তুষার বরণ হালদার
লেখক পরিচিতি
(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)
ভারতবিদ্যা চর্চায় যে সব কৃতি বাঙালী অবদান রেখে গেছেন, তাঁদের মধ্যে উনিশ শতকের একদম শুরুতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্মৃতিশ্রাস্ত্র বিশারদ পণ্ডিত ভরতচন্দ্র ভট্টাচার্য তৎকালীন ২৪-পরগনা জেলার বর্ধিষ্ণু গ্রাম লাঙলবেরিয়ায়, ১৮০৪ সালে। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছিলেন গ্রাম্য পাঠশালা ও চতুস্পাঠি তে। এরপর সদ্য স্থাপিত সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন ১৮২৪ সালে। ওই কলেজ থেকেই ১৮২৯ সালে তিনি কৃতি ছাত্র হিসাবে ‘শিরোমণি’ উপাধি প্রাপ্ত হন। তখন থেকেই তিনি ভরতচন্দ্র শিরোমনি নামে পরিচিতি লাভ করতে থাকেন। কলেজীয় শিক্ষা সমাপন করে তাঁর প্রথম প্রথাগত নিয়োগ ছিল হিন্দু ল পরীক্ষা কমিটির ‘পণ্ডিত’ এর পদে (১৮৩০-৩৭)। এরপর পরবর্তী দুই বছর তিনি বিহারের সারণ জেলায় জজ পণ্ডিতের পদে আসীন ছিলেন। এর পর শুরু হয় তাঁর মনন চর্চার গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, কারণ ১৮৪০ সালে বিহার থেকে প্রত্যাবর্তন করে তিনি স্মৃতিশাস্ত্রের অধ্যাপক রূপে নিযুক্ত হন কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ১৮৪০ সালে এবং সেখানে তিনি দীর্ঘ একত্রিশ বছর স্বারসত্ত সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন।
অতএব অন্যভাবে বলা যায় যে ওই সময় পর্বেই তিনি বিশেষভাবে ভারতবিদ্যা চর্চায় অবগাহন করেছিলেন। স্মৃতিশাস্ত্রের প্রায় সমগ্র পরিসরে তাঁর মননের দ্যুতি বিচ্ছুরিত হয়েছিল। প্রবেশ করেছিলেন ধ্রুপদী জ্ঞানচর্চার গহনে। উপকৃত হয়েছিল তাঁর ছাত্র সম্প্রদায়। সমৃদ্ধ হয়েছিল পরবর্তী প্রজন্ম। মনে রাখতে হবে তার সময়ে তিনিই একমাত্র স্মৃতিশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ হিসেবে বঙ্গ দেশে গণ্য হতেন। স্মৃতি শাস্ত্র গ্রন্থগুলির চর্চা বৃদ্ধির উদ্দশ্যে তিনি বেশ কিছু স্মৃতি শাস্ত্র কে সাবলীল ও সহজবোধ্য করে রচনা করেছিলেন। প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের আর্থানুকুল্যে ‘জিমুতবাহনের দায়ভাগ’ গ্রন্থটি টিকা সহ দুখন্ডে প্রকাশ করেছিলেন।
এরপর তিনি এক ব্যাপক কর্মযজ্ঞে হাত দিয়েছিলেন প্রসন্ন ঠাকুরেরই আর্থিক আনুকূল্যে। তা ছিল ‘দত্তক শিরোমনি’ নামে স্মৃতি শাস্ত্রের বিশ্বকোষ তুল্য গ্রন্থটির সম্পাদনা করা। এই গ্রন্থটির বিশেষত্ব ছিল এই যে ভারতে দত্তক সংক্রান্ত আটটি গ্রন্থ প্রচলিত ছিল। যেমন, ১. দত্তক চন্দ্রিকা,২. দত্তক মীমাংসা, ৩. দত্তক নির্ণয়, ৪. দত্তক তিলক, ৫. দত্তক দর্পণ, ৬. দত্তক কৌমুদি, ৭. দত্তক ধীধিতি, ৮. দত্তক সিদ্ধান্ত মঞ্জুরি। এগুলির প্রত্যেকটির সার সংকলন করে সেগুলিকে বিষয়ানুগ বিন্যাস করে পর্ব প্রতি অধ্যায় শেষে স্মার্ত পণ্ডিতদের বক্তব্য আলোচনা করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি নিজের মতামত বিশ্লেষণ করেছেন। দত্তক সংক্রান্ত যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর এই বিশাল গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়। এক কথায় এই মহা গ্রন্থটি বিশ্বকোষই বটে। বর্তমান কালের উত্তরাধিকার আইন সংক্রান্ত যুক্তি তর্কের ক্ষেত্রে আইনঞ্জ দের কাছে এটি বেদ তুল্য। এই গ্রন্থ প্রণয়নে তিনি