শরদিন্দু সাহা

বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই  বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।

(যা কিছু দেখি, তাই কি বাস্তব, নাকি যা কিছু অন্তরালে থাকে সেই আপাত অদেখা জীবনেই লুকিয়ে আছে বাস্তবের সারাৎসার। আমরা যদি কোন জাদুবলে সেই অদেখা জীবনকে জীবন্ত করে তুলতে পারি, গোটা সমাজজীবন আর তার চারপাশের চেনা জগৎটাই হয়ত একদিন পাল্টে যাবে, কিংবা অবাক হয়ে ভাবতে থাকবে, যাকে বাসভূমি বলে জেনে এসেছি এতকাল, আদপেই তা নয়, আসলে চোখে পট্টি পরানো সম্পূর্ণটাই এক ধাঁধার জগৎ। লেখক এই উপন্যাসে তার খোলস ছাড়িয়ে আসল জগৎ ও ঘুমন্ত মানুষগুলোকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন অন্য মোড়কে, যা আসলে স্বপ্নভঙ্গ নয়, কোন এক সুন্দর সকালে দেখে ফেলা আলো ঝলমলে জগতের বাহিরে ভিন্ন এক ভূমি, লড়াকু মানুষের জীবন, পশুদের চিৎকার, পাখিদের কলরব, পরম্পরায় মাখা  নোনা ঘামের কলেবর। উপন্যাসে বিচরণ করুন আর সেই কুশীলবদের নতুন করে আবিষ্কার করুন, চিনে নিন অচেনা, অপরাজিত, অপরিচিত নতুন এক বাস্তবতা, লেখকের সৃষ্ট জগতের  অপরনাম ‘অমরাবতী’ )

 

প্রথম অধ্যায় 

আস্তাকুঁড় বলা যায় কিনা জানিনা, অন্ধকূপ তো বটেই। দৃষ্টি যত গভীরে যায় শত শত ব্যাঙাচির দল কিলবিল করে। কত পুরুষের বাস একথা কে নির্দেশ করবে? ইতিহাসের উল্টানো পাতায় কে আর কবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছে না মানুষের আর না ব্যাঙাচির আর গায়ে গা লাগানো মাকড়সার বৃত্ত রচনা। এমন সুকৌশলে সময়ের ও নির্জনতার সদ্ব্যবহার করে, চক্ষু জুড়িয়ে যায়। ওরা পিল পিল করে উঠে আসছে ইটের পুরনো দেয়ালগুলোকে ঘিরে, ওদের বসবাসের সীমানাকে কোনও কথাবার্তার আমল না দিয়ে। শুধুই কি ওরা, এক ঘর লোক আসে, আবার হাসি কান্নায় গল্প বানাতে বানাতে অন্য কোথাও পাড়ি জমায়। কেউ কেউ এসে সাফসুতরো করে না, এমনও তো নয়। কালো কুচকুচে হয়ে যাওয়া ছাদটার নিচে চারদিকের দেয়ালে শ্যাঁতলা ধরা। দু’চারটে গাছ-গাছালি ছাদটাকে আমপাতা জামপাতায় জাপটে ধরেনি, কেমন করেই বা বলবে। কর্তারা পোকাদের শরীর বাঁকানো চলন আর মুন্ডু দর্শনে ঘিন ঘিন তো করেই, সুখী শরীরগুলো তাই কুঁচকে গেলে রোমকূপগুলো এলোমেলো হয়েই হেলতে দুলতে থাকে। অটল আর চঞ্চলরা তাও কোনরকমে নিজেদের বাসযোগ্য করে সকাল সন্ধে ঘুরেফিরে যায় আর আসে। কোথায় যায়, কিভাবে যায়, সে কথা না হয় গোপনই থাক। মাটির ঢেলাগুলো উঁকিঝুঁকি দিয়ে কিছুক্ষণ জং ধরা টিনের মাথায় চুপটি করে বসে থেকে আবার গড়িয়ে পড়ে, নানা রকম সকমে থিতু হয়ে যায়। পরিবর্তনটা যখন আসে ধুমকেতুর মতো চারপাশটা ওলট-পালট করে দেয়। সাতের দশকে ঘরছাড়ার পালা সাঙ্গ করেই দেড়শ বছরের পুরনো এক বাড়ির ডানপাশে ছোট্ট ঘরখানা ভাগাভাগি করেই  দুজনকে দুজনার আগলে রাখা। মাস ফুরোলে ঘরবাড়ির মুখ দেখলেও কিসের টানে যেন ছুটে চলে আসে। কিন্তু এই রাস্তা কাটাকুটি করে পাতালের গর্ভে যারা ধীরে ধীরে প্রবেশ করে মাটির গন্ধ শুঁকছে, এ তো বহুকালের চাপা গন্ধ, যা ওদের নিঃশ্বাসে এসে ধরা দেয় নি কোনকালে। বাস ট্রামের ঠাসাঠাসি ভিড়ে বিতশ্রদ্ধ হয়ে ওরা যখন হাঁটাই শুরু করে শহরের প্রাণকেন্দ্রে যাবে বলে, তেমন কোনো দুশ্চিন্তার কারণ ঘটেনি। মফস্বলের মাইলের পর মাইল হাঁটার অভ্যেসটা রপ্ত আছে বলেই না ওরা এক একটা দিন কোন এক গলির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে নাক বরাবর চলে যায়। একসময় কোথায় যে পথটা বেঁকেচুরে যায়, সেই হিসেবটা কাকেই বা দেবে? কেউ যায় উত্তরে, কেউ একদম মাঝবিন্দুতে। সময়টা কখন যে কার চুরি হয়ে যায় কোন অবশিষ্ট থাকে না। মাঝারি মাপের ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে কিংবা রং তৈরির কারখানায়। সেই সুবাদে বড় বড় বাড়ির সাত তলা দশ তলায় বিচরণ। অটল ভাবতে থাকে এ কী কোন দুঃস্বপ্ন, নতুন এক স্বপ্নের জাল বোনা! ধরা পড়েছে কি ওই মানুষগুলো যারা অলিতে গলিতে মুখ গুঁজে আছে।

অটল আর চঞ্চলরা ফুটপাতের রাস্তা বরাবর জোরে জোরে হাটতে হাঁটতে কখনো পায়ে পায়ে ধাক্কা খেয়ে যায়। আচমকাই বলে ওঠে, ‘আরে তুই! হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছিস?’ ‘ফ্রি স্কুল স্ট্রিট যাব।’ ‘কি এমন কাজ যে এমন করে ছুটতে হবে?’ ডানলপ হাউজের তিন তলার কাজ সেরে পার্ক স্ট্রিটের মুর্শিদাবাদ হাউজের কোল ঘেঁষে চলে যায় চঞ্চল। অটল চঞ্চলের চলে যাওয়া দেখে কত কিইনা ভাবতে শুরু করে। নিরন্তর সেই ভাবনা ওকে পাগল করে দেয়। চোখের আলোতে কত না চোরাস্রোত অনেক অজানা গল্পের জন্ম দিয়ে চলে। কে নেই, কী নেই, কেন নেই, শুরু থেকে নেই শেষ, সেই অসীমান্তিক চালচিত্রে।  যে ছবিগুলো দেখতে চায় দু’হাতে জাপটে ধরে নিয়ে আসে। চোখের পাতাগুলো ভিজে ভিজে জট পাকাতে শুরু করে। সামনে ভাসে ঘন আবিরের লাল লাল রং। চঞ্চল কত কথা বলে,বলতে চায়,অস্পষ্ট না অধরা কেইবা তা জানে! অটল তো কোন ছাড়, মুঠো করে ধরতে চায় বটে, ফুরুত করে পালিয়ে যে যায়। চঞ্চল ওকে অনেক গল্প শোনায়, নতুন অজানা কথা, পুরনো গন্ধ লেগে আছে, কেইবা তা জানে। সেই পৃথিবী দু’জনে জাপটে ধরে। দেখেছিল কত না মানুষ, কত রকমের মুখ, ওরা কোনকালেই ওই যে ঝুলে থাকা সাইনবোর্ডে জায়গা পায়নি, তাদের সঙ্গে একটুও। এই নিয়ে দুজনের কেন যে মাথাব্যথা নেই, কেউ তারা জানে না,জানার কথাও তো নয়। পথের তো কোন নিশানা নেই। কালো কালো রং, নীলচে হয়ে যাওয়া অনন্ত আকাশ, উড়ন্ত মেঘের খেলায় পথ চিনতে চিনতেই জীবনের হিসেব খোঁজা, কল্পনার হিসেব মেলানো এত সহজ কথা নয়। মানুষগুলো কি উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল,না বোধ হয়,ওরা নিজের নিয়মেই পোটলা-পুটলি নিয়ে আত্মীয়তার বন্ধনে এসে জড়িয়েছিল। না হয় এত যোগসূত্র খোঁজার কিইবা প্রয়োজন ছিল? বেজিগুলো আর নেংটি ইঁদুরের অষ্টপ্রহর উৎপাত সহ্য করেও বাঁচামরার ঘ্রাণ নেওয়া চাট্টিখানি কথা তো নয়।

কথাগুলো একেবারেই বেমানান নয়, অস্পষ্ট লাগে তো কারো কারো কাছে। জিবের আড়ষ্টতা নতুন অভ্যাসের জন্ম দিয়েছে হয়তো-বা। চঞ্চলের এমনিতে কোন তাগিদ নেই। নিজেরই খেয়ালে কিনা, হাঁটুগেড়ে বসে পড়ে। ফোঁটা ফোঁটা দুঃখগুলো ভেসে ভেসে চলে আসে। আসবে নাই-বা কেন, জন্ম নিয়েছিল তো অনেককাল আগে। নিজে নিজেই জন্ম নিয়েছিল, নাকি কোন প্রক্রিয়ার অনিবার্য ফলাফল এসে উল্লাসে মেতেছিল! এত রাস্তা,এত ল্যাম্পপোস্ট, কতকালের ধূলোর আস্তরণে মেশামেশি,ওরাও কথা বলে নাকি! কান পাতলেই শোনা তো যায় গুনগুনিয়ে কান্নার শব্দ, মায়ার বিস্ফোরণ ঘটে চলে বিন্দু বিন্দু করে। কেউ বলে,  ‘আয়, আয়, আয়।’ ওরাও তো এসেছিল, বসেছিল উদয়াস্ত, কত রকমের আকুতি, স্রোতের সেই চিহ্নের দাগ,জ্যান্ত হয় তো,প্রশ্ন তো করে, ‘কোথায় যাও?’ জিজ্ঞাসারও তো একটা অন্ত থাকে, তাও তো নেই। তাই বলে কি উঠে দাঁড়াবে না, ডেকে বলবেনা একটু আমায় দেখো বাবা। ওরা ওদের মতো করে দেখে। দৃষ্টির ঘনঘটায় ব্যথার সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে ভেসে চলে মনযমুনায়। কত কি দেখতে চায়, আর কত কী দেখে। নির্ভাবনায় নিরুদ্দিষ্ট যাত্রায় দিনযাপন করে। আসলে কী তাই! চঞ্চল দুপলক চেয়ে আবার চোখ নামিয়ে নেয়। ওরা গড়গড় করে বলে চলে, যা ওরা বলেছিল, যা ওরা বলে চলেছে, যা ওরা বলবে। কত কথা জুড়ে জুড়ে যাবে। অটল উল্টো দিক করে চুলগুলো পাঁচ আঙুলের ফাঁকে মুঠো করে নিষ্প্রদীপে দোল খায়। চঞ্চলের কথাগুলো রূপকথা ছাড়া আর কি। ওরা ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকিতে কেনইবা পিছপা হবে। এমন একটা রপ্ত করা ভাষায় মরা মরা গন্ধ, ধুপোস করে মরা ইঁদুরটা কাকের শক্ত চঞ্চু থেকে আলগা হয়ে যেই না চরকি হলো, চোখ দুটোকে লম্বা করে ধপাস করে সটান ওর পায়ের কাছে – বলে তো উঠল, ছিঃ ছিঃ বিচ্ছিরি গন্ধটা শেষে কিনা! ‘এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল, একটু অন্যরকম হলে কেমন হতো বল তো? ছিটকে তো যেত, বনবন করে ঘুরপাক খেলে কাকটা উল্টোলাফে মুখে পুরে পাঁই পাঁই করে ছুট তো ছুট, গোল্লাছুট। কেউ কেউ আড়চোখে দেখল বা নাই দেখল, কিইবা আসে যায় চ্যাংড়া কাকের, ডানা দুটো নাচিয়ে নাচিয়ে, মোটা সরু লিকলিকে জড়ানো তারের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেত এ লোকটার কাছে, ছেঁড়া পাতাগুলো পকাপক উড়ে বেড়াচ্ছে যেমন খুশি – উঃ কী বাস! উঃ কী বাস! তারপরও গন্ধটা উড়ল, এই কার্নিশ থেকে ওই কার্নিশ, মাথায় মাথায়, চালে চালে কিমভুত কিমাকার। উড়ো উড়ো ডানা থেকে দু-চারখানা পালক এসে আসর বসাল ওই তো দূরে থামটার ছায়ায় ছায়ায়। শরীর থেকে খসে পড়া কম বেদনার তো নয়। এই অনুভবটা ভাগাভাগি করতে চাইল চঞ্চল, অটল তখন অন্য পথে সতেজ ঘাসের গা-জোয়ারি আদেখলাপনা দেখে।

 ‘ওরে বিশ্বাস কর এই দেখা শেষ দেখা নয়।’ কাকেরও বলিহারি, অত সহজে জমি ছাড়বে কেন? ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ ওই কাক বেটার, ধর ধর ওকেই ধর।’ সব্বনাশটা ঝপাং করে লেংটা লোকটার গা ঘেঁষেই ঘটে গেল। না, যতটা অনুমান করা গেছিল, ততটা ঘটেনি। বলিহারি বেটা কাকের, ছালা আর আঁটি দুই নিয়ে ডানা ঝাপটিয়ে রেলিং-এর ধারে গিয়ে ঘষটানো ঠোঁটে এপাশ ওপাশ দেখল। চঞ্চল ওর গতিবিধি অনুসরণ করল না-দেখার ভঙ্গিতে। কাকটা শুনতে পেল তেলের কড়াইয়ে ছ্যাঁৎ ছুঁতে শব্দ, কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া থেকে যে আঁকাবাঁকা শরীর মূর্ত হলো, কাকটা সেই শব্দকে শোষণ করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে আবারও এমন এক ঢঙে উষ্মা প্রকাশ করল – আহা এমন সুন্দরী কে কবে দেখেছে? কে আর দেখবে? রূপে মুগ্ধ তনয় তনয়ারা নিজেরাই চোখাচোখি করে,  মুগ্ধ হয়ে  নাচানাচি করে। চঞ্চলের হাতে অঢেল সময়, দৃষ্টি ফেলে ফেলে এমন পথে যায় যেখানে কাক সুন্দরী পা থপ থপ করে চলে। ‘অটলটা কানা নাকি, পথ খুঁজে মরে পাতায় পাতায়, বড় নীরব, নিশ্চল, শব্দ খুঁড়ে মরে, গন্ধ কোথায়, চোখের আলোতে কত যে ধুলোপথ, হিজিবিজি চিত্রলেখা, গল্পের ছড়াছড়ি, ধুয়েমুছে ফেলা, জুড়ে জুড়ে যাওয়া, খুব সাঁতার কাটা মহাসমুদ্রের তরঙ্গে।’ চঞ্চল নিরুপায় হয়ে দেখে ফেলে কাক সুন্দরী নেচেকুঁদে বেড়াচ্ছে ডিশ আ্যন্টেনার এধার ওধার মনের সুখে। কী আনন্দ! কী আনন্দ! সোজা গোত্তা মেরে পান বিড়ির সিগারেটের দোকানের সামনে রাখা ডাস্টবিনের অন্দরে। বিচিত্র গন্ধগুলো কেমন সযত্নে ওড়াওড়ি করে, ফুটুর ফাটুর আওয়াজও করে। কাক সুন্দরী নাকের ডগায় পানবোঁটাকে,পোড়া বিড়ির গন্ধকে নিয়ে সেই কি সুখ। কা কা করে ডাকবে না, সে আবার কেমন করে হয়! ঠোঁটে গালে নাকে মিশিয়ে জড়িয়ে তো নিল। চঞ্চল বলল, ‘ওরে ও বেটা, এমন ধিঙ্গিপনায় বেশ তো সব চেটেপুটে নেবে বলে ঠিক করেছ।’

চঞ্চল কি নিজেকে দোষের ভাগী ভাবল। অটলকে কত করে বলল,’ওরে ওখানে যাস না, জঙ্গলে হাঁ করে বসে আছে কালনাগিনী।’ কার কথা কে শোনে। একটু তো বেয়ারা বটেই, জবাব দেবার মতো কেউ নেই কিনা। চোরাগোপ্তা কারা যে গিজগিজ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘাসের আড়ালে ছায়ারা গোপন কুঠুরিতে বাসা বেঁধে আছে, অটলের এমন কি সাধ্য তাদের পাল্টে দেবে। তবে কীসের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে উদয়াস্ত জম্পেশ করে ভাবের ঘরে আগুন জ্বালে। লাগাম ছাড়া ঘোড়ার মতো ছোটে কীসের নেশায়? এই প্রশ্নের জাল অনুভবের গোনাগুনতিতে সুঁইয়ের পরে সুঁই ফোঁটায়। জবাব তো মেলে নি। কে দেবে তার জবাব? নিজের ঘরে নিজেই সাফসুতরো করে কোথায় যে হারিয়ে যায়। একদিন হঠাৎই দেখে ফেলেছিল সেই কালনাগিনীর ভয়ঙ্কর রূপ। জলের পাইপের কালচে গা বেয়ে নিচে নেমে আসছে, একসময় চোখ ঘোরাতেই ছুটে চলে যায় নিজের গন্তব্যে। একদম সেই বিষধর চাহনির কোপে রঙগুলো নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে তাকে ধরা বোঝার অনন্ত সাধ অটলের মনের সংসারে করে আইঢাই। ওরা যে যেতে যেতে বিদ্রুপের বাক্যবান ছুঁড়ে দিচ্ছে পছন্দ হয় নি ওর। গোড়ালি দিয়ে রাগে  ক্ষোভে দুঃখে ইটবালির আস্তরণ করে ফালাফালা। কান পেতে থাকে দেয়ালের ফাঁকে ফাঁকে। কেমনতর সোঁ সোঁ শব্দ, জোরে এসে ধাক্কা মারছে, এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে পারে। কখন যেন কানে বেজেছে সেই শব্দের স্বর। শত শত জন্ম মৃত্যুর ক্ষণ, ক্ষণকে ঘিরে হর্ষ বিষাদের উৎসব জ্যান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরের আনাচে কানাচে। এত যে কথা, কবে জন্ম হয়েছিল এসবের? কেন জন্ম হয়েছিল এসবের? একটু একটু করে ভাসিয়ে দিয়েছিল অন্তরে, অন্দরে। কোষে কোষে জন্ম নিচ্ছে জল-জঙ্গলে-নালায়- ডোবাপুকুরে-খানাখন্দে কত কি। ওরা সব ওলটপালট করে দিয়েছে। ডিঙায় চড়ে বারো তেরো খাল পেরিয়ে রাস্তা খুঁজে মরেছে। কালনাগিনী চোখ পাকিয়ে দেখেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম শুষে নিচ্ছে ওদের শরীর। চোখের জলে বুক ভাসে। ওর তবুও কী উল্লাস! মুখ থুবড়ে পড়বে, এ আর এমন কী, লেজটা দোলায় আনন্দে। ওয়াক থুঃ। মরবি যদি, এই পুরীতে কি আশায়? ঐ নাগিন ওই আস্তানায় হল্লা মাচিয়েছিল। অটল যোগে বসেছিল, বিয়োগ তো করে নি, তবু এত! ছেঁড়া চপ্পলটা দিয়ে কারা যেন ওর দু’গালে এসে মারতেই থাকে ফটাফট। কারা এরা? কোথায় ছিল এতদিন? হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো। এমন সব্বনেশে কাণ্ড যে ঘটতে পারে, ছিল তো কল্পনাতীত। ‘অটল বেশি ঘাটাস না, বংশ নির্বংশ হবে। প্রেম আর শোক দুয়ে মিলে এমন আঁধার নামবে, হাত পা চিবোতে থাকবে, সময়ের সকল দ্বন্দ্ব যাবে ঘুছে, নিজেই ভাবতে থাকবি এমনটা না হলে চলছিল না।’

কাকটার চোখে ফোঁটা ফোঁটা জল। নিজের মনে কেউ কাঁদে বুঝি। ওর পায়ের কাছে বসা মানুষটা হাউমাউ করে চোখের জল ঝরাচ্ছে। গত রাতের আলোর উৎসবে ও এক কোণে লুকিয়েছিল। তাকিয়েছিল ও চোখ পিটপিট করে । কাকটা ওকে একটুও ভয় পায় নি, বরঞ্চ বস্তা পেতে শুয়ে থাকা শরীরটাকে ঠোঁট দিয়ে চুলকে  বলতে চাইল, ‘এত ঝিমিয়ে পড়লে চলবে কেন? আমায় দেখ, সব জল শুকিয়ে নিয়েছি।’ একটু আগেই দুমড়েমুচড়ে ফেলা ঠোঙাটা কত চেষ্টা চরিত্র করে তাড়াতাড়ি ছিঁড়ে নিল পাছে খাবারটা শুকিয়ে বাসি গন্ধ বেরোয়, তাই যদি হয় কুটিকুটি করে লোকটার ঠোঁট দুটো ফাঁক করে পেট ভরাবে কেমন করে! লোকটা একটু নড়েচড়ে উঠল, পাতা উল্টিয়ে দেখতে চাইল, এ আবার কোন শত্তুর দুশমন? ‘হুশ হুশ’। এক পা-ও নড়ল না, আরও বেশি করে ওর শরীরের গন্ধ শুঁকল। কে যেন লাথি মেরে ওর শরীরটাকে চিৎপটাং করে দিয়ে দু’এক পা এগিয়ে গেল। কাকটা আরও ঝাঁঝালো গলায় চিৎকার করল, তাতে শান্তি তো হলোই না, রাগে গজরাল ক্ষণেক। তারপর ওই ঠোঙাটা ওর মাথার উপর ফেলে ফুরুত করে উড়ে এসে সোজা বসবি তো বস লোকটার বুকের উপর। কি মনে করে লেজ দিয়ে ওর চুলে বিলি কেটে দিল। অপমানের জ্বালা জুড়িয়ে দিল বোধহয়। এমন একটা ভঙ্গি করলো, ‘ও শালা আবার কে, পাহারাদার নাম দেব গুছিয়ে এক লহমায়। এই শহরে কত তো গাছ, কত তো ডালপালা, কত তো ছড়ানো মূল, কত তো ছায়া, নিত্য কত আলোর আসা যাওয়া,কত বৃষ্টিজল, হ্যাঁ হ্যাঁ সব আমাদের। আমরা রোজ গায়ে মাখি। রাতরক্ষী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা দেখো। এখনও দিনের আলো আর ধুলোর গন্ধ ওদের পালকে লেগে। তোমাদের সাহসের তো বলিহারি!’ লোকটাকে সুরক্ষিত রেখে ও কোথায় যেন উড়ে চলে গেল, যাবার বেলায় বলে গেল, ‘এটা আমাদের শহর,ভুল করেও অন্য ভাবনায় মন দিও না, তাহলে কিন্তু জেনে রেখো, একেবারে শিরে সংক্রান্তি।’ ওর আকাশ, ওর মাটিতে, ওর দূরের গলিতে উলঙ্গ শরীর, বিনিময়ের বিলাপে হয়েছে উচ্ছিষ্ট। পাখিরাও ডেকে ডেকে সারা হল। এই ঘোর অন্ধকারের নির্জনতা ভেঙে খান খান হলো ঘেউ ঘেউ শব্দে। কালো রঙে কালো মেলায় ওর অস্তিত্বকে কেইবা চিনল। না, না কোন ক্ষোভ, কোন দুঃখ এসে ওকে ছুঁতে পারে না,তা অসম্ভবও কেবল কম নয়। মেয়েটি ঘোরে ছিল,চেনা রাস্তা অচেনা হল। কাকটা ডানা নাড়িয়ে পত পত শব্দে উড়ে গেল। সেই শব্দের আগুন ছড়াল এঁকে বেঁকে।  বাড়িঘরের বন্ধ দরজার আড়ালে লুকোবে ভেবেছিল, নিস্তার তো মিলল না, ছেঁড়া ব্লাউজের ফাঁকফোকর দিয়ে সন্ততির খাদ্যরস খেজুর গাছের নালির মতো টপটপ করে পড়ল। মেয়েটি হাঁটা থামিয়ে কাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়বে ঠিক করল,কি জানি কখন জ্বলা আলোটা নিবে যায়, ছেঁড়া খামচানো শরীরটা প্রাতঃভ্রমণকারীদের নজরে পড়ে বেরিয়ে না আসে সেই চিরাচরিত শব্দ ‘ছিঃ ছিঃ’। তাই বলে কি রোজগারটা মুষ্টিবদ্ধ করে রাখবে না, তা কেমন করে হয়? কত আশার বাতি জ্বালিয়ে পায়ে পায়ে এই জঙ্গলে পা রেখেছিল। মানুষের জঙ্গল যে এমনটা হয়,জানাটা কি জরুরী ছিল? চার চারটে পেট–কাঁধে, পেটে, পিঠে, কোলে। কাকটা যেতে যেতে অভয়বাণী উচ্চারণ করল, ‘মানুষের জঙ্গল তো! এরকমটা হয়। শরীরের আর দোষ কী! সস্তায় পেলে খাবলে তো নেবেই, মানুষের আবার মানুষীর মাংস খাওয়ার স্বাদ হয়েছে যে। এই গল্প লম্বা সময়ের গল্প, পোড়া মাংসের স্বাদও জিবে লেগে থাকে, বাপ-ঠাকুরদারাও এই গল্প বলতে ছাড়ে নি। ওরা বলেছিল,এই দেখ, এই নেই।’

চঞ্চল অনুসরণ করেই চলেছিল সেই উড়ন্ত ডানার পতপত শব্দকে। বিলুকে চেনেনা কে আর আছে। রাস্তার ফুচকাওয়ালা রতন, ফেরিওয়ালা কালু, কাটাফল বিক্রেতা গগন, মুচি রামু আর সন্তোষী ওকে ডাকখোঁজ করে বসায়। আদর করে বলে ‘এত পাগলামী করে না বাপু, কে কখন ঢিল ছুঁড়ে মাথা ফাটিয়ে দেবে।’ বিলু হো হো করে হাসবে না, সে আবার হয়! হাসবে তো বটেই, তা যদি না হবে শুরু থেকে শেষ আর শেষ থেকে শুরু শুনবে কেমন করে? ওরা তাই তো পেছন পেছন ছোটে। কী যে সব আজব গল্প, কম বলা হয় ভুতুড়ে বললে। রামু জুতো পালিশ করে চকচক করে – ম্যাঁয় সহি বাত বলা তো। চঞ্চলের পা চালানোর অভ্যাসটা তো থামার নয়, কোথায় যাবে আর কোথায় যে যাবে না, জানে না ও। কেমন করে জানবে? ওই কাক সুন্দরীই যত নষ্টের গোড়া। কখন যে কোথায় নিয়ে ফেলবে কে জানে। লোকগুলো বিলুর পেছনে ছুটছে আর মজার কাহিনীতে মজে ঢোক গিলছে, সে তো আর ওর নজর এড়ায়নি। এড়াতে কিছুতেই তো পারে না। বিলুর চোখগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে ফেলার কায়দা আর গপ্প বলার ফাঁকে ঠোঁট কামড়ানো এমন এক অভিনব আয়োজন কে আর কবে দেখেছে। ওরা তো ওর কথা বলার আদলটাই খেয়াল করেনি – মুখ চিবিয়ে চিবিয়ে শব্দগুলো ছুঁড়ে দিচ্ছে, একটু আধটু থুথু ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে – ‘শালা, চোখের কি মাথা খেয়েছিস, এধার ওধার দেখতে পাস না, ওই পাগলাচোদা লোকগুলোর কি মতিভ্রম হয়েছে? কী বলে ও! একটা ফান্টুস বই তো নয়।’ ‘না গো না, এই এক নেশা। বিলুর নাকি পেটের ভিতর সব গুড়গুড় করে, না বললে যে ওর রক্ষা নেই। এমন কোন রাস্তা আছে শহরের, ও চড়ে বেড়ায় না, এমন কোন মানুষ আছে, এগলি ওগলি যে বিলু পাগলাকে গড় করে না, এলেম আছে বটে, অদ্ভুত এক ক্ষমতা, স্বীকার না করলেই নয়। গল্পের গরুকে কেমন করে গাছে ওঠাতে হয়, এমন ভালো বিদ্যা কয়জনে জানে।’ পথচারীরা এমন করেই বকবকিয়ে এবাড়ি ওবাড়ির দরজায় ঢুকে যায়। কি জানি দু’তিন কামরার অফিসঘরে বসে বিলুর গপ্পের আমেজ নেয় না কে বলতে পারে। চঞ্চল এসে সেই শূন্যস্থান পূরণ করে। ‘পরখ করে দেখাই যাক না, এবার নতুন কী গ্যাঁজা দেয়।’

বিলু অনেক নতুন কথা আকাশে বাতাসে ছুঁড়ে দেয়। চঞ্চল ওকে ধরবে বলে অনেক কাছাকাছি চলে আসে। বিলু এত ঘনিষ্ঠ হতে চাওয়া চঞ্চলকে দেখে নতুন কোন গপ্পের বীজ বপন করতে শুরু করে। সেই ঘ্রাণ এসে চঞ্চলের নিঃশ্বাসে  সুড়সুড়ি দেয়। হঠাৎই বিলু চঞ্চলের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারে। চঞ্চলের ভাবনায় কত কিছুই না খেলে যায় – ‘লোকটার সত্যিই কী মাথার ব্যামো আছে! তবে এত লোক  ঘুরে কেন বেড়াচ্ছে ওর পেছনে?’ বিলু ওর মাথার চুল খামচে মাটিতে বসিয়ে দেয়। শুইয়ে দিয়ে বলে, ‘কান পেতে শোন বেটা।’ কাদের কান্নার শব্দ? মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ‘শুনতে পাচ্ছিস তো?’ ‘তাই তো!’ কান্নার আগ্নেয়গিরি যেন টগবগ করে ফুটছে। ভয়ে ওর পিলে চমকে যায়। কত গপ্পই তো মা-ঠাকমারা কানে কানে এসে শুনিয়ে গেছে, তিন পুরুষ ধরে এই রাস্তায় রাস্তায় মাটি মাড়িয়েছে। বিলু কী সেই গপ্প জানে। ‘শুধু কি জানি, ওদের ছোঁয়া পাই, ওদের পায়ের ছাপ আমি এঁকে রেখেছি আমার বুকে। দেখাবো নাকি?’ ‘বিলুটা বলে কী রে! চঞ্চলের চক্ষু চড়কগাছ হবে। না ভেবেই কিন্তু দু’হাত তুলে নাচবে। বলে ফেলতেও তো পারে ‘হরি হে মাধব’। কান্নার শব্দটা ভারি মনে হচ্ছে না! কত তো ও নিজেও কেঁদেছিল। কেই বা শুনেছিল সেই কান্না? নিজের কান্নার শব্দ কি কেউ শুনতে পায়! শিশুর কান্নার শব্দ কেবল মা-ই তো শুনতে পায়। মা-ই বার বার করে নানা শব্দে চিনিয়েছিল ওর কান্নার রোল – বৃষ্টি যেমন ঝরঝর করে পড়ে, পাতার পরে পাতা যেমন করে উড়ে উড়ে বেড়ায়, বাচ্চা পাখিরা চিঁ চিঁ করে ডাকে খড়কুটোতে শুয়ে। দাদু শরীরের যন্ত্রণায় গোঙ্গিয়ে ফুঁপিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে ডাকত ‘মরে গেলাম গো।’ ‘কোথাও কি মিল খুঁজে পাচ্ছিস?’ তবে কি এই পথে হেঁটে বেড়িয়েছিল তেনারা। কান্নার শব্দটা তাই তো বড়ো চেনা চেনা মনে হয়, ওদের চোখের জলের মণ্ড কখন যে সেঁধিয়ে গেছে, কংক্রিটের প্রলেপ পড়েছে। ‘দেখছিস তো ওরা কত প্রশ্ন করছে চোখের জলে।’ পাগলের প্রলাপ বকছে না তো। বিলুর মনের কোণে অজুত হাতির শক্তি। কী অসম্ভব বীর বিক্রমে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে অসংখ্য মানুষ। কোথায় পেল ও মানুষ টানার ক্ষমতা? ম্যাজিক তো রপ্ত করেছে কোনভাবে। ও কি এমন কাউকে খুঁজে পেয়েছে যে ওকে দৈবাৎ শুনিয়েছিল কান্নার শব্দ। না কোনো ভেলকি। দুনিয়াটা বনবন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কারা যেন জীবনের আয়ুটাকে খুশিমতো কমিয়ে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ‘এবার দেখ কান্নাগুলো আমি ভাগে ভাগে তুলে আনি, চিনতে পারবি তো?’ ‘পাগলের এ কেমন চৈতন্যের জাগরণ!’

চঞ্চল নিজের শরীরটাকে এলিয়ে দেয়। বিলু কথা ছুঁড়ে দেয়, ‘শুয়ে থাক, সটান শুয়ে থাক।’ কাঁপছে, গোটা শহরটাকে নিয়ে কাঁপছে। ওরা হঠাৎ জেগে উঠল কেন? জেগে ওঠার দরকার ছিল বলে। বিলুর ইচ্ছেতেই এই গুমরানো কান্না এমন করে হাহুতাশ করছে? ‘খুব মজা লাগছে,না!’ কাকটা এতক্ষণ গাছের আড়ালেই লুকিয়েছিল। এবার কা কা শব্দে প্রাণ ফাটালো। কোন অলক্ষুণে সময়ের আগাম সংকেত কিনা কি জানি। আবার কোন রাস্তা চৌচির হবে? আপনমনে হেঁটে আসা মানুষগুলো মাটির নিচে সেঁধিয়ে যাবে। কৌশলী মানুষজন যার যার হাতিয়ার, যন্ত্রপাতি নিয়ে ছুটে আসবে। উদ্ধারের বাসনা নিয়ে যেই না ঝাঁপিয়ে পড়বে, কী দেখতে পাবে? ‘ও মা, ও বাবাগো।’ যন্ত্রণাগুলো দলা পাকিয়ে আছে, কান্নারা সব ভিন্ন ভিন্ন কুণ্ডলীতে এমন এক ব্যথার জন্ম দিচ্ছে, সেখানে পৌঁছানোর বিদ্যা কারো জানা নেই, শুধুই শোনা, শুধুই অদর্শনের জাল বোনা। চঞ্চল মাটি সরিয়ে সরিয়ে কত কি দেখার চেষ্টা করে, আলাদা ঢঙে চিনে নিতে পারে কিনা, রক্ত কেবলই রক্ত, ফ্যাকাশে মেঠো রঙে বিবর্ণ হয়ে বদ্ধ বাতাসে দোল খাওয়া। কেউ নেই,নেই কেউ, কে জানবে,কেমন করে ওরা উপরের মাটি ছুঁয়েছিল, হাঁকডাক করে চলে গিয়েছিল বিলম্বিত সময় পার করবে বলে। লাথি ঝাঁটা কপালে জোটেনি একথা বলার সাহস কার আছে? লালমুখো আর দেশি সাপের ছোবল তো অনায়াসে খেয়েছিল,খেতে তো হবেই, ছেলেপুলে নাতিনাতকুরদের জন্য দুমুঠো অন্ন জোগাড়যন্ত্র করবে বলেই না খাটো ধুতি পরে, মাথায় বোঝা চাপিয়ে গলায় থলে ঝুলিয়ে নাঙ্গা পায়ে মুঠো মুঠো অফিস বাড়ি দেখা। কোন এক পুরুষের কেউ বাবুর বাড়ির খানসামা হয়েছিল, গুম করে দিয়েছিল কিনা। সে কান্নাও কি মেশেনি? মিশেছে বই কি, খোঁজার অন্ত নেই, রাস্তার নামটাই সম্বল ছিল,সেও তো পাল্টেপুল্টে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। ভাঙাচোরা ঘরবাড়ির দ্বারে দ্বারে খোঁজে নি, এমনও তো নয়, কত তো চিৎকার চেঁচামেচি, শেষমেষ কান্নাকাটি সার হলো! মরা মানুষের ঠিকুজি কুষ্টি সব ওই পাগলার মস্তিষ্কেই জায়গা নিয়েছে,হবে হয়তবা। বিশ্বাসে কিনা হয়, রাত দিন হয়, দিন রাত হয়। বিলু চিৎকার করতে করতে চলে যায় ‘আমি জানি, আমি জানি।’

দ্বিতীয় অধ্যায় 

ঘোড়াটা হ্রেষা ধ্বনি তুলতেই কেন যে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে রাস্তা ছেড়ে অগোছালো ক্ষুরের লাফালাফিতে  এদিক ওদিক ছুটতে লাগাল, স্বয়ং ঘোড়সওয়ারিও অনুমান করতে পারল না কী ঘটতে চলেছে। বিলুর পেছনে পেছন যারা মজা লোটার অসীম আগ্রহে পথ মাপছিল তারাও হতভম্ব হয়ে ঘোড়াটার লেজ দোলানোই দেখতে লাগল। এতক্ষণ যে কথার ফুলঝুরি ছড়াচ্ছিল, সেটাও যেন কোন জাদুবলে থেমে গেল, টু শব্দটি বের হলো না আর।  কেউ কেউ ভাবতে লাগল, বিলুর সঙ্গে কোন সাজশ আছে কিনা, কি জানি। বিলু শুধু  বলতে লাগল ‘বেশ হয়েছে, এবার সবাই বেঘোরে মর।’ দু’হাতে তালি দিয়ে বেজায় আনন্দ প্রকাশ করতেও ছাড়েনি। এরকমটা হয় হয়ত বা। ঘোড়াটা  দেখল ওই কড়কড় শব্দে আকাশ ভাঙা বাজ আর ঝকমকি আলোর বেহায়াপনা। কত তো জ্যামিতিক খেলা – যাকে পায় তাকে মুখে পুরে নেবে । চোখ পাকিয়ে  ঘোড়াটা দেখল পায়রাগুলোর বক বকম বক বকম আওয়াজে ডানা মেলে উড়ে যাওয়া। একটু আগেই তো আসর বসিয়েছিল খালি ছোট্ট এক ফালি জায়গা জুড়ে। এরকমটা হয় নিজের জায়গাটা কখন যে অন্যের হয়ে যায় জানতেই পারে না। খুঁটে খুঁটে বেশ তো খাচ্ছিল মনের সুখে, কেউ তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছিল ছোলা আর মটর দানা, আরাম আয়েশে দিন কাটাচ্ছিল, ছানার মুখে  ঠোঁটে করে আনা খাবার পুরে দিচ্ছিল, গা-ও চেটে দিচ্ছিল, দু’একটা পালক যে খসে পড়ে নি, এমনও তো নয়। কষ্ট হবে না আবার সে কখনো হয়! দিন তো সমান যায় না। কে জানত, ঘোড়াসওয়ার এইভাবে ঘোড়া ছুটিয়ে আসবে উল্কা বেগে, কালো কালো রাক্ষুসী হতচ্ছাড়া মেঘগুলো গজরে উঠবে, ক্ষুরের শব্দ চারপাশে এভাবে আছড়ে পড়বে। পায়রাগুলো না হয় ঘুলঘুলিতে বসে দেখবে ঘোড়ার কীর্তিকলাপ আর অন্ধকারের দাপাদাপি। ফুটপাতে শুয়ে থাকা বাচ্চাগুলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ভয়, ভীষণ ভয়, ভয়ের ভয়াল চেহারায় ওরা আঁতকে ওঠে, এই বুঝি ছেঁড়া নেকড়াগুলো কুকুর বেড়ালরা টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাবে। না এমনটা ঘটে নি, ওরাই বিপদ বুঝে বড় বড় পিলার দেওয়া চাতালে এনে এমন ভাব করে ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিয়েছে – মারবি তোরা কোন বাপের বেটা, তোদের যদি ঘাড় না মটকে দি, তবে এক মায়ের গর্ভে জন্মায় নি। বাচ্চাগুলো হাত পা নেড়ে বোঝাতে চাইল কোথায় যাবে ওরা। মা-বাপ ফিরবে যখন, তার আগেই যদি টালমাটাল হয়ে সবকিছু বেসামাল হয়, ওদের রক্ষকরা লেজ তুলে পালাবে না তো। ওদের কান্নাটা দলা পাকিয়ে গিয়ে উথলে উঠল। ওরা কি বুঝে উঠতে পারল ঐ যে দৌড়ে দৌড়ে আসছে, কীসের এত আতঙ্ক! তাহলে ওদেরও কী হৃৎপিণ্ড থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। যন্ত্রণায় কাতরাবে না ওরা? হ্যাঁ কাতরাবে, অবশ্যই কতরাবে, এক ফোঁটা ঘুম চোখে নেই, আঁধারের গুটিপোকাগুলো ঘুরে বেড়িয়েছে ওদের চোখের পাতায়। ওই অন্ধকারেও দেখেছে আলোর পৃথিবীর বিভীষিকা। ওদের পাছায় দুই  লাথি মেরে দূর দূর করে তাড়াবে। ঘেমে নেয়ে ভিজে যাবে ওদের পিঠ, খুক খুক করে কাঁদবে। ঘোড়দৌড়ে ভেড়া বই তো নয়। লোকের দুঃখে প্রানটা কাঁইকুঁই করে, কানটা ধরে দু’পায়ের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে।  ভোঁ ভোঁ করে আপ ডাউন হুশ্ করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়, সেকথা সকাল সন্ধে মনের কোনে গুনগুন করে। বড় বেসামাল দশা, এমন দশা কে দেখতে চায়?  কথায় কথায় বলে ওঠে প্রাণের মুক্তি। এমন শব্দ কি পোষ মানে?  সে কথা ভাবতেই বা যাবে বাবু মানুষরা  কোন দুঃখে! ঘাসের আড়াল আবডালে ওরা  গঙ্গাফড়িং-এর নাচন তো দেখে নি। সবুজ পাতারা যে কেঁদে কেঁদে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন দৃশ্য দেখে ওদের মনটা আকুল হয়নি তো! হয়েছে কী? বলেছি কি, ‘যা বেটা, সময় সুযোগ মতো দু’দণ্ড মানুষগুলোকে বুকে জড়িয়ে ধর।’ কিছু যদি আনমনেও জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে জাগে ওরা মুখ চেপে ধরেই ছোটে। ঘেউ ঘেউ আওয়াজ কেঁদে কেঁদে জানান দিল তোমরা ভয় পেয়ো না। কেঁদো না গো কেঁদো না, তোমরা কাঁদলে আমরা যাই কোথায়। ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দগুলো স্পষ্ট হয়ে পিচের ছাল উঠিয়ে ঘোড়াসওয়ারকে সচেতন করল, লাগাম শেষ কথা যে বলে না।

