তপোপ্রিয়

মানুষ যত বয়স্ক হয় তত তার যন্ত্রণাবোধ বেড়ে যেতে থাকে, কারণ সে দেখে তার চারপাশ কেবলই পাল্টে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত চেনা পরিবেশ আর চেনা মানুষের দল। আমার সেই ছোটবেলার বন্ধুরা আজ কোথায় ? তাদের অভাব আমাকে বড়োই বিচলিত করে। আমার সেই স্কুলজীবনের স্মৃতিরা ? তাদের আর কি কোনোদিনও উদ্ধার করতে পারব ? মা যেমন হারিয়ে গেছে তেমনি সেইসব বন্ধুদের দলও জীবন থেকে বিলুপ্ত। তারা বেঁচে আছে যদিও অনেকেই, তবুও মনে হয় থেকেও নেই কেউ আর, হারিয়ে গেছে অন্য কোন জগতে, অন্য কোন গ্রহে, যার নাগাল ও ঠিকানা নেই আমার আওতার মধ্যে। আমি কেমন এক হাহাকারের নিঃশব্দ আওয়াজ বাজতে শুনি প্রায়ই বুকের গভীর অন্দরে। মানুষের বন্ধু কি কেবল মানুষই ? নিশ্চয় তা নয়। মানুষ ছাড়াও বন্ধু তার পরিবেশ ও প্রকৃতি। বড় হওয়ার প্রক্রিয়াতে সেই চেনা পরিবেশও হারিয়ে যেতে থাকে জীবন থেকে। সেটাও সমান মর্মান্তিক। 

আমার স্কুলজীবনের কথা মনে পড়ে। আসলে বয়স্ক হওয়ার এটাও বুঝি এক স্বভাব, স্মৃতিরা বোঝার মত চেপে বসতে থাকে ঘাড়ের ওপর, তার ভারে মানুষ নুব্জ হতে থাকে। বৃদ্ধ বটবৃক্ষের দশা আর কি, ঝুড়ির আধিক্যে নিজের অস্তিত্বটাই বিলীন হয়ে যায়।এত এত স্মৃতি, জীবনপাত্র টালমাটাল, কোন্‌টা বাদ দিয়ে কোন্‌টার কথা বলি ! কিছু তো একটা বাছাই করতেই হয়। সবে ভর্তি হয়েছি আমি স্কুলে, চতুর্থ শ্রেণিতে। তার আগে বাড়িতেই পড়াশুনা করছিলাম। তো একদিন ক্লাসে নতুন পরিচিত একটি ছেলে মাখন আমাকে জানাল যে যাই পড়াশুনা করিনা কেন, গুটিকয় ভাল ছেলেমেয়ে ছাড়া কেউ তেমন কিছু ফলাফল করতে পারবে না আর শিক্ষকরা তাদেরই বেশি যত্ন করবে, আমরা ব্যাকবেঞ্চার হয়ে পড়ে থাকব নজরের বাইরে। শুনে তার সঙ্গে সে দিলেও অবস্থাটা ঠিক মেনে নিতে পারছিলাম না। পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার সময় সেই মাখন ফেল করে গেল, তারপর সে হারিয়ে গেল জীবন থেকেই, তবুও তার সেদিনের সেই অনুভূতি আজ দেখছি সজীব হয়ে রয়েছে আমার মধ্যে। আমি সেদিন নতুন ছিলাম আর সে আমাকে বন্ধু করতে চেয়েছিল, আমি তার বন্ধু হতে পারিনি। দুর্ভাগ্যক্রমে ব্যাকবেঞ্চার হতে পারলাম না, আমার ফলাফল দেখে সে জানিনা হয়তো আমাকে বিশ্বাসঘাতক মনে করেছিল, কারণ পরে যতদিন এক শ্রেণিতে ছিলাম সে আমার ঘনিষ্ঠ হতে আসে নি কোনদিন। 

