তুষার বরণ হালদার
লেখক পরিচিতি
(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)
উনিশ শতকের সূচনালগ্নে বঙ্গীয় জাগরণের এক প্রাজ্ঞ, শিক্ষিত, বিনয়ী এবং শিষ্টপ্রকৃতির বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন শিবচন্দ্র দেব। দুর্ভাগ্যবশত উনিশ শতকের আলোচনায় শিবচন্দ্রের নাম একরকম অপাংক্তেয় রয়ে গেছে। তার জন্ম ২০ জুলাই, ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে, হুগলি জেলার কোন্নগরে। অর্থাৎ তার আবির্ভাবের দ্বীশতবর্ষ অতিক্রান্ত। অতএব এই অবসরে উনিশ শতকের ভারতবিদ্যা চর্চায় শিবচন্দ্রের অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে। শিবচন্দ্র ছিলেন পিতা-মাতার কনিষ্ঠ সন্তান। গ্রামের পাঠশালাতেই তার শিক্ষারম্ভ। তিনি ছিলেন মেধাবী ছাত্র। ১৪ বছর বয়সেই তাঁর বাবা তাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে হিন্দু কলেজে ভর্তি করেছিলেন। এখানেই রচিত হয় তাঁর প্রতিশ্রুতিপূর্ণ ভবিষ্যত জীবনের প্রথম অধ্যায়। এখানেই একদিকে যেমন তিনি গণিত শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তির প্রমাণ দেন, তেমনি ডিরোজিওর শিক্ষাদীক্ষা ও চিন্তাধারায় তিনি উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। হিন্দু কলেজে তিনি সাড়ে পাঁচ বছর অধ্যয়ন করেন এবং প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। এইসময় তিনি কেশব চন্দ্র সেনের পিতৃব্য হরিমোহন সেনের সঙ্গে প্রগাঢ় বন্ধুত্ত্ব সূত্রে আবদ্ধ হন। এরপর দুই বন্ধু মিলে আরব্য উপন্যাস বাংলাতে অনুবাদ করেন। তিনি প্রাথমিক পর্বে সরকারী চাকুরীতে বেশ কিছু কাল অতিবাহিত করেন।১৮৬৩ সালে তিনি স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ করেন। এই প্রসঙ্গে শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘ রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ” অপরাপর লোকের পক্ষে বিষয়কর্ম হইতে অবসৃত হওয়ার অর্থ সম্পূর্নরূপে বিশ্রামসুখ ভোগ করা। কিন্তু শিবচন্দ্র দেব মহাশয়ের পক্ষে তদ্বীপরিত ঘটিল। পেনশন লইয়া কোন্নগরে বাস করিয়াই তিনি স্বীয় বাসগ্রামের সর্ববিধ উন্নতিসাধনে মনোনিবেশ করিলেন।” কর্মজীবনেও তিনি সমাজ উন্নয়ন এবং স্বদেশ হিতৈষনার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই মেদিনীপুরে একটি ব্রাহ্ম সমাজ স্থাপিত হয়েছিল।১৮৫২ সালে নিজ গ্রামের লোকজনদের একত্রিত করে ‘কোন্নগর হিতৈষনী সভা ‘ স্থাপন করেন। এর দুই বছর পরে তিনি সেখানে একটি ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এর পাশাপাশি তিনি একটি বাংলা মাধ্যম স্কুলের পুন:প্রবর্তন করেন।সেই সঙ্গে তিনি একটি সর্বসাধরনের জন্য একটি পুস্তকালয় প্রতিষ্ঠা করেন। হিন্দু কলেজে অধ্যয়নের সময় থেকেই শিবচন্দ্র স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের জন্য আন্তরিক ভাবে আগ্রহী ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে স্ত্রীজাতির উন্নতি ব্যতিরেকে সমাজের সার্বিক বিকাশ কখনোই সম্ভব নয়। এই ভাবনা থেকেই তিনি নিজের বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৮৬০ সালে এক বালিকা বিদ্যালয়। এই বালিকা বিদ্যালয়টিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি শিবচন্দ্র তাঁর সমাজ কল্যাণকর কাজের স্বাক্ষর রেখেছেন কন্নোগরে হোমিওপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা, রেল স্টেশন স্থাপন এবং ডাকঘর নির্মাণের মধ্যে দিয়ে। জনহিতকর কর্মে নিয়োজিত থেকেও তিনি নিয়মিতভাবে সাহিত্যচর্চা করে গিয়েছেন। শিবচন্দ্র তাঁর সাহিত্যকর্ম কে নিয়োজিত রেখেছিলেন সমাজের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণসাধনায়। তাঁর সাহিত্যকীর্তি খুব বেশি না হলেও স্ব -দেশ, স্ব-কাল ও সমকালীন সমাজের কল্যাণব্রতে তাঁর কলম ছিল নিরলস। এর মধ্যে শিশু পালন এবং অধ্যাত্মবিজ্ঞান বই দুটি খুব সমাদর লাভ করেছিলো। প্রথম বইটি শিশু বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়কে চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন। শিশুরাই কিভাবে জাতির ভবিষ্যত কারিগর হয়ে উঠতে পারে সে সাধনার কথা তিনি ব্যক্ত করেছেন। দ্বিতীয় বইটি অবশ্য কিঞ্চিত উচ্চমার্গিও। কি ভাবে আধ্যাত্মিক উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে মন – প্রাণ – আত্মার সামগ্রিক উন্নয়ন এবং উত্তরণ সম্ভব হয় সে বিষয়ের আলোচনা সেখানে অভিব্যক্ত হয়েছে। বই দুটির গুরুত্ব শুধু সেই সময়ের নিরিখেই নয়, আজও তার প্রাসঙ্গিকতা সমানভাবে বিদ্যমান। এর পাশাপাশি তিনি ব্রাহ্মদের প্রচারিত পত্রিকাগুলোতেও কলম ধরেছিলেন, যদিও তা খুব বেশি ছিল না। অর্থাৎ নবজাগরণের সেই ঊষালগ্নে শিবচন্দ্র কলকাতা থেকে দূরে মফস্বলে সামাজিক কাজকর্ম এবং লেখনী ধারণের মধ্যে দিয়ে বঙ্গদ্যুতির বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছিলেন এবং এই কর্মদ্যোগের দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছিল ভারতবিদ্যাচর্চা। পরিশেষে বলা যায় যে শিবচন্দ্রের সর্বপ্রধান গৌরব হলো তাঁর নীতিনিষ্ঠা এবং সমগ্র জীবন অবিচল চিত্তে কর্তব্য সম্পাদনের মধ্যে দিয়ে মনুষ্য ধর্ম পালন। ভারতবিদ্যার মূল ভাব তো এটিই। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এমন অসাধারণ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও শিবচন্দ্র ইতিহাসে তেমনভাবে জায়গা করে নিতে পারেননি। তার একটা কারণ হতে পারে, নিজের সংগতির জোরে তিনি কলকাতার বাসিন্দা হয়ে সেখানকার বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারতেন, অনেক সময় নেতৃত্বও দিতে পারতেন। যদি তিনি তা করতেন তাহলে আপনা থেকেই তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় উঠে আসত। তা না করে তিনি নিজেকে প্রচারের আলোয় রেখে দিয়ে স্বগ্রামের উন্নতিতে নিজের সমগ্র জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। আর তা করার মধ্যে দিয়ে তিনি মানবসেবা ও মনুষ্যধর্ম পালনের এক অসামান্য নজির রেখে গিয়েছেন। তাই মানুষের ইতিহাসে তিনি জায়গা করে নিয়েছেন।