অনিন্দ্যসুন্দর পাল

অলঙ্করণ : প্রীতন্বিতা

তাকিয়ে থাকে অনিমেষ কাঁচের টুকরো গুলোর দিকে। একেবারে টুকরো টুকরো ছিন্ন ভিন্ন। ছড়িয়ে রয়েছে যেন আলোময় মৃদু একবারেই স্থির মৌনের মত। শুনতে পায় কানের পাশ বেয়ে চলে যাচ্ছে ট্রেন, বাস, প্লেন সাঁই সাঁই করে।  কেউ বুঝি হেঁটে যাচ্ছে, মিলিয়ে যাচ্ছে , আবার কেউ আলতো করে ডাকছে, চেচাচ্ছে, কেউ কেউ কাঁদছে। হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করে নিজেকে, বুঝতে চায় সত্যি কি কেউ চলে যায়? যাঁরা যেতে চায়, তারা নয় যাক, যাঁরা থাকতে চায়, তাঁরা? চোখ কচলে নেয়, খানিকটা অন্ধকার কাটিয়ে ওঠে নীলাভ ওষ্ঠ, চামড়ার চিবুক, যে চিবুক ধরে অনেকেই বলেছে – ” তোকে সাদা পাঞ্জাবিতে ভারী মিষ্টি লাগে ! ” সেই চিবুক আজ নেই, চামড়াটা এক রয়ে গেছে। সেই আঙুল নেই, মানুষগুলোও নেই, শুধু রয়ে গেছে স্মৃতি। নিভু নিভু হয় চোখের দুই কোণ, কিন্তু যাঁরা যেতে চায় তাঁরা সবাই কোথায় থাকে?  চোখে  নাকি মনের ভিতর? উত্তর খোঁজে অনিমেষ, ততক্ষণে চলে যায় আরোও একটা সম্পর্ক। মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করে, প্রশ্ন করে – একটা সম্পর্ক কি দুটো শরীরের? নাকি দুটো চোখের? অনিমেষ বিশ্বাস করে চোখ ছাড়া সম্পর্ক হয় না। যাঁরা সম্পর্ক রাখতে চায় তাদের একটা দেখতে চাওয়ার ইচ্ছে থাকে। কিন্তু যাঁদের এগুলো নেই, তাঁদের? তাঁদেরও  থাকে; কেবল কোনো সম্পর্ক থাকে না। আসলে যে সম্পর্ক যত বেশি ব্রাত্য, সে সম্পর্ক তত বেশি গভীর। 

অন্ধকার কাটে হয়ত, হয়তবা সারি সারি তারাদের দল দখল করে রাখে দূরের সীমানা। অনিমেষ এগিয়ে চলে, কখনও দ্রুত কখনও আস্তে। মাঝে মাঝে কিছু জিনিস সে দেখতে পায় আবছা,  কিছু জিনিস পরিষ্কার। আলো সরে গেলে চোখে যেমন রাত্রি নামে, সে রাত্রিও এক অন্যরকম। সে ভালো জানে চোখের আলো আর সূর্যের আলোর মধ্যে কতটা তফাৎ? রামধনু আর প্রিজম যেমন এক জিনিস নয় ঠিক তেমনটাই হয়ত। অনিমেষ দেখতে পায় রাস্তার পাশে সারি সারি গাছের সারি। কত কত লোক হেঁটে চলছে আপন মনে। ঠিক যেভাবে সেও হাঁটছে এখন। পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে অনিমেষ। একটু পেরোতেই একজনকে জিজ্ঞাসা করে সে – ‘ আর কতটা দূর যেতে হবে? ‘ মেয়েটি তার মুখের দিকে তাকায়। মাথা নামিয়ে নেয়। আবার জিজ্ঞাসা করে অনিমেষ – ‘ আর কতদূর আপনি জানেন? ‘ মেয়েটি মৌন নীরব। যদিও অনিমেষ নিজেও জানে না সে নিজে আসলে  ঠিক কোথায় যেতে চায়? আসলেই কেউই জানে না কে কোথায় যাবে? এখানে সবাই যে যার মতো গন্তব্যবিমুখ। অনিমেষ অবাক হয়ে যায়। কেউ কোনো কথা না বলে কিভাবে এগিয়ে চলেছে একে একে। মনে মনে প্রশ্ন জাগে এত সারি সারি গাছ, লম্বা লম্বা আঁকাবাঁকা আল, কালো মেঘের দল এলো কোথা থেকে? অনিমেষ বুঝতে পারে এবার, যাঁরা হেঁটে গেছে এতকাল  এমন সারি সারি মানুষের ভিড়, গাঢ় স্মৃতি, অনন্ত অভিমান ঠেলে, তাঁরা আসলে সবাই গন্তব্যবিমুখ। এবার সে মনে মনে বিশ্বাস করতে শুরু করে গন্তব্যবিমুখ না হলে সত্যি সত্যিই সব কিছু একসময় শেষ হয়ে যায়। যে কথাটা  এতদিন ধরে তাকে তনিমা বলে এসেছে, সে কথাটা আজ ধীরে ধীরে আন্দাজ করতে পারে  অনিমেষ। ভিতরে ভিতরে ঝড় ওঠে, তোলপাড় হয় –  তনিমার  লজ্জা, শরীর ,যৌবন ইত্যাদি অনেক কিছুই ঠিক কতটা গন্তব্যবিমুখ ছিল এটা ভেবে। মুছড়ে পড়ে, চোখে থই থই করে জল, নিজের প্রতি নিজের ঘেন্না আসে, আফসোস করে সে, কতই না ভুল হয়ে গেছে ! যে মানুষটিকে বিশ্বাস না করে ছেড়ে গিয়েছিল তনিমা তিরিশ বছর আগে, সেটা কি এই গন্তব্যবিমুখতা নাকি অনিমেষ নিজেও গন্তব্যবিমুখ ছিল, যে কারণে সেরিব্রাল অ্যাটাকের পর অনিমেষ আর মনেই করতে পারলো না  তনিমাকে? 

অবাক হয়ে যায় অনিমেষ। মনে মনে ভাবে স্মৃতির মধ্যে নগ্নতা কি ভীষণ জরুরী।  কেননা, যে মানুষটি থেকে যায় স্মৃতির ভিতর, তাকেও তো বদলাতে হয়, পাল্টাতে হয়, দুমড়ে মুছড়ে নিজের জায়গা করে নিতে হয়। নগ্ন না হলে এমন কি করে সম্ভব ? প্রতিটি জন্মই তো একটা পূর্ণ নগ্নতার পর ফিরে আসে। নাহলে‌ যাকে মানুষ ভালবাসবে বলে রেখে দিতে চাইবে আজীবন, নগ্নতা ব্যতীত তাকে রাখা যাবে কি করে? কিন্তু এরপরেও তাঁদেরকেই মুক্তি দিতে হয়, ছেড়ে দিতে হয় নিজের মতো