বিলু পাগল তাই না দেখে হাততালি দেয়। পতপত শব্দের মায়ায় জড়িয়ে কেমন যেন বেসামাল হয়। ঘোড়াসওয়ার এই সুযোগে যে কোন পথ ধরে দৌড়তে শুরু করে, কেউ টেরও পায় না। অনেকটা আঁকাবাঁকা পথ কিনা। তা ধিনা ধিন ধিন। ‘রাজার বাড়ি চোখ খুলেছে, আয় লো তোরা আয়, খাঁচার পাখির মাতন দেখে যা।’ তাই না দেখে তারা হরি সংকীর্তনে মেতেছে। ভাবল, এতো ভালো কথা নয়। আওয়াজ তোলে ‘চলো মোরা রাজার বাড়ি।’ ঘোড়াটা যে এইদিকেই আসছে, বড় বেয়াদব ঘোড়া তো, বলে কিনা ‘হরিবোল’। মানুষগুলোর মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে রাজার বাড়ির দিকে তাক করে আছে। আবার  উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে বলে ‘হরিবোল’। শত শত লোক গলা মিলিয়ে বলে ‘গড়ে হরিবোল। কত সাধ্য সাধনা, চল দেখি না বিলু পাগলার কান্ডখানা দেখবি চল।’ কি জানি কোন স্বপ্নের আকাঙ্খা উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল কিনা। ঝমঝম, কচর মচর, মচমচ, হায় হায়রে শব্দগুলো এসে দোতলার ঘুপচি ঘর টপকে চলে আসে। হুড় হুড় করে ওরা নামে আর ওঠে। আদ্যি কালের বদ্যি বুড়োর মতো কালচে সিঁড়ি বেয়ে এলে বাসি পচা পচা ইঁদুর মারা গন্ধ নাকে লাগে, ওরা চক্রান্ত করেই মেরেছে। বিলু পাগলা জোরে জোরে হাততালি দেয়। শ মাইল, পঞ্চাশ মাইল পথ ভেঙে, পায়ে পায়ে ধুলোর পাহাড় এনে হয়েছে স্তূপের পর স্তূপ। সময়ের বাঁধনটা বড্ড শক্ত কিনা তাই জোরে জোরে চাকা ঘোরানো।  বুশ রেডিওর খাঁচাগুলো লাফাচ্ছে। তাই তো বোঝা গেল কিন্তু কাকগুলোর লাফালাফি ঝাপাঝাপি একটুও থামল না। 

চঞ্চলের সুযোগ বুঝে নানা জাতের প্রশ্ন – ‘ ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে যে সব। কাকেরা লাইটপোষ্টের উপর থেকে গোত্তা খাবে কিনা।’ পাগলাঝোরা কাক, নজরটা চট করে ওই লালবাড়িটার দিকে এক লহমায় চলে গেল। ভাবনার অনুগুলো ঘূর্ণিপাকে পাক খেল। আহাঃ কাকের চোখে জল। দু’চারজন লোক বলল, ‘দেখ, দেখ, কাকের চোখে জল।’ ‘অকাল বর্ষা এই শহরে’। ‘নারে না,সব পাল্টাচ্ছে কিনা। ওরা মানুষ হয়েছে।’ মানুষগুলো পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে হাঁটছে, আর হাত দুটোকে ডানার মতো করে উড়িয়ে উড়িয়ে ভাবছে কখন গিয়ে ল্যামপোষ্টে চড়ে বসবে। কাকটা ডানা নাড়ল, একটু একটু করে নাড়ল। আনন্দে আবারও ডানা দোলাল। ভাবনাটা এল আর গেল, অর্থহীন সব ভাবনার বিস্ফোরণ ঘটে পাশের উঁচু হওয়া ডালটাকে নাড়িয়ে দিলো। দীর্ঘদিনের সঙ্গী কিনা। বাঁশিওয়ালা যে সুর ভাঁজছে, তাই বলে কি সুরের মজাটুকু নেবে না? নিল তো একটু একটু করে আবার কোথায় যে উড়ে চলে গেল, মানুষরা হাঁ করে দেখল। কত যে ঘুরপাক খেলে। শেষে কিনা লালবাড়ির ছাদে গিয়ে বসা। ইচ্ছে হল দিঘিটার জল ঢোক ঢোক করে গিলে তৃষ্ণা মিটাবে, তা তো হবার নয়, ফলে যা হবার তাই হবে। চোঁ চোঁ করে টানল। চঞ্চল নাচতে নাচতে তো এল। বিলুর চিন্তার রস টেনে নেবে, এমন রসবোধ কি ওর আছে? মগজের জোর তো নেই, দূর্ভাগা ছাড়া আর কি, দু’চোখ ভরে তাই তো খামচে খামচে নেয়, এটাও তো ভাবে, নিতে গেলে যদি তেমন কোন বিপদ ঘটে। এতদিনে ও বুঝে ফেলেছে সবকিছু যেন কেমন এবড়ো খেবড়ো, পথ আছে, কিন্তু পথ নেই। ইচ্ছে হয় সব ঢিল ছুড়তে, ভেঙেচুরে সব ঝনঝন করে ছড়িয়ে যাক, চাইলে তো হবে না জঞ্জাল যে সাফসুতরো করবে, সেই লোকজন কোথায় মিলবে! মনটাকে সংযত করে। দেদার ছুট লাগাবে। কাকটা যদি ফাঁকতালে পালিয়ে যায়, তাহলে ধরবে কেমন করে? ও তো বিলুর মতো স্বভাব-খেল জানে না। কেন যে এমন ধরনের মানুষ হয়! লাফালাফি ঝাপাঝাপি কোনটাই যে ও কম জানে না। পাগলটা  মাটি খুঁড়েই চলেছে, না হলে মানুষের জন্য এতো দরদ হয়! চঞ্চল বুঝতেই পারেনা, বিলুর গভীরে যাওয়ার এমন খেয়াল কেন! মানুষগুলো ওর পিছনে ছুটলে ও কতকিছুই আকার ইঙ্গিতে বলে দেয়। কত মোলায়েম সুরে বাঁক নেয়। শুধু কি নিজে শোনায়, কত গপ্পই  ও নিজে শোনে, শোনার ইচ্ছেয় ছটফট করে।  

জুতো তো সেলাই করে মিন্টু। ভুট্টা গমের ক্ষেত আছে না, সব তো ছেড়েছুঁড়ে দিল। মন কেমন করল, ঘরবন্দি হয়ে থাকলে জীবন দেখবে কেমন করে! মনের কথা তাই তো গরগর করে সেই থেকে বলা শুরু করে। বিলু বলে, ‘লজ্জা পেয়োনা, তোমার কথা আমি শুনবো, যা মনে চায় তুমি তাই বলো।’ ‘ কেউ যে আমার কথা শুনতেই চায় না। রুটি রোজগার চুলোয় যাক,কী বলেন?’ ওই তো ঠা ঠা করে রোদ। গা তেতেপুড়ে যায়। কেউ কী ভাবে মিন্টুর কোন সময় গময়ের  বালাই নেই ? এক্ষুনি চাই। বলে তো ফেলে। মুখটা কেমন বেঁকিয়ে বলে, আবার ভেঙচায়। একটা হনুমান রোজই এসে এমন উৎপাত চালায়, মানুষের আবার দোষ কী! ওর কিন্তু বেশ লাগে।  মানুষের জঙ্গলে এসে খাবার খায়। ভাবে, ‘মানুষজাতটা কেমন সুখেদুঃখে ঘরদোর বেঁধে আছে। গাছগাছালির ফলমূল গুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। আমরা না হয় একটু ভাগ বসালামই বা। এই শহরটা তো ওদের একার নয়। নিজের জায়গাটা ছেঁড়েছি বলেই না ওদের এত বাড়বাড়ন্ত।’ ‘তুমি ওদের মনের কথা বোঝ কেমন করে?’ ‘তুমি যেমন মোদের মনের কথা বোঝ।’ ‘কেমন সুন্দর আমাদের ভাষাটাকে রপ্ত করে নিয়েছ।’  ‘এই শহরটাকে নিজের করে নিয়েছি যে।’ ওর গল্প যে ফুরোতেই চায় না। হনুমানটা নাকি চুপটি করে বসে থাকে। ওর চোখে চোখ রাখে। পাহারাও তো দেয়। কই, একটা জুতাও মুখে করে নিয়ে পালায় না। দুষ্টু  লোকদের খ্যাঁক করে কামড়ে দেয়। বিলুর পথচলা যে আর থামতেই চায় না।

অটল নিজের চিন্তায় মগ্ন হয়ে অন্য এক ঈপ্সিত পৃথিবীর স্বপ্নে মশগুল হয়ে পাতার পর পাতা ওল্টায়। এই শহরের সবচেয়ে উঁচু তলার বাড়িটির উচ্চতায় ডুব দিয়ে দেখে কতগুলো ইঁদুর আর ছুঁচোগুলো কেমন করে লাফাচ্ছে। ওদের মুখগুলো ছুঁচলো, নাক যেন ঠোঁটের সঙ্গে লেপ্টে আছে, ঠোঁটগুলো ঝুলে আছে, কয়লা কালো গায়ের রঙ। সদ্য শহরে এসে চেটেপুটে নিচ্ছে যার যার  নিজের মতো। কে কাকে শুধোবে? ওদের গায়ের গন্ধটায় পাশ কাটিয়ে যাওয়া সাহেব সুবোদের মুখে কত না দলা দলা থুতু। থুতুতে ডিজেল পেট্রলের পোড়া পোড়া ঘ্রাণ। বিদঘুটে চেহারার লোকগুলোকে দেখে মায়া না দয়া, যা সব পেয়েছির দেশের অনাহূতদের দেখলে হয় আর কী। স্বপ্নটা কুৎসিত নিরেস হয়ে ভাঙতে শুরু করলে আর একটা মেটে গন্ধ ভাসতে ভাসতে চলে এল ওর নাকের কাছে। এমন এক অনুভূতির জন্ম দিতে লাগল যার থেকে নিস্তার নেই। এমন এক জীবনের অনুভব রবাহূতদের ঘিরে থাকে যা হয় আপনের আপন। ওদের মুখগুলোকে বইয়ের পাতা থেকে টেনে বের করে আনে। যা দিয়ে ওদের রং ঢং নাকি চিনে নেওয়া যাবে। অটলের চেতনায় স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের মায়াজালে অধিকার শব্দটা জোরালো হয়। ও বলতেই থাকে, কেবলই বলতে থাকে, ‘কিহে বসবে নাকি,পিড়ি পেতে দেব। না হয় একটু ধুলো মাখা শরীর, জংলা গন্ধ, কত কত লড়াইয়ের চিহ্ণ। ভুলতে চেওনা, লজ্জা কেনো পাও, ওটা তো তোমাদের নিজের জিনিস।’ ও অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও নিজের কথাগুলো ওদের শরীরে জড়িয়ে দিতে অসমর্থ হলো, উপায়ান্তর না দেখে মুখগুলোকে টেনে নিয়ে গিয়ে শহরের এক গলির মধ্যে নিয়ে হাজির করবে ঠিক করল। ওরা কেমন করে বুঝতে পেরে লাফাতে শুরু করল। ওর কলমটা চলতে শুরু করল নিজের মতো। ও শুনতে পেল লড়াইয়ের বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে, লেগে আছে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ। ওরা আসার আগে কত তো চেষ্টা করল, মুছল কী? কত কালের ক্ষত ওরা বয়ে বেড়াচ্ছে ওরাও কি জানে?  বলে তো সেই মানুষটি, তার কোনো কালে গোঁফ গজায় নি, হৃদয়টা ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে কথার পিঠে কথা রেখেছিল, ‘আমরা এরকমই’। শব্দগুলো থেমে গেল। অটল এবার ঠিক করল, ওপারে যে পার্কটা আছে, লোহার রডে জং ধরেছে বৃষ্টির জল খেয়ে খেয়ে। কত রংয়ের প্রলেপ তো পড়েছে, লোহার বাঁকানো রডগুলো নিজেদের জানান দেবে না তাই বলে। পুরনো কথাটা জেগে গিয়ে বলল, ‘হল্ট’। মানুষের মুখগুলোকে সঙ্গে নিয়ে থেমে রইল। এই নিশ্চুপ হওয়ার পেছনে কেউ দায়ী থাকবে না, শুধুই কালি আর কলম, আঙ্গুলগুলো কি নিঃশব্দে থেমে যাবে? আসলে সেই সময় রাস্তায় কতগুলো বিকৃত মস্তিষ্কের লোককে দেখে ফেলেছিল। লোকগুলো বড্ড বদখচ্চর, মুখোশধারী, ‘অ’-য়ে অজগর আসছে তেড়ে’ যেই না বলেছে, আর কেউ কি থেমে থাকে। ওমা থেমে থাকবেই বা কেন, মহামানবটি কি থেমে ছিল? কত কীর্তির দায় যে বহন করল, সময়  ওকে একটুও গিলতে পারেনি। এত গলির পরে তস্য গলি, কত যে মুখ বের হয়ে হাঁ করে আছে, যদি গিলে নেয়, গোল গোল চাকাগুলো এমনি এমনি শুয়ে আছে! সেলাই মেশিনের চাকাটা ঘুরবে না বুঝি, হাতটা চলবে না বুঝি, কোথায় বিরক্তি, গোল টুলটা ছাড়ল, উঠে এসে বলল ‘ জো হুকুম’। অটলকে ওরা এইভাবেই জাপটে ধরল। ও যে ছেড়ে দেবে এই কথা কে বলল। কত মনের কষ্ট, কত যে বেদনা। কেন কষ্ট? স্বপ্ন না হয় দুঃস্বপ্ন হল, তাতে কি এল গেল। অটল তো এমনটা চাইছে না, তবু কেন এমনটা হল! ভারী মুস্কিল তো, ওর মধ্যে তবে কি কোনো দ্বিতীয় সত্তার জন্ম হচ্ছে? পুরুষেরা তবে গর্ভ ধারণ করতে পারে! পারে হয়তো, না হলো যে এক এক করে শব্দের জন্ম দিচ্ছে, ও তো নিজেই জানে না এরা কারা! গোলমাল হয়ে যাচ্ছে নাকি সব। নিজেকে একবার বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে নিল। মাথাটা ঘুরে উঠল বুঝি, উত্তর নিরুত্তরের মাঝের দশায় এমনটা হয়।

ঘোড়াটা এমন করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চব্বিশ ফুট রাস্তা বরাবর। রাজার ঘোড়ার রাজরক্ত টগবগ করে ফুটছে। ঘোড়ার আবার রাজরক্ত! অবাক হলে করার কি কিছু থাকে! কারা অবাক হয়, মানুষের কিনা আক্কেল গুড়ুম হয়। দম বন্ধ হয়ে আসে। ঘোড়ারও হয়। সে তো আর হিসেব কষে না, পথের নিশানা খোঁজে। তিলে তিলে ঘোড়াসওয়ার রাস্তা মাপে। চঞ্চল কি আর এমনি করে পথ চলে। বেহিসেবী স্বল্পবুদ্ধি নিয়ে ও দরজায় দরজায় ঘোরে। সে আর কবে নাটক মঞ্চস্থ করেছে। কবেই ভেবে নিয়েছিল গোটা শহরটার আত্মাকে পলে পলে দু’চোখ ভরে দেখবে কিন্তু বাধ সাধে ওই রূপবান ঘোড়াটা। এত সহজ কি খেলাটা চাইলেই সবটা চুরমার করে ফেলা  যায়! মানুষের চোখের জল কত কথাই না বলে। তাকে কি ধরে ফেলা এতই সহজ! নিয়মের ধরা বাঁধা গত আছে বটে, আবার ব্যতিক্রমও আছে বই কি। সে যে ভিন্ন পথে চলে। দিনের আলোতে কত আঁধার। কেউ যদি এমন প্রশ্ন করে জগৎ সংসার অন্য পথে চলে, দেখা তো যায়, আবার অনেকটাই অদেখা। 

ঈশ্বরী ঘর ছেড়ে পথে নামে। অসংখ্য মানুষের মেলাঘর কোনায় কোনায়, জীবনের স্রোত বেপথু হয়ে পাড়ি জমিয়েছিল বটে, শক্ত হাতে হাল ধরতে শিখেছিল বলেই না চোখা চোখা জবাব দিয়েছিল। অদ্ভুত জগতের হিসেবটা মেলাতে পারে নি। চঞ্চল না হয় সেই মনকাড়া দৃশ্যটা দেখেই ফেলেছিল। কী আর করে! লম্বা লম্বা টেবিলটার পায়ার কোনগুলোতে ওরা লুকিয়েছিল। রসময়ই টেনে বের করে এনে বলেছিল, ‘ভয় পাস না তোরা, অনেক মানুষ, অনেক জীবন, আকাশ জুড়ে কত আলোর বাস, আলোয় আলোয় বাঁকা, ওরা খেলা করে এখানে সেখানে নিজের মতো, কেউ কি দেখতে পায়?, পায় না তো। ওরা সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে, কত কথা বলে, মিলিয়ে যায়।’ ঈশ্বরী খাতা পেন্সিল ভাঁজ করে, চোখগুলো বড় বড় করে কি যেন দেখতে চায়। লম্বা নাম না জানা গাছটা থেকে পাতাগুলো কুড়িয়ে আনে, দু’চারটে ফুলের কুঁড়িও সঙ্গে নেয়, ঝুলিতে রাখে। ‘ ফুলগুলো ভারি সুন্দর তো, কোন গন্ধ নেই কেন ?’  চঞ্চল জলধোয়া এনামেলের থালাটা বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরে আলু চোখা আর ডালের জল দিয়ে চটকে ভাতের দলাটা মুখে পোরে। ‘রসময়দা এমন করে বললে কেন?’ ‘কুকুরের মা আর মানুষের মা একসঙ্গে মরল, দুটোরই শশ্মানযাত্রা করিয়ে এইমাত্র ফিরলাম কিনা, তাই তো এমন করে বললাম। কী জানি কখন কথাগুলো দম আঁটকে মরে যাবে, তাই তো তাড়াতাড়ি শুনিয়ে দিলাম। তুই আর ঈশ্বরী কখন কোন মনের ঘরে থাকিস, যদি শুনতে না চাস।’ ‘তুমি কীসের উপর দাঁড়িয়ে আছ?’ ‘অদ্ভুত কথা বলিস না ‘মাটির উপর’। ‘হাসি পাচ্ছে, বড্ড হাসি পাচ্ছে, বালি সিমেন্টের মণ্ড।’ ‘জলে জলময়, সব পাতালে টলমল করছে, একসময় পরম নিশ্চিন্তে উপরে ঘুরে বেড়াত। বজ্জাত সব মানুষ কিনা।’ ’কে আর এমন করে বানিয়েছে? হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলে এসেছে।’ ঈশ্বরী ঝন্টু মন্টুর চোখের জলটা মুছিয়ে দেয়। ছেঁড়া বোটকা গন্ধের কাঁথাটায় কাল রাতেই মা-টা ছটফট করেই তো অক্বা। ওরা গায়ে জড়িয়ে মার গায়ের গন্ধ শুঁকছে। সন্টা মন্টারা বুক ফাটিয়ে ঘেউ ঘেউ করে ওমাগো বলে আকাশের দিকে তাকায়। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘগুলো হাঁটতে থাকে। মায়ের মুখটা শেষবারের মতো দেখেছিল কিনা। ঈশ্বরী ডানে হাঁটে, চঞ্চল বাঁয়ে। কাকটা কাঁ কাঁ করে উড়ে গেল। ওর কি কম দর, লাল বাড়ি, নীল-সাদা সবটাই ওর নখদর্পণে। চিন দিয়েছিল বলেই না চিনে। ঘোড়াসওয়ার আর সময় পেল না, এই পথ দিয়ে ছোটাতে হল?  কোন সময় গময় থাকবে না। রসময় ডেকচিটা নাড়ে চাড়ে। কোলে তুলে নেয় ঝন্টুকে, আবার মন্টুকে – খা খা ভালো করে খা। নে নে তোরাও খা। থালাটা ঘুরে ফিরে ঝন্টু-মন্টুর কাছ থেকে  সন্টা-মন্টার দিকে চলে যায়। দেওয়ার পালা সাঙ্গ হলে, ওরা বলে, ‘আর একটু’। জলদি করে, সন্টা মনটা তোরাও কর, রাজার ঘোড়া আসছে।

 সুরের উৎস খুঁজতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছে অটল। চেনা চেনা,অথচ কতই না অচেনা। না জানি আদৌ কোন জন্ম হয়েছে কিনা, নাকি অঙ্কুরেই বিনাশ হয়েছে। চঞ্চলের কাছে এই অনুভব ভাগাভাগি করে নিলে ও হাসিতে গড়িয়ে পড়ে। ‘অত ভাবিস না, এরকমটা হয়। নিজেকে বারে বারে জিজ্ঞেস কর, উত্তরটা পেয়ে যাবি রে খোকা।’ অটল জানে এর কোন চটজলদি উত্তর হয় না। তবুও যদি পথের সন্ধান পেত। সুরটা ওর কানে কানে এসে বলে যায়, ‘আরও ভেতরে যাও। সিঁড়ি টপকেই ও অন্দরে গেল। জানালাগুলো খুলে দিল। ঘরের মধ্যে জমা সুরগুলো দমবন্ধ হয়ে গুমড়ে মরছিল, বোঝার তো কোন উপায় ছিল না। জানবেই বা কেমন করে? পিঠেপিঠি তো এর জন্ম হয় নি। কেউ একজন গলা সেঁধেছিল, সঙ্গত করেছিল অন্যলোকে। সুরের জাদুতে মজেই না কত সন্ধ্যা ফুরিয়ে গেছে, জীবনটা ছোট হয়ে গেছে। কলিগুলো ধারন করেছে বলেই না অনায়াসে চিনে ফেলেছে কত কি। কত তো বিচারক, কত তো মোসাহেব, কত তো ভাঙাগড়ার খেলা, কথায় কথায় মিলে গেছে। রাগরাগিণীরা এসে অন্তরকে নিয়ে এত টানাহ্যাঁচরা করেছে, বেচারা বিবাগী না হয়ে যায় কোথায়। আহাঃ কি যে আলাপ, কি যে বিস্তার। গমক আর মূর্ছনায় মূর্ছা না গিয়ে কোথায় আর যাবে! স্বর আর সুরের কোলাকুলিতে যে আত্মীয়তা, জুড়ি মেলা ভার, এক কুঠুরি ছেড়ে আর এক কুঠুরিতে যাওয়া। দেয়ালে দেয়ালে লেখা কত স্বরলিপি আর কত নামের মধ্যেই বেমানান এক নাম। কে ছিল মানুষটা? কত যত্ম করে ভিন্ন এক হস্তাক্ষরে লেখা, কত না গভীর সেই রঙ। মনটা ছিল সাদা, চাওয়া পাওয়ার ফর্দটায় কোন কলমের আঁচড় নেই। শব্দগুলো আড়াআড়িভাবে জড়িয়ে মুক্তির আনন্দে হয়েছে মশগুল। মনের মুক্তিই এই অভিসারে শুধু সম বাঁধতে চেয়েছিল। অহমিকা! নৈব চ, নৈব চ। ভাবনার জোয়ারে ভাসতেই এই পথ চিনে নেওয়া। পুঁজি যৎসামান্য, খই ফুটছিল কখন সুরে সুর মিলাবে, তাল, লয়ে সৃষ্টি করবে আর এক সুরের  মায়াবী জগৎ, মনের মাধুরী মিশায়ে পাড়ি দেবে অভীষ্ট লক্ষ্যে। অটল আরও অন্দরে যাবার পথ খুঁজে বেড়ায় হন্যে হয়ে। কতগুলো মুখ দেখে ফেলে যাঁদের ও দেখতে চেয়েছিল প্রাণভরে। এমন করে যে দেখে ফেলবে ও স্বপ্নেও কল্পনা করে নি। কত কিই না ঘটে। ছায়াময় হয়ে বিশ্বভ্রমাণ্ড ঘুরে বেড়ায়, ঘরের আঁধারে অস্তিত্বকে জানান দেয়। কল্পনার অবয়বে জ্যান্ত হয়েও মোলায়েম স্বরে ডাকে। অটল এই সৃষ্টির গোলকধাঁধায় কাকে যেন নিজের করে পেতে চায়, একান্তই নিজের। কে যেন বলে উঠল, ‘এত সহজ কাজ নয়। তুমি কি নিজে জান, কোন সুর তোমার বুকে বাজছে?’ দ্বিধাগ্রস্ত অটল প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। ডুব দিতে চায় আরও গভীরে, অতল তলে। কোন সেই সংগীতশিল্পী যার কন্ঠস্বরে জন্ম নিয়েছিল সেই সুর। অটল হঠাৎই দেখে ফেলে এক চোরাকুঠুরি। আনন্দে উদ্বেল হলে দেয়ালে দেয়ালে মাথা ঠুকে যায়। তবুও কী থামায় ওর খোঁজ। অতৃপ্ত পিপাসায় তৃষ্ণার্ত হয়ে নিজেই গলা সাধে। ‘পাগল হয়ে গেলে?’ চঞ্চল না, হ্যাঁ, চঞ্চলই তো বটে। তবে কী ও…।

ঈশ্বরী নিজেকে গৃহবন্দি করে রাখবে, এ-কথাটা ভাবলেই এক অন্তর্গত যন্ত্রণায় ও ছটফট করে। কাকটা ওকে ইশারায় ডাকে,কথা বলে। সে কথার মর্ম এই দুইজন ছাড়া কেইবা বুঝবে। ও যে নিত্য কথা বলাবলিতে নিজেদের জেনে বুঝে নিয়েছে। ঈশ্বরীর ভাবখানা ও জানে। কদম গাছের ডালে বসে জোরে ঝাঁকিয়ে দিলেই টের পায় কিছু একটা তো ঘটেছে। ‘ও মা নেবে নাকি, জয়নগরের মোয়া আছে গো, ক্ষীরের মোয়া আছে।’ শব্দগুলো ওকে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যায়। ‘একটা ফাউ আমার বন্ধুর জন্য দিতে হবে কিন্তু।’ কোলাহলে কোলাহলে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ‘সে আর কি বলব মা তোমায়। মাঝরাতে পায়ে হেঁটে ভ্যান গাড়ি করে  ফাষ্ট টেনে চড়ে তবে না লোকের দরজায় দরজায় ঘুরে মরি। চোখ মেলে কেউ দেখে না গো বাছা। তোমার মুখে মধু, শরীরে মায়া। ঈশ্বর তোমার ভালো করবে।’ কি বুঝে ঈশ্বরী ফিক করে হেসে ফেলে। মগডালে বসে কাকটারও অট্টহাসি। সাতপাঁচ না ভেবে ফ্যালফ্যাল করে চায়। কাকটা ডালটা নাড়লে ঈশ্বরী বুঝে নেয়, আর সময় নেই। ‘ও জয়নগরের মাসী, এবার আমায় উঠতে হবে।’ ‘ কেন গো? ‘সে তুমি বুঝবে না।’ ‘ভালোবাসা দিলে যখন আর একটু দাওনা, যাই যাই কর কেন।’ কী আর বলে ঈশ্বরী। ‘ গুরূদেবের হুকুম হয়েছে গো। আবার কার সেবা লাগে।’ ‘বাবা তারকনাথ বুঝি।’ ‘তাই তো, তিনি ছাড়া এমন কথা কে বলবেন?’ কাকটা উড়ে উড়ে গেল, আবার থেমেও গেল এক পলকে। ঈশ্বরী জানে, খোঁড়া ছেলেটা ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে গাছের গোড়াটায় এসে বসবে। দুষ্টু লোকটা বাপ-মা মরা ছেলেটাকে সুযোগ পেয়ে ঝোপ বুঝে কোপ মারবে। কাকটা লেজটা তুলে হাগু করে। পড়বি তো পড় জামার পকেটে। ঈশ্বরী শুধলো, ‘কী দাদা, হলো?’ ‘কী হবে?’কাকটা কা কা করল। ঈশ্বরী বুঝল, মাথা মারার দরকার নেই। এবারও সময় ফুরোচ্ছে, ফুরিয়ে গেলে আর কী পাবে? ওদিকে ওদেরও সময়টা খাবলে খাচ্ছে অন্য কেউ। লোহালক্করের দোকানটা ছেড়ে তেজারতি দোকানের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে টানা রিক্সা। ‘হ্যাঁ মাইজি, চাল্লিশ বছর বরাবর এই গাড়ি হামি টানছি। আর কতুদিন। বালবাচ্চা ভি বড়া হয়েছে।’ ঈশ্বরী ওর চোখের দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষন। ‘কেউ তোমার কথা ভাবল না।’ ‘ কে আর ভাববে মাইজি, হামাদের পেনসন তো নেই। রিক্সা টানতে টানতে শেষ ভি হয়ে যাব।’ কাকটা দোকানের ছাদ থেকে এমন তারস্বরে চেঁচায়, সব লোক কাজকর্ম ফেলে ওর দিকেই তাকিয়ে রয়। ঈশ্বরী আঁচলটা কোমরে গুঁজে নিয়ে রিক্সাওয়ালাকে কোন ভাববার অবসর না দিয়ে  যাত্রীটাকে গাড়িতে বসিয়ে হাতে ঘংটিটা নিয়ে ঢঙ ঢঙ শব্দ করতে করতে বাজারটা পেরিয়ে যায়। রাস্তার পথচলতি মানুষজন, দোকানের কর্মচারীরা ওর বেআক্কেলপনা দেখে প্রথমে চমকে ওঠে, পরে হতভম্ব হয়ে গেলে ওদের মুখ দিয়ে একটা কথাও সরে না। ফিরে এলে রিক্সাওয়ালা বলল, ‘মাইজি, আপ নে উঁচা ঘরকা ঔয়রত আছেন, হামার বহত পাপ হবে। জৌ হুয়া, ঠিক নেহি হুয়া।’ কাকটা ডানা ঝাঁপটায়। বলল, ‘যা করেছ, বেশ করেছ, ভবিষ্যতেও করবে। বড়মানুষদের পাপ, ফল একদিন ওদের ভুগতে হবে। যাও বেটি, কত তোমার কাজ বাকি।’ ছেঁড়া ছেঁড়া তালিমারা পেন্ট আর কালিঝুলি মাখা গেঞ্জি গায়ে ওরা কোথায় যে যায়, কোথা থেকেই বা আসে দলে দলে। হাত বুলিয়ে দেয় ওদের গায়ে, বলতে তো ইচ্ছে হয় অনেক কথা,  নষ্ট জীবন থেকে রেহাই দিয়ে খুঁজে দিতে চায় ঝলমলে সময়। দেখে আর হাউমাউ করে নিজেই কেঁদে ফেলে।  কী দরকার সময় নষ্ট করার এসব খবর রেখে ভালো মানুষদের? নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন রাখে। ভালো নয় কি বহাল তবিয়তে থাকা মানুষগুলো মস্তি করুক দিনের আলোয়, রাতের অন্ধকারে দেদার ফূর্তি। ঈশ্বরীর মাথায় কত ভাবনাই না গিজগিজ করে। কাক কা কা করে এক গলি ছেড়ে অন্য গলি যায়। ঈশ্বরী ভাবে, নতুন করে গর্ভে আসলে মন্দ তো হয় না, বেঁচে তো যাবে মানুষগুলো, কতকাল ধরে ওরা বাঁচতে তো চেয়েছিল।

কেউ নেই, সকলে যেন ঘুমিয়ে গেছে। বিলুর পেছনে এখন আসার আর কেউ নেই। ওর নিজের চোখ জুড়ে আজ ঘুমের নেশা। কত না ঘটনা কল্পনার সঙ্গে লাফালাফি করে। তাতে দৃশ্যান্তর ঘটে। একটা নদী এসে ছলাৎ ছলাৎ করে। নদীটা ওকে অনেক গল্প শোনাতে চায়। ওর বেড়ে ওঠার গল্প, ওর মরে যাওয়ার গল্প। আজ ও নিজে কোন গল্প বলবে না, শুধুই শুনবে। ও শোনানোর জাদু জানে, শোনার কায়দাকানুন ওতো রপ্ত করে নি। নদীটা হয়েছে উতলা। ওর নাকি সঠিক মনে আছে, কবে ওর শরীরটা দৈর্ঘ্য প্রস্থে নয়, উচ্চতায় এমন বেড়ে উঠেছিল, নিজেকেই নিজে চিনতে পারেনি। কী জানি ‘নবজন্ম’ শব্দটা কোনকালে শুনেছে কিনা। নদীটা আরও বলে, মানুষও নাকি মাঝে মাঝে এমন ড্যাং ড্যাং করে বেড়ে যায়, আন্দাজ করতে পারে না, এমন বেড়ে লাভ কি, কতটা বাড়লে ও ঠিকঠাক নিজের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে। মানুষের জীবনেও ঝড় আসে, কত ঝাপটা সহ্য করতে হয়। ওর জীবনেও নাকি একবার যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। নদীর গল্পটা এখন আর একটু এগোতে পারত, না তাই হয় নি। ঐ যে একটা ভয়ঙ্কর গুলির শব্দ ওর ভীত নাড়িয়ে দিয়েছে, বিলুকে চমকে দিয়েছে। আজ বিলু টু শব্দটিও করবে না। নদীর ইচ্ছে হয়েছে ওই বলুক। নদী বলল, ‘বিল্পব আসছে।’ ‘কী বললে, বিপ্লব! চমকে উঠলেন যে! এই শব্দটা কি ক্লিশে হয়ে গিয়েছে?’  ‘তুমি যে গল্প বল, তার মধ্যেও বিপ্লবের গন্ধ আছে।’ ‘কীরকম!’ ‘অন্তর্বিপ্লব। তাতেও একপ্রকার যুদ্ধের গন্ধ আছে। তোমরা দেখতে পাও না তো বাকিদের দোষ কী! আচ্ছা এই কথাটা ছাড়ান দাও। বড্ড বিতর্কিত কথা মনে এল তাই বললাম।  তাহলে জন্মের সময়ের আনন্দের কথা বলি। শুরুটাই তো অনেক শেষের কথা বলে দেয়। দেখ, আমি কতদূর যাব আমি কিন্তু একদম জানি না।’ ‘তুমি কতদূর যেতে চাও? তুমি নিজের ক্ষমতা নিয়ে কতটা আত্মবিশ্বাসী?’ ‘তুমি বিশ্বাস কর আমি একদম বলতে পারব না। বরঞ্চ ও কথা ছেড়ে জন্মের মুহূর্তের কথা বলি। খুব শিহরণ হয়েছিল, এতটাই উৎফুল্ল হয়েছিলাম, এত যে সংঘর্ষ সামনে অপেক্ষা করে আছে ভুলেই গেছিলাম। যেদিন মানুষের মুখ দেখলাম, সে যে কী সুখ! মানুষ হাসলে আমি হাসি, মানুষ কাঁদলে আমি কাঁদি। কেউ হয়তো বুঝতে অপারগ হয়। আমার ভেতরটা উচ্ছল মছল করে। সুপ্ত ইচ্ছেটা চাগাড় দেয়, মানুষগুলোর বন্ধু হব। যেদিন মানুষরা আমার কাছে এল, বুকের উপর দিয়ে চড়ে বেড়াল, বুকটা ফেটে গেছে, কোন অভিসম্পাত দিই নি। কেন জান?  ওদের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার কাহিনীগুলো আমি শুনতে পাই, ধারণ করি আমার শরীরে, ভাবি এত জ্বালা বুকে নিয়ে ওরা বেঁচে আছে কেমন করে? যখন ওদেরই লাশ এসে আমার বুকে ভাসে, তখন আমার ভেতরে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। আমি জ্বালা জুড়োই, আমার অস্তিত্বটা সাগরে মিশিয়ে দিই। আহাঃ মানুষের জন্য যদি একটা সাগর থাকত!’ ‘একটা প্রশ্ন করতে পারি? আজীবন কথাটা তোমার কাছে কোনো নতুন মাত্রা যোগ করেছে কী?’  ‘এতটা গম্ভীর হয়ো না বিলু। এই মানুষদের স্বভাব সব কিছুতেই অর্থ খুঁজে বেড়াও। মস্তিষ্কটা পেয়ে গেছ, ঘিলু পেয়েছ জব্বর। এতে তোমাদের লাভ হয়েছে বটে, ক্ষতিটাও কম হয় নি। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পার না, আমরাও তোমাদের প্রতিবেশী অথচ নেবার বেলায় তো ষোল আনা ।’  ‘কী যে বল? মনুষ্য জাতিকে এতটা খারাপ ভাবো কেন? মানছি, আমরা পরমানুর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে, তোমার শরীর ক্ষতবিক্ষত করে অপরাধ করেছি,  কিন্তু তোমাকে ‘মা’ বলে পূজাও তো করে চলেছি ।’ নদী বিলুর কথায় অর্থপূর্ণ হাসি হাসল। অভয় বাণী শোনাল কিনা কি জানি। আবারও একটা বোম ফাটার শব্দ শুনল বিলু। নদীও শুনল, চতুর্গুণ কেঁপেও উঠল। ‘দেখলে তো, তোমরা মানুষরা কেমন সিংহাসনের মালিক হতে চাও, রাজা না সাজলে তোমাদের চলে না। রাজার আবার বিচার করার সখ’ ‘কেন তোমার রাগও তো কম নয় গো?’ ‘আমার ছিদ্র খুঁজে বেড়াচ্ছ। তোমাদের পাপের হিসেব করছ না?’ ‘সে হিসেব তো অনেকই জটিল।’ ‘ভাব,ভাব,আরো বেশি করে ভাবো। অনেক সময় বাকি। রাজা না সাজতে চেয়ে বরঞ্চ প্রজা সাজ।’  বিলু অন্য একদিন গল্প শোনার এবং শোনানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঘরে ফিরতে চাইল বটে, ওর চেলা চামুণ্ডারা যে ঘুম থেকে জেগে যাবে এই অবসরে কে জানত! ওদের মনের কোনে জেগে উঠেছে অনেক গল্প, অনেক প্রশ্ন, আর কত যে ধাঁধা। ওদের নাকি সেইসব প্রশ্নের উত্তর, ধাঁধার সমাধান চাই-ই চাই, আজই চাই। বিলু খুব জোরে হোঁচট খেল, তবু হাঁটা কী থামায়!

