বনমালী মাল
।।এক।।
বিকালের শেষ আলোয় বাবা আমাদের প্রতিদিন পড়াতে বসতেন। খাড়া হয়ে থাকা বড় বড়
অর্জুন গাছের সারির তলায় দিদি দাদা আর আমি একটানা দোল খেতে খেতে হঠাৎ মুখ তুলে দেখতাম,
আমাদের বাবা একটা অর্জুন গাছে ঠেস দিয়ে বেমালুম মিশে গেছেন। লম্বা মেদহীন চেহারার খালি গা,
আমাদের বাবার মুখে চোখে এক অদ্ভুত ক্লান্তি। তখনকার দিনে তিন তিনটি ছেলেমেয়েকে পড়ানো আর
সংসার টানতে টানতে বাবার হাত আর পায়ের পেশী জমে টানটান হয়ে গিয়েছিল। আমাদের বিরহান
গ্রাম আর আশেপাশের চার পাঁচটা গ্রামের সবাই অবাক বনে যায়, কীভাবে বাবা আমাদের এই সংসারটা
টানতেন!
মুখ ভর্তি কাঁচা পাকা দাড়ি আর মাথার চুলে অযত্নের ছাপ নিয়ে আমাদের বাবা ডুবে যাওয়া সূর্যের
আলো মাখানো পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। সারাদিন কাজ করতেন বলে বাবার মুখ
আমরা ভালো করে দেখতে পারতাম না। শুধু এই সময়েই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে দেখতাম, বাবার সোনালী
আভার মুখ যেন সংসারের সবকিছু জানে। হেন কিছু নেই, যা আমাদের বাবা দেখেননি।
এই ভেবেই হয়তো, দাদা মানচিত্র থেকে মুখ তুলে মায়া মায়া চোখে বাবার কাছে জানতে চাইল,
“বাবা, মানচিত্রে মানুষ আঁকা নেই কেন?”
দাদার কথা শেষ না হতেই দিদি কেমন উসখুস করতে করতে কুঁকড়ে গেল। দাদা তখনও তার
উৎসুক চোখ নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। বাবা, আমাদের বাবা সোনালী আলো থেকে মুখ নামিয়ে
অনেকক্ষণ অন্ধকার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলেন।
।।দুই।।
আমি বালিশ থেকে আমার ভারী হয়ে যাওয়া মাথাটা একটু ছাড়িয়ে দেখে নিলাম। বাইরের চড়া
আলো ঘরে এসে মিইয়ে থিতিয়ে গেছে। তাপে কপাল পুড়ে যাওয়ার সময় চোখ আর মন আলো নিতে
চায় না। বাম হাত বাড়িয়ে বালতির জলে কাপড়টা চুবিয়ে কপালে নিলাম। বাবা বেঁচে থাকতে পই পই
করে বলেছিলেন,
“তোমাদের মা তো অনেকদিন আগেই আমাদের ছেড়ে গেছেন। আমিও একদিন ছেড়ে যাবো।
নিজের কপালে নিজেই একটা কিছু অন্তত জুটিয়ে নিও।”
বাবা ঠিক এমনটাই বলেছিলেন হয়তো। এমন ভেবেই! দিদি আর দাদাও ছিল বাবার কথাগুলোর সামনে।
উষ্ণ শরীরে স্মৃতি ভালো কাজ করে না বলে ঘরের মধ্যে দাদাকে ডাকলাম। আর গরগরিয়ে বৃষ্টি
ঝেঁপে এল। বৃষ্টি ভেজা ঝাপসা চোখে “দাদা দাদা” ডাকতে ডাকতে দেখলাম দাদা অমনি একটা খেঁজুরের
গাছে শিউলি হয়ে ঝুলে পড়ল। বুঝলাম দাদা এখন রস না পেলে নীচে নামবে না আর দাদা নীচে নামলে
আমি আবার নতুন পুকুরের ঈশান কোণের তালগাছটাতে চড়ে বসবো। দিদি তো কবেই বিয়ে হয়ে
বিরহান গ্রাম ছেড়েছে। বাবা গত হওয়ার পর থেকে দিদি আর এখানে আসেনি। সবাই কীভাবে যেন ছিন্ন
ভিন্ন হয়ে গেলাম। অথচ সবাই নিজের নিজের মতন করে সুখে আছি। দুখী থাকলেও যে একে অপরকে
মনে করতাম বা কাছে ডাকতাম, তেমনটা কখনো মাথায় আসেনি। এখন তো আমার কয়েকদিন ধরেই
জ্বর!