 এবং যাঁরা ফিরে আসে, তাঁরাই একমাত্র নিজের।  তবে বাকিরা ? তাঁরাও নিজের। তাঁদের শুধু নিজের বলে কোনোদিন কিছু থাকে না।  আজ ঠিক সেভাবেই কি অনিমেষ নগ্ন হতে হতে খুঁজে নিচ্ছে নিজেকে ? এমন নগ্নতা সত্যি কি এক রূপান্তর? অনিমেষ এমন প্রশ্নের ভিতরে বিভোর হয়ে আছে যেন।  এইভাবেই সে জন্ম নিচ্ছে অনবরত শূন্যতায়, হাওয়ায়, নীরবতায়, শব্দহীনতায়। জন্মাতে জন্মাতে অনিমেষ ভাবে, একটি মৃত্যু কি এক প্রেম নাকি ভালোবাসা? প্রেমে যেমন শরীর জরুরী, তেমন ভালোবাসায় একটা গোটা মানুষ। নাকি শরীর এবং মানুষ দুটোই একধরনের রূপান্তর। সে আজ মনে মনে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে একটা গোটা প্রেম সম্পূর্ণ নগ্নতা পেরিয়ে গেলে ভালাবাসা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ঠিক যেভাবে রাধার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় কৃষ্ণকে। নগ্ন রাধার মধ্যেই তো একটা অন্ধকার নীল হয়ে জ্বলে উঠলে কৃষ্ণ তৈরি হয়। সেভাবেই কি অনিমেষ ঘন অন্ধকারে নীলাভ চোখে খুঁজে ফিরছে নগ্ন রাধাদের সারি? সেভাবেই কি হাঁটতে হাঁটতে এতটা পথ আসার পরও তার মধ্যে কোনো ক্লান্তি নেই, ঘাম নেই, বিরক্তি নেই, আছে শুধু কোনো এক অনন্তকে ছুঁয়ে দেখার গভীর ইচ্ছে। সে অন্তত প্রেম হতে পারে, ভালোবাসা হতে পারে, তনিমা হতে পারে, রাধাও হতে পারে! কিন্তু আসলে কি তা অনিমেষ নিজেও জানে না। কেবল শুধু বিড়বিড় করে নগ্নতা মানেই যেমন উলঙ্গতা নয়, তেমনই সব প্রেম ভালোবাসা নয়। 

ভাবতে ভাবতে গলা শুকিয়ে আসে অনিমেষের, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ফাঁকা চারিদিক। নিস্তব্ধ। যেটুকু নরনারী ছিল, তারাও কেউ কোথাও নেই। শূন্য ধূ ধূ প্রান্তর। যেন ডুব দিতে চাইছে আধখানা চাঁদ  কোনোএক পৃথিবীর কার্নিশে। চেতনাগুলো ধূমায়িত হয়ে ভেসে যাচ্ছে মেঘ হয়ে। কিন্তু অনিমেষ কিছু একটা খুঁজছে। সেই ভাঙ্গা কাঁচ, অন্ধকার আল, লম্বা গাছেদের সারি সব পেরিয়ে চলে এসেছে অনেকটা। বুঝতে পারছে, সামনে আকাশ ছোঁয়া পাহাড়, তার গায়ে যে সাদা সাদা বরফ, কিন্তু তাতে কোনো শীতলতার বিন্দুমাত্র নেই, গাছ নেই, সবুজ নেই, নীল নেই, প্রতিধ্বনি নেই,  আছে কেবল  নিষ্প্রাণ উচুঁ উঁচু জমি, পাহাড়, পর্বত। অনিমেষের যদিও সেগুলো পেরোতে আর কোনো কষ্ট হওয়ার কথা না। কেননা সে এতদিনে শিখে গেছে কিভাবে পেরোতে হয় এই সুবিশাল পাহাড়, পর্বত, মালভূমি। অনিমেষ বিশ্বাস করে যেকোনো সম্পর্ক পেরোতে একটা গোটা মাউন্ট এভারেস্ট লাগে। যদিও এগুলো মাউন্ট এভারেস্টের মত নয়। সে চোখ বুজে বুঝতে চায় গভীরতা, সাধ্য ও অসাধ্যের মধ্যে দূরত্ব।  অনিমেষ হতাশ, সঙ্কুচিত।  এখান থেকে বোঝা যায় ফল যেমন জল ছাড়া সঙ্কুচিত হয়, ঠিক তেমন মানুষও দুশ্চিন্তায় সঙ্কুচিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো কিসের দুশ্চিন্তা? কিসের এমন সঙ্কোচন? যে আজ জন্ম নিচ্ছে অনবরত তার সঙ্কোচন একপ্রকার অবৈজ্ঞানিক। যদিও বিজ্ঞান জন্ম মৃত্যু বলতে কেবল কোষবিভাজন বোঝে। কিন্তু অনিমেষ অনেক কিছু বোঝে, সে বোঝে সাধ্য, সে বোঝে অসাধ্য, সে বোঝে পরাধীনতা, সেই কেবল একমাত্র বোঝে সূক্ষ অনুভুতি ছাড়া এমন বিশাল বিশাল পর্বত পাহাড় পেরোনো সম্ভব না। সত্যি সম্ভব  না।

পেরোতে পেরোতে সে এসে পড়ে ধূ ধু মরুভূমির উপর।প্রান্তরের পর প্রান্তর ঢেকে গেছে যেন শুধু বালি আর বালি। কোনো এক শান্ত শীতল হাওয়া এসে চোখ-মুখ ঢেকে দিচ্ছে তার। এমন শীতল হাওয়া সে মরুভূমির বুকে কখনও পায় নি আগে। অনুভব করতে করতে অনিমেষ বুঝতে পারে চারিদিকে এত যে অন্ধকার, তা  সবে একটু কেটেছে। তবে, চোখের মধ্যে আবছা আছে যতটুকু সেটুকু চিরন্তন, ওটুকু না থাকলে কোনো সম্পর্কই টেকে না । অনিমেষ বিশ্বাস করে যে সম্পর্ক যত বেশী আবছা সে সম্পর্ক তত বেশী মজবুত। এমনটাই  ভাবতে ভাবতে অনিমেষ পেরিয়ে আসে কিছুটা বালি। সে দেখতে পায়  একটু দূরে একটি মেয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে। সে যেন কিছু একটা খুঁজছে। কিন্তু সে নীরব, স্থির। এগিয়ে যায় অনিমেষ। ভাবে কিভাবে ডাকবে তাকে। কোনো নাম মাথায় আসছে না তার। সে অবাক হয়, এমন এক নির্জন মরুভূমির বুকে এই একটা মেয়ে কি করছে একা একা এই ভেবে।  আস্তে আস্তে কাছে এগোয়, নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করে অনিমেষ –

 ‘ শুনছেন ?’ 

কোনো উত্তর নেই, পাথরের মত দাঁড়িয়ে মেয়েটি। অনিমেষ আবার বলে – 

‘ শুনছেন, আপনার নামটা জানতে পারি? ‘ 

তখনও কোনো উত্তর নেই। অনিমেষ আবার জিজ্ঞাসা করে – 

‘ আপনি কি এখানে একা? কেউ আসে নি আপনার সাথে ? ‘ 

মেয়েটি মৌনতা ভাঙে। নিচু স্বরে উত্তর দেয় – 

‘ আপনার সাথে কেউ এসেছে ? ‘

‘ পুরুষদের অন্ধকারে কাউকে লাগে না। ‘

‘ মেয়েদের? তারা কি এতটাই দুর্বল ? ‘

‘ না তা নয়! এত ধূ ধূ মরুভূমি, কোনো জনবসতি নেই, এখানে একা দাঁড়িয়ে, তাই আর কি! ‘

মেয়েটি আরোও স্থির হয়ে যায়, দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে, জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বলে – 

‘ খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে, যদি আবার দেখা হয়ে যায়! ‘

অনিমেষের মনে খটকা লাগে, কৌতূহল মনে জিজ্ঞাসা করে,-

‘ কার কথা বলছেন, কার সাথে দেখা হওয়ার কথা বলছেন ? ‘

মেয়েটি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে, হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে –

‘ আপনি কাউকে খুঁজছেন না? এমন কাউকে, যাকে দেখতে পেলে আপনার ভয় হবে, দুশ্চিন্তা হবে এবং আরো অনেক কিছু হবে যা যা আপনি এখনও ভাবতে পারছেন  না। ‘

শুনে অনিমেষের গলাশুকিয়ে আসে, এতটুকু জল গলায় তার অনুভূত হয় না। অনিমেষের মনে পড়ে যাচ্ছে,  আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের কথা, যারা তাকে ছেড়ে চলে এসেছিল অনেক দূরে, যদি তাদের সাথে দেখা হয়ে যায় মুখোমুখি, তখন হয়ত আবার অনেক কথা উঠবে,প্রশ্ন উঠবে, তাই অনিমেষ মুখোমুখি হতে ভয় পায়। অনিমেষ জানে ভালোবাসা খুব দুর্বল, কিন্তু স্মৃতির থেকেও অনেক বেশি কঠিন। তাদের মুখোমুখি হতে  চায় না সে। 

মেয়েটি আবার বলে – 

‘ কি কিছু বলছেন না যে!’

