তপোপ্রিয়
আমরা আমাদের মায়েদের কথা বলাবলি করছিলাম। আমি আর দিশা।আমাদের দুজনেরই মা হারিয়ে গেছে। কোথায় সেটা জানিনা আমরা। মানুষ জীবন হারিয়ে যায় কোথায় কেউ সেই রহস্য আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেনি। সভ্যতার শুরু থেকেই এই প্রশ্নে মানুষ বিব্রত হতে হতে হাজার হাজার বছর কাটিয়ে ফেলেছে। তবুও উত্তর খুঁজে পায়নি। কত কত জ্ঞানী-গুণী, বিজ্ঞানী ও মহামানব হন্যে হয়ে খুঁজেও সঠিক কোন তথ্য দিতে পারেননি। আমি আর দিশা তো তার তুলনায় কিছুই নয়। আমরা এই মহা রহস্যের উত্তর খুঁজে পাব কিভাবে ?
দিশা তার মাকে হারিয়েছে বড়জোর দুবছর। খুব যে বেশি বয়স হয়েছিল তার মায়ের এমন নয়, এও নয় যে তার মা কোন বড় অসুখে ভুগছিল। অনেকটা বিনামেঘে বজ্রপাতের মত ঘটনা। হঠাৎই একদিন তার মায়ের শরীর খারাপ হল আর পরীক্ষা করে ডাক্তার দেখল লিভারের গন্ডগোল। তখন তখনই হাসপাতালে ভর্তি করে জানা গেল সিরোসিস অফ লিভার। তারপর আই সি ইউ এবং সেখানে সাতদিনের মধ্যেই সব শেষ।
তার মা নেই এই সত্যিটা মেনে নিতে পারেনি দিশা সেই মূহুর্তে এবং আজও । তার ভাষায়, ‘আমি ঠিক করেছিলাম মাকে পিস হেভেনে রেখে দেব। কিছুতেই মাকে যেতে দেবনা আমাকে ছেড়ে। মায়ের শরীরটা নষ্ট হতে দেবনা কোনমতেই। রেখে দেব প্রিজার্ভ করে। বলা যায়না মানুষ হয়তো শিগগিরই খুঁজে পাবে জীবনদানের উপায়, আর তখন মায়ের শারীরটাতো দরকার হবে। সবাই মিলে আমাকে বোঝাতে লাগল আর আমি নিজেও শেষে বুঝলাম যে ব্যাপারটা ঠিক হবে না। কতদিন মাকে রেখে দিতে পারব পিস হেভেনে ? দুমাস, তিনমাস ? বছরের পর বছর তো রাখা যাবে না ? মাকে নিয়ে যাওয়া হল কালীঘাটের কাছে যে শ্মশান আছে সেখানে। আমি তখনও বিশ্বাস করছি যে মা আমাকে ছেড়ে যায়নি আর সেটা যে ঠিক তার একটা প্রমাণও পেয়ে গেলাম তখন তখনই। মায়ের নাভি যখন বিসর্জন দেওয়া হল সেসময় গঙ্গায় জল ছিলনা বলে নাভি পলি-কাদার ওপর পরে রইল, হারিয়ে গেল না আর আমার মনে হল, মা আমাকে ছেড়ে যায়নি বলেই এমনটা ঘটল। তারপর থেকে আজও সেই বিশ্বাস নিয়ে আছি যে মা আমাকে ছেড়ে যায়নি, যেতে পারেনা। যে যা খুশি বলুক, আমি কোনদিন এই বিশ্বাস হারাতে পারব না।’
আমারও এমনই অবস্থা হয়েছিল মাকে হারিয়ে। আজও আমি ভাবতে পারিনা, আমার মা নেই। মাকে হারিয়ে বছরের পর বছর কেন আমার উন্মাদের মত অবস্থা তা কেউ বুঝতে পারেনি এবং প্রায় সবাই হাসাহাসি করেই এসেছে। বয়স হলে বা না হলে মানুষের এই যে চলে যাওয়া তা সবাই স্বাভাবিক ঘটনা বলে মেনে নেয় কোন না কোন সময়। মানতে পারিনা আমরা, আমি আর দিশারা। এই যে অবুঝ জগতের বাসিন্দা আমি আর দিশারা, আমরা আর কোন দোসর না পেলেও নিজেদের আবেগপ্রবণ বিশ্বাস নিয়ে অবিচল থাকতে জানি। সমব্যথী না পাওয়ার হাহাকার লুকিয়ে রাখি বুকের গভীরে। কেউ কেউ আমরা এই আক্ষেপ বুকে রেখে একদিন নিজেরাও চলে যাই জগৎ ছেড়ে। জাগতে সমব্যথীর বড়ই অভাব। সৌভাগ্যক্রমে আমি আর দিশা আমরা একে অপরকে হঠাৎই পেয়ে গেলাম।
