সাপ্লিমেন্ট টু বুগেনভিলেস ভয়েজ বইটি লেখা হয়েছিল আজ থেকে অনেক দিন আগে, সেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে। সেসময় পৃথিবীর মানুষকে আশার কথা শোনাচ্ছিলেন রুশো, ভলতেয়ার প্রমুখ মনীষী। বুগেনভিলেস ভয়েজ বইটিতেও রয়েছে সাধারণ মানুষের কথা, যারা সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের শিকার। তাহিতি দ্বীপের এক বৃদ্ধ মানুষ বিদেশী শাসকদের একজনকে বলেছিল, “আমরা স্বাধীন লোকজন; কিন্তু তোমরা আমাদের দেশে আমাদের ভবিষ্যৎ দাসত্ববৃত্তির দলিল রোপন করে দিলে। তোমরা ভগবানও নও দানবও নও; তাহলে তোমরা চাকর বানাবার কে? এই ধাতব ফলকে তোমরা লিখে রেখেছ: ‘এই দেশ আমাদের’। এদেশ তোমাদের? কেন? কারণ তোমরা এখান দিয়ে হেঁটে গেছো বলে? যদি কোন তাহিতিয়ান কোনদিন তোমাদের দেশের সমুদ্রতীরে গিয়ে হাজির হয় আর সেখানকার কোন পাথরের বা গাছের গায়ে লিখে দেয়: ‘এই দেশ তাহিতির মানুষের’—— তখন তা তোমাদের কেমন লাগবে?”
বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৯৬ সালে, কিন্তু লেখক মারা গিয়েছিলেন তার অনেক আগে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে। জীবদ্দশায় লেখককে ঘিরে নানা মহলে এত বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল এবং এতজনকে তিনি রুষ্ট করেছিলেন যে তাঁর সব বই ছাপাতে প্রকাশকরা সাহস পেত না। ইনি হলেন ডেনিস দিদেরো, পৃথিবীর অন্যতম সেরা দার্শনিক ও লেখক।
ইউরোপের নবজাগরণ যাঁদের হাত ধরে বাস্তবায়িত হয়েছিল দিদেরো তাঁদের একজন। তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি লা এনসাইক্লোপেডি, যেখানে তাঁর সময় পর্যন্ত মানবসভ্যতার সমস্ত কীর্তিকলাপের বিবরণী রচিত হয়েছে। এই সুবিশাল বিশ্বকোষের ১৭ ভল্যুম লেখা ও ১১ ভল্যুম ছবি, প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৫৯ থেকে ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে দিদেরো এই সৃষ্টিকর্মের মূল সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাঁর কৃতিত্ব এই যে কাজটিকে তিনি প্রাথমিক পরিকল্পনার বাইরে বিরাট আকার দেন ও যুগান্তকারী স্বাধীন মতামতদানের ক্ষেত্র বানিয়ে তোলেন। ক্যাথলিক চার্চের স্বৈরাচারিতার বিরুদ্ধাচারণও প্রকাশ পায় এখানে। ফলে বিশ্বকোষ উত্তপ্ত বিতর্ক সৃষ্টি করে। প্রকাশককে জেলেও যেতে হয়। তবে ভলতেয়ার, শেভালিয়ের, মার্মোন্তেল প্রমুখ ব্যক্তিত্ব এই বিশ্বকোষ রচনায় দিদেরোর সঙ্গী হয়েছিলেন।