অনিমেষ বলে –

‘ আমার এমন একটা চিন্তা ছিল, কিন্তু এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ‘

‘ এই যে বললেন পুরুষেরা অন্ধকার একা পেরাতে পারে।’

অনিমেষ ঢোক গেলে, কি বলবে আর কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে

‘ এর পরে কি আছে জানেন? তাদের সাথে ঠিক কোথায় দেখা হতে পারে আপনি বলতে পারবেন একটু? ‘ 

‘ আপনি ঠিক কার কথা, কাদের সাথে দেখা হওয়ার কথা বলছেন ? ‘

এমন প্রশ্ন শুনে হিসেব মেলাতে বসে অনিমেষ। জন্মের আগে ও পরে পুরোটাই বৃত্তের মত যে। আসলে পৃথিবীর বাইরে এবং ভিতরে যা দিয়ে শুরু হয় তার মুখোমুখি সবাইকেই একদিন না একদিন হতে হয়। যেমন অনিমেষ এখন হচ্ছে।

‘ যাঁদের সাথে দেখা করার জন্য দুশ্চিন্তা করছেন, তারা আজও মনে রেখেছে আপনাকে?’ –  মেয়েটি বলে একটু পর।

‘ তা জানি না, তবে  যদি না ভোলে?’ 

‘ এখানে কেউ কাউকে মনে রাখে না। সবাই মুখোমুখি হয়, চিনতে পারলে একটু হাসে, না হলে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়। ‘

 ‘ কেন? তারা কি খুব ব্যস্ত ? ‘

‘ ব্যস্ত ঠিক নয়, যখন কেউ এখানে পাস কাটিয়ে যায়, তারা কেউ কথা বলে না। তাদের বিশ্বাস মুখ খুললেই তারাখসা এসে পড়ে চোয়াল জুড়ে। চোখ রক্তাক্ত হয়। আসলে যারা চলে গেছে অনেকবছর আগে, তারাও যেন ঠিক তারাখসাদের মত। তাই  হয়ত অনিমেষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, একটা সুদীর্ঘ সময় পেরিয়ে যখন মুখোমুখি হবে অনিমেষ, তখন ছেড়ে আসা মানুষগুলো তারাখসার মতোই দেখাবে, ঢেকে দেবে চোখ, পুড়িয়ে দেবে বিস্মৃত সব। কথা বলতে বলতে অনিমেষও বুঝে যাবে যারা ঝরে পড়তে চায় সুদীর্ঘ সময় নিয়ে , তারাই এতকাল আকাশে আকাশে তারা হয়ে ফুটে থাকে। 

আবার, একটু পর পরই  আকাশ থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসছে কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমণ্ডল, উর্সা মেজর, মাইনর আরো কত কি! অনিমেষ কেবল মনে মনে ভাবে, যা নেমে আসছে ক্রমাগত, তারা  কি কালপুরুষের খসা  নাকি সপ্তর্ষিমণ্ডলের ? অনিমেষ জানে যারা উপর  থেকে হঠাৎ ঝরে পড়ে, তারা আসলেই নিষ্প্রভ হয়। কেউ হালকা না হলে  আর যাই হোক ঝরে পড়তে পারে না। অনিমেষ এতকাল এই বিশ্বাসটাই করে এসেছে – সম্পর্কের ভিতরে এমনভাবেই নিভে থাকতে হয়, চোখ বন্ধ করে গড়তে হয় শরীরের ভিতর আরও একটা শরীর। কেননা জ্বলে উঠলে তা অবশ্যই নিভে যাবে দ্রুত। তারপরই শরীরে শরীরে ঘর্ষণ আসবে, স্থিতিস্থাপকতা কমে যাবে, মানুষ পুনরায় মানুষ ছেড়ে অন্য এক মানুষ হবে, এবং এরপরে হয়ত হবে এমন কিছু,যা একবারেই অন্যরকম।  তবুও যে  সম্পর্ক ধরে এত উল্লাস,  সে কিন্তু কেবল সম্পর্কই থেকে যাবে, কেননা তার জন্য নির্দিষ্ট কোনো অধিকার বা শরীর, কোনটির একটিও বরাদ্দ থাকবে না। তাই কি অনিমেষ মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, আসল সম্পর্কের আদতেই  একাধিক সমার্থক উচ্চারণ থাকতে নেই? এমন ভাবতে ভাবতে অনিমেষ হটাৎই লক্ষ্য করে, মেয়েটি আস্তে আস্তে দূরে সরতে শুরু করেছে তার থেকে। অনিমেষ, এও দেখতে পায় সেই মেয়েটির আশেপাশে কতরকমের লোক। কেউ কেউ মেয়েটাকে টানছে, কেউ কেউ পায়ে পড়ে লুটিয়ে যাচ্ছে, আবার কেউ কেউ চিত্কার করতে করতে গর্জনের মত শব্দ তুলছে। অনিমেষ ভাবে মানুষে মানুষে এত জোরে গর্জন করে কিভাবে? এও ভাবে, এখানে কথা বলা মানে কি শুধুই চিৎকার? অনিমেষের মনে পড়ে যায়, মেয়েটার কথা, সে বলেছিল – এখানে পাশ কাটিয়ে গেলে কেউ কোনো কথা বলে না। মনে মনে তাই  সে উত্তর মেলানোর চেষ্টা করে, এখানে এত নিশ্চুপতার অর্থ কি আসলে এই অপ্রাসঙ্গিক গর্জন ? অনিমেষ যেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, যদিও তার পরিচিতদের  মধ্যে এমন গর্জন করতে সে শোনে নি কখনও। ঠিক তখনই তার মনে পড়ে যাচ্ছে সমস্ত কলহ, বিবাদ। অনিমেষ জানে দাম্পত্য কলহ কিংবা যেকোনো বিবাদ, সে তো  অন্য একপ্রকার কোলাহল, কিন্তু এই গর্জন কি? বিস্ফোরণ নাকি নিঃসরণ? তাঁদের প্রতিটি উচ্চারণে উচারণে আলোড়িত হচ্ছে চতুর্দিক। আর সেই আলোড়নে ভেসে উঠছে কত কত মুখ, চোখ, প্রতিচ্ছবি, আরো কতকি ! অনিমেষ দেখতে দেখতে ভাবে যাঁরা এতকাল ধরে, এসে দাঁড়িতে চেয়েও দাঁড়াতে পারে নি তার মুখোমুখি, তাঁরা যদি হটাৎই  এমন চোখ নাক মুখ হয়ে ফুটে ওঠে, অনিমেষ কি তাদের চিনে নিতে পারবে? সে যে বিশ্বাস করে একটা সম্পর্ক যেমন একটা চোখের তেমনই একটা শরীরেরও।  তাই, অনিমেষ নিজের দিকে তাকায়, এক হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে আর একটা হাত, ওই হাত দিয়েই ছোঁয় চোখ-নাক ইত্যাদি সব, যা যা এখনও সম্পূর্ণ অনিমেষের। অনিমেষ মিলিয়ে নেয় নিজেকে,বুঝে নেয়, কেননা, সে বুঝতে পারে যতই এগোতে থাকবে ততই ধীরে ধীরে টুকরো টুকরো হতে শুরু করবে সে, ঠিক যেভাবে এতকাল সে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে এসেছে প্রতিটি মূহুর্তে, প্রতিটি যন্ত্রনায়, আনন্দে এবং প্রতিটি অশ্রুতে।