দিশা পরিচিত বেসরকারি এক বাণিজ্যিক ব্যাংকের কোলকাতাস্থিত আঞ্চলিক একটি শাখার কর্ণধার। আমার সেখানে সেভিংস একাউন্ট আছে। আমার মূলত চেনা সেই শাখার এক বিশেষ আধিকারিক পাঞ্চালির সঙ্গে। দিশার সঙ্গেও আলাপ ছিল, তবে তেমন গভীর নয়। আজ কিন্তু হয়ে গেল অভাবনীয় গভীরতা কিছুটা দৈবের বশেই। ভাবিনি এমনটা ঘটে যাবে ওভাবে। সেদিন হঠাৎই সপরিবারে কোথাও একটা যাওয়ার পথে পড়ল বলে ওই শাখায় গিয়ে উপস্থিত হলাম কী যেন একটা দৈবাৎ মনে হওয়ার কারণে। ব্যাংকে তেমন ভিড় ছিল না। পাঞ্চালি আমাদের পাকড়াও করে নিয়ে গেল ম্যানেজারের ঘরে। দিশার মত ব্যাংকের কর্তারা কি কোন বছরের সূচনায় কোন গ্রাহককে হাতের মুঠোয় পেলে এমনি এমনি ছেড়ে দেয় ? কিছু না কিছু করিয়ে ছাড়বেই। ওইসময় এসব ব্যাংকে যায় কোন পাগল ? সময়টা খেয়াল ছিল না বলেই চলে গিয়েছিলাম। গিয়ে বুঝলাম, ভুল করে ফেলেছি। সেটা বলতেই দিশা গলায় আবদার ও অনুযোগ মিশিয়ে বলল, ‘তোমার ভবিষ্যৎ ভালোর জন্যই তো করালাম। খারাপ কী করেছি বল ?’ বলব আর কী ?
তারপর গল্প হচ্ছিল আমাদের। পাঞ্চালির হাতে উল্কি দেখে জিজ্ঞেস করা হল, ‘এটা কি পার্মানেন্ট ট্যাটু ?’ সে সম্মতি দিয়ে প্রশ্নের উত্তরে জানাল যে তার ছেলের নাম ওভাবে খোদাই করে রেখেছে হাতে, যেন প্রায় সারাদিনই কাজের চাপে বাড়ির বাইরে থাকার দৌলতে ছেলের অভাব না তাকে কাতর করে। দিশা তখন জানাল যে সেও উল্কি করেছে তার এক হাতের বাহুতে আর সেটা তার মায়ের মুখ। সে তার জামার হাতা গুটিয়ে মাকে দেখাতে দেখাতে বলল, ‘আমাদের নিয়ম রয়েছে, ট্যাটু করলে কর, কাস্টমারকে দেখানো চলবে না। তাই অফিসে এলে ঢেকে রাখতে হয়।’ আমরা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। সারাটা বাহু জুড়ে তার মায়ের সমস্তটা মুখ কী বিশাল ভাবে খোদাই করে রেখেছে সে ! প্রশ্ন করলাম, ‘এতবড় ট্যাটু করেছ হাতে অনেক্ষণ তো সিটিং দিতে হয়েছিল ? লাগল না ?’ দিশা আমাদের সমস্ত প্রশ্নের উত্তরে যা যা বলেছিল তা হল, ‘আসলে কী জান, আমি তখন সদ্য মাকে হারিয়ে প্রায় পাগলই হয়ে আছি। যেকোন মূল্যে যেকোন ভাবে মাকে আবার ফিরে পেতে মরিয়া। তার জন্য যা খুশি করতে পারি। তো পার্মানেন্ট ট্যাটুর ব্যাপারটা দেখে মনে হল, আমার মাকে আমার কাছে চিরদিন রেখে দেওয়ার এটা হচ্ছে সবচেয়ে ভালো উপায়। দশ ঘন্টা সময় লেগেছিল, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রায় সারাদিন। আমি স্ট্যাচু হয়ে বসেছিলাম। কী যন্ত্রণা হয়েছিল বুঝতেই পারিনি। মাকে আবার ফিরে পাওয়ার আগ্রহে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে ব্যথার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।’
বারণ করা সত্বেও ওদের স্টাফকে দিয়ে কফি বানিয়ে আনালো দিশা, খাচ্ছিলাম তা সবাই মিলে। পাঞ্চালি জানালো, ‘কী জানো, দিশা ওর মা সম্পর্কে কোনো কথাই পাস্ট টেন্সে বলেনা, বলে সব প্রেজেন্ট টেন্সে। মা অতীত ও ভাবে না। প্রত্যেক বার পুজোর সময় মাকে, মানে মায়ের ছবিকে নতুন কাপড় পড়ায়। মায়ের জন্মদিনেও এমনটাই করে। মালা পরায় না, ধুপ জ্বালায় না, কারণ এসব মা নেই বোঝায়। এত অল্পদিনে এইযে দিশা এতবড় পোস্টে এসে গেছে এ কিন্তু ওর মায়েরই আশীর্বাদ। ও বিশ্বাস করে ওর মা ওর সঙ্গেই আছে।’ সহকর্মী ও বন্ধু পাঞ্চালির কথার পিঠেই কথা বলল দিশা, ‘মা আমার থাকে সর্বক্ষণ এটা আমি ফিল করি। মায়ের ছোঁয়া আছে এমন প্রত্যেকটা জিনিস আমি বুকে আগলে রাখি। মায়ের কানের দুল, তার গায়ে লেগে থাকা ময়লাটুকু আমি পরিষ্কার করি না, যত্ন করে রেখে দিই। সবাই আমাকে পাগল ভাবে। কী বোঝাব যে মাকে আমি কাছে পাই ওসবের মধ্যে। জানো, আমি আর পুরী যাই না, কারণ মাকে নিয়ে লাস্ট বেড়াতে গিয়েছিলাম ওখানে।’
দিশার বর্ণনাতে আমি আমাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম, কুড়ি বছর আগের আমিকে। মাকে সদ্য হারিয়ে তখন আমিও এমনই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। মাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতাম গল্প-উপন্যাস লিখে, ম্যাগাজিন তৈরি করে। আমিও আর পুরী যাই না, কারণ একবার ওখানে গিয়ে মা আবার যেতে চেয়েছিল। নিয়ে যেতে পারিনি আর। আগ্রাতে গিয়ে পরিবারের অন্যরা তাজমহল দেখতে গেল, আমি বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম, যাইনি ভিতরে।মা বলেছিল একসময়, ‘বাবা, আমাকে একবার তাজমহলটা দেখিয়ে আনিস।’ পারিনি নিয়ে যেতে কোনদিন তাই। মায়ের শেষসময়ে মিষ্টি প্রিয় খাবার ছিল বলে আমি ওটা বর্জন করেছিলাম। সেসময় বাংলাদেশের অধুনাপ্রয়াত সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক এসেছিলেন কোলকাতাতে, ছিলেন নিজাম প্যালেসে। ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে আমার বাড়িতে আনতে গিয়েছিলাম। হাসানদার স্ত্রী আমাকে একগাদা মিষ্টি দিয়েছিলেন খেতে। আমি মিষ্টি খাই না এবং কেন খাই না জানাতে উনি বলেছিলেন, ‘এই যে তুমি মিষ্টি খাওয়া মায়ের জন্য ছেড়ে দিয়েছ এটা জানলে কিন্তু তোমার মা যেখানেই থাকুন কষ্ট পাবেন। সেটা ভেবে দেখেছ ?’ আমি থমকে গিয়েছিলাম। উত্তর দিতে পারিনি, কিন্তু মিষ্টিও খাইনি। আমার জীবনের প্রায় পনেরটা বছর এমনি উদ্ভ্রান্তের মত কেটেছিল, হারিয়ে গিয়েছিল মা চলে যাওয়ার পর। দিশার মধ্যে এখন আমার সেই আমিকে খুঁজে পেলাম। দিশাও বলল আমাকে, ‘মামায়ের জন্য আমার এই আবেগ কেউ বুঝতে চায় না। কাউকে বোঝাতে পারিনা। আজ তোমাকে খুঁজে পেলাম যে সত্যিই আমার সমব্যথী। আমি আর পাঞ্চালি একদিন তোমার বাড়ি যাব, গিয়ে তোমার মাকে দেখে আসব।’
আমি আর দিশা, আমরা কি অন্য গ্রহের বাসিন্দা ? আমাদের দেখে সবাই অস্বাভাবিক ভাবে, আমরা কাউকে বোঝাতে পারিনা আমাদের কথা, আমাদের ভাষা। আমাদের আবেগ হতে পারে অন্যদের পরিহাসের কারণ। আমরা নীরব থাকি বিশ্বাস বুকে আগলে, অন্য মাত্রা দিয়ে গঠিত জগতে। কে কী বলে কান দিই না। আমরা জানি, আমাদের এই বিশ্বাস আর আবেগই আমাদের জীবন চালাবার জ্বালানি।কাদের ক্ষেত্রে কী হয় জানিনা। আমার আর দিশার ক্ষেত্রে, আমাদের মায়েরা কখনও হারিয়ে যায় না। আমরা আবেগ আর অনুভূতির অতিরিক্ত মাত্রা দিয়ে গঠিত এক বিকল্প বিশ্বের বাসিন্দা।