তৃতীয়  অধ্যায়

অনন্ত এখনও ভাঙা রেডিওটার নব ঘোরাতে ঘোরাতেই ভাবে কোথায় গেলে ওর মনের মতো কথাগুলো শুনতে পাবে, গানের কলিগুলো সুর হয়ে মনের কোণে এসে এমন জোরে ধাক্কা মারবে, সারাদিনের ক্লান্তিগুলো ঝরঝর করে ঝরে পড়বে। যেতে তো হবে অনেক দূর, কেউ যদি পৌঁছে যায় ওর আগে, সারাদিনটাই মাঠে মারা যাবে। কেউ যেন ভেতর থেকে বলে ওঠে ‘দৌড়ও, অনন্ত দৌড়ও, সময় যে ফুরিয়ে যাবে।’ অনন্ত জানে না এমন নয়, কী অনন্ত শক্তি সময়ের। কেমন করে থাবা বসায় প্রতি মুহূর্তে। কী জানি কখন হোঁচট খাবে। কত মানুষের ধাক্বাধাক্বি, জটলা। সকলে যেন হাত পা ছুঁড়ছে। মনে ওদের কত বাসনা। ‘ও দাদা, চোখে ন্যাবা হয়েছে!’ বলেই কোথাও যেন উবে যায়। কোথাও গেল যেন। সামনেই তো কোনো এক ধর্মীয় সংস্থার আর্চ টাইপের গেইট। মানুষটা ওখানেই হারিয়ে গেল। কী তার উদ্দেশ্য! কিছুই তো বোঝা গেল না। অনন্ত’র ইচ্ছে হলো উঁকি মেরে দেখে মানুষটা কোন জালে জড়িয়ে গেল কিনা। কোথায় সময়ের তালাচাবি? ও দরজাটা গিয়ে খুলবে। অনন্ত সময়ের আলোআঁধারিতে ও ডুব দেবে। চেঁচিয়ে বলবে, ‘ওগো তোমরা কে কোথায় আছ, মানুষটাকে খুঁজে এনে দাও। অচেনা শহরে ও পথ হারিয়েছে।’ পরক্ষণেই ভাবল, ও কি পাগল হয়েছে। মানুষের জন্য এত টান কেমন করে এসে এত দলা পাকাল। আবার কেউ বলল, অনন্ত তোমার তো কিছু হলো না, মাঝে মাঝে থেমে যাওয়া ভালো লক্ষণ নয়। এটা তো এক ধরণের মনোরোগ ! ‘কী আমি পাগল হয়েছি!’ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবারো একটার পর একটা রাস্তা ছেড়ে কিছু আলো যেখানে ডুবছে আর নিভছে, সারি সারি শাল পাতার থালা, কব্জি ডুবিয়ে গোগ্ৰাসে গিলছে, ওরা কারা! এর মধ্যে এই মানুষটা আছে! কেন ওকে চিনতে চাইছে ও! চিনতে তো হবেই। না চিনে যে উপায় নেই ওর। আম পাতা জাম পাতার মচর মচর শব্দ ওকে নাড়িয়ে দিল। কুকুরের বিষ্ঠার ঘ্রাণ ওই গরম ডালের ধোঁয়ায় মিশে যাচ্ছে। তবে কী ডালের ধোঁয়া, এত এত নিরন্ন মানুষের মাঝে ওই মানুষটি আর ও একই বৃত্তে আঁটকে গেল। এর থেকে ছিটকে যাবার কোন উপায় নেই! অনন্ত খুঁজতে চায়। 

মানুষটির অস্তিত্ব ওকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। মনে হয় কোথায় যেন ও নিজেই লুকিয়ে আছে ওই মানুষটির মধ্যে। এই দেখে এই নেই, ইহ জীবনে এ মুখ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে কি মানুষটার অপমৃত্যু হলো ওর কাছে। হতে পারে এক পলক দেখা, অনাত্মীয় হল কেমন করে। ওই তো! সেই চোখ, সেই মুখ, গটগট করে হেঁটে যাচ্ছে। ‘এই যে চললেন কোথায়?’ ‘আমি আপনাকে চিনি বুঝি। পাগল কোথাকারে!’ লোকটা বিচ্ছিরি হেসে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে চলে গেল। ‘কোথায় যেন দেখেছি? কবে যেন আমার হাতঘড়িটা সারিয়ে দিয়েছিল। ‘ লোকটা অনন্তকে অনেক শোকদুঃখের গল্প শুনিয়েছিল। মানুষের যে কেন এত দুঃখ হয়। মজিদ না কি একটা নাম যেন। আব্বার অকালেই ইন্তেকাল হয়েছিল। বড় আশা ছিল পুরনো বাড়িতে ফিরে যাবে। পূরণ আর হল কই। কি এক মারণ রোগ এসেছিল সারা দেশে, ঘরের বের হওয়া দূরে থাক, মানুষের মুখগুলোই তো দেখতে পায়নি সেই শোকে। ‘আচ্ছা, একটু শুনবেন। একটু কথা বলতে চাই, চলে যাচ্ছেন কেন? আমার না মানুষের কথা মনে পড়লে খুব কষ্ট হয়। কাকে আর সেসব কথা বুঝিয়ে বলব দিনরাত শুধু কাঁদি।’ ঔষধের দোকানের কর্মচারী। একটু দেরি হলে চাকরিটি নট। বউবাচ্চা নিয়ে মাথা গুঁজে থাকে ভাঙাচোরা টালির চালের ঘরে। মনের মধ্যে কতশত আকাঙ্খার ঝড় বয়ে যায়। দূরত্বটা কেবল কম নয়। পায়ে হেঁটে মেরে দেয়। রোজই তো আসে, রোজই তো যায়। আসা যাওয়ার এ কেমন খেলা। ভবসাগরের কথা মনে পড়লে ভেতরটা গুড়গুড় করে উঠে। জোরে জোরে পা ফেলা ওর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। মানুষ অভ্যাসের দাস। এই দাসত্বের জ্বালা বড় জ্বালা। মনের খেয়ালে পাল্টে যায় এমন করে বুঝতেই পারে না। মানুষের সঙ্গে কথা বলবে বলে একটা উপায় ও বের করেছে। আব্বুর দুঃখটা যে ও কিছুতেই ভুলতে পারে না। ওর মনটায় যেন জাঁকিয়ে বসেছে। নতুন এক হাঁটার কায়দা রপ্ত করেছে। ভাবনাগুলো এসে যাবে হাতের মুঠোয়। রাস্তা কেন যে সরকারি লোকজন এমন করে খুঁড়ে খুঁড়ে চলে যায়, এ-ও আর এক অভ্যাস, মানুষগুলো মরল কি বাঁচল, আর কে দেখে। কোমর বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে হাঁটাতেই ধাক্কাটা লাগল। দাঁড়িয়ে রইল হাঁ করে কিছুক্ষণ। নেই কাজ নেই বেতন, এমনি তো কাজের ধরন। তবে আর কি। সব ভুলে মেরে দিল তো। সোজাসুজি দৃষ্টিটা গিয়ে পড়ল ওই খাদের গভীরে। এই গভীরেই তো যত নাড়িভুঁড়ি। শহরের মানুষের আলো আর তৃষ্ণা ভরাট করে চলে রাতদিন, নাড়ির টান যেমন করে হয়। ওখানেই তো এক কিশোরের মুখ। কত লোকই তো ঠিকানা বের করে দেয়, জানিয়ে দিয়েছে মনের মতো। 

কিশোরের অস্ফূট শব্দগুলো উঃ আঃ করে ধাক্কা খেতে খেতে অন্য এক উচ্চারণের জন্ম দেয়। মানুষের কন্ঠকেও ব্যাঙ্গ করে। অনন্ত উত্তর খুঁজে বেড়ায় কেন এরকমটা ঘটতে থাকে। কিশোর গভীরে গিয়ে মাটি নিয়ে নাড়াচাড়া করে, গন্ধ শোঁকে। অনন্ত লম্বা হয়ে শুয়ে আরো অনেক কিছুর সন্ধান করে। এমন যোগসূত্র খোঁজা দুরহ, কারা কখন এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করেছে। ওর কাজ বোধ হয় শেষ, এবার টেনে তোলার পালা। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে, গাময় ভোগের গন্ধে ভরপুর। ও কী বুঝে যেন অনন্ত’র কাঁধে চেপে বসে। কেউ নেই বুঝি গায়ে হাত বুলিয়ে দেবে। চিকচিক রোদের কানাকানি ওর গায়ের কালচে রঙকে কচলাতে  শুরু করে। অনন্ত ওকে বুকে চেপে ধরে বলে ‘আয়, আয়, আয়, কাছে আয়।’ কিশোরের মনে হয় কেউ কোথাও নেই। বুকে এসে লাফিয়ে পড়ে, যেমন করে ক্ষত বিক্ষত পাখির ছানা ডানা ঝাপটে এসে পড়ে মা-পাখির কোলে। কিশোরটির নিঃশ্বাস দ্রুত ওঠানামা করে। জলের লাইনের কলকল শব্দ কানে বাজে। অনন্ত’র মনঃশ্চক্ষুতে কত কী ভাসে। কি মনে হয়, কত কিছুর বিনিময়েই না আমাদের জীবনচক্র। আমরা কোনো কিছুকেই ছাড় দিতে শিখিনি। কিশোরের চোখের পাতায় বেদনার রেখাগুলো ওলট পালট খায়। কিশোরের চোখগুলো ওর নিজের মতো। কেউ তো দেখতে চাই নি, ও কেমন করে কাঁদছে, কোন মুহূর্তে ও হাসিতে ফেটে পড়েছে, উচ্চঃস্বরে চিৎকার করে বলেছে, ‘ ঐ ঐ, যা, আমার কথা অনেক দূর উড়ে যা।’ বন নেই, বাদাড় নেই, বকাবকি নেই, ধাক্কাধাক্কি নেই। আরও কত কি চাই, বুঝেও বুঝে উঠতে পারে না। অনন্ত কিশোরটিকে লুকিয়ে ফেলতে চায়। ওকে যে এখনও অনেককিছু দেওয়ার বাকি থেকে গেল। কারা যেন আবারো বলছে, ‘ অনন্ত দৌড়ও, আরও দৌড়ও, যত জোরে পার দৌড়ও, আর যে সময় হাতে নেই।’ এক অতি সংকোচের ভাব এসে ওর পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ বাপু, একটু থামলে হয় না।’ কিশোরটি ওর হাত দুটো ছেড়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সেদিকেই তো তাকিয়ে একদল ছেলেমেয়ে আপনমনে এগিয়ে চলেছে, দেখেশুনে মনে হচ্ছে ওদের গন্তব্য ওরা জানে। উচ্ছলতা মন খুঁড়ে বাহিরে ছাপাবে বলে কত আকুতি। কিশোরটি কী হাত মুঠো করে ধরে ফেলবে বলে প্রস্তুত হচ্ছে। কী নিদারুণ এক প্রতিচ্ছবি পলে পলে বেড়ে চলেছে। হ্যাঁ, গাছই তো, কত লম্বা গাছ, পাতায় পাতায় কত রকমের ধ্বনি। পাতাগুলো উড়ে উড়ে এসে কিশোরটির হাতের মুঠোয় আসবে বলে নেচে বেড়াচ্ছে। কোন এক জাদুবলে মাঝপথেই আটকা পড়ে যায়। কিশোরটি হাঁ করে চেয়ে থাকে। ভয়ে বুক দুরু দুরু করে অনন্তর। অনন্ত ডেকে ওঠে, ‘ও মানিক, ও মানিক’। ওর কোনও নাম থাকতে পারে ও বিশ্বাসই করতে পারে না। কে ডাকে অসময়ে! সময়ের অসময়ের বালাই তো নেই তবে সময় নিয়ে আজ চিন্তা কেন! মাটির গভীরে ছিল বলেই কি। গভীরতার গল্পগুলো কি একটু অন্যরকম হয়ে যায় থেকে থেকে। কিশোরটির মন কিন্তু খুশিতে নেচে ওঠে। অনন্ত’র কন্ঠেই কি কোনো জাদু আছে। এই বিদ্যা রপ্ত করতেও হয়ত এমন যাপনের প্রয়োজন হয়, জীবনের অন্য চাওয়া পাওয়াগুলো দিনে দিনে গৌণ হয়ে যায়, অনেক কিছু না-পাওয়াই শিখিয়ে পড়িয়ে নেয়। অনন্ত নিজেও তো জানে না কেমন করে এরকমটা হল! কে শেখাল, কেইবা বলে দিল মানিক বলে ডাকতে। ও কিশোরটিকে কিছুতেই এই অন্ধকার গহ্বরে যেতে দিতে পারে না। মানুষগুলো তো এইদিকেই দৌড়ে দৌড়ে আসছে, কাঁধে হাতে খন্তা, কোদাল, কাটারি, লম্বা লোহার শিক। ওরা কি ওঐ কিশোরকে তুলে নিয়ে যাবে বলেই তেড়ে আসছে। একী এত টানাটানি আর মুখে কত কথা – ‘ নামবি না মানে, আলবাত নামবি, না হলে পেটের ভাত জুটবে কেমন করে! ঢোক বেটা ঢোক।’

ছাগলের দলবেঁধে আসা অনেকেরই কাছে দৃশ্যদূষণ তো বটেই, নাসারন্ধ্র বন্ধ করে বলেই ফেলে, ‘ওয়াক থু’। মনুষ্যেতর না নীচ মনুষ্য দুই ক্ষেত্রেই বাবুলোকদের  একই শব্দমালা প্রয়োগ করতে দ্বিধা থাকার তো কথা নয়। ওদের কল্পনার অবয়বে দুটোই সমান গোত্রের, কেউ দু’পেয়ে আর কেউ চারপেয়ে এইটুকুই কেবল তফাৎ করে। দূর দূর করে তাড়িয়ে মারতে অনর্থ কোন ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়া কাজের কথা নয়। কলুর বলদ কিনা, এই কথাটা ভাবতে কি বাড়তি মাথা মারতে হয়, যা তৈরি হয়ে রয়েছে তাই কাফি। না হয় কি বলে, ‘দেখ দেখ ওই উটকো বেহায়ারা আবার আমাদের এলাকা দাপাতে চলে এসেছে। শীগগিরিই ওঐ বেটার ছেলেকে চালান করে গুঁতিয়ে। ওগুলোকে কেমন গুঁতোচ্ছে, ছড়ির বাড়িতে এখন পিঠ ফাটাচ্ছে, দৌড়ও, পরে এক এক করে কোতল করবে, ধারালো লম্বা ছুরি দিয়ে কুচি কুচি করে তেল মশলা পেঁয়াজ রসুনে আমরা সাটাব।’ ‘ তাহলে আর এত ঘেন্না করে চোখ কপালে তুলে লাভ লোকসান খু্ঁজে কী লাভ।’ এসব কথা শুনে অনন্তর চক্ষু তো চড়কগাছ।ওদের বলাকওয়া তো থামে না, বলেই চলে।  ‘ওই হারামজাদার একার কম্ম নয়। আরো দু’চারটাকে টাকার লোভ দেখিয়ে নিয়ে তো আয়। কতগুলো তো আধা উলঙ্গ হয়ে এমাথা ওমাথা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা-ও যদি বেঁকে বসে দু’ঘা লাগিয়ে নিয়ে আসবি।’ অনন্তের চোখে অন্ধকার নামে। ছাগলের দলের অন্ত নেই। ওরা ওদের প্রভুদের সমীহ করে। মারের চোটে বেন্দাবন দেখছে, তবুও এক ফোঁটা চোখের জলও যদি গড়াত। কোনটা ভেজে ওঠে না এমন তো নয়, রসনায় এত লালা ঝরে দেখতে তো পায় না কোনটা হাসি, কোনটা কান্না। কোন কালেই তো দেখতে পায়নি। কানেও কম শুনতে পাচ্ছে! ওদের যে চ্যাং দোলা করে নিয়ে আসছে, হাউমাউ করে কান্না তো জুড়েছে। নাকি কখন যন্ত্রণায় কোঁকিয়ে উঠতে হয় সেই বোধটাই হারিয়ে ফেলেছে। কে ওদের বাপ, কে ওদের মা, কে আর কবে শুনিয়েছে। রাস্তার কুকুরগুলোই তো গা চেটে চেটে, পোঁদ ঘষটিয়ে শিখেয়েছে ভালোবাসার রকম সকম। রাত হলে পায়ে পায়ে জড়িয়ে ঘূমিয়ে পড়ে  আর আলোর মুখ দেখলেই  চেয়েচিন্তে খাবে বলে দোকানে দোকানে হাত পাতে। কারও কারও দু’একটা লাথি খেলে কুঁইকুঁই করে। ভাবে এটাই বুঝি করতে হয়। মারামারি করে মাথাও ফাটায়। ‘বেজম্মার দল, খাই খাই, কেবলই খাই খাই।’ অনন্ত আবারও কেন যেন ডাক দেয় নিজের মনেই যে নাম মনে আসে, সেই নামে। ওরা সাড়া দিল কি দিল না কি এল গেল, মনের আশ তো মিটল। ছাগলের দল আর মা-বাপের ঠিকানাহীন মানিক, ঝন্টু মন্টুকে একই দাড়িপাল্লায় দাঁড় করিয়ে কোমর বেঁকিয়ে ডানে বাঁয়ে পা ফেলে পথ কাটে। হাঁটার ছন্দের তালে তালে অনন্ত পেছন ফিরে তাকায়। একী! কী আশ্চর্য! ছাগলের দল ধীরে ধীরে কেন উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে, শত চেষ্টাতেও ওদের মালিকেরা ওদের বশে রাখতে পারছে না। তবে কি ওরা এতক্ষণে বুঝে ফেলেছে কী হতে চলেছে, হয়তো মরিয়া হয়ে ওদের শেষ চেষ্টা। জীবনকে বাজি রেখেই ওদের এই শক্তি সঞ্চয়। ওরা একটু একটু করে উপরে উঠছে। তবে কী ওদের কোন  অদৃশ্য ডানা গজিয়েছে। কতশত শব্দই তো ভেসে আসছে, কিছু কিছু চেনা শব্দ – ভ্যাঁ ভ্যাঁ। ধরতে পারলে না। কাঁচকলা খাও। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ছাগলের দল উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। পথচারীদের শত শত চোখ যেন ছানাবড়া। কী হচ্ছে, কিছুই যেন বোধগম্য হচ্ছে না। ‘ জাদু নাকি!’ ওরা ক্ষণেক হতভম্ব হয়ে ‘কাজকর্ম চুলোয় যাক’ এমন রহস্য উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অনন্তের এমন অবস্থা হল ‘নট নড়ন চড়ন’। কারও কাছে কোন জবাব নেই। ওরা এক স্বপ্নের পৃথিবীতে হাঁটা শুরু করে। আরও আশ্চর্য হল ওই ঠিকাদারদের পোষা কিশোরদের একই অবস্থা দেখে। ওরাও ওই দৃশ্য দেখে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল, কোনোভাবে ডানা গজাতে পারে কিনা। কতক্ষণ ধরে হাত দুটো ধরে টানাটানি করল। একসময় টের পেল একটু হলেও ডানা গজিয়েছে। ওদের ওড়ার চেষ্টা দেখে রোজ দেখা লোকগুলো ভাবল, ‘ওরা এমনিতেও মরবে, অমনিতেও মরবে, মরতে চাইছে মরুক’। 

অনন্ত আর নিজেকেই যেন চিনতে পারছে না। ভাবনাগুলো মরে যেতে লাগল ‘,কী হচ্ছে এসব!’ এই জীবন নিয়ে ওদের একটুও ভয় হল না। কী অকল্পনীয় সুখ এই ডানা ঝাপটানোয়, কিশোররা কি জানত! ছাগলদেরও ইচ্ছাপূরণ হয়, মানুষগুলো আর কবে বুঝবে! অবাক চোখে ওরা জীবনের ছান্দিক উপলব্ধির জের টেনে চলবে। চিন্তাশূন্য মন নিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে ভিন্ন ছবি আঁকবে। মানুষরা উড়ছে, পাগলেরা উড়ছে, একই আকাশে। যাদের ডানা গজায়নি, এমন অত্যাশ্চর্য পরিক্রমায় হিংসেয় জ্বলে পুড়ে মরতে লাগল দুপাশের পথচারীরা, সমান পাল্লায় মাপজোক করতে মন চাইল না। ঠিকাদারদের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল।  স্থান পরিবর্তন যে এভাবেও সম্ভাবনার সীমাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে ওরা একটুও অনুমান করতে পারেনি। পতপত শব্দে উড়ে বেড়াচ্ছে, শোনা যাচ্ছে মেঘের চলাফেরার উচ্চকিত ধ্বনিতে আরও কত যে মিশ্রিত আলাপন, এমন শোনায় ওরা আলোড়িত হল। ভেসে যাওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা হলো, ওদের চলনেও হচ্ছে নানা অঘটন। ফলওয়ালা, ভুজিওয়ালা, আনাজ, তেলেভাজা, ফুচকা বিক্রেতারা অনেকক্ষন ওদের কাজকর্ম থামিয়ে দিয়ে ভাবল যদি ওদের জায়গাটা এমন হতো, ‘ দেখিয়ে তো দিল মুরোদখানা।’ ছাগলের আর ঠিকাদারদের ছটফটানি আর হায় হুতাশে চমকে গেল, শিরশির করতে লাগল গোটা শরীর, দু’হাতের আঙুলগুলো মুঠো করে প্যান্টের দু’পকেটে হাত ঢুকিয়ে চোয়াল শক্ত করে ভাবতে লাগল, কেমন করে ওদের নামিয়ে নিয়ে আসবে, ছাগল মালিকদের চিৎকার চেঁচামেচিই সম্বল হল, মাথার চুল ছিঁড়তে লাগল বেশ করে আর হাতের লাঠি গুলো ঘোরাতে ঘোরাতেই পরখ করতে লাগল, কোথাও তো কোন চমৎকার আছে। ওরা লাঠি দিয়ে বেশ করে  নিজেদের পাছায় মারতে লাগল যদি এমনটা হয়। না না কিছুতেই উড়তে দেওয়া যাবে না। ‘ বেটার ছেলেদের নিচে নামিয়ে না আনতে পারি তো…’। 

অনন্ত এবার কি আরো দৌড়বে, নাকি কাণ্ডকারখানা দেখার মজা লুটবে! একটা কাঁকড়াবিছে সুড়সুড় করে এদিকেই এগিয়ে আসছে, নজর গেল সেইদিকে। অনন্তকে দেখে কিঞ্চিৎ দাঁড়িয়ে গেল। মানুষের মুখ দেখে ওর আপাদমস্তক দেখে নেওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল হল। কি জানি ওর কোন প্রবৃত্তিটা ওকে প্রবলভাবে ধাক্কা মারল, কামড়ানোর ইচ্ছেটা একটুও চাগাড় দিল না, ইতস্তত চলাফেরার পরে নিজেকে খানিকটা সংযত করে পথ ছেড়ে গাছের গুঁড়ির পাশে গিয়ে পকপকিয়ে অনন্তকে দেখতে লাগল। দু’পায়ের উপর ভর করে ভাঁজ করা হাঁটু নিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে যে মানুষটি দুটি পয়সার জন্যে হাত বাড়িয়েছিল, সে-ও ওঐ‌ অমূল্য দৃশ্যটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিল। সেই মুহূর্তে কোন ভাবনায় ও আক্রান্ত হয়েছিল সেটা বোঝার সাধ্য অনন্তের ছিল না। সে শুধু অকস্মাৎ ওদের সখ্যতা একটু একটু টের পেয়েছিল, হয়ত পথচলার ইশারায় নিত্য নতুন ঘটনায় ও রোজই কমবেশি এমন আস্বাদ টেনে নেয়, ভাগাভাগি করবে এমন পালা বলাকওয়ার ওর ক্ষমতা কোথায়। কোনটা যে বিষ, আর কোনটা যে বিষাক্ত, নিজে বুঝলেও কাউকে বোঝাবার দায় যে থাকে না, পরগাছার জীবনের মায়া যে অন্যখাতে বয়। অনন্ত ওঐ পূর্ণ-অপূর্ণ মানুষ আর কাঁকড়াবিছের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজে। অপাংক্তেয় আর দুচ্ছার শব্দদুটি ঘোরাফেরা করে, ধাক্কা যে মারে না জোরে কে আর বলবে। এর আগেও ও দৌড়তে গিয়ে জোরে ধাক্কা খেয়েছে, দেখেও কি এড়িয়ে গেছে। ঠিক এমনি সময় ঝাড়ুদার সাফাই করতে করতে ধুলোবালি ওড়াতে ওড়াতে চলে যেতে চায়। ওকেও ওর একটু অন্যরকম লাগে, ধরা অধরার মাঝখানে ও দাঁড়িয়ে থাকে। দু’এক কলি গানের গুনগুনানি যে নেই, সুরে সুরে যে আক্ষেপ নেই, এমন কথা বললে, পাগলের দীর্ঘশ্বাসই তো বলবে, শোনার তাগিদটা মাঠে মারা যায়। ওই বোধহয় কোন ফাঁকে সুড় পাকানো বিছেটাকে দেখে ফেলেছিল, লেজে লেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওর ছানারা। একটুও এদিক নয়, একটুও ওদিক নয়, এমন নিশ্চিন্তে, মনের আনন্দে এত যে মানুষের ফাঁকফোকর দিয়ে সুড়ুৎ করে অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরছে ওরা কেমন করে জানবে। মানুষের শরীর ছুঁয়ে গেলে অল্পস্বল্প টের পায়, একেবারে অন্যরকম, চেখে দেখলে মনে হয় মিষ্টি স্বাদ, ক্রমে ক্রমে বুঝে নেয়, এদের কব্জা করতে পারলে মন্দ হতো না। কৌশল কিনা, পিছিয়ে গিয়ে বুঝতে চায় কতটা দূরত্বে গেলে ঝাঁপিয়ে পড়তে সুবিধা হবে। ‘বাদাম চাই, বাদাম চাই’ হেঁকেডেকে যে মানুষটি কৌটো নাড়ায় তাকেই লক্ষ্য করে, যদি ঝোপ বুঝে কোপ মারতে পারে। বাদামওয়ালা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে গল্পগাছা করে শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করে, কে হুল ফোটাল, কে আবার রঙ্গরসিকতা করল, কে আবার থু থু করে পচা বাদাম গায়ে ছিটাল, সে তো অনেক দূরের কথা। অনন্ত উদাসীন হলেও, বেমানান নয়, কারা ছক কষছে, কারা ছক ভাঙছে ও একটু আধটু জানে। তাই তো বাদামওয়ালার বুঁদ হয়ে থাকাকে অনন্ত প্রশ্রয় দেয়। ওর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে নোনা ঘামের গন্ধ, ওর উচ্চারণে আত্মীয়তার জ্যান্ত আস্বাদ। রোজকার অস্ফুট শব্দগুলোকে ও চিনে নেয়। বিছেগুলোর তিক্ত, বিষ ছড়ানোর উগ্ৰ বাসনায় ও ভয় পায় না। ও জানে ওরা দিনরাত শুধু ছোবলের আকাঙ্খায় সময় গোনে। অনন্ত এই মানুষগুলোর ইশারা বোঝে।  ঝাঁকে ঝাঁকে গদিওয়ালা চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে আসে। ওদের দাঁড়াগুলো পাকানো, কোনটা লম্বা, কোনটা গোটানো। যারা এতক্ষণ উবুড় হয়ে কাজ করছিল, ওরা মাথা নিচু করে সব কথার তীরে ঘায়েল হয়ে ছটফট শুরু করে। এদের না আছে উঠোন, না আছে ঘর, কোন এক প্রান্তে মাথা গুঁজে কোনরকমে সময়টা পার করে চলে। 

কে খুঁজে দেবে জীবন, কোথায় গেলে পাবে আর কেই বা দেবে সম্মানের ছিটেফোঁটা। লোকগুলো বেঁকে গেছে, ওদের পিঠের উপর ঘুরঘুর করছে সেই বিছেগুলো, জানাবোঝা গেলেও নড়চড় হবে, কার এমন বুকের পাটা আছে। এই বুঝি প্রাণবায়ু নিঃশেষিত হয়। ওরা দাঁড়া দিয়ে শিড়দাঁড়া বেয়ে গলার কাছে চলে আসে। ওরা ভারী বোঝায় নূব্জ হয়ে যেইমাত্র পথ পরিবর্তনের চেষ্টা করে, গদিটা শূন্য হয়ে যায়, বিছে কিংবা বিচ্ছুরা কথার পরে কথা জুড়ে মুখের চোয়াল বাঁকিয়ে ভুরু কুঁচকে এমন বাক্যরচনার মহড়া দেয় মনে হতে থাকে এই বুঝি সব শেষ। অনন্ত ভিরমি খায় – এ কী হল! সব রসাতলে যায়। জ্যান্ত সমাধি থেকে উঠে আসে মরাকান্নার শব্দ। গুমরায়। সকলে যখন ঘরে ফেরার তোড়জোড় করে, বিচ্ছুরা সক্রিয় হয়ে বলে, ‘এই সাম্রাজ্য তোর বাপ সামলাবে, বোকাচোদার দল।’ ওরা একবার হাঁ, একবার না বলে নিজেদের চলন্ত রোবট বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। ‘তুই যাবি না, তোর বাপ যাবে।’ কান্নার শব্দগুলো দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে বলতে চায়, ‘তোমাদের আর কত চাই। আরো চাই, আরো চাই।’ ওমা একি ওদের জিভগুলো কেমন করে উল্টো দিকে ঘুরে গেল। বিচ্ছুরা ওদের দাঁড়াগুলোকে শক্ত করে বিশেষ পরিকল্পনার দিকে ছুটে যায়। তখনো বজ্রাঘাত হয়নি, বিদ্যুৎও চমকায়নি, কালো কালো মেঘগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কাকে ডাকছে কেউ জানে না। আয়োজন সম্পূর্ণ হয়েছে। বিচ্ছুরা সব কিলবিল করে ওঠে। অনন্ত বুঝতে পারে না ওর কী করা উচিত। বিচ্ছুরা আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করবে না,এমনি এক স্থির প্রতিজ্ঞা নিয়েছে। এবার ওরা ধীরে ধীরে লেজ থেকে বের করতে শুরু করে সেই ধারাল কাঁটা। ওরা ওদের গলার কাছাকাছি চলে আসে। কি অসম্ভব সেই বিষের জ্বালা। অনন্তের শরীরে দু’একবার প্রবেশ করেছে বটে, কাবু করতে পারেনি। অনন্ত চিৎকার করতে শুরু করে – দৌড়ও দৌড়ও। তোমরা কি বুঝেও বুঝতে পারছ না। ওরা এসে গেছে। তোমরা কি দেখেও দেখতে পাচ্ছ না, ওরা তোমাদের গোটা শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে, এবার বিষ ঢালবে। তোমাদের মনের উপর দখল নিতে পারে নি, এখনও সময় আছে, মনটাকে কাজে লাগাও। অচিরেই না হয় মনের উপর অধিকার কায়েম করতে চাইবে। ওরা এতকাল ওই চেষ্টাও চালিয়েছে। তোমাদের বাপ-ঠাকুরদারা জবাব দিয়েছে, এবার তোমাদের পালা। মনটাকে শক্ত বাঁধনে বেঁধে ফেল, দ্বিতীয় আর কোনো রাস্তা খোলা নেই। অনন্ত আবার ছোটার আগেই ওই বার্তাটাই পৌঁছে দিল। ও নিজেও তো ভুক্তভোগী। ওঐ অস্ত্রের আবির্ভাবের দিনগুলো ওর বড়ই চেনা। 

বিলুর অচেনা জগতের হদিস অনন্ত কখনও জানবে না। সেই সীমা অতিক্রমনের বিদ্যেটা জানা নেই ওর। ক্রমাগত অনুশীলনই ওকে সেই দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। অনন্ত আরো খুঁজতে চায়। ঠিকানাবিহীন এই পথ বড় দুর্গম, কাঁকর বালি সরিয়ে গেলেও কেউ না কেউ প্রস্তুত হয়ে থাকবে ওকে দমিয়ে দেবে বলে। ওই লোকগুলো সে পথেই তো আস্তানা গেড়েছে। ওরা এইভাবেই তো হেঁকে হেঁকে বাঁচে। কোন রাস্তা যে আর খোলা নেই। ওরা এইভাবেই নিজেদের মধ্যে কথা চালাচালি করে। ইটপাটকেল ছোড়ে। একটা ঘরেই জরাজরি করে নিজেদের ভালোমন্দ ভাগ করে নেয়। জন্ম মৃত্যুর হিসেব কষে। কখন যে কোথা থেকে কান্নার রোল এসে অস্থির করে দেয়, মরা মানুষটার শরীর ঘিরে হায় হুতাশে জীবনের মানে খোঁজে। অনন্ত হাঁটাহাঁটি করে এক বিন্দুতে এসে স্থির হয়ে যায়। ওঐ তো দূরে এক প্লাস্টিক ঘেরা পায়খানা ঘরে লোকজন যায় আর আসে। লম্বা লাইন। কুকুরগুলো পেটটা পরিষ্কার করে বার কয়েক ঘেউঘেউ করে নিল, বাচ্চা কোলে নিয়ে মা-টা কি যেন ভেবে নিল, ওকেও যে অনন্তের মতো দৌড়তে হবে। কোলেরটা ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলে সাবিত্রী অস্থির হয়ে পায়চারি করে। সময়ের যে ওর গোনাগুনতি হিসেব, ছয় ছয়টা বাড়ির কখন কোথায় যাবে। বেচারা স্বামী হুজ্জতি করে গলায় ঢক ঢক করে গিলে আধা-মাতাল হয়ে রিকশার ঘন্টি বাজিয়ে প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতেই চলে গেল। কি জানি আবার কোন যাত্রীকে না ছিটকে ফেলে দিয়ে পাবলিকের মার খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে দরমার বেড়ার ঘরে ফিরে চিৎপটাং হয়, কাজের বাড়িতে বসেও ভয়ে বুক কাঁপে সাবিত্রীর ভেবে ভেবে। ‘দোষ বলে দোষ, মেয়েছেলের দোষ যে, দিনরাত কালি মাগীর পেছনে ঘুর ঘুর করে, ওঐ মাগীর স্বামী যে পালিয়ে গিয়ে আর একটা মেয়েছেলের সঙ্গে ঘর বেঁধেছে, তাই তো আমারটার দিকে নজর। বাগে পাই একবার, মুখে চুনকালি না মাখিয়েছি তো বাপের বেটি নই, কচি ছেলের দিব্যি খেয়ে পেতিজ্ঞা করলাম।’ ওরা দিনেরাতে এমন কত প্রতিজ্ঞাই যে করে। শুধুই কি পেটে খিদে, মনেরও তো খিদে। পচা জমা জলের গন্ধে ভূত পালায়, মশারা বন বন করে, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু গোটা বস্তিতে। অনন্ত নজর ঘুরিয়ে এইভাবেই  থেমে যায়। 

কত জীবনের গল্প ওর ঝোলায় পুরে আরও অনেক গল্পের রস চেটেপুটে নেয়। সাবিত্রীরা ছোটে পূব দিকে তো ও পশ্চিমে। হোঁচট খেয়েও উঠে দাঁড়ায়। ডালে বসে কাকটা কা কা করে ডেকেই চলে। বিলু ওর দিকে চেয়ে চেয়ে কখনও আকাশে ওড়ে আবার ঘুড়ির মতো গোত্তা খেয়ে নিতে নামে। অনন্তের সঙ্গে ওর মুখোমুখি হয়ে যাওয়া নেহাতই কাকতালীয় । না হয় লোকটার কাকচক্ষু হতে যাবে কোন দুঃখে। গরগর করে ঠিকুজি কুষ্টি সব তো বলে দেয়। বলে, ‘দেখ, ভালো করে দেখ, গোটা শহরটাকে দেখতে পাস কিনা।’ অনন্ত মোটা কাঁচের ফাঁক দিয়ে চোখ পাকিয়ে দেখে। কী দেখতে পেল ও। লক্ষ লক্ষ লোক গিজগিজ করছে। উঁচু প্রাচীরটায় একটুও ফাটল না ধরিয়ে কাণ্ডটা মানুষের কোমরের মতো পেঁচিয়ে জাপটে ধরে আছে এমন করে যেন আর কারোই নিস্তার নেই, একটু এদিক ওদিক হলেই বংশ শুদ্ধ বিনষ্ট হবে, ষোল কলা পূর্ণ হবে। এমন দুনিয়ার চেহারা সুরত ওতো কোনকালে দেখে নি, তাহলে কি সবটাই বিলুর কারসাজি, নাকি ওঐ লোকটার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভেলকি দেখাচ্ছে – ছু মন্ত্রর ছু, কালি কুত্তার গু। কাকটার গলা এত বিচ্ছিরি শোনাচ্ছে কেন! কোন অশুভ সময়ের ইঙ্গিত! বেড়ালটাও চোঁ করে পালিয়ে যাবার আগে বাচ্চাদের গলা করে ম্যাও ম্যাও করে বারকয়েক কান্নার ঝড় বইয়ে দিয়ে গেল। কী সুখ পেল বেড়ালটা, এনে তো দিল মনে একরাশ ভয়। লোকটা তখনও কি একটা দেখাবে বলে মনপ্রাণ ঢেলে ষোলো আনা চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল। ওর দেখা ওই জাদুর শহরটাকে দর্শন না করাতে পারলে ওর নিস্তার নেই। ‘ দেখলি কেমন গোটা শহরটার কেমন ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে।’ ‘ কই কিছু নেই তো!’      ‘সে কীরে! এই তো আমি দেখলাম, তুই কিছুই দেখতে পেলি না! সময়টা কেমন ঘুরপাক খাচ্ছে চক্রাকারে। তুই একটা গবেট। চোখে ন্যাবা হয়নি তো!’ অনন্ত ধীরে ধীরে নিজের উপর বিশ্বাস হারাতে শুরু করে। কোন পথে যাবে? আবার কি ফিরে ফিরে দেখবে। কিছুতেই যে এই অত্যাশ্চার্য শহরটাকে দেখার লোভ সামলাতে পারছে না। কি যেন ওর উপর এসে ভর করেছে। ওরা সব মাথা নিচু করে বাকরুদ্ধ হয়ে মায়ার বাঁধন ছিঁড়তে চাইছে। ওরা হাহাকার করে উঠছে থেকে থেকে। মুখে উচ্চারণ করছে, ‘এ বড় দুঃসময়! জন্মের সুসময়ে মা কেন আমাদের গলাটিপে মেরে ফেলল না, তাহলে তো এমন দিন এসে ধাক্কা মেরে ফেলে দিত না। কে যেন বলল, ফিরে যা, নিজেদের ঘরে ফিরে যা।’ অনন্ত এখনও জানে না কোনটাকে বলে নিজেদের ঘরে। লোকটা আবারো বলল, ‘ দেখরে বাপ দেখ, এই সুযোগ হেলায় হারাস না, কালেভদ্রে একবার আসে।’ অনন্ত লোকটার দেওয়া অদ্ভুত চশমাটা পরে নেয়। আশায় বুক বাঁধে। এইবার ও এমন কিছু দেখে ফেলবে নিশ্চয়ই আগে কখনো দেখেনি। ‘ শত শত আগুনের গোলা ধেয়ে আসছে, আর বুঝি নিস্তার নেই। লোকগুলো নিমেষে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। ওদের পোড়ানো হচ্ছে। ওরা কীসের আকষর্ণে আবার গর্ভে ফিরে যেতে চাইছে! এটাও কি জীবনকে না চেনার আর এক ঘোষণা, না হলে এত শূ্ন্যতা কেন? অনন্ত একা দাঁড়িয়ে আছে এত লম্বা চওড়া রাস্তায়। কেউ কোথাও নেই। লোকটার টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। এ কী স্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন! কিছু লোক বলে গেল অনন্ত পাগল হয়েছে, না হলে এমন করে ছাপোষা লোকগুলোর রুটি রোজগারে ভাগ বসিয়ে বলে, ‘আয় তোরাও দেখবি আয়। সাহেবসুবোরা দু হাত তুলে করতালি দেয় আর বলে, কেমন দিলুম, ও তো আমাদেরই লোক, যা এবার রসাতলে যা। অনন্ত বিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকে, বিলুকেই খুঁজে বেড়ায় আর বিলু খোঁজে কাকেদের ঘরবাড়ি। ওঐ লোকটা কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে এসে বলে, ‘নির্বোধ, কেমন বোকা বানিয়ে দিলাম তো!

এমন উলঙ্গ হয়ে যায়! কারা ওরা, কে না জানে। কোন এক পৃথিবীর বাতায়নে বসে নিজেদের ঘরে ডুব দিতে চাইছে। শরীরে  অমৃত সুখের ধ্বজা উড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরছে, তবু তাকে কি আনন্দে লালন করে চলেছে, মনে তাদের যন্ত্রণা সুখ। বিলু ইশারায় জানাচ্ছে অনন্তকে, কেমন তারা নিজেদের মুড়িয়ে রেখেছে একবার জানবি না। অনন্ত বলে বেড়াচ্ছে সেও কী সম্ভব! পলক না ফেলা দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে মরে।  আবীর রঙের আলতো ছোঁয়ায় এপাশ ওপাশ করে। অনন্ত যেতে তো চায় কিন্তু কেন যাবে!  কত তো রঙ রঙিন হয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে রূপের আগুনে, নিজেরা পুড়ছে, অন্যদেরও পোড়াচ্ছে। আসছে এক এক করে কারা যেন ওদের শরীর কিছুক্ষণ অন্তত ছিঁড়ে খাবে বলে। লালসার রস দিনমান বয়ে বেড়িয়েছে এক শরীর থেকে অন্য শরীরে। ‘নে, নিবি তো নে, আর কত নিবি। শরীর যত চাইছে তত খা। খাবি না আবার না হলে পেট পুরবে কী করে, চ্যাটের সুখ শরীরে ঢালবি না, তা আবার হয় নাকি!’ অনন্ত মাথা ঝুঁকিয়ে দেখে কত বিষ ঘন কালো হয়ে রয়েছে জমাট বাঁধা অন্ধকারে। অল্পস্বল্প আলো এসে মেখে দিচ্ছে ক্লান্ত শ্রান্ত খাঁচা। কার বাসা কে রয়, শুধুই লাশ হয়ে আছে। ধুলোমাখা বাতাসের প্যানপ্যানাতিতে কত না আত্মীয়তা। কারা কাঁদে আনন্দের ডামাডোলে। দুমুঠো খাবারের আশায় পাত পেতে বসে থাকে। ছেঁড়া ছেঁড়া শালপাতার ফাঁকে কত না রসের আয়োজন, কত কিইনা মিশে আছে, ধুলো আর বালি জুতোর গায়ে সেঁটে থাকা কফ, থুথু, সব যে মিশে যাচ্ছে একটু একটু করে ভাতের থালায়।  যুবতী মেয়েগুলোর ছলাকলা, কথার জাদুতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলা, মাঝবয়সীদের শরীরে পড়ন্ত রূপের ছেনালি, ধরবে না ফেলবে কে জানে।  ল্যাংটা শিশুগুলো, ঘুরছে তো ঘুরছেই, কোন হেলদোল নেই। একটা কেরা পোকা কিলবিল করে ওদের মুখের কাছে ঘুরে বেড়ায়, এই শহরের মুখ কিনা, কত তো ছিরি! শহরের নামি দোকানের খাবার – চিকেন, মাটন রোল,চিকেন কাটলেট, বিরিয়ানি, কাবাব টেবিলে থরে থরে সাজানো। ক্যামেরাম্যান তাক করে আছে, সাংবাদিক কথার জারিজুরিতে বিজ্ঞাপনি রঙ ছড়াচ্ছে চ্যানেলের সৌজন্যে। ওদের তোবড়ানো মুখগুলো কোন ফাঁকে রসনা তৃপ্ত মুখগুলোর সঙ্গে মিশে যায়, ওরাও হয়ে যায় বিনোদনের খোরাক। পাশে দাঁড়ানো লোকটা বলল, ‘ আসুন, আমরা অভ্যর্থনা জানাই।’  শরীরের মজা লুটতে আসা ড্রাইভারের সঙ্গে দর কষাকষি করে,  চুলে সুগন্ধি তেল মাখা, শরীরে ঘেউ খেলানো, পাউডার ছড়ানো মুখগুলো। সদ্য প্রসবিনী মায়ের ভরন্ত মাইগুলো থেকে ওরা টেনে নিচ্ছে যত রস, টপ টপ করে ঝরে পড়ছে রসের হাঁড়িতে। অনন্তের শরীরেও কি জ্বালা ধরাচ্ছে? টের পাচ্ছে না এমন তো নয়, কেমন করে মেলাবে ও মুখগুলোর সঙ্গে। বাচ্চাটা দৌড়ে এসে বলল, ‘মা খাব।’ ‘ কে মা, কার মা, সন্তানের মুখটা মুহূর্তে অচেনা হয়ে যায়।’ খরিদ্দারটা জ্বালিয়ে মারে, ‘আর কতক্ষণ?’ অনন্ত কি এখনও দাঁড়িয়ে থাকবে, ওদের দলে জায়গা করে নেবে কিনা। ও জানে না, জানতে চায়ও না। আঁধারটা কখন যে জমাট বেঁধেছিল, হুই আকাশে। কই কোন রামধনু অনন্তের চোখে ধরা তো পড়ছে না ! কাকটা মন্দিরের চুড়োয় বসে মন দিয়ে তো দেখছিল কত কাণ্ডকারখানা। কার কাছে ও জবাব চাইবে? অনন্তের কাছে! ও নিজেই এখন নিজেকে সামলাতে গিয়ে হচ্ছে বেসামাল। বিলুর হাতে কাঁসরঘন্টা ছিল, বাজিয়েই তো চলে – ঢঙ ঢঙ। ওরা যারা মজা লুটবে বলে পিছু নিয়েছে, নেচে নেচে গেয়ে চলে, হরি হে মাধব! হরিবোল, বলো সবে ‘হরিবোল’, জোরসে বলো ‘হরিবোল’।

চতুর্থ অধ্যায়

নাম সংকীর্তন সেরে জঙ্গল সাধুখাঁ যখন ইহকালের পাপবোধ থেকে মুক্ত হতে চাইছিল ঠিক তক্ষুনি ওর ডাক পড়ল। ‘এত চটজলদি মুক্তি চাইলে হবে বাপু, জীবন যে অনেক কিছু এখনও চেয়ে বসে আছে, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তো কী হয়েছে, সে কি এত সহজে ছাড় দেবে?’ জঙ্গলের তখনও বিশেষ কোন ভাবনার পাহাড় এসে জমা হয় নি। একটা সমতার খেলাই খেলছিল এতদিন যা খেলছিল এঁটেল মাটির মতো, এখন খানিকটা কাদা মাটি, পিছল খেয়ে চলে যায়। জীবনের মর্মাথ কী খোঁজার সুযোগ থাকে! যে গাছটা লম্বা হয়ে ডালপালা ছড়িয়ে সবুজ পাতার ফাঁক ফোকরে হলুদ পাতার আত্মীয়তায় জড়াতে চাইছিল, বলছিল  যার ফুরিয়ে যাবার সময় হয়েছে তাকে ধরে রেখে কী লাভ! বিবর্ণ পাতাগুলো দুই তিন ভোল্ট খেতে খেতে এসে পড়ল জঙ্গল যেখানে ডালা নিয়ে বসেছিল, ঠিক নাক বরাবর।  এমনিতে দূর্ভোগের অন্ত নেই, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। টিয়া চন্দনারা বিনা বাধায় ছ র্ র্ র্ করে ছেড়ে দিল মাথার তালুতে, কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই, পেট ছাড়াড় কথা উঠেছিল বলেই যখন তখন মাথার তালুর ওপরে আগাপাশতলা না ভেবেই এমন কাণ্ড বাঁধিয়েছে। ‘হারমজাদা রাধাচূড়া আমার সঙ্গে বেইমানি, জন্মাতে দেখেছি লজ্জা করে না। ট্রামলাইনটার পাশ থেকে  যেতি তো ধাপার মাঠে, ভাগ্যিস চোখটা পড়েছিল, না হলে কী দশা হত, বংশ নিব্বংশ হতো, কত বড় বেইমান। ‘ মানুষের উপর দায় না চাপিয়ে, যত দোষের ভাগ ওর! হরি হে দীনবন্ধু কাছের মানুষ দূরে যাবে, দূরের মানুষ মজা লুটবে, এই তো জগৎ সংসারের নিয়ম। কাঁকটা কা কা করে উঠলে জঙ্গল চমকেই ওঠে। শ্রবণশক্তি কমে গিয়ে মাঝে মাঝে এমন আক্বেল গুড়ুম হয়, লাথি ঝাঁটা খেয়ে আর শোধবোধ থাকে না। সেই তো সাতসকালে সাইকেল চালিয়ে দশ মাইল দূর থেকে টানা ছয় ঘন্টা খরিদ্দারের সঙ্গে বকর বকর। ওই তো পুঁজি। বিকেলে ট্রেনে চেপে পাইকারি বাজারে লাইন লাগান। কে আর অত পাত্তা টাত্তা দেয়। বাপ-ঠাকুরদাকে কেউ গণায় ধরেনি, দূর দূর করে তাড়িয়েছে, শেষমেষ বাজার কমিটির হাতে পায়ে ধরে একরকম মাটি আঁকড়ে বসেছিল। ঝাঁকা মাথায় নিয়ে দু-চারটে কাগজি গন্ধরাজ লেবু, বেগুন ঢেড়স দূর দূর গাঁ থেকে কিনে ভোর রাত থেকে পায়ে হেঁটে তবে না বাজার ধরা। হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে আধপেটা খেয়ে সেই যে বুকের ব্যামো বাঁধালো, এক ধাক্কাতেই সব শেষ। জঙ্গল এখন বুঝতে পারে না কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক, সব হিসেব গোলমাল হয়ে যায়। বাবার স্মৃতি আঁকড়েই বাকি পথটুকু চলে ফেরে বেড়ান। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করলেও জঙ্গল মুখ চেয়ে বসে থাকে কখন সুফল এসে টিফিন ক্যারিয়ারে ওর সবজি ভাতটা নিয়ে হাজির হবে। আরো দু-চারটে ভাতের হোটেল যে চারপাশে গজিয়ে ওঠেনি এমন নয়, তবুও পুরনো আমলের ঠাকুর সুফলের সঙ্গে ওর আত্মার সম্পর্ক, এই কথা ও ভুলবে কেমন করে, দেরি একটু না হয় হল, সুফল তো বারবার করে যে ওর বাবার কথাই মনে করিয়ে দেয়, তার দামই বা কম কী! তবু দিন দিন এই যে জায়গাটা পাল্টে যাচ্ছে,  মেনে নিতে একপ্রকার যন্ত্রণাই হচ্ছে। কেউ কেউ প্রশ্নও তো করে ‘কীরে জঙ্গল এত ঝিমুচ্ছিস কেন? বাজারের গতিক ভালো নয় বুঝি।’ কাঁকটা এবার ফাটিয়ে চিৎকার করল  ‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ।’ উত্তরটা জঙ্গলের হয়ে ওই ছাদে বসা কাঁকটা দিল কিনা, আংশিক সত্যটাই কি প্রকাশ হল? সফলের দুশ্চিন্তায় দিন যায় আর বাজারের অন্দরে বেড়ে ওঠা বাজারটার দিকে চেয়ে থাকে। মাঙ্গা হয়েছে বলে কত কথাই না শুনতে হয়। সইতে হয়, আবার কথার ঝাঁজ থাকলে জবাব দিতে পিছপা হয় না – ‘বাবু, যত দোষ জঙ্গল সাধুখাঁর, আসল দোষী যে কলার তোলে ঘোরে, সে খেয়াল আর কার আছে? অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকায়ে যায়।’ 

তলার পর তলা ওঠে। বড় মজবুত এই বহুতল বাড়ি। পুরুষের পর পুরুষ পার হয়ে গেল, জঙ্গলরা যেই তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেল। চঞ্চলের কাছে মনে হল সব ভোজবাজি। আলো আঁধারের ভোল বদলালে কখনও সখনও এরকমটা হয়ে থাকে। এই আছে এই নেই, বড় আজগুবি এই দেশ, গুঁড়িয়ে দিতে

কে আর কতটা ভাবে। বাড়িটার গায়ে কালচে ছোট ছোট দাগ পড়েছিল, মজবুত ছিল এইকথা বলা যাবে না, লোকজনের আনাগোনাও ছিল, কত গল্পের ছিল ছড়াছড়ি। জন্ম মৃত্যুর হিসেবের কথা সে তো কেবল মূর্খের কাজ, তাই না! জমা খরচের হিসাব সকল লেনাদেনা সকলে চোখ পাকিয়ে দেখেছে। আর কেউ চোখের জল ফেলুক না ফেলুক জঙ্গল দরদর করে কেঁদেছিল। বলেছিল ‘কেন যাব, যাব কেন?’ গ্যাঁট হয়ে বসে রইল। কী জানি ওই ভাঙনের সময়টা মিষ্টি না তেতো। চালওয়ালা বোকা বলল, ‘ বাবুলোকদের জন্য রোজ পাঁচ কেজি করে চালের অর্ডার ছিল বাঁধা।’  যে দু-একটা পুরণো দোকান নিজেদের সগর্বে অস্তিত্ব ঘোষণা করছে পরাজিত বীর সৈনিকের মতো, চঞ্চল ঘুরেফিরে সেই দরজাগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল, সময়টা বোধহয় এইভাবেই একদিন নতুন হয়ে ওঠে। নতুনের গর্জনে সব ওলট পালট হয়ে যায়, পুরাতন এসে শেষবারের মতো নিস্ফল মায়াবী বন্ধনে জড়াবার চেষ্টা করে। দেড়শ বছর আগের পোড়া  ইট বালি সিমেন্ট আর লোহার বিমগুলোর লরির পর লরি এসে শেষকৃত্য সম্পন্ন করে। চঞ্চলের কানে যেন মরাকান্নার এক জরাগ্ৰস্ত বাজনা এসে গুনগুন করে। চঞ্চল অস্থিরময় হয়।  ‘কেউ আপনারা নিজের কথাগুলো বললেন না।’ ‘ বলেছে না! মিউ মিউ করে বলেছে।’ চঞ্চল অবাক হয়ে জঙ্গলের দিকে তাকালো। ‘ তুমি দেখেছিলে লোহার রড, বিশালকায় স্ল্যাবগুলো একে একে কীভাবে জায়গা দখল করে নিচ্ছিল?’ জঙ্গল নিশ্চুপ হয়ে যায়। চঞ্চলের উচ্চারিত শব্দগুলো ওকে ধাক্বা মারে কিন্তু বেশিদূর পৌঁছতে পারে না। গুড়গুড় শব্দ করে। ক্রেইনের ওঠানামার শব্দগুলোর তুলনায় বড়ই ম্রিয়মান। কাঁকটা শাগরেদ জুটিয়ে সমস্বরে চিৎকার জুড়ে দেয়। চঞ্চলকে দেখে জঙ্গল কথাগুলো আওড়াতে থাকে। কীসের কথা? বলার কথা তো বটেই। মানুষগুলো কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসবে এক এক করে। কোটি কোটি টাকার বান্ডিল এনে হাজির করবে। ওরা এমনি করেই নিদ্রা যায়। সুখই সুখ, সুখের গগণে উড়ে উড়ে বেড়ায়। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে থাকে জঙ্গলের। কত পুরুষের অনিশ্চিত জীবন। ওই তো গাঙের বুকে কালো জলে ভরা মানুষের লাশ ভাসে। টলটলে জলে কোন পুরুষ পশরা নিয়ে নাও ভাসাত। বানের জলে কাঠের টুকরো হাফিজ, কুকুর বেজি ইঁদুরের লাশ নিয়ে জলে ভাসলো। জঙ্গল ইঁদুরের জায়গা নিল। কোন রকমে থামের গোড়ায় প্লাস্টিকে মুড়িয়ে পরিচয় দিল – ওই দেখছ আমার বাপকেলে জায়গা, কেমন লাগছে। চলেই তো আসছে। জোটেনি তো এক চিলতে, একটা হিল্লে তো হতো। ত্রিশটা বছর গেল। ওই লোকগুলো টাকার জোরে এমন আস্তানা গড়ল, চার পুরুষ ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং তুলল, আমফান, যশ সব ধোপে টিকল না,এমন ইমারত বানাল, জঙ্গলের টিনের চাল উড়ে উড়ে গেল, দেয়াল খসে পড়ল। জঙ্গল নিজের গান নিজে লিখল, সুরের টানে এতকাল নিজেই মাতাল, এমন করে ঠোঁট নাড়াল, যারা রাস্তার ধারে নাড়া বেঁধেছিল, বুঝতেই পারল না, কোথায় শুরু কোথায় শেষ। চঞ্চল শুনে বলল, ‘ভায়া হিম্মৎ রাখ। কেউ ওদিকে ফিরেও তাকাবে না, এমন দিন আসছে।’ কাঁকটাও তালে তাল মেলাল – ওই দেখ জীবন হাসছে আর বলছে তোমাদের দশ পুরুষের জাবদা খাতা খুলেই যাবে একদিন। জঙ্গল কোন কথার মানেই বুঝল না। সাইকেল চালিয়ে ক্রিং ক্রিং শব্দ করে গলিপথ ধরল। ‘ পড়ালেখার বাবুটা পাগল।’

বিলুর উৎকণ্ঠা নিজের অঙ্গনে ঘোরাফেরা করে নিজেই যখন খোঁজার আকুতিকে চতুর্গুণ করল, পদ্মপলাশই ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল, বলেই ফেলল জোর গলায়, ‘তুমি আমায় চিনলে কেমন করে গো?’ ‘দেখলাম যে হুবুহু অধিকারী বাড়ির পোষ মানানো হরিণের মতো, যতই খাঁচায় পুরুক, পালিয়ে ও যাবেই, সে তুমি যতই আটকে রাখার ফন্দি কর। তুমি বলবে কেমন করে পালাল? সে কী আর আমি জানি। জানতে পারলে আমার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার হয়ে যেত। তবে এটা জানি কেমন করে সশরীরে স্বর্গে যাওয়া যায়।’ ‘তোমার গল্প শুনেছি বটে, কিন্তু এত গোপন কথা জান, সে তো জানতুম না।’ ‘এত তো খুঁজে মরি, এই পথের খোঁজে বের হব, এ জানব না। এই দেখ, এই রহস্য জানবে বলেই তো ওরা আমার পিছু নিয়েছে।’ পদ্মপলাশ বিলুর চিন্তার এই বন্ধনকে নিজের জীবনের সঙ্গে মেলাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। মিল খুঁজে বেড়ায় নানা রঙে। পদ্মপলাশ জানতেই পারল না ওকে জানবে বুঝবে বলেই এই কানা গলিতে অনুসরণ করে চলেছে বিলু। হোঁচট খায়নি বলতে চাইছেন, কত যে রক্ত ঝরেছে। ঝরছে ঝরুক, তাই বলে পথচলা তো থামাতে পারেনা। বিলু জানে ওর জীবনের গল্পগুলোতে আগুন আছে। সেই আগুন জীবনকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে যে কোন মুহুর্তে। তাই তো ওর এত জ্বালা। ও কি বিশেষ কোনো হুঁশিয়ারি দিতে চায়! বলতে চায় এই বেপরোয়া জীবনে রাশ টানতে না পারলে ধ্বংস অনিবার্য। পদ্মপলাশ কি দেখেও দেখেনি এই অনুসরণকারীকে। বিলুর মতলবে কোন দূরভিসন্ধি জেনে পাল্টে দিয়েছিল ওর চেনা পথ। বলতে কি শোনেনি, শুনেছে কত কথা, মানুষের চলার পথে এখন কত চোরাগলি, ওরা ঘুমিয়েছিল, না জেগে ঘুমিয়েছিল বিলু কেমন করে জানবে। পদ্মপলাশকে ডেকে বলতে পারে, ‘যেয়ো না গো, ও পথে কাঁটা আছে।’ শুনবে কি শুনবে না ওর সিন্ধান্ত। গাঁক গাঁক করে চলে যায়। ওর ভেতরে জ্বালা, বাহিরে জ্বালা।  কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্ক্রুডাইভার, ফিল্টার, টিডিএস মাপার যন্ত্র, মেমব্রেন,পাম্প মোটর নিয়ে বড় রাস্তা থেকে গলি, তস্য গলির ভেতর ঢুকে পড়ে বড়লোক, মেজলোক,সেজলোকদের দরজায়। ওর অবস্থানটা যে কোথায়, জানে না তো, ছোটলোক কিনা, এই প্রশ্নের উত্তর ওদের সম্বোধনের মধ্যেই, নিন্দেমন্দের মধ্যেই গুমড়ে মরছে। বিলু তো সবজান্তা, কিছুটা বেশিই জানে। এই বিশেষ বিদ্যাটা জানে বলেই না এত ওর দুশ্চিন্তা, টেনে হিঁচড়ে নিতে চায়। ‘ও ছেলেটা জবাবটা তো দিতেই পারিস, মুখ বুজে কত আর সইবি বাপ, মানুষ কি নয়, না রোবট।’ চোখের সামনে চোখে মুখে রক্ত তুলে মরে গেল, জ্বলন্ত পিচের গোলা এসে পড়ল পাঁজরে। বয়স আর কত সতের আঠারো হবে, ঠিকাদার মালিক, পাড়ার লোকজনই সম্বল কিনা, বাপের চিকিৎসা তো করাল, টিকে ছিল বছর তিনেক, যেই কে সেই। নেমে তো পড়ল রাস্তায়। বিলু তো এইসব দেখতে পায়, মিথ্যে তো নয়, ‘লোকে যা ভাবছে ভাবুক না, ভাবাভাবি দিয়ে তো দোষগুন বিচার হয় না, লাথি ঝাঁটা খাচ্ছিস, এই কথা চাউর হতে কত বাকি, এই কথা কি আর বুঝি না।’ ‘দেব না আবার, বাবুরা উল্টোসিধে বললে ছাড়ি কি আমি। ঝেড়ে দি,বেশি দাঁত ফুটিয়ো না, গরীবের ছেলে বলে কথা জোগাবে না মুখে, এ কেমন করে বুঝলে।’ পদ্মপলাশের চোয়ালটা শক্ত হচ্ছে কিনা। শক্ত হয়ে চলেছে আবার নরমও হচ্ছে, চোখের চাহনিতে কত ভাষা ঘুরে ঘুরে মরল, আবার জেগে উঠল। জেগে

 গিয়ে থেমেও তো যায়। রীক্সা স্ট্যান্ডের ছেলেগুলো বিলুকে কত তোষামোদি না করে। করবে নাই বা কেন, উত্তর দক্ষিণের খোকাখুকু, ছেলেবুড়ো, নানা নানী, দাদা দাদী কেউ কি আর বাদ যায়, নাড়িভুঁড়ি টেনে সকল কথার আদ্য শ্রাদ্ধ করে ছাড়ে। মুখের উপর দাবি পেশ করেই ছাড়ে না, সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। কী জানি কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য হবে কিনা, কে আর বলবে? পূর্ব পশ্চিমে গুণকীর্তন তো কম হচ্ছে না। বিলুর আবার থোরাই কেয়ার। ভাবের ঘোরে দিন কাটে, মন মানে না। মানুষের মন চেনার কত আন্দাজ কত গালগল্প সবই তো জানার জন্য ছিপ ফেলে বসে থাকা, কখন বরশিতে মাছ গেঁথে তুলবে, সেই ধান্দায় না থাকে। ভুলু তখন তড়িঘড়ি করে রীক্সার প্যাডেল ঘোরায়, সে কি আর ঘোরে, কে যেন ঘুরিয়ে দেয়। আরে পড়বি তো পড়, ধড়াস করে পথভোলার ঘাড়ে, পথ চেনে না, ঘাট চেনে না, গন্তব্যে যাওয়ার টান।

কত আর বয়েস। এই বয়সে জোশ থাকবে না সেও কি হয়, তাতে যত বিপত্তি। নিশ্চুপ নিঝুম নিরালায় বসে ওরা দিন গোনে। শেষের কি আবার অন্ত হয়! ভুলু আঙ্গুল পাকিয়ে পাকিয়ে স্পঞ্জ কারখানার কোল ঘেঁষে চলে যাওয়া সরু রাস্তার পাশে ভাঙাচোরা টিনের ঘরটার দিকে তাকিয়ে কী যেন বলতে চায়। ডানা ঝাপটে চন্দনা পাখিগুলো দলবেঁধে কিচিরমিচির করে, খুঁটে খুঁটে পিচের আস্তরন ছাড়িয়ে এগিয়েই অল্পস্বল্প মাটির ঢেলাগুলো আছাড়ি পিছাড়ি খুঁজে বেড়ায়, যদি কিছু মিলে যায় খুদকুঁড়ো। ভুলু গেঞ্জিটা উপরে তুলে পেটের ভাঁজে ভাঁজে হাত বুলায়। বাপ খেদানো, মায়ের দুচ্ছার করা জীবনটা ওকে এর চেয়ে ভাববার বেশি সুযোগই দেয় না। না হলে ঘর ছেড়েছে এক গেলাস জল খেয়ে, সারাদিনটা কেউ জিজ্ঞেসও করেনি বগার ছেলের পেটে দানাপানি পড়ল কি পড়ল না। রীক্সাটা নিয়ে এক পাক মেরে তাসের আড্ডায় এসে জমে গেল, জমবে না আবার! বগা জুয়ার আড্ডায় গিয়েই তো দিনরাতে সর্বসান্ত। পা দুটো টলমল করবেই তো গলা সমান মদ গিললে। ওর বউ কেতু গালাগাল দিয়ে ঝাঁটা পিটা করবে না সে আবার হয় নাকি। লুঙ্গি উঁচিয়ে ল্যাংটা হয়ে পড়ি কি মড়ি করে পালাবার আগে কেতুকে লাথি কিল চড় ঘুষি মেরে নাস্তানাবুদ তো করবেই। কেতু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলে মাটিতে ধড়ফড়ালে ভুলু এসে বলবে, ‘ কিচ্ছু ভাবিসনি মা তুই, ওই শালার বাপের মাজা না ভাঙতে পেরেছি তো, আমিও বগার বেটা নয়।’ মাজা ভাঙলে কেতুরই কপাল পুড়বে, সে কথাটা ওর চেয়ে ভালো আর কে বোঝে। মায়ে পোয়ে দরজার হাতল ছাড়াবার লড়াই চলে যতক্ষণ ওদের কথা কাটাকাটিই না থামে। ‘তবে মর বগার বউ, মারের ঘায়ে বেন্দাবন দেখ, এই বগার বেটা ভুলুকে ডাকবিনি।’ পেটটা ভুলুর আজ বড্ড কামড়াচ্ছে, শ্বাসের কষ্ট, বুকের ব্যথাটা থেকে থেকে চাগাড় দেয়। ডাক্তার তো বলেই দিয়েছে, ‘ওই বাংলা খাওয়া তোকে ছাড়তে হবে ভুলু, বাপ কত ভালোবেসে এই অভ্যাসটি তোকে দান করেছে, ধন্য তুই বাপের বেটা, কে আর তোকে বাঁচাবে বল।’ বিলু হাত দুটো আশীর্বাদী ভঙ্গিতে ‘তথাস্তু’ বলে বলেই চলে, ‘ খেয়ে যা বাপ, কিচ্ছু ভাবিস নি।’ ‘প্যাডেল ঘোরাতে গেলেই বুকে হাপরের শব্দ শোনে।’ ভুলু ঘোরাতেই থাকে, চেইন পড়ে গেলে আবার তুলে দেয়। ব্যথাটা বাড়তেই থাকে।  যাত্রীরা যদি ভুল করে এমন প্রশ্ন করেই ফেলে ‘ধরে চালা ভাই।’ ও নিজের অক্ষমতাকে ঢাকার জন্য বলে ওঠে, ‘এ তো কিছুই নয়, সবে তো শুরু আরো তো খেলা বাকি। ভলুকে দেখেছেন, ভুলুর বাপ বগাকে তো দেখেননি, এক ছিলিমেই রাজা।’ বিলু চমকায় না, ও জানে না এমন কথা আছে নাকি। ‘রাজার বেটা বড়লাট হওয়ার সখ হয়েছে, তাই তো এত গপ্প দিচ্ছিস। জমিদারিটা দেখাবি একবার।  বড্ড শখ জেগেছে রে বাপ।’ পেটে যে দু’কাপ চা আর জল ছাড়া কাল থেকে পেটে একটা দানা পড়েনি, সেই লজ্জাটুকু তো এখনও ঝেড়ে ফেলতে পারে নি। এই ব্যামোতে শুয়ে বসে থাকতেই তো বলেছে ডাক্তারবাবু, তের-চৌদ্দ বছরের ছেলেকে কি মানায় গোটা সংসারটার জোয়াল কাঁধে তুলে নেবে।

‘এই তো বাবু রিক্সা পট্টি। এই কথা কি সকলের মুখে সাজে! ওই বগার ছেলে ভুলু, একটা পাজির পা ঝাড়া,নচ্ছার, যেই না বড়াই করার সুযোগ পেল, জমা যা ছিল উগড়ে দিল।’ বিলু ভাবল স্বপ্ন তো ও দেখায়, খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে কোথায় আছে স্বপ্নের খনি। কী বলে যে লাল ফুল সাদা করে দেবে, ওটা তো ভেলকিবাজদের কাজ। কোন কথার জাদুতে যে ওদের বুঁদ করে রাখবে। এরা তো মেঘের কোলে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। নিজের ঘরে কত যে ঘর বানায়। সংসারের বাঁধাধরা নিয়মগুলো অনায়াসে নিজের মতো করে পাল্টে দেয় হিসেবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। জগা যখন গজিয়ে ওঠা শিবমন্দিরের লম্বা টেবিলটায় পা ছড়িয়ে বসেছিল, বুঝতে অসুবিধা হয় না বোধ হয় একটু পরেই আরও দু’তিনজকে নিয়েই দলবেঁধে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দূরেই যে কর্পোরেশনের ভ্যাটটা পাতা রয়েছে ওরা সেইদিগেই ছুটবে, রিসাইকেল হওয়ার মেশিন বসেছে ঘটা করে, কাছে কিনারেই সুলভ শৌচালয়। দুটো কাজই একসঙ্গে সারবে কিনা। সাউণ্ড বক্সটা গাঁক গাঁক করে ডেকে উঠল হঠাৎই। ‘মিউজিক প্লিজ’। শব্দগুলো মুখস্তই আওড়াল। জগার বউ মালতি একটু আগেই কেতুকে দু’চারটে সান্ত্বনা বাক্য শুনিয়ে বিলুর দলটাকে দেখবে বলে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়েছিল। সাধে তো আর চুপ মারেনি। ‘মাগী তোর খালি রসের নাগর দেখলেই চুকচুক করা।’ ‘বলছে বলুক এমন সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়!’ ছেলে ছোকরা ছুকরি কেউ যে আর বাকি নেই। জগা বলেই তো গেল ‘অকম্মার ঢেঁকি’। জগা, নন্তু, রতনরা কোমর দোলানিতে চোস্ত। সাহেববাবুরা তো চাইছে ওরা আরো নাচুক, কেত্তনের সঙ্গে পপ মিশিয়ে গজকচ্ছপ না হলে ভুলিয়ে দেবে কী করে।  মালতির খিলখিলিয়ে সে কী হাসি। বিলুর গাঁজাখুরি গল্প তো নতুন এক জগৎ। ওই যে বেঁটে লোকটা লম্বাই তো ছিল, ও ঢেঙা ছিল বলেই না সখ জেগেছিল নাটা হলে কেমন লাগে। কত লোকই তো স্বপ্ন দেখে লাফাতেই থাকে। ওই দেখাতেই কত আনন্দ। ‘লোকটা বলে কীরে! এমনটা কখনও হয়!’ ওরা চোখ বুজে স্বপ্নের নদীতে নাও ভাসিয়ে দেয়। ভাসতে ভাসতে বহুদূর চলে যায়, আর যে কিছুতেই ফিরে আসতে পারে না। ‘ ‘আজ আর ঝাড়ু দেব না। স্বপন দেখব। এই তোরা সত্যি সত্যি স্বপন দেখেছিস। ওই দেখলি ওরা দাঁত কেলাচ্ছে।’ ‘কথার তোমার কী অমন ছিরি, দাঁত ক্যালাব না! বিশ্বাস না কর তো যাও যমের দূয়ারে।’ কোথায় যেন ওদের ধাক্বা লাগে। ‘ নিকুজি করেছে তোদের ‘মিউজিক প্লিজ’। ওরা চোখ বোজে। বউদের একপাশে সরিয়ে দেয়। ‘সে কী!’ কত তো রাস্তা। রাস্তার পর রাস্তা। এক এক করে খুলে যাচ্ছে। থামাথামির লেশমাত্র নেই। ওরা ঠিক করে অনেকটা পথ পার হয়ে যাবে। বিলু বুঝতে পারে সবকিছু ঠিকপথেই এগোচ্ছে। অস্থিরতা ঘোরাফেরা করে। কত মানুষের চেল্লামেল্লি বড় বেশি অখুশি করে দেয়। ওরা যাবে তো যাবে, কোন পথে যাবে? স্বপ্নের সঙ্গে ঝাড়ুকে মেলাতে ইতস্তত করে না। ঝাড়ুদার হয়ে খোলা রাস্তাটাকে সম্বল করে নেয়। এমনটা তো হওয়া যায়। রাস্তার ধারে ভ্যাটটা কোথায় গেল উধাও হয়ে। বুড়ি বউ ছেলেমেয়েরা যারা জড় হওয়া জঞ্জালে বাঁচার রসদ খুঁজে বেড়ায় ওরা হাউ হাউ করে। ওরাও কি এমনি করে বিলুর স্বপ্নটায় এতক্ষণে ধাতস্থ হয়ে গেছে। জগা নন্তু রত্না যারা কোলাকুলিতে জড়াজড়ি করা ভুলতে বসেছিল, মুখেই কথার তুফান ছুটিয়ে জেতা হারার অঙ্ক কষত, রাস্তাগুলো খোলা বন্ধের খেলায় শব্দগুলো পাল্টাতে থাকে। তাহলে স্বপ্নেরও এক আগুন আছে, এত উঁচুতেই তার অবস্থান হাইড্রলিক ল্যাডার লাগিয়ে জল ছিটানোর তীব্রতায় সেই স্বপ্নের আগুন নেভাতে গেলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। এত দূরে চলে যায় স্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন নিরূপণ করা যায় না। বিলুর স্বপ্নের তরঙ্গ তাই তো আগুন হয়ে যায়। জগা ছুটে বেড়াচ্ছে, চেনা রাস্তাটা অচেনা হয়ে যাচ্ছে। অন্তু যে পথের ঠিকানায় বিচরণ করে, সে পথে ছিল তো কত কাঁকর, আজ এত মসৃন লাগছে কেন? এর রাস্তা ওর রাস্তার ঘাড়ে চেপে বসছে। একেই কী বলে স্বপ্নের মিথ্যা, না মিথ্যার স্বপ্ন। বিলু কি তাহলে স্বপ্নের ছাদনাতলায় এই বন্ধনটাকে শক্তপোক্ত করতে চায়। ভ্যাটটা আবার নিজের জায়গা দখল করে নেয়। যে মুখগুলো দুর্গন্ধের আস্তাকুঁড়ে গুনগুন করত, ফিরে এসেছে এক এক করে। স্বপ্নের ঘোরে কি ওরা পথ হারিয়েছিল? তাই কেমন করে হয়! বিলুর গড়া পৃথিবীটায় জন্ম নেওয়া মানুষগুলো তো মিত্ররা হতে পারে না! তাহলে কী কোন বড় ঝড় আসতে চলেছে! ছিয়াত্তরের মন্বন্তর কী বামন হয়ে যাবে, তেতাল্লিশ তাকে ঝামটা মেরে ফেলে দেবে। ভ্যাটের বৃত্তকে ঘিরে এক অসামান্য পৃথিবীর জন্ম হবে, আরও ভয়ঙ্কর, আরও নিরবিচ্ছন্ন। বিলু  কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে?

বিলু হঠাৎই এক আধা উলঙ্গ শিশুর দলকে দেখে ফেলেছিল। ওরা কি উলঙ্গ হয়েছে, নাকি কেউ উলঙ্গ বানিয়ে দিয়েছে কোন পোটোপাড়ার কুমোর এসে ওদের সাজপোশাকে মুড়িয়ে দেবে বলে। ওরা কুড়িয়ে পাওয়া টেনিস বলটা নিয়ে লোফালুফি খেলেই ইচ্ছেমত পা-টাকে বাড়িয়ে দেয়। কোন পথচারীর পায়ে লেগেছে কি লাগে নি ফোঁস করে ওঠে – ‘ বেজন্মা উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেগুলোর আর থাকার জায়গা পায় নি। এই শহরে এসে আস্তানা গেড়েছে।’ কথার ঝালটা গায়ে মাখে নি। রাস্তার পর রাস্তা লাফিয়ে লাফিয়ে চলেই তো ওরা উত্তর থেকে দক্ষিণে এসেছে। আপন পর ওরা বোঝে না, বিলুর ওই ছু মন্তর ছু ভাবখানা দেখে বলটা নাচাতে নাচাতেই দাঁড়িয়ে পড়ে। ‘ ওটা বল কোথায় দেখলি, সোনার ঢেলা।’ কথাটা প্রথমে কানে গেলেও ওরা খেলার ছলে এমনই মত্ত ছিল শব্দের মায়ায় ওদের ছুঁয়ে ফেলতে পারে নি। হঠাৎই সোনা শব্দটা ওদের হতচকিত করে দেয়। বিলু কথাটা বার বার উচ্চারণ করলে এবার আরও মনোযোগী হয়ে পড়ে। বলটাকে ওরা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে, সন্দেহের বশে আবারও এর ওর হাত ঘুরে ওদের দলের দাদা গোছের ছেলেটার হাতে এসে পড়ে। ওরা জানে না সোনা কাকে বলে, সোনাকে কীভাবে আগলে রাখতে হয়, ওটা আসলে কোন কাজে লাগে? নাদান ছেলেরা আগের মতোই লাফাতে শুরু করে। বুকে পিঠে ধুলোবালি মিশে চামটি ধরলেও ওদের ভ্রূক্ষেপ নেই। ওদের পাশ কাটিয়ে স্কুল ভ্যানটা চার পাঁচটা ওদেরই সমবয়সী বাচ্চাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলেও বাধা পায়, সামনেই দুটো অটো, দুটো মিনি বাস, তারও সামনে দুটো পাবলিক বাস আর একটা ভলভো বাস ক্রসিং-এ পথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়ে। স্কুল বাচ্চারা ভ্যানগাড়ি থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে গলা বাড়িয়ে দেখতে গেলে ড্রাইভার এসে চড় কসায়। ‘কতবার বারণ করেছি ওদিকে তাকাবে না। গলাটা ক্যাঁচ করে কেটে গেলে তোদের মা-বাবা আমাকে  আস্ত তো রাখবেই না, জেলের ঘানি টানাবে।’ ছেলেগুলো ওদের কাণ্ড দেখে অবাকই হয়ে গেল। ওদের ভয় মাখানো চেহারা আর কথাবার্তার মাথামুন্ডু না বুঝতে পেরে অবাকই হলো। সিগন্যাল পার করে চলে গেলে ওরা আবারও বল নিয়ে লোফালুফি খেলতে গিয়ে বিলুর কঠিন শব্দটা বেমালুম ভুলে যায়। বিলুর দলটিকে ওরা আরও অনেকটা পথ অনুসরণ করল। একজন শুধু না বুঝেই জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কী বলছিলে!’ ফুটপাতের মেয়েটার গলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওই ঐটা’। ওরা এবার মেয়েটার পেছন পেছন ছুটল। ‘এই তোরা কী চাস?’ ‘ওটা।’ মেয়েটা ভয় পেয়ে চোর চোর করে চেঁচাতে ওরাও ছুট লাগাল। চোর শব্দটার সঙ্গে ওরা বিশেষভাবে পরিচিত কিনা। ওদের সুযোগ বুঝে বাবুলোকরা এই নামে ডাকতে পছন্দ করে। কত কিছু ভেবে দু’এক ঘা দিতেও ছাড়ে না। ‘দুটো পয়সা দেবে বাপ’ এই বলে কেউ কেউ ক্ষিদের জ্বালায় ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় , সেটাও তো সত্যি। তাই বদনামটা ওদের বয়েই বেড়াতে হয় – জাত-কাকের ছাঁ, বাসায় করে রা। কিছু অতি উৎসাহী লোক ওদের চোর চোর করে তাড়িয়ে মারল। হোঁচট তো খেল, চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেল, রামধোলাই খেল, অপরাধের বহর না জেনেই। বিলুর হেঁয়ালির যে এভাবে খেসারত দিতে হবে কে জানত। মার খেয়ে দু’একটা কটু কথা উচ্চারণ করল বটে, ধুলো ঝেড়ে উঠেও দাঁড়াল, রাস্তার ছেলেকে এত সহজে কাবু করা যায়! ঝড় তুফান হজম করে, ধুলোর পাহাড়ে ভরা কাঁথা মুড়িয়ে রাতের অন্ধকারে কাঠের পাটাতনে শুয়ে যারা প্রহর গোনে তাদের ঘিরে সব দিনের আলোরা  এইভাবেই চোখ বুজে থাকে। চোখের আলো নিভিয়ে দিয়ে খেলাটা চালিয়েই যায়, হতে পারে টেনিস বলটা সজ্ঞানেই আগুনের গোলা হয়ে যায় কিংবা বিলুর কল্পিত সোনার বল, কিইবা যায় আসে তাতে। ল্যাংটা ছেলে চোর হল, চোর হল ল্যাংটা, সোনা চেনা কি এতই সোজা!