অনিমেষ বসে পড়ে। জল চায়, একটু আদর চায়, একটা মানুষ চায়, চায় একটা কুকুর, যে তাকে রাস্তা চিনিয়ে চিনিয়ে সামনের দিকে নিয়ে যাবে।  যেদিকেই তাকায় দেখে ঘন কালো শূন্যতায় ঢেকে রেখেছে চারিদিক।  সে অনুভব করে যে গর্জনটা শুনে এতক্ষণ সে ভয় পাচ্ছিল, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল, সেরকমই কোনো এক তীব্র ঢেউয়ের শব্দ তারই সম্মুখভাগে এসে স্থির হয়েছে যেন। ক্লান্তিতে তৃষ্ণায় চোখগুলো একেবারে ঘোলাটে হয়ে আছে তার। সে শুধু একটুকুই বুঝতে পারে একঘরা জল নিয়ে কেউ যেন উপস্থিত হয়েছে তারই সম্মুখে।  তার সারা গা বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সুভাস, আতরের গন্ধে ম ম করছে চতুর্দিক। অনিমেষ অনুভব করে যাঁরা এত রাতে আতর মাখতে ভালোবাসে, তারা আর যেই হোক, সাধারণ কেউ নয়।  তার মনে কৌতূহল জাগে। মনে মনে জানতে চায় সে কে? এর গন্ধ তো স্বাভাবিক মানুষের নয়। হটাৎ মেয়েলি শব্দে বলে ওঠে – ‘ আপনি হা করুন, আমি জল ঢেলে দিচ্ছি। ‘

অনিমেষ শোনা মাত্রই হা করে, মেয়েটি জল ঢালতে থাকে তার মুখের ভিতর। এই জল তৃপ্তির নয়, এই জল তৃষ্ণা নিবারণের নয়, এই জল অনিমেষের ভিতরের শুকিয়ে যাওয়া নদীর। অনিমেষ ভাবে এতকাল যেটার জন্য দৌড়ে ছিল চারদিক, তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল, সেটা এত সহজে এতটাই সহজে তৃষ্ণা হয়ে এলো অবশেষে? কিন্তু এতটা সময় সে কি করেছে তাহলে? রোদে জলে বন্যায় আশঙ্কায় সে যে সন্ধান করে গিয়েছিল এমনই এক নদীর, সেটা কি তবে কিছুই ছিল না? অনিমেষের ভিতরে ভিতরে ভাঙচুর চলে, সে বুঝতে পারে না ক্ষুধার্থ আর তৃষ্ণার মধ্যে পার্থক্য ঠিক কোথায়? মনে মনে ভাবে অতিরিক্ত ক্ষুধার্থতায়  কি তৃষ্ণা নেমে আসে? এটা জানার জন্যই  হয়ত অনিমেষ  কাছে এগিয়ে যায়, ভালো করে দেখে। ঘরাভর্তি জলের মধ্যে ফুটে ওঠে মেয়েটির মুখ। পেছনে যেন জ্বলজ্বল করছে চাঁদ, জোৎস্নাময় তারা। ‘তুমি কোথায় ছিলে এতদিন?’ – প্রশ্ন করে অনিমেষ। চুপ করে থাকে সে, ঘরা থেকে জল নিয়ে ভিজিয়ে দেয় তার পা। অনিমেষ বিরক্ত হয়। ‘ এমন ভাবে শুকনো পা টাকে ভিজিও না। ‘ – অনিমেষ বলে। মেয়েটি কোনো কথাই শুনতে চায় না যেন, নিজের মতো সে যা করতে চায় করে চলে। দুহাত চেপে ধরে অনিমেষ। ‘ তোমায় বলছি না এমন কোরো না’ – বেশ বিরক্তির স্বরে বলে অনিমেষ। মেয়েটি তখনই চোখে চোখ রাখে। অত্যন্ত রাগে লাল হয়ে ওঠা ওই চোখ। যেন কয়েক হাজার সূর্য এখনই বেরিয়ে আসতে পারে এখনই তার দৃষ্টি ঠেলে।

 ‘ তুমি এ কি করলে? আমার হাত ধরলে কেন? তুমি জানো না এখানে কেউ কাউকে ছুঁয়ে দেখা অন্যায়।’

অনিমেষ হতবম্ব হয়, লজ্জিত হয়। 

‘ আমি বুঝি নি,ক্ষমা করবেন, আপনি কথা শুনছেন না দেখে আমি হাত দুটো ধরেছিলাম ‘

‘ আপনি জানেন, এখানে কেউ কাউকে কোনো কাজে বাধা দিলে কি শাস্তি হতে পারে ? ‘

অনিমেষ ভীত হয়, পুনরায় সঙ্কুচিত হয়। 

‘ বলুন কি শাস্তি হবে আমার? ‘

‘ একটা গোটা জীবন আপনি হেঁটেই যাবেন, হেঁটেই যাবেন,গলা থেকে শরীর সব শুকিয়ে যাবে, শুকিয়ে যাবে সম্পর্ক, মানুষও যাবে, শুধু আপনি একা বেঁচে থাকবেন। ‘

‘ এতকাল তবে কি ছিলাম,  একাই তো ! ‘

‘ না এতকাল আপনি একা ছিলেন না, আপনার সাথে স্রোত ছিল, ঢেউ ছিল, পাপ ছিল, এখন আপনি নিঃস্ব হবেন, নিরর্থ হবেন। ‘

‘ একাকী যে, সে কি নিঃস্ব নয়, নিরর্থ নয়? ‘

‘ আপনি কিছু একটা খুঁজছেন, অনুসন্ধান করছেন, তার মানে আপনি নিঃস্ব নন, কেবল স্থিত নন আপনি। ‘

‘ যে খোঁজে সেও একা, ফাঁকা, শূণ্য ‘ 

‘ এমন শূন্যতা সুন্দর, এই শূন্যতা নিঃসঙ্গতার। ‘

‘ তবে আপনি যেটা বলছেন সেটা ? এটা কেমন ? ‘

‘ আপনার কিছুই থাকবে না, না জল, না নদী, না মরুভূমি, না ধূ ধূ প্রান্তর, না মহাকর্ষ, না গতিপথ, কেবল শূন্য থেকে আরো শূন্যে ভেসে থাকবেন, না নামবেন না উঠবেন। কেবল স্থির স্থবির। ‘

‘ আমি এখনও তো ভাসমান, স্থিত।’