তখন হয়তো পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছি। একদিন টিফিনের সময় ঘুরতে গিয়েছিলাম পাশেরই বি.টি. কলেজটির চত্বরে। সেখানে হঠাৎ হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে জোর ধাক্কা খেয়ে আমি ধরাশায়ী আর চিবুকের তলা কেটে রক্তের বন্যা। হৈ-হৈ রব তুলে সহপাঠীরা ধরাধরি করে আমাকে স্কুলে এনে শুইয়ে দিল বেঞ্চের ওপর। শিক্ষকরা এসে দেখে ওষুধ-টষুধ দিলেন, কিন্তু রক্ত আর থামে না। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, এটাই হল শেষ সিদ্ধান্ত। কে নিয়ে যাবে ? যেতে হবে রিক্সায় চাপিয়ে যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়ে। কে হবে সেই সঙ্গী ? কাউকে যখন পাওয়া যাচ্ছিল না তখনই এগিয়ে এল একজন, তার যে এমন দায়িত্ববোধ জানা ছিল না। সে ছিল চরিত্রে কিছুটা জোকারের মত, সবসময় এমন সব আচরণ করত যে তাকে দেখলেই আমাদের হাসি পেত। সে কিন্তু বেশ দায়িত্বের পরিচয় দিয়ে আমাকে রিক্সায় করে হাসপাতালে নিয়ে গেল। তিন-চারটে সেলাই পড়ল, আমিতো কাবু। সে পাশে থেকে আগলে রাখল আমাকে। বাড়িতে নিয়ে এল তারপর। মা তো সব দেখে আর শুনে হাহাকার করে উঠল। সে তখন মাকে সান্ত্বনা দিল, বোঝাল আপ্রাণ চেষ্টায় কিছুই হয়নি বলে। তাকে মা পায়েস দিয়েছিল খেতে, বানানো ছিল কী যেন উপলক্ষে। সে তৃপ্তি করে খেল, আর যাওয়ার সময় মাকে বলে গেল যে দু’দিনেই আমি সেরে উঠব, কোন চিন্তার কারণ নেই। সেই বন্ধুটিও পরে হারিয়ে গেল জীবন থেকে, সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার সময় সে পরীক্ষাতে পাশ করতে পারল না। 

আমার স্কুলজীবনের বন্ধুদের মধ্যে যাদের স্মৃতি আজও বিশেষ অমলিন তারা আমার সঙ্গী ছিল নবম ও দশম শ্রেণিতে। শ্যামল বলে একটি ছেলে ছিল, সে একবার একটি গল্প লেখার চেষ্টা করেছিল। গল্পের বিষয়বস্তু ছিল এইরকম, এক পূর্ণিমার রাতে সে নাকি পাশের বাড়িতে গিয়েছিল এক কাঁদি কলা চুরি করতে। চুরি করতে পেরেছিল কিনা সেকথা লেখার আগেই তার প্রচেষ্টা আমাদের কাছে ধরা পড়ে গেল, আর সবাই মিলে আমরা তাকে খেপিয়ে জীবন অতিষ্ঠ করে দিলাম। সেই শ্যামল হল তারপর আমার তাস খেলার সঙ্গী। সেই দোলে ছিল গৌরাঙ্গ, আবেশ ভৌমিক, আবুল কালাম, স্বপন নট্ট এবং আরও কয়েকজন। রোজ বিকেলে আমার বাড়িতে বসত তাস খেলার আড্ডা। আমরা সবাই নতুন তাস খেলতে শিখেছি। টোয়েন্টি নাইন, ব্রে, ব্রিজ ইত্যাদি। যারা নতুন তাস খেলা শুরু করেছে তারা জানে কী নেশা খেলায়। রোজই রাত দশটা-এগারোটা বেজে যায়, আমাদের খেলা শেষ হয় না। মা প্রচণ্ড বিরক্ত হয়, বকাবকি করে, কে শোনে সেসব। ভাগ্যিস দশম শ্রেণির পর মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছিল। একাদশ শ্রেণিতে আমরা গিয়ে ভর্তি হলাম অন্য স্কুলে, অন্য জায়গায়। আমার বন্ধু আবেশ চলে গেল ধরাছোঁয়ার বাইরে, একেবারে পুরুলিয়াতে। আবুল কালামের বাবা বলল ছেলেকে আর পড়াবেন না। আমি তাঁকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়েছিলাম। দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় সেই আবুল এক কাণ্ড করে বসল। জামজুরি নামে এক বাজারে গিয়ে একটা গরু চুরি করে বিক্রি করল আর পালিয়ে চলে গেল আসামে। তারপর আর কোন খবর পাই নি তার। বাকি বন্ধুরা, যারা আমার তাস খেলার সঙ্গী ছিল ? কোন যোগাযোগ নেই করোও সঙ্গে। কে যে কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে ! 

এইসব বন্ধুরা ছিল আমার সর্বকাজের সঙ্গী। তাদের নিয়ে প্রায়ই বেড়াতে চলে যেতাম পাহাড়ে, জঙ্গলে নানা জায়গায়। সেই বেড়ানোর স্মৃতিগুলি যতদিন আমি থাকছি থেকে যাবে আমার মধ্যে। পথঘাট, মাঠ, পাহাড়-পর্বত, জলাজমি ইত্যাদি প্রকৃতির নানা বিচিত্র পরিচয় মানবচরিত্রের সমানই আকর্ষণীয়। স্কুলে যাওয়ার গোটা পথটা যখন যেতাম তখন তেমন আহামরি কিছু বলে মনে হত না, এখন তার কথা আমাকে স্বপ্নাচ্ছন্ন করে তোলে। জলাজমি ঘিরে রাখা বাঁধের ওপর দিয়ে পথটা গেছে লম্বা টিলার তলা ঘুরে, সেই টিলার ওপরটা সমতল, সেখানে লোকজনের বাড়িঘর। বর্ষাকালে জলাজমি ভরে যেত জলে, বাঁধের ওপর দিয়েও বইত জলের স্রোত। সেসময় স্কুলে যেতাম পাকা রাস্তা ধরে। পরে স্কুল যখন নতুন জায়গায় নতুন বাড়িতে চলে এল তখন ওই পাকা রাস্তা ধরেই চলত নিত্য যাতায়াত। 

অমলেন্দু ভাওয়াল বলে আমার এক সহপাঠী ছিল পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি যখন। সেসময় প্রত্যেক শনিবারে সাহিত্যসভার আয়োজন করা হত স্কুলে কয়েকটি ক্লাশের পর। একটা আধখ্যাঁচড়া রাক্ষসের গল্প শুনিয়েছিল অমলেন্দু সেখানে এক আসরে। আসলে আমি বলতে চাই তার ভাই শান্তি ভাওয়ালের কথা। একবার পরীক্ষার হলে শান্তি আমাকে ধরে বসল তাকে সাহায্য করার জন্য, নাহলে সে ফেল করে যাবে। তার আবদার শুনে বেশ দয়াই হয়েছিল আমার, আর আমি তাকে আমার খাতা খুলে দিলাম যাতে সে সব টুকে নিতে পারে। সে বসেছিল ঠিক আমার পিছনেই, সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল মনে আছে। তারপর একদিন সন্ধেবেলা সে আমাকে বাজারে ধরল। জোর করে টেনে নিয়ে গেল একটা খাবারের দোকানে, আর যা পারল তাই কিনে কিনে খাওয়াতে লাগল আমাকে। আমি যতই না করি সে কানই দিলনা, জোর করে খাওয়াবেই। এখন মনে নেই সে ঠিক পাশ করেছিল কিনা, কিন্তু ওই যে প্রচণ্ড খাইয়েছিল আমাকে তা মনে আছে।

এ সমস্ত সবই আমার সকালবেলার গল্প। সৌভাগ্যক্রমে আমার সেই সকাল কেটেছিল প্রাকৃতিক বৈচিত্রে ভরা এক পরিবেশে, যার অভাব আজ আমাকে এমন বিষণ্ণ করে তুলেছে। আমার ওই সকালে পাহাড় ছিল, জঙ্গল ছিল, ছিল খোলা মাঠ আর দিগন্তছোঁয়া জলাভূমি। তাদের বুকে ছিল আমার অবিরাম হাঁটাচলা, কিন্তু তাদের কাহিনী আমি তেমন প্রাণ ঢেলে বলতে পারিনি কখনও। আমি যদি না বলি তো কে শোনাবে তাদের কথা ? জানি, তবুও তাদের গল্প শোনাতে গিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলি, বুঝি না কিভাবে জানাবো কেমন বন্ধু ছিল ওইসব টিলা-জঙ্গলেরা আমার। 

এমনই আরেক বন্ধু বা সঙ্গীর নাম ছিল শিবু বা শিবশঙ্কর। সে ছিল ছিল নজরুলগীতির ভক্ত। তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম মাঠে-ঘটে, বনে-বাঁদাড়ে গলায় নজরুলের গান নিয়ে। কখনো বর্ষাকালে এক ছাতার তলায় হাঁটতাম দু’জনে জঙ্গলের ভেজা পথে, গাইতে গাইতে নজরুলগীতি। সেসব দিনগুলি আর নাগালে পাই না এখন। সুভাষ কুরী নামে এরকম অন্য এক সকালের সঙ্গীর কথাও মনে হয় প্রায়ই। তার শখ ছিল মৌমাছি পোষা। তার বাড়িতে বাক্স বাক্স ভরা মৌমাছি। তাদের জীবনবৃত্তান্ত মুখস্থ ছিল তার, শোনাত সেসব আমাকে। আমার বাড়িতে আসত সে প্রায় রোজই, সে এক অন্য আকর্ষণে। আমি যেসব গল্প লিখতাম সে ছিল সেসবের একনিষ্ঠ শ্রোতা, সেসব শুনতে আসত সে। এতবড় ভক্ত আমার গল্পের আর কি পেয়েছি ? হ্যাঁ, পেয়েছিলাম আর একজনকে, তার নাম ছিল শম্ভু। সে থাকত পশ্চিমবঙ্গে কাঁচরাপাড়াতে বলত, পালিয়ে গিয়েছিল আমাদের ওখানে তার দাদার আশ্রয়ে নকশাল আমলে। আমার একটি উপন্যাসের সে ছিল পরম ভক্ত। সেই সূত্রেই তার সঙ্গে বন্ধুত্ব জমে উঠেছিল। 

রাতে আকাশভরা জোনাকি-জ্বলা আসরের তলায় শুয়ে থাকা জলাভূমি ঘিরে রাখা টিলাগুলির সমতল জমিতে ঘুমিয়ে থাকত লোকজনের ঘরবাড়ি, স্বপ্নাচ্ছন্ন করে তুলত পরিবেশ। আমি এখানে তা হারিয়ে ফেলেছি। তাদের বড় হিংসে হয় আমার, যারা জীবনে সবসময় সকালবেলার বন্ধুদের সঙ্গে থাকতে পারে। বড়বেলার বন্ধুরা আসলে বন্ধু হয় না, বন্ধু থেকে যায় আজীবন সকালে যাদের সঙ্গে পরিচয়। আমি সকালবেলার সেইসব বন্ধুদের হারিয়ে বসে আছি, যেমন করে হারিয়ে ফেলেছি মাকেও আমার। ওই সকালের বন্ধুদের সঙ্গে আমার মায়েরও অনেক আলাপ ছিল, তাদের সঙ্গে দেখা হলে বলত তারা আমাকে মায়ের কথা, যেহেতু জানত তারা মাকে আমার। বড়বেলার বন্ধুদের মধ্যে কোন দরদ খুঁজে পাই না আমি, তারা বন্ধু হতে জানে না, বড় বেশি সাংসারিক ঝঞ্ঝাটে ব্যতিব্যস্ত সবাই। আমার সেই সকালবেলার বন্ধুদের প্রয়োজন জীবনের এখানে এসে আমি অহরহ অনুভব করি আজকাল। তারা সবাই হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে, কেউবা এই পৃথিবী থেকেও। যেমন ভুলু আইন বলে আমার এক বন্ধু ছিল, কোন সূত্রে জানতে পারলাম সে আর বেঁচে নেই। তার একটা সমস্যা ছিল, কথা বলত অনুনাসিক সুরে, কিন্তু আমি তার কথা সব বুঝতে পারতাম। কতই না কথা আমাদের, কোথাও বসে একটানা বা লম্বা পথ হাঁটার প্রক্রিয়ায়। এইসব সকালবেলার বন্ধুদের বড়োই অভাব আমি অনুভব করি আজকাল। তারা হারিয়ে গিয়ে আমার মা হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা বুঝি আরও বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। নিজেকে কেমন নিঃসঙ্গ মনে হয় এখন। আমাকে আমার নাম ধরে ডাকার কেউ নেই আর ভাবলে কেমন অবাক লাগে, অসহায় বোধ জেগে ওঠে বুকের মধ্যে। মা নেই, সকালবেলার বন্ধুরাও নেই, কে ডাকবে আমাকে আমার নাম ধরে ? আমি এখন এক একা মানুষ, হারিয়ে আছি মহাশূন্যে। যা দেখি আমার চারপাশে সবই অচেনা আর অপরিচিত। প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানুষ। আমি কাউকে চিনি না, কিছুই চিনি না।    

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *