অঙ্কিতা কোলে
আচ্ছা আপনি কি কখনো নিজের কাঁধ থেকে কনুই এর দৈর্ঘ্য এবং কনুই থেকে হাতের আঙ্গুলের শেষ প্রান্তের দৈর্ঘ্য মেপে দেখেছেন? অথবা ধরুন বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের পাপড়ির সংখ্যা গুনে দেখেছেন? হয়তো দেখেননি, তাই একটা অদ্ভুত ব্যাপার আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে। আচ্ছা ধরুন প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমি আমার বাহুর দৈর্ঘ্য মাপলাম। কাঁধ থেকে কনুই অবধি 25 সেমি আর কনুই থেকে হাতের আঙ্গুলের শেষ প্রান্ত অবধি আমার হল 40 সেমি। এবার বড় সংখ্যাটিকে ছোট সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলাম। উত্তর এলো 1.6। একইভাবে আমি এবার কনুই থেকে কবজি ও কবজি থেকে আঙ্গুলের শেষ প্রান্তের দৈর্ঘ্য মাপলাম, বড় সংখ্যাটিকে ছোটটা দিয়ে ভাগ করলাম, উত্তর এলো প্রায় 1.5। একই পদ্ধতিতে হাতের তালু ও আঙুলের দৈর্ঘ্য মেপে ভাগ করায় উত্তর এলো 1.67। কোনো কি মিল লক্ষ্য করলেন এই সংখ্যা গুলোর মধ্যে? আসলে এই প্রত্যেকটা সংখ্যা একটি বিশেষ সংখ্যার দিকে ধাবিত হওয়ার প্রবণতা দেখায় এবং এই সংখ্যাটি হল সুবর্ণ অনুপাত বা গোল্ডেন রেশিও। সুবর্ণ অনুপাতের মান গ্রিক অক্ষর ‘ফি’ বা ‘ফাই'(Φ) দ্বারা প্রকাশ করা হয় এবং এর মান হয় (1+√5)/2 বা দশমিকে প্রায় 1.61803398875 এর সমান।এবার আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে ফিবোনাচ্চি সংখ্যাটাই বা কি আর এর সাথে সুবর্ণ অনুপাতের সম্পর্কটাই বা কোথায়?
আপনি প্রথম দুটো অখণ্ড সংখ্যা(whole number) ধরে নিন এবং এদের যোগফল বের করুন। প্রথম দুটো অখণ্ড সংখ্যা হলো 0 এবং 1 আর এদের যোগফল হল 1। অর্থাৎ,
0+1=1
এবার এই সমীকরণের শেষ দুটো সংখ্যা যোগ করলে দাঁড়ায় 1+1=2।
এই একই পদ্ধতিতে শেষ দুটো সংখ্যা যোগ করতে করতে গেলে আমরা একটা অনুক্রম পাই। যেটা কিছুটা এইরকম
0+1=1
1+1=2
1+2=3
2+3=5
3+5=8
5+8=13
8+13=21
13+21=34
…..
এই ভাবে সংখ্যাগুলো চলতেই থাকবে। শেষ দুটো সংখ্যা যোগ করার পদ্ধতিতে আমরা যোগফলের যে অনুক্রম পাই তাকে বলা হয় ফিবোনাচ্চি অনুক্রম বা ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স।
এবার ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স টা বিবেচনা করুন। অনুক্রমের পর পর দুটো সংখ্যা নিয়ে তাদের বড়োটাকে, ছোটটা দিয়ে ভাগ করলে যে সংখ্যা গুলো পাওয়া যাবে সেগুলো কিছুটা এইরকম 2, 1.5, 1.67, 1.6, 1.625, 1.61538, 1.619047619, …। এই সংখ্যা গুলো এটাই নির্দেশ করে যে ফিবোনাচ্চি অনুক্রমের যত বড় সংখ্যা নিয়ে তাদের ভাগফল বের করা হবে, ততই তাদের ভাগফলের মান সুবর্ণ অনুপাতের সমান হওয়ার প্রবণতা দেখাবে।এবার এই ফিবোনাচ্চি ক্রমের কিছু মজার ব্যাপার বলি।
১. ক্রমের যেকোন পর পর দুটো সংখ্যার বর্গের যোগফল এই ক্রমেরই অন্তর্ভুক্ত।
যেমন, ক্রমের পরপর দুটো সংখ্যার বর্গের যোগফল এই ক্রমে চলবে 3, 13, 34, 89, 233, …।
২. যেকোন সংখ্যা তার পরবর্তী পরপর দুটি সংখ্যার বিয়োগফলের সমান।
৩. যেকোন সংখ্যা তার পূর্ববর্তী পরপর দুটি সংখ্যার যোগফলের সমান।ফিবোনাচ্চি সংখ্যার অবিষ্কর্তা হলেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইতালিয় গণিতজ্ঞ লিওনার্দো বোনাচ্চি। তিনি পিসার লিওনার্দো নামেও পরিচিত। যদিও ভারতীয় গনিতশাস্ত্রে খ্রিষ্টজন্মের প্রায় 200 বছর পূর্বেই এই সংখ্যার উল্লেখ পাওয়া যায় তথাপি লিওনার্দো বোনাচ্চির ডাকনাম ফিবোনাচ্চি অনুসারে ফিবোনাচ্চি সংখ্যা নামেই এই সংখ্যা বেশি পরিচিত। 1202 খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রথম খরগোশের প্রজননে এই সিরিজের প্রভাব লক্ষ্য করেন। দুইটি খরগোশ থেকে প্রজনন শুরু হলে এবং যদি একটিও খরগোশ না মরে তাহলে তারা ফিবোনাচ্চি ক্রম অনুযায়ী সংখ্যাবৃদ্ধি করে অর্থাৎ 2, 3, 5, 8, 13, 21, 34, … এই ক্রমে সংখ্যাবৃদ্ধি হয়। ফিবোনাচ্চি তার “Liber abachi” গ্রন্থে এই সংখ্যামালার উল্লেখ করেন।
প্রকৃতিতেও ফিবোনাচ্চি সংখ্যার ছড়াছড়ি। ভালোভাবে লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবেন বেশিরভাগ ফুলের পাপড়ি সংখ্যা ফিবোনাচ্চি ক্রম মেনে চলে। অর্থাৎ বেশিরভাগ ফুলের পাপড়ি সংখ্যা 3, 8, 13, 21, 34, 55 বা 89 সংখ্যক হয়। সূর্যমুখীর পাপড়ি সংখ্যা, বীজের বিন্যাস; বিভিন্ন উদ্ভিদের পাতার বিন্যাস; পাইনকোন, আর্টিচোক, রোমানেস্কো, আনারসের গঠন; আমাদের হৃৎস্পন্দন, হাড়ের দৈর্ঘ্য, DNA র হেলিক্স গঠন, আকাশগঙ্গার spiral এর গঠন সব জায়গাতেই লুকিয়ে রয়েছে ফিবোনাচ্চি ক্রম এবং সুবর্ণ অনুপাত। এমনকি সঙ্গীত ও শিল্পেও রয়েছে এর ছাপ। তাই ফিবোনাচ্চির উক্তি যথার্থ মনে হয়: “এই সংখ্যামালাতেই লুকিয়ে রয়েছে সৃষ্টির রহস্য।”