জানি, দাদা দিদি কেউ এখন আমার কথা ভাবছে না। এমনকি আমিও তাদের কারোর কথা
ভাবতাম না যদি না আমি কয়েকদিন থেকে জ্বরে পড়ে থাকতাম। অসুস্থ মন দুর্বল শরীর আমাকে যেন
এই এক টুকরো ঘরে আরো একা করে দিচ্ছে।
আরো কাল হয়েছে উত্তর দিকের দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা সেই মানচিত্রটা। যেটা সকাল বিকেল দেখে
দেখে আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, এই মানচিত্রেরও একটা ইতিহাস আছে। আসলে আমি একা ছিলাম
সুখী ছিলাম বলেই হয়তো…
মানুষ যেমনভাবে চোখের সামনে সবসময় ঘুরতে থাকা মানুষগুলোকে গুরুত্বহীন করে দেয়। আজ
সকাল থেকেই আমি গায়ে এতটুকু বাতাস পাইনি, অথচ কেমন মৃদু বাতাস পেয়ে মানচিত্রটা দোল খেয়েই
যাচ্ছে!
।।তিন।।
আমাদের বাবা এতক্ষণ অর্জুন গাছে ঠেস দিয়ে জাদু দেখাচ্ছিলেন আর স্থির বিশ্বস্ত মুদ্রায় হয়তো
তিনি জীবনের ফেলে আসা উপকরণগুলো নিয়ে লোফালুফি করছিলেন। একটার পর একটা অপ্রত্যাশিত
বস্তু আমাদের সামনে এনে চমকে দিচ্ছিলেন। লখার ঘরের মেজো কালীর মাঠ থেকে টানটান বাঁট নিয়ে
ফিরে আসা আর বাবার হাতের ঝোলানো মুদ্রায় খালি একটা বালতি। ফিনকি ঝরা সাদা দুধে বাবার মুখ
উজ্জ্বল হয়ে উঠছে আর বাবা মাঝে মাঝে আমাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছেন। এমন সময়ে দাদার প্রশ্ন
বাবাকে সত্যিই অপ্রস্তুত করে দিয়েছিল।
আমার বেশ মনে পড়ছে, দিদির চাপা ভয় উপেক্ষা করে বাবা দাদার দিকে না তাকিয়েই তার
প্রশ্নের উত্তরে বলতে থাকলেন —
“পাশের গ্রামের লোক সুধীর দত্ত। সম্পর্কে তোমাদের দাদু হয়। তাঁর কাছ থেকেই শোনা, তিন
চার পুরুষ আগে তাঁদের সম্বল ছিল একটি মাত্র সাতাশ কাঠা জমি। বহুকাল আগে তাঁদের এক পুরুষ
মৃত্যুশয্যায় শুয়ে বললেন,
‘মোকে ওই জমিনের এক কোণে রাখবি বাবা।’
রাখা হল। স্মৃতি মন্দির গড়ে উঠল। তারপর থেকে ওই পরিবারের সবার শেষ ইচ্ছে, যত জন মারা
গেছে, সবাই শুয়ে আছে ওই সাতাশ কাঠা জমির মাটিতে ঠাসাঠাসি করে।
এখনও গেলে তোমরা দেখতে পাবে সেই স্মৃতি মন্দিরের জমি। যে জমি ফসল ফলাতে ভুলে গেছে।
এখন সুধীর কাকা দুঃখ করেন সব মাটি ঢাকা পড়ে গেছে বলে।”
দাদার দিকে স্থির তাকিয়ে বাবা বললেন,
“মানচিত্রে এত জায়গা কোথায় মানুষ রাখার!”