বিলু এখন একলা হতে চায়। যারা এতক্ষণ ওর পিছু নিয়েছিল, নিজের অজান্তেই ‘হুশ’ কথাটা বাতাসে উড়িয়ে দিল। নিজের দেখাটা কাছেপিঠে পেলে ও যে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় কেমন করে বোঝাবে। যা নেই বলে অনেকে উল্লাসে মেতে উঠেছে, কেবলই আমার, কেবলই আমার বলে অধিকার ফলাতে চাইছে, তা যে আদপেই মিথ্যার ফুলঝুরি ছাড়া কিছুই নয়। সময় তো নেবে, যত সময় গুনবে, স্পষ্ট হয়ে ধরা দিতে ওরা এগোতে থাকবে। অনেক দূরের পথ, সামনে থকথকে কাদা, কোথাও কোমর অবধি জল। শ্বাপদের উৎপাত কম হবে, কেমন করে ভাবা যায়, সব কাজ যে চুপি চুপি সেরে ফেলে। এমনও দিন যায় ও মুখ দেখা ছাড়া ওরা জলগ্ৰহণ করে না। দিনদুপুরে পুকুরে ডুব দেবার সখ, নিদেনপক্ষে ডোবার বদ্ধ জল, দিঘির কথা না হয় নাই ভাবল। শান বাঁধানো সিঁড়ি হলে শ্যাওলায় পা পিছলে যাওয়ার ভয়, না হয় চার ঘাটের জল খেয়ে আইঢাই আইঢাই। বিলুর আবার কত দিকেই না নজর। বাঁচলে ভালো, মরে গেলে তো ল্যাঠা চুকে গেল, উদ্ভট জীবনের গোঙানি তো কত রকমেই না জানান দেয়। চাকাটা ঘুরছে, বড় জোরে ঘুরছে, রোজই তো ঘুরতে থাকে, পা দুটো সমানতালে না চাপলে চাকাটাইবা ঘুরবে কেমন করে। সারাদিনই চলে এমনি করে। কে দেবে একটুকু বিশ্রাম। শুধু কি এই চাকা, আর কত চাকা যে ঘুরছে সকাল সন্ধ্যা ইরফানের জানার তো কথা নয়, শুনতে পায় প্রচার গাড়ি থেকে ধামাকা সেলের ঘোষণা, বলেই চলে চালু রেকর্ডার থেকে, থামাথামি তো নেই। চার চারটি ব্যাগ জমা পড়েছে। চেইন তো কেটেই গেছে, রানারও খারাপ, চেইনের দাঁতগুলো অয়েল দিয়ে দুদিকে ভাবল সেলাই মেরে দেওয়া, লক পাল্টানো, চাকা পাল্টানো, হাতল মেরামত করা, রিফু করা, আরও কত রকমের কাজ। সামান্য এদিক ওদিক হলে কাস্টমারদের গায়ে জ্বালা ধরানো  দাঁত খিঁচুনি। সামনের পার্কে রাইডে চড়াবে ছাওয়ালদের, ভাবাই সার, বরঞ্চ দুটো পয়সা বাড়তি রোজগার হলে দু’বেলা দু’মুঠো জুটবে। আজ কাজ আছে, কাল যে কাজ জুটবে, তার কি কোন গ্যারান্টি আছে? বিলুর সাঙ্গোপাঙ্গরা অর্থাৎ যারা সারাক্ষণই বিলুর কথার জাদুতে মুগ্ধ হয়ে এপাশ ওপাশ ঘুরে বেড়ায় তারা গলির মোড়ে থেকে ডান দিকে ঘুরে যায়। ইরফানের কানে ওদের গল্পগাছার সংবাদ যে পৌঁছয়নি এমনটা নয়। বিলুর এই আসা যাওয়ার পথনির্দেশে যে কাঁকের ডানা মেলানোর এক জাদুকরি সম্পর্ক রয়েছে সেই গল্পও এমন ছড়িয়েছে শহর জুড়ে, বলাবলি শুরু হয়েছে ওদের জন্ম জন্মান্তরের গল্প নিয়ে। কেন কে বা কারা এর উৎস তা জানার আগ্রহ লোকে হারিয়েছে, কেবলমাত্র ওদের উপস্থিতি দিয়ে ঘটনার সত্যাসত্য বিচার করে, সমস্যা সমাধানের বাছবিচার হয়। বিলু যে এই মুহূর্তে ইরফানের মনোযোগ দাবি করছে, ইরফান হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। বিলু যে ওর ঘূর্ণিত চাকাকে দেখবে বলে ঘুরে দাঁড়াবে এটাও তো স্বপ্নাতীত, চোখ ফেরায় না যে। কথাটা যে এমন করে জুড়ে দেবে, সেটাও কি জানত। বলার ভঙ্গিটা একরকম ঘাড় ঘুরিয়ে, মাথা ঝুঁকিয়ে, বলার কথাটা সাবলীল। ‘চাকা উল্টো দিকে ঘুরে যাবে।’ ইরফান কান পেতে শুনবে কি? দমকা হাওয়াটা এল, মর্মর করে পাশের আড়াইশ বছরের পুরনো বাড়িটার ছাদটা খসে পড়ল, আওয়াজের তীব্রতায় শুষে নিল সব কোলাহল। খণ্ডহারে স্মৃতি গেল, বিস্মৃতি এল। বিলুর অদেখা জগৎ ওলটপালট হল। ঝাঁপ বন্ধ করবে কি, এখনো যে অনেক কাজই বাকি রয়ে গেল, কি জানি কখন শেষ হবে, সময়ের কী মাপজোক আছে!

বিলুর আরও একবার অন্তর্দর্শন হল। গাছে গাছে মিতালি হলো। ফলে ফলে হল চুমোচুমি। চেনার ঐশ্বর্যে আরও কত অচেনার দীনতা। টুকরো টুকরো সিমেন্ট বালি তুলে গা ঘষে নেয়। কত তো আঁকিবুঁকি দেয়ালে দেয়ালে ভিজে যাচ্ছে, ওরা থাকে আপনমনে। কার ছোঁয়া মেখে নিজের অস্তিত্বে আজও থাকে ভাসমান। মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায়, হাঁটুজলে বেগবান এই স্রোত। গর্ভে নাচে কত পুতলা পুতলি। বিলুর তো ইচ্ছে করে কোন এক জাদুদণ্ড হাতে পাক, ছাল ওঠা, আঁচড় কাটা দেয়ালগুলো উঠে আসুক মনের পাতায়। ওই তো এক চিলেকোঠা ঝুলে আছে কোন এক কড়িবরগায় ভর করে। ছায়াময় আলুথালু এক কিশোরীর আয়ত চোখ দুটো। স্বপ্নের রঙিন পাখায় এ কোন মোহিনী মায়ায় ঘিরে আছে নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে। কল্পনার জ্বাল বুনতে বুনতেই সিঁড়ি ভাঙছে। অহিংস ঘ্রাণে হিংসার উলুক ঝুলক। বিলু থলে ঝুলিয়ে চেয়ে আছে গল্পের ছানাগুলো ডানা মেলে কখন এসে গলা জড়িয়ে ধরবে। মেয়েটির কলমটা তো বুলিয়েই চলেছে কাগজের পাতায় পাতায়। সময়রা মরে গিয়ে জন্ম নিয়েছে নিজের মতো করে। দোষের কি আছে? নিয়মের আঙিনায় দিনগুলো এমনি করে ফুরিয়ে যায়। আর এক জগৎ দেখবে বলে ছটফট করে। বিলুর কল্পনাগুলো উড়ে এসে জুড়ে বসে। ওরা বলে, ‘বাপু হে, পালাও পালাও।’  কোন এক পড়ন্ত বিকেলে ওরা কথা বলে উঠবে। মচমচ করা ভাঙা ইটের টুকরোগুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হলে বেঁকে যাবে ওর শরীর। ঝুলিটাও ভর্তি হয়ে  পড়তে পড়তেই বলবে, ‘বিলু আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন, আমরা আবার আমাদের উৎসে ফিরে যাচ্ছি। বিলুর গল্পগাছার হাত পা নড়েচড়ে ওঠে। অভিনন্দনের আকাঙ্ক্ষায় ওরা কুলোয় করে ধান দূর্বা সিঁদুর মিষ্টি নিয়ে দূয়ারে হাজির হয় মিষ্টি মুখখানি দেখবে বলে। ঘোমটা টেনে দেখে, ‘আহা, ভারি সুন্দর মুখখানা।’ বিলু ভাবে এ না হলে গল্পের মুখখানি! আরো কিছু কি চাই? কত গয়নাগাটি সাজগোজ করার উপকরণ ছড়িয়ে তো রয়েছে, সাজিয়ে গুছিয়ে নিলেই তো হয়। রূপবতী না হলে পাড়া পড়শী বলবে কী! ওরা যা বলছে বলুক, ঘরদোর ওতো পয় পরিষ্কার করা জানা চাই। না হলে অতিথিরা ঘরবাড়ি দেখে বলেই তো বসবে ‘দেখতে মন্দ নয় বটে, কাজে তো অষ্টরম্ভা।’ ছি ছি তখন মুখ দেখাবে কেমন করে? সেই উত্তরই তো খুঁজে বেড়ায়। এটা ঠিকই সুন্দরের সংজ্ঞাটা দেশকালে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। যেই ভাবা, সেই কাজ। ওর ঘরে যেই ধন আছে তাতেই তো মাতব্বরি করতে হবে, না হলে চলবে কেন! বিলু ভাঙাচোরা যাই পেল, তাই কুড়োতে শুরু করল, কত বছরের ধন, পড়ে পড়ে কি মারটাই না খাচ্ছিল। রং চং তো সব ধ্বসে গেছে। কোথাকার জিনিস কোথায় গড়ায়। বিলু একটু হড়বড়ই করে ফেলে। যতটুকু পারল তো নিল, বাকিটা শাগরেদদের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘ হারাস না কিন্তু, আজ না হয় কাজে লাগবে।’ তাতেও কী শেষরক্ষা হল! মনের মতো গড়ে নিতে আরো তো চাই। এই ঘর থেকে ওঘরে গিয়ে শুনতে পেল কত কথার ফিসফিসানি, শোনাতে চেয়ে হায় হুতাশ করছে, বিলুকে দেখে আনন্দে আত্মহারা। সময়ও কখনও কেঁদে ফেলে। নিজেকে চিনে নিতে চায় আলোর বিন্দুগুলোকে চুরি করে, আঁধারের মোড়কে বন্দী হয়ে। অন্যের উপর নিজের দায়ভার চাপিয়ে নিশ্চিত হতে চায়। বিলু ইটের টুকরোগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। ফেলে আসা ইচ্ছেগুলোকে কোলে তুলে নেয়, আদর করে, চোখের জলের হিসেব কষে। অস্তিত্বের বিপন্নতাকে নিয়ে সময়ের আত্মায় ঘর করছিল যারা তাঁদের মুখগুলোকে চিনতে চায়। ইচ্ছে হলে ইরফান,বগা,ভুলু, পদ্মপলাশ ও জঙ্গলদেরও জুড়ে দেয়। এই লম্বা হয়ে যাওয়ার ইতিহাস কী কোনদিন ধরা দেবে? পন্থাটা খুঁজতে ওকে হবেই, না হয় ওরা জানবে কেমন করে চাকাটা আসলে কোনদিকে ঘুরছে। বাতাসের কাঁপুনিটা আবারও শুরু হয়, আরও দ্বিগুন জোরে। যা যা বাকি ছিল, খসে পড়তেই লাগল, কোনটা ছেড়ে কোনটা নেবে, এই ভেবেই তো বিলু অস্থির। ইরফানের সেলাইয়ের মেশিনের চাকাটা ঘুরেই চলেছে বিলুর দেখার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। ইতিহাসের ভগ্নদশা ওকে আক্রান্ত করেছে, নিশ্চুপ করিয়ে দিয়েছে, বিলুকে চেনাতে মোটেই দেরি করে নি। কাঁকটা বিলুর হতভম্ব দশায় অস্থির হয়ে এই নির্মম ঘোরালো বাতাসেও জানতে চায় – এই পৃথিবীর জন্ম হওয়ার খুব কি দরকার ছিল? জন্ম যদিবা হল, অন্ত হওয়ার এত তাগিদ কেন! এমন হলে এই মানুষগুলোর কী দশা হবে! উত্তরটা ও নতুন কোন হিসেবেই চায়। ‘সক্বলে ফেইল মেরেছে যে।’

পঞ্চম অধ্যায় 

মেদিনীকে চঞ্চল দেখেছে কী! এমন একটা জীবনের আঁতিপাতি খুঁজে বেড়ানো চক্ষুলোভ না গোপন আকাঙ্খায় মশগুল থাকা কেউ কি জানে? সে নিজেও কি জানে? গুটিয়ে রেখেছিল নিজের মতো করে। সে তো দেখতে পায়নি মেঘেদের আনাগোনা, শুনতে পায় নি তো নীল আকাশের ডাক। সে খালি দিনরাত কাঁদে,  বুকের কোনে ওর আগুন জ্বলে। ওর কাচ্চাবাচ্চারা এখনও ঘরে ফেরে নি। কনে সাজায় বটে, নিজে কি আর তেমন করে সাজে। সময়ের ঝঞ্জাটে নিজের কথা নিজেই শোনে সাত সতেরো কথা। কে আর কার কথা শোনে। এর মুখের কথা ও কাড়ে, ওর মুখের কথা ও কাড়ে, এর শিকড়ের জ্বালা ও বোঝে না, ওর শিকড়ের জ্বালা ও বোঝে না। জ্বালা কি আর কম, জুড়ায় না যে সহজে। এর ঘরে  উলুধ্বনি দেয় তো, ওর ঘরে ঘন্টা বাজে, তার ঘরে কাঁসর বাজে।  ঘরে ঠাকুর শয়ান দেয় তো, মেঝেতে শ্বশুর শাশুড়ির মাঝে পর্দার আড়ালে সঙ্গম করে। জমিন আর ফসলের জন্ম দেয়। বর বর বর্বর তুবড়ি বানাতে গিয়ে সেই যে ক্লাবঘরে প্রাণ গেল, কত লোক তো উঁকিঝুঁকি দিয়েছিল দর্মার ঘরের ফাঁকফোকরে। পড়তি যৌবন ও মেদিনী যে কাটাল, কম খেসারত তো দিতে হয়নি। শেষে মালতির বুদ্ধিটা কাজে লাগিয়ে দুবেলা দুমুঠো ভাত জুটল। কালসিটে দাগ পড়েছে ওদের কনুইয়ে, হাঁটুর গোড়ায় সদ্য বোলতা কামড়িয়ে ফিরে গেছে নিজের ঘরে, ওরা তো ঘরে ফেরে নি। কত তো ছড়া কাটে –  তুলসি তুলসী তুলসী, ও তুলসী/তুলসী তলায় ঘর/তুলসী তুলি কৃষ্ণ বরাবর।  না, একটুও উঠোনের মাটিও তো নেই, কখন কাঁদবে পা ছড়িয়ে। করাত কলে খ্যাঁচ খ্যাঁচ শব্দ করে চিরে চিরে একসার হয়ে গেল। এল আর গেল এপাশ ওপাশ। কেউ বলে ওরা জ্যান্ত নেই, মুখ গুঁজে ধাঁতানি সইতে সইতে দেখে সব গুঁড়িগুলো টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কাটা আঙুলটা নিয়ে ফসল কান্নাটা চড়াতেই থাকে। চারপাশের বাতাসকে ভারী করে দেয়। পথচারীরা উঁকি দিয়ে যায়। মেদিনী নিজের মতো করে চড়া সুরে উৎকন্ঠায় বলে দিল ‘আমি আর পারছিনা। আমি যদি কোনভাবে আমার মৃত্যুর দিনটা জেনে নিতে পারতাম!’ মেদিনীর সবকিছু কেমন ওলটপালট হয়ে যেতে পারত। হারিয়ে ফেলাটা জীবন থেকে নতুন কথা নয়। মরা মানুষের মুখ দেখেনি তাও তো নয়। মর্গে শরীরের জ্যান্ত হওয়ার আশায় দিনরাত অপেক্ষার দিনগুলো ভয়ঙ্কর, ধুকধুক করেনি এমন তো নয়। ফসল ঘরে ফিরবে, জমিন ওকে পথ দেখাবে। দেখাবে তো বটেই। রক্তাক্ত আঙুলের যন্ত্রণা ফসল হজম করছে, জমিনকেও চালান করছে নীরবে নিভৃতে। এগিয়ে এলো কেউ কেউ। জড়িয়ে ধরে আহা উঁহু কত কী শব্দ করল, উচ্চারণে কত কি ছিল, আসল কথা ছিল না। যে চারাগাছটার পাতাগুলো ধূলোর ভারে নুইয়ে পড়েছে, ওরা আরও ঢলে পড়ল, এমনটা হয় কিনা কেউ দেখে না, রোজ হয়ে চলেছে তো একটু একটু করে। ফসলের কাটা আঙুলটা জমিন ছুঁয়ে থাকল আরো কিছুক্ষণ। উল্টোদিকে একটা গলি ছিল, জন্তু তো থাকে না, মানুষ থাকে। গজ আনলো, ব্যান্ডেজ করল, আঙুলটা যেমন ছিল, তেমনি পড়ে রইল। করাত কলটা সামনে পেছনে চলতেই থাকল। করাতের রঙটা কালো কেন বলা, কালচে হলে মন্দ হয় না শুনতে, রক্তের দাগটা শুকনো, ঘা হয়ে চোখটা বড় বড় করে আছে। ওরা লরিতে বোঝাই করবে বলে বলেই বেড়াচ্ছে ‘তড়িঘড়ি কর বাবা, আগাম বরাত দিয়েছে,না হয় মাথা কাটা যাবে।’ মুখে চওড়া হাসি, এতগুলো টাকা, গুনে গুনে দেখে। গজের টুকরোটা লোকটার দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে। কত মানুষ যায় আর আসে, ওরাও দেখে এক কোনে বসে বুড়িটা কাঁদছে। কেন যে কাঁদছে? এই কান্না কি ক্ষিধের ? ব্যথা থেকেও তো কান্নার জন্ম হয়। জীবনের কাছ থেকে কিছু না পাওয়ারও তো কান্না হয়।  জীবনকে কিছু না ফিরিয়ে দেওয়ার রোদন কিনা কে জানে। বঞ্চনা আর বঞ্চিতের কোলাহলে জন্মে গেছে কোথায় যেন, নাড়ি কেটেছিল কোন বাঁশের ছিলায়, সেও তো হুড়মুড় করা শব্দের গুঞ্জন, উচ্ছন্নে গিয়েছিল সময়ে অসময়ে। করাতের চলাচল কি আর থামে। ফসলের যন্ত্রণার শব্দগুলো ভেঙেচুরে যায়। জমিন ভাইয়ের আঙুলটা নিজের শরীরে জড়িয়ে নেয়। কাঠের বদলে শুইয়ে দেয় লাশ যেমন অচৈতন্য হয়ে থাকে। দেয়ালে দেয়ালে কথার জঞ্জাল থাবা বসায়। বাসি বাসি গন্ধ। মলমূত্র যোগ হয়ে মশামাছিগুলো বনবন শব্দে ওড়ে। জমিন পথের নিশানা মেপেই চলে। মোড়টা এমন বিদঘুটে ভাবে চলে একটুখানি জায়গা ছাড়ল তো মহাভারত অশুদ্ধ হবে, রক্তারক্তি কিলঘুষিতে ভাঙা পিচের টুকরোয় দাপাদাপি শুরু হয়। ‘আঙুলকাটা বাচ্চা ছেলেটার জন্য মায়া হয় না বুঝি।’ ‘ দরদ উথলে উঠছে বুঝি, আগে ছোট হাতি যাবে, পরে যাবে ওই ভ্যান। মরতে গেছিল কেন করাত কলে। পেটে দানা পড়েনি তো আর কোন কাজ ছিল না।’ জমিন ফসলকে আগলে রেখে দু’গুদাম ছেড়ে আর একটু পথ এগোয়। ওরা কেউ কেউ পিল পিল করে বের হয়, কালিঝুলি গায়ে গায়ে মাখা। একটা ঠোঙা থেকেই দু’চারটে করে পাখির খানার মতো টপাটপ মুখে পোরে। ‘কী সর্বনাশ, বেটা মালিকের চামচা, দুধের ছানাটা মরতে বসেছে, ছোট হাতির গুমোর হয়েছে বেশি।’ গাড়ির চাকাটা ভ্যানগাড়িটা ঘষে দিয়ে চলে যায়। ভ্যানগাড়িটা থেকে থেকে চিঁ চিঁ আওয়াজ আসে, ‘ঘর যাব, দুটি ভাত খাব, বড্ড খিদে পেয়েছে।’ ‘আহারে দুধের ছানাকে কাজে পাঠিয়েছে, একটুখানি মায়া মমতা নেই গো। পাষানি গো পাষানি’ দল থেকে এক মেয়েছেলে বলাকওয়া করে, ‘আরে এটা তো মেদেনীর ছাওয়াল, জম্মাতে দেখেছি। আহা গো! জন্মের মতো আঙুলটা গেল।’ হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ। ওরা নেচে নেচে কোমর দুলিয়ে গান ধরে। ‘পথের ধুলো পথে মরে, যে যাবার যাবে চলে। দোষ‌ আবার দেবে কাদের, ধুলোয় ধুলোয় মরণ মোদের।’

চঞ্চল ভেবে নেয় পথটাকে আগলে রাখবে। ওর বিচরণক্ষেত্র দ্রুত পাল্টে যাবে কোনাকুনি না সোজাসুজি। অধরা দুঃস্বপ্নে আক্রান্ত হবে এমন ইচ্ছে ও পোষণ করে না। মেদেনীর খোঁজ ওর চোখের আড়ালে চলে যায়। প্রথমেই ও চিনে নেয় কোন বিন্দু থেকে কত দ্রুত হাঁটলে ও অনেকটা পথ চিনে ফেলবে। এমন যে মানুষের আনাগোনা ও ফসল আর জমিনের ভ্যানগাড়িটাকে অনুসরণ করে চিনিয়ে দেবে কোন এক চেনা রাস্তা থেকে অন্য আর এক অচেনা অন্দরমহল । চঞ্চল জমিনকে চিনিয়ে দেবে শক্তপোক্ত মনোভূমিকে। শক্তির বহরটা গতিটাকে উল্টোপথে ঘোরাবে। ফসলের পঙ্গুত্ব ওর অন্তরকে নতুন করে প্রশ্ন করে বলবে, ‘ তোমার এই গমন নিজের মতো করে সহজ করে নাও।’ ফসল চমকে উঠে বলতে পারে ‘এটাই কী নতুন এক প্রতিবাদের ভাষা,ঘৃণা নয়, রাঙা চোখের আলো নয়, নিজেকে প্রকাশ করে, সন্ধানের পথটাকে খোলা রেখে দাও।’ চঞ্চল ভারাক্রান্ত হয়ে, কোন পথটা সহজ আর সাবলীল, আক্রান্তই শিক্ষক নাকি প্রদর্শক, যে ও নিজে সেজেগুজে বসে আছে ওর ইচ্ছেটাই জমিন আর ফসলকে বাঁচার আর কোন নতুন রাস্তা খুলে দেবে। রাস্তাটাও তো কম সংগীন নয়, লোকগুলো যারা পলক ফেলছে না ডেকে বলবে, ‘ এটা নয় গো, ভুল, গোটাটাই ভুল, ওই তো নতুন রাস্তা দেখেও দেখে না, নতুন আর এক সূত্রের আলো এসেছে, সেই মায়াবী আলোয় প্রদক্ষিণ করে বেড়াচ্ছে আর এক নতুন পৃথিবী।’ মেদিনী সন্তানকে আগলে রাখতে পারে গোপন গভীরে।  দুনিয়া সেই কথাটা বলবে বলেই আড়ালে আবডালে সাজাচ্ছিল নিজের ঘর দূয়ার। কে এই দুনিয়া? চঞ্চল জানতে চেয়েছিল দুনিয়ার হাল হকিকত। দাঁড়াতে চেয়েছিল সীমানাটা ভেঙেচুরে দিয়ে নতুন সীমানা গড়তে। ভেবেছিল এই প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে চলে যাবে। জনে জনে সংবাদ নিয়ে নিজেকে হাজির করবে আমদরবারে। তাদের উচ্চারণে উঠে এসেছিল বারবার,  ‘ চঞ্চলের আত্মীয়তা পাতানোর নরম আকাঙ্খায় দেখা দিয়েছিল, প্রমাণ করে দিতে চেয়েছিল তা কিন্তু সত্য নয়, যা ভাবনার গণ্ডীতে ফেলে‌ নিজের সৃষ্টি বলে চালান করতে চাইছে তাও কিন্তু সত্য নয়। অংশত সত্য চঞ্চলকে দুনিয়াকে কখনও চেনাবে না। জমিন ফসলকে নিয়ে মাঝপথে আটকে যাবেই। দুনিয়ার কী এমন সাধ্য চঞ্চলকে সঙ্গে করে মেদিনীর সান্নিধ্যে নিয়ে যায়। দুনিয়া নিজেই যে মাঝপথে বারবার হোঁচট খাচ্ছে। মনের আন্দোলনে আন্দোলিত হতে হতে ওর দৃষ্টির মধ্যে প্রবেশ করছে এমন সব অভাবিত অঞ্চল মনে হচ্ছে শূন্যতার মাঝে পূর্ণতার জন্মভূমি। হে জন্মভূমি কোথায় রেখেছো তুমি জমিনকে আর কোথায় বা রেখেছো ফসলের ঝরা ঘামের ক্লান্ত মুখ। আজ আঙুল গেছে, কাল যদি গোটা হাতটাই চলে যায় পরশু যদি হৃদয়টা বন্ধ হয়ে যায়, জমিন কি পারবে ফসলকে আগলে রাখতে বুকের পাঁজরে মিশিয়ে নিতে, হয়তো না। দুনিয়ার চাওয়া-পাওয়ার গোপন কথোপকথন ওদের চলনকে দিতে পারবে তো গতি, সে প্রশ্ন প্রথমে ও নিজের কাছেই রাখে। তাইতো এতটা নীরব নিঝুম নিরালায় নিজের বৃত্তে নিজেই ঘোরাফেরা করে। উদ্দেশ্যবিহীন যাত্রা নয়, কোন এক জীবনের মাত্রাহীন সন্ধান। মেদেনী আকাশ তো ছুঁতে চায়, সঙ্গে নিতে চায় চঞ্চলকে, জুড়বে বলে ইতিউতি মানুষের শয়নকক্ষ, জমিনও আছে, ফসলও আছে, ওরা ইচ্ছে অনিচ্ছের হিসেব কষে না, এই কথা কেউ তো বলে নি, প্রশ্নোত্তরের হিসেব চায়নি, এই কথাই বা কে বলেছে। কাকটা আজও ওর পিছু ছাড়েনি, চোখ দুটো মেলে মেলে এডাল থেকে ওডালে গিয়ে ডালে ডালে মুখ ঘষে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়িয়েছে। শ্বাস আরও শ্বাস, মধ্যিখানে উড়ে গিয়ে তৃষ্ণার্ত কাক দেখেছে জমিন ফসলের আঙুলটায় চুমু খেয়ে টেনে নিয়ে চলেছে ওর গোটা শরীর। কঠিন প্রহরায় চোখ বুলোচ্ছে চঞ্চল, কাকের সঙ্গে আত্মীয়তায় ওর কোন খামতি নেই। কোন ফাঁকে যে মেদিনী উড়ে এসে জুড়ে বসবে কে জানত। আসলে ও যে প্রস্তুতি পর্ব সারবে বলে কত কিছুই না খুঁটে খুঁটে দেখে নিয়েছে, মাটি আঁচড়ে আঁচড়ে পোড়া কলসির কানা জড় করেছে, কে আর জানত। ওর ভাঙা টেবিলটার পায়া টের পেয়েছিল, কেমন করে পৃষ্ঠাগুলো অক্ষরের মায়ায় প্রদক্ষিণ করছে গোটা ঘর। মেদিনীর চোখের পাতায় একী আলো, একী রঙ, কত রঙের মেলা ওকে যে ঘিরে রেখেছে, ফসলকে না চেনার কোনো কারণ তো ছিল না। কিন্তু রঙটাকে ওকে যে চিনতেই হবে। ফসলের ধারা থেকে যে রক্তের ধারা বইছে তার ওজন মাপা তো সহজ কথা নয়। ফোঁটাফোঁটা রক্ত রাঙিয়ে দিচ্ছে ওর গোটা শরীর। চঞ্চল নিরুত্তর জবাব নিয়ে হাজির হয়ে যায় মেদিনীর আয়োজনে। ভ্যানগাড়ীটার সিগন্যাল সবুজ যে হয় না সকল পথে। কারা যেন বলে ‘চল যাই সব রঙের মেলায়, নিজের মতো করে বেছে নিই।’ আর এক দল বলে, ‘চোখ গেল, মন গেল, রইল বাকি কী?’ এই উত্তরের আশায় মেদিনী হাঁটতে  গিয়ে হোঁচট খেল। কত মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। ডেকে নিল কত দুঃখী দুঃখী ভাব করে করুণ স্বরে। ‘সব কী শেষ হয়ে গেল! মিছিল আর মিছিল রইল না। ঘাত প্রতিঘাতে কথাগুলো ভাব হারাল, দমটা রইল ষোল আনা। সমস্বরে চিল্লিয়ে বোঝাতে চাইল কত জানে ওরা। ফসলের আঙুলটা তখন জমিনের পাঁজরের ছোঁয়া ছেড়ে দু’আঙুলের ফাঁকে এসে ঝুলছে।

মেদিনী কনেকে রাঙিয়ে দিয়ে নিজের রুপকে মুছে নেয়। যে দাগগুলো সহজে উঠে যায়, আর যে দাগগুলো অবিচল থেকে বলে, ‘আরো সময়ের ধাক্কা সামলে তবে তো পথ চলা।’ ও জানে আজ আর সেই সময় নয়, অনেক গানে মাতিয়ে দেবে, অনেক প্রাণের সাড়া জাগবে। সংবাদটা এসেই গেল ‘,ওরা আসছে, অনেকটা পথের বাঁক কেটে কেটে ওরা ঘরে ফেরার আপ্রাণ চেষ্টায় পথ হারাচ্ছে। আবার খুঁজে মরছে। বুড়িটা দরজার খুঁটি ধরে বলে, ‘ঘরে ফেরা কী এতই সোজা!’ কেউবা আবার খিলখিল করে হাসে, ‘এই বুড়ি, এই তুমি কী বললে?’ ‘ঘর কাকে বলে জানিস? পুরুষ মানুষের গোঁফ গজানো দেখিছিস! এই কাটে, এই আসে, এই আছে, এই নেই। মোদের ঘর এরকমটা লা, এই তাণ্ডবে ওলটপালট হবে, কেউ এসে ঠেসেঠুসে দেবে। এই মাইয়াটা দুনিয়া পড়ানেখা শিখছে না, তাই তো ওর সব কেমন আবোল তাবোল লাগে। সুরে সুরে মিলতে চায় না রে। ভালা করে শুনতে লাগে যে।’ দূনিয়া এসে তো বলেই ফেলে, ‘কত মেয়েকে সাজাও গো, আস না, আমি তোমার চুল বেঁধে দি, না হয় এমন উকুন বাসা বাঁধবে, চুলে জট ধরবে, গা বেয়ে বেয়ে পা সমান গড়াবে, নেচে কুঁদে পার পাবে না।’ দুনিয়ার আকন্ঠ অনুসন্ধিৎসা ওকে জানিয়ে দেয় পূর্ণাঙ্গ নিবাসের হদিস, আগুনের ফুলকি উঠবে ও জানে বলেই ও জানতে পারে ফসলরা পথ অতিক্রম করে আসবে, চলে আসবে ওই অন্ধকার বৃক্ষের মূল যে পথ অবরূদ্ধ হয়েছে রাতারাতি, যে গর্ত বুজে গেছে আপনা আপনি, কোন নির্দেশের অপেক্ষাই করেনি,  ভাবেনি মা পুষ্ট হয়েছে নিজেরই প্রয়োজনে। দুনিয়া বলেছিল, ‘আসুন, আলিঙ্গন করি। কেউ যদি নিন্দেমন্দ করতে চায় করুক, তাতে কীইবা যায় আর আসে। ফসলের যায় আসে, সে যে রক্তাক্ত পথটা ভালো করে দেখে নিতে চায়। রক্তশূন্য পথটা অপেক্ষা নিয়ে দণ্ডায়মান। সে যে মনে মনে ভেবেছে মৃত্যুর স্বাদ নেবে, জীবনকে ধরবে বলেই না ওর আমরণ লড়াই। জমিনের মনটা জলে জলাকার হয়। ও যে ভূমিটা দেখেছিল বড় নড়বড়ে। ভেবেছিল কাউকে বেঁকে বলবে, ‘একটুখানি জায়গা দাও।’ 

ঘরে ফিরেই দেখল, ভিন্ন এক সন্ধ্যায় মূহ্যমান বাড়িঘরগুলো উচ্ছলতাহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে জমিনকে অনেক গল্প শোনাবে বলে। রোজকার ভাবনাগুলো জমা হচ্ছিল স্তূপ হয়ে। জমিনের নজরটা ঘুরেই গেছিল অনন্ত অবলম্বনে। সূর্যের প্রথম আলো যখন জীবন ছুঁয়ে যায়, ওয়েল্ডিং মেশিনের আওয়াজ ওকে কী সত্যিই টানে, নাকি কোন এক জীবনের খোঁজে পায়ের ভাজে ভাজে পৌঁছে যায় সেই আলোর বৃত্তে, স্ফূরণ ঘটছে নতুনের এক শিহরণে, শরীরটা দোলায় বটে, চিন্তার দেয়ালটা টুকরো টুকরো হয়ে যায় বটে, কি জানি কখন কোন বজ্রাঘাত এসে দানা বাঁধে। জমিন একটু আধটু কথা বলার জের টানে, কত রসের মেলা সেই স্ফূরণে। মন তো চায় নিজেকে ঢেকেঢুকে রাখতে, বলবে বলে যে কত ঘটনার জন্ম হয়, কী হয় কখন, শব্দ বের করে আনার আকুলি বিকুলে অজানা আঘাতে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। প্রশ্ন তো করতেই পারে, প্রয়োজন শব্দটা আসলে কী? কত তার দৌড়, এই জিজ্ঞাসার উৎপত্তিই বা কোথা থেকে শুরু। জমিন তাই মনের কোনে উথাল পাথাল করলেই এক এক করে জিজ্ঞাসার নিঃশেষ করে না ‘কে তোরা?’ আত্মম্ভরিতা বড় বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়ায়। আগুনটা উৎপাত করে না কে বলল। সে তো গ্ৰাস করতে চায়। ‘কত তার দাম বললেন না তো, তাহলে তো আপন করে নিতাম, চেখে অনন্ত দেখতাম, না হলে যে সবকিছু কেমন অধরা থেকে যেত। একেবারেই ছোঁয়া অছোঁয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। চলে যাবে না তো, সময় হয় নি তো, কেন যাবে? ফাটা ফাটা বুকে অজানার রেশ টেনে এইভাবে পাওয়া যায়? এটাও কি মনে হয় না, এটা প্রশ্ন নয়, এটাই আশ্চর্য হওয়া। হ্যাঁ, একা একা ও দাঁড়িয়ে আছে তো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছিল, ‘এটা চাই, ওটা চাই’। ঘরের মাঝখানে বন্দী হয়ে বলছে কত কী চাই ওর, সেটাও তো কোন ভুবনে, কাছে গেলেই সবকিছু ফুস। সব মিথ্যা, আবার সব সত্য। একসময় জানাতে গিয়ে বলে, ‘আমি সব জানি’। ওয়েল্ডিং মেশিনটা চলতেই থাকে।‌ আগুনের ফুলকি নিজের মতো করেই নাচে। কালো কাঁচের আড়ালে চলছে কত তো তরঙ্গ। চলতেই থাকে, সবকিছু চলতেই থাকে। খালি এক মৃত মানুষের গন্ধ। ওর শরীর থেকেই জন্ম নিচ্ছে। কত কী জন্ম নিচ্ছ? একেই কি জীবন্ত বলে? ‘ আরে হ্যাঁ তাই তো বলে।’ শ্রান্ত শরীরের রূপ পাল্টাতে পাল্টাতে একদিন আসে, জমিন এরকমই হয়ে যায়। মায়ের গর্ভের উপরে কিংবা কাছাকাছি কোথাও ফসলের জন্মের বীজ তৈরি হয়েছে। ওর আঙুলটা হয়েছে রক্তাক্ত। কাল রক্তে ওর বুকটাও ভেসে যাবে। ঘরের পাশের মায়ের গর্ভে আরও রক্তপিণ্ড দলা পাকাবে, আর একদিন ওর শরীরটা আধাআধি হতে থাকলে বলতে থাকবে, ‘ আমি বাঁচতে তো চাই, একটু তো দোয়া কর। ‘ইনশাআল্লাহ সব একদিন মনের মতো হবে।’ মজিদ ও তাই বলেছিল। হাত দুটো টেনে নিয়ে বলেছিল, ‘ আস্তে চালা মজিদ ভাই, এই সংসারের কথা তো কিছু বলা যায় না।’ দু’জনের আনন্দের ভাগটা পাল্টাপাল্টি হয়ে কেমন যেন হয়ে গেল।’ আজকাল মজিদ অনুকরণ শব্দটা খুব শিখেছে, ভালো কি মন্দ জানে না, কিন্তু শিখেছে। ওয়েল্ডিং মেশিনটা চলতে থাকলে ও কথাগুলো ধার করতে পারে না। এই এক ভারি বিপদ! সব কথা থেমে যায়, সব গল্প শেষ হয়ে যায়। উৎপত্তি যে হয় না, এই কথা কেউ বলে। গল্পের জন্ম যে কখন হয়, এটা কেই বা বলতে পারে, ও তো কোন ছার! জন্ম ওর কোন হাসপাতালে সেই খবর নাইবা রাখল। কিন্তু কতবারই তো ওর জন্ম হয়েছে, ও টের পেয়েছিল, মস্তিষ্কটা সচল হয়েছিল বলেই না। মাঝে মাঝে অনেক গোলমালও টের পায়। অগুণতি মানুষের গোপন গল্পগুলো গুমড়েই মরে যায়, দিনরাত জন্ম হচ্ছে নিজের মতো করে, চাবিটা বন্ধ করছে আর খুলছে, সোনার কাঠি, রূপোর কাঠি জিয়ন কাঠি হয়ে জ্বলছে আর নিভছে। একথা সেকথায় হালকা হয়ে আসল নকল গুলিয়ে যায়। মানুষের মেলায় অন্য এক পৃথিবী, ওরা নিজেদের সাজিয়েছে নিজেরই মতো, মেঠো গন্ধে কত না গাছ গাছালির বাঁক, স্বপ্নিল সুন্দরী গরান, ওদের বাতাস-গায়ের গন্ধ এই অজানা বিভুঁইয়ে ছড়িয়েছে নিজেদের আমেজে। ওদের বৃত্তে এমন খানাপিনা, নিজেদের ঘরটাকে কেমন খুঁজেপেতে নিয়ে আসে। যারা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে, ভ্রূ কুঁচকে দেখছে বটে, গল্পগাথা উদ্ধার করবে,তেমন দৃষ্টি আর বাচন কোথায়। সুখদুঃখে নিজেদের গন্তব্যের আস্বাদ আর তিক্ততাকে ওদের সামনেই আছাড় মেরে বলে, ‘তরকারিতে মশলাপাতি আর একটু কম হলে মন্দ হতো না। কেমন তেতো তেতো লাগে। কথাটা না বললেই নয়। জিহ্বাটা কম কি লাগে। কোন ব্যামো হয় নি তো, চল তো ঘরবাড়িটার খুঁটিনাটি খোলসা করে দেখি। দেবতা অসুরের লড়াইটা জমে উঠছে উঠুক, মন্থনে অমৃত নাই বা উঠল, বিষের ভাণ্ডারটা গিলতে হয় গিলুক। বাকি যেটুকু থাকবে ভাগবাটোয়ারা করে খেয়ে ফেলা যাবে।’ 