‘ আপনি এখন দোদুল্যমান। স্থিত আর স্থিতির মধ্যবর্তীতে দাঁড়ানো, এবার স্থিত হবেন। ‘

‘ তবে কি আমার শাস্তি হয়েই গেল,আমি কি আর কিছুই দেখতে পাব না? ‘

‘ এখনও কিছুটা পাবেন, আস্তে আস্তে সূর্যাস্ত হবে আপনার । ‘

বলেই কোথায় যেন মিলিয়ে গেল মেয়েটা। অনিমেষের ভিতরটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। বুকের ভিতর নিঃশব্দে যেন এসে পড়ল পাথরের পর পাথর। স্তূপাকার সেইসব। অনিমেষ ভাবে মানুষ কেবল নিঃস্ব নয়, নিঃসঙ্গ নয়, মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে উঠলে তবেই খুব ভয়ানক ওঠে সে। আজ তবে অনিমেষ কি? নিঃস্ব ? নিথর? তাপ-উত্তাপ হীন? মৃত্যুঞ্জয়ী? জানা নেই, কোনোটাই জানা নেই। অনিমেষ খালি জানে, যার কেউ নেই, তার কোনো শূণ্যতাও নেই। 

অনিমেষের চারিদিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল সবই যেন উদ্বিগ্ন, বিধ্বস্ত। গত পঞ্চাশ বছরে এমন শীর্ণতা কখনও দেখে নি সে। অন্ধকারের পর অন্ধকার রাস্তা, এবড়োখেবড়ো গর্ত, হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় অনিমেষ। অথচ শরীরে কোনো আঘাত লাগে না, অনুভূত হয় না কোনো ব্যথা। স্বপ্নের মধ্যে যেমন নিজেকে খোঁজে মানুষ, সেরকমই সে কোনো ব্যথাকে খুঁজে পাবে আশা করেছিল। এই ব্যথা খুঁজতে চাওয়া তার নেশা। কখনও খোঁজে শরীরের, কখনও  মনের , কখনও চোখের, কখনও  মাথার, আবার কখনও খোঁজে নিজের। সে মনে করে চোখ নাক মুখ মাথা এসব যেমন তার কোনোটা না, তেমনই কোনো ব্যথাও কারো নিজের না। ব্যথা অন্যের মধ্যে দিয়ে নিজের মধ্যে অনুভূত হয়। তাই সে খুঁজে চলেছে এমন কোনো গর্ত, খাদ, বিভাজিকা।  যার মধ্যে দিয়ে হয়ত বেরিয়ে আসবে জগতের সমস্ত কান্না, স্তব্ধতা, দীর্ঘশ্বাস। অনিমেষ খুঁজতে খুঁজতে এসে পড়ে বিপুল সমুদ্রের সামনে। যে সমুদ্র তার অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, সেই সমুদ্র কিনা তারই সম্মুখে। সমুদ্রের পার থেকে সমুদ্র যতটা সুন্দর লাগে দেখতে, অনিমেষের ঠিক ততটাই ভয় হয় আজও। এই সমুদ্র অনিমেষের চোয়াল ছুঁয়ে যায়, ঠোঁট ছুঁয়ে যায়, আলজিভ ছুঁয়ে যায়। গলায় জল লাগলে বুঝতে পারে, এখানে সমুদ্রের জল কিছুটা নোনতা। আস্তে আস্তে  তার চোখ লেগে আসে ।  ঘুম নামে। এই এতক্ষণ পর সে ক্লান্তি অনুভব করতে শুরু করে। তবুও তাকে হাঁটতে হবে , কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে সে নিজেও জানে না। অনিমেষ দেখে পাল পাল নৌকা ছুটে আসছে তার দিকে। কারো  কারো নৌকায় লাল পতাকা লাগানো। অনিমেষ বোঝে কোনো বিশেষ সংকেত হয়ত। অনিমেষ দাঁড়িয়ে পড়ে, এক মনে দেখতে থাকে। সে দেখতে পায় সারি সারি মধ্য বয়স্ক মহিলাদের দল দাঁড় টানতে টানতে এগিয়ে আসছে। যদিও মধ্যবয়স্কতা অনিমেষের একটা অভিশাপ।  অনিমেষ দেখতে পায় সেই পরিচিত মুখেদের সারি। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে সে মুখটাকে জুড়ে ভেঙে ফেলছিল ভিতরের ঘাত প্রতিঘাত। নিজের সবটুকু যাকে দিতে গিয়েও অন্যায়ভাবে অবেহেলিত করেছিল গোটা সমাজ। সেই মুখ পুনরায় কেন ঘুরে আসছে তার কাছে? এমনটা হওয়ার কথা তো ছিল না। যা ফেলে আসা হয় তা তো অগ্রাহ্য, পুরাতন। তবে? অনিমেষ বুঝতে পারে কিছু কিছু মুখ আলাদা, কিছু সম্পর্ক ব্যক্তিগত, কিছু বোঝাপড়া চিরন্তন। এতদিনে পরে বুঝতে পারে অনিমেষ,  ব্যক্তিগত কোনোকিছুই যেমন অগ্রাহ্য হতে পারে না , তেমন অবহেলাও নয়। 

‘ কেমন আছো, অনিমেষ? ‘ 

নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অনিমেষ। কথা বলার আগেই শরীর জুড়ে চলতে থাকে বিস্ফোরণ, মস্তিষ্কের ভিতর যেন আঘাত করে লক্ষ লক্ষ ধূমকেতু। কত আলো, কত প্রলয়। অনিমেষের মুখ থেকে একটিও শব্দ নেই। মনে মনে ভাবে চোখ মুখ নাক দেখার বদলে এ কি দেখছে সে। সামনে দাঁড়িয়ে একটা গোটা শরীর, সেই মুখ,  সারা গাল জুড়ে সেই একই বলিরেখা। যা অনেকবার অনিমেষ হাত দিয়ে মোছার চেষ্টা করেছিল। দিন গেছে, বয়স হয়েছে, বলিরেখা স্পষ্ট হয়েছে আরোও। কতদিন গেছে নিজের হাতের তালুর মধ্যে রেখেছিল এই নরম চিবুক, উদ্বাস্তু মস্তিষ্ক, বিপর্যস্ত শরীর। সেগুলো কিছুই বদলায় নি। সেই একই চাহনি, একই আলতো হাসি, একই চোখ, সবকিছুই আগের মত। অনিমেষ চোখ বুজলেই মনে পড়ে যায় সেই সব দিনের প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মূহুর্ত। 

‘ কেমন আছো অনিমেষ? ‘

অনিমেষ ঢোক গেলে, ‘ আপনি কেমন? ‘

‘ কতকাল পর, সবাই ভালো ? ‘

‘ সবাই আর কই, কেউ নেই, সবাই একে একে আপনার মতোই ……. ‘ – চুপ হয়ে যায় অনিমেষ। 

‘ কি হলো চুপ করে গেলে? তারা কেউ আসে নি তোমার সাথে? ‘

‘ আপনি এসেছিলেন ? তারা আসবে ? ‘

‘ আমি তো এলাম অনিমেষ। আবারও তো এলাম। ‘

অনিমেষ মুচকি হাসে। চোখে আর জল নেই, নেই বাতাস, আছে কেবল সারি সারি দেবদারু গাছের ছাউনি, ঝাউবনের শীতলতা।  

‘ আপনাকে তো আসতে বলি নি। ‘

‘ আসতে হতই অনিমেষ, সেদিন অনেকে ছিল, আজ কেউ নেই, দুদণ্ড কথার জন্যই আজও ফিরে যাই নি অনিমেষ ‘

‘ ফিরিয়ে দিয়েছিলাম তো আমি। আপনি বরং থাকতে চেয়েছিলেন ‘

‘ আমি রাখতে চেয়েছিলাম। ‘

অনিমেষ চোখে চোখ রাখে, দুহাত দিয়ে মুছে নেয় কাঁচের মতো গাল দুটো। সেই একই অনুভুতি, ঠোঁট নাক চিবুক ছুঁয়ে ভেসে আসে সেই একই গন্ধ। অনিমেষ বোঝে কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে যাদের ঠোঁট  নাক চিবুক আলাদা হয়। একেবারেই অন্যরকম। 

‘ এই দাগগুলো এখনও যায় নি ? ‘

‘ হাত দুটো নেই, আঙ্গুলগুলোও, যাঁরা মুছে দিত পরিশ্রান্ত সব, আমি কখনও জানাই নি সেগুলো। ‘

‘ আপনি ভয় পেতেন। ‘

‘ পেতাম , অনেক পেতাম। নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয়। অনেক তো হারিয়েছি। ‘

‘ যা হারিয়েছিলেন তা আপনার ছিল না, যা ছিল না তাই আপনি হারিয়েছেন। ‘

‘ তুমি? হারিয়ে যাবে বলে তো আসো নি! ‘

‘ আমি কি আদৌ হারিয়েছি ?’

