পৃথিবীতে যে ক’টি প্রাকৃতিক অত্যাশ্চর্য দৃশ্য রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো উত্তর মেরুর স্বর্গীয় জ্যোতিঃপুঞ্জের খেলা, যা বিখ্যাত অরোরা বোরিয়ালিস নামে। উত্তর মেরুপ্রদেশের আলাস্কা দেশ থেকে সবচেয়ে ভালো দেখা যায় এই বিশেষ আলো। প্রধানত শীতকালেই এই আলো আকাশে মায়াজাল সৃষ্টি করে, গরমকালেও যে দেখা যায় না এমন নয়। আলাস্কার ফেয়ারব্যাংকস্ স্থানটি হচ্ছে অরোরা দেখার পক্ষে আদর্শ। বিদেশী পর্যটকের ভিড় এখানে লেগেই আছে, বিশেষত শীতকালে। ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা থেকে রোজ বিকেল ৩টে নাগাদ রাতে অরোরা দেখা যাবে কিনা বা কেমন দেখা যাবে তা ঘোষণা করা হয়। আছে উৎসাহী দর্শকদের জন্য টেলিফোন সার্ভিস। মেরুজ্যোতি আসলে প্রবল সৌর কলঙ্ক থেকে প্রভাবিত হয়। আলোকমালার প্রদর্শনী স্থায়ী হতে পারে একদিন, আবার এক সপ্তাহের বেশিও থাকতে পারে। নৃত্যরত বহুবর্ণমিশ্রিত এই আলোকঝরনা বা অরোরা বোরিয়ালিস গরমকালে দেখার সম্ভবনা বেশ কম। একটু আগেই যেমন বলা হয়েছে, আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয় অরোরা দেখার বিষয়ে আগাম খবর জানায় সবাইকে। এছাড়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন আশ্চর্য আলো নিয়ে গবেষণাও চলছে। ভোরবেলার রোমান দেবীর নামানুসারে অরোরা নামটি। আগে মনে করা হত যে মেরু অঞ্চলের বরফে প্রতিফলিত প্রতিসৃত সূর্যালোক এই অদ্ভুত দৃশ্য সৃষ্টি করে। আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা থেকে জানা গেছে যে আবহমন্ডলের খুব উঁচু স্তরে অবস্থিত অ্যটমকে উচ্চগতিসম্পন্ন ইলেকট্রন আর প্রোটন আঘাত করলে যে বিকিরণ ঘটে সেখান থেকেই এই আলোর জন্ম। এটমের প্রকৃতি ঠিক করে অরোরার রং কী হবে। গবেষণায় এটাও দেখা গেছে যে সূর্যেরও একটা বড় ভূমিকা আছে। সূর্যে বিশেষ কোন বিক্ষোভ বা আলোড়ন তৈরি হওয়ার দু’দিন পর অরোরা অনেক উজ্জ্বল,স্পষ্ট হয়ে অনেকটা বেশি এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আসলে দুটো দিন সময় লাগে সূর্য থেকে পৃথিবীতে সোলার উইন্ড আসতে। সৌরঝড় ঊর্ধ্বাকাশের আবহমণ্ডল ধরে যাওয়ার সময় নানা গ্যাসের কনাগুলোকে আলোকোজ্জ্বল করে অরোরা তৈরি করে। বিষয়টিকে পরীক্ষা করে দেখার জন্য আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বোঝাই রকেট আকাশে পাঠানো হয়। আগেই বলা হয়েছে যে অরোরা দেখার সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে শীতকাল। ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত যখন রাতগুলি দীর্ঘায়িত তখন এই মায়াবী আলোর স্বর্গীয় নাচ আকাশ ভরিয়ে দেয়। অবশ্যই চাঁদবিহীন অন্ধকার রাতে। তরঙ্গায়িত আলোর বহুবর্ণ ফিতেগুলি আকাশ জুড়ে চকমকিয়ে ওঠে। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে সবুজ, হলুদ, কমলা, ঘন লাল রঙের পর্দাগুলি আকাশে নেচে নেচে বেড়ায়। মাটি থেকে এর উচ্চতা হয় কম করেও ৬০-৭০ মাইল। পাক খেতে থাকা গুচ্ছাকার আলোকমালাও দেখা যায় ১৫-২০ মিনিট, যারা শেষে বিপুলাকার সবুজ জ্যোতির্বলয় হয়ে যায় ঘূর্ণি তুলে এবং আকাশের সমস্ত প্রান্ত জুড়ে গনগনে অগ্নিশিখা হয়ে মেলে এক কেন্দ্রীয় বিন্দুতে, আস্তে আস্তে নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। ১৯৫৮ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি দেখা গিয়েছিল রক্তিম অরোরা। এটি এক বিরল ঘটনা। উত্তর ও দক্ষিণের জিওম্যাগনেটিক মেরুপ্রদেশের অঙ্গুরীয় সদৃশ এলাকায় অরোরা জন্ম নেয়। একেক রাতে বা রাতের বিভিন্ন সময়ে এর প্রাবল্য কমবেশি হয়। তীব্র অরোরা পৃথিবীর বুকে নানা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বৈদ্যুতিক তারের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহের মাত্রা বেড়ে গিয়ে ব্ল্যাকআউট যেমন ঘটে তেমনি তৈলবাহী পাইপলাইনেও ক্ষতি দেখা যায়। আয়োনোস্ফিয়ারে অরোরা প্রভাব ফেলে এবং এতে স্বল্পদৈর্ঘ্যের তরঙ্গনির্ভর যোগাযোগ বিঘ্নিত হয়। অরোরা থেকে বিচ্ছুরিত ইলেকট্রন যোগাযোগব্যবস্থা, উপগ্রহের সোলার প্যানেল ও ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম নষ্ট করে দিতে পারে।
এসব ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে অরোরার নৈসর্গিক দৃশ্যকে বিচার করা যায় না। অরোরা পৃথিবীর এক পরমাশ্চর্য ঘটনা, সৌন্দর্যপিপাসু সমস্ত শ্রেণির মানুষের কাছেই এক অধরা বিস্ময়। যা দেখতে সারা পৃথিবী থেকেই ছুটে আসেন পর্যটকেরা কিন্তু অরোরা দেখা ভাগ্যের ব্যাপার।
যেমন বলা হয়েছে, অমাবস্যার তিথিতে অন্ধকার রাত হল অরোরা দেখার ভালো সময়। শীতকাল ছাড়াও বসন্তকালের ফেব্রুয়ারি, মার্চ, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে একে পূর্ণ গরিমায় দেখা যায়। দেখার ক্ষণটি হলো শেষরাত বা ভোরবেলা, আকাশ যখন পরিষ্কার ও বাতাস হিমেল ঠান্ডা। আলাস্কার লোকরা গায়ে পারকা পড়ে বরফে পিঠ রেখে শুয়ে অরোরা দেখে আকাশে। এস্কিমোদের উপকথা অনুযায়ী অরোরা হল আসলে অশরীরি প্রেতাত্মার দল যারা আকাশে সিন্ধুঘোটকের খুলি নিয়ে ফুটবল খেলে। অন্য আরেকটি উপকথায় বিশ্বাস করা হয় যে মৃত আত্মারা এই আলোকোজ্জ্বল টর্চ আকাশে জ্বেলে মৃত ব্যক্তিদের পথ দেখায়।