পথ কাটিয়ে আশপাশে যায় বটে, যাবার বলায় হাসি মস্কারা চলে বটে, নতুন ঘরবাড়ি, নতুন আদলে নতুন মানুষের কথা ছোঁড়াছুঁড়ি। ওরা ওদের পাত্তা দেয় কি দেয় না, গ্ৰাহ্যি করে কি করে না, এই কথা কে আর ভাবে। ওরা হেঁটে হেঁটে চলে যায়, কতদূর যাবে, লোহালক্করের গায়ে নাটবল্টু জুড়ে কত কি যে বানিয়ে এই শহরের বাবুদের বলবে, ‘ নাও না গো বাবু, ওপরওয়ালা তোমাদের মঙ্গল করবে, দুধেভাতে রাখবে। ওরা দু-চার পয়সা রোজগারপাতি করে ঘরে ফিরবে। এ ওর পিঠে ধাক্কা মেরে বলবে, ‘মালিক কী বলল রে?’ ‘বলল, রোজের টাকা, অমনি অমনি বাড়াব, গায়ে-গতরে খেটেখুটে পুষিয়ে দিতে হবে না। না হয় কোন চুলোয় যাবি যা। না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মরলে তোদের কোন বাপ দেখবে, আমিও দেখব।’ ‘বল দেখিনি বাড়তি কাজের অর্ডার পেয়ে কত কামাবি বেটা তুই, মোদের করা দেখাবি।’ ‘কী করা যায় বল তো? কোন ঝান্ডার তলায় মাথা ঝুঁকিয়ে মরি।’ ‘বেঁফাস কথা মুখে আনবি নি। ভাবতেছি আর একটা পথের খোঁজে যাব।’ ‘পাগলটার কথা শুনতেছিস, না খেতি পেয়ে কোমর বেঁকে যেতিছে, সে নাকি বানাবে ঝান্ডা।’ ‘পাগলা বউবাচ্চার পরনে কাপড় জোটাতে পারিস না, ঝান্ডা বানাবি। ঠেলা সামলা, ওই সত্তরে বুড়োটা ঘুরে ঘুরে হকের টাকা পেলো নি, শেষে ঘুরে ঘুরে স্টোক হয়ে হাত পা ছড়িয়ে বিছানায়। কেউ খোঁজ রাখল নি। আমরাও কি রাখি?’ ওরা তালে তাল রেখে পা ফেলে। যাবে তো অনেকদূর, সোজাসুজি, কোনাকুনি, মতে অমতে, পথে পথে কত জোর মিলান্তি, চোখে চোখ রাখা, ভালো মন্দের হিসেব কষা, জবাবটা তো দিতেই হবে, কত তো চিহ্ন, গায়ে পিঠে হাতে গলায় মুখে, তাই দেখে তো মুখ চেনা চিনি। যাবার বেলায় ফুটের দোকান দেখে ঠোঙায় ঠোঙায় মশলা মুড়ি, ভাজাভুজি, চিমসে পেট, ঠেলে বেরনো ভুরিওয়ালা পেটটা বেশ লাগে, আগে আগে পেট যায়, পিঠটা যায় পেছন পেছন, সে এক মজার কাণ্ড, এরকম কত মজার কাণ্ডই ঘটে বটে। কারো মুখ চিনতে চাইলে বলেই ফেলল ‘ওটা ইন, ওটা আউট।’ শব্দটা ইংরাজি বটে, একটু উল্টেপাল্টে নিলে অর্থ যে এভাবে পাল্টে যায় কে জানত। তাই তো ডেকেডুকে আত্মীয়তা পাতানো। ‘বৈঠিয়ে না দাদা, বিক্রিবাট্টা হয়নি গো, তুমহার হাতে পেথ্থম বউনি হল। খেত লাগ, খেতে লাগ, মিলেগা নেহি, খোদ মুল্লুক থেকে আনা।’ ‘সময় নি গো, সময় নি। সেকরার ঠুকঠাক কামারের  এক ঘা, এমন যন্তনা, সারা রাত ঘুমোতে দেবে নি, ছটফট ছটফট, এত বেদনা নিয়ে কেমন করে টিকে থাকা যায়, বল তো।’ ‘এট্টুখন দাঁড়িয়ে যাও না, ওই ভবঘুরেটাও আছে দেখছি। দু’জনের হাতখানা পরখ করে দি।’ চঞ্চলের হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে। ‘ ভাগ্যটা কেমন করে পাল্টানো যায়, এই কথাটা বল দেখি। তাবিজ, পাথর কিছুই তো দেখিনা।’ ‘আহা, ওসব কি আমি বলতে পারি, তোমার কি হতে চলেছে, এখন কেমন কাটছে, শুধু ওইটুকুই জানি।’ ‘আচ্ছা, আমার ভাগ্যের কথা আমার মাথায় থাক।‌ এই দিনখাটুরের হাত দেখে বলল দেখিনি, ভবিষ্যত কিছু দেখতে পাও কিনা। ‘জন্মসাল, জন্মক্ষণ বল’ ‘ব্যাস ওইটুকু বললেই হবে, রাশি, নক্ষত্র এসব কিচ্ছু লাগবে না!’ বেজার মুখ, মালগাড়ির কয়লার মতো চোখ পাকিয়ে বলল, ‘আঁধার, শুধুই আঁধার। শুধুই কি আঁধার, ঘুটঘুটে আঁধার।’ ‘আশু কোন সমাধান নেই!’ চঞ্চল হাত বাড়িয়ে ডাকে, ‘ও ভাই শোন, হাত দেখিয়ছ কখনও’ ‘হাত! সে আবার কোথায়!’ ‘দেখাও না একবার, জানতে তো পারবে, এই শহরে বাংলোবাড়ি হবে কিনা। কাড়িকাড়ি টাকাপয়সা হবে কিনা, সোনাদানা হবে কিনা, ঘর থেকে লুটপাট বন্ধ হবে কিনা।’ ‘কত্তদিন এমনি হাসিনি। আপকা লিয়ে হাসি আপনাআপনি এসে গেল। হামার হাত দেখেছেন বাপু। এই দেখুন ঠেলা ঠেলতে ঠেলতে সবি হাতের রেখাগুলা গায়েব হয়ে গেছে। এই বাবু হামার ভাগ্যের কথা বলতে পারবেন নাই। পরের জন্মে এই ঠেলাওয়ালার সাথে আপলোগদের যদি কখনও দেখা হয়, তবে হামার ভাগ্যের কথা পুছে নেব।’ চঞ্চল শব্দহীন হয়ে যায়। নিঃস্তব্ধ নিরালাপে হস্তরেখাবিদের পাশে দাঁড়িয়ে সময়টাকে ঘেঁটেঘুটে বুঝতে চায় এই নীল আকাশের নিচের পৃথিবীর এক শহরের এক কোনের ঠেলাওয়ালার কথার অর্থ কী, ওকে কী ও শিক্ষকের আসনে বসিয়ে হাঁটুগেড়ে বসে অনুরোধ জানাবে ‘আমি আপনার ছাত্র হলে খুব কী দোষের হবে? নতমস্তকে আর একটা প্রশ্নও করে বসলেন, ‘আপনি কি নালন্দা কিম্বা তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন? ঠেলাওয়ালা বড়জোড় ‘বিশ্বভারতী’ আর ‘রবীন্দ্রভারতী’ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনলেও শুনতে পারেন। ‘রবিঠাকুরের নাম শুনেছি বাবু। জোঁড়াসাকোর পাশ দিয়ে ঠেলায় করে কত তো বই  টেইনে নিয়ে গেছি বাবু। এসব নাম তো কভি শুনি নি।’

‘তোমার নাম যেন কী বললে? ‘তুলসীরাম। এতো বাত পুছতেছেন কেন বাবু? হামার কোন গলতি হয়েছে কী?’ থানাটা কাছেই ছিল, খানিকটা ভয় পেয়ে তুলসীরাম বলল, ‘ বাবু, গরীব মানুষ, থানায় ঢোকাবেন না, রামপুর টিভি কোম্পানির বারান্দায় শুয়ে থাকি, কোন কসুর হামার হলে মাফ করে দেবেন। তাড়িয়ে দিলে কুথায় আর যাব।’ তুলসীরাম ভয় পেয়ে মাথার চুল ছিঁড়তে থাকে । ‘না না তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’ ও খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে চঞ্চলের দিকে চেয়ে রইল। মনে মনে ভাবল, ‘পুলিশের লোক নয় তো! পুলিশে ছুঁলে আবার আঠারো ঘা। তবে কি ওই দোকানি বাবু নালিশ করেছে থানায়।’ কত লোকেই তো বাজারের দোকানে শুয়ে থাকে, ওর বেলায় যত দোষ। কেউ কি পিছনে লেগেছে? এরকমই হাজার কথা ভাবতে ভাবতে তুলসীরাম একবার সামনে দেখে আর একবার চঞ্চলের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, যা দিনকাল পড়েছে যা কিছু হতে পারে কিছুতেই যেন কিছু বিশ্বাস হচ্ছে না।

অটল নির্ধারিত সময়ের আগেই ওর চিন্তাকে ছড়িয়ে দিয়ে হয়তো ভাবতে চাইল যে মানুষগুলোর জীবনকে চঞ্চল ছুঁতে চাইছে আসলে ওরা কারা? ওরা কী ঘুমিয়ে পড়েছে না জেগে আছে। বইয়ের পাতা ওল্টাতে গিয়ে ভাবে এইভাবেও ধরা যায় না জানাবোঝার নির্দিষ্ট একটা মাধ্যম আছে। কোনটা পাটিগণিত, কোনটা বীজগণিত, কোনটা ত্রিকোণমিতি। গাণিতিক সূত্র দিয়ে জীবনকে কি উপলব্ধি করা যায়, এই কথার উত্তর ও নিজেও তো খুঁজতে থাকে। ওই যে লোকটা, কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে আছে, আষ্টেপৃষ্ঠে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে তার কি কোন দৃষ্টিকোণ থাকতে পারে না! কি জানি কেন ওর উপলব্ধির মাত্রা বলে, চঞ্চলের চোখটা ওর নিজের করে নিতে সংকোচ হয়। তাই তো ও কিন্তু কিন্তু  করেও একবার ওর মুণ্ডটাকে ঘুরিয়ে দেয়। দেখে চুলের ভাঁজটা উল্টোদিকে ঘুরে গেছে। ওর মাথায় আলাদা এক সুগন্ধি তেলের গন্ধ। হাতে কেমন অতি সহজে মুঠো করে ধরে আছে এক বনৌষধি। ওর ঠোঁটটা দুদিকে ঝুলে আছে। চঞ্চল জানে না ও কি খেয়ে কেমন করে কোন বিদ্যায় শরীরটাকে মুড়িয়ে রেখেছে। ও ইচ্ছে করলেই ওর একটা নাম দিয়ে দিতে পারে। ওই নাম দিলেই মানুষটাকে চেনা যাবে। আলোর খেলাগুলো তো থেমে যায় নি। এতক্ষণ আলোটা ডান দিক থেকেই ওর শরীরটাকে চিনিয়ে দিচ্ছিল, চমকেই উঠেছিল অটল। আবার ও যখন বাঁদিকে ঘুরে ওর শরীরটাকে মনে হল একটু আগেই ওর বইয়ের তিনশ নম্বর পাতায় যে ছবিটা দেখেছিল তার সঙ্গে নব্বই ভাগ মিল। ও ওর শরীরটাকে ছেড়ে ঘরে ফিরে আসবে যেই না ভাবছিল, ও শুনতে পাচ্ছিল একটা মানুষ কানফোনে, স্মার্টফোন নয়, অনর্গল বয়ে যাচ্ছিল, সেই কথায় শব্দ ব্যবহারে এমন দু’একটা নাম ব্যবহার করছিল, না শুনতে পারলেই উচিত কাজ হতো, কিন্তু তা হল না। আর বলার গল্পে যে ভাবে ওই ঔষধের দোকানের কর্মচারীর কথা উঠে আসছিল, যে চিন্তার স্রোতটা বয়ে আসছিল, দুপুরের ব্যবহার করা উচিত অনুচিতের সঙ্গে কতই না মিল। ওই মানুষটাকে বাকি লোকগুলো অনিমেষ বলে সম্বোধন করছিল। ও এই আঁধারে অনিমেষ একা একা কথা বলে যায়, শব্দগুলো হুবুহু মিলে যায়, ও যে ভাবে বাঁচার কথা বলে, তাও যেন সমান সারিতে চলে আসে। অটল ভাবল পাঁচশত বছর ধরে নেওয়া যাক। সময়টাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এমনভাবে আগলে রাখা যাক, কথার স্বরটা পাল্টে গেলেও ‘নিমন্ত্রণ’ শব্দটা ‘নিয়ন্ত্রন’ হলেও ওর চিন্তার শর্তগুলোকে অমান্য করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে না। অটল ওই নামধারী মানুষটাকে চিনবে বলেই একটা দামের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। অনিমেষ কেন একটুও পাল্টাচ্ছে না, এতটাই ভিন্ন সময়ের ভিন্ন রঙ, ওপারের ব্যক্তিটি ও নয়, তাহলে ওর দেখাটাই ভুল, দুপুরের মুহূর্ত আর গল্পটাই আবার পুণ:প্রচার হচ্ছে।

অটলের দর্শন যে বিপরীত মেরুর চঞ্চল পলে পলে অনুভব করে। সম্পর্কটা চির ধরার কোনো প্রশ্নই আসে না। দ্বন্দ্ব এখানে মোটেই নেই মানুষের চলার পথটা সুগম নয়। পথটা রুদ্ধ হয়ে যাবে এই ধারণা অকল্পনীয়। তেজোদ্বীপ্ত রোদ চঞ্চল মাথায় করে বয়ে বেড়াতে পারে অনায়াসে। অটল ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই গাঙের জলে ঝুপ করে ডুব দেয়, প্রয়োজনে একটু সাঁতার কেটেও নেয়। ভেজা কাপড়ে ফেরার পথে ওই লোকটাকে ডাক দিয়ে বসে – ভাঙলো ঘুম? ওঠো নিজের মতো করে ওঠো, কম্বলটা ভাজ করে পিলারটার এক কোনে গুঁজে রাখে, পায়খানা প্রস্রাব সারবে বলে কর্পোরেশনের শৌচালয়ে ছোটে পেটটা চেপে ধরে, জলাধারে হাতমুখ ধুয়ে স্নান সেরে সেই যে দৌড়য়, আর ফেরে না। অটল কত করে চেয়ে থাকে আর দেখতেই পায় না। ওর ঘর থেকে কুড়ি বাইশ ঘর দূরের চায়ের দোকানের সুধন ওর সঙ্গী হয়ে যায়। দশ টাকার আধাভাঙা টালির ঘর থেকেই ও আধা মাইল দূর থেকে ছুটতে ছুটতেই চলে আসে। কাঁধে একটা ব্যাগ ঝোলানো থাকে, সেটা এমন করে মুঠো করে ধরে, মাটির সঙ্গে ঝুলেই থাকে, ও টের পেল কি পেল না, তাতে কিইবা আসে যায়, লক্ষ্য তো ওই কাউন্টারটাই। কাঠের বাক্সগুলো এক এক করে নামায়, সাজিয়ে গুছিয়ে গুঁড়ো চা, পাতা চা, দুটোরই মেশামেশি, নিজের মুখে ‘ইসপেশাল’ শব্দটা বসিয়ে দেয়। মুখস্ত চা বাগানের নামগুলো নিয়ে ওর গর্বের শেষ নেই। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে ‘এতবার নামগুলো আওড়াও কেন?’ অটল জানে, এতে ওর কিছু হয়তো আসে যায় আসে না, কিন্তু অদ্ভুত আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার অধিকার তো নেই। তাই বলে স্ত্রী পুত্র তখন ওকে ওগো,বাবাগো বলে দুপুর বিকেলে ডাক দিয়ে যায়, কেমন করে ওঠে তো ভেতরটা, বাক্সগুলো নাড়াচাড়া করার সময়ও করে। চঞ্চলেরও করে। নাড়ানাড়ি হলে মনটা কেমন করবে না! সুধন আপনমনেই চেয়ারটা টেনে নিয়ে পায়ের উপর পা তোলে, প্রয়োজনে চেয়ারটা দোলায়। মালিক সাজতে যাবে ঠিক অমনি সময় দু-তিনবার গলা খাকারি দিয়ে কাঁশি তুলে খরিদ্দারটা কফ তুললে আর ফেললে ঘেন্না হয়, ‘বুড়ো থুরথুরে বলে বেঁচে গেলেন। বয়সের বুদ্ধিটার তো কদর করবেন। কী জমানা এলো ছেলে বুড়ো এক হলো।’ আবার থেমে গেল মহাশ্মশানের ঘাটের দিকে চলে যাওয়া মরা মানুষটি দেখে। এই জীবন কেন এই প্রশ্নটা এলো না নাকি, স্বাভাবিক জীবনের তাড়নায় মনেই তো পড়ে গেল, দরমার বেড়াটায় বড্ড উইপোকা ধরেছে, ঘুণে ধরেছে বাঁশে, ঘুঁটে আর কয়লা কিনতে হবে না। গরুটা রেল লাইনের ধারে বেঁধে রাখে খুঁটিতে, কম কথা তো শোনায় না কেউ। চঞ্চল দু-এক কলম লেখে বটে, তাতে কি আর মন ভরে! বইয়ের পাতা যখন নাড়াচাড়া করে, ডুব দিয়ে তো দিয়ে যায়, তাকিয়ে থাকে সুধনের দিকে, পলক ফেলে না। সুধন কেন জন্মালো খুব যে মাথাব্যথা আছে এই নিয়ে, তা কিন্তু নয়, এমন করে জন্মানোর আদৌ কোন দরকার ছিল কিনা এই প্রশ্ন ও রাখলে যে দোষের কিছু নয়, অটল আরও বেশি করে ওর কাছাকছি যায়, ওকে ব্যতিব্যস্ত করে। ‘ যান তো যান, কেটে পড়ুন, নিজের জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরি, জ্বালাতন করার লোক জুটেছে। মানুষের এক বেলা খানা জোটে।গরুটার খাবার ঘাস নেই,খড় নেই, খোল নেই, চোখ দিয়ে জল গড়ায়, সইতে পারিনি গো অটলদা। বাবু আমার ছেড়ে কথা বলবে না যে, বিকরিবাট্টা শিকেয় উঠেছে, বাবুর গালমন্দ তো আর তুমি সইবে না গো, যতো দোষের ভাগ তো আমার ঘাড়ে চাপবে, বুঝবে কি আর তুমি। এই শহরের মরা গুনতেই তোমার দিন কাটে, তা-ও আবার আবার আমাদের মতো গরীবের মরা। এই ছোটলোক মরারা নাকি শহরের কাছে হাত বাটায় নি, টাকার কুমিরদের ভাবনার আগামাথা নেই।’ সত্যি হয়তো অটল মরা মানুষের মাথাগুলো গুনে চলে রাতদিন, আত্মার খোঁজ করে কিনা। হয়তো শুনতে চায় না, দাঁড়াতেও চায়না, জানতেও চায় না, ওর কিচ্ছু যায়ও আসে না, শুধু বাঁচাতে চায়, রোজ জ্যান্ত মানুষগুলোর মাথা গুনে যাওয়া ওর রোজের কাজের ডায়েরিতে ধরা পড়ে। হয়তো কতকিছুই বিশ্বাসও করেনা আবার করেও। দ্বন্দ্বটা সাময়িক কিনা কিংবা মাথার কোন গোলমাল কিনা সেটা চঞ্চল অটলকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল বটে কিন্তু অটল মাথায় নেয়নি, শরীরেও জায়গা দেয়নি, মনেও ধারণ করে নি। অটল ঘরে ফেরে না কত রাতেই না, সে রাত অন্ধকার নয়, ফুটফুটে আলোর মধ্যে যে অন্ধকার লুকিয়ে থাকে তারই আরেক রাতের রঙ। সুধন এক অনন্য মানুষ হয়ে যায় ওর কাছে তখন আর চা দোকানের কর্মচারী থাকে না।  ও বলেই ফেলে,’সুধন তুমি ধন্য, ধন্য তোমার এ-জীবন।’ সুধন চঞ্চলের কথার কোন অর্থই খুঁজে পেল না। জোরে জোরে হেসে উঠে বলল, ‘দাদা, মরে বাঁচার পথটা একটু বাতলে দিতে পারেন তো, একবার চেখে দেখে নি। সারাজীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকব, এই কথা হলফ করে বলতে পারি।’ অটল ভাবে, ‘লোকটা বলে কীরে!’

ষষ্ঠ অধ্যায়

লোকটার পশ্চাৎগামীতা দেখে বিলু ভাবে জীবন কখনও কখনও এইভাবেই হিসেব কষে বুঝে নিতে চায় আসলে তিনি কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন।  শুধুমুধু দাঁড়িয়ে থাকবেন কেন, তিনি দৌড়তেও পারেন। সহজ কথা তো নয়। এমন ব্যত্যয় পৃথিবীতে ঘটে, ঘটে চলেছে, বাদ কী করে পড়ে মানুষটি। ধরে নেওয়া যাক মানুষটার নাম ল্যাংড়া। ল্যাংড়া না হয়ে অন্য নামও হতে পারত, তাই বলে তিনি কিন্তু নুলো নন, বরঞ্চ বেশি করে বকবক করতেই ওনার পছন্দ। বিলু লক্ষ্য করেনি এমনটা কেমন করে হতে পারে। পারে না তো! ধুত্তরি কা, তবে কী মানুষটার ভীমরতি হয়েছে লোক দেখলেই ছোঁক ছোঁক করে। হোমো ভাবনার কোনো কারন নেই। হোমো শব্দটার বাংলা প্রতিশব্দ কেন যে মনে পড়ছে না, এমনটা হয়েই থাকে। নিজের বিস্মৃতির অপরাধ বোধটা এমন করে চেপে বসে, বুঝতেই পারেনা ও ল্যাংড়ারা  ধীর স্থির না অস্থির। এরকম কেন হয় বিলু ভাবতে ভাবতেই হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়, যদি একবার ধরে ফেলতে পারে তাহলে কী দশা হবে? ভয় পেয়েছে বিলু, ভয়টা অমূলক নয়, অবান্তরও নয়। একবার নয়, দুবার নয়, ঘন ঘন পাক খায়। হায় হায় রে, কত তো মানুষ, আবার অমানুষ, সিঁড়ি বেয়ে কেউ উপরে উঠছে, কেউ নামছে, তরতর করে নামছে। নিশ্চয়ই সেই ধাঁধারও উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে, কতটা সিঁড়ি টপকাল, আদৌ গুনে ফেলেছে, কি গুনে ফেলেনি, নাকি আন্দাজে ইস্টনাম করে জানার চেষ্টা করছে, সঠিক সংখ্যাটা কি। ল্যাংড়ার কাছে লোকগুলো এতটা নরম সরম নয়, না হলে এতটা জোরে কেমন করে ধমক মারছে বলুন তো! বিলুর এমন ইচ্ছেটা হয়নি ওকে জড়িয়ে ধরে। ল্যাংড়াকে ও বসিয়ে দেয়, না ও নিজেই বসে পড়ে নিজের মনে করে, কেউ কেউ আবার দখলদারীও ভাবলে অসম্ভব কিছু মনে হবে না, জায়গাটা বড্ড ছোট, আধাখ্যাঁচরা হয়ে আছে। কী কাণ্ড! কী কাণ্ড! ওরা কথা বলতে চাইছে না, তবুও ও কথা বলবে। কথা বলতে চাইলে তো হলো না, কথার ওজন চাই তো। বিলুর মত পাগলামি, ল্যাংড়ার গায়ে বিচুটি পাতার দাগ লাগে নি, ফুলেও ওঠেনি, তবু ও ভেবেই চলেছে ওর গা থেকে গন্ধ ছড়াচ্ছে, বা গন্ধ ছড়াতে পারে। ল্যাংড়া আলটপকাই চেনাজানাহীন লোকটার গাল টেনে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার গালে এত বসন্তের দাগ কেন? কবে থেকে হয়েছে বলে তো? দিনটাই বা কেমন ছিল? মুহূর্তটা কোন দাগা দিয়েছিল কিনা। বিলুর ইচ্ছে হল একটু এগিয়ে গিয়ে দেখা যাক না, মুখটা চেনা চেনা মনে হয় কিনা। কোথায় যেতে পারে ল্যাংড়া, এমনিতেই মনে এসে গেল কিনা। সবকিছু কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া লাগছে। ডাক দিয়ে দেখা যাক। গলার স্বরে এমন একটা চিনচিনে ভাব ছিল ল্যাংড়ার কাছাকাছি পৌঁছনোর আগেই স্বরটায় এমন ভাঙচুর হলো, ল্যাংড়া ভাবল, বাতাসের দপদপানিতে এমন এক জায়গায় ধাক্বা খেয়েছে দু’একটা অক্ষর অদল বদল হয়ে গিয়ে ল্যাং-এর সংগে জুড়েছে ‘টা’, ‘ড়’-এর আগে জুড়েছে ‘জ’, জড় শব্দটা ওর সঙ্গে খাপ খায় কিনা। কিন্তু ‘উলঙ্গ’ শব্দটা জড় তার সঙ্গে ‘ভরত’ শব্দটা জুড়লে একটা অর্থবোধক শব্দ হয় বটে,কিন্তু পথচলতি মানুষের কাছে অস্বস্তির কারন তো ঘটে। বিলু আরও একটু এগোবে কিনা ভাবছে,   ল্যাংড়া কি মনে করে লম্বা টেবিলটার এক কোনে বসে পা দোলাতে শুরু করে। আঙুলগুলো মটমট করে উঠলে যে লোকটা খরিদ্দারকে কাপড়ের আঁচল চেনাচ্ছিল, বলতে ছাড়ল না তারস্বরে ‘দেবো নাকি এক ঘুসি।’ পাই পাই করে দে ছুট। বিলুর সাধ্য কি তাকে ছোঁয়। যে রাস্তাটাকে বিলুর আঁকাবাঁকা মনে হচ্ছিল, সোজা হয়ে গেল কেমন করে। এমনটাই বোধ হয়। বিলুর মগজটা টলমল করে উঠল। কত আবর্জনার স্তূপকে সরিয়ে ভেবেছিল মানুষের চলার পথটাকে সহজ করে দেবে, ভক ভক করে বেরুচ্ছে কতই  না দুর্গন্ধ,  নাকে মুখে সেঁধোচ্ছে। ল্যাংড়া যে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে কে তার খোঁজ রাখে। সে কি ঠিকই করে ফেলেছে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে রাতের আঁধারকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করবে। একটু এগিয়েই জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার ছুরি কাঁচি কাটারি’র দাম কত?’ লোকটা পলকে পলকে তাকাল। কোঁচকানো ভুরু অদ্ভুত ভঙ্গিতে উপর নিচ নাচানাচি করে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার মতলবটা কী! কোথাও কোন ফাঁদ পেতেছ?’  ‘এত কামকাজ থাকতে ফাঁদ পাততে যাব কেন?’ ‘সিঁদ কাটার দিন ফুরিয়েছে কিনা। মনে কি কোন নতুন প্রশ্ন জাগতে নেই? ভয়ে ভয়ে চোখমুখে দাগ লেগেছে। কালসিটে পড়ে গেছে গায়ে পিঠে।’ ‘বকবে না একদম বলে দিচ্ছি। ছলচাতুরি করে কথা বের করবার রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছ কিনা। এই রাস্তা এত সহজ নয়। মরা বাঁচার প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসতে পারে।’ ‘ আরে বাবু, পালাও দেখি, মাথা চেটো না। মেঘ দেখ না। কেমন উরু উরু করে মনের সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটুখানি রাস্তা তো বের করে দাও। ঝর ঝর ঝর করে নামলে তার দাম কে দেবে, তুমি? 

উটকো ঝঞ্জাট! কেমন ডানা নাড়তে নাড়তে  কাছেই চলে আসে। ধার নেই, যেমনটা তুমি চাইছ। এত সহজে ডালগুলো খ্যাঁচ করে কাটা যাবে না। গাছগুলো ফালাফালা হবে না।’ ‘ তুমি কচু জান। এত বছর ধরে বসে বসে আমি এমনি এমনিতে লোম ছিঁড়ছি।’

 গাছে গাছে কত জাতের কত পাখি ডেকে চলে গেছে নিজের ঘরে। কে রাখে আর কেমন করেই রাখে, কোন দলিলে লেখা রয়েছে সেই হিসাব কিতাব ? ‘তুমি এসেছ কাটারি আর ছুরির ধার আছে কিনা পরীক্ষা করবে বলে!’ ‘ ধারই যদি না দেখব, পথটাকে পরখ করব কেমন করে, ছক কষে তো আর জীবন চলে না, যাচাই করে দেখব না!’ কাকটার তক্ষুনি বোধ হয় ডাক দেবার সময় হল। ডাকটা কর্কষ না মিষ্টি এই সিন্ধান্ত দেবার মালিক ল্যাংটা কিনা সেই কথাটা মনে মনে কেউ ভেবে রাখেনি। বিলু তো নয়ই, সে শুধু দেখেছিল কাকটার গলাটার ওঠানামাটা কত দ্রুত চলে। ওর শক্ত চঞ্চু দুটি ওঠানামা করছিল, তাই নিয়ে ও শহরের কল্লোলটাকে আন্দাজ করে। এতকালের অভ্যাসটা নিয়ে ওতো মুখ গুঁজে থাকতে পারে না, কাঁদতে তো পারেনি এমন নয়। গোপন কান্নায় গুমড়ে গুমড়ে মরেছে,  ল্যাংটাকে খুঁজে মরেছে কিনা নিজের মতো, হয়তো খুঁজেছে। ল্যাংটা এসেছিল নিজের মতো সেজেগুজে, চিনলে কি কেউ চিনল না এই দায় তো ওর নিজের নয়। কত নজরেই তো জব্বর নিজের জায়গাকে আগলে রেখেছে। ল্যাংটা কাটারিটা চেয়েছিল বটে, উদ্দেশ্যটা তেমন করে ব্যাখ্যা করেনি, না অন্য পদক্ষেপগুলো নিয়ে উত্তর জানতে চাইলে কোন মানুষটা এসে ধরা দেবে, জব্বরের তাতে কী এল আর গেল। কত মানুষই তো দলে দলে আসে আর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ‘না বাপ এমন করে কাঁদতে নেই।’ চোখের জল মুছতে মুছতে চলে যায়। ল্যাংটাকে কতকটা চেনে, আর কতকটা চেনে না। দশ হাত দূরে যে ভাজাভুজির কড়াইটা ছিল, ছ্যাঁতছুঁত আওয়াজটা যে ঢঙে উঠে আসা দরকার ছিল, সেইভাবে হয়নি। হায় হায়রে কস্মিনকালেও যদি ওই যে ওপার থেকে সুরটা ভাসতে ভাসতে আসছে, মিশিয়ে দিতে তো পারতো এপারের রঙ ঢঙের সঙ্গে, কত তো রঙ্গ হতো, নেচেকুঁদে এমন সব গল্পজুড়ে দিত তার কোন মাথামুণ্ডু নেই। ল্যাংটা তো চলে গেল, জব্বর আবার নিজের মতো করে সব ‘গুইচ্ছে গাইচ্ছে’ নিল, ডান দিকেরটা বাঁয়ে নিল। ‘ আরে লোকটা পাগল নাকি, বকবক তো করতেই লাগলো, চেহারাটা বেঁটে, লম্বাচওড়া কথা, জো বাইডেন সাহেবের সঙ্গে উলঙ্গদের আকথা কুকথাগুলো যত তাড়াতাড়ি দরবার করে বোঝাচ্ছে নাকি ছাপোষারা নিপাত যাক, এটাই চাইছে, ঠিকাদারি নিয়েছে নাকি। ছি ছি মানাচ্ছেনা গো, যে চুলোয় ছিলি, সে চুলোয় যা।

আহাঃ কী সুখ! কী সুখ! সুখের আবার রামরাজত্ব! ল্যাংটার যে কী হলো। বাঁধা নেই, কোন বিপত্তি কোথায়! সে আবার কী রঙ্গ দেখল, ধেই ধেই করে নাচল। কত তো পাখি আগুন ছড়াল। ‘ যা যাবি তো যা যেমন করে যেতে চাস যা।’ যেই সুখের কোন বিনাশ নেই, আত্মসুখ সেই এক পরম প্রাপ্তি। কথার পরে কথা সাজালে সে কেমন কথা হয়,  জব্বরও জানে, কেমন করে জানে, ল্যাংটা যেমন করে জানে। বিলু সে পথের মালিক নয়। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। ল্যাংটাকে পথ দেখাবে এমন দিশা পেলে তো যাবে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার। এত ধুলো গায়ে মাখলে সে কি আর এত সহজে ছাড়ানো যায়। জয় পরাজয় তো দূরের কথা। ভাবের ঘরে চুরি করলে আর তো কোন কথা নেই। রাজা রানী পায়ের উপর পা তুলে ছড়ি ঘোরাবে, ল্যাংটা সে কথা আর জানবে কেমন করে! এত জোরে দৌড়ল রাজার হাতি শুঁড় তুলে সেলাম করল, ভেবেছিল লোহার তোরণটা আপনা আপনি খুলে যাবে। সে মারের চোটে পিঠে রক্ত ঝরল। ‘কত করে বারণ করলুম ও পথ মাড়িও না, শুনল সে কথা।’ ল্যাংটা নিজের মতো করে পা ফেলল, যা হবার তাই হল, কত লোক গাঁইগুঁই করল। ‘ তাই বলে স্বপ্ন দেখব না। খালি ওরাই পথের সন্ধান পাবে? দোষ আমাদের ছিল যদি, ছুঁড়ে ফেল না চার বিঘত দূরে। জোঁক এসে রক্ত চুষবে।’ বিলু বলল, ‘এমন মাঠে ধান চাষ করতে যেয়োনি গো। জঙ্গলের রাজত্বে এমনটি করতে নেই।’ রুলের বাড়ি পড়ল, ‘ও মা গো’! তাই বলে কথার সুখে মন ভরাব নি।’ জব্বর তো সাবধান করেছিল। ‘গোখরোর সঙ্গে গায়ে পড়ে ঝগড়া করো নি গো। যে পথ তুমি খুঁজে বেড়াচ্ছ, সে পথ তুমি পাবে কোথায় কালে কালে, কালের আঁধারে সেঁধিয়ে গেছে।’ ল্যাংটা এসেছিল যে কোন পথে, কবে থেকে, বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভুবনে, উল্টাপাল্টা মা পড়েছিল, আওড়েছিল, যদি কিছু একটা ম্যাজিক ঘটে চলে। ভাগ্যিস ঘটে নি, কেউ ভাগ ও বসায় নি। ভেবেছিল অনেক কথা। দিল্লী বুঝি অনেক দূরের পথ। শুনল রাজামশাই হাতে তালি, মুখে বুলি তুলে এক নিমিষে সেই যে গিয়ে একবার বসল, আর নামল না। অ আ ক খ – ই জানে না, সে নাকি রাস্তা চেনাবে। বিলুর কথা শুনল না। কাঁকটা যেই না বেঁকে বসল, পথের নিশানা গেল পাল্টে। সেই তো কাকভোরে মুখে করে যেই না আনল লেফাফাখানা, পড়বি তো পড়, রাজার বেটা গামছা গলায় উলঙ্গ হলে যেমনটি লাগে। সৈন্যসামন্ত সকল তেড়ে এল, হুমকির পর হুমকি, বলে বেড়ায় যে যার পথ চিনে নে। কে আর কার কথা শোনে, ল্যাংটা সেই যে দুনিয়া চিনল, আর কি থামতে চায়। চেনার কে, ওই জব্বর মিঞা! এত কথার আমদানি করল, রপ্তানির বেলায় শূন্য, পেট খালি নিয়ে কি রাজার বাড়ির পাথর গোনা যায়, তবু সাত রাজার ধন এক রাজার মানিক, নিড়ানি দিয়ে কি আর ওসব কাজ চলে। জব্বর মিঞা কেন যে নিড়ানী খানা হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল ‘পথ দেখ’। কী অবাক কাণ্ড! হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া। রাজার চেলা চোঙা ফুকে বলে বেড়ায় ‘ ওরে ও মূর্খের বেটা, পথ মাপতে এয়েছিস, তোর ঘাড় মটকে না দিয়েছি তো! আমি রাজার পা চাটা কুত্তা নয়।’

জব্বর কখন আসে, কখন যায়, ফিরে ফিরে আসে। ফিরে আসাটা ও পছন্দের তালিকায় রেখেছে কিনা, সে নিজেও জানে কিনা সন্দেহ। মনের কান্না শরীরের কান্নাকে ছাড়িয়ে ভিন্ন জায়গা নিতে পারে কিনা এই জিজ্ঞাসা অবান্তর। শুধু ওর ডালার দিকে তাকিয়ে – রামদা, কাটারি, ছোরা, চাকু, ভোজালি, বল্লম, সড়কি,কোঁচ,বঁটি, কুরানি,কাস্তে, কর্নিক কতকিছুই যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, চোখের দেখাই যে শেষ কথা নয়, কখন যে যন্ত্রপাতির সঙ্গে আত্মীয়তা পাতিয়েছে, ভেঙেচুরে গেলেই যন্ত্রণাটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মানুষগুলো হেঁটে চলে যায় বটে, চেয়ে চেয়ে থাকে, চোখ পাকিয়ে তাকায় না এমনটাও তো নয়। ঘৃণা ছড়ানোটাও কম জ্বালাতনের নয়। জবরদখল শব্দটা মনে মনে পোষণ করে বিড়বিড় করে পাশকাটিয়ে যায়, জব্বরের জানার কথা নয়, হুশ হুশ শব্দ করে নিজের উপস্থিতিটা বুঝিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে। হারিয়ে যাবে না, গেলেও তো যেতে পারে। অস্তিত্বকে অসাধারণ করার কোন চেষ্টাই তো থাকে না। থলেটাকে মুড়িয়ে যে মাঝে মাঝেই খোলা মুখে হাত গলিয়ে দেয়, দাঁতের গোড়ায় দিয়ে তৃপ্তির রস জিভ দিয়ে টেনে নিয়ে গালের ডানে বাঁয়ে নিয়ে সামনে হাতটা বাড়িয়ে দেয়। মুলামুলি করে দু’পক্ষের সমঝোতায় এলে ঘন নিঃশ্বাস টেনে বলে, ‘ না পোষালে চলবে কেন, ভরদুপুরে চড়া রোদে ঘাম ঝরাচ্ছি এমনি এমনি। এই শহর জীবন দিয়েছে, রুটিও দেবে, প্রাণটা যখন টেনে টেনে নেবে, শ্বাসটা যখন আসবে আর যাবে, তোমাদের মুখগুলোই ভাসবে গো ভাসবে। এন্তেকালের সময় এমনটা হয়, হয়তো, না হলে চলবে কেন? অনিশ্চিত আর অস্বস্তির পৃথিবীতে এমনটা হয়েই থাকে। বাপকেলে ওই যে দোকানটা ছিল ওই চার মাথার দোকানের ডান পাশে কে যে এসে গুঁড়িয়ে দিল, ছিঁটকে গেল ঘটিবাটি, বোয়াম, টিনের কৌটো, ভাঙা কাঠগুলো টুকরো টাকরা হলো, বালতিটা উপুড় হয়ে পড়ে রইল। নোটিশ দিয়েছে তো কর্পোরেশন, কিছু কি করার ছিল, ভিটের মাটি চটকে গেল। হাজার চোখের জমায়েত হলো, যার গেল তার গেল। ওরা তরতর করে পরমুহূর্তেই ছুট্টে চলে গেল, রক্তের নদী বইছে গলগল করে। জব্বরের ছেলেটাই তো সাদিক। দৌড়চ্ছিল এপার ওপার, রাস্তার ডানে বাঁয়ে, চেনাশোনা ছিল না এটা কেমন করে হয়, রোজ আসে, রোজ যায়, হাপুস হুপুশ করে কাঁদে। হাত পা ছড়িয়ে মাথা চাপড়ালে কি আর ছেলে ফিরে আসবে, বুড়ি লোকটা বলেই তো ছিল। এক দল গেল, আর এক দল গেল। কাঁচের আয়নাটা ভেঙে দু’টুকরো হলে ভেবে দেখল, কবর থেকে বেহেস্তের পথটা কতটা লম্বা। ইলেকট্রিক লাইনের থাম্বাটা ধড়াস করে ভাঙা ইটের টুকরোয় পড়ে গড়াগড়ি খেল। চলে তো গেল, এক এক করে লাশ হয়ে গেলে কাফনের সাদা ঢাকনায় লেগে ছিল অসাড় শরীরটা। কত চোখের পানি রাস্তায় রাস্তায় মিশে গেল কেউ জানতেই পারল না। জব্বর রামদাটা ওর ঘাড়ের কাছে কি মনে করে আবার নামিয়ে নিল। দুর্দিনে এমনটাই হয়, কেউ ভিড় পাতলা হলে ফিরেও তাকায় না।

বিলুর এই জিজ্ঞাসা বৃথা যায়নি। কোন ভনিতা না করেই জিজ্ঞেস করল জব্বরকে, ‘চোখের জলের দাম নেই ভেবেছ? যারা ফেলার আয়োজন করছে, তাদের বলতে তো ইচ্ছে হয়, একটুও কি মেপে দেখতে চাও না, কোনটা দামী, চোখের জল না অন্যকিছু?’ ল্যাংড়াকে কেন যে বিলু খুঁজে বেড়াচ্ছে? ল্যাংড়াই বা পালিয়ে মরতে চাইছে কেন? ‘মরতে হয় সকালের সামনে এসে মর, নাকি সব চুরমার করে দিয়ে নতুন করে গড়েপিঠে নিতে চাও।’ সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে কিনা, নাকি মরা মানুষরাই জ্যান্ত মানুষের ভান করে পড়ে আছে। দয়া করে যদি কেউ মর্গে নিয়ে শুইয়ে দিতে পারে। ইচ্ছেটা এমন নাকি, ডুবে যদি যাক সব যাক না, নোয়ার নৌকাটা ভেসে তো বেড়াবে এপাশ ওপাশ যাত্রী তুলে নেবে বলে। ‘সর, সর, তাড়াতাড়ি সরে যাও, পথ খুঁজে নিতে দাও। পথটা আমার বড় জানা দরকার।’ এত তো অলিগলি, কোন গলিতে গেলে কোন জিনিসপত্রের আড়ালে ল্যাংড়া লুকিয়ে আছে কে জানে! পাহাড়প্রমাণ কত তো জিনিস এক একটা মানুষের মাথা গোঁজার জন্য প্রয়োজন হয় কে জানে। অম্লমধুর সম্পর্কে জীবন চলে। উত্থান পতনে আকাশপাতালের শব্দ শোনা যায়। আশংকার ধোঁয়া গলগলিয়ে ওঠে। বিলু কেন যে খুঁজে বেড়ায় ল্যাংটাকে। ‘বহুত হারামি  নয়তো ল্যাংটা।’ প্রথমে ওই লোকগুলোর গল্পগুলো গড়গড়িয়ে বাড়ে। সময়ের বাড়াকমা নিয়ে আজকাল  ওদের গল্পগুলো ওঠানামা করে। কাজের বহর ছেড়ে বাহিরের দোষগুণ ঢুকে পড়ে ফাঁকে ফাঁকে। কোনটা আগে যাবে, কোনটা পেছনে কিছুই বোঝা যায় না।  তবু ওরা বলেই চলে। তর্কের জালে বিতর্কের আড়েবহরে আবারও গল্প খোঁজে। ওদের গল্পগাছায় গল্পের গরু গাছে ওঠে বটে, নিচে নামতে খুব একটা সময় নেয় না, ল্যাংটা কোন আড়ালে গিয়ে পরখ করছে, বোঝার কোনো উপায় থাকে না। শব্দগুলো বিলুর চেনা নয়, নামছে আর উঠছে, পাঁচ নম্বর প্যাকের দু’নম্বর ছানা, ছয় নম্বর প্যাকের জয়পুরিয়া, ধড়াম করে নামছে আর লুপছে। কেমন যেন নামগুলো – কেত্তন, ভোঁদাই, বিটলে, কানমলা, কচি। বিলু হুড়মুড় করে ঢুকল, নামের অর্থ খোঁজার নামাবলী গায়ে জড়াবে, বুঝবেইবা কেমন করে। ‘ও কেত্তন, বৌদিকে ট্রেলারের কাছে নিয়ে যা দিখিনি। যান বৌদি, কোন চিন্তার কারন নেই। ঠিক যেমনটি চাইছেন,তেমনটি বানিয়ে দেবে।’ ‘মানুষকে যদি মনের মতো করে বানিয়ে দিতে পারত।’ ‘তাও পারবে, গিয়েই একবার দেখুন না। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।’ বিলুর মাথাটা ঘুরেই গেল। মানুষ কত জাদু না জানে। তবে ওর চেয়ে কম না বেশি, নজরটা অন্যদিকে ঘুরে গেল। শোনা তো যাচ্ছে, ‘দিদি, একবারটি শুনুন, কেনা দামেই না হয় দেবেন। গরীবদের দিকে তাকিয়ে দেখবেন না। বালবাচ্চা আমাদের ঘরেও আছে। আপনাদের বাচ্চা আদরের ধন, আমাদের বাচ্চা বানের জলে ভেসে এসেছে? দু’টাকা কমই দেবেন।’ ‘দশ টাকা কম দামে দিলে দু’পিস নিতে পারি।’ ‘পোষাবে না দিদি। দেখুন সস্তায় পান কিনা।’ গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন মহিলা। ‘এনারা নাকি ভদ্দরলোক! হবে হয়তো।’ ‘কী বললেন?’ লোকটার মুখ দিয়ে আর কথা সরল না। এক দলা কফ উল্টো দিকে মুখ করে পথের ডান দিকে ছুঁড়ে মারলেন। ভোঁদাই পোলা মাইয়াদের জন্য মিলিয়ে মিশিয়ে সাত আটটা বাক্স মই বেয়ে নিচে নামিয়ে এনে বলল, ‘এগুলা থেকে বাইচ্ছা নিন।’ 

ভোঁদাই বিলুর দিকে ফাঁকতালে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতেই থাকল। ‘ ভাবতেছি কোথায় যেন দেইখেছি আপনারে। এদিকে কী কামে? কাকে খুঁজতে আছেন বুঝি। আপনারে দেখেছি তো রাস্তাঘাটে কী যেন খুঁজতেই থাকেন। লোকে তো আপনারে বিলুপাগলা কয়।’ বিলুর চোখের ভাষায় কোন শব্দ নেই। হঠাৎই বেরিয়ে এল দাঁতের ফাঁকে,’প্রাইভেট গলি’ শব্দ দুটি ফুরুৎ করে, ‘বিলু পাগলা জানল কেমন করে?’