‘ থেকে যেতে পারতে। তাহলে এতকাল পর দাঁড়িয়ে মুখোমুখি নয়, আজ অন্য কিছু  হতো। ‘

‘ ভয় ঋণ বাড়িয়ে দেয়। যত ঋণ বাড়ে তত বাড়ে পাপ। ‘

‘ আমি বুঝতে পারি নি ঠিক করছিলাম না ভুল? আমি আসলেই ভিতরে ভিতরে ভেঙে যাচ্ছিলাম। ‘

‘ তাই তো ছেড়েছি। একটা সম্পর্ক তো দুজনের। ‘

‘ ওটা সম্পর্ক ছিল অনিমেষ? আমি যে অতি সাধারণ ছিলাম। বুঝি নি । ‘

‘ তবে ওটা কি ছিল? কতবার বলেছিলাম এমন সম্পর্ক সহজে আসে না। ‘

মুখ নামিয়ে নেয়। চোখ থেকে বেরিয়ে আসে প্রাপ্তবয়স্ক জল। সেই জল সমুদ্রের মতোই নোনতা। কিন্তু ঘনত্ব অনেক বেশি। ফেনা হয় না, জমাট বেঁধে নুন হয়ে যায়। 

অনিমেষ কাছে এগিয়ে যায়। চারিদিকে নেমে আসে ঘন অন্ধকার। হাত দুটো ধরে, আঙ্গুলের ফাঁকে ঢুকিয়ে নেয় আঙুল। মুঠো চেপে ধরে। একটি শিশু যেভাবে মায়ের আঙুল ধরে। কত বিশ্বাস কত ভরসা কত নির্ভরতা। 

‘ এখনও শিশুর মত মুঠোগুলো তোমার অনিমেষ। ‘

‘ শিশুর মতো ছিল বলেই কি নিজে থেকে ধরেন নি কখনও? ‘

‘ আমি ধরেছিলাম। তুমি বোঝো নি। সব সম্পর্কই নিঃশব্দে সুন্দর , তুমি তো শিখিয়েছিলে! ‘

আবার চুপ করে যায়। চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে অনবরত, পড়তে পারে কিছু? কিছু ঝরে পড়ছে কি? 

 আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে এমনও যদি কিছু পেত অনিমেষ, তাহলে হয়ত এমন যেতে হতো না। 

‘ তুমি বলেছিলে মনে আছে? চোখে চোখ রাখলেই ভালোবাসা হয় না, এমনকি  ঠোঁটে ঠোঁট রাখলেও ‘

‘ আমার কথা না, এটা একটা কবিতা। ‘

‘ একটা গান গাইবে অনিমেষ, গান শুনি নি অনেকদিন। ‘

‘ আমার গান আপনার ভালো লাগবে না, সেই সুর নেই। বয়সের চাপে স্বর ভেঙে গেছে। ‘

‘ তুমি যখন গান করতে লুকিয়ে লুকিয়ে শুনতাম, মনের গান সেগুলো।’

‘ মনে মন রাখলে ভালোবাসা হতেই পারত। ‘

‘ ওই যে ভয় পেতাম। আমি অতি সাধারণ। দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না। ‘

‘ আমি তো চাই নি কিছুই। কি চেয়েছিলাম ? একটু সান্নিধ্য! ‘

‘ ওটাতেই তো বেশি ভয়। ‘

‘ ভয় পেলে সান্নিধ্য বাড়ে। আপনার তো বাড়ে নি। এড়িয়ে গেছেন। বারংবার মুখ ফিরিয়েছেন। ভুল বুঝেছেন। ‘

‘ ওটাও তো এমনি এমনি হয় না। কিছু তো থাকতে হয় ?’

‘ কি ছিলো? সেটাই তো বুঝতে পারি নি। ‘

কেউ কোনো কথা বলে না। আগের মতই আবার চুপচাপ। শব্দ যেন বাহুল্যতা এই মূহুর্তে। অনিমেষ জানে যে ভালোবাসার শব্দ নেই, সেটা বোঝা। ভালোবাসা থাকলেই সান্নিধ্যতা থাকবে, প্রকাশ থাকবে। চুপচাপ ভালোবাসি যাঁরা বলে তাঁরা আসলেই ভীতু। ভালোবাসতে ভয় পায়। 

‘ তুমি বোঝো নি কেন? বোঝা তো উচিত ছিল। ‘

‘ ভিতরে ভিতরে কতটা যুদ্ধ চলেছিল আপনি বুঝেছিলেন? একটা শিশুর পেটের ভিতর ভিতর কতটা যুদ্ধ করে সেটা মাও বোঝে না। ‘

‘ তুমি কি তবে শিশুর মতো ছিলে? ‘

‘ ভালাবাসা শিশুর মতো আদর পেলে, সম্পর্ক হয়, আপনি বোঝেন নি! ‘

‘ আমি নিরূপায়। ‘

‘ নিরূপায়  ছিলেন না। বরং আপনার প্রয়োজন ছিল না। অতিরিক্ত সব কিছু উধলে যায়। ‘

‘ তুমি তো আর একটু বোঝাতে পারতে। ‘

‘ বুঝিয়ে বুঝিয়েআর যাই হোক ভালোবাসা হয় না। আপনার চারপাশে যাঁরা ছিল, তাঁদের তো বোঝোতে হয়নি। আপনি তো তাঁদের ছেড়ে যান নি কখনও। ‘

‘ তাঁদের রাখতেই হত। ‘

‘ শুধু কি আমায় বুঝতে হতো ? ‘

‘ আমি এত উত্তর দিতে পারি না তুমি জানো। শরীরে ঘর্ষণ লাগে, স্থিতিস্থাপকতা কমে আসে।’

‘ আমি তো তাই ছেড়ে গিয়েছিলাম। এমন ঘর্ষণ খুবই কষ্ট দেয়। ‘

আরো জাপটে নেয় দুজন দুজনকে। নাড়ির টানের থেকেও সে আরোও গভীর টান। গোটা লক্ষ লক্ষ ব্রহ্মান্ড আটকে যাবে যেন। 

‘ এমন টানের পরেও ছেড়ে গেলে কিভাবে অনিমেষ? ‘

‘ বেশি টান আপনার আমার ঋণ বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আপনার কষ্ট হচ্ছিল দেখে …..’