নিজের মৌলিক এবং অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ রচনা গুলিও দিদেরো বিশ্বকোষ তৈরির সময়কালেই লিখেছিলেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে লা রেলিজিউস, যাতে খ্রিস্টান নানদের মধ্যে কি কুকীর্তি চলে তা দেখানো হয়েছে সুজান নামে একটি মেয়ের নান হওয়ার গল্প দিয়ে। এই বইটিও প্রকাশ পায় লেখকের মৃত্যুর অনেক পরে ১৭৯৬ সালে। দিদেরোর জ্যাকস লে ফ্যাটালিস্টে রচনাটিতে সারভানতিস ও ভলতেয়ারের প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায়। জনৈক নাইটের ভৃত্য জ্যাক, সে মূল চরিত্র, সে তার প্রভুকে জানিয়েছিল যে ভালো মন্দ যা ধরাধামে আমাদের জীবনে ঘটবে তা ওপরে লেখা থাকে। প্রশ্ন হল: ওই ওপরের লেখা ঘষে মুছে ফেলার কোন উপায় আছে কিনা।
দিদেরোর জন্ম ১৭১৩ সালে ফ্রান্সের ল্যাগ্ৰেস অঞ্চলে। বাবা ছিলেন সফল কাটলার, পয়সাকড়িও ছিল ভালই। প্রথম জীবনে পাদ্রীদের কাছেই তাঁর শিক্ষার আরম্ভ। সব ধরনের বই পড়লেও তাঁর প্রিয় ছিল হোরেস ও হোমার। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করলে তাঁর বাবা ভেবেছিলেন তিনি ডাক্তার বা উকিল হবেন, কিন্তু বাবাকে হতাশ করে তিনি দিনরাত বই আর মেয়েদের নিয়ে কাটাতেন। অর্থাভাব দেখা দিলে বাধ্য হয়ে তাঁকে রোজগারের চিন্তা করতে হয়। ফ্রীলান্স রাইটার, টিউটর, বইবিক্রেতা ও অ্যাটর্নির কাছে কাজ ইত্যাদি অনেক কিছুই তিনি করেছেন। দশ বছর বোহেমিয়ান জীবনযাপনের পর চল্লিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন অ্যনতোইনেত্তি চ্যাম্পিয়নকে। আর ইংরেজি থেকে ফরাসি ভাষায় অনুবাদকের কাজ শুরু করেন। কিন্তু স্ত্রীয়ের সঙ্গে অল্পদিনের মধ্যেই সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। ইতিমধ্যে লেখিকা ম্যাদেলিন দ্য পুইসুর-র সঙ্গে তাঁর নতুন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এছাড়া সোফি ভোল্যান্ডের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল।
অনুবাদক হিসেবেই তিনি প্রথমে নাম করেছিলেন। তাঁর লেখা নীতিকথাগুচ্ছ পেনসীজ ফিলোসোফিক্স্-এ খ্রিস্টানবিরোধী কথাবার্তা থাকার জন্য প্যারিস পার্লামেন্টের আদেশে পোড়ানো হয়েছিল। লেটার অন দ্য ব্লাইন্ড বইতে ভগবানের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ফল হিসেবে তাঁর ভাগ্যে তিন মাসের জন্য কারাবরণ ঘটে।
রুশোর সঙ্গে তাঁর ভালই বন্ধুত্ব থাকলেও একসময় তা ভেঙেও যায়। পরে রুশো তাঁর রচনাবলী নিজের প্রেস থেকে প্রকাশ করেছিলেন। রাশিয়ান সম্রাজ্ঞি দ্বিতীয় ক্যাথারিনের মেয়ের বিয়ের যৌতুক সমৃদ্ধ করার জন্য দিদেরো তাঁর গ্রন্থাগার সম্রাজ্ঞীর কাছেই বিক্রি করে দিয়েছিলেন। ক্যাথারিনের সঙ্গে দেখা করার জন্য এবং রাশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনায় দিদেরো সেন্ট পিটার্সবার্গে যান। এই দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি ও কষ্ট তাঁর স্বাস্থ্য বেশ ভেঙ্গে দিয়েছিল। দিদেরো মারা যান শ্বাসকষ্ট ও উদরিরোগে। শতাব্দীর এক অনন্য প্রতিভা হওয়া সত্বেও তাঁর খ্যাতি সমসাময়িক অন্য দুই প্রতিভা রুশো ও ভলতেয়ারের ছায়ায় কিছুটা ম্লান হয়ে গিয়েছিল।