চোখ দুটো বেশ করে ঘুরিয়ে নিল। ‘ জানলা কেমন কইরে?’ ‘যেমন করে তুমি জানলে।’ ‘ঘরের উপর ঘর, তার উপর ঘর।’ ‘সাধে তোমারে লোকে বেআক্বেলে জাদুকর কয়!’ ‘ একটা খবর দিতে পার গো? ল্যাংটার দেখা কোথায় পাই, বল দেখি।’ ‘এই কথা! কত ল্যাংটা লোক চাও। এই যে দুকানঘরগুলো দেখতে আছ, পুরা দিনে কত ল্যাংটা লোক ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়ায়। ভাবতেছ আমি মস্কারা করতে আছি।’ ‘তোমাদের কাঁড়ে লুকিয়ে রাখা নি তো! এই যে কত লোক মুখ বাড়িয়ে আমাকে দেখছিল, ওদের মধ্যে কেউ নেই তো?’ ‘ বিশ্বাস হচ্ছে না, তাহলে চল আমার লগে।’ ‘কোথায়?’ ‘চল না, ওই ল্যাংটা লোকটারে যদি আমি না দেখাইতে পারি, তবে আমি এক বাপের বেটা না।’ ভোঁদা ম্যানাজারের দিকে চেয়ে বলে, দাদা, আমি দুমিনিটের লাইগে একটু আইতে আছি।’

এমন একটা কাণ্ড যে বিলুর কল্পনার বৃত্তে এসে জায়গা দখল করতে পারে, ভাববার অবকাশও ছিল না। তবু ভোঁদাই যে ঘটিয়ে দিয়েছে তা যতটা না চিন্তার ততটাই অচেনার।  লোকটি উলঙ্গ ছিল, মুখ দিয়ে ফেনা বেরচ্ছিল, কিছু কথাও ছুঁড়ে দিচ্ছিল পথচারীদের উপলক্ষে। পাত্তা দিল কি দিল না, সে অবহেলা সরিয়ে রেখে চলনে বলনে এমন ইঙ্গিত করছিল, উড়ে এসে জুড়ে বসা নিয়ে নানা প্রশ্ন। এই জায়গাটা ওদেরই চেনার কথা ছিল। কেউ কি বলতে পারে, কংক্রিটের রাস্তা আর শক্তপোক্ত মজবুত বাড়ি বানানোর দু’বাহুতে তাকতটা কাদের ছিল। ওরা কিন্তু হাসতে হাসতে চলে গেল।  আপাত অন্ধকারে পড়ে পড়ে পায়খানা আর মুতের গন্ধ তার পাকস্থলীর আয়তন বাড়িয়েছে। ভোঁদাই ওর সকাল সন্ধ্যে আর গড়িয়ে পড়া সময়টাকে বিলুকে ফিরিয়ে দিয়ে যাচাই করতে চাইছিল ল্যাংটার অস্তিত্বটা নড়বড়ে কিনা না ওর পথের দিশা ভিন্ন। কথাটা আমল দেওয়ার মতো, ঈশানকোণে মেঘ জমেছে কিনা, তাই বলে নৈঋর্তকোণে আলোর ঝিকিমিকি জমাট বাঁধবে না, কেউ কি জানে! ওরা পুলের বাঁ পাশে জঙ্গলের আগুন থেকে শরীরটাকে বাঁচিয়ে এনে উচ্ছন্নে যেতে বসেছিল, বিটলে আর কানমলা সেই বনের দরজা খুলে একটুখানি জায়গা চেয়ে বসেছিল বলেই না এত টান, এত শোনা কথায় বলে দেওয়া এক লফতে। চেয়েচিন্তে, আস্তাকুঁড়ে হাত গলিয়ে জাঙ্গিয়া পরে লজ্জা থেকে রেহাই মেলেনি। তারামা হোটেলের বাসি ভাত আর কাঁটাকুটায়, পচা তারকারি মুখে পুরেছিল। কে জানবে, কখন কি ঘটবে, বিলুর ঘ্রাণশক্তিটা দিনে দিনে বেড়েছে, মনের কথা শোনাবে না, তা বলে কি হয়! ওরা গা বাঁচিয়ে রাখবে কোথায়! এত সোজা নয় বাপ, দিন দুনিয়ার পাশাখেলা যখন খুশি, তেমন খুশি পালটে পাল্টে যাবে। কত আর খেলবি বাপু, সময়েরও মাপজোক আছে, মনেরও রকমফের আছে। গতির খেলার রঙ দেখেছ, হাঁটা তোমার যত জোরেই হোক, হোঁচট তুমি খাবেই আজ কিংবা কাল, এত জ্ঞানবুদ্ধি বেপথু হলে ল্যাংটারা রাস্তায় নামবেই। মন্ত্র তুমি যতই জপ, পুরোহিত তুমি যতই ডাক, নিদান তুমি যতই দাও, হাতে হাত না ধরলে লিফটে তোমার আগুন ধরবেই। বিলু নিজে থেকেই একটু উলটে পালটে দিল নিজেকে নয়, খোলা শরীরের লোকটাকে। একটুও লজ্জা হয়নি কারও। নিজেকে ঢেকে রাখার আনন্দে কত লাফালাফি, আলাদা প্রমাণ করার কত উন্মাদ উত্তেজনা। কেউ কি ওকে কখনও লাথি মেরে ড্রেনে উল্টে ফেলে দিয়েছিল, ‘যা, যমের দূয়ারে যা, খাবি খেতে খেতে মনের যত গোনাগুণতি আছে সব থলেয় পুরে নে।’ ও একবার জানতে চেয়েছিল কীসের থলে? এত চটজলদি কেন? এখনও অঢেল সময়। আমি তো জানি না, সময় কাকে বলে! সময় তো আমাকে কেউ চেনায় নি। বলতে পারেন বিপদ হবে বলেই ওরা মুখ ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা ধরেছিল। ওই রাস্তাটি নাকি কেউ বানিয়ে দিয়েছে নিজেদের জন্য। কী গর্ব! বুক ফুলিয়ে হাঁটে তাই তো। কী মনের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। আমার রাস্তাটা বড্ড কাঁচা থকথকে, পা ডেবে যায়। ওই মনকাঁটা আছে না। শরীরটাকে জাগিয়ে দু’কথা বলব, সেই বোধটুকু নেই বলে কত ব্যঙ্গই না করেছে, ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমির গল্প আমি জানি না, এটা পুরোপুরি মিথ্যে। মিথ্যে বলেই কত তো সত্যের অপলাপ, শ্মশানের শরীরে কত তফাৎ। ওরা যায় আর আসে। ‘ কে তোরা? ভাগ বসাচ্ছিস। কুত্তার বাচ্চা কারা? ভিক্ষে দিল তো খাবি। ভাগ বাটোয়ারা করে ওয়াগনে করে যাচ্ছে না ঝিকুর ঝিকুর। কতদূর আর যাবি, ইঁদুরকলের ফাঁদ পেতেছে।’ বিলুর কানের পাশ দিয়ে বুনে শুয়োর আর হরিণগুলোর কথাগুলো দাপটে আর মিঁউ মিঁউ করে চলে গেল । ‘কুত্তা’ শব্দটা কানে বাজল বুঝি, নেড়ি কুত্তা,খেঁকি যেই সেই কুত্তা নয়, ওদের লোমে,হাঁটুতে দুর্গন্ধ। আর ওই এলসেশিয়ান, জার্মান শেফার্ড, গ্ৰেহাউন্ড, লাব্রাডর, যেমন মিষ্টি নাম, সুগন্ধ, পটি তো রাস্তার কোণে কোণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। অধিকার, একমাত্র ওদেরই, প্রতিবাদ করেছেন কি মরেছেন। যত দোষ, নন্দ ঘোষ, জেগে জেগে থাকে মানুষের জন্য কত দায়। অজাত কুজাতদের কত দায় ওরা থাকে তুলোর বিছানায়। মানুষ শূয়োরগুলো দিব্যি পড়ে থাকে। ভিখিরিদের আবার জাত বলতে ওই তো একটাই ‘নিচু জংলী। কত কথা ঘেউ  ঘেউ করে বলার স্বাধীনতা আছে না! ওদের দয়ায় বেঁচেবর্তে আছে। প্রমাণ তো করতে হবে, কোথায় আমরা, কোথায় তোরা। বিলু আবারও শরীরটা নেড়েচেড়ে দেখতে চায়, ল্যাংটা কিনা। ভোঁদাই ওর পুরণো বুদ্ধিতে পুরণো কথা মুখ ফসকে বলেই ফেলে, ল্যাংটার নেই বাটপারের ভয়। কী সোন্দর কথা! এই কোথায় আনলি রে ভোঁদাই? গাঁ গাঁ করে চলে যাচ্ছে উড়াল পুলের উপরে কত কত গাড়ি। কী গতি! বারে বা! কী মজার কথা, মজার দৃশ্য!

ভোঁদাই-এর কথার সূত্র ধরে বিলু লোকটাকে উলঙ্গ বলেই সম্বোধন করে। ‘ও ভাই উলঙ্গ, শুনছ আমার কথা।’ বিলুর হাতের ছোঁয়ায় উবুড় হওয়া শরীরটাকে খানিকটা হলেও ঘুরিয়ে নেয় উলঙ্গ। ধুলোর চামড়ায় মোড়ানো চামটি লাগা শরীরটা থেকে কিলবিল করে ওঠে নাম না জানা পোকারা। ওরা কোথা থেকে এলো কীভাবে এল, কেইবা দিল এমন সন্ধান। উলঙ্গ এত সহজে মরতে না চাইলেও এরা বোধ হয় ঠিকই করে ফেলেছে ওরা উলঙ্গ’র চামড়াটাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। ভোঁদাই কথায় কথায় বলেছিল, ‘তখন পুল ছিল না, ফুটপাতের দোকানগুলোর পাশ দিয়ে ছিল হাঁটাচলার রাস্তা। উলঙ্গ দু’পাশ দিয়ে মনের সুখে হেঁটে চলে যেত। জুতোর দোকান, থালা-বাসনের দোকান, কাপড়-চোপড়ের দোকান, ফলমূলের দোকান, মোবাইলের দোকান, পুরনো বইয়ের দোকান, ফ্রেমে বাঁধানো ছবির দোকানে কিছু পয়সাকড়ির বিনিময়ে ফায়ফরমাস খাটত, চলে যেত জীবনটা এইভাবেই দৌড়ঝাঁপ করে। তিনকুলে এমন কেউ ছিল না, ভালোবেসে বলবে যে ‘পাত পেড়ে দুটো ভাত খা।’ এর তার টিফিন কৌটোয় ভাগ বসিয়ে জীবন চলে যেত। উলঙ্গের কদর ছিল সবার ঈর্ষা করার মতো। সকলে বলত, ‘উলু, তোর মরণকালে দেখার মতো আর কেউ থাকবে না, আমরা তো হরিনাম জপতে জপতে ততদিনে উপরে গিয়ে দেবতাদের গা-হাত পা টিপতে হবে। বুঝলি না, আমাদের একুশ ওকুল দুকুলই লাথিঝাঁটা খেয়ে থাকতে হবে।’ সেই মানুষগুলো ঘরে বসে গেছে, ওদের ছেলেরা দুচ্ছারই করত দিনেকালে। পুলটা হয়ে গেলেও উলঙ্গ ওরফে উলু দু’এক পাক খেত এমথা ওমাথা, লম্বালম্বি সোজাসুজি কম বড় তো নয়। পোকাগুলো সব কিলবিল করে উঠছে।   ওরা বাসা বেঁধেছিল কখন কীভাবে কেউ জানে না। ওর নিজের উপলব্ধি ওকে শিখিয়ে দিয়েছে গোপনে মায়ের গর্ভের কথা। উলঙ্গকে ওরা নাড়ী কাটার সময় থেকেই কুট কুট করে খেতে শুরু করেছে। কেমন করে খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে রপ্তও করেছে। শুধু কি তাই! কৌশলকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যত পদ্ধতি ছিল পরীক্ষা করে করে রপ্তও করেছে। উলঙ্গরা বুঝতেই পারে নি । মধ্যরাত থেকে শুনে নিয়েছে মৃত্যঘন্টা। ভোর না হতেই মৃত্যুভাবকে প্রয়োগও করেছে। কী বলবে, কেমন করে বলবে আর কি বলতে চায় সেই শব্দগুলো জানা ছিল না বলে ছন্দ আর সুরকে বাতাসে ছেড়ে দিয়ে বলেছে ,’এই তো আমি।’ উলঙ্গ ওর নিজের গায়ে হাত বুলিয়ে জন্ম মৃত্যর ব্যবধানে নিজেকে দাঁড় করিয়ে শুনেছিল মৃত্যুর ঘন্টাধ্বনি। সেই কথা আর সুরগুলো ছিল অভিনব। ওই জনতার বৃত্ত থেকে উঠে এসেছিল সেই কথারূপ। বলতে চাইছিল এক, হয়ে গেল অন্যকথা। উলঙ্গ কি তবে নিজেকে চিনতেই পারছে না! ও ভুল করে আপন মনে গজিয়ে ওঠা গাছটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিল ওই গাছের পাতাগুলো সবুজই-বা হয় কেন, ধীরে আরও ধীরে হলদে হয়ে নিজেকে আবার পাল্টে ফেলছে কেন? একসময় স্বরগুলো থেমে যেতে চায়, সুরগুলো হারতে হারতে জিতে যায়। উলঙ্গ আর নিজেকে নিজের মতো করে দেখতে চায় না। ওর চোখের জ্যোতি উজ্জ্বল হয়ে উঠলে ভাবে ‘এই তো আমি? আমি কি পৃথিবীর অধীস্বর! তবে এরা কারা! ওরা ফিসফিসিয়ে সনহনিয়ে কথা বলে উঠেছে কেন? হনহনিয়ে চলে যেতে চাইছে কেন অনেকদূর। ওরা কতকিছুই তো মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে! তাতে ছিল বুঝি আমারও শরীর। উলঙ্গ ওর আত্মপরিচয়কে এইভাবেই খুঁজতে চায়। আর ও একবার দৌড়ে চলে গিয়ে হাত দুটো উপরের দিকে তুলে গোটা শরীরটাকে নিয়ে পাক খেয়ে জেনে নিতে চায় আবারও,’ওরা কারা! ওরা জাল বুনছে কেন? গোটা জাল ছড়িয়ে ওদের বন্দী করবে বলে!’ প্রশ্ন করে ফেলে উত্তরটা আশার আগেই কেমন হারিয়ে গেল? ওরা উলঙ্গের দিকে তাকাচ্ছে কেন? যেমন করে তাকালে ওর নিজেকে আপন আপন মনে হতো। ওর অন্য বন্ধুগুলোকেও তো ওরা সমান তিরস্কার করল। ওরা কি তবে ভুলে গেছে আরও অসংখ্য পা এইভাবেই দৌড়চ্ছে। এতক্ষণ বিলু ওর ভাবনাগুলো নিজের মতো করে নিজেই টেনে নিয়ে আসল। বিলু দেখে নিতে চাইল, জগৎটা কেমন দাঁড়িয়ে পরে, একসময় নিজের মতো করে থেমে যায়। বড় আজব কান্ড তো! উলঙ্গকে ঘিরে থাকা গুয়েপোকাগুলো ওকে রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে। বিলুর সেই চোখের আলোতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ওরা কেমন করে ভাবছে! উলঙ্গের প্রৌড় বন্ধুগুলো নুব্জ্য হয়ে যাচ্ছে। উলঙ্গদের বামন করে দিয়ে ওরা সুখের পালঙ্কে শুয়ে শুয়ে শীতসন্ধ্যায় মুড়িয়ে ফেলছে রাজকীয় কম্বলে। সুখই সুখ! আরামই আরাম! একবারও প্রশ্ন করছে না, ‘উলঙ্গ তোরা থরথর করে কাঁপছিস কন? বিলু ওর বাবার কাছ থেকে শেখা শব্দটাই বলতে চাইল ‘স্ক্রাউন্ডেল’ কোত্থেকে শিখলে কী জানি! নাকি ওদের শেখানো শব্দটাই ওদের ফিরিয়ে দিল। বিলুর মনের মধ্যে অন্য আরও ঘৃণ্য শব্দের জন্ম হচ্ছে বটে। ওরা দাবিয়ে রাখার জন্য যে শব্দগুলো আবিষ্কার করেছিল বিলুর মনের মধ্যেই সেই শব্দগুলোর নতুন করে জন্ম হচ্ছে। কী যেন নাম দেওয়া যায়? উলঙ্গ তখন বলতে পারত, ও বোধ হয় বলতে শেখেনি। জবাবটা নিজের মনের মতো করেই দিতে পারত। ‘এই উলঙ্গ দিতে পারবি তুই, খুঁজে পাবি সেই আগুনখোর শব্দ?’ ছি ছি উলঙ্গকে ও তুই করে বলছে কেন? ল্যাংটাকে খুঁজে না পেয়েই ওর মনের বিকার! ল্যাংটাকে খুঁজে বের করতেই হবে যেই করে হোক। ‘ ও উলঙ্গদা, তুমি বোধ হয় বলতে শেখনি?’ বিলু প্রথম ওকে ‘দাদা’ বলে সম্বোধন করল।  উলঙ্গ কী শুনতে পেল! এতটা সহজ নয় উত্তরটা। ও কতদিন ধরে শুনতে পারছে না এই প্রশ্নের জবাবই কে দেবে? সামাল দেওয়াও তাহলে কঠিন হয়ে যাবে না তো! উলঙ্গের পেট আর মন মিলিয়ে ও বুঝতেই পারছিল না এ কেমন পৃথিবী! কি জানি বড্ড চুলকাচ্ছে হয়তো। বিলু ওর গা-টা চুলকাতে যায়। গুয়েপোকাগুলো ওর নখ ছুঁয়ে আঙুল বেয়ে গোড়ালি বরাবর কনুইতে চলে আসার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়।  ‘আহাঃ করছটা কি।’ কথাটা ভোঁদাই বলে ফেলেও দাঁতে কাটল। বুঝতে তো ও পারেনি বিলু আসলে কী করতে চাইছিল। শহর জুড়ে সব পয়সাওয়ালাদের ছেড়ে ওই গুয়েপোকারা কেমন করে এই শহরের বাকিদের শরীরে গা বেয়ে বেয়ে চলে আর কেনই বা চলে আর কারাইবা ওদের ছেড়ে দেয়, দেখার বড় সখ বিলুর। বিলুর রঙঢঙ কেন এমন হল এমন প্রশ্ন ওকে তাড়া করে বেড়ায় নি, কেমন করে বলে! চঞ্চল ওর পেছনে ঘুরঘুর করলেও অপরের মাস্তানি নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলে দিত। আর ওই ডানা ঝাপটানো কালো কালো পাখিদের কথা বলতে গেলে আর শেষ হবে না। এত দেখে, তবু দেখার সাধ মেটে না, যখন তখন যেখানে সেখানে ঢুকে পড়ে, ঝাড়ুদার না মাইন্দার কে জানে। একবার ভাবতে বসলে দ্বিতীয়বার চেহারা আর হাঁকডাক করে এমন ধারা করে ঝাঁটা নিয়ে তাড়া খেলে দুজন দুজনায় কী কথা হয ও়রাই জানে ‘মানুষগুলা মোদের বুঝতে পারলনি গো। এশহর ছেড়ে অন্য শহরে যাব নাকি হে, জেবনটা গোটাটাই নাকি মিছে। মিছে কথা বলব নি, এই উলু দাদাদের দুঃখটায় আগুন জ্বলে যায়। মাইনষে মোদের সাথে বন্ধুত্ব পাতাল নি, অথচ মিলমিশ করে থাকতি চাইলেও তাড়াতি চায়। ওই সব পেয়েছির দেশের নোকেরা ওদের সাথে যেমন পারা করে। কত করে বলি ওই বড়বাবুদের, ‘এই শহরটা মোদের সক্কলার, মোদের ছাড়া তোমরা বাঁচবেক নাই, এই কথাখান বুঝে নাও, মনের ভেতরে গেঁথে নাও।’ ওরা হো হো করে হাসে। বলে, ‘পালা পালা।’ ‘বলি গুয়েপোকার গন্ধ যেদিন শুঁকতি হবে, বুঝি যাবে ওইদিন কত ধানে কত চাল। এটা ভালো করে বুঝি নাও, দ্যাশটার মালিক বল, আর মালকিন বল, মোদের বাদ দিবা কোন সাহসে।’ ভোঁদাই বলে, ‘এই শহরটা আমাগো রক্তে গড়া, তোমরা রাজা সাইজলে কেমন কইরা, দেখবা না মজাখান। মৌজ করতে চাও, যত খুশি কর, বাপের নাম খগেন হইলে টেরটি পাবা।’ উলঙ্গের পিঠ যত চুলকায়, গুয়েপোকাগুলো বিলুর গা ছেড়ে নেমে পিচ রাস্তায় নেমে খেলা করতে শুরু করে।

   সপ্তম অধ্যায়

কালভার্টটায় ফাটল ধরলে পিলে চমকে যায় কাকটার। কাকে বাঁচাবে আর কাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখবে এই নিয়ে চিন্তার কি অন্ত আছে! যে শূন্যস্থান এসে সামনে হাজির হয়েছে, ঐ যে দেখতে পারছেন ছয় সাত বছরের শিশু, পোঁদ ঘষটে ঘষটে চোখের জল ফেলতে ফেলতে একটা ল্য্যবঞ্চুচের বায়না করে মৃত্যু ফাঁদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেছিল, ভাগ্যিস ওই রেলযাত্রীটা কোলে তুলে নিয়েছিল, চুমু খেতে চেয়েছিল ধুলোমাখা মুখে, না হলে বিপদ ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারত। জানেন বোধ হয় সকলে, কত বছরের পুরনো। মনে পড়ে তো সেই দিনটার কথা, দৌড়ে ছুটে এসে প্ল্যাটফর্মের কোলঘেঁষে ট্রেনটার কামরার গেইটটা ধরে পাদানিতে পা-টা ছোঁয়াবে বলে হাঁপাচ্ছে হুপহাপ করে, কাকটা বোধ হয় দেখে ফেলে স্বরটাকে একটু আধটু পাল্টে নিয়েছিল। ওরাও অর্থাৎ ওই ছোট্ট ছোট্ট মুখগুলো চেয়ে চেয়ে দেখেছিল ওই ডালের উপর ঠ্যাংগুলো চিপকে থাকা ওদের ওই অজানা অচেনা না বোঝা বন্ধুটিকে, পরম বন্ধু, একা হয়ে থাকা মানুষ, না না-মানুষটিকে। মানুষ কাকে বলে, কেমন করে মানুষ হতে হয়, ওদের তো জানার কথা নয়। ওদের মায়েরা এখন কোথায় যে যায়, ওরা তো জানে না, ওরা তো চোখে ঘুম মেখে  বসে আছে, ওরা তো জানতে পারে না, একটু পরেই তো গু মেখে ঢুকে যাবে সুড়ঙ্গে। ওই আর কি ওদের জন্মস্থান, জন্মভূমিতে, আঁধার যেখানে লেপ্টে থাকে সারাক্ষণ, কখন চুপি চুপি এসে মহাযোজন দূর থেকে চলে আসা আঁকাবাঁকা আলোর বিন্দুগুলো এসে জমাট বাঁধবে, ওরা এক এক করে নিজেদের মুখগুলো চিনে ফেলবে, হি হি করে হেসে ফেললে হাসিগুলো এক হয়ে গেলে ওরা অবাক চোখে প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজবে, ওরা কারা! আর ওরাই বা কারা! আর ওই অনেক দূরের মুখগুলোই বা কারা! সেদিন বাসি গায়ে মায়ের বাজুতে জাপটে প্যান্ডেলের বাইরে এসে অপেক্ষা করেছিল ঘন্টা পার করে ওদের মায়েরা। কোথায় যে ওরা দাঁড়ায়? কেন যে ওরা দাঁড়ায়? পাঁচিলের কাছে ভুটভুট করে জলের ফোয়ারা ছিটকে যাচ্ছিল রাস্তাটা, রাস্তার কফ আর থুথুর দলা জলের সঙ্গে মিশে গিয়ে অনয়াসে চলে আসছিল খাবারের ডাব্বার কাছাকাছি,খেটেখুটে আসা এক পেট খিদে নিয়ে গোগ্ৰাসে গিলতে গিলতে বলেছিল ‘ নে খা, নে নে।’ ‘দেবে তো! তবে দাও।’ 

বিলু দেখেও দেখতে চায় না। ঘুরেফিরে নিজের ঘরেই ফিরতে চায়। কাকে নিজের আলয় বললে ওর মনের তৃপ্তি হবে, এই প্রশ্ন নিজের মনে জেগে উঠলেও থেমে যেতে চায়। এই আশ্চর্য প্রশ্নটির উত্তরের আশায় ও কোন গর্ভগৃহে যাবে। সুড়ঙ্গগুলো কোন জাদুকর নিজের মনের মতো গড়ে তুলেছে সেই তো আর এক সময়। দেখেছিল হয়ত এমন কেউ, ভাঙা গালে আর বিষন্ন চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জীর্ণ সময়ের এক কোনে, দু’চোখে ছানি নিয়ে নাতি-নাতকুরদের দেখছে চোখেরই পর্দায়। ওরা হুশ করে যায়, হুশ করে আসে। সেদিনই তো হল, ভাঁজ হয়ে চলা পেটের এক কোনে নাতনিকে কোলে নিয়ে কেঁপে উঠেছিল ওর শরীর। গল্পটা শুনেছিল বলেই না, আদিম এক প্রবৃত্তি নিয়ে খেলে বেড়িয়েছিল এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত, ঐটুকুনি শরীর থেকে ঝরেছিল রক্তের দলা, মাথাটা ঘুরেই গিয়েছিল দিনু ঢুলির। জলও গড়িয়েছিল একটু একটু করে। নাতনী ওর সঙ্গীসাথী নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চোখের নিমেষে যখন প্ল্যাটফর্মের কালভার্টগুলো পার হয়ে গেল, বুঝতেই পারল না মালগাড়িটা ঝিকুর ঝিকুর শব্দ তুলে চাকার ঘর্ষণে এইদিকেই তাক করে আছে। দু’চারটে ধেড়ে ইঁদুর আর ভোঁদর ফাঁকতালে গুলু গুলু চোখে বগির নিচ দিয়ে কেমন স্বচ্ছন্দে পার হয়ে গেল। দিনু’র নাতনি কালিমনির দুই নাতির হাত ধরে অনায়াসে ঠিক সময়েই পাশাপাশি সুড়ঙ্গে ঢুকে গেল। ওদের চেয়ে আর একটু বড় কালা আর ধলা নিজেদের মধ্যে বাবুদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে পাওয়া আট আনি নিয়ে হুজ্জতি করতেই বলে গেল ওদের পাড়াটায় বিদঘুটে সব জীবজন্তুর উৎপাত শুরু হয়েছে। বিলুর আবার পাগলামির ইচ্ছেটা চাগাড় দিয়ে উঠল। বসন্তের বিস্কুটের বয়ামে হাত ঢুকিয়ে লেরি বিস্কুটটা তুলে যেই না হাত ঢোকাতে যাবে তাকিয়ে দেখল নেড়ি কুত্তাটা জিভ লকলক করে চেয়ে আছে। আয় তু তু করে ডাকতেই দেখল লখাই পকপক করে দেখছে। এই লখাইকে দেখেছিল কাল রাতেই বিশুদের পাড়ার মোড়ে দোকানের জায়গা দখল করা নিয়ে রক্তারক্তি, মাথা ফেটে চৌচির। ওকে যে কোন দল হুজ্জতি করবে বলে মাঝরাতে হাঁকাহাঁকি ডাকডাকি করে তুলে নিয়ে গেছিল, সেই নিয়ে পাড়া কাঁপিয়ে দোচালা থেকে হাত পা ছুঁড়ে সেই যে কান্না, সেই কি আর থামে, না থামতে চায়। লখাইয়ের হাতটা ধারালো ছুরির পোঁচে সেই যে চিরে গেল, দাগটা গভীর ক্ষত হয়ে হয়েছে দগদগে ঘা। বিলুর টানটা বেড়েই যায়, আধ টুকরো কুকুরটার মুখে পুরে বাকি আধ টুকরো লখাইয়ের গায়ের কাছে গিয়ে বলে, ‘নে খা।’ বিলু গায়ে গতরে কত তো খেটেছিল, রেলের এই বাড়িটা তরতর করে যখন বেড়ে উঠছিল, তাই তো এত টান, রোজই তো পালা করে পাহারা দেওয়া,চুরিচামারি হয় কিনা, অতন্দ্র প্রহরীর মতো পড়েই তো ছিল। দুষ্টুমি করতে করতেই সেই উদোম গায়ের ছেলেগুলোর সঙ্গে চেনাশোনা। কোথায় যে গেল, গেল হয়ত মাটির নিচে চাপা পড়ে, বিলুর দৃষ্টির আড়ালেই ঘটেছিল। কত কিছুই তো ঘটে যায় অজান্তে। মানুষরাও বন্য জন্তুর মতো চলে যায় গোপন গভীরে, কেউ দেখে, কেউ দেখে না, কারো পায়ের তলায় জমি সরে গিয়ে লাফিয়ে ওঠে, বিলু তো তাই মনে করে। 

চঞ্চলকে তাই তো নিজের ঘর সংসার চেনাতে চেয়েছিল বিলু। ঘর সংসার বলতে চঞ্চল বুঝেছিল ঘর, আসবাবপত্র, জঞ্জাল, এমন এক ধাতুতে গড়া জীবন, যাকে দেখাও যায়, অনুভব করা যায়, তার স্পর্শে মন চনমন করে ওঠে, হৃদয়ের আন্দোলনে বিস্ফোরণ ঘটে, এই শহরের আদুল গায়ের মানুষদের সেইভাবেই চিনেছিল ও। কী আর বলবে, বলতে বলতে বলেই ফেলেছিল, ‘ কে ভাববে আমাদের কথা, কোনদিন চিনতে গিয়ে চলে যাবে, কোন এক পরদেশে, দেখে ফেলে বলবে,’ এই তো আমাদের দেশ, চিনতে পারিনি বুঝি, কেন পারি নি, কোন পথে হাঁটি নি, হাঁটা উচিত ছিল, তাই তো এত দুরবস্থা! পরিত্রান মেলেনি তো। ‘ আচ্ছা মিলবে কেমন করে, তাই তো এত সাদা চোখে এত সাদা আলো, কেমন অদ্ভুত না। চঞ্চল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে, জড়িয়ে জড়িয়ে ধরে। নদী ওর কাছে উন্মত্ত মনে হয়, পাড়ের গাছগুলো কথা বলে তো, মনের মতো কথা বলে, যারা ওদের তলায় লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে ‘বড় নিশ্চিন্তে আছি, লম্বা করে শ্বাস নিচ্ছি, যত গোলমাল বাড়ে হাত বাড়ালেই, যত দুঃখ হয়, যন্ত্রণাটা চাগাড় দিলেই।’ গরমে সিদ্ধ হয়ে যাই, একটুখানি সরে গেলেই দূর দূর করে তাড়া মারে কিনা। ওরা ভাবে কাঙালগুলোর জন্য আঁধার নামলেই পোড়ো বাড়ির ভাঙা ভাঙা ইটের টুকরোগুলোতে গুঁতো খাওয়া। তাড়া খাওয়া গরুগুলো ছুট লাগায়, পই পই করে ছোটে, সেই ছোটা কেউ যদি দেখেছে, কানে তো দুঃখের শব্দগুলো তো বাজছে, সমান তালে তো বাজছে না, কোনটা মনে হচ্ছে দূরে, কোনটা কাছে। সুখের রঙগুলো চিনবে না তাই বলে। ‘আচ্ছা বলেন দেখি তারও তো কত রকমফের, এই যায়, এই আসে, পোড়া পোড়া, মরা মরা, পচা পচা, কাদা, কাদা, ফেনা ফেনা, সুখের রঙের কথা তো বলে শেষ করা যায় না, দূরের রঙ কত কমলা, কাছের রঙ কত হলুদ, চেনা অচেনার দেয়াল ভাঙলে ওদের কোন টান টান ভাব নেই, শুধু আধপেটা নাড়িভুঁড়িতে কত তো ক্ষত চিহ্ন। তাই বলে চঞ্চল দৌড়বে না, দৌড়বে। পায় না বলেই তো খাবলে খাবলে খেতে চায় এখানে সেখানে।’ 

অটল তো বিন্দুর মধ্যে বৃত্ত খোঁজে, তাই তো শুয়ে শুয়ে কান পেতে শোনে। ওদের যখন লাথ মেরে কত উঁচু তলা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় পান থেকে চুন খসলেই, ওদের চোখে কী তখন জল থাকে! ওরা জানে আজ না হয় কাল ওদের কেউ ঠেলে ফেলে দেবেই। রাখবে তো না, রাখবে কেন! রাখলেই তো বিপদ। অটল ভাবে ‘বিপদ! বিপদ আবার কি কোন শব্দ!’ তাই তো ওদের বারণ ও শূনতে চেয়েও কানে আঙুল দেয়। ওরা আবার ঘন ঘন মৃত্যুর শব্দ শোনে, ওই লোকগুলো ওদের তাড়িয়ে শহর ছাড়া করবে। অটল ওই ষড়যন্ত্রের কারণ খুঁজতে চেয়েও কোন কূলকিনারা পায় না। ওদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করে বলে, ‘এখনও সময়ের খেলাধুলা অনেক রে বাকি। ঘাবড়ানোর কোন কারণ তো ঘটেনি। আনন্দের নানা বাজনা ঘন্টা কাঁসর ঢাক ঢোল বাজবে, হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাবে অনেক দূর। এমন হাসি হাসবে, তাই বলে পেটে খিল ধরবে না, তাই কখনও হয়!’  ওরা তবু অটলের হাতে হাত রেখে বিশ্বাসের জায়গাটা মজবুত রাখতে চায়। ‘যাব যখন যাব, নিজেদের উত্তরসূরিদের জন্য কথার বাঁধটাও তৈরি করে যাব। কি জানি কখন বানের জলে যদি ভেসে যায়? ফন্দি তো আঁটছে ষোল আনা। কত তো অস্রশস্র, কত তো ছল চাতুরী, না হলে কি আর এমনটা হয়! এমন পিছুই বা হঠবে কে?’ না হলে চঞ্চলের চেনা লোকগুলো কেমন করে এত অচেনা হয়ে যায় অটলের কাছে। অটল ওর এত কাছে থেকেও বুঝতে পারে না চঞ্চল কেন মানুষগুলোর ছোঁয়া পেতে চায় ? কেন দূরকে ও নিকট করতে পারে না এত ভাবনার বহরে ? কল্পনার নীরব যাত্রা কি পায়ে জায়গা পেতে পারে না? ধরে‌ ফেলতে হবে, ধরার জায়গাটাও করে দিতে হবে। ‘তোমরা এত ভাব কেন?’ ,’ কী বল হে,  দুনিয়াটা তো ভাবনার জগৎ থেকে আসে। খসে খসে পড়বে তো। না পড়লে কী বাঁচার উপায় আছে? নতুন ডালপালা গজাবে কেমন করে?’ ওরা বলে, আর দিনে দিনে কুঁজো হয়ে চলে। ‘কী অদ্ভুত জীবন না? একে শুধু সাজালে তো হবে না, মনের মতো করে সাজাতে হবে। সে সাজানোটা কেমন?’ ‘বেদনার বলছেন, না করুণার।  এগিয়ে যাবেন, না থেমে থাকাও অভ্যাস করবেন। একটু থেমে আবার চলবেন?’  ‘ মনে বড় কষ্ট বুঝলেন।’ ‘এই কষ্টের শুরু কবে থেকে?’ ‘চেপে বসে আছে, শক্তপোক্ত হয়ে। দিনটা কি মনে আছে! কে কবে এসে পুঁতে দিয়ে গেছে চারাগাছটি, গজায়নি যে ঠিকঠাক। লোকে বলে, ‘দূর হট।’ ‘বলি, এ কী তোর বাপের রাস্তা? হাঁটব তো হাঁটব, বুক চিতিয়ে হাঁটব। আপনাদের কারও কিছু বলার আছে?’ ‘কথা তো বলতে চাই, তা-ও বলতে চাই, মনের মতো। কাঁচুমাচু হয়ে শুয়েছিলাম রাতটুকু, একটুও জায়গা ছিল না।’ ‘ছুটছ কেন গো? কেউ কি তাড়া মারছে?’ বুনে শেয়ালরা জড় হয়েছে যে। কত তো অঙ্ক! এমন অঙ্ক কখনও শুনি নি গো। ‘শুভঙ্করি আর্যা’র কথা শোন নি,?’ ‘কে কার কথা শোনে? মাথাটা ঘোরাচ্ছে বুঝি। ঔষধটা সময়ে সময়ে খেয়ো কিন্তু।’ ‘ মানুষকে এমন করে ভালবাসতে তোমার একটুখানি কষ্ট হয় না? কত তো গল্প তোমার পেটে পেটে। একটু গালে আবার চুমু খেতে দেবে?’ ‘অটলদা এ-আবার শোনালে গো কেমন কথা?’