মুখে হাত চাপা দিয়ে চুপ করিয়ে দেয় অনিমেষকে। অনিমেষ আঙুল, দুই হাত পুরোটাই ঢুকিয়ে নেয় মুখের ভিতর। শীতল হাওয়া বেরিয়ে আসে নাক থেকে। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়। বুকের মধ্যে টেনে নেয় মাথা। শুনতে পায় সূর্য ওঠার শব্দ। তারারা  খসে পড়ে এদিক ওদিক। 

‘ আমি হাত দুটো কতদিন পাই নি জানো? ‘

‘ আপনার অন্য অনেক হাত ছিল। ‘

‘ তোমার মত ছিল কি? ‘

‘ বুঝি নি। আসলে সম্পর্ক হাতের বদলে বুক চায়, বুকের বদলে শরীর চায়, শরীরের বদলে নগ্নতা চায়। জন্মের সময় দেখেছেন  মা ও সন্তান দুজনেই কতটা নগ্ন? ‘

‘ আমি সব তো দিয়েছি। বাদ কি ছিল? ‘

‘ বাদ ছিল অনেক কিছু। আপনার হাত দুটো আমি বাদে, সব কিছুকে নিংড়ে নিয়েছে।’

‘ যেমন ….. ‘

 ‘ যাঁরা সেবা পেয়েছে আপনার, ঘুম না এলে মাথার উপর হাতের তালু পেয়েছে, খুব ঠান্ডায় গায়ের চাদর পেয়েছে, ভীষণ মন খারাপে অভিমান পেয়েছে, অনেক অপমানে ক্ষমাও পেয়েছে। ‘

‘ আর……… ‘

‘ ঠুনকো আঘাতে কান্না পেয়েছে, এক নিমেষে আদর পেয়েছে, গভীর রাতে ঝগড়া পেয়েছে। ‘

‘ এত কিছু কখনও বলো নি তো আগে ‘

‘ বলেছিলাম, জানিয়েছিলাম, বোঝেন নি ‘

‘ কিভাবে? ‘

‘ অভিমানের ক্ষেত্রে নীরবতার থেকে বড় আত্মপ্রকাশ; আর কিইবা হতে পারে !’ 

‘ নীরব থাকলে আমার খুব কষ্ট হতো!’

‘ আর আমার? আমি তো শুধু ছুঁতে চেয়েছিলাম। আপনার  গাল দুটো আমার হাতের উপর ……..’ 

(চুপ করিয়ে)

‘ আমি তো কখনও কিছুতে বাধা দিই নি তোমায়। ‘

‘ বাধা দেন নি ঠিক, কিন্তু যাঁরা বাধা দেয় না, তাঁদের বেঁধে রাখা বেশি কঠিন ‘

‘ আমিও তো ভেঙেছি নিজেকে, বারবার বুঝিয়েছি, ভিতরে ভিতরে ভয় পেয়েছি ‘

‘ ওগুলো কি আদৌ ভয় ছিল? ‘

‘ কি ছিল তবে? ‘

‘ আমাকে না ফেরাতে পারার অপারগতা। ‘

‘ যদি তাই হবে, এই যে দীর্ঘ অপেক্ষা, তবে এগুলো কি? ‘

‘ এগুলো উপলব্ধি। ‘

‘ উপলব্ধি এমনি এমনি আসে? ‘

‘ কিছু হারিয়ে ফেলার পর উপলব্ধি প্রেম হয়ে আসে। আমার তারও আগে ভালোবাসা এসেছিল। ‘

‘ আমি ভুল করেছি। ‘

‘ অনেকবার করেছেন। শোধরানোর চেষ্টা থাকলে আঁকড়ে ধরতেন, জাপটে নিয়ে মুখোমুখি কাঁধে মাথা রাখতেন।’

‘ লোক লজ্জা ছিল। লোকে সেটা যদি পরকীয়া বলে? আমার সংসার, তার কি হতো? ‘

শুনেই হাত ছেড়ে দেয় অনিমেষ। বুক থেকে তুলে নেয় মাথা। মুখ পেট সব কিছু থেকে বের করলে নেয় আঙুল, গোটা শরীর। দৌড়ে চলে যায় দূরে। আগুন ফেলতে ফেলতে গিলে নেয় সমস্ত অন্ধকার। আলো আলো হয়ে যায় চতুর্দিক। বাড়ি ঘর নদী নালা, সব আগের মত। দেখতে পায় তারা দুজন শুয়ে আছে পাশাপাশি। বুকের উপর হাত রেখে দুজন দুজনে। নীলাভ দুই চোখ ঘুরে চলেছে শরীর জুড়ে। কিছুই বাকি নেই। যা তার সবই দুজনের। ঠোঁটে ঠোঁট রাখে দুজন। ঠোঁটে ঠোঁট রাখলেই কিন্তু সম্পর্ক হয় না। কিছু সম্পর্কে ঠোঁটের ধরন আলাদা। একটা চিৎকার করে অনিমেষ  – ‘ আপনি বোঝেন নি, একটি সন্তান মায়ের নগ্নতা পেরোলে তবেই  নগ্নতা অলঙ্কার হয়ে ওঠে। এটাকে পরকীয়া বলে না। দুটো শরীর মিলে গিয়ে সম্পর্ক হলে, প্রেম হয় । আর সেই প্রেম স্বীকৃতি পেলে তবেই হয় ভালোবাসা। একজন মায়ের মধ্যে সান্নিধ্যতা থাকে, ভালাবাসা থাকে, নির্ভরতা  থাকে,  পরকীয়া মায়ের মত না, এতে কোনো মমতা থাকে না। 

অনিমেষের টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়ছে অভিমান, শরীরের স্পর্শ, চামড়ার টান টান উত্তেজনা। শরীরের যতটুকু ঘাম, উষ্ণ অভ্যর্থনা সবকিছুই সমুদ্রের মত। যে কাছে আসে সে বোঝে, এর কাছে আসতে গেলে যে উত্তাপ লাগে, সেই একই উত্তাপে ঝলসে গেলে মানুষের সমপরিমাণ অনুতাপ তৈরি হয়। এটাই কি তবে সম্পর্ক ভাঙার ভয় ?এটাই কি প্রবল হলে পরকীয়া হয়? না, অনিমেষ বিশ্বাস করে একটা দাম্পত্যের বাইরে যে কোনো সম্পর্কই পরকীয়া। আসলে পরকীয়া কোনো  সম্পর্ক না, একটা শারীরিক অনুভুতি। আর যদি অনুভুতি শরীর পেরিয়ে সান্নিধ্যতা পায় তা হলে তা পবিত্র হয়ে যায়। তাই কি অনিমেষকে সমাজ অস্বীকার করে, তাই কি অনিমেষ বারংবার প্রমাণ করতে চায় সে বিবাহিত নয়। কেননা অতিরিক্ত দাম্পত্য সম্পর্ককে অনাথ করে দেয়। আকাশে আকাশে ঝিলিক লাগে, বাজ পড়ে, কিন্তু কেউ মরে না, বাঁচেও না। অনিমেষ এতদিন পর বুঝতে পারে আসলে সম্পর্ক জিনিসটাই মৃত, মৃত্যুর যেমন শরীর থাকে, তেমনই থাকে শরীর আর জীবনের মধ্যে একটা আপেক্ষিক দূরত্ব। যদিও এই দূরত্ব অনুভবের, তনুভবের। অনিমেষ সরে আসে, গায়ে গা লেগে গেলে সে গলে যায় ভিতরে ভিতরে। মনে মনে বলে ভালোবাসা বুঝতে তার এতদিন লাগলো কেন? কেনই না একটা মানুষকে ছুঁতে পেরিয়ে আসতে হলো, ছেড়ে আসতে হলো গোটা জীবন, অন্ধকার, আলো, নারীর টান। সে এবার প্রমাণ করতে পারে মা এবং মেয়ে দুজনেই সমান। বাকিরাও এবার বুঝতে পারে একটি মেয়ে গর্ভধারণ  করলেই মা হয়, আর একটা পুরুষ সে? সে গর্ভের দায়িত্ব নিলে বাবা হয়। অনিমেষ হালকা হয় যত তার ভার হয়ে আসে মাথা। সারা শরীর জুড়ে উষ্ণপ্রস্রবণ চলে। মুখ তুলে দেখে সামনে কত সম্পর্ক, কত কান্না , কত নর, কত নারী। আজ সে ক্লান্ত, বিমর্ষ, আচ্ছন্ন। অনিমেষ কাউকে বোঝাতে পারে নি কোনোদিন এই পার্থক্যটাই –  সম্পর্ক একটা আলিঙ্গন, দাম্পত্য শরীর ও নগ্নতার অধিকার, আর যে আলিঙ্গন দাম্পত্য নয়, তা হলো স্নেহ, শ্রদ্ধা, পবিত্রতা ও মাতৃত্ব। আর এই মাতৃত্বই হলো দাম্পত্যের পরবর্তী, সন্তান ও মায়ের মধ্যে একপ্রকার পরকীয়া মাত্র। 