কোথায় একদিন ভিড়ের মাঝে দেখেছিলাম, হঠাৎ দর্শক আসন থেকে কেউ যেন জাদুকরের সব
জারিজুরি ধরে ফেলল, আর জাদুকর টুপ করে একটা পর্দার আড়ালে লুকিয়ে একটু হাপু টেনে ফের
বেরিয়ে এলেন। হাসি মুখে দর্শকদের মাঝখান থেকে যুবকটিকে ডেকে দাঁড় করিয়ে শুনিয়ে দিলেন তাঁর
একটি মজার অতীত অভিজ্ঞতা।
“ইয়ে উম্র অকসর আয়সা হি গলতি করতা হ্যা। আঁখে ধোখা খা যাতা হ্যা বেটা। খোয়াব অর
দুনিয়াদারি মে কোয়ি ফর্ক নাহি কর পাতা। তুমার মতন এক ল্যাড়কা ছিল, একদিন উ ভি সোকোলের
সামনে আমাকে ঝুঁটা দেখিয়েছিল। লেকিন উসকো ইখানে ইস মঞ্চ মে লাকর পর্দে কে পিছে এক চিজ
দিখাই অর বো মান গ্যায়ে।”
মঞ্চের রঙিন আলোয় জাদুকরের চোখের সত্যি মিথ্যা ধরা পড়ল না। কেবল তার ভঙ্গিটুকু আমাদের
শান্ত স্থির আর নরম করে রাখল।
বেশ মনে পড়ছে, দাদা বাবার দিক থেকে চোখ নামিয়ে এই মানচিত্রটার দিকে স্থির তাকিয়েছিল।
তারপর উজ্জ্বল মুখে বাবাকে সায় দিতে দিতে মেনে নিয়েছিল। আমিও প্রশ্ন না বোঝা, উত্তর না বোঝা
বয়সে বুঝতে পারছিলাম, বাবা সফল হলেন। এমন কিছুই নেই, যা আমাদের বাবা জানেন না।
কেবল দিদিকে দেখলাম, বাবার দিকে না তাকিয়ে ছল ছল চোখে অন্যমনস্ক হয়ে আছে। দিদি কি
বাবার কথাগুলো মেনে নিতে পারেনি! তাহলে কি দিদি সঠিক জানত! দিদি উত্তর দিতে পারত দাদার
প্রশ্নটার! হয়তো পারত, তখন শুধু এটুকু বুঝতাম, দিদি আমাদের দুই ভাইয়ের থেকে বড়। বাবা
কখনোই দিদিকে দক্ষিণ পাড়া আর দাস পাড়ায় যেতে দিতেন না। দিদিও বাবার এই বারণ খুব সহজে
স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিত। দিদি হয়তো বুঝতে পারত, বাবা কী বলতে চান। তাহলে দিদির কাছেও
নিশ্চিত উত্তর ছিল।
বিরহান গ্রামের সব বাবারা জানতেন, আমাদের বাবা কখনো মিথ্যা কথা বলতেন না। স্বল্পবাক
মানুষটি মা বেঁচে থাকতে থাকতেই কেমন চিন্তা আর ভাবনায় গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন। হাতে একটা ময়ূর
পালক থাকলে বাবাকে যারা দিব্য মূর্তি জাতীয় কিছু ভাবতে পারত, তারা কেউ কোনোদিন বাবার হাতে
একটা ময়ূর পালক দেখতে পায়নি। পাবে কী করে! বিরহান গ্রামে কস্মিনকালেও কোনো ময়ূরই ছিল না।
শোনা যায়, উজ্জয়িনী নরেশ যেসময় মহামায়ার মন্দিরে এসে তাল বেতাল পেলেন, সেই থেকেই রাজ
আক্রমণ আর রাজার খামখেয়ালি আদেশের ভয়ে এই অঞ্চলের সব ময়ূর রাতারাতি উড়ে গিয়েছিল। উড়ে
পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা নাকি যেখানে যা পালক আর রেণু পড়েছিল, তাও সঙ্গে করে নিয়ে যায়।
তবে আমি নিজেও দেখেছি, বাবার কান ঝাঁপানো চুলের নীচে সবসময় তোলা থাকত একটা
হাঁসের পালক। সেই হাঁসের পালকটা কান থেকে নামিয়ে আমাদের বাবা দিদিকে বললেন,
“তুমি পড়ো।”
অমনি আমাদের চোখের সামনে দিদি আরো বয়সী আরো গম্ভীর হয়ে দোল খেতে লাগল।
।।চার।।
সেইদিন থেকে দাদা আর আমি দিদিকে সমীহ করতাম। দিদি এমন কিছু জানে, যা দিয়ে সে
বাবার উত্তরের ভার কমিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তারপর থেকে কখনো তেমন ভাবে দিদিকে কাছেই পেলাম
না, যে কিছু জানতে চাইবো। দিদি এই বাড়িতে আসে না। দাদা মাঝে সাঁঝে এই বাড়ির পেছন দিকের
রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হাঁক দিয়ে যায়। যেদিন রসের ধারা তার মুখে চোখে দাগ রেখে যায়,
সেদিন তার সুরে আনন্দ থাকে। বলে,
“আমাদের একটা গাছ হলেই চলে যেত। একই দুয়ার হলেও অসুবিধা ছিলনি…”
দাদার সঙ্গেও সেই প্রথম শেষবারের মতন সুধীর দাদুদের স্মৃতি মন্দিরে ঢাকা জমিটা দেখতে
গিয়েছিলাম। দাদা অবাক বনে গিয়েছিল। আমিও। এমন করে কেউ মাটি ঢাকা দিয়ে দেয়! ফিরে আসতে
আসতে বাবার কথা মনে হয়েছে। আমাদের বাবা, আমাদের সোনালী আলো মাখা বাবার কথা। যিনি
আমাদের কত কী শিখিয়েছেন! কত কত সত্যির সামনে দাঁড় করিয়েছেন!
কিন্তু এত কিছুর মাঝেও আমাদের বাবাকে আমি বুঝতে পারতাম না। দিদি বুঝেছিল। হয়তো দাদাও
বুঝেছিল বয়সে বয়সে। বাবা হয়তো চাইতেন না আমার বয়সে সেইসব সত্যি কথা শোনাতে। দিদিও
তাইই হয়তো সবকিছু আড়াল করে রেখেছিল। যেসব সত্যি শুনলে মানুষ নিজেদের সন্দেহ করে, যেসব
কল্পনা মানুষকে সুখী করে…
।।পাঁচ।।
কত বছর আগের কথা! তখন আমাদের বাবা বেঁচেছিলেন, মা সেই ছোটো সংসারে ধোয়া মাজা
আর ফরমায়েশ খাটতে খাটতে দিন কাটাতেন। একদিন দুপুরের খাওয়া শেষ করে শুয়ে ছিলাম, মা ভেবে
নিলেন, আমি ঘুমিয়ে গিয়েছি, দিদিকে বললেন,
“আমাদের একসময় বড় হাঁড়ির সংসার ছিল। একদিন ভর দুপুরে তোমার বাবা দাদু ঠাকুমা
কাকারা একসাথে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলল। পাড়ার কত লোক এসে জড়ো হল। তোমাদের বাবা
সবার সামনে দিয়ে ভাতের হাঁড়িটা নিয়ে ছুঁড়ে দিলেন পুকুরের মাঝখানে। আর শান্ত পায়ে সবাইকে অবাক
করে ঘরে ফিরে এসে তিনি তাঁর কান থেকে পালকটা আমার আলগা খোঁপায় গুঁজে দিলেন। সেই থেকে
আমরা ভিন হয়ে গেলাম।”
যেসব কথা তখন বুঝতাম না, যেসব কল্পনা তখন সেই বয়সে সত্যি থেকে আলাদা করতে
পারতাম না, এখন বুঝি। দিদি দাদা কেমন সুখে আছে! আমিও। আমাদের বাবা কেন মানচিত্রে মানুষ
নেই বলতে গিয়ে এমন গল্প ফেঁদেছিলেন, এখন বুঝি। অথচ আজ সকাল থেকেই জ্বরের ঘোরে আমার
চোখ টানছে। ঘোলাটে আর ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে চারপাশ। বারবার শুকনো হয়ে যাওয়া জলপট্টি যেন
আমার শরীরের ভেতর থেকে সব রস টেনে শুষে নিচ্ছে। দাদাকে ডাকলেও আসছে না। দিদি ধারে কাছে
কোথাও নেই! একা এই নিঃসঙ্গতা এতদিন যা আমাদের আমাদের কাছে সুখের ছিল, এখন কুরে কুরে
খাচ্ছে আমাকে। মাথার ভেতর থেকে কেউ যেন ওই মানচিত্রটা দেখিয়ে বলছে,
“একবার মানুষকে কাছাকাছি বসিয়ে দেখ্ না!”