 ‘লোকটা এমন করে চলে যাচ্ছে কেন? ওর কি মরণ হয়েছে? চালচলন ভাল নয় গো, ভালোবাসা ভিক্ষে চেয়েছে, কেউ দেয়নি যে। খালি বলে, নিজে খাব, নিজে পরব। জোটে না গো, শয়ে শয়ে লোক পায়ে হাঁটতে চায়।’ ‘হাসব বুঝি একটু, কেউ কারো দিকে তাকায়‌ না। ফিরেও চায় না। কালকে ওরা আমার বউদিকে পিটিয়েছিল। বলতে পার, তুমি জান কি আমার কাছে কী ধন আছে? সব নাকি লুটপাট করে নেবে। আমাদের ঘরছাড়াতেই ওদের আনন্দ। এক টুকরো মাটিও দেয়নি যে।’ জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘কেন দেব?’ কাকে প্রশ্ন করা যায় বলো তো? বক্তৃতার বহরখানা দেখ, স্বর্গের দূত যেন। আজরাইল গো, উদ্ধার করে তবে নাকি যাবে। অটল তো চঞ্চলকে দু’চামচ ভাত দিয়ে বলেছিল, ‘তোর আর একটু লাগবে, আর একটু চাই নাকি!’ ধোঁয়াটা একটু আগেই গলগল করে উঠেছিল। পোষ মানানো কী যায়! এঘর থেকে ওঘরে যায়, কত গল্পস্বল্প করে আবার তো ফিরে আসে। ফিরে ফিরে আসে। অচেতন, ঘুম, আধা ঘুম, ঘোরে থাকে, আধা ঘোরে থাকে। আচ্ছা বল দেখি,’তাপটা না উঠলে চালটা ফুটবে কেমন করে? আধা সেদ্ধ ভাত কি খাওয়া যায়?’ ওরা বলে, ‘খাওয়া যায়। খেতে অভ্যাস কর, খেতে খেতে সব শিখে যাবি। 

অটলের কি হয়েছে ও নাকি কোন কিছু চিনতে পারছে না, সব কিছু ঘোর অন্ধকার লাগে। দেখতো চঞ্চল যে দিকে তাকায়, কোথাও নাকি একটুও কালো নেই। ও বিশ্বাস করে আর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে সকল কিছু ভাঙচুর হয়ে সব নাকি নতুন হয়ে যাচ্ছে। কি জানি কেন ওর মনে নয় আর তাতেই নাকি ওর সকল কিছুকেই আদর করতে ইচ্ছে করে। আরে ও তাই বলে যেখানে যায়, জড়িয়ে মড়িয়ে যায়, এই এক পাগল ছেলে। কথাটা কি জান, পাগলের অভিনয়টা করতেই শেখেনি, ও নাকি আবার জ্যান্ত মানুষ চায়, যাকে পায়, তাকে ছোঁয়। কান্ডখানা দেখনি। এমন মানুষ পাবে কেমন করে! না, না, বুঝলে না, সব কেমন অগোছালো। আমার মাথাটা দেখেছ কেমন বড় বড়, লোকে বলে তাই নাকি আমার এত বুদ্ধি। ও আমাকে বিলুর গল্প বলে। বিলুকে ও যেমন করে দেখেছে, তেমন করে আর কেউ দেখে নি। ও আবার নাকি সবকিছু সব ঘেঁটে ঘেঁটে দেখে। ‘আচ্ছা, আপনারাই বলুন, আমি এমন করে দেখতে শিখিনি তো! এই তো  এক আজব কাণ্ড কারখানা। ওরা নাকি প্রবল তান্ডব থেকে রেহাই পেতে অগ্ৰিম বায়না ধরেছিল যদি জীবনের উষ্ণতাকে বাড়িয়ে নিয়ে চলে যেতে পারে কয়েক ধাপ, অভিশপ্ত সময় থেকে রেহাই পেয়ে ইচ্ছেগুলোকে ওলট পালট করে দিতে পারে। যারা ছুটে আসছিল সীমানার ওপারে গিয়ে দেখে নেবে, আর কতটা উঁচুতে উঠলে চিনে নিতে পারবে পূর্বসূরিরা কোথায় কেমন করে বসেছিল, কী ছিল তাদের অভিপ্রায়? ওদের মাথার খুলিটা ধরে ওরাই নাড়িয়ে দেখল, কতটা বোঝা  পিঠে চাপিয়ে দিলে মাথাটাকে রেহাই দিতে পারবে! অটল এই গোপন ইচ্ছেটা জানিয়ে দিচ্ছিল পথেঘাটে, মোড়ের মাথায়, গোলপোস্টের কিনারে, বার্তাবাহকদের গন্তব্যস্থলে। 

‘মুক্তি!’ শব্দটা জোরে এসে ধাক্কা মারল কেন, মুহূর্তটাকে বোধে আনতেই সময় ক্ষয় করে ফেলল অনেকটা। চঞ্চলকে এই বলে কথার লড়াই চালালে কতটা ওর ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতে পারল এই নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করলে যেই উত্তরটার জন্ম হল, ‘ পাওয়ার কথা কি ছিল, তবুও তো পেলি, আর দু-ঘন্টা বেগার খেটে দে। গরু ছাগলরা ঘুরে মরছে, তোরা কোন জমিদারের বেটা?’ ওরা কাঁদল, খুব কাঁদল, পথ খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল, নিজের ভাষাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ দেরি হোক তাও সই।’ চোখ বড় বড় করে বলল, ‘ভাবখানা ভুলেছি বেশ করেছি, মায়াদয়ার কোমল স্থানগুলোতে পট্টি পরিয়েছি, এর চেয়ে বেশি রোগদের  নেমন্তন্ন তো করি নি। অটল হাঁক লাগাল, ‘ধীরে চল বাপু, গোলামি থেকে এত সহজে মুক্তি পাবে, এই কথাটা তোমাদের কে বলেছে? ষণ্ডাগুণ্ডাদের যা উৎপাত, থলে কেড়ে নেবে, পকেট কেটে ফাঁক করে দেবে, তাতেও কি রক্ষা মিলবে, তোমার ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে চোখ টাটাবে। বলবে এত নাচানাচি করিস না বাপ, বাজারঘাট করে দিস, থালাবাসন মেজে মুছে দিস, ফায় ফরমাস না খাটলে চলবে কেন? এই যে দু’চার পয়সা তারা দয়া-দাক্ষিণ্য করে হাতে গুঁজে দিলেন তোরা ধন্য ধন্য করিস, ওই টাকার মালিক কে জানিস?’ দু’আঙুলের টুসকি মেরে বলে, ‘ওটা আমাদের!’ ‘তোমরা আমাদের নয়, কাদের তাহলে ? এই দেশে থাক কেন? কে তোমাদের থাকতে বলেছে?’ ‘এত জ্ঞানগম্মী তোমার অটলদা। এত বুদ্ধি তুমি কি ধার করেছ, না সবটাই নিজের?’ এই কথাটা তো ভেবে দেখেনি কখনও। কার মাথায় কখন যে কি এসে যায়। আহা, এমন কথার যদি কোনদিন সামনে এসে বলাবলি করত, ‘ আয়, আয় ওই তো সব সুখের দিন আসছে, গোটা দেশটাই অহল্যার মতো উদ্ধার পেয়ে যাবে একদিন।’ ওরা সক্বলে অটলের কথা শুনে হো হো করে হাসলো, না কাঁদল, কিছুই বোঝা গেল না।

ডান হাতে লাঠিটা বন বন করে ঘোরাতে গিয়ে শুনে ফেলল, ‘ কারা যেন কান্না করছে।’ যারা মাঝে মাঝেই ওর পিছু নেয়, রহস্য করে বলতে শুরু করে, ‘পৃথিবীটাই কাঁদছে বোধ হয়।’ নিষ্ঠুরতার থেকেই জন্ম নেয় আর এক কান্নার। বিলুর কিন্তু তা মনে হল না। এমন কান্নার স্রোতে ও জীবনে কোনদিন ভেসে যায়নি। শোনা যাচ্ছে, অথচ শোনা যাচ্ছে না, নিজের মতো করে একটা আকারের আয়োজন করছে। বিরুপ রুপে ওরা যে ধরা দিতে চায়, সেটা গৌরবের না অনাসক্ত, তাদের চোখের জল ওদেরও অজানা, তাদের জন্য তারাই বা কতটুকু জানে। বিলুর মায়ায় যারা পথের ইশারায় মাতে তাদেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিলুর পায়চারিটা আজ অন্যরকম, বেসামাল, বেঘোরে। চিন্তায় কোন দৈন্যতা এসে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে কিনা কে জানে। কালভার্টের ভাঙাচোরা টুকরোগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে ধোঁয়া উড়ছে গলগল করে। ওদের পাতা ঘর সংসার গুলোতে আঁধারের কোনে কোনে টুকরো টুকরো আলোগুলো উঁকিঝুঁকি দেয়। পিলপিল করে বেরিয়ে আসে কিশোর কিশোরীদের দল। ওরা ডাংগুলি খেলতে খেলতে দলে দলে ভাগ হয়ে গেলে শক্তির উচ্ছাসে ফেটে পড়তে দেখে ভাবতে কষ্ট হয় ওদের আধপেটা খাইয়ে একা করে দিয়ে চলে গেছে এঘর থেকে ওঘরের মানুষজন। বিলুর চিন্তার ধরণেও এক আশ্চর্য পরিবর্তন এসেছে। কেন এল, কীসের জন্য এই ভাব পরিবর্তন, এই প্রশ্নে অনেকে নিরুত্তর। মানুষ যায়, মানুষ আসে,  হুড়মুড় করে মানুষের জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। ওরাও ছুঁচো আর ইঁদুর হয়ে ঘর-গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। কেউ কাউকে সোনা মনা ধনা নানা নামে ডাকাডাকি করে, তারপরে পচা পেটের গন্ধে চারপাশের রাতের বাতাস আরও বিষাক্ত হয়ে এলে ওই কোন অঞ্চল থেকে তিন চারটে লাইন বরাবর শুধুই রেল ইঞ্জিন, মালগাড়ি, মানুষের গাড়িগুলো নিজের থামা-চলার কাজ সেরে গড়াতে আরম্ভ করে। ওরা ঘর-গর্ত থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে যেতে আরম্ভ করলে বিলুর দলের মনে হতে থাকে জীবনটা শুরু হয়ে গেছে। ওর ছড়ির জাদুখেলা কীভাবে শুরু হয়ে যাবে কেউ জানে না, শহরটাও জানে না। পেঁ পোঁ, ভটর ভটর, ঘ্যাঁচ ঘুঁচ, ঝিকঝাক, মচর মচর, টুং টাং ওরা সব নানা বৃত্তে যে খেলা শুরু করে, ঘর-গর্তের মানুষ-জন্তুরাও জড়িয়ে পড়ে। ওরা লাথ খায়, এমন জোরে খায় চিৎপটাং হয়ে লোহার চাকতির মতো ঘুরতে শুরু করে। খাড়া হয়ে মাথা উঁচু করে যারা জীবনের স্টিয়ারিং ঘোরাতে আরম্ভ করে, ওদের পংক্তিটা চাওয়া না-চাওয়ার হিসাব কষে না। ‘যা, যা, প্যাঁক প্যাঁক করিস না, কোন কিছু হবার নয়, বুঝলি না, পথ দেখ, আরও বার চারেক ঘুরে ফিরে আয়, খিস্তি-খেউর হজম করতে শিখ, এলাইনমেন্ট, সাইলেঞ্চার মেরামত করা এত খেলো কাজ নয়, এলাম আর জয় করলাম, এলেমদার লোক দরকার।’ মাথা নিচু করে ঘন্টুরাম যন্তরটা উঁচু করে হোসপাইপটা চালিয়ে দিলে যত দাগদুগ নিমেষে ভ্যানিস। ‘তোর মূরোদ ঐটুকুই, বুঝলি না, সকলে ব্যাটন নিয়ে ছুটতে পারে না কিনা, এই দুনিয়াটা একটা রিলে রেস, একটুখানি এধার ওধার হলো তো খেল খতম। ঐ সাদা আ্যপ্রন পরা বড় বাবুকে দেখেছিস, কেমন রেলা মেরে চলে, আসলে একটা ঘেঁচু, অষ্টরম্ভা, কাঁপাকাঁপি শুরু করে।  রেস্তর জোর আছে তো, এমন লোক যেই না দেখল, পায়ে পড়ে যায় আর কি।’ ঘর-গর্তের এক দঙ্গল দলে দলে ভাগ হয়ে বাস স্ট্যান্ডের লাইনে, বিরানি’র হাঁড়ির ডান দিক বাঁদিক, খান পঞ্চাশেক ফুটপাতের দোকানের সামনে সেই কী হুজ্জতি। ঘুরে ঘুরে সব দেখে, আর গামছা পেতে গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে কত কিছু ও যে জুড়ে দেয়, মুখস্ত বলে যায়, এর তার কথা, রসকস মিশিয়ে লাখো লাখো লোকের গল্প শোনায়। আসলে এমন গল্প শোনায়, এই লোক ওই জীবন চেনে না তো, ওই লোক এর কথা শোনে না। ওই যে বলল না রসিয়ে রসিয়ে এমন লোকের গল্প, খাওয়ার জোটে না, কেমন করে ট্যাক্সি চড়ে ঘোরে। বিলুর ছড়িটার খেমতা আছে, ঘোরালে গল্পগুলো কেমন ফরফর করে বেরিয়ে আসে।’ ‘এই খেঁচুনির বেটা এখানেও গ্যাঁজা দিচ্ছে।’ বিলু আসলে কি জানাতে চায়, কেমন করে জানালে এই শহরের মানুষগুলোকে বুঝে নিতে পারবে। ওরা বিদ্রুপের মশলা মাখিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ কথা ওরা ওর দিকে ছুঁড়ে দেয়। কেউ কাউকে ধরতেই জানে না। একটু আগেই ও বসন্তকে দেখেছিল, কেমন করে বলার কথা শোনাচ্ছে আর শিখিয়ে দিচ্ছে, ‘জ্যান্ত থাকাটা একটা বিদ্যা, ও জানে, জানাতে চায়, পছন্দ নিজের নিজের।’ মা কালীর মায়াময়ী মূর্তিটার ছবি ও জোগাড় করে নিয়েছিল। পিলারের গায়ে টাঙিয়ে দিয়েছিল ছোট্ট একটা বাক্স। বাক্সতে রয়েছে একটা গর্ত। পদ্ধতিটা শিখেছিল নিশ্চুপ হয়ে। ওই গরীব-গুরবো লোকগুলোকে ফল খাওয়াবে বলেই না বুদ্ধিটা কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। ও চিৎকার করে বলেই তো বেড়ায়, ‘ও বেটি আমার এখানে, ভেতরে যাবার দরকার কী!’ শুনিয়েই তো দিল পথিক, ‘ দামী কথা বলেছ হে। লাখ কথার এক কথা, দ্যাশের মাইনষে বুঝল নি।’ 

বিলু কি ওই উত্তর খুঁজবে বলে ওই থরে থরে চাতালের নিচে বইয়ের বাগানে ফুল ফোটাতে যাবে, পাতার পর পাতা ওলটাবে। ‘ওই লোকটার ঝোলাতেই বা কি?’ ‘ওমা তাও জানো না, একটু দাঁড়িয়ে যাও না বাপ, দেখবে ও কেমন জাদু জানে। তোমার জীবনের গল্প তো রয়েছে। ‘তা তো আছে।’ ‘কত ভাবেই না ভেবেছে। বয়স কত?’ ‘কী!’ ‘বলছি বয়স কত?’ ‘এই ধরে নাও পঞ্চান্ন’র কোঠায়।’ ‘কর কি?’ ‘ জাহাজ এসে নোঙ্গর করলে গোডাউনে মাল বয়ে বয়ে নিয়ে যাই। মজদুর বলতি পার।’ ‘ তোমাদের কথা কেউ কি বলে?’ ‘কে আর বলে বাপ। কন্ট্রাক্টর বাবুর দিনরাত গাল খেয়ে মরি।’ ‘ সরকার বাহাদুর তোমাদের কথা বলে’ ‘সরকার! তাঁর কত কাজ। তিনি আমাদের কথা শুনতে যাবে কোন দুঃখে, বলেন দেখি। ছাপোষা লোকের কথা কেউ কি কোনকালে ভেবেছে। বাপ-ঠাকুরদার মুখে কত গল্প শোনা। আমার ঠাকুরদার বাপের বাপ ক্ষেতমজুর ছিল গো। কত মারটাই না খেয়েছে।  এই কি যেই সেই মার,চাবুকের মার। আমাদের গ্যারামে কত্ত বড় মন্দির বাইনেছে জমিদারবাবু সেই কত্ত বছর আগে। বংশধররা আসে, বছরে বারোয়ারি পূজার সময়, খিচুরী খাওয়ায়। আর আমরা হলেম গিয়ে মজদুর। ইউনিয়ন বাবুরা আমাদের তাই তো বলে। আচ্ছা বলেন দেখি আমাদের অন্য নাম হতি পারে না?’ ‘পারে, পারে, অবশ্যই পারে। ওই যে লোকটারে দেখতে আছ, ও তো তোমাদের গল্পই বলে। দেখনা, তোমার জীবনের কত গল্প জমা হয়ে আছে। গড়গড় করে বলে তো ফেললে। আমাদের আরও অনেক গল্প আছে। আমরা জানতেও পারি না, বুঝতেও পারিনা। ওই লোকটা বুঝতে পেরে আমাদের না জানা গল্পগুলোই বলে। ‘ তুমি কি কাম কর? ‘শিল্পী বলে লোকে। আমি কিন্তু নিজেকে শিল্পের চাকর বাকর বলি।’ ‘ সে আবার কেমন কাম?’ ‘ লোকে তেমন পাত্তাটাত্তা দেয় না। চৌমাথা তেমাথার মোড়ে মোড়ে ঠাকুর দেবতার ছবি এঁকে বেড়াই। ‘ছবির ইসকুলে গেছিলে বুঝি?’ ‘আমাকেও বাপ শিখাইছে। বলেছিল, ‘জায়গা জমিন তো নাই, তোকে এই বিদ্যাটাই দিয়ে গেলাম।’ বাপই হলেন গিয়ে আমার গুরু। এই লোকটা একদিন আমার জীবনের গল্পটাই আমাকে অন্য রকম করে শোনাল। ঊরি ব্বাস! শুনি তো আমি  আকাশ থেকে পড়লাম। আমার নাড়ী নক্ষত্র সব জানে। শুধু আমার! আরও তো আমাদের মতো কত লোকের কথা জানে। কেমন করে শুনল কী জানি! এই বড় আজব বিদ্যা, রপ্ত করেছে বটে, এলেম আছে।’  ‘তাইলে তো শুনতি হয়। একটু বসি না হয়, কি বল?’ ‘সময় তো আজ আর নেই গো। সূয্যি যখন অন্য দেশে যায়, তখন ওই লোকটাও ছুটি নেয়।’ ‘ তাহলে আর ওর মুখে নিজের গল্পগুলো শুনতি পাব না?’ ‘ ভাগ্যি থাকলে শুনতি পাবা একদিন।’ ‘ আচ্ছা, আমার আর কী কী গল্প থাকতি পারে বলে তোমার মনে হয়!’  ‘আচ্ছা, সে যদি আমি নিজে জানতে পারতুম তাহলে এত কথা বিলুকে নিয়ে বলতে যাব কেন! সক্বলের জন্য সকল কাজ নয়। সক্বলের মগজ আর মনটা এক নয়। ‘ ও এই সবগুলো জানতে গেলে বুঝি মগজ আর মনের দরকার পড়ে। এতই তখন বিদ্যাবুদ্ধি, তবে আর এসব করে বেড়ায় কেন গো?’ ‘এইসব ওর কাজ বলে।’ ‘যা, এইসব আবার কাজ হল, লোকের কথা লোককে শোনানো।’ ‘কাজ নয়! ,তাহলে তুমিই বা শুনতে চাইছ কেন?’ ‘হ্যাঁ, তাই তো আমিই বা শুনতি চাইছি কেন! এ তো ভারি অবাক কাণ্ড। মনের যে এত ইচ্ছে হয়, আগে তো জানতুম না।’

রোজদিন তো সূর্য একই সময়ে অস্ত যায় না। কালো কালো মেঘ এসে পৃথিবীটাকে আর পৃথিবীর মানুষগুলোকে ঢেকে দেয়। সেই দিনটায় কোনো মানুষ অন্য মানুষকে চিনতে পারে না। সূর্য চন্দ্র পৃথিবীটা একই সরলরেখায় চলে এলে আঁধারের সঙ্গে ‘মহিমা’ শব্দটা এসে জুড়ে যায় কখনও। অবস্থাটা মহাকাশ বিজ্ঞানের চর্চার বিষয়, একথা সত্যি তো বটেই, তাবৎ প্রাণীকুল এমন এক বিষ্ময়কর অবস্থার আড়াল আবডালে গিয়ে নিজেকে ধন্য ধন্য করবে না মহাজাগতিক কর্মকান্ডকে প্রত্যক্ষ করে, এই কথাটা মিথ্যা হবেই বা কেমন করে? বিলুর  বয়স কিইবা ছিল, কেমন ছিল তার মনের গতি, কল্পনার চূড়ায় উঠে সেই মানুষগুলোর চিন্তাশক্তি আজ শতচ্ছিন্ন হয়ে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে বা থাকা উচিত ছিল এই জবাবই বা কে দেবে? বিলু ছড়িটা আবারও ঘোরাতে আরম্ভ করে, জেনে নিতে চায় নিজের কাছ থেকে ‘মানুষ কি সেই অদ্ভুত আঁধারের পরশ পেয়ে নিজের ঘুমন্ত মানুষটাকে টেনে আনতে পেরেছে নাকি ওই ক্ষণিকের অন্ধকার পৃথিবীর সাক্ষী হয়েছে কয়েক গুণ। পাওনাগণ্ডার হিসেব যারা করবেন বা যারা হিসেব চাইবেন, তার মূল্যায়ন হতে পারে এইভাবে – আসলে প্রকৃতি কী কী চায় আর কী কী ফিরিয়ে দিতে পারে। বিলু এই গোটা মানবজাতির একজন পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির মানুষ হয়ে কি এমন চাইতে পারে, যার জন্ম হয়েছে সাত বাই পাঁচ ফুট পাট কাঠির বেড়ার মাটির মেঝেতে বাঁশের ছিলায় নাড়ী কেটে, কাঁচা মাটির উপর খড়ের বিছানায় ওঁয়া ওঁয়া শব্দে সেই আলোর ছোঁয়ায় গড়াগড়ি খেয়েছে, এই অন্ধকার পৃথিবীর মুহূর্তের সত্যিই কি কোন মূল্য আছে ? হয়তোবা আছে, হয়তোবা নেই, কিন্তু মুহূর্তের চাক্ষুস করেছে এটা তো মিথ্যা নয়। হ্যাঁ, এই প্রতিক্ষণ নিয়েই বিলু জীবনটাকে দেখতে চায়। যে মানুষটিকে ভিড়ের মধ্যে এইমাত্র ও দেখেছিল, মানুষটা কোথায় যে হারিয়ে গেল, ভিড়টাও একে একে শূন্য হয়ে গেল, তারা কারা ছিল, লোকটিই বা কে? মুহূর্তের দামটা যে একেবারেই উড়িয়ে দেবার মতো নয়। ওই মুহুর্তে গড়নের ভূমিকাটা অস্বীকার করবে কার সাধ্য। ভিড়ের মাঝখানের ওই লোকটির কোন একটি কল্পনা ভাবনার স্রোতে মিশে গিয়ে জুড়ে দিয়েছে কোন এক শূন্যতাকে যা কিনা দুঃসাধ্যই ছিল পূর্ণ করার। বিলু তাই তো বলে মুহূর্তকে অবহেলা নয়, চঞ্চল অটলকেও নয়, ওই নিকষ অন্ধকারে ডালে বসে থাকা বিস্মিত কাকটাকেও নয়, স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল কিনা ডেকে ডেকে, ‘প্রকৃতির এই বিষ্ময়কে যতক্ষণ যত খুশি দেখে নাও।’

বিলুর এই আকাঙ্খাকে চিনে নেওয়া নিজের ভূমির আপন বৃত্তে বিচরণ ছাড়া আর কি। নতুন ভাবে মেলে ধরবে বলেই তো চেনা ছকটাকে ভেঙে ফেলতে চায় বিলু। প্রাণের উৎসকে একই সূত্রে গেঁথে দিয়ে জানাতে চায়, ‘তোমরা তোমাদের উৎস আর পরিণতির সম্পর্কটাকে জুড়ে দাও অন্য ঢঙে, ঘর বেঘর হওয়ার কারণটা হাতের মুঠোয় এসে যাবে দিনেকালে। বিনু শোনাতে শুরু করে নতুন গল্প। বরুণ হাত জোর করে দাঁড়িয়েছিল দরজার সামনে। হাতটা নামিয়ে দিয়েই বলেছিল, ‘হাতে হাত মেলাও না বাপু, তুমি তো কোন হিংস্র জন্তুর সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি করছ না। কোন লুকোচুরিও নয় জোচ্চুরি নয়, নিজের মাটির উপর নিজেই দাঁড়িয়ে কথা বলছ। বিলুর শব্দের মায়া বরুণকে মাতিয়ে দিয়ে বলে, ‘চাকরিটা খোয়াব নাকি, দারোয়ান বই তো নই’। বিলু ওর হাতের ছড়িটা  ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখি তো কেমন থামাতে পার? পারোনি তো! এবার তোমার দেখার মতো ঘুরিয়ে দিচ্ছি। দেখলে তো কেমন সুন্দর ধরে ফেললে। দোকানটা মালিকের কিন্তু খরিদ্দারের মুখোমুখি হচ্ছ তুমি। ওদের খুশি অখুশি তোমার চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে। চেয়ার কথা বলে না, মানুষ কথা বলে।’ বরুণের ভাবনাকে বিলুর চিন্তা ওলট পালট করে দেয়। বরুণ বোঝার চেষ্টা করে কোথায় বিলুর কথার জাদু। লোকের মুখে গল্প শুনেই না ও ভিড়ে এসে গা ঘষেছিল। এই কথাগুলো অন্যের মুখে শুনলে আজগুবি মনে হতো, বিস্বাদ লাগত। বিলু ছড়িটাকে বনবন করে ঘুরিয়ে দেয়। বিদায়ক্ষণ বুঝতে পেরে ভিড় পাতলা হতে শুরু করে। ‘কোথায় ওর পথের জমায়েত হবে?’ ‘লোকটা এইভাবে কথা বেঁচে খায়!’ ‘কোথায় বেচতে দেখলে! এটি ওর সত্য কথা বলার পুরস্কার। অন্য জমায়েতে কেমন করে ফিরিয়ে দেবে, দেখবে চল।’ বদ লোকটা বলল, ‘ গোটা শহর জুড়ে এমন তান্ডব চলে!’ ‘তোমার একটুও লজ্জা করল না, ‘তান্ডব’ শব্দটা এমন বিচ্ছিরিভাবে উচ্চারণ করলে।’ ‘কোন নতুন কথা বলার ঢঙ রপ্ত করতে পারলে না? কেন আস সময় খরচা করে?’ ‘ বন্ধু বলল, ‘চল, বিলুর বকবকানি শুনবি, কত লোকই তো শোনে। লোকটা উদ্ভট উদ্ভট কথা বলে, তবু লোকে বুঁদ হয়ে শোনে যেন এমন কথা আগে কেউ বলে নি।’ ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমাকে কেউ ল্যাংটাকে খুঁজে দেবে?’

‘সে আবার কে বিলুদা?’ ‘ ওকে আমার খুব দরকার, খুঁজে তো পাচ্ছি না, কি করি বলতো?’ ‘দেখতে কেমন? কোন ছবিটবি আছে?’ বিলুকে নিরুত্তর দেখে লোকটা আর কথা বাড়ায় না। 

এক পথচারী গলার আওয়াজেই চিনে ফেলে বলল, ‘বিলুদা না?’ ওই মোড়ে চঞ্চল, অটলরাও এসেছে শুনবে বলে, বিলু আজ নতুন কী এমন কথা বলে। শহরের ছাপোষা লোকগুলো ওর কথা শোনার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে, কি এমন কথা যা ও নতুন ভাবে শুনবে। লোকে ওই প্যাঁচপ্যাঁচে পুরণো কথা আর শুনতে চায় না। বেঁটে কালো লোকটার মধ্যে এত কথার জন্ম হয় কি করে? নির্ঘাত মা সরস্বতী ওর জিভে এসে ভর করেছে। ‘আজব এক পৃথিবী আর পৃথিবীর মালিক, হাভাতের মগজে সব কথা গুঁজে দিয়েছে। এসব ওর কোন কাজে লাগবে!’ ‘ তা বেটা, তুই পেলে তো সব ঝেড়ে খাবি। শুনতে হয় শোন, না হয় কেটে পড়।’ যা বলতে চাস তাড়াতাড়ি বল না বাপ, আলো যাবে চলে তখন হবে সমূহ সর্বনাশ! কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের নিয়মকেও হার মানায় বিলুর এই স্বঘোষিত নিয়ম। এমন বক্তা আর তার নিয়ম ইহকালে দেখি নি।’ উপদেশ ও নির্দেশ কোনটাই বিলুর বিবেচনায় জায়গা পেতনা। যন্ত্রণায় ও বেদনায় নিজের মুক্তিকে নিজেই আঁকড়ে ধরতেই বোধ হয়। পথ খুঁজতে গিয়ে পেয়ে যেত লম্বা সময়ের মাটি চাপা পড়া মরা নদীর গন্ধ। নিরূপায় নিরুদ্দেশ যাত্রায় তরণীর সহযাত্রী সাজিয়ে পাড়ি জমাতে চাইত বিলু যাদের তারা আর কেউ নয়, যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে চলা নিজের ভূমির নির্বাসিত মানুষজন। ল্যাংটাকে কখন যে ও দেখে ফেলেছিল, আর কী এমন দেখে ফেলেছিল, আর কেনইবা দূরে গিয়েও কাছে আসতে চাইছিল আর সেই তাড়নাতেই হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে ছায়াময় কায়া ল্যাংটাকে।

ল্যাংটা দৌড়চ্ছে, প্রাণপনে দৌড়চ্ছে। যদি ওকে কেউ চিনে ফেলে। ও কী এদের রক্তের মূল্য ফিরিয়ে দিতে পারবে না কোনদিন? আক্রমণের ভয়! বন্দী হয়ে যাওয়ার ভয়! নাকি বিলুই ওর ছায়া হয়ে উঠছিল এমন এক আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিল ওর মন। খবরটা চাউর হয়ে গিয়েছিল উৎক্ষেপণের সংবাদ ছড়ায় যেমন কোনে কোনে। আশা নিরাশার, সাফল্য অসাফল্য মাথায় চেপে বসে বিলুর । কত লোকই তো রুটি রোজগারের আশায় দলে দলে নতুন রাস্তায় পা রাখছে। ঢাক ঢোল পেটাচ্ছে, পৈতে পরে নকল পুরোহিত সেজে মন্ত্র আওড়াচ্ছে। কার কাছে যে ধরা পড়ে যাচ্ছে, ঘোমটা দিয়ে মুখ লুকোচ্ছে। চেনা তো ল্যাংটাকে সহজ কথা নয়! শব্দগুলো পাল্টে ফেলেছে, গলার স্বর পাল্টে গেছে, কথার বিষয় পাল্টেছে। কোন পথ দিয়ে গেলে ওকে ধরে ফেলতে পারবে? ওকে তো ধরে ফেলতে হবে। অন্তত ছায়াটা ঘন হয়ে এলে ওর অবয়বটা জাপটে ধরে ফেলা সহজ হয়ে যাবে। দু’জনেই যে দুজনকেই চায়, তবে কেন এত লুকোচুরি! এর উত্তর খুঁজে বের করতেই হবে। ছোট ছোট গলিপথে ও খুঁজবে বলে পথের মানচিত্র এঁকে নিয়েছিল। সংশয় তো ছেড়ে কথা বলে না। ছায়াটা দীর্ঘ হলে ল্যাংটা নিজেকেই চিনতে পারে না, অন্যকে ধরা দেবে কী! রূপের এই বাহ্যিক পরিবর্তন অন্তরের পরিবর্তনের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে নামে। বিলু ভাবে  এই রূপান্তর মহাজাগতিক অদল বদলের চেয়ে কম কীসে! তাই বলে কি ফাঁকি দেবে, এমনটা কী চলতে দেওয়া যায়, না দেওয়া উচিৎ! এই কথার উত্তর জনপদের কোলাহল থেকে জন্ম নেওয়ার কথা নয়, মানসিক বিচ্ছিন্নতা থেকে জন্ম নিলেও নিতে পারে। বিলু জানে ল্যাংটা বারবার এই জনসমুদ্রে ফিরে আসতে চাইছে, এর উত্তর না দিলেই যে চলছিল না। কিন্তু হতদরিদ্র, কাঙালি, অনাথ, পাতকুড়ানিদের যে জায়গাটা জরুরি এই কথা অস্বীকার করবে কে? ফেরিওয়ালা, হকার, মাংসের, কাপড়ের, ওষুধের, দশকর্মভাণ্ডার, লোহার, ইমারতি, মুদির, মনিহারি শুঁড়িখানায় করেকম্মে যারা দিনরাত ঘাম ঝরাচ্ছে তাদের জমে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর যে বিলুকে দিতে হবে, পালিয়ে তো পার পাবে না, যাক না মন্দির মসজিদ গীর্জায়। ইহকালে, না হয় ধরাই গেল পরকাল, নিত্য নতুন জীবন হচ্ছে, কত কথার বুদবুদ হচ্ছে, উত্তর তো চাই নাকি, উত্তরের যে কত রকমের ফাঁকফোকর। ওরাই খালি মানুষ, এরা কি কেউ নয়! বটেই তো, জন্মেছে যখন ধরাধামে, মানুষ নয় একথা কী কেউ বলতে পারে, না বলা উচিত! ‘ ও বিলুদা, তুমি কোথায় গেলে গো?’ ‘সত্যি দেখনি বুঝি। পথটা যে ওখানে গিয়ে ঠেকেছে, তবে গেল কোথায়! লোকটার মাথায় যে কখন কী ভূত চাপে, কে জানে।’ ‘তোরা এত ভাবিস না তো, যখন আমাদের কথা মনে পড়বে, তখন এসে যাবে। টান, মনের টান বলে তো একটা বস্তু আছে না নাকি। আমাদের বাদ দিয়ে যে চলবে সেটা আবার হয় নাকি!’  ‘আমাদেরকে গনায় না ধরলে দেশটা হবে কি করে, দেশটাকে মানাবেই বা কী করে! আমরা আছি বলেই না দেশটা চলছে, নাকি!’ 

বিলুর চোখের সামনেই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে। ল্যাংটার ছায়াটা ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ধরাছোঁয়ার বাহিরে চলে যাচ্ছে। বিলু অনেক কসরত করলেও, অনুনয় বিনয় করলেও মাটি ছোঁয়ার নামটি করছে না। এত বিষোদগার কেন? বিলু এ কী দেখছে! আকাশের এত ভাবান্তর! মাটিকে আগলাবার ব্যাকুলতা কেন? এইভাবেই কি কোনদিন পরিবর্তন আসবে? ভালো লাগা মন্দ লাগার ইচ্ছেটা নিজের খুশিমতো পাল্টাতে থাকবে! ল্যাংটা ছোট হয়ে যাচ্ছে আবার। জমি, গাছগাছালি, ফুলফলাদি, মানুষ এইসবের জন্য ল্যাংটার আচ্ছন্নতা চাঙ্গা হয়ে উঠছে। অন্য কোথাও যাচ্ছে না তো। মানুষ হয়ে মানুষকে যারা জায়গা দেয়নি, ল্যাংটা যাচ্ছে তো ঝুপড়ির মানুষগুলোর কাছে। হাঁড়িতে ফুটছে কন্ট্রোলের চাল। পোকা বেছে বেছে ফেলে দিয়েছিল। ওই তো কোলের ছেলেটি ভুল করে কুড়িয়ে নিয়ে ঢুকিয়েছে ঠোঁটের কোনায়। খুঁটিতে ঝুলছে বাসি শাড়ি আধাআধি ভাঁজ করা। যাবে নাকি সেই টাইম কলের লম্বা লাইনে, ঝগড়াঝাঁটি সুখ দুঃখের গল্প আওড়াচ্ছে ওরা কেমন। কী কটু কথা, মিলমিশ নেই একথা কে বলে! কত কথা শেষ হয়ে যায় না। অনেক কথা হয় নিঃশেষ। ল্যাংটা আসলে নিজের অবিশ্বাসকে কখনও কখনও বিশ্বাসে রূপান্তরিত করতে গিয়ে দেখে আসলে অবিশ্বাসই বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মানুষের চেহারাটা ওর কাছে ধরা পড়ছে না, উল্টো করে ওর নিজের দেখাটাই হয়ে উঠছে মানুষের চেহারা যা কোন কালেই সত্য নয়। ছুটে বেড়াচ্ছে ও পাগলের মতো। পাগল অসুস্থ মানুষ কিনা জানা নেই। পাগলরাই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। জানাতে চেয়েছে, কারো দেখা ও দেখানোটাই সিন্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে না। বিলু ল্যাংটার এই ছোট হয়ে যাওয়াটাকে তাই আন্দাজ করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। ও চাইছে ল্যাংটা নিচে নেমে আসুক, আরও ছোট হয়ে যাক, সাজিয়ে দিক নিজের মতো। ঝাঁপ দিক গনগনে আগুন থেকে জলে, পৃথিবীটাকে ঠাণ্ডা করে দিক। জীবনের উত্তাপ থেকে মৃত্যুকে সহজ করে নিক। মৃত্যু যদি সহজ হয়ে যাবে, জীবন এত কঠিন কেন? এই প্রশ্ন সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই করে বসবে ল্যাংটাকে কোন একদিন। কে টিকে থাকবে আর কারাইবা টিকে থাকবে, এরও উত্তর চাইবে ব‌ই কী! ল্যাংটার নতুন মতাদর্শকে আগলে ধরা ‘শুভ লক্ষণ’। কত দ্রুত স্থান পরিবর্তন করছে, এ-ও কিন্তু লক্ষণীয়। বাড়িগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, ওরা রোগাক্রান্ত হয়ে এখন খোলা আকাশের নিচে। ওরা হাত-পা নেড়েচেড়ে কামনা করছে ‘ জীবন ফিরিয়ে দাও।’ ল্যাংটা ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

এতক্ষণ বিলু যা দেখছিল, না ভাবনার প্রশ্রয় দিচ্ছিল বিলু ছাড়া আর কেইবা বলতে চায়, জানতে চায়। জানার কথাটা এতটা গুরুত্ব যখন পেলই, শতাংশের হিসেব কষে নব্বই ভাগ লোককেই ধরে ফেলা যাক। ইতিমধ্যেই ওরা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। না, কোন প্রশ্ন নয়, এক নজর দেখে মনের সাধ মেটানো। হারানো প্রাপ্তির নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপনের পরের পর্বে যে প্রশমিত উত্তেজনার প্রবাহ থাকে, তার বাকি অংশটা, অচঞ্চল, ধীর ও শান্তির নির্জনতা। ওরা এমনভাবে দেখবে বলেই নিজের নিজের জায়গাটুকু ছেড়ে অন্য এক পথের এমন মোড়ে এসে হাজির হলো, বিলু বলেই চলে, ‘বাতাসের শনশন শব্দ কানে আসবে ভেসে যখন, জানবে এটা তোমাদের কন্ঠস্বর, কথার জালে আটকা পড়ে গেলে জানবে এটা তোমাদের বোকা বানানোর আয়োজন. ঝনঝন শব্দ যদি কানে বাজে, জানবে তোমাদের ফাঁদে ফেলবে বলে জাল পেতেছে।’ ওরা কতদিন অভুক্ত শরীরটাকে টেনেটুনে এনে অপেক্ষা করেছে, আজ ওরা এমন বৃত্ত রচনা করেছে ওদের নিজেদের মুখগুলো হয়েছে জ্বলন্ত অঙ্গার যেন, ধিকি ধিকি করে জ্বলছে, ওরা নিজেরাও জানে না কবে নিভবে। কী  আসুরিক শক্তিতে ওরা বলীয়ান হয়েছে, কেউ চাইল কি চাইল না কী আসে যায়! ফিরে যাওয়ার পথ যে আর খোলা নেই। পরের পিড়ির মুখগুলো যে কোনও মূল্যে জ্যান্ত রাখতে চাইবেই চাইবে। কাকটা কা কা করে উঠল এমন মিষ্টি স্বরে, চঞ্চল আর অটলের দেখানো পথটাকে রয়ে গেছে কত রকমের দাগ, ওরা শুনতেও পেল না বিলুর নতুন শেখানো কথা আর কোনো উন্মুক্ত পথ কিনা। গুয়ের গন্ধ যেন বেরুচ্ছে শুধু ওদের গা থেকে, সাহেব সুবোধের গা থেকে ফুরফুরে সুগন্ধি। ভেসে আসছে ওদের পোষা ঘোড়ার খুরের শব্দ খটখট করে, যারা ওদের প্রিয়জনদেরও মাড়িয়ে চলে গেছে,  ওদেরও মাড়িয়ে যাওয়ার ফন্দি এঁটেছে, তিল তিল করে মাড়িয়ে যাবে ছানাপোনাদের। জমায়েতের শেষ প্রান্ত থেকে শুধু শেষ শব্দটি শুনতে পেল, বিলুরই তো  গলা, অমরাবতীর ছাপোষারা শোন ‘বৈতরণীর পাঁক, শুধুই ছলনা, কেবলই বঞ্চনা, কেবলই ভণ্ডামি।’ আরও কত কথা তো বলে ‘ছি ছি ঘরের পাশে ঘর বাঁধল, আর নিজেদেরই ঘর বাঁধার জায়গা পেল না।’

সমাপ্ত 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *