রঞ্জন দত্তরায়
লেখক পরিচিতি
(জন্ম ১৯৫৯ সালে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর থানার নড়িদানা গ্রামে। পূর্ববঙ্গ থেকে আগত পরিবারের সন্তান হলেও লেখকের এই গ্রামেই বেড়ে ওঠা। কর্মসূত্রে একটি বেসরকারি কলেজে যুক্ত ছিলেন। ছোট থেকেই লেখালিখির ঝোঁক। ছোট বড় নানা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে গল্প কবিতা প্রবন্ধ।গল্পগ্রন্থের নাম ক্যাকটাস ও অন্যান্য।)
বিষয় পরিচিতি
(দখিনের সমুদ্দুর থেকে হু হু করে ছুটে আসে নোনা বাতাস। গভীর সুন্দরবনের জংগলে মউলিরা যায় মধু আহরণে। মাছমারার দল গহীন খাঁড়িতে যায় কাঁকড়ার খোঁজে। কেউ কেউ ফেরে। কেউ আর ফেরেনা। ছেঁড়া গামছার নিশেন পোঁতা থাকে গরানের বনে। বনবিবির হাজতে হিন্দু রমনীর হয়ে মানত মানে মাজার থেকে ছুটে আসা মুসলমান পীর। বন্দুক হাতে বড় মিঞাকে চোখ রাঙায় দক্ষিণরায়। আয়লা,ইয়াশে, আচমকা প্লাবনে বাঁধ ভেঙে নোনা জল ঢুকে যায় চাষভূমিতে। মাটি হয় লবনাক্ত।
ওদিকে উত্তর থেকে শহর ক্রমশ এগিয়ে আসে নিম্নভূমির দিকে। হাতে হাতে স্মার্ট ফোন। দু চাকা চারচাকা ধোঁয়া আর ধুলো উড়িয়ে ছুটে যায় বিস্তীর্ণ বাদার বুক চিরে। জমি..জমি। জমি দখলের যুদ্ধে লাল নীল সবুজ হলুদ নানা রঙের পতাকা ওড়ে পতপত করে। জিন্স টিশার্ট টাঙানো মলগুলির জেল্লায় ক্রমশ বিবর্ণ হতে থাকে দু তিন পুরুষের দোকানদারি। বহুজাতিক কোম্পানির সম্ভার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয় ডেলিভারি বয়।
আর এই টানাপোড়েনের মধ্যিখানে বসবাস এই কলমচির। কানে আসে কতশত ভেসে আসা কথা। শহরের,আবাদের,জঙ্গলের নানা লবজের কথা। অটোয় নৌকায় ট্রেনে মটোরভ্যানে কথারা ধাক্কাধাক্কি করে। হাওয়ায় ভেসে যায় কথা। আবার কিছু কথা চুপিসারে ঢুকে পড়ে গোপন কুঠুরিতে। থেকে যায়। কিছু বলতে চায়। তাদের নিয়েই কথকতার জাল বোনার প্রয়াস এই লেখকের। নোনামাটির শোনা কথা।)
আমার দুগগা
ক্যানিং এ ব্রিজ হয়ে যাওয়ার পর গাড়ি এখন সোজা ঝড়খালি পৌছে যায়। সেখান থেকে লঞ্চে চেপে নদী কেটে কেটে সুন্দরবন ভ্রমণ। খান তিনেক গাড়িতে ঠাসাঠাসি করে বেরিয়ে পরা হল। ক্যানিং পৌছতেই প্রাণ সবার টা টা করছে একটুখানি চায়ে চুমুক দেবার জন্য। একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড় করানো হল গাড়ি। একটা ছোট্ট মত টিনঘেরা ভাঙাচোরা দোকান। মাটির উনুনে কয়লার আঁচে চাপানো হাঁড়ি। আজকাল তো কয়লার উনুন দেখাই যায়না। শহুরে, হাফ শহুরে লোকজনদের এ সব হল বেড়াতে যাবার উপরি মজা। হাঁকডাক শুরু হল, কইগো চা হবে তো? ভ্রমণার্থী দলে বিশেষজ্ঞ থাকবেনা এমনটা হতেই পারেনা। – জানতো, এরা যে গুঁড়ো চা ব্যবহার করে তাতে কাঠের গুঁড়ো মেশানো হয়? – কাঠের গুঁড়ো কি গো, চামড়ার গুঁড়োও মেশানো হয়। এইসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিনিময়ের মধ্যেই দোকানি মহিলা ভাঙা একটা হাতপাখা দিয়ে উনুনে হাওয়া দিতে শুরু করল। তা দেখে অকারণ ব্যাস্ততা, খুব দেরি হবে নাকি গো? আবার কয়লা দিতে হবে নাকি? তোমার ও পাখায় হাওয়া ঢুকবে তো উনুনে! সঙ্গীদের টিপ্পনি চলছিল।
তার মধ্যেই ভিতর থেকে শানিত একটা কন্ঠস্বর শুনে একটু চমকে তাকালাম। – ক’টা চা হবে?
আধা অন্ধকারে আগে বুঝতে পারিনি ভিতরে কেউ আছে। রোগা, কালোমতো এক কিশোরী। হাঁক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, – সবাই চা খাবে তো? এক এক করে গুনতি শুরু করলাম।
-আমরা তিনজন খাবনা। এক মহিলা সঙ্গী উত্তর দিলেন।
– প্রজাপতি বিস্কুট আছে, লোকাল বেকারির। দেখবে নাকি টেস্ট করে ? প্রায় আঁতকে উঠে একজন বললেন, – না না। কিচ্ছু না।
শাড়ি পরার ধরণ, হাতের চুড়ি, ঘোমটার প্রকরণ ইত্যাদিতে অনেক সময়েই ফুটে ওঠে জাত ধর্ম পরিচয়। মজা লাগে বেশ। গাড়িতে জাত-ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ব্যাপারীদের মুন্ডপাত হচ্ছিল এতক্ষণ। অথচ..।
-পনেরটা চা হবে। গোনা গুনতি করে বলি।
– কে চা করবে? তুই?
-হ্যাঁ। মেয়েটি উত্তর দেয়। পরনে বিবর্ন চুড়িদার। ওড়না। ওকে আগে দেখতে পেলামনা কেন! তত অন্ধকার তো নয় ভিতরটা। দড়মার দেয়ালে দড়ি দিয়ে ঝোলানো তক্তায় সাজানো বয়াম, কেতরে থাকা ক্যালেন্ডার.. সব তো পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।
– পাঁচটা লিকার হবে। চিনি ছাড়া। ঠিক করে বানাস। কাগজের গ্লাশ আছে তো?
– আছে। বিস্কুট দেব? কেমন যেন ছুঁড়ে ছুঁড়ে কথা বলছে মেয়েটা। একটু যেন বিরক্তি ভাব।
– দে গোটা দশেক। তোর বিস্কুট মিইয়ে যায়নি তো? আমিও একটু ঠেস মেরে বললাম।
– একদম টাটকা বিস্কুট গো বাবু। এই তো খানিক আগে গাড়ি এসে দে গেচে। হাওয়া দিতে দিতে উত্তর দেয় মহিলা। বেঞ্চিতে বসোনা, এক্ষুনি হয়ে যাবে।
বাঁশের ফালি দিয়ে বানানো ‘বেঞ্চি’। বসলাম। অন্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বসে বসে লক্ষ করছিলাম মেয়েটির চা বানানো। কত বয়স হবে? বারো তের বড়জোর। ফর্কের টুপি মাথায়, চোখে সানগ্লাশ লাগিয়ে সেলফি তুলছে এক বন্ধু-কন্যা। ওরই বয়সী প্রায়।
– পাঁচটা লিকার। চিনি ছাড়া। কথা ছুঁড়ে জানান দেয় মেয়েটি। একটা এলমুনিয়ামের থালা এগিয়ে দেয়। থালায় কাগজের কাপে চা। পাশে কাগজ মোড়া বিস্কুট। একটু মিস্টি করে বলা যায়না! আমরা তো তোর খদ্দের। খদ্দেরদের সাথে কথা বলাও শিখিসনি! মনে মনে গজগজ করি। আবার নিজেকেই বোঝাই, আহা। কি করেই বা মিস্টি কথা বলবে বেচারি! এইটুকু বয়সে এই চা দোকানের কাজ করতে ভাল লাগে কখনো! ওর এখন পড়াশুনার বয়স, খেলাধুলা করার বয়স।
চা নিয়ে সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে গেছে। আমি আমার স্বভাব কৌতুহলে জিজ্ঞেস করি, – হ্যা রে, ইস্কুল টিস্কুল যাসনা?
– যাই তো। এখন তো ছুটি আমাদের। একটু যেন ঝাঁঝ কমেছে মনে হল।
– ইস্কুলে যাস! বেশ বেশ। কোন ক্লাসে পড়িস?
– ইলেভেন। পরীক্ষা হয়ে গেছে। এবার টুয়েলভ হবে।
– টুয়েলভ! বিস্মিত গলায় বলি, বলিস কি রে! তোকে দেখে তো সেভেন এইটের মেয়ে মনে হয়।
আমার কথায় মেয়েটা হেসে ফেলে। ম্লান মুখে হাসিটা কিন্তু ভারি সুন্দর। কেমন মায়া মাখানো। বড্ড রোগা হাত দুটো। অপুষ্টির ছাপ।
– তা কোন স্ট্রিম? আর্টস?
– না না। সায়েন্স। পিওর। বায়োলজি এডিশনাল। এবার বেশ উৎসাহ নিয়েই বলে সে।
চমকিত হয়ে তাকাই ওর দিকে।
– পিওর সায়েন্স! সে তো বেশ কঠিন বিষয় রে। সামলাতে পারবি? আন্তরিক ভাবেই বলি আমি।
– মেয়ের নেকাপড়ায় খুব মাথা গো বাবু।আমি অতসব পড়াতি পারতুমনা। ফি বছর কেলাশে ফাসটো হয় তো। তাই মাস্টার দিদিমনিরা খুব সাহায্যি করে..। মহিলার পরনেও বেশ পুরনো শাড়ি। পরিশ্রমের ধকলে ভাঙা চোরা শরীর । বয়স বোঝা মুশকিল।
থালায় দুধ-চায়ের কাপ সাজিয়ে এগিয়ে দেয় মেয়েটি। আমি চা নিয়ে বলি, নাম কি তোর?
– তসলিমা। তসলিমা খাতুন।
– ওরে বাবা। তোর নাম তো একজন বিখ্যাত লেখিকার নামে। জানিস?
– জানি। তসলিমা নাসরিন। আমি উনার লেখা পড়েছি। ওর মুখের সেই কঠোর ভাবটা সরে গেছে। হাসি ফুটে উঠেছে। আমারও কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। এই হতচ্ছিন্ন দোকান, রুগ্ন চেহারা.. এগুলো তো ঠিক ই ছিল.. কিন্তু সায়েন্স স্ট্রিমের টুয়েলভ ক্লাশ, তসলিমা নাসরিন পড়া..এ গুলোকে যে কিছুতেই মেলাতে পারছিলামনা।
– তোর তো তাহলে এখন পড়াশুনার খুব চাপ। দোকানে বসিস কেন? মোলায়েম স্বরেই জিজ্ঞেস করলাম।
-কি করব, আম্মু একা পেরে ওঠেনা..
– কেন, তোর বাবা? কোন জবাব দেয়না মেয়ে। মুখটা কি আরো ম্লান হয়ে গেল আমার প্রশ্নে?
– বাবা দেখেনা আমাদের। মুখ নিচু করে বলে মেয়ে।
আমি কি বলব বুঝে উঠতে পারিনা। আন্দাজ করি বউ বাচ্চা ছেড়ে নতুন সংসার পাতার গল্প আছে। দোকানের ভিতরে নজর করে দেখি মেঝেতে একটা মাদুরে বিছানো বই খাতা। ও তাহলে নিচে বসে পড়াশুনা করছিল।তাই চোখে পড়েনি। পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটেছে বলেই মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে ছিল।
– ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভেবেছিস? কী হতে চাস? স্পষ্ট টের পেলাম আমার গলা থেকে যে স্নেহ মাখানো সুর বেরিয়ে এল, সেটা আরোপিত নয়।
– স্যর ম্যাডামরা তো নিটে বসাবে বলছেন। আলাদা কোচিং ও করাচ্ছেন। এখন তো ওইজন্যই খাটছি। দেখি কি হয়।
হিসাব করে দাম মিটিয়ে দিয়ে বলি, – তসলিমা মানে জানিস?
– সালাম।অভিবাদন। তসলিমা হাসে। চোখদুটি ভারি উজ্জ্বল লাগছে এখন।
– আমি আগাম সালাম জানিয়ে রাখছি, ডাক্তার ম্যাডামকে। বুঝলাম আমার রসিকতায় খুব আনন্দ পেয়েছে মেয়ে।
– আবার আসবেন। বলে তসলিমা।
– কখনো যদি এই পথে আসি। ঠিক খোঁজ করব তোর। তখন চিনতে পারবি তো? লজ্জ্বা পেয়েছে মনে হল। নামানো মুখের হাসিটা ক্লিক করে তুলে রেখে দিল মনের ভিতরে রাখা ক্যামেরা।
হই হই করে গাড়িগুলো রওনা দিল। রাস্তার পাশে বড় বড় স্কুল বিলডিং চোখে পড়ছে আর মনে হচ্ছে এটাই কি তসলিমার স্কুল? সাইকেল চালিয়ে কিশোরী মেয়েরা চলেছে স্কুলে। মনে মনে ভাবছি সে মেয়েও কি এইভাবেই স্কুলে যায় রোজ?
ফেরার পথে কথার ফোয়ারায় উঠে আসছে খাবার নিয়ে, টয়লেটের সমস্যা নিয়ে, নদীর পাড়ে কুমির দেখার দৃশ্য নিয়ে নানা কথা। সবাই যে যার মত অভিজ্ঞতার স্মৃতি নিয়ে ফিরছে। আর আমি ফিরলাম তসলিমা নামের এক কিশোরী কন্যাকে নিয়ে।
পাঁচ ছ বছর হয়ে গেল প্রায়। না। ক্যানিং এর ওদিকে আর যাওয়া হয়নি। কোনদিকেই আর যাওয়া হয়না
এখন। বাড়িতে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়ি। দেখি কত ছেলেমেয়ে কিভাবে দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে জয়ী হচ্ছে তার প্রতিবেদন। টি ভির অনুষ্ঠানে দেখি হাজারো প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে লড়াকু মেয়েদের হাসিভরা মুখ। এক একজনকে দেখি আর ভাবি এই বুঝি সেই মেয়ে।
একদিন আয়না মা! তুই তো জানিসওনা একটা বুড়োমত লোক রোজ তোকে খুঁজে চলেছে খবরের কাগজে.. টিভির পর্দায়…।
মান্দাস
বর্ষার দিনগুলো পেরোলেই শুরু হয় মনসার গান এর পালা। তিন রাতের বায়না। মটোর ভ্যানে চলে আসে মাইক লাইট আর পালাগানের কুশীলবেরা। তাদের থাকার জায়গা হয় পুরনো গোয়াল ঘরে আর মন্দির চাতালে।
সন্ধে হতেই বেজে ওঠে কনসার্ট। চাঁদ সদাগরের দম্ভ।সনকার কাকুতি। মনসার কুটিল অভিসন্ধি। পালা যত এগোয় দর্শকদের উত্তেজনাও বাড়ে। ঘটনা সব তো জানা। তবু পালা জমলেই সবার মনে কি হয় কি হয় ভাব। লখীন্দরকে সাপে দংশায়। বেহুলার ক্রন্দন। মান্দাস নিয়ে ভেসে যায় একাকী বেহুলা। লখিনের প্রাণ ফেরাতে পারলে তবেই সে ফিরবে। না হলে নয়। বেহুলার গানে মিশে যায় বুক ফাটা কান্না। ফ্লুট এর করুণ সুরে কাঁদে স্রোতা। কাঁদে অভাজন।
কাঁদে ভজার বউ উর্মিলাও। লখাই করছে যে ছেলে, সে এই দলে সবচেয়ে সুদর্শন। তার এমন দশা সয়না যে। সে যদি বেহুলা হত ওই কালনাগিনকে ঢুকতেই দিতনা ঘরে। আর এ মেয়েছেলে এখন দ্যাখোনা কেঁদে ভাসাচ্ছে। তা তুই যদি সতীলক্ষ্মী বউ হবি তো ঘুম এল কেন তোর চোখে? উর্মিলা কাঁদে আর গাল পাড়ে বেহুলাকে। সব দোষ যেন ওরই।
পরদিন পালাদলের দুপুরের রান্নায় উর্মিলার পালা। খেতে খেতে সব্বাই প্রশংসা করে উর্মিলা বউএর ফোড়ন মারা ঘন ডাল আর বগা মাছের অম্বলের। শুধু বেহুলা মুখ বেঁকিয়ে বলে ডালে নুন কম। আলুভাতে এট্টু লংকা পুড়িয়ে দিতি পারলেনা!
বড় বউ ঘরে এসে বলে, হ্যাঁ লা ছোট, ডালে কি নুন দিতি ভুলে গিছিলি?
উর্মিলা মুখ ঝামটে বলে, চুপ কর দিকি। সব্বাই ভাল বললে, আর ওর নুন কম হল। ও মেয়েছেলের স্বভাব বাঁকা। নইলে অমন সোন্দর বরটাকে সাপে কাটে?
বড় বউ চোখ কপালে তুলে বলে, ওই, তুই মেয়েছেলে বলছিস কাকে? ও তো ব্যাটাছাবাল রে।
উর্মিলা জবাব দেয়, তবে অত পিরিত দেখায় কেন? কেমন ব্যাটাছেলে ও?
বড় বউ মুখ টিপে হাসে। তারপর বলে, সত্যি ছোট, তোর ঢং দেখে আর বাঁচিনে। শোন, পালাগানের লোক কিন্তু পালাবে। খবরদার। তুই যেন মান্দাস ভাসাতে যাসনি। কেঁদে মরবি।
তসরের শাড়ি
– এখানটায় দুটো যামিনী রায়ের প্রিন্ট টাঙিয়ে দেব। আর ওপাশটায় ভ্যানগোঁর সানফ্লাওয়ার..
– না না। ওখানটায় ব্রাকেট লাগাব। ফাইন কাটগ্লাসের ব্রাকেট দেখে এসেছি সেদিন..
– নাঁ নাঁ.. ব্রাঁকেট নয়.. সাঁনফ্লাওয়ার..ওঁ মাঁ বঁলোনা..
