-বারো কিলোমিটার দূরে ছিল মেলাঘর বলে এক মহকুমা। সেখানে থাকত এক গৃহী কিন্তু সাধক ব্যক্তি যার পরিচিতি ছিল রাইহরণ কবিরাজ নামে। তার উপাস্য মহাপুরুষ সাধকের নাম ল্যাংটাবাবা, যিনি নাকি শিবেরই এক অবতার। কোন এক শুভার্থীর পরামর্শক্রমে গোস্বামীবাবুরা সেই কবিরাজমশাইয়ের শরণাপন্ন হল। সে রাজি হল তাদের সংকট থেকে বাঁচাতে। কবিরাজ এক সকালে তাদের বাড়িতে এসে সমস্ত কিছু দেখাশোনা করে জানালো যে কেউ তাদের বাণ মেরেছে কোন তান্ত্রিককে ধরে যাতে তাদের সবারই মৃত্যু অনিবার্য। বাড়তে ঢোকার মুখে ছিল এক নারকেলগাছ, সেটি ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছিল। কবিরাজ বলল যে ওই গাছ এভাবে শুকিয়ে যেতে যেতে যেদিন পুরোপুরি মোর যাবে সেদিন মৃত্যু হবে পরিবারের সমস্ত সদস্যের। এবার প্রথমেই ওই নারকেল গাছটিকে বাঁচাতে হবে। তার জন্য অনেক তন্ত্রমন্ত্রের ব্যবস্থা দরকার, আর দরকার বিশেষ কিছু পূজার্চনার। নিয়মিত কবিরাজ মশাই তাদের বাড়িতে এসে সেসব আচার-অনুষ্ঠান নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করল। সপ্তাহ দুয়েক এমন সব আচার-অনুষ্ঠান পালন করার পর একদিন দেখা গেল সেই নারকেল গাছে আবার প্রাণসঞ্চার ঘটেছে, তাতে দেখা দিয়েছে নতুন কুঁড়ি। কবিরাজ মশাই জানালো যে বিপদ কেটে গেছে। আর তারপর সত্যিসত্যিই পরিবারের সমস্ত সদস্যরা আবার খাওয়ার আগ্রহ ফিরে পেল এবং কয়েকদিনের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে উঠল। এই রাইহরণ কবিরাজ মশাইয়ের শরণাপন্ন পরে আমাদেরও হতে হয়েছিল এবং সে সত্যিই এক সংকট থেকে উদ্ধার করেছিল। সে অন্য কাহিনী।
এই যে ঘটনার বিবরণ দিলাম তার কী বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আমার জানা নেই। অন্ধবিশ্বাস হতেই পারে, কাকতালীয়তা থাকাটাও বিচিত্র নয়। সেসব বিশ্লেষণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি কেবল দেখতে চেয়েছি আমার জীবনের প্রাথমিক অধ্যায় জুড়ে ছিল এমনই এক রূপকথার জগৎ, তাতে বিজ্ঞান না থাকুক উত্তেজনা আর উন্মাদনা ছিল। তারপর জীবনের অনেক দশক পেরিয়ে এখন অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি আশ্রিত এক অকল্পনীয় পৃথিবীর বাসিন্দা আমি। কিন্তু আমার জীবনে সেই উত্তেজনা সেই উন্মাদনা কোথায় ? আমার জীবন দেখি বিমর্ষ-বিবর্ণ। জীবন থেকে মা হারিয়ে গেছে, বিলুপ্ত হয়েছে কল্পকথার দিনগুলির সমস্ত বাসিন্দারা। বড় একা লাগে তাই। নিজেকে মনে হয় স্বজনহীন, নির্বাসিত।