আমাদের বাবা নয়তো! হয়তো আমাদের জাদুকর বাবা আমার অবিশ্বাস নিয়ে আমার কাছে বাজি
রাখছে! আমার না বোঝা মনকে পরখ করে দেখতে বলছে! কিংবা বাবা হয়তো বলতে চাইছেন,
মানচিত্রে মানুষ আঁকলেই আমার এমন অসময়ে তারা এসে আমাকে দেখে যাবে। দিদি আমার বাম পাশে
বসে কপালে জল-ন্যাকড়া দেবে। দাদা এসে তার ভাঁড়ভর্তি রস আমাকে দিয়ে বলবে,
“এটা এখন তুমি খাও। আমি পরে পেড়ে নেবো।”
ব’লে সে আমার ঠিক চোখের সামনে মানচিত্রটাকে আড়াল করে বসবে। পাড়া থেকে বাবাই দাদা আসবে।
দুলাল কাকা আসবে। আরো কত মহিলার হাত আর শাড়ির যত্নের সুবাস। তারা আমার দুর্বল ঝাপসা
চোখের সামনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বলতে থাকবে,
“আরে, আমরা তো আছি…”
।।ছয়।।
মানচিত্র আর আমাদের বাবা আমাকে কতক্ষণ থেকে ওলট পালট করছেন। সেই ঘোর আমাকে
ডুবিয়ে রেখেছে এখনও। দাদার প্রশ্ন, বাবার নিজেকে লুকিয়ে রাখার মুদ্রা থেকে ধীর স্থির গলায় স্মৃতি
মন্দিরে ঢাকা জমির কথা বলা, আমি অপলক তাকিয়ে আছি মানচিত্রের দিকে। যেন বাবা ওই মানচিত্রের
নীলের ভেতর থেকে আমাকে টেনে নিচ্ছেন আর বারবার আমাকে সাবালক করে তোলার জন্য আঁকতে
বলছেন মানুষ! এখন আমার জ্বর কেটে গেছে, যা আছে তা কেবল এই শরীরটুকুই। কোনো
অনুভূতিহীন। ভাবতে পারার সমস্ত শক্তি ভগবান আমার কাছ থেকে কেড়ে নিক। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে
নির্ভাব দেখছি। কেউ আমাকে পরিচালনা করছে যেন! আমাকে বাধা দেওয়ার মতন কেউ ছিল না।
হাতের তালু উল্টে কপালে রাখলাম। বাবার আহ্বান স্বীকার করার জন্য নিজেকে বেশ স্বাভাবিক আর
সতেজ মনে হল।
একটা স্কেচ হাতে নিয়ে পাগলের মতন মানচিত্রের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। এতদিন পর্যন্ত যে অল্প
কয়েকজন মানুষ দেখেছি, তাদের আদল একটু পাল্টে নিয়ে অজস্র মানুষ ছোটো ছোটো করে এঁকে দিচ্ছি
মানচিত্রের সব জায়গায়! নদী সমুদ্র পাহাড় পর্বত বিভাজিকা কিছুই বাদ পড়ছে না! এমনকি যেখানে
মানুষ কোনোদিন পৌঁছাতে পারবে না, সেখানেও!
যখন মানুষের ভিড়ে মানচিত্র ভরে উঠল, বিকেল তখন বহুকাল আগে দেখা বাবার সোনালী
মুখের মতন। প্রতি সন্ধ্যা আসার আগে পুকুর থেকে হাত পা ধুয়ে আসতে বলতেন আমাদের বাবা। ধুয়ে
এসে চোখ মুখ মুছতে মুছতে মানচিত্রটার দিকে তাকাতেই দেখি, গোটা মানচিত্রে রক্ত লেগে আছে!
যে মানুষগুলো এঁকে দিয়েছিলাম, তাদের কারো পা নেই, হাত নেই এমনকি কারো কারো আস্ত শরীরটাই
নেই! একটাই লাল রঙের স্রোত তাদের অস্তিত্ব মুছে দিয়েছে!
মনে হল, আমার শরীরের ভেতরে অজস্র পোকা বাসা বেঁধেছে! একবার বমি করে দিতে পারলেই
সব শান্তি। কিন্তু বমি করার জন্য যে একটাই ঘৃণাকে কিছু সময় ধরে লালন করতে হয়! তখন তো
আমার সমস্ত অনুভূতির পথ আগলে আছেন আমাদের জাদুকর বাবা! তাঁর স্থির প্রত্যয়ী দৃঢ় গলার স্বর!
সেই অর্জুন গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের বাবা, অর্জুন গাছের মতন একা অথচ শক্ত সোজা,
যিনি হয়তো দিদি আর দাদাকে আগেই সব বুঝিয়ে দিয়েছেন। এখন আমাকে আরো একবার স্পষ্ট
বোঝানোর জন্য বলছেন,
“ছোটো বাবা, মানুষকে এত ঠাসাঠাসি করে রাখতে নেই। রাখলে, মানচিত্র রক্তে ভিজে যায়।”