তাঁর সমস্ত মেধা, ধৈর্য, শ্রম ব্যয় করেছিলেন, তার তুলনা হয়না। অথচ আমরা অনেকেই এই মহাগ্রন্থটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নই। যেমনভাবে আমরা অভহিত নয় ভরত শিরোমণি সম্পর্কে। মজার ব্যপার হল অবহিত নয় বলেই ভরতচন্দ্রের বেশ কিছু বই আমাদের দেশে আর পাওয়া যায়না; বইগুলির একটি করে খন্ড ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। যেমন, বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে লিখিত একটি গ্রন্থ, ‘যোগ সংস্কার ব্যবস্থা’ অগম সংহিতা।
পাশাপাশি সমাজ সংস্কারের ব্যাপারেও তাঁর পরোক্ষ অবদান অনস্বীকার্য। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিধবা বিবাহ প্রচলনের ব্যাপারে তাঁর অকুন্ঠ সমর্থন ছিল। তিনি নিজে শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত হওয়ায় বিদ্যাসাগর তথা বিধবা বিবাহের পক্ষে সওয়াল করা সহজ ছিল। তিনিও শাস্ত্র গ্রন্থগুলির সাহায্য নিয়ে যুক্তি তুলে ধরে বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। সুতরাং একাজে বিদ্যাসাগরের মহৎ কীর্তির পাশে ভরতচন্দ্রের কিঞ্চিৎ অবদানকে অস্বীকার করা চলে না। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্যের জীবনধারা ও পরিবেশের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে একজন স্মৃতিশাস্ত্রবিদ বাঙালী পণ্ডিত ভরতচন্দ্র শিরোমণি যে ভাবে বিধবা বিবাহের পক্ষে আন্দোলনের সমর্থনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, উদারতা, নৈতিকতা ও সাহসের দিক থেকে বিচার করলে, তার তুলনা বিরল। আবার দেখা যায় রাজা কলিকৃষ্ণ দেবের সভাপতিত্বে ‘সনাতন ধর্মরক্ষিনী’ সভা নামে একটি প্রস্থিষ্ঠান স্থাপিত হলে, সেই সভার আচার্যের দায়িত্ব ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ভরত শিরোমণি। এই সভার পক্ষ হতে ‘সনাতন ধর্মোপদেশিনী’ নামে মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হত, যার সম্পাদনা করতেন তিনি। এখানেও তাঁর লেখনীতে সুধা বর্ষিত হোত। সেখানেও তিনি আমাদের দেশের বহু প্রাচীন গ্রন্থের উপর আলোকপাত করতেন এবং সেগুলিকে অবলম্বন করে অনেক মৌলিক লেখা তিনি লিখেছিলেন, যার বেশির ভাগই বর্তমানে অধরা, সামান্য কিছু বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে রক্ষিত আছে। এই লেখনিগুলি তাঁর এবং তাঁর পূর্বের সময়কে বুঝতে এক অসামান্য উপাদান হিসেবে সহায়তা করে।
জীবনের প্রান্ত সীমানায় তিনি যখন উপস্থিত, তখন তাঁর উপর কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি পরিচালনার দায়িত্ব ভার এসে পড়ে। সোসাইটির সভাপতি থাকাকালীন কর্তৃপক্ষ তাঁর উপর একটি গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছিল। তা হল, এশিয়াটিক সোসাইটির ‘বিবলিওথেকা ইন্ডিয়া গ্রন্থমালায় দাক্ষিণাত্যের পণ্ডিত হেমাদ্রী বিরচিত ‘চতুর্বর্গ চিন্তামনি’ গ্রন্থটিকে প্রকাশ করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পাঁচ খন্ডে বিভক্ত সেই গ্রন্থ পুরোপুরি শেষ করার পূর্বেই তার প্রয়াণ ঘটে ১৮৭৮ সালে। আমরা হারালাম উনিশ শতকের প্রথমার্ধের একজন শ্রেষ্ট বাঙালী পণ্ডিতকে। তবে দীর্ঘ জীবন ব্যাপী নিরলস ভারতবিদ্যা চর্চা সাধনার দ্বারা তিনি বঙ্গজাগরণে একজন অখ্যাত, অপরিচিত বিরল প্রতিভার সাধক হিসাবে অবদান রেখে গেছেন।