উলুরু বা আয়ার্স রক এক বেলেপাথরের পাহাড়, মধ্য অষ্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চলের দক্ষিণাংশে এর অবস্থান। প্রকৃতির এই আশ্চর্য সৃষ্টি কাছাকাছি বড় শহর অ্যালিস স্প্রিংস থেকে সড়কপথে ৪৫০ কিলোমিটার দূরে কাতাৎজুতা ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত। উলুরুর মূল দুটি শৈলগঠনের মধ্যে ব্যবধান ২৫ কিলোমিটার —- একটির নাম কাতাৎজুতা বা দ্য ওলগাস এবং অন্যটি উলুরু। স্থানীয় পিৎজানৎ জাৎজারা ও ইয়ানকুনিৎজাৎজারা দুই আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে উলুরু এক পবিত্র স্থান। প্রচুর ঝরনা, ওয়াটারহোলস, গুহা ও প্রাচীন চিত্রকলা রয়েছে এখানে। উলুরু এক প্রাকৃতিক আশ্চর্য, অন্যতম বিখ্যাত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট।
পিৎজানৎ জাৎজারা সম্প্রদায়ের লোকরাই এর নাম দিয়েছিল উলুরু, যদিও তাদের ভাষায় শব্দটির কোন নির্দিষ্ট মানে নেই। পরে শেতাঙ্গরা এর নাম রেখেছিল আয়ার্স রক। বর্তমানে সরকারিভাবে উলুরু আয়ার্স রক দ্বৈত নামটি চালু আছে।
বিশ্ববিখ্যাত বেলেপাথরের এই কাঠামো উচ্চতায় ১১৪২ ফুট, সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা ২৮৩১ ফুট। সমস্ত শৈলগঠনটির যতটা অংশ মাটির ওপরে তার চেয়ে অনেক বেশি অংশ মাটির তলায়। সমগ্র গঠনটির পরিধি ৯.৪ কিলোমিটার। দিনের বা সমগ্র বছরের বিভিন্ন সময়ে আলোর তারতম্যে উলুরু রঙ পাল্টায়। সূর্যাস্তে এর দৃশ্য মনে রাখার মত, যখন সমগ্র গঠন রক্তিমবর্ণ হয়ে যায়। এই এলাকায় বৃষ্টি প্রায় হয়ই না, তবুও জলীয় আবহাওয়ার সময়ে শৈলস্তূপের রঙ হয়ে যায় রূপোলি ধূসর।
একটি মাত্র পাথরে গঠিত এক পাহাড় হল উলুরু। একে তাই বলা হয় মনোলিথ। অন্যদিকে, এটি এক দ্বীপপর্বত। এক বিশাল পার্বত্যাঞ্চল খুবই ধীরগতিতে যুগের পর যুগ ক্ষয়ে ক্ষয়ে তৈরি হয়েছে উলুরু, সমগ্র পর্বতের বিচ্ছিন্ন অবশেষ হিসেবে। উলুরুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার সমগনীয়তা, ভিত্তিমূলে জোর বা বিভাজিকা প্রায় নেই। এসব কারণে ভূমিসংলগ্ন গোড়ার দিকে ঢালু অংশে প্রস্তরখণ্ডের স্তূপ বা মাটি জমতে পারেনি, আর এজন্যই চারপাশের সমস্ত পাথর ক্ষয়ে গেলেও উলুরু অটুট থেকে গেছে।
উলুরু এবং কাতাৎজুতা জাতীয় উদ্যানে বন্যজন্তু ও উদ্ভিদের বৈচিত্র্যও ব্যাপক। ক্যাঙ্গারু, এমু ,পাইথন, নানাজাতীয় বাদুড়, উট, শেয়াল, কুকুর, বুনোবেড়াল, খরগোস ছাড়াও রয়েছে গাছ, ঝোপঝাড়, এবং ঘাসজমি।
উলুরু কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল এই নিয়ে স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক উপকাহিনী চালু আছে। একটি কাহিনী অনুযায়ী, উলুরু তৈরি হয়েছিল পৃথিবীতে সৃষ্টির কাজ চলার সময়। তৈরি করেছিল দুই বালক। বৃষ্টির পর তারা কাদা নিয়ে খেলা করছিল। খেলা শেষ হলে তারা দক্ষিণ প্রদেশের দিকে এগিয়ে যায় এবং পরস্পর লড়াই শুরু করে। তারপর তারা এক পাহাড়ের চূড়োয় গিয়ে পৌঁছায় যেখানে তাদের দেহ বোল্ডার হিসেবে সংরক্ষিত হয় এবং জন্ম নেয় উলুরু। অন্য একটি উপকথায় রয়েছে অশরীরী দুদল উপজাতীয় লোকের গল্প যারা এক ভোজসভায় গিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে দু দলের নেতারাই মারা যায়। যুদ্ধে যেখানে রক্তপাত ঘটে পৃথিবী সেখানে মনের দুঃখে মাথা তোলে আর জন্ম নেয় উলুরু।
বর্তমানে উলুরু দেখার জন্য সারা বছর প্রচুর পর্যটক আসে। কাতাৎজুতা জাতীয় উদ্যানের ঠিক পাশেই রয়েছে ছোট পর্যটন কেন্দ্র ইউলারা, যেখান থেকে সড়কপথে উলুরু মাত্র ১৭ কিমি।
উলুরু যারা ঘুরতে আসে তাদের অনেকেই পাহাড়ে চড়তে চায়। স্থানীয় আনাঙ্গু উপজাতীয়রা পর্যটকদের গাইড হলেও পাহাড়ে তারা চড়তে রাজি হয় না। পর্যটকদেরও তারা শিলাখন্ডটিতে চড়তে বারণ করে, যেহেতু তাদের বিশ্বাস এখানে অশরীরী আত্মাদের বসবাস আছে। তবুও উলুরু চড়া এক বিরাট আকর্ষণ, যদিও একেবারে ন্যাড়া ও খাড়াই পাথরের দেয়াল বেয়ে ওপরে ওঠা যথেষ্ট বিপজ্জনক। তার ওপর শিলাখণ্ডের মাথায় রয়েছে একটানা ঝোড়ো হাওয়ার দাপট। উলুরু চড়তে গিয়ে বছরে অনেক লোকের অপঘাতে মৃত্যু হয়। সরকার থেকে এসব কারণেই উলুরু চড়া নিয়ে নানান বিধিনিষেধ রয়েছে।