নতুন টাইলস পাতা ফ্লোরে পা দাপায় বুনু। দেখতে দেখতে কেমন বুনোলতার মতো হিলহিলিয়ে বেড়ে উঠছে মেয়েটা। বেশি বয়সের সন্তান। হবার সময় কষ্ট দিয়েছে খুব। হাসপাতালে কদিন যমে মানুষে টানাটানি। মনে পড়ে বুনুর বাবার সেই ভয় মাখানো ক্লান্ত মুখটাকে। অত যন্ত্রণার মধ্যেও মানুষটাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল কল্যানী, অত ঘাবড়াচ্ছ কেন? তোমায় এভাবে পথে ফেলে আমি যাবনা। ঠিকঠাক স্নান খাওয়া কর। ছেলেদুটোকে দেখো।
সেই বুনুর এখন ইউনিভার্সিটি। একে শেষ সন্তান তার উপর কন্যা। মেয়ের উপর বাপের টান ছিল খুব। অথচ মেয়েটা সেভাবে পেলইনা বাবাকে।
আর পুলুটাও হয়েছে তেমন। বড় হয়েছিস, চাকরি করছিস, দুদিন বাদে বউ আনবি ঘরে, এখনও ছেলেবেলার মত সবসময় বোনের পিছনে লাগা।
– ছাড় না। ও কি করতে চাইছে করতে দে না ওকে। ছেলেকে কপট ধমক লাগায় কল্যানী।
– তুমি জানোনা মা, ওকে ছেড়ে দিলে বাড়িটাকে আর্ট গ্যালারি বানিয়ে ছাড়বে।
ছেলের দিকে তাকায় কল্যানী। রোগা পাতলা চেহারায় এখনও কলেজ পড়ুয়া মনে হয়। পাশ ফিরে তাকানোটা ঠিক ওর বাবার মতন।
– এ ঘরটা না হয় ওকে ছেড়ে দে। ও নিজের ইচ্ছেমতো যেমন খুশি সাজাক। তোর ঘরে বুনুর কোন কথা গ্রাহ্য হবেনা। ঠিক আছে? মধ্যস্থতা করে রাতুল। বড় ছেলে। কলেজে পড়তে পড়তেই বাড়িতে কিছু না জানিয়ে কেটারিং বয়ের কাজ করেছে। জানতে পেরে ওর বাবা বকাবকি করেছিল। কিন্তু তখন দোকানের অবস্থা ভাল না। ওর রোজগারের কুড়ি পঁচিশ টাকাও তখন সংসারে খুব দরকারি। অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে বেঁচে যাওয়া খাবার দাবার পলিপ্যাকে করে বাড়ি নিয়ে আসত। ভাইবোন দুটো রাত জেগে দাদার ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকত। রুগ্ন মানুষটার মুখেও একটু স্বাদের খাবার দেওয়া যেত তবু।
দীর্ঘশ্বাস ফেলত মানুষটা। বলত, কোন কিছুই ঠিকমতো করতে পারলামনা কনি। ওইটুকু বয়স, কোথায় পড়াশুনা করবে, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরবে, সিনেমা থিয়েটার দেখবে.. তাকে কিনা রোজগারে বেরুতে হচ্ছে.. দোকানটা যে ভাল করে সাজাব, না আছে পুঁজি না আছে শরীরের জোর..।
সেই ছেলে রাতুল। এখন এলাকার সবচেয়ে বড় ডেকরেটার্স ক্যাটারার্স এর মালিক। এখন ওর কাছে কাজ করে সেই বয়সের জনা কুড়ি রাতুল।
– মা, দেখুন, আমার বাপের বাড়ির জন্য পুজোর কেনাকাটা। ঢাউস একটা প্যাকেট নিয়ে ঢুকল সুমিতা। – দেখি দেখি..বন্যা প্রায় ছিনিয়ে নিল ব্যাগটা। সোফার উপর একে একে বার করতে লাগল সব। এটা বাবার। এটা ঠাম্মার..। সুমিতা খুলে খুলে দেখায়।
– বৌদি,আমাদের বাড়ির গুলো কিন্তু আমি আর তুমি যাব কিনতে। দাদাকে নেবেনা।
-ঠিক বলেছ, এত তাড়া লাগায়। ঠিকঠাক পছন্দ করাই যায়না ও থাকলে.. সুমিতা বলে।
কল্যানী দেখে নতুন নতুন জামা কাপড়ের সম্ভার। পুজো এসে গেল তাহলে..।
সেবার পুজোয় এমন অবস্থা যে ছোট দুজনের জন্যও কিছু কেনা হয়নি। পুলু তবু একটু একটু বুঝতে পারত। কিন্তু বুনু রোজ আবদার করে, আমার জামা কখন আনবে, ও বাবা.. মানুষটার মুখের দিকে যেন তাকানো যেতনা। দোকানে বিক্রিবাটা প্রায় নেই। মেয়েকে এত ভালবাসেন, অথচ..।
পুজোর ষষ্ঠীর দিনে রাতুল নিয়ে এল পল্লবের জন্য শস্তা একটা জামা আর বুনুর একটা ফ্রক। দুই ভাইবোনের তাতেই কি আনন্দ। বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। বালিশের পাশে রেখে ঘুমায়।
কল্যানী দেখেন সোফার উপর বিছিয়ে রাখা নতুন কেনা বস্ত্রসম্ভার। কল্যানী দু চোখ ভরে দেখেন। ডিস্টেম্পার দেওয়াল..পাথর বসানো মেঝে..ঝকমক নতুন দোতালা.. ছেলে মেয়ে বউ.. পুজোয় সবার জন্য নতুন নতুন জামাকাপড়.. এ সব যদি দেখে যেতে পারত..
মাঝরাতে উঠে বসে থাকত চুপচাপ। জীবন যুদ্ধে হারতে হারতে ভেঙে পড়া একটা মুখ। পুজোয় যখন সবাই আনন্দে মেতে উঠত, তখন মানুষটা মুখ লুকিয়ে বেড়াত। পুজো মানে আর একবার হেরে যাওয়া। মুখ লুকোনোর পালা।
বড় ছেলের রমরমা ব্যবসা, ছোট ছেলের চাকরি, মনের মত বউ, নাচ গান শেখা মেয়ে.. এসব যদি দেখে যেতে পারত..।
রাতুলের কথায় চমক ভাঙে কল্যানীর। – মা, সুমিতা বলছিল এবার পুজোয় তোমার জন্য একটা তসরের শাড়ি আনতে। পুজো আচ্ছায় পড়তে পারবে..
প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে কল্যানী। – নারে বাবা না। আমার ওই মোটা সূতিকাপড়ই ভালো। অত দামী তসর আমার সহ্য হয়না। গা কুটকুট করে।
শাট ডাউন
-দ্যাখো, এই ডিজাইন কি তোমার দোকানে ছিল? মঞ্জুলা শাড়িটা মেলে ধরে চোখের সামনে। -আঁচলটা দেখেছো? কি দারুণ কালার কম্বিনেশন না? সমীরণ দেখে। মনে মনে ভাবে সত্যি, এই ডিজাইনের শাড়ি তার দোকানে নেই। বড়বাজারে সে যে ঘর থেকে মাল তোলে সেখানে এসব ডিজাইন পৌঁছয়নি এখনও।
– বাবা তো এগুলোর নামই শোনেনি.. হাসতে হাসতে মেয়ে তার পোষাক দেখায়। নাম শুনেছে। কিন্তু এগুলোও তার দোকানে নেই। চলবেনা। সদরে দোকান হলেও তার খরিদ্দারদের সিংহভাগই গ্রামের লোকজন। সালোয়ার কামিজ, চুড়িদার কুর্তা জিন্স লেগিংস.. এগুলোই চলে।
অনলাইনে অর্ডার দিয়ে নিজেদের পছন্দসই পোষাক আনিয়েছে মা-মেয়ে। সমীরণ গাঁইগুঁই করেছিল। -দোকান থেকেই তো নিয়ে আসতে পার যা খুশি। কেনাদামেই হত। এতগুলো নগদ টাকা খরচ শুধুশুধু..। পাত্তা দেয়নি মা-মেয়ে।
মহিমবাবু পড়াশুনা করা লোক। দোকান ফাঁকা থাকলে মাঝেমাঝে বসে গল্পগুজব করেন। তিনি বলেছিলেন একদিন, – পারবেনা সমীরণ, তোমরা আর ব্যবসা করতে পারবেনা। বিশাল এক অজগর হাঁ করে ধেয়ে আসছে। তোমাদের ব্যবসা পত্তর সব গিলে নেবে..।
মহিমবাবুর কথায় ভয় যে হয়নি একেবারে তা নয়, তবে মনকে বুঝিয়েছে অনলাইন, শপিং মল ওসব শহুরে ব্যাপার। গ্রামে অত প্রভাব পড়বেনা।
চাকরি বাকরি নেই, দোকানপাট বেড়ে যাচ্ছে ব্যবসায় তাই হয়ত একটু মন্দাভাব, এমনটাই ভাবত সমীরণ। কিন্তু লকডাউন শুরু হতেই বিশাল বিশাল ব্যাগ নিয়ে গ্রামে গ্রামে হু হু করে ঢুকে পড়ল পার্সেল ডেলিভারির বাইক স্কুটি সাইকেল।
মাঝবয়েসী জগন্নাথবাবু বছর পাঁচেক ধরে কাজ করছিল দোকানে। ছাড়িয়ে দিতে হল। জগন্নাথবাবু আর কি ই বা বলবেন। নিজেই তো জানেন বিক্রিবাটার যা হাল তাতে ইলেকট্রিক খরচই ওঠেনা, কর্মচারীর বেতন আসবে কোথা থেকে।
জগন্নাথ বাবু নেই, দোকানটা যেন খাঁ খাঁ করে আজকাল। এক একদিন সমীরণের ধূপধুনো দিতে, ঝাড়পোঁছ করতে ভুল হয়ে যায়। জগন্নাথ বাবুই করতেন এসব কাজ।
সন্ধে থেকে বিক্রিবাটা কিছুই হলনা আজ। আলোগুলো নিভিয়ে দোকানের শাটার খুব আস্তে করে নামায় সমীরণ। অন্যদিনের মত ঘড়ঘড় আওয়াজটা বিরক্তির কারণ হয়না কারো। শাটারে যত্ন করে চার চারটি তালা লাগায়। রোজকার মত খবরের কাগজ জ্বালিয়ে আগুন দেখায় বন্ধ দরজাকে। মাথা ঠেকায় শাটারে। আধো অন্ধকারে চাবিগুলোকে মুঠোয় ধরে দাঁড়িয়ে থাকে একটু। তারপর ছোট থলেটায় ভরে নেয় চাবির গোছা। কাল থেকে আর সে শাটার তুলবেনা। মন্টু প্রোমোটার পিছনে পড়েছিল অনেকদিন ধরেই। আজ বায়নানামায় সই করে দিল।
বিজয়ার মিষ্টি
বছর চল্লিশ আগে একটা দুর্গামন্ডপ দেখতে হলে অন্তত মাইল দুয়েক হাঁটতে হত।
একটা কাঠপুলের দুধারে ছিল গুটিকয় দোকান। সেখানেই ছিল আমাদের আড্ডা। আর ছিল চায়ের বাজিতে টুয়েন্টি-নাইন তাসপেটা। যে দল হারবে তারা দেবে বিজয়ী দলের চা য়ের দাম। মাঝে মাঝে দল বেঁধে ম্যাটিনি শোয়ের সিনেমা দেখা। সেই আড্ডা থেকেই উঠে এল দুর্গাপুজোর ইচ্ছে। বিল ছাপানো, চাঁদা তোলা..। সবাই নগদ টাকা দিতে পারতনা। কেউ কেউ কলসি থেকে বের করে দিত একখুঁচি চাল। থলে নিয়ে যেতে হত সঙ্গে। জেনারেটরের আলোয় শুরু হল এলাকার প্রথম দুর্গাপুজো।
সেই পুজো এখন অনেক জমজমাট। কিন্তু আমরা প্রায় কেউই আর জড়িয়ে নেই সেই পুজোর সাথে। যুগ বদলের সাথে তাল মেলাতে না পেরে একটু দূর থেকেই পুজো দেখি আজকাল।
বিসর্জনের পরদিন সকালে ক্লাবঘরের ভিতর থেকে কিসের যেন চেঁচামেচির আওয়াজ এল কানে। ভুলোর গলা না? উৎসুক হয়ে উঁকি মারতেই ভুলো পাকড়ে ফেলল আমায়। .. এই দেকো, সেই গোড়া থেকে..যখন এই বাবুরা পুজো করত.. তখন থেকে পুজোর যোগাড় দে আসছি আমি..এই ভুলো সরদার..বিশ্বেস না হয় জিজ্ঞেস করে দেখো… আর আজ তোমরা আমায় টাকা দেখাচ্চো? দু হাজার টাকা! সেই পঞ্চমী থেকে রাতদিন পড়ে আছি। তা কি তোমাদের ওই দু হাজার টাকার জন্যি? আমার খাটনির দাম দিতি পারবে?
ক্লাবের যুবকদলও বেশ উত্তেজিত। টাকা বেশি চাই তো বল কত দিতে হবে। ফালতু চেল্লাচ্ছ কেন? দেখুন দেখি কাকু। প্রতিবারই লোকটা পেমেন্টের সময় কেন যে ফালতু ঝামেলা করে বুঝিনা..। ছেলেগুলোর দিকে তাকালাম। কেন যে ঝামেলা করে তা এরা বুঝবে কি করে!
কতদিন বাদে ভুলোকে সামনে থেকে দেখলাম। বুঝলাম আমিও বুড়ো হচ্ছি। পুজোর মিটিংয়ে আমরা ভুলোকে ডাকতাম। মন্ডপ সাফ করা, ভাঁড়ার সামলানো, পুরোহিত ঠাকুরের ফাই ফরমাশ খাটা সব একা সামলাত ভুলো। আমরা ওকে দিতাম ধূতি গেঞ্জি গামছা আর শাড়ি। সেটাও দিতে হত খুব কুন্ঠিতভাবে। সদস্যদের বাড়ি বিজয়া করতে গেলে ভুলো আমাদের অবশ্য-সঙ্গী। সেদিন ওর মদ্যপান নিষেধ। ভুলোকে আমরা কেউ আলাদা ভাবিনি। এই নব্য ছেলেরা কি করে বুঝবে কেন এত রাগ দেখায় মানুষটা!
একটি মাতব্বর গোছের ছেলে চোখে মিনতির ভাব এনে ইশারায় আমায় ম্যানেজ করার আর্জি জানায়।
.. তখন কোথায় ছেল এরা? বাঁশ ঘাড়ে করে এনে প্যান্ডেল বেঁধিচি..ঠাকুরের মাটি তুলে এনিচি খালপাড় থেকে। আজকের ছাবাল সব..টাকা দেখাচ্চে আমারে.. ভুলো গরগর করছে রাগে।
আমি বললাম, ও সব পড়ে হবে। আয় আগে কোলাকুলিটা সেরে নিই..।
রাগী মুখটা মুহুর্তে কেমন নরম হয়ে গেল। হাসি ফুটে উঠল মুখে। দু হাত ছড়িয়ে আমায় টেনে নিল বুকে। ফিসফিস করে বললাম, ছেলেপুলেদের উপর রাগ করতে আছে? যা দিচ্ছে হাসিমুখে নিয়ে নে।
ভুলো বলল, আচ্ছা তোমার কথা রাখব। কিন্তু আমার একটা কথাও রাখতি হবে তোমায়। আমি জিজ্ঞাসার চোখে তাকাতে ও বলল, অনেকদিন বাদে তোমায় পেইছি। আমি মিস্টি খাওয়াব। খেতি হবে কিন্তু।
আমার যে মিস্টি বারণ ওকে আর বললামনা। একদিন অনিয়ম হোক। বিজয়ার মিস্টি.. তা ও তো মুখে নিইনি কতদিন।
দান মানে চাল
লোকটার গায়ের ফুলশার্টটি যত ময়লা ততধিক ময়লা পরনের ধুতিটি। একগাল খোঁচা খোঁচা দাড়ি।সুতোবাঁধা গোলফ্রেমের চশমা।কাঁধে একটা লম্বা ক্যাম্বিসের থলে। কিন্তু মুখের হাসিটি ছিল বেশ মন কাড়া। আমাকে দেখলেই বলত কি বাবুমশাই, পড়াশুনা হচ্ছে তো ঠিকমত?
প্রায়ই সকাল বেলায় দেখতাম বাবার সাথে বারান্দায় বসে কি সব কাগজ পত্র বার করে হিসেব নিকেশ করছে। মাঝে মাঝে ঝগড়াও হত দুজনের।
– আপনার জন্য শেষে আপনার জামাইরা না কোর্টে তোলে আমায়..।
বাবার কথায় রাগ দেখাত সে বুড়ো।
– তুমি থামতো..হুঃ..জামাই..জন জামাই ভাগনা তিন নয় আপনা..।
আমার যে মানুষটাকে মনে আছে পরিস্কার তার কারণ অন্য। সে বুড়ো ছিল আমার খেলার পার্টনার। মাঝে মধ্যেই তাকে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে হত অনেকক্ষণ। আর সে সময়টা সে আমার সাথে অদ্ভুত একটা খেলা খেলত। খেলাটার নাম আঁদফাঁদ।নামটা ওর কাছ থেকেই শোনা। ছটা ছোট ছোট খোলামকুচির টুকরো। ওগুলো হল গুটি। তিনটে আমার তিনটে ওর। সিমেন্টের রোয়াকে উনিই দাগ কেটে কোর্ট বানাতেন। খুবই সোজা। ছোট মত একটা বর্গক্ষেত্র। কোনাকুনি ক্রসের মত দুটো দাগ আর সোজা আড়ে যোগ চিহ্নের মত দুটো দাগ। এক প্রান্তে আমার গুটি, অপর প্রান্তে ওনার। এক একটা চালে একদাগ করে গুটি এগিয়ে খেলা। কোনাকুনি পাশাপাশি লম্বালম্বি যেভাবে হোক যে তার গুটি তিনটিকে আবার এক লাইনে আনতে পারবে তার জিত। জিতলে ফোকলা মুখে খুব হাসত বুড়ো। আর আমি জিতলে মাথা চুলকে বলত আমার চালে বড্ড ভুল হয়ে গেছে গো বাবুমশাই..। খুব মজা হত বুড়োকে হারিয়ে।
মা মুড়ি নারকেল দিলে কি খুশি। খানিক খেয়ে থলের ভিতর থেকে কাগজের ঠোঙা বার করে তাতে বাকিটা ভরে নিয়ে রেখে দিত থলের মধ্যে। একগাল হেসে আবদার করত – মা জননীর হাতের এককাপ চা খাব যে…।
পরে জেনেছি লোকটা পোর্ট ট্রাস্টে চাকরি করত। পয়সা কড়ি জায়গা জমি যথেষ্টই। কিন্তু হাড় কেপ্পন। কোনদিন একটু ভালমন্দ বাজার করেনি। একটা ভাল পোশাক পরেনি। মেয়েদুটিকে অল্প বয়সেই নমো নমো করে পার করেছে। সেই মেয়ে জামাইদেরও দুদিন থাকতে দেয়না খরচার ভয়ে।
-এত কিপ্টেমি করে পয়সা জমাচ্ছে বুড়ো, মরে গেলে সেই সবতো খাবে ওই ধম্মের ষাঁড় জামাইরাই। লোকজন বলাবলি করত।
জামাইরা কি করেছিল জানিনা, তবে দুই মেয়ে এসে একদিন খুবই শাপসম্পাত করে গেল বাবাকে। তারা বিদায় হতেই দেখি বাবা খুব হাসছে। আমার কৌতুহল মেটাতে জানাল, বরদা মুখুজ্জের গোঁ, একটা হাইস্কুল করবে। জমি সম্পত্তি টাকা পয়সা সব দান করে দিল ইস্কুলের জন্য। আর তার মুরুব্বি হলাম আমি। গাল তো খেতেই হবে।
বরদা মুখোপাধ্যায় শিক্ষাসদন এখন এলাকার নাম করা স্কুল। হাজার হাজার ছেলে মেয়ে প্রথম প্রজন্মের স্কুল শিক্ষা পেয়েছে এই শিক্ষা সদন থেকে। সেদিন সেই স্কুলে গিয়েছিলাম একটা অনুষ্ঠানে। বিশাল তোরনদ্বারে নামফলক দেখে মনের মধ্যে ভেসে উঠল সেই ময়লা পোশাক পরা বৃদ্ধটির ছবি। তার নাতি নাতনিরা শুনেছি কেউ তেমন লেখাপড়া করেনি। দারিদ্রেই আছে। মনে মনে ভাবলাম এভাবে সর্বস্ব দান না করে মেয়েদের জন্য কিছু রাখা কি উচিত ছিলনা ভদ্রলোকের?
বরদাবাবুর একটা মূর্তি বসানোর প্রস্তাব দিতে হেসে উঠলেন বর্তমান কর্মকর্তা। -ওনার একটা ছবিও পাইনি দাদা। খরচার ভয়ে ছবি তুলতে দেননি কাউকে।
মনে হল যেন সেই মানুষটি মিটিমিটি হাসছেন আমার দিকে তাকিয়ে। তিনি বললেন, – দান মানে যেমন খরচ করা, দানের আরেকটা মানে আছে জানতো? দান মানে হল চাল। লুডোখেলায় বলেনা এবার আমার দান এবার তোমার দান.. তা আমার চালটা তো আমি চেলে দিয়েছি বাবুমশাই। এবার তোমার দানটা কেমন চালবে ভাব। আমি দেখি কেমন খেলোয়াড় তুমি। মিটমিট করে হাসছেন তিনি।
আর আমার ভিতরটা কেমন হু হু করে উঠল। আমার হাতে অনুষ্ঠানের আয়োজকদের দেওয়া উপহার সামগ্রী, ফুলের স্তবক। আমি চাল দেব কি করে, হাত তো আটকানো!
বুড়ো অমাবস্যা
কালীপুজোর রাত। তাকে বলে বুড়ো অমাবস্যা। সে অমাবস্যার গা ছমছমে গল্প কম নয়। বছর দশের দুবলা এক বালকের পক্ষে তা চাপের ছিল বইকি। তার বাড়িতে যতই পাত্তা না দিক, বাড়ির বাইরেই তো আসল দুনিয়া। ফিসফিস কত কথা, এই অমাবস্যায় কারা নাকি তুক করে কেটে নেবে মাথা থেকে একগোছা চুল। ব্যাস। দিনে দিনে রক্ত শুকিয়ে যাবে। পরদিন সকালে দেখাও যেত কাঁচারাস্তার তেমাথায় পড়ে আছে কলাপাতায় সিঁদুর মাখানো মাটির ঘট। আমের পল্লব। আরো কি সব। দেখেই সে বালকের বুক ধড়ফড়।
সন্ধে হলেই বাড়ির পাঁচিলে মোমবাতি জ্বেলে দেওয়া, কলার ভেলায় জ্বলন্ত বাতি পুকুরে ভাসানো, বেশ খুশিয়াল মন। কিন্তু সেইসংগে একটা বিষন্নতা। খেলার সঙ্গীরা যে শুকনো গাছের ডাল আর পাতা দিয়ে বানিয়েছে বুড়ির ঘর। ডালপাতা সংগ্রহে সে ও তো অংশ নিয়েছিল। একটু পরেই আগুন লাগানো হবে সে ঘরে। দাউদাউ আগুনের আঁচে নাচ করবে ওরা। সেখানে যাওয়ার জন্য মন উচাটন। কিন্তু তার যে সন্ধের পর বেরুনো বারন।
রোদে সেঁকা বাজিগুলো সে একা ফাটাবেই বা কি করে? ভয় লাগে যে। তার এলেম তো তারাবাজি, রং মশাল আর চরকি পর্যন্ত। খবরের কাগজ পাকিয়ে দূর থেকে দোদমায় আগুন লাগিয়েই ছুট্টে পালিয়ে আসা। একা ভাল লাগে!
তাহলে কি ঠাকুর দেখা হবেনা? সহায় ছবিদি।বাড়িতে সে দুধ দেয় রোজ। মা ডাকে ছবিদি। আমিও। তার দাপট খুব। আমায় নিয়ে চলল ঠাকুর দেখাতে। বিজলি আলো তখন কোথায়! ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছবিদির সাদা থান। ছবিদিও তুকতাক কম জানেনা। নানা মন্তরে আমায় সুরক্ষিত করে হাত ধরে হাঁটে। দূরে আকাশ চিরে চলে যায় হাউই। এঁদো ডোবাটা কেমন রহস্যময় লাগে। খেলার মাঠটা মনে হয় সদ্য পড়া ভুশণ্ডির মাঠ। ওই তো পুজোর প্যান্ডেল। হ্যাজাক জ্বলছে। বেদিতে প্রতিমা। একপাশে কজন বউ ফল কাটছে। ওরা ছবিদিকে কেমন আড়ে আড়ে দেখছে। কেমন চুপচাপ। একটা খুঁটিতে বাঁধা একটা ছাগল। পাতা চিবুচ্ছে। ছবিদি বলল, ওটা বলি হবে রাতে। আমি প্রতিমার দিকে দেখি। দেখি একটা শিয়াল বসে আছে নিচে। আমার ভয় লাগে। বলি, ছবিদি বাড়ি চল।
অপরাজেয় মানুষ
শম্ভুকাকা ছিলেন অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের এক গরীব স্কুল শিক্ষক। কিন্তু তার চরিত্রে ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন প্রতিবাদী মনোভাব। একদিকে যেমন বিনা পয়সায় গরীব ছাত্র ছাত্রীদের পড়াচ্ছেন, অন্যদিকে প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার। আর সে কারণেই গ্রামের মাতব্বর নরেন মন্ডলের কাছে তিনি ছিলেন একেবারে চক্ষুশূল। নরেন মন্ডল ছিল এম এল এ সাহেবের তখনকার ভাষায় বড় চামচা। সে এক সময় গেছে। এম এল এ র গাড়ি গেলে একমাইল দূর থেকে তার হর্নের আওয়াজ পাওয়া যেত। গ্রামের লোকজন আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। চামচাগিরির সুবাদে নরেন মন্ডল গরিব মানুষের জমি জায়গা সামান্য পয়সায় লিখিয়ে নিয়ে দখল করছে। কেউ গাঁইগুঁই করলে নরেনের মস্তান বাহিনির সন্ত্রাস। শম্ভুকাকা বারেবারে এগিয়ে যান প্রতিবাদ করতে, কিন্তু সে প্রতিবাদ দানা বাঁধেনা। ভীত মানুষ মেনে নেওয়াকেই ভবিতব্য মনে করে। নরেন মন্ডল ফিকির খোঁজে শম্ভুবাবুকে জব্দ করার। ক্ষমতার বিরুদ্ধাচারণ সহ্য হয়না এম এল এ সাহেবেরও। একদিন এক শালিশী সভায় প্রকাশ্যে হুমকি দেন তিনি। – আমার কাছে খবর আছে আপনি উগ্রপন্থিদের মদত দিচ্ছেন। অস্ত্রশস্ত্র জড়ো করছেন। আমার এরিয়ায় এসব কিন্তু বরদাস্ত করবনা..।
সবাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। অমন নীরিহ একজন মানুষ, উগ্রপন্থী! অস্ত্রের কারবারি! মেলাতে পারেনা কেউ।
কিন্তু যে মেলাবার সে মিলিয়ে নেয়। কদিন পরই নরেন মন্ডলের পোষা গুন্ডারা আক্রমণ করে শম্ভুকাকার বাড়ি। ওই বাড়িতে নাকি বোমা মজুত ছিল। বাইরে হিচড়ে টেনে এনে রোগা শরীরটার উপরে চলতে লাগল লাথি ঘুঁষি লাঠির বাড়ি। দুটি অবুঝ শিশু হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। কাকিমা ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লে তাকে যেভাবে বলপ্রয়োগ করে সরানো হল সেটা শ্লীলতাহানির চেয়ে কম কিছু নয়। নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে, কিন্তু তাতেও মারের ক্ষান্তি নেই। অবশেষে অচেতন শরীরটিকে পুলিশ এসে তুলে নিয়ে গেল। কালা আইনের কবলে ফেলে তাকে বিনা বিচারে জেলবন্দি করা হল। অসহায় কাকিমা মুড়ি ভেজে, ঠোঙা তৈরি করে বাচ্চাদুটিকে আঁকড়ে দিন কাটাতে লাগলেন। সবাই বলাবলি করত শম্ভুবাবুর পরিবারটি ধ্বংস হয়ে গেল।
রাজনৈতিক পট বদল হল, বন্দীমুক্তিতে বাইরে এলেন শম্ভুকাকা। কিন্তু পুলিশের অত্যাচারে তখন তার শরীর জরাজীর্ণ। নতুন ক্ষমতাবানদের কাছেও শম্ভুকাকা ব্রাত্যই থেকে গেলেন। ইস্কুলের চাকরিটি অবশ্য ফিরে পেয়েছিলেন। অভাব,অবহেলার ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়া সন্তান দুটির পড়াশুনা শুরু হল আবার। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে দারুণ রেজাল্ট দু জনেরই। নতুন অংকুর। নতুন গজানো পাতা।
শম্ভুকাকা বেশিদিন বাঁচেননি। কিন্তু সেই এম এল এ এখনও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বিছানায় দিন কাটাচ্ছেন। কথা বলতে পারেন না। শোনা যায় সম্পত্তি লিখে দেবার জন্য বৃদ্ধ নরেন মন্ডলকে তার গুণধর দুই পুত্র প্রায়শই বেধড়ক ঠ্যাঙায়।
এদিকে সেই অংকুর এখন মহীরুহে পরিণত হতে চলেছে। শম্ভুকাকার ছেলে এখন ডাক্তার। এই করোনাকালে তার প্রাণ বাজি রেখে সেবাকর্ম খবরের কাগজ, সোস্যাল মিডিয়াতে বারবার উল্লিখিত। মেয়ে স্কুল শিক্ষিকা। অসহায় দরিদ্র মানুষজনের জন্য সে ও তার স্বামীকে নিয়ে কিছু না কিছু করে চলেছে।
এভাবেই ধ্বংসের ভিতর থেকেও কিভাবে বেঁচে উঠেছেন শম্ভুকাকা তা দুচোখ ভরে দেখি আর বারবার উচ্চারণ করি, অসদো মা সদগময়…তমসো মা জ্যোতির্গময়…মৃত্যুর্মামমৃতম গময়ো.. ওম শান্তি..ওম শান্তি..ওম শান্তি..।
তুই ফেলে এসেছিস
ঘুম থেকে উঠে দেখি আকাশ যেন একটা উপুড় করা কালো গামলা। একটু একটু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছেনা। হাঁকডাক করে হবে হবে এমন একটা ভয় দেখিয়ে চলেছে। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি রাস্তায় লোক চলাচল প্রায় নেই। তাহলে কি আজ হাঁটতে যাওয়া হবেনা!
কিন্তু মেঘ ভরা কালো আকাশ, নিথর প্রকৃতি কেমন যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায়। যা হয় হবে এমন ভেবে ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
যেখানটায় হাঁটতে যাই রোজ, সেটা সদ্য হওয়া একটা বাইপাস। দু পাশে বিস্তির্ণ ধানক্ষেত। কোন বাড়ি ঘর নেই। ভোরের দিকটায় অনেকেই হাঁটতে আসে। কিন্তু আজ দেখছি একটাও লোক নেই। ভারি ভারি ট্রাক দু একটা বেরিয়ে যাচ্ছে গম্ভীর ভাবে। পূব দিকে মুখ করে দাঁড়ালাম। সূর্যটাকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করলাম খানিকক্ষণ। বৃথা চেষ্টা। আর এর মধ্যেই হুড়মুড়িয়ে নেমে এল বৃষ্টি। আমার যে ছাতা তাতে মাথা ছাড়া আর কিছুই বাঁচবেনা। অগত্যা ফেরার রাস্তায়।
একটু এগিয়ে দেখি ধাবা মত একটা দোকান খুলেছে। দোকান মানে চারপাশ খোলা। মাথার উপর একটা পলিথিনের ছাউনি। চা পাঁউরুটি ঘুগনি এইসব। দুপাশে কয়েকটা ইটের উপর ইলেক্ট্রিকের ভাঙা পোস্ট পেতে একটা বেঞ্চ বসার মত। ওখানেই ঢুকে পড়ি। বছর বারো চোদ্দর দোকানদারটি দেখি গজগজ করছে, “ধার হবেনি কিন্তু। নগদ পয়সা দিতি হবে বলে দিচ্ছি..”।
বেঞ্চের উপর উবু হয়ে বসে থাকা যার উদ্দেশ্যে গজগজানি তাকে দেখি ভাল করে। ময়লা লুঙ্গি।বিবর্ণ ফতুয়া। গালে খোঁচা খোচা দাড়ি। গ্রামাঞ্চলে বয়স ঠাহর করা খুব সহজ না। তবু আমার চোখ বলছে পঞ্চাশের কাছেই হবে। মানুষটা কিন্তু কোন উত্তর দিচ্ছেনা। চুপ। হয়ত গজগজ করেও অবশেষে চা ঠিকই দেবে এমন আশায়।
ছেলেটি আমায় বলল,” চা দেব?”
কোনদিনই এই দোকানে চা খাইনি। কিন্তু আজ তো বৃষ্টি না থামা অবধি বসতেই হবে। বললাম,
“লিকার হবে তো? দে তাহলে”।
দোকানে আর কেউ নেই। নজর পড়ল লোকটার উপর। বললাম, “তোমার জন্য একটা বলি? চা খাবে তো?”
লোকটা কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। বললাম, “আমিই খাওয়াব। তোমায় পয়সা দিতে হবেনা”।
এবার হাসি ফুটল মুখে। চা বিস্কুট দিতে বললাম ওকে। খুব যত্ন করে বিস্কুট ডুবিয়ে ডুবিয়ে চা টা খেল। তারপর ফতুয়ার পকেট থেকে বিড়ি বার করল। আমার দিকে এগিয়ে দিল একটা। আমি হেসে বললাম, “আমার তো চলেনা”।
লোকটা নিজে বিড়ি ধরিয়ে টান দিতে লাগল। তারপর নিচু গলায় গান ধরল নিজের মনেই। ..সাধুগো আমার উপায় বলনা..আমার তিক্ত কটু কমন্ডলু..হাড়ের তেতো গেলনা.. রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গাওয়া এ গানটা আমারও খুব প্রিয়। লোকটার গলায় সুর আছে। ভেজা বাতাসে যেন দোকান ছাড়িয়ে বাদায় ছড়িয়ে গেল সে সুর। কত নিশ্চিন্ত একটা মানুষ। কোন তাড়া নেই। কোন উদ্বেগ নেই। অবাক হয়ে দেখছিলাম ওকে।
মাঠ ধুয়ে যাচ্ছে বৃষ্টিতে। গাছপালা গুলো স্নান করছে ধারা জলে। যদি চুপ করে ওর পাশে বসে থাকতে পারতাম এইভাবে.. আর ও যদি শুনিয়ে যেত একটার পর একটা গান..। কিন্তু আমার তো সে উপায় নেই। বাজার করতে হবে। খবরের কাগজটা দেখতে হবে। দু জন আসার কথা আছে। তাদের সাথে কথা বলতে হবে। সাধুগো..আমার উপায় বলনা..।
বৃষ্টি ধরে এসেছে। আমি উঠে পড়ি। ধীরে ধীরে ফিরতে থাকি ঘরের দিকে। আর ফেরেববাজ প্রেমিকের মত নিজেকে আবারও কথা দিই, অমন একটা দিন যদি আবার পাই, তাহলে তখন আর ফিরবনা। আমি ওর কাছে বসে আরো গান শুনব। বসে বসে গাছেদের চান দেখব। ও দিকে যা হয় হোক।
জানি এ কথাও রাখা হবেনা। তবু..।
মুচকি হাসির আড়ালে
ক্লাশ নাইনের মাঝপথেই স্কুলে আসা বন্ধ করে দিল ভৃগুপ্রসাদ। ফার্স্ট সেকেন্ড না হলেও অংকে বরাবরই ভৃগু ছিল একনম্বর। ক্লাশের ফার্স্টবয় নব্বই পেলে ভৃগু পাবে পঁচানব্বই ছিয়ানব্বই। একশোয় একশও পেয়েছে বেশ কয়েকবার। ম্যাথ স্যার গোপালবাবুর কোন অংক গোলমাল ঠেকলে ভৃগুকে বলতেন দ্যাখতো ভৃগু এটা।
ভৃগুর বাবা মাছ বিক্রি করত বাজারে। অনেকগুলো ভাই বোন। ইংরেজিতে ওর নম্বর কম ওঠে। টিউশন পড়েনাতো।
ভৃগুর মুশকিল ছিল কথা বলায়। খুব তোতলাতো। একটা বাক্য শেষ করতে ঘেমে নেয়ে একশা হত। এমন কি নিজের নামটা বলতেও ধাক্কা খেত। নাম দিয়েছিল দাদু। তিনি তো জানতেননা নাতি তার এত তোতলা হবে। তাহলে এত কঠিন নাম রাখতেননা নিশ্চয়ই।
ক্লাশে কিছু ছেলে ছিল যারা ও কোন কথা বলতে গেলেই ভ্যাঙাতে শুরু করে দিত। ফার্স্টবয়ের ইন্ধনও ছিল তাতে। পন্ডিত স্যর ক্লাশের মধ্যেই ঠাট্টা করতেন ওকে নিয়ে। বলতেন তোকে তো পড়া ধরা যাবেনা। তোর উত্তর দিতে দিতে পিরিয়ড খতম হয়ে যাবে। সবাই হাসত। মাথা নিচু করে বসে থাকত ভৃগু।
কিছু ছেলে ছিল যারা ভৃগুকে এই তোতলা, এই তোতলা বলে ডাকত। শুধু তোতলা নয়, তার সাথে বিশেষণ জুড়ে। ভৃগুর চোখ মুখ লাল হয়ে যেত। কিন্তু কিছু বলতে পারতনা। কিছু বলতে গেলেই সবাই মিলে ভ্যাঙাতে আরম্ভ করবে।
এইট থেকে ভৃগু বলতে গেলে স্কুলে কথা বলাই বন্ধ করে দিল। নাইনের মাঝামাঝি স্কুল ছেড়ে দিল। স্কুলের হিসেবে ড্রপ আউটের খাতায় একটা সংখ্যা যোগ হল শুধু।
ছোটবেলায় কোন কঠিন অসুখের জেরে মিতালির মাথায় চুল ছিল খুব কম। মিতালি খুব ভাল গান গাইত। কিন্তু স্কুল থেকেই তার নাম হয়ে গেল টাকি মিতালি। পরে রাস্তা ঘাটে শুনতে পেত আড়াল থেকে কেউ বিকৃত স্বরে টোন করছে এটাকি ওটাকি বলে। মিতালি গলা তুলে তাদের উদ্দেশে গালাগালি করত। তাতে যেন উৎসাহ বেড়ে যেত ওদের। ভদ্রলোকেরা সব মুচকি মুচকি হাসত। ভাল ড্রেস পড়লে আওয়াজ দিত আরে এটাকি সেজেছে রে । মিতালি সাজাগোজা ছেড়ে দিল। অথচ সাজতে খুব ভালবাসত সে। গানটাও আর ধরে রাখতে পারলনা। পাড়ার ফাংশানে গাইতে উঠলেই আওয়াজ আসত এটাকি গাইলি রে? ওটাকি গাইবি? এমন কি কিছু ছোকরা যারা কি না বয়সে অনেক ছোট, তারাও একে অপরকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলা শুরু করে দিল, এটা কি রে? ওটা কি রে? মিতালি পারতপক্ষে বাইরে বেরুনোই বন্ধ করে দিল।
দিনুবাবু একটু রগচটা, খিটখিটে মেজাজের মানুষ। কারনে অকারনে লোকজনের সাথে ঝগড়া করে ফেলেন। আবার অন্য সময় মাটির মানুষ। বাড়ির সামনে নানা রকমের ফুল ফলের গাছ লাগিয়েছেন। তার পরিচর্যা করেন রীতিমতো। কেউ তার প্রশংসা করলে তাকে গাছেদের নানা গল্প শোনাবেন। গাছ থেকে পেড়ে দেবেন পেঁপে কলা আম সবেদা কিছু না কিছু। হরিবাসরে কেঁদে ভাসাবেন। কিন্তু কালীপূজোর চাঁদা চাইতে এলে ছেলেদের সাথে ঝগড়া।
সে সময় দশ পয়সায় পাওয়া যেত রঙীন কাঠি আইসক্রিম। কাঁচা বরফ। বাচ্চাদের এগুলো খাওয়ানোর প্রবল বিরোধী ছিল দিনুবাবু। কিন্তু তিনি তো সবসময় বাড়িতে থাকতেননা। বালিকা কন্যার আবদার রাখতে তার ঠাকুমা, দিনুবাবুর মা ওই বরফ কিনে দিতেন প্রায়ই। বরফওয়ালাও বিক্রির আশায় তার বাড়ির সামনে এসে এ বরফ এ বরফ বলে হাঁক পাড়ত। একদিন দিনুবাবু বাড়ি আছেন এমন সময় বরফওয়ালা তার বিশেষ সুরে হাঁক দিতে লাগল। আর যায় কোথায়! দিনুবাবু বেড়িয়ে এসে তাকে এই মারে তো সেই মারে। -কেনরে, তোর এই বিষ বরফ বিক্রির আর জায়গা নেই? এখানে এসে এই বরফ এই বরফ.. বরফওয়ালাকে ভেঙাতে গিয়ে যে ভাবে সুর করলেন দিনুবাবু সেটাই হয়ে গেল পাড়ার ছোকরাদের ক্যাচ লাইন। তারাও ওই সুর নকল করে চেঁচানো শুরু করল এই বরফ এই বরফ..
ব্যাস। লোকটার নামই হয়ে গেল বরফ।
ডবলডেকার বাস চালাতেন। সেই বাস একদিন অফিস টাইমে গড়িয়াহাটার ব্যস্ত মোড়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন। -যে বদমাশের বাচ্চাটা ভিতর থেকে বরফ বরফ করছে, ওটাকে ঘাড় ধরে না নামিয়ে দিলে আমি বাস ছাড়বইনা। হুংকার দিতে লাগলেন ড্রাইভার সিটে বসে। শেষে কন্ডাকটর নিজে স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে বাস ছাড়ে।
ইচ্ছে করে রাত করে বাড়ি ফিরতেন। তাতেও রেহাই ছিলনা। ক্লাবের ক্যারাম পেটা দলের কেউ না কেউ গলা বিকৃত করে আওয়াজ দেবেই, -এই বরফ। কোনদিন একটা অশ্লীল কথা মুখ থেকে বার করেননি, সেই মানুষটা অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে দিল। তাকে আর বাসের স্টিয়ারিং হাতে নিতে দিতনা অফিস থেকে। সহকর্মীদের সাথে প্রায়ই ঝগড়া হাতাহাতি হত। রাতে বাড়িতে ফোন আসত, বরফ আছে?
মেয়ে বড় হয়েছে। উঁচু ক্লাশে উঠেছে। তাকেও শুনতে হয় লাল বরফ হলদে বরফ। যেদিন যে রঙের জামা পড়ে সেদিন সেরকম আওয়াজ।
একদিন মেয়ে এসে হাউহাউ করে কেঁদে বলল বাবার জন্য আমি আর রাস্তায় বেরোতে পারিনা। এ বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করেনা আমার।
সেইরাতে দিনুবাবু গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলেন।
ভারতীয় যাদুঘরের পাশে সি আই এস এফ ক্যাম্পে এক হেড কনেস্টবল অক্ষয় কুমার মিশ্র গত ৬ আগস্ট, শনিবার আচমকা ক্ষিপ্ত হয়ে ১৫ রাউন্ড গুলি চালায়। মৃত্যু হয় একজনের। অবশেষে আত্মসমর্পণ করেন অক্ষয়। কাগজ জুড়ে খবরের মাঝখানে কোথায় যেন লেখা ছিল কয়েকজন সহকর্মী অক্ষয়কুমারকে নিয়ে মশকরা করত। খুবই ছোট্ট, নীরিহ একটি লাইন।
অক্ষয় কুমারের বিচার হবে। চাকরি যাবে। জেল কিংবা ফাঁসি হবে। আমাদের মহান গণতান্ত্রিক দেশে নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার উপর কোন কথা বলা চলেনা।
শুধু পাড়ায় পাড়ায় ভৃগু, মিতালি, দিনুবাবুরা হারিয়ে যাবে সব হিসাব থেকে। কিছু বদরসিক আবার নতুন কাউকে হাসির খোরাক তৈরি করবে আর আমরা ভদ্দরলোকেরা আড়ালে থেকে মুচকি মুচকি হাসতেই থাকব।
বিভুচরণ
খালপাড় ধরে মাইল চারেক গেলে সোনারপুরের রাস্তায় ওঠা যাবে। দুধারে শুধু ধু ধু ধানবাদা। এই বাদার মাঝখানে আছে এক বহু পুরনো বিশালাক্ষ্মী মন্দির। আগে জংগলে ঘেরা ছিল। ইদানীং একটু সাফসুতরো হয়েছে। কিন্তু ভক্ত সমাগম তেমন হয়না। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। রাস্তা নেই। সন্ধের পর তো বলতে গেলে কেউই আসেনা। বিভুচরণ ছাড়া। বিভু প্রায়ই একা গিয়ে সারারাত হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে মন্দিরে।
বিভুকে বলি, এই যে তুমি সংসারে থেকেও সন্নেসী হয়েছ, রাতবিরেতে মার কাছে গিয়ে পড়ে থাকছ, তা মা কি কিছু চমৎকার দেখিয়েছেন তোমায়?
বিভু একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে, সবসময়েই তো তাঁর চমৎকার দেখছি দাদা। এ আর বলার কি আছে। তবে আপনি যেমন বলছেন, শুনুন তাহলে একটা ঘটনার কথা বলি।
বিভুচরণ বলে, বছর দুয়েক আগে, এক পড়তি বিকেলে আমি একা বসে মা কে গান শোনাচ্ছি। সন্ধে হব হব এমন সময় একটি তরুণী আর দুটি যুবক এল। ওদের ভাবভঙ্গি কথাবার্তায় বুঝলাম। এরা ভক্তিতে আসেনি। ফূর্তি করতে এসেছে। চোখ বুজে ধ্যানের চেষ্টা করতে লাগলাম। ওরা আমাকে গ্রাহ্যই করলনা। রীতিমতো অসভ্যতা শুরু করে দিল। মা র সামনে এরা এইভাবে অসভ্যতা করবে! মাকে বললাম, মা তুই বন্ধ করে দে এই অনাচার। কিন্তু মার কাছ থেকে কোন সাড়া পেলামনা। উঠে দাঁড়ালাম চুপচাপ।
দেখলাম দুজনের মধ্যে একজন যুবক দরজায় দাঁড়িয়ে আমায় পাহারা দিচ্ছে। আমাকে দেখে ঠাট্টা করে বলল, সাধুবাবার ধ্যান ভেঙ্গে গেল! কিন্তু ওদিকে তাকাবেননা যেন, মার বারন আছে। বিশ্রী ইঙ্গিত তার ইশারায়। আমি মাকে ডাকি। মনকে শান্ত করি। শান্তভাবেই বলি, মার কাছে এসে যা অন্যায় করছ তোমরা এর ফল কিন্তু পেতে হবে তোমাদের। সে ছোকরা যেন খুব আমোদ পেল আমার কথায়। কুৎসিত হেসে বলল, ফল? কী ফল? আপেল না কমলালেবু?
ওরা হাসাহাসি করতে করতে ফিরে গেল। আমি মার সামনে বসে কাঁদতে লাগলাম। একটু পরে দেখি আমার মন বেশ শান্ত লাগছে। মাকে প্রণাম করে উঠে পড়লাম।
ফেরার পথে দেখলাম রাস্তায় একটা ছোটো ভিড়। কাছে গিয়ে দেখি একটা বাইক উলটে পড়ে আছে। রাস্তায় পড়ে আছে সেই তিনমূর্তি। রক্তাক্ত।
বিভুচরণ কিন্ত আমার মত মিথ্যে গল্প বানাতে পারেনা।
সব দুঃখের শেষ আছে
এ একেবারে নিয্যস খাঁটি কথা। দুক্ষের যদি শেষ না থাকে তাহলে তো দুখ্যুটা যে কেমন তা মালুম ই হবেনা। যেমন ধরুন গিয়ে সুদেব কোচোর কথা। সুদেবকে চেনেনা এ গ্রামে এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আর তাকে না চেনার তো কোন উপায়ও নেই আপনার। আন্ডারপ্যান্টের উপর গামছা জড়ানো উদোম গার কোন মানুষের যদি একহাতে লম্বা একটা ছিপ আর অন্য হাতে থাকে একটা ছোট আকারের মাটির কলসি, যেটির মুখ ঢাকা অর্ধেক নারকেল মালায়, আর সেই মালায় যদি রাখা থাকে কেঁচো মাটি, তাহলে আপনি এক দেখাতেই বুঝে যাবেন এই সেই সুদেব কোচো। সুদেব সারাদিন ভর খালে বিলে মাছ ধরে বেড়ায়। বাদায় পাতা থাকে ফেঁসো জাল। সেই জালে যা মাছ পড়ে তা কেনার জন্য ওঁত পেতে থাকে আচ্ছা আচ্ছা ভদ্দরলোকেরা। তাই সুদেব কোচোরও ডাঁট কম নয়। নরম করে মিঠে স্বরে না বললে সে ভাঁড়ের ঢাকনা খুলে দেখাবেইনা ভিতরে কি মাছ আছে। বাজারের মাছওয়ালাদের সে তুচ্ছ জ্ঞান করে। তার মানে কি দাঁড়াল? মৎস্য ধরিয়া সুখেই দিন কাটিতেছিল তার। কিন্তু সুদেবের মনেও ছিল ভারিমত চাপা একটা দুখ্যু। সুদেবেরও বিয়ে হয়েছিল আর পাঁচজনের মত। তার বাপ পণ হেঁকেছিল ঘড়ি আংটি সাইকেল। সে আংটি গেছে, সাইকেল গেছে, এমনকি বউটাও ভেগেছে। কিন্তু ঘড়িটা আছে। দম দেওয়া ঘড়ি কেউ কিনতে রাজি হয়নি। তা আছে থাক। সুদেব তাতে রোজ দমও দেয় নিয়ম করে।কিন্তু সুদেবের মনে চাপা অম্বলের মত দুখ্যুটা ওইখানেই। এত বছর ধরে প্রত্যেকদিন দম দিয়েও সে ঘড়ি হাতে পড়ে কোনদিন কোথাও বেরুতে পারলনা সে। এই দুখ্যুটা আর মন থেকে যায়না তার। কাউকে বলাও যায়না।
সেই সুদেব কোচো হঠাৎই চলে এল খবরের একেবারে হেডলাইনে। সাপে কেটেছে সুদেবকে। তা কাটবেনা! সব মাছ যদি সুদেব একাই ধরে নেয় সে খাবে কি? চারদিকে হই চই পড়ে গেল। ছেলেরা আজকাল মোবাইল দেখে দেখে অনেক বেশি সচেতন। তারা ওঝাকে তাড়িয়ে সুদেবকে নিয়ে গেল ক্যানিং হাসপাতালে। ছত্তিরিশটা ইঞ্জেকশন নিয়ে সুদেব সুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফিরল দিনসাতেক পর। সুদেবের কাছে এখন দেদার লোকের আনাগোনা। কেউ জানতে চায় কি সাপ কেমন তার ফণা। কেউ জিজ্ঞেস করে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা। ওদিকে এন জি ও র লোকজন এসে ভিডিও তুলছে। এখন সুদেব তো আর সেই আন্ডারপ্যান্ট গামছা পড়তে পারেনা। আড়ায় তোলা ছিল বিয়ের ধূতি পাঞ্জাবি। সেগুলো পেড়ে গায়ে চড়াল। আর হাতে পড়ে নিল সেই হাতঘড়িটি। ব্যাস। সুদেবের দীর্ঘকালীন দুঃখের শেষ। সুদেব সেই হাতঘড়িটি পরে জনে জনে ইন্টারভিউ দিচ্ছে আজকাল। তার মন এখন খুব খুশ।
ওদিকে গোপনে গোপনে নতুন দুখ্যুও তৈরি যে হচ্ছে তা বুঝতে পারছে সুদেব। ছিপটায় ভেকনো ধরেছে। বড়শিতে জং। ভাঁড়ের মধ্যেকার খলবলানো যে খুশিটা চলকে উঠত সেটা আর পাওয়া যাচ্ছেনা। দুখ্যু তৈরি হচ্ছে। তবে এটাও থাকবেনা। কটা দিন যাক। আবার আন্ডারপ্যান্টের উপর গামছা জড়িয়ে বেরিয়ে পরবে সে। দুখ্যু কিসের? সবাই জানে। সব দুঃখের শেষ আছে।
বুনোজাম
গাছের কথাই যদি বলো তাহলে শোনো, তার সাথে আমার কেমন ভাব ছিল তা বলে বোঝাতে পারবনা। আসলে সেই ছেলে বেলায় কতনা সখা সখী, কারো কথা কি আলাদা করে কিছু বলা যায়?
একটা বিশাল পুকুর ছিল। শান বাঁধানো। আর পুকুর ধারে বিশাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত সে। তলায় বিছিয়ে রাখত তার শীতল ছায়া। তার গোড়ার দিকটায় ছিল একটা ফোকর। সেটা ছিল একান্তই আমার জন্য। আর কেউ তার খবরই রাখতনা। সেই ফোকরে লুকিয়ে রাখতাম আমার সেইসব গুপ্তধন যা বাড়িতে দেখানো যাবেনা। কাঁচা আমের ছাল ছাড়ানোর জন্য পুকুরের ঝিনুক। দেয়ালে ঘষে ঘষে মাঝখানে ফুটো করে রাখা। খোলাম কুচি ভেঙে তৈরি হত বাসের টিকিট খেলার ডিগেল। সে ডিগেল থাকত ওই কোটরে। টিকিটগুলোও।
এসব খবর কেউ জানতনা ও ছাড়া। খুব নিশ্চিন্তে থাকতাম। ও কাউকে বলবেনা। হেরে গিয়ে যখন টিকিট প্রায় শেষ, তখন ওকে বলতাম আজকে যদি না জিতি, তোর কাছে আর কিচ্ছু রাখবনা। আশ্চর্য, সেদিন জিতেও যেতাম। তা বলে ওকে কি গলা জড়িয়ে আদর করতাম? তা করব কেন, আর তখন তো থ্যাংকু বলারও চল ছিলনা।
গরমকালে তলাটা ভরে থাকত কালচে রঙে। ও তো ছিল বুনোজাম গাছ। তাই কেউ যত্ন করে ওর ফল পারতনা। বুনোজাম চেনোনা? সে অনেকটা জামের মতই কিন্তু খুব ছোট আকারের। আমরা অবশ্য তলা থেকে সেগুলো কুড়িয়ে মুখে দিতাম। কষটা কষটা স্বাদ। ভুদেব দাদু কলাপাতায় করে নিয়ে যেত। বুনোজাম নাকি বহুমূত্র রোগের ওষুধ।
একটু বড় হতে তার সাথে আবার অন্যরকম ভাব। তখন তো কথায় কথায় মন মেঘলা। তখন সেই পুকুরঘাটে ওর ছায়ায় চুপটি করে বসে থাকা। ও যেন বুঝতে পারত আমার মন ভাল নেই। পাতাগুলো নাড়িয়ে বাতাস করত। ডালে এনে বসাত সেইসব পাখি, যাদের শিস শুনলে মন ভাল হয়ে যায়।
ওর উপর খুব রাগ হয়েছিল সেদিন, যেদিন শরিকানি লোকজন এসে পুকুর, শান, ময় ওই বুনোজাম গাছটারও দখল নিল জবরদস্তি। খুব অভিমান হয়েছিল। ও কেন চুপ করে আছে! বলতে পারছেনা আমি তোমাদের দিকে যাবনা। আমি এ তরফেই থাকব। এখানে আমার বন্ধু আছে। আমি চলে গেলে ও কষ্ট পাবে খুব। মন খারাপ করলে কার কাছে বসবে সে?
তারপর দেখলাম একদিন করাতিরা এসে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলল ওকে। তখনও ওর কোটরটায় যত্ন করে রাখা ছিল পুরোনো টিকিট, ঝিনুক ভাঙা, খোলামকুচি।
আমিও কিছু বলতে পারিনি সেদিন। চুপ করে ছিলাম। ওর মতই।
গাছটা কাটার পর ওদিকে তাকালেই দেখতাম কেমন একটা ফাঁকা। শূণ্যতা। বেশিক্ষণ তাকাতে পারতামনা।
এতগুলো বছর চলে গেছে। আজো সেই শূণ্যতা মাঝে মাঝেই টের পাই। বাইরে নয়। ভিতরে।
সমাপ্ত