হারিয়ে যেতে থাকে সেই মুখ পুনরায়। সমগ্র রাস্তার ভিড়, জলের স্রোত, ঢেউ ভেঙে যেতে থাকে। সে জানে, যে আগেও ছিল না সে আজও নেই। কিন্তু ঘুরপাক খায়, ওই একটিই মুখ।  কেন বারংবার গিলে খেয়েছে তাকে। মিথ্যে অপবাদ সব কিছু কেড়ে নিয়েছিল তাই নাকি সেই মানুষগুলো নিজেরাই চায় নি অনিমেষকে? প্রতিটি ক্ষত আজও জীবন্ত। ক্ষত যদিও সবক্ষেত্রে প্রদাহ নয়। মাঝে মাঝে বিরাট অভিমানে শূন্যতা নিয়ে এলে মানুষ বোঝে সম্পর্ক  বলে কিছুই ছিল না। যে বা যাঁরা বুঝিয়ে এসেছে অনিমেষকে তাঁরা আছে, তাঁরা যে কেউই নেই সেটা অনিমেষ ভালো মত বুঝে গেছে আজ। আসলে ‘ বোঝা ‘ আর  বোঝার মাঝে কিছু জিনিস দাঁড়িয়ে থাকে। সমাজ যা যা স্বীকৃতি দেয় তাঁর অধিকাংশই কুসংস্কার। যা আদতেই মুক্ত প্রাঞ্জল তাকেই ঘিরে রাখে সমাজের হাজার নিয়ম। অনিমেষ নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, যাঁরা এতকাল তাকে আঁকড়ে নেবে বলে নেয় নি, ধরবে বলেও রাখে নি ধরে, তাঁরাও কি অনিমেষের মত খুঁজে চলেছে কিছু? তাঁরাও কি ভালোবেসে পায় নি যাঁদের তাঁদেরও কি একটা করে অনিমেষ আছে? উত্তর নেই। চারিদিক স্থির, স্থবির, শুধু যাঁরা রেখে দেবে রাখতে পারে নি অনিমেষের মত মানুষদের, তাঁরা কি স্বার্থপর নাকি স্বার্থনির্ভর ?

অনিমেষ ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে নদীতে, গায়ের চামড়া খুলে যাচ্ছে অতঃপর।  খুলে রাখছে জামা, প্যান্ট, ইনার, জুতো, ব্রেসলেট, আংটি, মাদুলি, যা যা নিজের বলে এতকাল ভেবে এসেছে সে, সব কিছুই খুলে রাখতে হচ্ছে তাকে। সে জানে কোনোকিছুই চিরজীবন বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। তবুও, নিজের বলে,  সমাজের বলে দাবি  করে কেন মানুষ?  কিন্তু অনিমেষ, যাকে কেউই নেয় নি, ছেড়ে গেছে  বা ছেড়ে দিয়েছে যাঁরা, তাঁরা  কি এইবার অনিমেষের পাশে এসে সত্যিই দাঁড়াবে? জড়িয়ে নেবে দুই হাত? বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলবে যা যা করেছি সব ভুল? তোমার আমার মধ্যেকার টান যা অসামাজিক, অসভ্য বর্বর তাঁরা কি বলবে এসব আজ আর মানিনা? যাঁরা চোখে চোখ রেখে কিংবা ঠোঁটে ঠোঁট রেখেও ভালোবাসতে পারে নি তাঁদের তাঁরা শাস্তি দেবে? কোনো উত্তর নেই। আগে কিংবা পরে , পরে কিংবা পরবর্তীতে যে যে যা যা পায় না, তা তাঁরা কখনই পায় না। বুকের কষ্টেরা অভিমান হলে দূরত্ব বাড়ে, দূরত্ব বাড়তে বাড়তে মহাকর্ষের বাইরে চলে যায়, তখন তারা ঘুরে বেড়ায় মহাকাশে, অসীম শূন্যতায়। তাঁদের তখন কোনো মৃত্যু হয় না, জন্ম হয় না , তাঁদের কিছু থাকে না, না থাকে শূন্যতা, না  থাকে একাকীত্ব। কেবল ঘুরে বেড়ায় অনবরত। ধাক্কা খায় গ্রহে গ্রহে, উপগ্রহে উপগ্রহে। তাঁরাই কি তবে মৃত্যুঞ্জয়ী? তাঁরাই কি মৃত্যুর নামে বেচেঁ থাকে বছরের পর বছর। ঘোর কাটে অনিমেষের। চোখে আগুণের ফুলকি লাগে, আস্তে আস্তে বুঝতে পারে জ্বলে যাচ্ছে সেই দুই বাহু, যেখানে আজও লেগে আছে কাঁচের মতো গাল, নিভু নিভু চিবুক, বিধ্বস্ত শরীর, বিমর্ষ স্তন, প্রাপ্তবয়স্ক অব্যর্থ ভালোবাসা, নবীন প্রেম, মৃন্ময়ী আলো, প্রীয়ম্বদার অপেক্ষা। যা যা হতাশা সব মিশে যাচ্ছে এবার। চোখ পুড়িয়ে দিচ্ছে আঁচে, গুটিয়ে যাচ্ছে সেই সমস্ত নাভির মত টান, সেইসব মানুষরা এতকাল পর যেন কাছে এসেছে তার, কানে কানে উলুধ্বনি দিচ্ছে ‘ ওম্ শান্তি, ওম্ শান্তি’ বলে।  সব ছাই হয়ে যাচ্ছে। পড়ে থাকছে কেবল অর্জুন কুন্ড। সে আর পোড়ে না কখনই। কেন পোড়ে না ? কি আছে অবশেষ? সেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন একটাই যা যা পোড়ে না, পড়ে থাকে অদাহ্য হিসেবে সেখানেই কি  লুকিয়ে থাকে অনিমেষের সমস্ত কলঙ্ক নাকি জমাট বেঁধে থাকে অতৃপ্ত আত্মারা ? নাকি বর্বর অসভ্য বলে যা যা ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে এতকাল , তারই নির্যাসটুকু অনিমেষ  ‘ নাভি ‘ নামে ফেলে রেখে গেল পৃথিবীর বুকে ?

সব তর্ক হোক শেষ –       সব রাগ, সব দ্বেষ,

সকল  বালাই।

বলো শান্তি, বলো শান্তি,     দেহ-সাথে সব ক্লান্তি

পুড়ে হোক ছাই। “

                                                                                    – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ( মৃত্যুর পরে )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *