তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় কোভিড পরিস্থিতিতে লেখা ইংরেজি ভাষায় ‘ইটস মাই আইল্যান্ড ‘ প্রকাশের অপেক্ষায়। স্বউদ্যোগে প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস ‘অন্তরালোকে ‘ নিজের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ও মাকে নিয়ে লেখা। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিরক্তি ‘অনন্ত জীবন ‘ উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। )
মূলাংশ
(মরজগতে মানুষ চলেছে অমরত্বের সন্ধানে। অনাদি অতীত থেকে তার এই যাত্রারম্ভ। অনন্ত জীবন তারই এক প্রকাশ। তাই অমৃতের অধিকার নিয়ে সুরাসুরে এত অশান্তি, কারণ অমৃত নাকি অমর করে। অমরত্বের ব্যাখ্যা আবার দ্বিধাবিভক্ত, দৈহিক অমরত্ব এবং আধ্যাত্মিক অমরত্ব। দানব ও সর্বসাধারণ বোঝে প্রথম মতবাদটিকেই। কোনটি সঠিক? সবাই ছোটবেলায় হারিয়ে যায় মানুষের মেলাতে, সেখানে সে বন্ধু খুঁজে পায় যাকে সে তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়, বোঝাতে চায় মানুষ ও বিশ্বজগতের উদ্দেশ্যবিধেয়। যে তাকে চেনে সে বোঝে সব। শৈবাঙ্কন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে অস্বীকার করে চলে যায় স্পিতি ভ্যালিতে। সেখানে সে আবিষ্কার করে সর্বজনীন ভাষা যাতে বাক্যালাপ চালাতো সনাতন মুনি-ঋষিরা কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, নদী-জঙ্গল, পাথর-প্রান্তর এবং অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে। স্পিতি ভ্যালির পটভূমিকায় স্পিতি নদী ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ এবং মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে সে খুঁজতে থাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ত্বের ব্যাখ্যা। কী পেল সে শেষ পর্যন্ত ? )
প্রারম্ভিক
বকপক্ষির উপাখ্যান
( পৌরাণিক )
কৃষ্ণসখা সহ পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদী যমুনা তীরে শূরসেন বনে উপনীত হইল একদিন। অতীব মনোরম সে বনের বিস্তার, নানা জাতি-প্রজাতির পত্রপুষ্প বৃক্ষরাজি তথায় বিরাজমান। তখন বসন্তকাল। শীতল সমীরণ স্পর্শে ও পিকাদি পক্ষিকুলের কূজনে দেহমন পুলকিত সকলের। শ্রীকৃষ্ণ প্রথম পাণ্ডব ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করিয়া জানাইলেন,
‘শুন রাজা, এই বনে আশ্রম স্থাপনান্তে এস্থলে অবস্থানই তোমাদের সমীচীন হইবে। এতদাঞ্চলের নিকটস্থ রাজ্যসমূহ কলিঙ্গ, কম্বোজ, মদ্র, অযোধ্যা, অঙ্গ, বঙ্গ, গুজরাট, কাশী, পাঞ্চাল, কনখল, ভোজ, সিদ্ধসেন, তৈলঙ্গ, বিরাট, কাশ্মীর ইত্যাদি। এসব রাজ্যে কৌরবদের কোন প্রভাব না থাকায় তোমরা নিরাপদ, আর বৎসরেক কাল অজ্ঞাতবাসেও থাকা সম্ভব। ততদিনে শর্তপূরণ সাপেক্ষ স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তনান্তে তুমি আবার রাজ্যপাট পাইবে। এক্ষণে আমি স্বীয় রাজ্য দ্বারকা পুরীতে যাত্রাভিলাষী।’
শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা চলিয়া যাইবেন শুনিয়া যুধিষ্ঠির ব্যথিত হৃদয়ের নিবেদন ঢালা কন্ঠে কহিল,
‘হে কৃষ্ণ, তুমি যাইবে বলিয়া মনস্থ করিয়াছো যখন তোমাকে বাধা দিব না। তথাপি এ কথা তোমাকে জানাই যে তুমি বিনে পান্ডুপুত্রগণের কোন গতি নাই। তুমি একাধারে সহায় ও সম্বল, বন্ধু, সখা, ভাই ও মিত্র সমান। বহুবার বহু বিপদে তুমি রক্ষা করিয়াছো। তুমি সঙ্গে না থাকিলে আমরা অসহায়।’
শ্রীগোবিন্দ সান্তনান্তে জানাইলেন যে দ্বারকাতে প্রস্থান করিলেও চিন্তার হেতু নাই, কারণ স্মরণ মাত্রেই তিনি উপস্থিত হইবেন আবার। যদি প্রকৃতই সেরূপ কিছু ঘটে।
কৃষ্ণ বিদায় লইয়া যাইবার পরের ঘটনা। সেদিন পঞ্চপান্ডব অকস্মাৎ তৃষ্ণা পীড়িত হইয়া পড়িল। কোন স্থানে জলের চিহ্নমাত্র নাই। ক্লান্ত, শ্রান্ত, তৃষ্ণার্ত যুধিষ্ঠির একটি বৃক্ষের ছায়ায় উপবেশন করিয়া ভীমকে আজ্ঞা দিলেন,
‘যাও ভাই, তৃষ্ণাবারি সন্ধান করিয়া সত্বর লইয়া আইসো।’
বৃকোদর সেই বনে বহু অন্বেষণ করিয়াও জলের সন্ধান না পাইয়া বনান্তরে যাইবার মনস্থ করিল। কতদূর যাইবার পর সম্মুখে দেখিলো অতি সুশোভন এক কুসুম কানন। তথায় বিবিধ ফলফুলের সমারোহ। পলাশ, অশোক, কাঞ্চন, টগর, জাতি, চম্পক, কিংশুক, মল্লিকা, কুরু, শেফালিকা, ঝাঁটি, ইন্দ্রমণি ইত্যাদি নানা পুষ্পরাজির শোভা বিদ্যমান। মধুলোভি অলিকুল মনোসুখে মত্ত। খঞ্জন-খঞ্জনি, ময়ূর-ময়ূরী মহানন্দে নৃত্যরত। পবননন্দন ভীম সেই স্থানেও জলের সন্ধান না পাইয়া চিন্তাকুল চিত্তে ভ্রমণ করিতে লাগিল।
হেনকালে মৃত্যুপুরীর অধীশ্বর ধর্মরাজ ভাবিলেন,’আমার প্রসাদে কুন্তী গর্ভে জাত পুত্র যুধিষ্ঠির সবাই বলে ধার্মিক। সে যখন আমার পুত্র তাহাকে ধর্মপালন করিতেই হইবে। কিন্তু সে কী পরিমাণ ধার্মিক তাহার এক পরীক্ষা লওয়া যাউক।’
এইরূপ মনস্থ করিয়া ধর্মরাজ সেই বনে দিব্য মায়ায় এক মনোহর সরোবর সৃজন করিলেন এবং স্বয়ং বকপক্ষি রূপ ধারণ করিয়া সেই স্থানে এক বৃক্ষোপরি অধিষ্ঠান হইলেন। সহসা সম্মুখে শীতল জল পরিপূর্ণ এক সরোবর দেখিয়া ভীম আনন্দে অধীর। ভাবিয়া দেখিবার প্রয়োজন বোধ করিল না যে ওই সরোবর কোথা হইতে উপস্থিত হইল। মায়ার এরূপই লীলা। তৃষ্ণার্ত ভীমসেন কালবিলম্ব না করিয়া সেই সরোবরে গিয়া জল পানে উদ্যত হইল। মায়া পক্ষিরূপী ধর্ম তাহাকে ডাকিয়া কহিলেন,
‘শুন, এই জল স্পর্শ করিবার অগ্রে তোমাকে আমার কতিপয় প্রশ্নের উত্তর দিতে হইবে। নতুবা জল পানে তোমার মৃত্যু সুনিশ্চিত। আমার সমস্যাগুলি শ্রবণ কর, উত্তর দানের পশ্চাতে জল পান করিলে তোমার কোনরূপ বিপদ ঘটিবে না।’
অতঃপর ছদ্মবেশী ধর্মরাজ তাহার প্রশ্নগুলি উচ্চারণ করিলেন,
‘কিবা বার্তা, কী আশ্চর্য, পথ বলি কারে
কোন জন সুখী হয় এই চরাচরে
পান্ডুপুত্র আমার যে এই প্রশ্ন চারি
উত্তর করিয়া তুমি পান করো বারি।’
ভীম সর্বদাই তপ্তমস্তিষ্ক, বিশেষ ভাবিয়া-চিন্তিয়া কর্ম সম্পাদন করিবার অভ্যাস তাহার নাই। তদুপরি দেহে প্রবল বল থাকায় সে চরিত্রে অহংকারী ও ক্রোধী এবং সমস্ত কিছুকেই তুচ্ছ জ্ঞান করে। কনিষ্ঠ ভ্রাতা অর্জুন সদৃশ্য বুদ্ধি ও ধৈর্য তাহার নাই। যদি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির তাহাকে শাসনে না রাখিত তাহা হইলে সে যে কী সমস্ত কীর্তি ঘটাইয়া বসিত সেইসব কল্পনা করাও সাধ্যাতীত। এস্থলেও তাহাই ঘটিল। ধর্মবচন শ্রবণে সে ক্রোধোন্মত্ত হইয়া কহিল,
‘তোমার এইসব অবান্তর প্রশ্নের উত্তর দানের কোনরূপ ইচ্ছা আমার নাই। নিতান্তই যদি উত্তর শুনিবার দায় তোমার থাকে তো অগ্রে জল পান করিতে দাও, পশ্চাতে ভাবিয়া দেখিবো উত্তরদান করিব কিনা।’
এই বলিয়া অহংকারী ভীম সদর্পে তৃষ্ণা পূরণের উদ্দেশ্যে জল পান করিবার নিমিত্ত জলস্পর্শ করিল এবং স্পর্শ মাত্রই ধর্মের মায়ায় তাহার মৃত্যু ঘটিলো। তাহার নিষ্প্রাণ ও নিথর বিশাল দেহ সরোবরের কাকচক্ষু জলে ভাসমান রহিলো।
হেথায় রাজা যুধিষ্ঠির বনের আশ্রমে পাঞ্চালি ও অপরাপর ভ্রাতাগণের সহিত ভীমের নিমিত্ত প্রতীক্ষা করিতে করিতে অধীর হইয়া চিন্তাকুল মনে ভ্রাতা অর্জুনকে সম্বোধন করিয়া কহিল,
‘শুন ধনঞ্জয়, ভীমের কী কারণে এত বিলম্ব হইতেছে বুঝিতে পারিতেছি না। শঙ্কা হইতেছে, বৃকোদর বুঝিবা কাহারো সনে রণে মত্ত হইয়া পড়িল। হে পার্থ, তুমি শীঘ্র যাইয়া ভীমের অন্বেষণ কর এবং তৃষ্ণাবারি লইয়া আইসো।’
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আজ্ঞা বীর অর্জুন নত মস্তকে মানিয়া তৎক্ষণাৎ তাহার গাণ্ডীব ধনু ও শরপূর্ণ তূণ লইয়া ভীমের সন্ধানে দ্রুতগতিতে গিয়া নির্ভয় চিত্তে গভীর বনে প্রবেশ করিল। ভীম কোন পথে গিয়াছে বুঝিতে তাহার বিশেষ বেগ পাইতে হইল না। পবননন্দন শক্তিমান ভীম সর্বদা সম্মুখের সমস্ত বাধা উপেক্ষা করিয়া চলে। অর্জুন দেখিল, ভীমের যাত্রাপথে অগণিত বৃক্ষ উৎপাটিত রহিয়াছে। পদাঘাতে যাত্রা পথের পাদপপাথর, এমনকি পর্বতচূড়া পর্যন্ত চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া গিয়াছে ভীম। সেই পথ অনুসরণ করিয়া চলিতে চলিতে অর্জুন উপনীত হইল সেই কুসুম কাননে। বসন্তকালের মৃদুমন্দ সমীরণ দেহেচিত্তে পুলক আনিতেছিল, কোকিলের কুহু কুহু রবের সহিত ছিল ভ্রমরকুলের প্রস্ফুটিত পদ্মবনে বিচরণের গুঞ্জন। শীঘ্রই পার্থ বীর সেই মায়া সরোবর দেখিতে পাইল। তৃষ্ণাবশে কাতর ধনঞ্জয় ধাইয়া জল পানে উদ্যত হইলে বকরূপী ধর্মরাজ পূর্বের ন্যায় তাহাকে ডাকিয়া কহিতে লাগিলেন,
‘হে অর্জুন, আমার প্রশ্নসমূহ শ্রবণ করো। উত্তর দানান্তে জলপান করিতে পারিবে। নতুবা এই জলস্পর্শ মাত্র তোমার মৃত্যু ঘটিবে।’
পুনর্বার ছদ্মবেশী ধর্মরাজ তাহার চারিটি প্রশ্ন অর্জুনের উদ্দেশ্যে উপস্থাপন করিলেন। মোহবশে আচ্ছন্ন অর্জুন দাম্ভিকতার সহিত তাহাতে কর্ণপাত না করিয়া জল পানে প্রবৃত্ত হইতে গিয়া ভ্রাতা ভীমের মৃতদেহ জলোপরি ভাসমান দেখিতে পাইল। শোকাচ্ছন্ন অর্জুন ভাবিল,
‘এই জল পান করিতে গিয়া আমার ভ্রাতার প্রাণ গেল। আমার জীবন আমি আর কোন মুখে বাঁচাইবার কথা ভাবি?’
অতএব সেও নির্দ্বিধায় জলস্পর্শ করিবামাত্র মৃত্যুমুখে পতিত হইল।
অতঃপর রাজা যুধিষ্ঠির বিমাতৃ ভ্রাতা মাদ্রীসুত নকুলকে ভীমার্জুনের অন্বেষণ পূর্বক তৃষ্ণাবারি আনয়ন করিবার আদেশ দিল। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আজ্ঞা পালনে বনে প্রবেশ করিবার পর নকুল ও একইভাবে মায়া সরোবর ও মায়াপক্ষির দর্শন পাইল। জ্যেষ্ঠ দুই ভ্রাতার ভাসমান মৃতদেহও তাহার নজরে আসিল। সেও একইভাবে শোকাচ্ছন্ন হইয়া পড়িল এবং মায়াপক্ষি বকের বচন অবজ্ঞা করিয়া জলপান করিতে গিয়া প্রাণ হারাইলো।
কিছুকাল অপেক্ষা করিবার পর যুধিষ্ঠির অপর মাদ্রীতনয় সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা সহদেবকে কারণ অনুসন্ধানের হেতু বনে গমন করিতে বলিল। আজ্ঞা মাত্র সহদেব নিষ্ক্রমণ করিল। এস্থানে রাজা জন্মেজয় মহামুনি বৈশ্যম্পয়ানের নিকট প্রশ্ন করিয়া জানিতে চাহিলো,
‘আমি তো যুধিষ্ঠিরের কার্যকলাপ দেখিয়া বিস্ময় বোধ করিতেছি। তিনি মহা ধার্মিক, বিচক্ষণ ও মহা বুদ্ধিমান নরপতি। তিনি জানিতেন যে ভ্রাতা সহদেব সর্বজ্ঞ, তাহার সবিশেষ গণনা ক্ষমতা বর্তমান। সহদেবকে বনে না প্রেরণ করিয়া তাহাকে দিয়া কী ঘটিতে চলিয়াছে জিজ্ঞাসা করিয়া লইলেই তো পারিতেন? কেন তাহা করিবার বুদ্ধি তিনি হারাইয়াছিলেন?’
এস্থলে পূর্ব কথা কিঞ্চিৎ উল্লেখ করা প্রয়োজন। রাজা জন্মেজয় পান্ডবদের উত্তরপুরুষ, তাহার পিতা পরীক্ষিৎ অর্জুন ও সুভদ্রা তনয় অভিমন্যুর সন্তান। পরীক্ষিৎ দৈবনির্বন্ধে সর্পাঘাতে নিহত হইলে জন্মেজয় সর্পকুল বিনাশে সর্পনিধন যজ্ঞের আয়োজন করিয়াছিল। সর্প দেবী মনসানন্দন মহামুনি আস্তিক তাহাকে তদ্রুপ কর্ম হইতে নিবৃত্ত করিয়া অন্তরের ঘৃণা ও প্রতিশোধস্পৃহা দমন করিবার নিমিত্ত পূর্বপুরুষ কুরু-পাণ্ডবদের কাহিনী শোনাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। তাহার দায়িত্ব সমর্পিত হইল মহামুনি বৈশ্যম্পয়ানের উপর। ঋষি বৈশ্যম্পায়ন রাজা জন্মেজয়কে যাহা শুনাইলেন তাহা ব্যাসদেব বিরচিত মহাভারত।
জন্মেজয়ের বিস্ময় শুনিয়া বৈশ্যম্পয়ান উত্তরে জানাইলেন,
‘শুন রাজা, জগতে সকল বস্তু ও ঘটনাই দৈবের অধীন। দৈব দুর্ঘটনা খন্ডাইবার কোন পন্থা নাই। দৈবের কারণেই ধর্মরাজের মায়া তাহার সকল বুদ্ধি হরণ করিয়া নিয়াছিল বলিয়া সমস্ত বিপদ ঘটিয়াছিল। দৈবাধীন জীব ও জড়জগৎ সর্বদা বা কদাপিও আপন ইচ্ছায় চলিতে সমর্থ নয়। যাহাই হউক, এইবার পরবর্তী বিবরণ শ্রবণ কর।’
অগ্রবর্তী তিন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ন্যায় সহদেবও বনে গিয়া মায়া সরোবর, মায়া পক্ষি ও ভ্রাতাদের ভাসমান মৃতদেহ দর্শন করিয়া শোকবিহ্বল অবস্থাতে বকবেশী ধর্মরাজের বাক্য উপেক্ষা পূর্বক তৃষ্ণাবারি স্পর্শমাত্র প্রাণ হারাইলো। সর্বশেষে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বলিল,
‘যাও কৃষ্ণা, এইবার তুমিই উহাদের সন্ধানে বনে গমন কর।’
রাজা, সর্বোপরি স্বামী যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞা দ্রৌপদী অবজ্ঞা করিতে পারেনা। সে আর্য নারী, উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত। তাহার অন্তরে একাকী বনে বিচরণের ভীতি থাকিলেও সে গেল। অনতিবিলম্বে বনে মায়া সরোবর তাহারও গোচরীভূত হইল এবং তৃষ্ণা মিটাইতে জলস্পর্শ করিবার পর সেও মৃত্যুমুখে পতিত হইল।
কিছুকাল অতিক্রান্ত হইবার পর যুধিষ্ঠির আর একাকী আশ্রমে স্থির থাকিতে অসমর্থ হইয়া স্বয়ং সকলের অন্বেষণে বনে গমন করিল। তাহার অন্তরে নানা প্রকার সম্ভাবনা ও সন্দেহ উদয় হইতে লাগিল। ভ্রাতাগণের নাম উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারণ পূর্বক সে বিলাপ করিতেছিল। তাহার মনে হইলো, দ্রৌপদী কি বনবাসের দুঃখ সহিতে না পারিয়া একাকী ভ্রমণের সুযোগ পাইয়া হস্তিনাপুরে পলায়ন করিয়াছে। এইরূপে চলিতে চলিতে রাজা একসময় মায়া সরোবরে উপনীত হইল এবং দেখিতে পাইল যে দ্রুপদদুহিতা যাজ্ঞসেনী ও চারি ভ্রাতার মৃতদেহ হ্রদের জলে ভাসমান। নিদারুণ আঘাতে যুধিষ্ঠির জ্ঞান হারাইয়া ভূমিতে পতিত হইল। ক্ষণকাল পর জ্ঞান ফিরিয়া পাইয়াই আবার সে মূর্চ্ছা গেল। বারংবার এইরূপ হইবার পর অবশেষে যুধিষ্ঠির পাকাপাকিভাবে চেতনা ফিরিয়া পাইল এবং বিলাপ করিতে লাগিল। বনবাসের যাবতীয় বিড়ম্বনা এবং বর্তমান পরিণতির জন্য সে দুর্যোধনের সমস্ত অপকীর্তি উল্লেখ করিয়া সমুদয় দুর্দশার কারণ হিসাবে তাহাকেই দায়ী করিল। তাহার মনে শোক উথলাইয়া উঠিল যখন সে উল্লেখ করিল যে ভীমার্জুন ব্যতীত দুরাত্মা দুর্যোধনের কবল হইতে হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের কোনরূপ সম্ভাবনা নাই। একে একে বনবাসের সমস্ত যাতনা ও অপরাপর কীর্তিকান্ডের স্মরণপূর্বক দুর্যোধনের উদ্দেশ্যে ভর্ৎসনা জানাইতে জানাইতে তাহার অবশেষে মনে হইল যে কাহারো দোষ নহে, ইহা নিজেরই কর্মফল। অতএব হ্রদের জলে ডুবিয়া মৃত্যুবরণ করিবার অভিলাষে সে অগ্রসর হইলে বৃক্ষের আড়াল হইতে বকরূপী ধর্ম তাহাকে ডাকিয়া কহিলেন,
‘আত্মহত্যা অতীব পাপ কাজ। ইহাতে নরক বাস অনিবার্য। হেনো কর্মে বিরত হও।’
যুধিষ্ঠির তখন বকপক্ষির নিকট আপন সমুদয় দুঃখ কীর্তন করিতে লাগিল। ছদ্মবেশী ধর্ম তাহাকে প্রবোধ দানের হেতু নানা রূপে বুঝাইবার প্রচেষ্টা করিলেও যুধিষ্ঠির নিবৃত্ত হইল না। সে আত্মহাননেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকিলো। তাহাকে অত্যন্ত কাতর দেখিয়া অবশেষে বকরূপী মৃত্যুপতি ধর্ম কহিলেন,
‘শুন রাজা, যদি অতিশয় তৃষ্ণার্ত হইয়া থাকো তাহা হইলে আমার চারিটি প্রশ্নের উত্তর দান কর, নতুবা জলস্পর্শে তোমার মৃত্যু ঘটিবে। ইহারাও আমার প্রশ্নগুলির উত্তর না দিয়া জল পান করিতে গিয়া মৃত্যুবরণ করিয়াছে।’
যুধিষ্ঠির দৃঢ়কন্ঠে ধর্মকে কহিল,
‘আমাকে মৃত্যু ভয় দেখাইও না। ভ্রাতাগণ বিহনে আমি প্রাণদানেই স্থির প্রতিজ্ঞ। মৃত্যু ভয় দেখাইয়া কী হইবে? তথাপি মৃত্যুর পূর্বে তোমার প্রশ্ন সমূহের উত্তর আমি অবশ্যই দিব, যেহেতু আমি তাহা ধর্মানুসারী বলিয়া মনে করি। ধর্ম রক্ষা আমার নিকট মুখ্য। তোমার প্রশ্ন সমূহ কী, জানাও।’
বকপক্ষি যুধিষ্ঠিরকে চারিটি প্রশ্নের উল্লেখ করিল। রাজা একে একে চারিটি প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর দিল। পুত্রের ধর্মজ্ঞান ও বিচার বুদ্ধির ক্ষমতা দেখিয়া ধর্মরাজ বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন যে তিনি এক দেবতা এবং যুধিষ্ঠিরকে তিনি বরদানে ইচ্ছুক। বরস্বরূপ যুধিষ্ঠির নিহত কোন একজনের প্রাণ ভিক্ষা করিলে সে প্রাণ ফিরিয়া পাইবে। যুধিষ্ঠির জানাইলো যে সে বিমাতৃ তনয় সহদেবের জীবন চায়। সে বলিল যে ইহাতে ধর্ম রক্ষা পাইবে। তাহার পিতৃকুল ও মাতৃকুলকে সে পিণ্ড দিয়া উদ্ধার করিতে পারিবে। কিন্তু সহদেবের মাতৃকুলকে পিন্ডদানের কেহ নাই। অতএব ধর্মরক্ষার্থে সহদেবেরই প্রাণ পাওয়া উচিত। ছদ্মবেশী ধর্ম তাহাকে নানা রূপে প্রলুব্ধ করিয়া ধর্মচ্যুতি ঘটাইবার বিস্তর প্রচেষ্টা চালাইয়াও ব্যর্থ হইলেন। যুধিষ্ঠির কোন প্রলোভন বা ছলনার নিকট নতি স্বীকার করিল না। ইহাতে ধর্মরাজ অতিশয় প্রসন্ন হইয়া আত্মপরিচয় দিয়া কহিলেন,
‘আমি তোমার পিতা ধর্ম। তোমাকে পরীক্ষার নিমিত্ত আমি এইসব মায়া সৃজন করিয়াছি। আজ তোমার ধর্ম জ্ঞান দর্শনে আমি অসম্ভব প্রীত। ধন্য পুত্র তুমি আমার, চিরকাল এইরূপে ধর্মে অটল থাকো। অচিরেই সমস্ত দুঃখের অবসান ঘটিবে।’
অতঃপর ধর্মরাজ স্বীয় পুত্রকে বক্ষে ধারণ করিলেন এবং দ্রুপদ নন্দিনী কৃষ্ণাসহ ভীমার্জুন ইত্যাদি চারি ভ্রাতার জীবন দান ঘটাইলেন।
ধর্ম পুত্র যুধিষ্ঠির ছদ্মবেশী বকরূপী পিতা ধর্মের চারিটি প্রশ্নের কী উত্তর দিয়াছিল?
চতুর্থ প্রশ্ন,’পৃথিবীতে সুখী কে,’ যাহার উত্তরে যুধিষ্ঠির বলিয়াছিল যে শাকান্ন জুটিলেও সে জন সংসারে সুখী যে প্রবাসী কিংবা ঋণগ্রস্ত নয়।
তৃতীয় প্রশ্ন,’কোনটি সঠিক পথ,’ যাহার উত্তরে যুধিষ্ঠির বলিয়াছিল যে মহাজনেরা যে পথে গমন করে, তাহাই সঠিক পথ।
প্রথম প্রশ্ন,’কিবা বার্তা,’ এর উত্তরে যুধিষ্ঠির বলিয়াছিল যে এই মোহময় সংসারে বা জগতে সমস্ত কিছুই মহাকালের উদরে সমর্পিত। মহাকালেরই আবর্তনে আবর্তিত রাত্রিদিন এবং সূর্যের উপস্থিতিতে জীবকুল কালের গহ্বরে নিয়ত বিলীন হইতেছে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন,’কী আশ্চর্য’। যুধিষ্ঠির উত্তরে কহিয়াছিল,
‘প্রতিদিন জীবজন্তু যায় যমঘরে
শেষে থাকে যারা, তারা ইহা মনে করে
আপনারা চিরজীবী নাহি হৈব ক্ষয়
ইহা হইতে কী আশ্চর্য আছে মহাশয়।’
অর্থাৎ,
প্রতিদিনই জীবজন্তু সকল যমালয়ে যায়। তথাপি যাহারা বর্তমানে বাঁচিয়া থাকে তাহারা ইহা দেখিয়াও বুঝিতে পারে না যে সকলের জন্যই মৃত্যু অবশ্য পরিণতি। তাহারা মনে করে, আমরা অমর, আমরা এই রূপে চিরকালই বাঁচিয়া থাকিব। ইহার অধিক আশ্চর্য আর কী থাকিতে পারে?
( কৃতজ্ঞতাঃ কাশীরাম দাস কৃত মহাভারত )
অধ্যায় : এক
তারপর একদিন শৈবাঙ্কন নিজেকে প্রশ্ন করল,
‘আচ্ছা, আমি ঠিক কী করব বলে ভেবেছিলাম ?’
মানুষ চলতে চলতে বা বলতে বলতে প্রায়ই খেই হারিয়ে ফেলে। কাজ করতে করতেও অনেকেরই এমন দশা হয়। কী করব বা কী বলব বা কোথায় যাব এই ব্যাপারটা মাঝামাঝি কোন এক জায়গায় গন্ডগোল করে ফেলে অনেকেই। শৈবাঙ্কনেরও এখন হয়েছে তেমন অবস্থা।
তখন সন্ধে লাগার আগের মুহূর্ত। গোধূলিবেলায় দিনের পদক্ষেপ। এসময় আকাশে একলাপথিক সূর্য ক্লান্তি ভোলার অপেক্ষায় অবসন্ন দেহ এলিয়ে দিতে উন্মুখ শৈলশিরার আড়ালে। সারি সারি প্রতীক্ষমান শৈলচূড়া কোন একটি অত্যুন্নত শিখর বেছে নিতে সে তৎপর। তার বিষণ্ন নিস্তেজ রক্তিমাভ আমেজ পড়েছে প্রান্তরের বিছিয়ে থাকা ছোট-বড় নানা আকার ও আকৃতির শিলারাশিতে, আনত ঢালসমূহের আনাচে-কানাচে। এই অশ্রুতিমধুর ঔদাসীন্যতার যাত্রাপথ প্রায়ান্ধকার বেলার দিকে, যার স্পর্শসুখ অনুক্ত শিহরণ হয়ে লেগে রয়েছে ধ্যানমগ্ন আকাশের তলায় শয়ান শৈলশিখর বেষ্টিত মৌনী প্রকৃতির অঙ্গে অঙ্গে, অধরে বা বক্ষদেশে। চোখ বোজার আন্তরিক বাসনায় নিবেদিতপ্রাণ সূর্য সেসব তাকিয়ে দেখার ইচ্ছে জলাঞ্জলি দিয়ে ঢুলছে সর্বোচ্চ শৈলচূড়ার ঠিক মাথার ওপরে, বলতেও তার আগ্রহ নেই ভূপৃষ্ঠে আসীন শিলাপুঞ্জবিন্যস্ত উপত্যকার অন্তরে আর উত্তুঙ্গ পার্বত্যপ্রাচীরের নানা বৈচিত্র সমাকীর্ণ গায়ে কী রঙরূপের মনোরম শান্তস্বভাব চারিত্রিক ভাষ্য রচনা হয়ে চলেছে, এমনকি নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকা মুগ্ধতাছন্ন শৈবাঙ্কনের জন্যও কোন ইশারা রাখতে চাইছে না অলস শৈথিল্যের আরামে। তার ঝোলাঝুলি পাহাড়ি গুহায়, যেখানে রয়েছে জীবনযাপনের আর আর সমস্ত উপকরণ। একটু পর নিজেও সে তাকে তাদের আশ্রয়ে সমর্পণ করবে। এখন সে এই উন্মুক্ত প্রকৃতির কোলে উপস্থিত থেকে একটি বড় মাপের পাথরের প্রায় সমতল পিঠে বসে আছে। যেমন সে থাকে নিত্যদিন এইসময়, এখনও তেমনই আছে। আলো ফুরিয়ে যাওয়ার পর অন্ধকার প্রদেশের অপেক্ষায়। সে শুনছে উচ্চশির পার্বত্যপ্রাচীরের ঢালে প্রতিফলিত সূর্যের ক্লান্তি। বর্ণালির শেষ সীমায় থাকা রক্তিমাভাতে তারই অনুরণন যা সে নিস্তেজ কণ্ঠস্বরের ভাষায় প্রকাশ করছে শৈলচূড়া, উঁচুনিচু প্রান্তরের গায়ে বিছিয়ে থাকা ছোটবড় প্রস্তররাশি, আপনমনে বয়ে চলা স্বল্পবাক স্পিতি নদীর সঙ্গে মৃদু-মন্থর আলাপচারিতায়। সে তার অস্পষ্ট ভাষায় সবাইকে বলছে, ‘আমার আর শরীর চলছে না। একটু আমাকে থামতে দাও।’ ভূপৃষ্ঠে আসীন এবং উর্ধাকাশের মেঘপুঞ্জ হয়ে উপস্থিত তার সঙ্গীরাও তাকে কথা না বলাবার চেষ্টায় তার ম্লান রক্তরাগের মলিন বিক্ষেপ আর শিথিল মাখামাখির মাধ্যমে বলছে, ‘তুমি আর কথা বলো না। যাও, এবার গিয়ে তোমার রাত্রির বিছানায় শুয়ে ওপারের পাহাড়ি ঢালের বালিশে মাথা রেখে একটু বিশ্রাম নাও।’ তার পাংশু মুখের সৌরোচ্ছটায় বর্ণালির শেষ প্রান্তের রক্তবর্ণ বিক্ষেপের যে শিথিল কণ্ঠ তা জানাচ্ছে যে তার আর মমধ্যাহ্নবেলার মত সবাক-মুখর থাকার ক্ষমতা নেই, ইচ্ছেও নেই। তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের বিচ্ছুরণ যে প্রেক্ষাপটে উপস্থিত অবসন্ন শিলারাশি, খাড়াই ঢাল, গিরিখাত, নদীর মূর্ছনা তাতে তা স্পষ্ট। তার এই সঙ্গীরাও তার এমন মনোভাব মেনে নিয়ে তাকে বেশি কথা বলিয়ে আরও অবসন্ন করে না দেওয়ার বাসনায় নিজেরাও যতটা সম্ভব নির্বাক থাকার চেষ্টায় নিজেদের ক্রমাগত অস্পষ্ট করে তুলছে। যেমন শৈবাঙ্কনও তাদেরই মত ওই ঢলে পড়া সূর্যের সঙ্গে কোন কথোপকথনে আগ্রহী না থাকার প্রমাণস্বরূপ মুগ্ধ, নির্নিমেষ। তবে ওই প্রশ্ন আজই তার প্রথম মাথায় এল। দিনের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে নানান রহস্যের মোড়কে মোড়া নানান উপাদান। তারা কেউ হাতের মুঠোয় আসে না, দেখাও যায় না তাদের কাউকে। সেইসব উপাদানের সমন্বয় খেলা করে এখানে হিমালয়ের এই গাম্ভীরস্বভাব পার্বত্যাঞ্চলে, উপত্যকায় উপত্যকায়, পাহাড়ি ঢালের গায়ে। সমান্তরাল রেখায় বয়ে চলেছে স্বল্পভাষী ক্ষীণতনু এক ঝিলমিল কলতানে নদী যার চলন এঁকেবেঁকে বহুবর্ণ বহুবিচিত্র টিলাগুলির সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় মগ্ন থেকে। ওইসব মায়াবী চরিত্রের টিলাগুলি পেরিয়ে বিছিয়ে আছে মনে হয় একেকটি অভাবনীয় রূপকথার জগৎ। সেসব জগতের বাসিন্দারা কি এই পৃথিবীর কেউ, নাকি অপ্সরালোকের গল্পগাঁথায় শোনা সব চরিত্র ? এখানেই হিমাচলপ্রদেশের এই উন্মুক্ত স্পিতিভ্যালির অন্তরাত্মায় আর শিলারাশি শোভিত পাহাড়তলের গাম্ভীর্যে দেবতারা বসবাস করতে ভালোবাসে এই বিশ্বাস এখনো আছে তার ধারণায়।
সেইসব প্রাণপ্রিয় দেবতাদের সান্নিধ্যে থাকার প্রেরণা তাকে এমন কষ্টসহিষ্ণু করে রেখেছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। তার আত্মার সারল্যে এমন বিশ্বাস সবল থাকে সর্বসময় যা নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করে রাখে। যদিও শ্রুত্যাশ্রিত সেইসব উন্নাসিক দেবতাদের দর্শনের এযাবৎ সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ প্রায় তবুও তার উদ্যম এখনও ওই একলাপথিক সূর্যের মত অস্তমিত হতে হতেও দীপ্যমান।
একলাপথিক শৈবাঙ্কন নিজেও। যেদিন তার যাত্রারম্ভ ঘটেছিল সেদিন থেকেই। অবশ্য যাত্রারম্ভ সে কতটা স্বেচ্ছায় করেছিল তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যাত্রাপথ উন্মুক্ত ছিল ঠিকই, সেখানে চলা তার নিজের ইচ্ছেতে ঘটেছিল এমনটা হয়তো সে নিজেও স্বীকার করবে না। কিভাবে সে চলতে শুরু করেছিল তা মনে থাকলেও কিসের তাড়না চলতে বাধ্য করেছিল সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। কিভাবে চলা শুরু হয়েছিল তারও একটা গল্প আছে আর এই গল্প সবার ক্ষেত্রেই এক হলেও হতে পারে বলে তার বিশ্বাস। গল্পটির সূচনা ঘটে হারিয়ে যাওয়া থেকে। হারিয়ে গিয়েছিল সে একদিন তার চেনা পরিসরের বাইরে, চেনাজানা দৈনন্দিনতা ছাড়িয়ে। এভাবেই সবাই জানে সব মানুষ সূচনার দিনগুলিতে বা জীবনে কখনো না কখনো কোন সময় হয়ত হারিয়ে যায়। এই হারিয়ে যাওয়ার গল্পটা কতজন বিশ্বাস করে আর কতজন জানে এবং বিশ্বাস করলে বা জানলেও কতজন বুঝতে পারে সেটা তো বিতর্কের বিষয়। ব্যাপারটা যদিওবা তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া যায় তো প্রশ্ন আসে হারিয়ে গিয়ে উপস্থিত হয় কিসের দরবারে ? হারিয়ে যাওয়ার তত্ত্বে যারা বিশ্বাস করে তাদের মতে কেউ কেউ সেটা আবিষ্কার করতে পারলেও অনেকেই তাতে অপারগ আর তাই ব্যাপারটাকে মানুষ ভাবে অলীক কল্পনা। তাদের ধারণায় যদিওবা বিষয়টা কারো কাছে স্পষ্ট থাকে তবুও সেজন বুঝতেই পারে না যে হারিয়ে গিয়ে শেষপর্যন্ত কী ঠিকানায় সে বসবাস করে। সেই হারিয়ে যাওয়া থেকেই সে তারপর এখানে এই ভঙ্গিল পর্বতমালার নির্জনতায়, কল্পনাশ্রয়ী দেবতাদের সুরম্য বাসভূমির উদাসীন সান্নিধ্যে।
শৈবাঙ্কন একলাপথিক নিজস্ব বিশ্বাসে আর আচরণে, তবে সঙ্গীবিহীন নয়। কেউ কি সঙ্গীবিহীন হতে পারে ? আর কিছু না হোক, প্রত্যেক মানুষ নিজেই তার নিজের সঙ্গী। নির্বাসিত কোন মানুষ একা হয়েও কিভাবে নাহলে বেঁচে থাকতে পারে? অকূল সমুদ্রে জাহাজডুবিতে বেঁচে থাকা একটি মানুষের গল্প একবার শুনেছিলাম লাইফবোটও ছিল না যার সঙ্গে। সেই মানুষটি সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থেকেছিল টানা উনিশ দিন, তার মধ্যে ছিল অন্ধকার রাতের বিভীষিকা আর দিনের দিকবিদিক না পাওয়া অথৈ ঢেউয়ের আস্ফালনেও সে বেঁচে থেকেছিল আত্মবিশ্বাসকে সঙ্গী করে। তারপর আরেকজনের কাহিনীও সবাই বলাবলি করেছিল যে পথ ভুলে গিয়েছিল আদিগন্ত এক মরুভূমিতে। সে সেই আত্মবিশ্বাসকে সঙ্গী করে মাসখানেকের চেষ্টায় ফিরে এসেছিল লোকালয়ে। এখানেও শৈবাঙ্কনের সঙ্গী সে নিজেই, তার উদ্যম, তার লক্ষ্য, তার প্রেরণা। একাগ্রতা আর দৃঢ়তা মানুষকে এভারেস্টের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দেয় বলে জানি। নিজের মত সঙ্গী নিজের আর কেউ হতে পারে না। তবে এখানে তার সঙ্গী সে কেবল নিজেই নয়। উপত্যাকার অন্য সব বাসিন্দারাও আছে, তারা দূর দূর গ্রামে থাকে, প্রান্তরের বুকে ভেড়ার পাল চড়ায়। আদিবাসী সেইসব মানুষরা ছাড়াও রয়েছে নিঃসঙ্গ পথিকরা, আছে ভবঘুরে চরিত্রের মানুষ,দেবতার সান্নিধ্য খোঁজা তার মত কিছু বিচরণকারী ভ্রমণার্থীর দল এবং দেশি-বিদেশি পর্যটকরা।
শৈবাঙ্কন যখন শৈবি নামে পরিচিত ছিল তখনকার দিনগুলি তার মনে পড়ে। বাবা-মা ও পারিবারিক সদস্যদের সঙ্গে যত খুশি কথা বলতে কেউ তাকে বাধা দিত না। তার ওপর বাইরে ছিল বন্ধু ও সহপাঠীরা। স্কুলে আর খেলার মাঠে সঙ্গীদের সাহচর্যে আরও অনেক কথা বলার সুযোগ ছিল সবসময়। তবুও মনে হতে পারত আরও কথা বলা যেত। সেই ঘাটতি পূরণ করার জন্য সে অন্য উপায় খুঁজে নিয়েছিল। যখন বন্ধুরা নেই, পরিবারের লোকজন নিজেদের কাজেকর্মে ব্যস্ত, কোন মানুষ সঙ্গীকে পাওয়ার উপায় থাকত না যেখানে সে চলে যেত বাড়ির কাছাকাছি বনে-বাদাড়ে বা খোলা মাঠে কিংবা জলাভূমির ধারে। শৈশবে এই একটা বাড়তি সুবিধে তার ছিল শহরবাসী না হওয়ার কল্যাণে। ওই পরিবেশে গাছপালা, ঝোপঝাড়, পাখি, ঘাস-লতা-পাতা আর আকাশের যথেচ্ছ দেখা পাওয়ার মধ্যে কোন কার্পণ্য ছিল না। জংলা ঝোপের সঙ্গে সে সমরায়োজন করত। বাঁশবনের ধারে সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা সেইসব ঝোপের আগাছার সব তার শত্রুপক্ষীয় সৈন্যসামন্ত, তাদের সঙ্গে অনর্গল কথা বলে যেত রনং দেহি মেজাজে। তারপর যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত একসময়। তার হাতে থাকত লম্বা বাঁশের কঞ্চি যা ছিল তলোয়ারের প্রতিরূপ আর নিজেকে সে ভাবত পরাক্রমশালী দ্বিগ্বিজয়ী সেনাপতি বা সম্রাট। মুখে থাকত অবিশ্রাম রণহুঙ্কার ও প্রাসঙ্গিক আলাপচারিতা এবং ধারালো হাতিয়ারের মুহূর্মুহূ আঘাতে আগাছা সমুদয়ের ডাল-পাতা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ধরাশায়ী হতে থাকত। ঘন্টার পর ঘন্টা চলত এই যুদ্ধযাত্রা। এছাড়াও সে কখনো হত ধর্মপ্রচারক বা আবিস্কারক বা সুবক্তা আর তার অনর্গল কথোপকথন চলত গাছ-পাখি ও আদিগন্ত আকাশের মেঘরাজি বা মাঠসমূহকে একনিষ্ঠ শ্রোতা বিবেচনা করে। কয়েক শতাব্দীর ব্যবধানে আরেকটি প্রযুক্তিবিপ্লব ঘটল সভ্যতার ইতিহাসে আর তাতে পাল্টিয়ে গেল জীবনযাপনের মৌলিক অজস্র অভ্যেস। কথা কম কাজ বেশি। এই মূলমন্ত্র এতদিন চালু ছিল কাজের দুনিয়ায়। নতুন প্রযুক্তি এসে তাকে নিশ্চিতভাবে বাস্তবে রূপায়িত করল। এখন আর অফিসে-আদালতে প্রশিক্ষক বা উচ্চপদস্থদের বলে বলে হদ্দ হয়ে যেতে হল না শিক্ষার্থী বা অধস্তনদের ওই সারকথা। প্রযুক্তি বাধ্য করল সবাইকে অথবা সবাই স্বেচ্ছায়-সানন্দে বরণ করে নিল কাজের দুনিয়ার সেই মূলমন্ত্র নিজেদের জীবনে।
এক বন্ধু তাকে একদিন বলল, ‘শৈবি, এখন আর ফোন করার দরকার নেই। টেক্সট করবি আমাকে।’ অল্পদিনের মধ্যেই সে দেখল পাশাপাশি যে বন্ধু রয়েছে তার সঙ্গেও কথা না বললে চলে, মেসেজে কথা চালাচালি অনেক সহজ অনেক সরল এবং তাতে মাথাব্যথা আর পরিশ্রমও অনেক কম। ‘বারে বাঃ, কী সুন্দর ব্যবস্থা বার করল মানুষ মাথা খাটিয়ে !’ বলল সে নিজেকে নিজে। কাউকে বিরক্ত না করে, কোন সময়ের অপচয় না ঘটিয়ে, কোন কাজে ব্যাঘাত না এনে এভাবেও কারো সঙ্গে কথা চালিয়ে যাওয়া যায় ? নিঃশব্দে কথা বলার এই যে যুগান্তকারী উপায়ের উদ্ভাবন ঘটাল মানুষ সহস্রাধিক বৎসর প্রাচীন সভ্যতায় এমনটি আর দেখা যায় নি কোনদিন। মানুষের বুদ্ধিমত্তা বুঝি বা আবার সৃষ্টিকর্তাকেও অবাক-অভিভূত করে দিল !
সমস্তটা বিশ্ব ঘরে চলে আসার অভাবনীয় প্রক্রিয়া শুরু হল। শুধু নিজেকে তার আনুষঙ্গিক করে নিতে হবে। সব মানুষের সঙ্গে সেও যেভাবেই হোক নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারছিল। একসময় দেখা গেল কেবল ঘরই নয়, সারাটা পৃথিবী কোন একটি মানুষ নিজের মুঠিতে নিয়ে আসতে সক্ষম হচ্ছে। আজ যা নতুন, কাল তা পুরনো ও বর্জনীয়— সদাচঞ্চল সদাপরিবর্তন নিত্যনতুন উপায় রোজই আগমন ঘটাতে লাগল মানুষের জীবনে। এই অস্থিরতা এই ধারাবাহিক নতুনত্ব অন্যকথায় চলমান জীবন ও ঘটমান উন্নয়নের পরিবর্ত প্রকাশ মাত্র। আগে তাকে বই পড়তে বা খুঁজতে লাইব্রেরি বা দোকানে যেতে হত। দিনের পর দিন কেটে যেত সংগ্রহের চেষ্টায়। এখন গোটা লাইব্রেরি ও দোকান তার ঘরে এসে উপস্থিত, এমনকি তার মুঠোর মধ্যে। জাগতিক, মহাজাগতিক সমস্ত তথ্য সমস্ত খবর আঙুলের ছোঁয়াটুকুতেই কাছে এসে হাজির হবে। সিনেমা, সাজসজ্জা, খাওয়াদাওয়া, খেলাধুলা নাচ ও গান ইত্যাদি সমস্ত বিনোদন সমস্ত প্রয়োজন সমস্ত আনন্দ চাইলেই যখন খুশি নাগালে এনে দেবে এই নয়া প্রযুক্তির জাদুকাঠি। এখন এদেশ-বিদেশ কোন স্থানের কোন জনের বা কোন বিষয়ের কোন খবর নানান দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থিত করবে একাধিক খবরের চ্যানেল। সবকিছু পাল্টিয়ে যেতে লাগল দু’-আড়াই দশকের মধ্যেই, দুরন্ত গতিতে এবং সে প্রায়ই তখন ভাবত, ‘মাঝেমধ্যে মনে হয় সব কি সত্যি দেখছি, সত্যিই ঘটছে, নাকি সমস্ত কিছুই স্বপ্ন অথবা মায়া ?’
তারপর শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শুরুতে অতিমারির কবলে পড়ে মানুষের সভ্যতা ও জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ল।পৃথিবী জুড়ে মানুষরা সব গৃহবন্দী আর মুখোশঢাকা জীবন। চলমান সভ্যতার থেমে যাওয়ার উপক্রম। প্রশ্ন উঠল, এটাই মানুষের শেষসময় কিনা। তখন এই অতিমারিকে মোকাবিলা করে মানুষের জীবন চালিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাতে সহায় হয়ে এল এই নতুন প্রযুক্তি। সে নিজেও ভাবছিল সেসময় যে মানুষের আয়ু বোধহয় সত্যিই এবার ফুরিয়ে এল। এতে তার মধ্যেও অন্য আর সবার মত অসহায় বিলাপ জেগে উঠেছিল। সেও চাইত না সভ্যতা এখানেই শেষ হয়ে যাক। বিশ্ববাসীর সম্মিলিত সেই ইচ্ছের সম্মান রাখতে রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হল নয়া প্রযুক্তি। এই উপায় হয়ে উঠল নিরুপায়ের অবলম্বন। সবার সঙ্গে সঙ্গে সেও ভাবল, ‘ভাগ্যিস যথাসময়ে আবির্ভাব ঘটেছিল এই নয়া প্রযুক্তির, নাহলে যে কী হাল হত সভ্যতা ও মানুষের !’
এতকিছু ঘটে গেলো এত কম সময়ে যে সে এর মধ্যে বোঝার কোন সুযোগ পায়নি কোনকিছুর কোন ঘাটতি কোন অভাব আছে কিনা। তবে কখনো কোন গভীর রাতে বা নির্জন অবকাশে তার মধ্যে হঠাৎ অনুভূত হতে থাকে কী এক অস্বস্তি। এভাবেই চলতে থাকে দিনের পর দিন। পুরনো আর নতুন দুই প্রজন্মের দুই প্রযুক্তির সন্ধিক্ষণ পার করে আসা সে একদিন হঠাৎই প্রশ্ন করল নিজেকে, ‘এর চেয়ে কি আগের জীবনটাই ভালো ছিল না ?’ কারণ সে এতদিনে কথা না বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠেছে, অজস্র মানুষের গাদাগাদি ভিড়ের মধ্যে থেকেও একা হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণায় অস্থির। ততদিনে সে ভাবতে শুরু করে দিয়েছে, ‘তাহলে এই অস্বস্তিকর মানুষের ভিড় এড়িয়ে নির্জনতায় অপার্থিব সঙ্গীর খোঁজে বেরিয়ে যাওয়াই তো ভালো। তাহলে খুঁজে দেখা যেতে পারে দেবলোকে গিয়ে দেবতাদের সঙ্গী হিসেবে পাওয়া যায় কিনা।’ কারণ সে একটা ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত ছিল যে দেবতারা আর যাই হোক মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার করতে চাইবে না, তারা অন্তত টেক্সট মেসেজ করা পছন্দ করবে না। যেহেতু জানা আছে যে দেবতারা সবাই অন্তর্যামী এবং যেকোন লোকে মুহূর্তের মধ্যে বিচরণের কৌশলে অভ্যস্ত।
আগের জীবন মানে নয়া প্রযুক্তির আবির্ভাবের আগের অবস্থা, সেই সময়টা পরবর্তী সময়ের তুলনায় ভালো ছিল কিনা এমন প্রশ্ন কারো মনে উদয় হওয়া মানে কেঁচে গণ্ডূষ পাকানোর মত অবস্থা। এই প্রজন্মে যাদের সূচনা যাদের আগমন তারা কেউ তার মত এমন অবান্তর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে জানে না। এমন প্রশ্ন মনে হয়াটাকেও তারা বোকামি বলে ভাবে। যদিবা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করা যায় তো তারা বলবে, ‘এটাই মানুষের স্বভাব। নতুন কিছু মেনে নেওয়াতে গ্রহণ করতে তার আপত্তি আর অস্বস্তি। প্রথম শিল্পবিপ্লবের পরও তখনকার মানুষ তাকে স্বাভাবিক বলে ভাবতে পারেনি, ওই শ্রেণিভুক্ত মানুষের মনে তখনও এমনই বিদ্বেষ ছিল। সেবারও তার মধ্যে অনীহা দেখা গিয়েছিল যান্ত্রিক প্রগতি সহজভাবে মেনে নেওয়াতে। পরে সেই মানুষটি বুঝতে শিখল ট্রেন, বাস, প্লেন, কলকারখানা অপরিহার্য। উন্নয়ন বাদ দিয়ে মানুষ চলতে পারে না, সভ্যতার বিকাশ ঘটে না।’
সে তাই কাউকে কিছু বলতে যায়নি। যেহেতু সে জানত না বিশ্ব জনমত কিভাবে সে নিজের চিন্তানুসারি করতে পারবে। সে তার চেয়ে বোবা লোকালয় থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে সরিয়ে নেওয়ার প্রয়াসকে বরণীয় বলে ভাবতে থাকে। ক্রমশ সে নিজেকে আবিষ্কার করে নীরব প্রকৃতির সবাক ঘনঘটায়। আবার তাকে ফিরে পাওয়ার প্রক্রিয়া সরব হয়ে ওঠে তার মধ্যে। জগৎ তারপর যত খুশি শুয়ে থাকতে পারে পায়ের চলাফেরার তলায়, যত খুশি ঘুমিয়েও থাকতে পারে নির্জীব নিঃসঙ্গ হয়ে তাতে তার কিছু যায়-আসে না। সে জানে তার আত্মার অন্দরে যার বসবাস তার খোঁজে সে প্রবহমান স্রোতের মত, হদিশ পাক বা না পাক। তার মধ্যে এখন এটাই সান্ত্বনা যে সেই অপরূপের কথা সে ভাবতেও পেরেছে। আর কিছুক্ষণ পর রাত্রির আলিঙ্গনে দিন মুছে গেলে সে একটি নিঃসঙ্গ তারার মত হারিয়ে থাকবে কালো আকাশের গায়ে ফুটে ওঠা অগণিত তারার ভিড়ে। দিন কি অনন্ত হতে পারে না ? রাতে অন্ধকার না আসতে দেওয়ার কি কোন উপায় আছে ? তার সঙ্গে একবার এখানেই কোন এক শৈলশিখরের নিভৃত ছায়ায় দেখা হয়েছিল জীবাক্ষ নামে জনৈক ভিক্ষু সন্ন্যাসীর। সে জানিয়েছিল, ‘অনন্ত দিন আর অনন্ত জীবন সমগোত্রীয়। রাত্রি যত স্বল্পায়ু হবে দিন তত দীর্ঘায়ু পাবে। তাহলে তোমাকে আয়ত্ত করতে হবে অন্ধকার দূর করার উপায়। তুমি যদি অন্ধকার দূর করার কৌশল করায়ত্ত করতে পারো তোমার দিন আর কখনও ফুরিয়ে যাবে না। তখন তুমি সহজেই জেনে যেতে পারো অনন্ত জীবন লাভের মন্ত্র।’ তার শুনে খুব আশ্চর্য মনে হয়েছিল। এ বিষয়টা সে কোনদিনও ভেবে দেখেনি। মনেই হয়নি কখনও। সে তাই অবাক প্রশ্ন তুলে ধরেছিল, ‘অনন্ত জীবন পেয়ে কী লাভ ?’ জীবাক্ষ প্রশ্ন শুনে অপ্রসন্ন না হয়ে তাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল। বলেছিল, ‘অন্ধকার না থাকলে যা লাভ, তাই। জীবন আর জগৎ থেকে অন্ধকার নির্মূল করাই মানুষের লক্ষ্য। সবরকমের অন্ধকার। সেজন্যই যুগে যুগে মহামানবরা ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন। অন্ধকার দূর হলেই জগৎ পবিত্র হবে, জনজীবনে শান্তি আসবে। তাই তো অমৃতের সন্ধান। তুমি চাও না তাকে পেতে ? অমৃতকে, অথবা অন্যকথায়, অনন্ত জীবনকে ?’ এই ভাবনা তার মাথায় ছিল না বলে সে জানত না তা চায় কি চায় না। এখন সে ভাবিত হয়ে পড়ল। কতটা প্রয়োজন কেন প্রয়োজন সব তো বুঝে দেখতে হবে। তার জন্য সময় চাই ভাববার। মনের সেই কথা প্রকাশ করার আগেই জীবাক্ষ প্রস্তাব দিল, ‘চল, আমার সঙ্গে একত্র হয়ে তুমিও করবে অমৃতের সন্ধান। তুমি আর আমি চল একসঙ্গে মিলে অনন্ত জীবন পাওয়ার অভিযানে বেরিয়ে পড়ি। যাবে ? আচ্ছা, সময় দিলাম। কয়েকটা দিন ভেবে মনস্থির করে জানাবে।’
সেই থেকে সে এই ভাবনা নিয়েই দিন কাটাতে শুরু করেছে।
অধ্যায়: দুই
সে তার খুব ছোটবেলাতে মেলায় হারিয়ে গিয়েছিল।
তাদের বাড়ি থেকে মেলাপ্রাঙ্গণ খুব একটা দূরে ছিল না বলেই মনে আছে। ঘন্টাখানেকের পথও হবে কিনা সন্দেহ। কিসের মেলা অত আর এখন খেয়াল নেই। তবে সেই মেলাতে অনেক অনেক মানুষ আর দোকানপাট। কত কত রকমারি দ্রব্যের পসরা সাজিয়ে বসেছিল বিক্রেতারা, আর ক্রেতারাও সেজেগুজে রঙবেরঙের জামাকাপড় পরে সেখানে হাজির ছিল। মেলাতো কত রকমেরই হয়, প্রাচীন কাল থেকে মানুষ মেলার আয়োজন করে আসছে। কোন মেলা কোন অঞ্চলকে ভিত্তি করে তৈরি হয়, পরে হয়তো তা স্থায়ী হয়ে যায় এবং হয়তো সে এমনই বিশেষত্ব অর্জন করে যে দেশকালের গণ্ডি পেরিয়ে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তার কলেবর বৃদ্ধি পেতে পেতে কোনদিন সে আন্তর্জাতিক মেলার মর্যাদা পায়। এ তো গেল বড় মেলার কথা, এছাড়া আছে ছোট ছোট বহু মেলা যারা স্থানীয়ভাবেই সীমাবদ্ধ থাকে। যে মেলায় হোক না কেন, মেলার প্রধান বিশেষত্ব হল প্রচুর লোকের ভিড়, হৈ-হট্টগোল, সারি সারি দোকানপাট, ক্রেতা-বিক্রেতার আনাগোনা, বিনোদনের বিপুল সম্ভার। এক কথায় তাই বলে সবাই, মেলা হল মানুষের মিলনস্থল। নানা বর্ণের, নানা ধর্মের, নানা ভাষার, নানা জাতির, নানা স্বভাবের, নানা চেহারার মানুষ।মেলায় তারা সবাই একত্র হয়, একে অন্যের সঙ্গে মিশে যায় স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বা পরিচিতি হারিয়ে সাময়িকভাবে। মেলাপ্রাঙ্গণে যে মানুষগুলিকে দেখে অন্য কোন মানুষ তাদের প্রথম দর্শনে কেবল মানুষ বলেই ভাবে, পরে হয়তো ঘনিষ্ঠ হলে পর তাদের নিজস্ব স্বভাবচরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে, মেলাতে উপস্থিত থাকে কেবলই মানুষ, তার বর্ণ-জাতি-ধর্ম ইত্যাদি উহ্য রেখে।
খুব ছোট ছিল সে যদিও দিনটা তার বেশ মনে আছে। বাবা সেদিন দিনে-দিনেই কাজ থেকে বাড়ি চলে এসেছিল। মা যেন কী একটা কাজে ব্যস্ত ছিল। বাবাকে এমন হঠাৎ বাড়ি ফিরতে দেখে অবাক। তারও বেশ আনন্দ হয়েছিল। কী যেন খেলছিল উঠোনের কোন অংশে, বাবাকে দেখে ছুটে চলে এল। বাবা রোজই কাজ সেরে বাড়ি ফেরে রাত করে। তার চোখ তখন ঘুমে জড়িয়ে আসতে থাকে। বাবার সঙ্গে অনেক গল্প করার ইচ্ছে থাকলেও করা হয় না। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে পর দেখে বাবা কাজে বেরিয়ে গেছে। তখন তার নিজের ওপরই বেশ রাগ হয়, রাতে বাবাকে পেয়েও ঘুমিয়ে পড়ার জন্য।
বাবার গলা পেয়ে মা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,
‘হঠাৎ এখন চলে এলে ?’
বাবা তাকে কোলে তুলে নিয়েছিল। ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে উত্তর দেয়,
‘আজ ওকে নিয়ে মেলায় যাব ভাবলাম। তুমিও যাবে, চল।’
শুনে তার যা আনন্দ হয়েছিল সেই স্মৃতি এখনও অক্ষয়। মাকেও দেখা গিয়েছিল উল্লসিত হতে। আলমারি থেকে নতুন কাপড় বার করে সেজেগুজে নিল। তাকেও তুলে রাখা জামাকাপড় পরিয়ে দিল। তারপর একটু কিছু খেয়ে নিতে বলল সবাইকে। বাবা অরাজি না হয়েও জানাল,
‘বেশি কিছু খাওয়ার দরকার নেই। মেলায় গিয়ে কিনে খাওয়া যাবে।’
সে তখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। হাতেখড়ি হয়েছে সদ্য সদ্য। সরস্বতী পুজোর পুরুতঠাকুর মায়ের অনুরোধে তাকে স্লেট-পেন্সিলে প্রথম লিখিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকে সারাদিন মা কাজের ফাঁকে তাকে পড়াশুনা করায়। বাল্যশিক্ষা বই কিনে এনে দিয়েছে বাবা বাজারের দোকান থেকে। সেখানে মা তাকে পড়ায়, ‘অ-য় অজগর আসছে তেড়ে।’ আর মা মুখস্থ করায় কবিতা, ‘পাখিসব করে রব রাতি পোহাইল।’ কাঠের ফ্রেমঘেরা কালো স্লেটের ওপর মা চক দিয়ে লিখে রাখে, ‘অ-আ ……ক-খ,’ সে তাতে হাত বুলিয়ে যায়, আবার সেই শিক্ষা অনুযায়ী সে অক্ষরগুলি না দেখে লেখার চেষ্টা করে মায়ের সামনে। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি। তারপর হঠাৎ এই মেলায় যাওয়া। জীবনে সেই প্রথম তার এত জন সমাগমে হাজির হওয়ার অভিজ্ঞতা। এত মানুষের ভিড় দেখে সে অবাক হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীটা এত বড় ? এই এত এত মানুষ তারা সবাই এখানে এই মেলাতে থাকে ? মেলাতে এত লোকের জায়গা হয় কী করে ? আর কত কত জিনিসপত্রের পসরা ! জগতে এত জিনিসও আছে ? এত জিনিসপত্র দিয়ে কী করে মানুষ ? পেল কোথায় এসব ? কাদের জন্য এতসব জিনিস সাজিয়ে রাখা হয়েছে মেলাতে ?
মেলাপ্রাঙ্গণের ভিড় আর জাঁকজমক তাকে বিস্ময়াভিভূত করে দিয়েছিল। যা দেখে তাতেই তার চোখ আটকে থাকে। বাবা কোল থেকে তাকে চলতে দিয়ে মাকে বলল,
‘নিজের পায়ে চলতে শিখুক।’
‘পারবে কি ?’
মায়ের গলায় ছিল দ্বিধা। বাবা বলেছিল,
‘একদিন না একদিন পারতেই হবে। আজ থেকেই শুরু হোক সেটা।’
তবে হাতটা ধরে রেখেছিল বাবা, আর চলছিল কিছুটা মন্থর পায়ে যাতে তার পক্ষে চাপের না হয়ে যায়। সে হাঁটছিল, হাঁটতে নিজের পায়ে ভালোই লাগছিল, কিন্তু মেলার নানান আয়োজনে চোখ আটকে যাওয়ার জন্য থেমে থেমে যাচ্ছিল আর তাতে হোঁচট খেতে হচ্ছিল।মা তার অবস্থা দেখে আশঙ্কা প্রকাশ করলেও বাবা ছিল নির্বিকার।
মেলা মানে মিলনস্থল। সব মানুষ যেখানে এসে মেশে। সব নদী যেমন মেশে সমুদ্রে। এও ঠিক তেমন, জনসমুদ্র। নদীরা যখন সমুদ্রে মেশে তাদের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় হারিয়ে যায়। এখানে এই জনসমুদ্রেও মানুষ তার পরিচয় হারিয়ে ফেলে। অন্যকথায়, প্রতিটি মানুষ মেলায় এসে হারিয়ে যায়। কোন মানুষকেই আর আলাদা করে চেনার উপায় থাকে না।
বিচিত্র এক জনসমাবেশ এই মেলা। এখানে নাগরদোলা, সার্কাস, রাইড সবই আছে। একপ্রান্তে জাদুকর জাদুবিদ্যাও দেখাচ্ছে। পৃথিবীর সমস্ত জাতি-উপজাতি-জনগোষ্ঠী এখানে এসে হাজির। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান। এই মেলাতে রয়েছে পৃথিবীর সমস্ত বস্তুর প্রতিভূ একেকটি সংস্করণ। পাহাড়-নদী-জঙ্গল-সমুদ্র-মরুভুমি কী নেই এখানে ? আবার মাথার ওপর একটি আকাশও বর্তমান, কখনও তা তারকাখচিত, কখনও চন্দ্রালোকে উদ্ভাসিত, কখনও বা সূর্যবিকশিত। পৃথিবীতে যত মানুষ বা প্রাণি বা গাছপালা ছিল, আছে বা আসবে তাদের সবারই একেকটি প্রতিরূপ এখানে উপস্থিত। এমনই সংযুক্তিপ্রভাব মেলাতে। সেই মেলাতে গিয়েই সে হারিয়ে গিয়েছিল, একেবারে ছোট্টবেলায়। আর সেই থেকে হারিয়েই থেকেছিল। কিভাবে হারিয়ে গেল ? তার নিজেরও সেটা ধারণায় নেই। বাবা-মা সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও ঘটেছিল ব্যাপারটা। মজার কথা হল এই যে মেলাতে হারিয়ে গেলেও বাবা-মা তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এমন নয়। এই হারিয়ে যাওয়া বড়োই বিচিত্র। বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা মেলা ভার। হারিয়ে যায় যেজন মেলাতে সে কিন্তু চেনা পরিবেশ, চেনা লোকজনকে হারিয়ে ফেলে না। তারা সব তার পাশে যেমন থাকা দরকার তেমন থাকলেও সে নিজে মেলাতে হারিয়ে যায়। এ কেমন বিভ্রম কেউ বোঝে না, যে হারায় সে তো নয়ই। কেবল যে হারিয়ে গেল সে কোন্ পথে জনসমুদ্রে ঢুকেছিল তার কোন হদিশ আর পায় না। সে সেই থেকে মেলাপ্রাঙ্গণেই ঘুরতে থাকে, সেখান থেকে বার হওয়ার রাস্তাগুলি সব হারিয়ে যায়। চোখের সামনে হাতের কাছে থাকলেও সে বুঝতে পারে না। তার কোন দোষ নেই। বুঝবে কী করে সে ? মেলাতে পথ তো আর একটা-দুটো নয়, অজস্র পথের সমাহার চারপাশে। হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ পথ। খুব কম লোকই আসল পথটি চিনতে পারে বা দৈবাৎ পেয়ে যায় যা তাকে মেলা থেকে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করতে পারে। সেই পথ চিনে নেওয়ার চোখ থাকে না সবার, তা বহু সাধ্য-সাধনায় অর্জন করতে হয়। সেই ধৈর্য বা অধ্যবসায় ক’জনের থাকে ? এ বহু কষ্টসাধ্য তপস্যার ফলশ্রুতি। তা যে করতে পারে না সে আজীবন মেলাতে ঘুরেই যায়, যে পথই বাছাই করুক না কেন বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পথ ভেবে তা তাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আবার মেলারই কেন্দ্রবিন্দুতে এনে হাজির করে। এভাবে সে মেলার গোলকধাঁধাতে ঘুরতেই থাকে ঘুরতেই থাকে, বাইরে যাওয়ার পথ আর চিনে নিতে পারে না। তার জীবন তারপর শেষ হয়ে যায় একদিন। সে বুঝতেও পারে না যে সারাজীবন ধরে একটি মেলার জনসমুদ্রে সে অনর্থক ঘোরাঘুরি করে মরল। অনেকে আবার জীবনের শেষলগ্নে এসে টের পায়, কী বেকার ঘোরাঘুরি করে গেছে জন্ম থেকে। তখন তার হাহাকার জাগে অন্তরে, তার মনে আবার জীবনের সূচনালগ্নে যাওয়ার বাসনা হয়। মরিয়া হয়ে সে ভাবে, তাকে আরও বেশিদিন বেঁচে থাকা উচিত।অনন্ত জীবনের মোহ এভাবেই হৃদয়ে বাসা বাঁধে। সেই অনন্ত জীবনকে সে সাদা ভাষায় অমরত্ব বলে বোঝে। জীবনের শেষ লগ্নে এসে যে সব মানুষ এমন অপার্থিব কল্পনাবিলাসের মোহগ্রস্ত হতে পারে এমন নয়। তার এই মোহ যেকোন লগ্নে অন্তরে অঙ্কুরিত হতে পারে। এই মোহ বা বাসনার উৎস কিন্তু অনেক কিছু পাওয়া হল না জীবনে অথচ পাওয়া উচিত ছিল বা পেতেই হবে এমন অদম্য মানসিকতালব্ধ। মানুষের মেলায় হারিয়ে গেল যেজন, এমনকি যে বুঝল না হারিয়ে গেছে সে পর্যন্ত চায় এমন অনন্ত জীবন যাতে সে অনন্তকাল ধরে সেই মেলাপ্রাঙ্গণে অবুঝ ঘোরাঘুরি করে যেতেই থাকে। তার সমস্ত আনন্দ সে ভাবে ওখানেই পাওয়া যাবে। প্রকৃতপক্ষে মেলায় যে আসে সে যদি না বুঝতে পারে যে সে হারিয়ে গেছে তো সে ভাবে, এ মেলা যেন কখনও না শেষ হয়, আর মেলায় যেন সে অনন্তকাল ধরে থেকেই যেতে পারে। একবার যে মেলায় আসে তার মেলাপ্রাঙ্গণ ছেড়ে চলে যাওয়ার কোন ইচ্ছেও থাকে না। এর ব্যতিক্রম এতটাই মুষ্টিমেয় যে ধর্তব্যের মধ্যে আসার উপযুক্ত নয়। প্রত্যেকেই চায় চিরদিন যেন সে মেলাতে থেকেই যেতে পারে, এমনি মেলার আকর্ষণ। সে যে বোকার মত নিজেকে হারিয়ে বসে আছে মেলার গোলকধাঁধায় কে আর তা বোঝে ? সে শুধুই ভাবে, এই মেলাতে জনসমাবেশে সামিল হয়ে থাকাই আমার মূল উদ্দেশ্য, পরমার্থ। হবে না-ই বা কেন ? এত বৈচিত্রের সমাহার মেলাতে যে যত থাকা যায় ততই মনে হয় আরও থেকে যাই। আর যে একবার আসে মেলাতে সে ভাবে চিরটা কাল থেকেই যাব, থেকে যেতে হবে যেকোন মূল্যে, তার জন্য তার যত চেষ্টা যত কাজকর্ম যত কৌশল আর যাবতীয় উদ্যম। অনন্ত জীবন, সাদা বাংলায় অমরত্ব, তাই তার একমাত্র লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য কত যে উপায়ের আশ্রয় নেয় মানুষ ! মাঝেমধ্যে এমন কাজ করে বসে যা করার কোন যুক্তি বা কারণ নেই, এমনকি যা করা একেবারেই অনুচিত। মেলাতে থেকে যাওয়ার অদম্য নেশায় যে কোন পন্থা অবলম্বন করে মানুষ, বৈধ-অবৈধ অথবা ন্যায়-অন্যায়, কিছুই তার করতে বাধে না। ভাবে সবাই, ঢুকে পড়েছি যখন মেলাতে থেকেই যেতে হবে, চলে যাব না কিছুতেই, চলে যেতে পারি না।
সে যে মেলাতে হারিয়ে গিয়েছিল তার জন্য তার বাবাকে অনেকটাই দায়ী করা যায়। কারণ মেলা কী বস্তু সে জানত না, বাবাই তাকে মেলাতে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। আসলে এমনই নিয়ম বা নিয়তি, অধিকাংশ লোকই একা একা মেলাতে হারিয়ে যায় খুব কম ক্ষেত্রে। তাকে মেলাতে নিয়ে আসে তার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুবান্ধব। যারা নিয়ে আসে তাদেরকে সঙ্গে করেই সে মেলাতে হারিয়ে যায় এবং হারিয়ে থাকে। এমনকি ব্যাপারটা বোঝেও না এমনই বিধির বিধান। আসলে ওই যে বলে না, নির্বন্ধ দেখেও কিছু দেখতে পায় না। তার বাবার যদি তাকে নিয়ে মেলাতে আসার শখ না হত তাহলে তার হারিয়ে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ছিল না। সে তো জানতই না, জগতে মেলা বলে কোন বস্তু আছে এবং সেখানে এত জনসমাবেশ ঘটে। না জানলে তার এমন কী ক্ষতি হত ? কী ক্ষতি হয় মানুষের যদি প্রত্যেকেই না কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী হয় ? বা যদি না কেউ জগতে সবার দৃষ্টান্ত হতে পারে অথবা রাবণের মত দশটি মাথার অধিকারী না হয় তার কি বেঁচে থাকা অনর্থক হয়ে যায় ? যদি কেউ পথপ্রদর্শক না হয়ে অনুসরণকারী হয়ে নীরবে মুছে থাকে পৃথিবী কি তাকে তার বুক থেকে মহাকাশে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ? সে পরে ভেবে দেখেছে, বাবা সেদিন তাকে মেলাতে বেড়াতে নিয়ে না গেলেও তার বেঁচে থাকা বিপর্যস্ত হত না। কপালগুণে দোষটা কি তাহলে তার বাবার ? না, বাবার যে কোন দোষ ছিল সেটাও সে মনে করে না। বাবা তার কাজটা করেছিল স্বাভাবিক প্রেরণায়। তার জন্য বাবাকে দোষ দেওয়া সত্যিই উচিত হবে না। কিন্তু মেলাতে যাওয়ার পর যে কাজটা করেছিল বাবা সেটা কি ঠিক ছিল ?
মেলাতে নিয়ে যাওয়ার পর বাবার ইচ্ছে হয়েছিল তাকে স্বাবলম্বী করে দেওয়ার। তাই তাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে মাকে বলেছিল বাবা,
‘একে নিজের পায়ে চলতে দাও।’
ওখানেই যদি থেমে যেত বাবা তো কথা ছিল, কারণ তাকে স্বাধীন পায়ে হাঁটতে দিলেও হাতটি ধরে রেখেছিল তার। পরে যা করল সেটা দুঃসাহসিক। ততক্ষণে তারা মেলার মধ্যে অনেকটা সময় কাটিয়ে ফেলেছে। একনাগাড়ে হেঁটেছে অনেকটা পথ। মা বলল একসময়,
‘কোথাও দু’দন্ড থেমে একটু বিশ্রাম নিলে হত না ? বাচ্চামানুষ, কম তো হাঁটল না।’
‘তা অবশ্য ঠিকই বলেছ। চল, দেখি কোথায় বসা যায়।’
বাবা দ্বিমত করল না। আর খানিকটা হাঁটার পরই কতগুলি দোকানের পারস্পরিক পিঠ ছোঁয়াছুঁয়িতে যে একচিলতে ফাঁকা জায়গা পাওয়া গেল একটা পাকুড় গাছ ছিল সেখানে। গাছটা পাকুড় না হয়ে দেবদারুও হতে পারে। অনেকদিন আগের কথা, গাছটা আর চোখ বুজলে তেমন স্পষ্ট দেখা যায় না মনের বিগত পৃষ্ঠায়। কেমন আবছা ভুতুড়েমার্কা তার অবয়ব। যাই হোক. গাছটা রাম না রহিম, মাটি কি পবন, জল কি হুতাশন তাতে কিছু যায়-আসে না। সে কথা বলুক আর দেখা দিক বা না দিক তাও কোন চিন্তার কারণ নয়। আসল কথা হল, ওই দোকানগুলির পারস্পরিক অবস্থানপ্রসূত স্থানটিতে শীতল ছায়া ছিল, যা রৌদ্রতাপিত মেলাটির অন্তহীন ও সীমান্তবিহীন পথেঘাটে যাঁহাতক উদ্ভ্রান্ত ঘোরাঘুরির অবিশ্রাম বর্ণবিন্যাসে এতটুকু বিচ্যুতি, সান্ত্বনা পুরস্কারস্বরূপ। অথবা কোন সুযোগের সুবর্ণখচিত প্রাপ্তি। মেলাতে এমন শীতল ছায়া অনেক লুকিয়ে থাকে, কেউ দেখে কেউ দেখে না। বাবা-মায়েরা দেখিয়ে দেয়, বন্ধুরা দেখিয়ে দেয়। সেই সূবর্ণরঞ্জিত সুশীতল ছায়াতে প্রাণের আরাম চিহ্নিত থাকে, তাকে গ্রহণ করাও ভাগ্যের ব্যাপার। কেউ পেয়েও চায় না, কেউ চেয়েও হারায়। বড়কথা, খোঁজে না কেউ, অজান্তে হাতে এলেও অবজ্ঞা করে। একেই বলে ললাটলিখন, ললাট কার কেজানে, সেখানে কে লেখে তাই বা কেজানে। যাই হোক, বাবা কিন্তু তেমন একটা ছায়া খুঁজে পেয়েছিল আর মায়ের সঙ্গে তাকে নিয়ে সেখানে বিশ্রামের জন্য বসেছিল। বাবা আর মা অনেক কথাই দুজনে বলাবলি করছিল, আর সে ছিল চুপচাপ, আসলে মেলার বিশালতা তাকে বিহ্বল করে দিয়েছিল এতটাই যে কী দেখে গেল এতক্ষণ সেসব গুছিয়ে ভাবতে গিয়ে ভাবনার চালচিত্র এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। একসময় বাবা বলল,
‘আমি এবার কী ভাবছি জান ? ভাবছি ওকে মেলায় একা ছেড়ে দেব। দেখি, ও কী করে কোথায় যায়।’
শুনে মা আঁতকে উঠল। প্রায় সরবে আশঙ্কা প্রকাশ করল,
‘পাগল নাকি ! যদি হারিয়ে যায় কী হবে ? কোথায় পাব ?’
‘হারাবে না। মেলা যতই বড় হোক কোথাও খোলা নয়। মেলা থেকে তাই কেউ হারিয়ে যায় না।হারালেও মেলার মধ্যেই থাকে। জগতের এটাই নিয়ম।’
বাবার গলা ছিল শান্ত আর অচঞ্চল। মা কিন্তু যুক্তিটা মানতে নারাজ ছিল। পাল্টা যুক্তি সাজাবার চেষ্টা করল তাই,
‘অগুন্তি মানুষ এখানে। এত লোকের ভিড়ে কোথায় চলে যাবে তার কি কোন ঠিক আছে ?’
‘এটাই তো আশার কথা। যদি বা হারিয়েও যায় মানুষের মধ্যেই থাকবে। ভিড়টা যদি মানুষের না হত তো দুশ্চিন্তা ছিল।’
বাবা তার সিদ্ধান্ত থেকে হটে যাওয়ার ইচ্ছে দেখাল না। মায়ের আশঙ্কাপীড়িত মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝাল,
‘ওকে যদি না একা ছেড়ে দাও তো কোনদিন স্বাধীন চলাচলের ক্ষমতা পাবে না। মেরুদন্ড শক্তসবল হতে গেলে স্বাধীনতা দরকার। যদি না ওকে মানুষের ভিড়ে একা চলেফিরে বেড়াবার সুযোগ দিই তো ও পরগাছা হয়ে যাবে। লতানে গাছ হয়ে বেঁচে থাকা মানুষের শোভা পায় না।’
বাবা যা করব বলত করতই, মা প্রতিবাদ জানাতে জানাতে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিত। সবসময়ই এমনটা ঘটত, তার ব্যতিক্রম কিছু হল না এবারও। ছায়ার আরাম ছেড়ে বেরিয়ে বাবা তাকে একা ছেড়ে দিল মেলার আদিগন্ত মানুষের ভিড়ে। মা হতাশ মুখ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর সে যে কী করবে বুঝতে না পেরে হাঁটতে লাগল কোন দিক দিশা না ঠিক করে। একটু সময়ের মধ্যেই রাশি রাশি মানুষের ভিড় তাকে গ্রাস করে নিল। আর সে হারিয়ে গেল মেলার মধ্যে। এত এত মানুষ, কাউকেই সে চেনে না। সবাই যদি অচেনা হয় কাকে সে কী বলবে ? তার খুব ভয় হতে লাগল, নিজেকে অসহায় মনে হল। একজন কেউ চেনা লোক থাকবে না কেন ? যদি না থাকে তো কী করা উচিত ? এরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আর উদ্দেশ্যবিহীন চলতে চলতে তার দেখা হল কোটিকল্পের সঙ্গে। আলাপ হয়ে গেল কিভাবে নিজেই সে বুঝল না। কেবল এটুকু বুঝল, চেনা লোকেরা আসলে অচেনা লোকেদের আড়ালে গোপন থাকে।
অধ্যায়: তিন
আগের দিন প্রান্তরের শেষে নদীর ধার ধরে যে রাস্তা সেখান দিয়ে একটা কনভয় যাচ্ছিল। বিকেল আসার মুখোমুখি সময়ে। বেশ কয়েকটি গাড়ির এক শোভাযাত্রা। যেতে যেতে তারা এখানে থেমেছিল কিছু সময়ের জন্য। ছিল তাতে খান তিন-চারেক এস ইউ ভি ধরনের শক্তপোক্ত গাড়ি ছাড়াও অন্তত দুটি এগারো-বারো আসনের যাত্রীবাহী ছোট বাস। সবাই ভ্রমণার্থী। একেক গাড়িতে একেক দল, নানা দেশের এবং এদেশেরও। ওখানেই গেরহার্টের সঙ্গে তার আলাপ। মধ্যবয়সী, কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ, বেশ লম্বা আর সমর্থ দৈহিক কাঠামো। নিয়মিত ঘোরাঘুরিতে তামাটে গাত্রবর্ণ, টিকোলো নাক। জার্মান ওই ভদ্রলোক পেশায় অধ্যাপক ও দার্শনিক। মুখেচোখে অতীত যুগের আর্যসুলভ গর্ব এবং কথাবার্তাতেও রয়েছে সেই রেশ। তারা পাহাড়ি ঢাল দিয়ে সযত্নে আচ্ছাদিত এক এলায়িত প্রাঙ্গণে ম্যাট বিছিয়ে বসেছিল নানান দলে। একটানা চলতে থাকার মধ্যে একটু থেমে বিশ্রাম নেওয়া ও একইসঙ্গে কিছু খাবার খাওয়ার জন্য। আর খানিকটা সময়ের মধ্যে যান্ত্রিক বাহনের কথা ভুলে মানুষের প্রথম অভ্যেস হেঁটেচলে পরিবেশকে উপভোগ করার বাসনায়। সে ছিল কাছাকাছি, তবে অন্য পার্বত্য ঢালের আড়ালে। ঘুরতে গিয়ে গেরহার্ট তাকে আবিষ্কার করে নিজেই ভাব জমাবার চেষ্টা করল তার সঙ্গে। সে বলল, ‘তোমরা ভারতীয়রা এবং আমরা একই গোত্রের। আমাদের উৎস এক। তোমাদের আর আমাদের গায়ে একই পূর্বপুরুষের রক্ত। তাই তোমাদের সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্যের এতটাই মিল।’
গেরহার্টের কথায় প্রকাশ পেয়েছিল প্রচ্ছন্ন গর্ব। শৈবাঙ্কনের মধ্যে এমন বিশেষ একাত্মবোধ নেই, সে মনে করে সমগ্র মানবজাতিরই পূর্বপুরুষ এক, সবাই একই উৎস থেকে উৎসারিত। কিন্তু নিজের মতামত সে গোপন রাখতে শিখে গেছে এ যাবৎকালের সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে। তাই সে নীরব থেকে গেল।
দিনের প্রকাশ এখন শান্তমনা স্থিতধী পুরোহিতের মত, যেন সে পূজাপর্বের শেষলগ্নে নিবেদিতপ্রাণ কোন ইষ্টদেবতার উদ্দেশ্যে, যেন বলছে, ‘আমার কি কথা বলা উচিত হবে ? নাকি আমি দেখে যাব কেবল আমার এতক্ষণের নিবেদন কী ফল দেয় ?’ পার্বত্যচূড়ার খাড়াই ঢালগুলির পায়ের তলায় স্তূপাকৃতি প্রসারিত নানান আকৃতির পাথর ও বোল্ডারের সমাবেশে কোন চঞ্চলতা নেই, তারাও অপেক্ষমান কোন এক প্রত্যাশায়, আপন আপন অবস্থানে মগ্ন আর দৃশ্যত নীরব। তবুও তাদের অন্তরের কথা কান পেতে বোঝা যায়, শোনা যায় তাদের মৃদুকন্ঠের পারস্পরিক আলাপ, ‘আমরা কিন্তু ঘুমিয়ে নেই। আমাদের গায়ে যে সৌরবর্ণের ছটা আপতিত তাতে কি স্পষ্ট নয় আমরা কী মুগ্ধতা রচনা করতে পেরেছি ?’
আকাশের ভাষা এমনই নীল যাতে কোন কবিতা লেখা হয়ে চলেছে অবলীলায় আর শুভ্রবসনা মেঘের ঝাঁক এখানে-ওখানে উপস্থিত থেকে ছন্দ আর অলংকারের পসরা সাজিয়ে এনে অনুচ্চারিত ভাষায় জানাচ্ছে, ‘তুমি যখন কবিতা লিখছ আকাশ, আমরা তোমার জন্য শব্দচয়ন করে এনে দিচ্ছি। তুমি সাজাও তোমার কবিতা যেভাবে পাহাড়ি প্রেক্ষাপটের গাম্ভীর্য অবিস্মরণীয় মাত্রায় নিজেকে উপস্থাপন করতে পারে।’ তারপর সেখানে হওয়ার এসে যোগ করে তাদের কণ্ঠস্বর, ‘আমরা আছি প্রচারের দায়িত্বে।’
তার পরিবেশকে এভাবে রোজ দেখে শৈবাঙ্কন। কী কথা শোনায় চারপাশের প্রকৃতি সে দীর্ঘদিন তাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে বুঝতে শিখে গেছে তাদের মর্মার্থ। অথবা অন্যকথায়, তার প্রাকৃতিক পরিবেশের সদস্যরা তাকে এতদিন দেখতে দেখতে বুঝে গেছে কিভাবে নিজেদের দেখালে সে জানতে পারবে তাদের অন্তরের কথা। এভাবেই দিন কাটে তার এমন নির্জনতায় স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে। তার নিজেকে একা মনে হয় না।
তবে আজ গেরহার্টের আগমন হঠাৎই তার দৈনন্দিনতায় এক বিক্ষেপ। মানুষের সঙ্গ কি আজকাল তার জন্য অস্বস্তিকর ? হতে পারে না, কারণ উপত্যকার নানা প্রান্তের গ্রামগুলিতে সে যাতায়াত করে আর সেখানকার অধিবাসীদের সঙ্গে মেলামেশায় সে অভ্যস্ত। সমস্ত গ্রীষ্মকাল জুড়ে এখানে ভেড়া আর ছাগলের দল চড়াতে আসে পাহাড়শ্রেণির ওপ্রান্তের দূরদূরান্ত বাসস্থান থেকে আধা-যাযাবর প্রান্তরান্বেষী গাদ্দি সম্প্রদায়ের মেষপালকরা। তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা রয়েছে তার। এখানে এই উপত্যকায় দেবতাত্মার সন্ধানে বাসিন্দা হওয়ার পর বড়োই উপকার হয়েছে। মানুষের পাশাপাশি সে প্রাকৃতিক সদস্যদের ভাষাও শিখে গেছে, কথা বুঝতে পারে তাদের, তাদের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথাও বলতে পারে। ‘তোমাদের প্রাচীন দর্শন জগৎবাসীকে অনন্ত জীবনের কথা শুনিয়েছে। মোক্ষলাভের উদ্দেশ্যে তোমাদের মুনিঋষিরা অনন্ত জীবন অর্জনের পথ কিভাবে পাওয়া যেতে পারে তার সন্ধান দেখিয়ে গেছে। এখানেই তোমাদের বিশেষত্ব। তোমাদের পুরাণ শাস্ত্র তাই অদ্বিতীয়। তোমরা ধর্মকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের মত চর্চা করনি। ধর্ম তোমাদের কাছে মোক্ষলাভের উপায়, যা দেয় অনন্ত জীবনের সন্ধান।’
পাশেই অন্য একটি অপেক্ষাকৃত নিচু পাথরে বসে কথাগুলি বলছিল গেরহার্ট। দু’হাত দুই হাঁটুর ওপর রেখে আঙুলগুলির পারস্পরিক আলতো বন্ধন তৈরি করে আর চোখ ফেলে অনির্দিষ্ট সম্মুখে। পাহাড়ি দেয়ালের ছায়ার ভাষায় সূর্য জানিয়ে দিচ্ছিল যে ওখান থেকে তাকে দেখা যাবে না। ‘যদি তুমি আরও শীতলতাকে পছন্দ কর তো এখানে এসো,’ উন্নত ঢালের আচ্ছাদন ছেড়ে বেরিয়ে আসতে থাকা ছায়া ওকথা বোঝাচ্ছিল দীর্ঘায়িত হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায়। পরিবেশ নিঃশব্দ হতে পারেনি যেহেতু কোথাও কোন আড়ালে একটানা চলমান থাকার কৌশল ব্যবহার করে হাওয়ার সম্মিলিত শনশনানি কলরবে কণ্ঠ মুখর রাখছিল বিরামহীন ভঙ্গিমায় শোনাতে শোনাতে, ‘আমরাও আছি, আমরাও আছি।’
উন্মত্ত হাওয়ার এই প্রবাহ এখানে এই ত্রিধাবিভক্ত পর্বতগাত্রের কল্যাণে বিরচিত খাঁজের ছায়াচ্ছন্ন অঞ্চলে প্রবেশ না করতে পেরে কেবল তাদের মৃদুকন্ঠের দামাল উপস্থিতি ঘোষণা করছিল। সেই শৈত্যপ্রবাহের অস্ফুট রেশ এখানেও বর্তমান যদিও সৌরকিরণের দুর্বলতা প্রকাশিত ছিল ক্ষীণ তপ্ত ভাষ্যে, ‘আরও সতেজ থাকার উপায় কী আমার ?’ কারণ এখানে এই বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে আবহাওয়ার চরিত্রে উষ্ণতা অনুপস্থিত গ্রীষ্মের এমন প্রখর সময়ে। এটাই স্বভাব এই অঞ্চলের নিরবচ্ছিন্ন ঘোষণায়, ‘আরও বেশি উষ্ণতা আমার চরিত্রে নেই। কী করব, এখানে আমাকে এমনই মেজাজে দেখতে পাবে। থেকেই দেখ, ভালো লাগবে অবশ্যই।’ শৈবাঙ্কন শ্রোতা হয়ে থাকতে পছন্দ করে সবসময়, আর এখনও। কী শুনে তার কী মতামত সহজে সে ব্যক্ত না করতে অভ্যস্ত। তার আয়ত কালো চোখও কথা বলে না, ওষ্ঠাধরে অনুচ্চারিত ভাষা ভরাট মুখমণ্ডলে কোন ভাব প্রকাশ করতে জানে না। প্রশস্ত কপালে থাকে না ভাঁজ, এলোমেলো অযত্নলালিত দীর্ঘ কালো চুল কাঁধে নেমে থাকে নীরবে, চঞ্চল থাকে স্পষ্ট প্রকাশিত আলম্ব দুটি কানের দু’পাশে। তার স্থির সমর্থসবল ঋজু দেহে থাকে না কোন চঞ্চলতার প্রকাশ, প্রশস্ত দুই কাঁধ থেকে নেমে আসা কোলের ওপর রাখা দু’হাত সে কথা বলুক আর না বলুক চলাচল করে না। এতকিছু বলার পরও তাকে নীরব দেখে গেরহার্ট প্রশ্ন করেছিল তার মুখে দৃষ্টি ফেলে,
‘তুমি কোন্ ধর্মে বিশ্বাসী ? বৌদ্ধ ? এই অঞ্চলে জানি বজ্রযান মতাবলম্বী বৌদ্ধরা থাকে। বৌদ্ধধর্ম মূলত হিন্দুধর্ম থেকেই বিচ্যুতি ঘটিয়েছে এবং এখানেও আছে অনন্ত জীবনের বিশ্বাস, যেহেতু তারা জন্মান্তরবাদকে মেনে নিয়েছে। তারাও বলে, একই মানুষ এক জন্ম থেকে অন্য জন্মে বিচরণ করতেই থাকে বিভিন্ন পরিচয়ে আর এভাবেই কোন মানুষের মৌলিক সত্ত্বা অবিকৃত থেকে যায় অনন্তকাল যা অন্য কথায় অমরত্বেরই এক বিশেষ রূপ। তুমি কোন্ ধর্মমতে আছো ? বৌদ্ধ বলে মনে তো হয় না তোমার চেহারা আর পোশাক দেখে। মুন্ডিতমস্তক নও, অঙ্গ আচ্ছাদিত নয় তাদের নির্দিষ্ট পোশাকে। হিন্দু মনে হচ্ছে, কিন্তু সন্ন্যাসী বলেও মনে হয় না। অথচ থাকছ এখানে। স্থানীয় অধিবাসী যে নও তাও তোমার চেহারায় স্পষ্ট। বোঝা যাচ্ছে সমতলের মানুষ।পরিব্রাজক ?’ এবার কিছু বলতেই হয়, না বলা অশোভন। মৃদুকণ্ঠে সে জানাল,
‘ঠিকই ধরেছ, আমি সন্ন্যাসী নই। না বৌদ্ধ, না হিন্দু সন্ন্যাসী। আমি সমতলেরই বাসিন্দা ছিলাম। পরিব্রাজকও ঠিক নই। আমাকে অভিযাত্রী কি বলা যায় ? নিজেও জানি না আমি ঠিক কী। তবে এখানে আছি এই অঞ্চলকে ভালো লেগেছে বলে। মনে হয়েছে এখানে হয়তো এককালে দেবতারা বসবাস করত। এখানকার আকাশে-বাতাসে-পরিবেশে এখনো তাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস আমি অনুভব করি। মনে হয় এখনো তাদের স্পর্শ থাকছে এই এলাকার অঙ্গসজ্জায়, সুউচ্চ পাহাড়ের ঢালে, বিছিয়ে থাকা পাথরের মেলায়, গিরিখাতে, স্পিতি নদীর জলধারায় আর তার ওপাশের গুচ্ছ গুচ্ছ টিলা ও শৃঙ্গের বর্ণবৈচিত্রে। এখানে শৈত্যপ্রবাহে, সূর্যকিরণের নানা চরিত্রে, অবারিত প্রান্তরের ঢেউখেলানো ছন্দে, হাওয়ার চলাফেরায়, পাহাড়ি ঢালের গাম্ভীর্যে আর রাতে অন্ধকার ঘনঘটায় তারকারাজির নিঃস্পন্দ কোলাহলে বা পূর্ণিমাতিথির চন্দ্রকলার জ্যোৎস্নাবিকশিত ভাষ্যে আমি সেইসব দেবতাদের অশ্রুত কণ্ঠের আলাপ শুনতে পাই। আমি আধুনিক প্রযুক্তির প্রশ্রয়লালিত ক্রমশ ভাষা ভুলতে যাওয়া মানুষের ভিড়ে থেকে থেকে জীবনের স্বাদ আর আহ্লাদ হারিয়ে চলে এসেছি এখানে। ফার ফ্রম দা ম্যাডিং বাট স্পিচলেস ক্রাউড এখানে খুঁজতে এসেছি নীরব প্রকৃতির বাসিন্দারা সবাই আমার সঙ্গে সবাক হতে পারে কিনা তার সন্ধানে।’
সে যতটা সময় নিচ্ছিল তার সমস্ত কথাগুলি বলার জন্য ততক্ষণ গেরহার্ট নির্বাক শ্রোতা হয়ে রইল। তার চোখ থাকল সোজাসুজি পাহাড়ি ঢালের আড়াল থেকে বেরিয়ে রয়েছে যতটুকু আকাশের নীল সমাচার তার দিকে, যদিও সেই নীলে তার নীল চোখ ঠিক পড়েছে এমন মনে হচ্ছিল না। শৈবাঙ্কন থামলে পর তার দিকে ফিরে তাকিয়ে গেরহার্ট দরদভরা গলায় জানাল,
‘তোমার এই মনোভাব আমার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, প্রায় হুবহু। কী জান, কোন মানুষই পৃথিবীতে নিঃসঙ্গ নয়। জীবনের কোথাও না কোথাও প্রত্যেকেই তার দোসর খুঁজে পায়। আধুনিক পৃথিবীর চালচলন আমারও পছন্দ নয় বলেই বছরের অধিকাংশ সময় আমি ঘুরে বেড়াই। হিমালয় আমাকে অভিভূত করে, এই পর্বতমালার সঙ্গে মাখামাখি হয়ে আছে তার মতই সুউন্নত সুগম্ভীর দার্শনিক তত্ত্ব, অবশ্যই বৈদিক হিন্দু সভ্যতার, যেখানে লুকিয়ে রয়েছে জীবনের রহস্য। তারই টানে আমি এখানে বারবার আসি, বিগত দশবছরে অন্তত ছ’বার তো হবেই। যতবার এসেছি ততবারই মনে হয়েছে জীবনকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছি, চোখে পড়েছে কিছু না কিছু অভিনবত্ব। এই পর্বতশ্রেণির খাঁজে খাঁজে, শৃঙ্গরাজিতে, আনাচে-কানাচে জড়িয়ে আছে বৌদ্ধ আর হিন্দু দর্শনের অমৃতভাণ্ডার, যেখানে পাওয়া যায় অমরত্বের সন্ধান। এই অমরত্বের খোঁজেই এখানে গুহায় বসতি স্থাপন করে ধ্যানমগ্ন থেকেছেন সহস্রাধিক বছর ধরে তপস্বী ঋষি ও সন্ন্যাসীরা।আমাকে এই ব্যাপারটা বিস্মিত করে। আমি এখনও বুঝতে পারি নি ওই দার্শনিক তপস্বীরা কেন অমরত্বের সন্ধানে মগ্ন থেকে জীবনের মোহ ভুলে যেতেন। জীবনের মোহই যদি তাঁদের না থাকল তো অমরত্বের খোঁজ কেন ? ব্যাপারটা কী, কিসের এমন ব্যাকুল সন্ধান ?’
জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল গেরহার্ট। সে কিছু উত্তর আশা করছিল। একটু তাই চুপ করল। শৈবাঙ্কন কিছু বলল না, সে বুঝতে পারল না কী বলা উচিত। নির্বাক ভাষা তার চোখেমুখে, স্থির অচঞ্চল বসে থাকা। তাকে নিরুত্তর দেখে গেরহার্ট প্রশ্ন তুলল,
‘তোমার কখনও অনন্ত জীবনের রহস্যটা কী জানার ইচ্ছে হয়নি ? অবশ্য তোমার এই নির্জন প্রদেশে আসা যদিও অন্য কারণে, তবুও জিজ্ঞেস করছি যেহেতু তুমি বললে দেবতাত্মার অন্বেষণ তোমার একটা বড় উদ্দেশ্য। দেবতারা তো হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী অমৃতের অধিকারী হওয়ার সুবাদে অমরত্বপ্রাপ্ত। তুমি কোনদিন এই অমরত্বের বিষয়ে কৌতূহল বোধ করোনি ?’
খুবই নরম ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সে, কোনভাবে উত্তর দেওয়ার মত। সত্যিই তার এই ব্যাপারে কোনদিন কৌতূহল হয়নি। অমরত্ব শব্দটা জানে সে, এই পর্যন্ত। কিন্তু এই জানা অন্য অনেক কিছু জানার মত যেসব বিষয় মনে কোন দোলা দেয় না। তাকে এই একই ব্যাপারটা বলেছিল সন্ন্যাসী জীবাক্ষ। এইতো কয়েকদিন আগে। কী আশ্চর্য, কথাটা সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। তার কাছে উত্তর জানতে আসবে সে বলে গিয়েছিল। কিছু তো বলতেই হবে। ভাগ্যিস আজ গেরহার্টের সঙ্গে দেখা হল, তাই তার মনে পড়ল বিষয়টা। কিন্তু কী বলবে সে ওই ভিক্ষু সন্ন্যাসীকে ? তার কি অনন্ত জীবনলাভের অভিযানে যাওয়ার কোন ইচ্ছে আছে ? বর্তমান জীবনের ব্যাপ্তিকে দীর্ঘায়িত করে যাওয়ার এমন বিশেষ এক প্রক্রিয়া যার আবিষ্কার দেবে অনন্ত জীবন। সেই বিশেষ উপায় প্রাচীন মুনিঋষিদের করায়ত্ত ছিল বলে শোনা যায়। তা কি গল্পকথা নাকি বাস্তব ? কিন্তু তাতেও কি অমরত্ব পাওয়া গিয়েছিল ? যদি যেত তো সেদিনের সেই মানুষগুলি আজ গেল কোথায় ? তাদের তো এখনও বেঁচে থাকার কথা ছিল ? তারা তাহলে অমরত্বের কথা কেন বলেছিল বা কী অর্থে অমরত্বের সন্ধান করছিল ? অনন্ত জীবন বলতে জীবাক্ষই বা কী বোঝাতে চেষ্টা করেছে ? কোথায় কিভাবে চলবে তার অন্বেষণ ? আরও বড় প্রশ্ন, কী উদ্দেশ্যে এমন অনুসন্ধান।
লোকজনের গলার আওয়াজ শোনা গেল ধারেকাছে। অনেকে মিলে এগিয়ে আসছে বোঝা যাচ্ছিল। গেরহার্ট উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘সঙ্গীরা আমাকে খুঁজছে। আমি এবার যাব। তাবো হয়ে কাজা, আর সেখান থেকে চন্দ্রতাল লেক। পথে আরও কিছু গন্তব্য আছে, যেমন ধনকর ভিলেজ ও ধনকর লেক ট্রেকিং, হিক্কিম আর কিবের ভিলেজ, কি মনাস্ট্রি, তারও আগে পিন ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক, মাড ভিলেজ এইসব। হয়তো তোমার সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না। আরও খানিকটা সময় থাকতে পারলে ভালো হত। একই মানসিকতার লোক জীবনে ক’জন পাওয়া যায় ? আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চাই। কিভাবে সম্ভব, বল ?’
গেরহার্ট দাঁড়িয়ে কথাগুলি বলতে বলতে তার দিকে সাগ্রহে তাকাল। সে কী বলবে নিজেও জানে না, মুখে সে কথা না বলে মাথা নেড়ে জানাল সেটাই। এই নীরব প্রদেশ তাকে নির্বাক থেকে কথা বলতে শিখিয়েছে। প্রকৃতিও সবাক হয় অন্তরের ভাষায়, মৌখিক ভাষার কোন ভূমিকা নেই এখানে। দেবতারাও নিরুত্তর থাকে, সাড়া দেয় না ডাকাডাকিতে। উপলব্ধি করা যায় তাদের উপস্থিতি আর কার্যকলাপ এমনটাই বিশ্বাস করে সবাই। তাই তাদের অন্তর্যামী বলা হয়। প্রাচীন ভারতীয় মুনিঋষিরাও এভাবেই বাক্য বিনিময় করতে শিখেছিলেন, মুখে কথা বলতেন না তাঁরা কেউ, কথা বলতেন অন্তর দিয়ে। ধ্যানমগ্ন হয়ে জেনে যেতেন মানুষ, জীবজন্তু বা অন্যসব বস্তুসমূহের মনের কথা। প্রচলিত বিশ্বাস অন্তত এটাই জানায়।
সঙ্গীরা সবাই খুঁজতে খুঁজতে এসে গেল। তিন-চারজন মহিলা-পুরুষ। শৈবাঙ্কনকে দেখিয়ে গেরহার্ট অল্প কথায় জানাল তার বিবরণ। তারা সবাই কৌতূহলী হয়ে আরেকটু নিকটে এসে ঘিরে দাঁড়াল। একজন তার দামি ক্যামেরা হাতে নিয়ে অনুমতি চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
‘ছবি তুলতে পারি তোমার ?’
সে আপত্তি করল না। আবারও মৃদু মাথা নেড়ে উত্তর দিল সে, সম্মতিজ্ঞাপক। তবে উঠল না তার আসন থেকে। পাহাড়ি ঢালের প্রেক্ষাপটে কয়েকটি কোণ থেকে ছবি তোলা হল বেশ কয়েকটি। অন্য আর সবাইও এগিয়ে এল। প্রত্যেকেই নিজের নিজের মোবাইল ফোনে তাকে সঙ্গে নিয়ে ছবি তুলে গেল একের পর এক। এবং গেরহার্ট নিজেও। আবার সে তার সঙ্গীকে দিয়ে তার ক্যামেরাতে দ্বৈত ছবিও তোলাল বেশ কয়েকটি। সবাই মিলে যৌথ ছবিও তোলা হল।
‘কিন্তু তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব কিভাবে তার তো কোন নিস্পত্তি হল না ? তোমার মোবাইল নম্বর দাও।’
গেরহার্টের আকুল জিজ্ঞাসার উত্তরে সে মাথা নাড়ল খুবই মন্থর ভঙ্গিতে। নেতিবাচক সেই আন্দোলন দেখে বিস্মিত-হতাশ প্রশ্ন তুলল গেরহার্ট তার দিকে তাকিয়ে,
‘তোমার মোবাইল ফোন নেই ?’
সে নেতিবাচক মাথা নেড়ে উত্তর দিল। গেরহার্ট জিজ্ঞেস করল,
‘নেই ? কেন ? মোবাইল ফোন নেই তোমার ? যোগাযোগ রাখো তাহলে কিভাবে ?’
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল সে, অস্পষ্টভাবে। এবার তাকে কথা বলতেই হবে বলে সে বলল,
‘আমি বোধহয় আমার কথা তোমাকে বোঝাতে পারিনি। বললাম না তোমাকে, বাইরের পৃথিবীকে ভুলে গিয়ে একা থাকব বলেই আমি এখানে চলে এসেছি। তুমি কেন ভাবলে আমার কাছে মোবাইল ফোন থাকবে ?’
কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিতভাবে নিস্পলক দাঁড়িয়ে তাকে দেখল গেরহার্ট। তারপর দুঃখিত ভঙ্গিতে বলল,
‘ক্ষমা করবে। আসলে সভ্য মানুষের স্বভাবদোষ ভুলতে পারিনি।’
পকেট থেকে ছোট্ট নোটবই বার করে কলম দিয়ে লিখল তার পাতায় কিছু। সেই পাতাটা ছিঁড়ে তাকে দিয়ে বলল বিনীত মিনতির ভঙ্গিতে,
‘এখানে আমার ঠিকানা আর মোবাইল নম্বর রইল। প্লিজ রাখো, আর একবার অন্তত আমাকে ফোন করো কোনদিন।’
শৈবাঙ্কন আপত্তি করল না। হাত বাড়িয়ে কাগজের টুকরোটা নিল।
অন্তর্বর্তীয়: এক
অমরত্ব
( পৌরাণিক )
তখন আদিকাল। পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল অবশ্য তারও কয়েকশ’ কোটি বছর আগে। জন্মাবার পর সদ্যপ্রজাত পৃথিবী ছিল অকল্পনীয় উত্তপ্ত এবং তার সমস্ত দেহ ছিল গলন্ত ও ফুটন্ত লাভার সমুদ্র। প্রাণ কোথায় ? তারপর কয়েকশ’ কোটি বছরের অপেক্ষার পর পৃথিবীতে জীবসৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ তৈরি হল। পৃথিবীর বুকে এল জল ও বায়ুমণ্ডল। আবার অনন্তকাল অপেক্ষার পর তার বুকের জল মহাসমুদ্র হল এবং আবির্ভাব ঘটল স্থলভূমির। আরও লক্ষ-কোটি বছরের অপেক্ষার পর বনজঙ্গল, পাহাড়পর্বত, নদীনালা, মরুভুমি ইত্যাদি তৈরি হতে লাগল। আবার পৃথিবী ভাবল, আমার বুক এখন জীবসৃষ্টির অনুকূল। প্রথম জৈব কোষের আগমন ঘটল সমুদ্রে। আদিকাল বলতে বুঝি বা সেইসময়। তখন তিনজন দেবপুরুষ প্রথম নিজেদের আগমন ঘটালেন। তাঁদের দায়িত্বে থাকল সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়। ব্রহ্মা তাঁর ব্রহ্মলোকে, আদিদেবতা শিব শিবলোকে বা কৈলাশ পর্বতমালার কোথাও নিজের বাসস্থান বানালেন আর নারায়ণ উপস্থিত হলেন ক্ষীরোদসমুদ্রে বা গোলোকধামে। আরও দুটি প্রাণ সৃষ্ট হয়েছিল। সহস্র ফণাযুক্ত অনন্তনাগ ও মহাদেবী লক্ষ্মী। এই দেবী ক্ষীরোদসমুদ্রে গিয়ে নারায়ণের সঙ্গিনী হলেন এবং অনন্তনাগও চলে গেল সেখানে। তার সুবিশাল দেহ ভাসন্ত রইল ক্ষীরোদসমুদ্রে, নারায়ণ গিয়ে তার ভাসন্ত দেহে অনন্তশয্যা বানালেনএবং শায়িত অবস্থায় থাকার উপক্রম করলে লক্ষ্মী তাঁর পদতলে বসে পদসেবা করতে লাগলেন এবং তাই দেখে অনন্তনাগ তার হাজার মাথাওয়ালা ফণা শায়িত বিষ্ণুর মাথার ওপর ছাতার মত মেলে ধরল। তিনি স্থিতিশীলতা বজায় রাখার দেবতা। অন্যদিকে শিব বরফমুকুট পরা পর্বতচূড়ার মাথায় তাঁর শিবলোকে বসে গেলেন তপস্যায়। তিনি হলেন ত্রিনয়নযুক্ত ধ্বংস বা প্রলয়ের আদিদেব। আর ব্রহ্মা আশ্রয় নিলেন ব্রহ্মলোকে চতুর্মুখ নিয়ে। তাঁর দায়িত্ব হল সৃষ্টিকর্ম। ততদিনে দেবতারা দলে দলে এসে গেলেন দেবলোক বা স্বর্গে এবং পাতালে থাকলেন মৃত্যুর দেবতা যম। চতুর্মুখের আটটি চোখ দিয়ে ব্রহ্মা মর্তলোকের দৃশ্য বা অবস্থা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন, পৃথিবীতে জলে ও স্থলে এবার জীবসৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে যেহেতু সমুদ্রজলে ইতিমধ্যেই প্রাণের অস্তিত্ব এসে গেছে। জীবকুল সৃষ্টি হল স্থলভূমির পাহাড়ে-প্রান্তরে, সমতলে ও উপত্যকায়, বনেজঙ্গলে এবং অবশ্যই সমুদ্রে। কেটে গেল আরও কোটি কোটি বছর। আরও উন্নত হল পৃথিবীর বুক এবং মাত্র কয়েক হাজার বছর আগে সৃষ্টিদেব দেখলেন, এবার পৃথিবীর স্থলে অত্যাধুনিক জীবসৃষ্টি করা যায়। দেবতা, যক্ষ, রাক্ষস, দৈত্যদানবরা তো ইতিমধ্যেই স্থলভূমিতে এবং মহাসমুদ্রে এসে গেছে। ব্রহ্মা সযত্নে আটটি চোখ বুজে ধ্যানস্থ হয়ে চারটি মাথা দিয়ে ভেবে ভেবে আধুনিক জীবের কেমন দেখতে হবে তার চূড়ান্ত পরিকল্পনা পাকা করে দশজন মানুষকে মানসপুত্র হিসেবে রচনা করলেন। তাঁদের একজন ছিলেন পুলস্ত এবং অন্যজন নারদ। ব্রহ্মা কি ভুল করেছিলেন খানিকটা ? তাঁর তো চোখের সামনেই ছিলেন বিষ্ণু ও তাঁর সঙ্গিনী কমলা, তাহলে তিনি কেন দশজন পুত্রের কোথায় ভাবলেন ? কেন একটিও কন্যাসৃষ্টি করলেন না ? তার জন্য মহাদুর্দশা ঘটল তাঁর একপুত্র নারদের। মেয়ে না পেয়ে তিনি ঋষি হয়ে গেলেন এবং আজীবন চিরকুমার হয়ে রইলেন। স্বর্গে তো নানা দেবীও ছিলেন ! ব্রহ্মা তাঁদের দেখলেন না, একবারও কন্যাসৃষ্টির কথা ভাবলেন না ? মেয়ে না পেয়ে অন্য পুত্র পুলস্ত মর্তে এসে কিভাবে কিজানি তাঁর এক পুত্র ঋষি বিশ্বশ্রবার জন্ম দিলেন। বিশ্বশ্রবা তাঁর সমগোত্রীয় কোন মানবীকে না পেয়ে মর্তে এক রাক্ষসী নিকষাকে বিয়ে করে বসলেন। ব্যস, লঙ্কাকাণ্ডের সূচনা ঘটে গেল কারণ, নিকসার গর্ভে জন্ম নিল ঋষি বিশ্বশ্রবার তিন পুত্র রাবণ, কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণ এবং এক কন্যা শূর্পণখার। রাবণ গিয়ে রাজা হয়ে বসল এক দ্বীপরাজ্য লঙ্কার। রাবণ লঙ্কার রাজা হওয়ার আগে যৌবনকাল থেকেই বুঝতে শিখেছিল যে কেবলমাত্র দৈহিক ক্ষমতা যথেষ্ট নয়। নিকষানন্দন রাবণকে বলা হত নৈকষেয়। সে মহাঋষি বিশ্বশ্রবার পুত্র হলেও তাঁর মত মানসিক ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেনি। সেসব গুণ ছিল তার সর্বকনিষ্ঠ ভাই বিভীষণের। দুর্ভাগ্যক্রমে রাবণ ও তার মধ্যম ভাই কুম্ভকর্ণ মাতৃকুলের ধারা পেয়েছিল। যদি না পেত তাহলে আর রামায়ণ তৈরি হত না। দস্যু রত্নাকর ঋষি বাল্মীকি হওয়ার পর এতবড় মহাকাব্য রচনা করার প্লট পেতেন না। জন্মসূত্রে রাবণ একাধারে রাক্ষস, দানব, দৈত্য, যক্ষ এবং মহা শক্তিধর। নানারকম ছলনা ও মায়াবিদ্যা তার করায়ত্ত। তার দশটি মাথা এই অর্থে যে কেউ একটি মাথা কেটে ফেললেও আবার অন্য একটি মাথা গজিয়ে যাবে এবং এমনহবে অন্তত ন’বার। তার ভাই কুম্ভকর্ণ আরও ভয়ানক। আসুরিক ক্ষমতা ছাড়াও তার দেহ আকারে পর্বতের মত। কিন্তু রাবণের মত তার অত বুদ্ধি ছিল না। তার মাথাটাও ছিল রাক্ষসদের মত ভোঁতা। রাবণ বোধহয় পিতৃসূত্রে বুদ্ধির অধিকারী হয়েছিল। তাতে তো সোনায় সোহাগা। চেহারা ও মানসিকতায় দৈত্যদানব, তাদের মতই লোভ আর মাথায় পৈতৃক সূত্রে যতটা যতটা বুদ্ধি পেল তার পুরোটাই কুবুদ্ধি। ওই কূটবুদ্ধি দিয়ে রাবণ বুঝতে পারল, আমি জন্মসূত্রে যতই শারীরিক শক্তি পাই না কেন বার্ধক্য অনিবার্য এবং মৃত্যুও হবে একদিন। দৈত্যদানব, রাক্ষস, অসুররা হয় লোভি ও দুশ্চরিত্র এবং সেজন্যই চায় যেন সে যৌবনকালে থাকতে পারে সবসময় যাতে বিলাসব্যসন ও ভোগে কোনও অতৃপ্তি হবে না। কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মে সেটা তো সম্ভব নয়। দেহ চিরকাল থাকে না ভোগ করার মত অবস্থায়। তাই কিছু একটা উপায় তো চাই যাতে আমি চিরদিন একই থেকে যাব, অনন্তকাল ধরে কেবলই ভোগে সক্ষম থাকব। তা সম্ভব হবে যদি আমি অমৃতের অধিকার পাই। তারা ভাবে স্বর্গের দেবতারা অমর কারণ, তাদের কাছে আছে অমৃতভাণ্ডার। তারা দেখে মুনিঋষিরাও দীর্ঘজীবন পায়, তপস্যায় নিমগ্ন থাকে বলে এবং তাদের কাছেও নিশ্চয় অমৃত আছে। তাহলে তপস্যা করলে অমৃত পাওয়া যায় আর অমৃত পেলে অমর হওয়া যায় ? তারা বুঝল, পার্থিব ও শারীরিক অনন্ত লোভ মেটাতে চাই অনন্ত যৌবন এবং কালের চাকা রুদ্ধ করে তা হাতে আসবে যদি অমরত্ব পাওয়া যায়। আর এই অসাধ্য ইচ্ছে পূরণ করা সম্ভব যদি মুনিঋষিদের মত কঠিন তপস্যা করা সম্ভব হয়। তিন আদি দেবতার কাউকে যদি স্তবে তুষ্ট করা যায় তো তাঁদের বরে অমর হওয়া আশ্চর্য কিছু নয়, কারণ তাঁরা কালের চাকা রুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখেন।
অসুর, দৈত্যদানব, রাক্ষসরা তখন মুনিঋষিদের দেখাদেখি তপস্যা শুরু করে দিল। তাদের ধারণা, ওই মুনিঋষিরাও নিশ্চয় দেবতাদের স্তবে তুষ্ট করে অমরত্ব পাওয়ার বর চায়। নাহলে কিভাবে তারা এত দীর্ঘজীবন ও ক্ষমতা লাভ করে ? কিন্তু অসুর-দানবরা দেখল, যতই তপস্যা করুক না কেন ওই তিন দেবতার কেউই অমরত্বের বর দেন না কাউকে। তারা তখন চালাকি করে এমনসব বর চাইতে লাগল যা প্রকারান্তরে অমরত্বের সমান। যেমন ভস্মাসুর নামে এক দানব শিবকে তপস্যায় পেয়ে বলল, ‘আমাকে এমন বর দাও প্রভু যাতে আমি যার মাথায় হাত দেব সে ভস্ম হয়ে যায়।’ শিব ভোলানাথ, সবসময় ঘোরে থাকেন, অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই বললেন, ‘তথাস্তু’। বর পেয়ে ভস্মাসুরের দুর্মতি হল, সে শিবকে বলল, ‘দেখি প্রভু, তোমার বর সত্যি কিনা। এসো, পরীক্ষা করি তোমার মাথায় হাত দিয়ে।’ বলে সে শিবের মাথাতেই হাত রাখতে গেল। শিব এবার টের পেলেন, মহাবিপদ। তিনি পালাতে লাগলেন আর ভস্মাসুর ছুটল তাঁর পিছনে। স্বর্গ-মর্ত -পাতাল দৌড়ে বেড়ালেন শিব, পিছনে নাছোড় ভস্মাসুর, কেউ শিবকে বাঁচাতে এগিয়ে এল না। নিজে বর দিয়ে নিজেই বিপদে পড়ে গেছেন শিব দুষ্টবুদ্ধি অসুরের কাছে। শেষে এগিয়ে এলেন নারায়ণ, তিনি স্থিতিশীলতা বজায় রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত, কূটবুদ্ধিসম্পন্ন। তিনি মোহিনী মূর্তি ধরে হাজির হয়ে সেই অসুরের মাথা ঘুরিয়ে দিলেন। ভস্মাসুরকে মৃদু হেসে বললেন, ‘তা তুমি নিজের মাথায় হাত দিয়েই তো দেখতে পার বরটা সত্যি কিনা।’ অসুর তো, অন্তর্যামী নারায়ণের বুদ্ধির পার পাবে কোথায় ? বিষ্ণুর কথা শুনে আর মোহিনী মূর্তি দেখে সে এতটাই মোহিত হয়ে পড়ল যে কিছু না ভেবেই নিজের মাথায় হাত দিয়ে বসল আর সঙ্গে সঙ্গেই ভস্ম হয়ে গেল।
রাবণ এসমস্ত কিছুই নিশ্চয় জানত। পৈতৃক সূত্রে তার বুদ্ধি আরও প্রখর ছিল। সে জানত, নারায়ণের তপস্যা করে তার কাছে বর আদায় করা কঠিন ব্যাপার। ওই দেবতাকে ভোলানো সহজ নয়। এমনিতে সে শিবের ভক্ত, শিব তাকে অনেকবার নানা বরও দিয়েছেন। কিন্তু অমরত্বের বর কার কাছে চাওয়া বিধেয় ? রাবণ চিন্তাভাবনা করে বুঝল, ব্ৰহ্মাই হবেন উপযুক্ত দেবতা। দেবতারা কেউ চাইলেই আমার বর দেন না সত্যি, সেক্ষেত্রে এমন বর চাওয়া হবে যা অমরত্বেরই সামিল, তবে তার আশা ছিল ব্রহ্মা হয়তো তাকে অমরত্ব বর দিয়েও ফেলতে পারেন। তিনি সৃষ্টির দেবতা, জীবকুলের আয়ুষ্কাল তিনিই নির্ধারণ করেন। তাঁর ব্রহ্মলোকে সময় প্রায় স্থির হয়ে আছে, যেহেতু ওখানে তাঁর এক মিনিট মানে মর্তে হাজার হাজার কোটি বছর। তো ব্রহ্মা যদি তাকে তাঁর ব্রহ্মলোকের সময় অনুযায়ী দশটি বছরও বেঁচে থাকার বর দেন তাহলে কত বছর বেঁচে থাকা হবে ? হিসেবে করতে গিয়ে রাবণের বুঝি বা মাথা বিগড়ে যাচ্ছিল, অঙ্কটঙ্ক জানত কিনা কেজানে ! যাই হোক, তাও এক ধরণের অমরত্ব। সবচেয়ে বড়কথা, ব্রহ্মা হল সম্পর্কে তার প্রপিতামহ, তার পিতামহ পুলস্তের সৃষ্টিকর্তা। তার জন্য ব্রহ্মার দুর্বলতা থাকতেও পারে, আর সেই কারণে তাকে অমর করে দিতেও পারেন।
রাবণ ছিল অসুর বা দানব বা রাক্ষস এবং ষড়রিপুর ভয়ঙ্কর বশীভূত একজন। সে ভোগ ও দৈহিক পরিতৃপ্তি বা দুর্ভেদ্য দেহ পাওয়াটাকেই ভাবতে পারত। সে বুঝতে কেবল শারীরিক বিষয়সমূহ, ঋষিপুত্র হওয়া সত্বেও উচ্চমনা ছিল না সে। দর্শনীয় দৈহিক কাঠামোর বাইরে কিছু সত্যি আছে বলে ধারণা করতে পারত না। তার মত অবস্থা অন্য সব দৈত্য-দানব-অসুর-রাক্ষসদের। তারা সবাই দেহসর্বস্ব জীব, ভোগসর্বস্ব প্রাণি। তারা দেহটাকেই জগৎ বলে ভাবত। আর মনে করত, মুনিঋষি ও দেবতারাও তাদের মতই ধারণায় বিশ্বাসী। রাবণও দুর্জন, হিংস্র, অত্যাচারী, অমানবিক দানব জাতীয় জীব এবং গোঁয়ারগোবিন্দ বা একগুঁয়ে। এই একরোখা মনোভাব অন্যদিকে তার একটা গুণও বটে। এই স্বভাবের জন্যই সে যা পেতে চাইত তার শেষ দেখে তবে ছাড়ত, তাকে পেতে যা করা উচিত তা করতে পিছপা হত না, কেউ তাকে থামাতে পারত না।
সে যেমন ভাবল, বহ্মার তপস্যা শুরু করে দিল। সে যে কী তপস্যা তা বুঝি কেউ ধারণাও করতে পারবে না। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, বহ্মা আসেন না। রাবণ টলে না, তপস্যা করতেই থাকে। তখন একদিন রাবণ করল কী, তার মাথাটা কেটে ব্রহ্মাকে উৎসর্গ করল। তবু ব্রহ্মা এলেন না। অবশ্য রাবণের নতুন মাথা আবার গজিয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। এভাবে ন’বার মাথাটা কেটে ব্রহ্মাকে নিবেদন করল, ব্রহ্মা এলেন না তবুও। রাবণ জানত, নিজের মাথা এভাবে দশমবার কেটে ফেললে তার আর নতুন মাথা গজাবে না এবং সে তখন সত্যি মরে যাবে। তবু রাবণ ভাবল, অমর না হতে পারলে বেঁচে থেকে কী লাভ। এই ভেবে সে দশমবার বিনা দ্বিধায় তার মাথা কেটে ফেলল। ব্রহ্মার আসন এবার টলে গেল। তিনি বুঝলেন, তাঁর নিয়ম অন্যথা করে দিচ্ছে রাবণের কঠিন তপস্যা ও ত্যাগ, কারণ তিনি রাবণের জন্য যে আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন তা যে মিথ্যে হয়ে যাবে রাবণ এখন মরে গেলে। ব্রহ্মা বাধ্য হয়ে রাবণের কাছে উপস্থিত হলেন এবং তাঁর কমণ্ডলু থেকে অমৃতবারি সিঞ্চন করলেন মৃত রাবণের দেহে। রাবণের মাথা আবার স্বস্থানে ফিরে এল এবং রাবণ বেঁচে উঠে চোখ খুলে তাকাল। যেন গভীর ঘুম আর স্বপ্নদেখা থেকে সে জেগে উঠল। সে ঘোরলাগা চোখ খুলে তাকিয়ে দেখল, চতুর্মুখ ব্রহ্মা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ইটা কোন স্বপ্ন নয়, সত্যি। সে ওই আদিপিতাকে সাষ্টাঙ্গে সশ্রদ্ধ প্রণাম করল এবং বলল,
‘হে প্রভু, আপনি তাহলে এলেন শেষপর্যন্ত।’
ব্রহ্মা আপাত উৎফুল্ল মুখে মনের উদ্বেগ ও আশংকা চেপে রাখলেন। এসব দৈত্য-দানব-রাক্ষসদের তিনি সৃষ্টি করেছেন মনের আনন্দ, এখন তার বিপদ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। এরা প্রবল শক্তিধর, ষড়রিপুতে আক্রান্ত এবং সদাসর্বদা তাঁর অন্যান্য সৃষ্টির জন্য বিপজ্জনক। তো ছিল এরা ভোঁতা বুদ্ধি নিয়ে, ভালোই ছিল, তেমন হাঙ্গামা করত না। ইদানীং তারা তপস্যা-টপস্যা শুরু করে গোলযোগ বাঁধাচ্ছে। কঠোর তপস্যা করতে শিখেছে এবং তাঁকে বাধ্য হয়ে এদের ডাকে উপস্থিত হতে হয়। এরা সব দেহসর্বস্ব জীব, সবাই অমর হতে চায়। ব্রহ্মা জানেন এদের কুমতলব। এদের অমর হওয়ার বর দিলে আর রক্ষে থাকবে না। এরা তাঁর সাধের সৃষ্টি ধ্বংস করে দেবে। আবার অমর বর না দিলেও বিপদ। এরা এমনই একগুঁয়ে যে এদের ঠেকানো মুশকিল। তপস্যার তাপে তাঁকে জ্যান্ত পুড়িয়ে দেবে, আর বর দিলেও ঝঞ্ঝাট। এরা লোভ আর অহংকারের বশে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে বসবে। তখন তাদের এমন বর দিতে হয় যা অমরত্বের কাছাকাছি। তাতেও লণ্ডভণ্ড ঘটে যায়। তাঁর কিছু করার থাকে না। তিনি তাই পারতে এখন দৈত্য-দানব-রাক্ষসদের সামনে আসা যেভাবেই হোক এড়িয়ে থাকেন যতটা সম্ভব। আর আসতে বাধ্য হলে বর দিয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে বাঁচেন।
এখন রাবণের সামনে আসতেও তাঁর ঘোরতর আপত্তি ছিল। পারলেন না কারণ, রাবণের তপস্যার প্রবল টান তাঁকে একরকম জোর করে মর্তে টেনে নামিয়ে তার কাছে তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হাজির করিয়ে দিল। তিনি ঠেকাতে পারলেন না সেই টান, আদিপিতা হওয়ার সূত্রে প্রবল ক্ষমতা থাকা সত্বেও। এলেন বুকের আশংকা ও ভয় চেপে। তিনি জানতেন এও চাইবে অমর হওয়ার বর, কারণ রাবণও দেহসর্বস্ব জীব, দেহকে অবিনশ্বর করাই তার মূল উদ্দেশ্য। সে বর না দিলে রাবণ কী করে বসবে আর তাঁর প্রতিষ্ঠিত নিয়ম ভেঙে গিয়ে কী বিশৃঙ্খলার দৃষ্টান্ত তৈরি হবে এই নিয়ে বেশ আতঙ্কে ছিলেন। কী বলে রাবণকে খুশি করবেন আর সে তার লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে সেসব কথা ভাবছিলেন ভিতরে ভিতরে। তপস্যা স্থানের প্রজ্জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের দিকে খানিক তাকিয়ে ব্রহ্মা দৃষ্টি ফেরালেন রাবণের দিকে এবং সংযত কণ্ঠে বললেন, ‘যে কঠিন তপস্যা তুমি করলে তা সত্যি অতুলনীয়। আমি আজ পর্যন্ত এমনটি আর কবে দেখেছি সন্দেহ।’ রাবণের মুখ গর্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং সে ভাবল নিশ্চয় প্রপিতামহ সে যা চায় তা মঞ্জুর করবেন নির্দ্বিধায়। ব্রহ্মা বলতে লাগলেন, ‘বল বৎস, কী বর চাও। তুমি যা চাও আমি তাই দেব তোমাকে।’ বললেন তিনি আন্তরিক গলায়।
রাবণ কোন ভণিতা না করে আর্জি জানাল, ‘প্রভু, আমাকে অমর করে দিন।’ রাবণ দৈহিক অমরত্বের অভিলাসী দীর্ঘদিন, জাগতিক সুখ ও গৌরব সে অনন্তকাল ধরে অনন্ত জীবন ও যৌবনের অধিকারী হয়ে উপভোগ করে যাবে, এটাই তার একমাত্র বাসনা। একবার যদি সে অমর হতে পারে তাকে আর পায় কে ! কিন্তু এখানেই সে আদিপিতা ব্রহ্মার মুখচোখ দেখে আশংকায় পড়ে গেল। তার প্রার্থনা শুনে তাঁর উজ্জ্বল মুখে বিষণ্নতা। তিনি মাথা নাড়লেন বলতে গিয়ে, ‘না বৎস, ওই বর আমি তোমাকে দিতে পারি না। দৈহিক অমরত্ব অসম্ভব, প্রাকৃতিক নিয়মবিরুদ্ধ। জীব জন্ম নেবে এবং তাকে মরতে হবেই। কোন জীবের জন্যই আমি প্রকৃতির এই নিয়ম পাল্টাতে পারি না।’ রাবণের তখন চিৎকার করে বলার ইচ্ছে ছিল, ‘কিন্তু দেবতারা ? তারা তাহলে অমর হল কী করে ?’ কিন্তু সে তাকে সংযত করল এবং আদিপিতার উদ্দেশ্যে বিনীতকণ্ঠে নিবেদন জানাল,
‘প্রভু, যদি না আমাকে অমর করতে পারেন তো অমরত্ব লাভের অমৃতের অধিকার দিন যা দেবতাদের আছে। তাহলেই আমি তাদের সমকক্ষ হতে পারব।’
ব্রহ্মা পূর্ণচোখ মেলে রাবণকে দেখে ও তার বায়না শুনে বুঝতে পেরেছিলেন তার কী চরিত্র ও উদ্দেশ্য। এর হাতে অমৃত গেলে পরিস্থিতি কতটা বিপজ্জনক হতে পারে ? কিন্তু তিনি উপায়ান্তর। রাবণের প্রখর তপস্যার টান তিনি উপেক্ষা করতে পারেন নি। এখানে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তার অমর হওয়ার আর্জি নাকচ করে দিলেও বারবার তাকে ফেরাতে পারবেন না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। তিনি বিষণ্ণ মুখে অন্তরের দীর্ঘশ্বাস অন্তরেই গোপন করে বললেন,
‘ঠিক আছে, তোমার এই দাবি মঞ্জুর করলাম। তুমি অমৃত পাবে।’
শুনে রাবণের মুখে হাসি ফুটল। অমৃত হাতে পাওয়া মানেই অমর হওয়া। তার চোখ লোভে চকচক করে উঠল। সে আরও বলল,
‘আমি অমৃত আমার নাভিমূলে রাখতে চাই। যদি আমি অমৃত নিজের অধিকারে পাই তো আমি দুর্ভেদ্য হব।’
ব্রহ্মা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। সেকেন্ডের মধ্যে রাবণ অনুভব করল, এক অদ্ভুত শক্তির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে তার শরীরে। রাবণ উদরে হাত রেখে বুঝল যে অমৃত তার নাভিমূলে রক্ষিত হল এবং তারই ক্ষমতার বন্যায় ভেসে যাচ্ছে তার সমগ্র দেহ যা তাকে দিচ্ছে অপরিমেয় শক্তি।
রাবণের আরও কিছু চাহিদা ছিল যা সে পাওয়ার যোগ্য তার ওই কঠোর তপস্যার কারণে। আদিপিতার দিকে চোখ ফিরিয়ে সে আর্জি জানাল,
‘প্রভু, আমার আরও একটি বর চাওয়ার আছে।’
শুনে ব্রহ্মা মনে মনে প্রমাদ গুণলেও সম্মতিসূচক মাথা নাড়তে বাধ্য হলেন, তাঁর মুখে কিছু বলার উৎসাহ থাকল না। রাবণ বলতে লাগল,
‘আমি চাই আমি স্বর্গের দেবতা, যক্ষ, রক্ষ, গণ এবং নাগেদের তুলনায় বেশি শক্তিশালী হব। এরা ছাড়াও সমস্ত বন্য জন্তুরাও যেন আমার শক্তির কাছে বশ্যতা স্বীকার করে। আমি হতে চাই অপরাজেয়। আর আমি তাদের শাসন করতে চাই। কেউ যেন আমার সমকক্ষ হতে না পারে।’
একমাত্র মানুষ ও বানরদের কথা বলল না রাবণ কারণ, সে জানত যে ওই জীবরা তার খাদ্য। তাদের থেকে তার বিপদের কোন আশংকা নেই। রাবণের আর্জি শুনে ব্রহ্মা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেও মেনে নিতে বাধ্য হলেন। রাবণ বুঝতে পারল না প্রপিতামহের বিরক্তি, তাঁর প্রকাশ্য সম্মতিদানকে সে ভেবে নিল সন্তুষ্টি আর সে আবার অনুভব করল তার দেহে বইছে শক্তির জোয়ার। পাশাপাশি রাবণ আদিপিতার কাছে চেয়ে আদায় করে নিল দিব্য অস্ত্র ও জাদুবিদ্যা। রাবণের চাহিদা বাড়তেই লাগল। বিপদ বুঝে ব্রহ্মা আর অপেক্ষা না করে তার সামনে থেকে অন্তর্ধান করে একরকম পালিয়ে বাঁচলেন। তবে রাবণ ততক্ষণে পরিতৃপ্ত। আর কিছু না হলেও চলবে তার। অমৃত তার অঙ্গে অধিষ্ঠিত বলে কেউ তা কেড়ে নিতে পারবে না অমৃত দেহে থাকা মানেই সে অমর। সে এখন থেকে পার্থিব-অপার্থিব সমস্ত শক্তির কাছে অপরাজেয়। এখন আর জগতে কোন শক্তি তাকে দমাতে পারবে না। সমস্ত অর্থেই সে হবে দুর্ভেদ্য। অনন্ত জীবন আর অফুরন্ত ভোগ থাকবে তার দখলে। সে বলতে গেলে, অজর-অমরই হয়ে গেল। কে আর তাকে থামাবে ? তার মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত।
রাবণ তার দ্বীপরাজ্য লঙ্কায় ফিরে এল। এই ক্ষুদ্র দ্বীপের অধীশ্বর থাকা কি তাকে মানায় ? ব্রহ্মার বরে সে বলীয়ান। সে দুর্ভেদ্য। রাবণ ক্ষমতার দম্ভে প্রায় উন্মত্ত হতে লাগল। আমি সসাগরা পৃথিবী দখলে চাই, সে ভাবল। তাই বা কেন ? স্বর্গ-মর্ত-পাতাল এই তিন জগতের অধীশ্বর হওয়াই আমার উদ্দেশ্য।
তারপর শুরু হল রাবণের অত্যাচার ও সন্ত্রাসের রাজত্ব। কারণে-অকারণে সে সে পৃথিবীর সমস্ত রাজ্য আক্রমণ করতে লাগল। কোন রাজ্যের রাজাই তার সামনে দাঁড়াতে পারল না, ব্রহ্মার বরে এতটাই সে ক্ষমতাবান। তার হিংস্রতা ও বর্বরতার কোন তুলনা পাওয়া গেল না। সমস্ত রাজ্য আক্রমণ করে সে সব ধ্বংস করত,রাজ্যের সম্পদ লুঠ করে নিয়ে যেত লঙ্কায়, রানি বা রাজকন্যা ও অন্যান্য নারীদের সে ইচ্ছেমত তুলে নিয়ে যেতে লাগল দানবিক উল্লাসে। রাবণের সন্ত্রাসে ত্রাহি-ত্রাহি রব উঠল জগৎ জুড়ে।
রাবণ শেষপর্যন্ত একদিন অযোধ্যা রাজ্য আক্রমণ করল। সেখানে ছিলেন মহান রাজা অনারণ্য। রাবণ ও অনারণ্যের মধ্যে তুমুল লড়াই শুরু হল এবং তা চলল দীর্ঘদিন। কিন্তু রাবণ বরপ্রাপ্ত, তার হাতে আছে চিরযুবা থাকার মন্ত্র এবং সে তাই অনেক বেশি শক্তিশালী। একসময় অনারণ্য যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন এবং রাবন তাঁর মাথায় শেষ আঘাত হানল। নিশ্চিত মৃত্যু শিয়রে জেনেও মাটিতে পরে যেতে যেতে রাজা অনারণ্য ছিলেন ভয়লেশহীন। তিনি রাবণের চোখে চোখ রেখে মৃত্যুর আগে নির্ভিক কণ্ঠে তাঁর শেষ কথা বলে গেলেন, ‘তুমি অত্যাচারী ও দুর্বিনীত। তোমার সঙ্গে আমার কোন শত্রুতা ছিল না। অকারণে শক্তির অহঙ্কারে মদমত্ত হয়ে আমার রাজ্য ধ্বংস করতে এসেছ।’ বলতে বলতে তিনি বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর প্রাণবায়ু এখনই বেরিয়ে যাবে। তবুও সেই নির্ভীক মহান রাজা অতিকষ্টে শেষ কথাগুলি উচ্চারণ করে গেলেন, ‘তোমার এই অত্যাচার একদিন থামতে বাধ্য। এবং তোমার নিধন ঘটবে আমারই বংশের কোন উত্তরপুরুষের হাতে, যেভাবে আমাকে মারলে অকারণে সেভাবেই। সেদিন সারা পৃথিবী দেখবে তুমি আর তোমার বংশ নির্বংশ হবে কোন ন্যায় বা অন্যায়ের পরোয়া না করেই। তুমি যত অন্যায় করে চলেছ তার বিচার হবে সেইদিন। এ মিথ্যে হবে না। এ এক প্রজাবৎসল নির্দোষ রাজার অভিসম্পাত।’ রাজার মৃত্যু হল তৎক্ষণাৎ। তিনি কী বলে গেলেন রাবণ তা শুনলেই না। রাজাকে কষ্ট পেয়ে মরতে দেখে সে তো উল্লাসে অস্থির। সে ভুলে গেল, কোনদিন তারও এমন অসহায় অবস্থা এমন দুর্দশা ঘটা কিছুই বিচিত্র নয়। মহাকাল কারও অত্যাচার কারও অনাচার দীর্ঘকাল প্রশ্রয় দিতে জানে না। দুরাচারী, অত্যাচারী, সাম্রাজ্যলিপ্সু, নারীলোলুপ, চরিত্রহীন রাবণ এইভাবে একের পর এক রাজ্য ধ্বংস করতে লাগল। তাকে থামাবে কে ? দেবঋষি নারদ শেষপর্যন্ত এগিয়ে এলেন। তিনি দেখলেন, তাঁর পিত ব্রহ্মার সৃষ্টি সাধের মানুষ প্রজাতি রাবণের অত্যাচারে বুঝিবা বিনষ্ট হয়। তিনি তাই একদিন মদমত্ত রাবণ অন্য এক রাজ্য ধ্বংসে উদ্যত হওয়ার সময় তার সামনে উপস্থিত হলেন ‘নারায়ণ নারায়ণ’ বলে। রাবণ বিষ্ণুনাম একেবারেই সহ্য করতে পারত না। নারদকে দেখে সে সক্রোষে বলল, ‘কী চাই তোমার ? আমার কাছে মরতে কেন এসেছ ?’
নারদ মধুর হেসে বললেন, ‘বন্ধু, নগণ্য মানুষের সাম্রাজ্য ধ্বংস করে তোমার কী গৌরব বৃদ্ধি পাচ্ছে ? তোমার মত শক্তিমা নারদ বীণা থামিয়ে চোখ পিটপিট করে বললেন, ‘বন্ধু, তুমি কেন মিথ্যে এইসব ছোট ছোট রাজ্য ধ্বংস করে মরছ ? এ তোমার শক্তির অপপ্রয়োগ মাত্র। তুমি বড় কিছু করে দেখাও জগৎকে।’ রাবণ তাঁকে থামিয়ে দিতে যাচ্ছিল এই বলে যে সে তার বন্ধু নয় কোনমতেই। কিন্তু সে বলল না, কারণ ঋষির শেষ কথাগুলি তার মধ্যে আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছিল। সে জিজ্ঞেস করল, ‘কী বলতে চাও ?’ নারদ অমায়িক হেসে বললেন, ‘এই যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য তুমি ধ্বংস করে চলেছ তোমার মত ক্ষমতাবানের জন্য এ বড়োই অপকীর্তি। তুমি বড় কিছু ভাব। কেউ তোমাকে বলছে না দেখে আমি এলাম। তুমি কেন দেবতাদের জয় করার কথা ভাবছ না ? বিশেষ করে, মৃত্যুর দেবতা যমের কথা ? তুমি যদি যমকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে পার তাহলে কী অক্ষয় কীর্তি হবে ভাব। তুমি মৃত্যুকে জয় করতে পারবে। জগৎবাসী এমনিই তোমার পায়ে এসে লুটিয়ে পড়বে যদি একথা রাষ্ট্র হয় যে শমন দমন রাবণরাজা।’ নারদের চোখ থেকে ঠিকরে বার হচ্ছিল দুষ্টবুদ্ধির আভাষ। কিন্তু রাবণ তা দেখতে পেল না, কারণ এই অভিনব চিন্তা তখন তাকে আপ্লুত করে দিয়েছে। সে ভাবল, ‘সত্যিই তো, এই সাংঘাতিক বিষয়টা এতদিন কেন আমার মাথায় আসে নি !’ রাবণ ঠিক করল, নারদের পরামর্শ মেনে সে এবার মৃত্যুর দেবতা যমকে পরাজিত করতে যাবে।
এদিকে নারদ বুঝলেন, কার্যসিদ্ধি ঘটেছে। রাবণকে তিনি উপযুক্তভাবে প্ররোচিত করতে পেরেছেন। এবার জগৎবাসী রক্ষা পাবে রাবণের অত্যাচার থেকে। যম হচ্ছেন মৃত্যুর দেবতা, ব্রহ্মা তাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন এক বিশেষ অস্ত্র যার নাম কালদন্ড। ওই অস্ত্র দিয়ে যম পারেন সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে। ওই অস্ত্র যম যাকে উদ্দেশ্য করে নিক্ষেপ করবে তাকে কোন বরই রক্ষা করতে পারবে না, সে যত বড় ব্যক্তি হোক না কেন। রাবণ তো কোন ছার।
নারদ এবার তাঁর পরবর্তী কাজের জন্য যমপুরীতে গিয়ে যমদেবের মুখোমুখি হলেন। জানালেন যে তিনি রাবণকে বলেছেন যমকে আক্রমণ করতে এবং রাবণ আসছে। যম শুনে যথেষ্ট অবাক হলেন। কোন মর্তবাসী, সে মানুষ হোক বা দানব, তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে সাহসী হবে না, কারণ তিনি মৃত্যুর দেবতা এবং সময়ের নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে। তখনই শোনা গেল অদূরে কোলাহল। হতভম্ব যম দেখতে পেলেন রাবণ তার অপরাজেয় বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাঁর প্রাসাদ আক্রমণ করতে ধেয়ে আসছে। যম তাঁর রক্ষি ও যমদূতদের সতর্ক করে দিলেন। যমদূত ও রক্ষিরা জীবনে এমন কাণ্ড দেখেনি, এক মর্তবাসী সাহস পাবে যমের সঙ্গে যুদ্ধে যেতে। তবুও তারা বিস্মিত ভাব কাটিয়ে যুদ্ধের জন্য তৈরি হল। অচিরেই শুরু হল ধুন্ধুমার মহাযুদ্ধ এবং যমের সৈন্যরা দেখল রাবণ কতটা নিপুণ যোদ্ধা, তারা রাবণের শক্তি আর কৌশল দেখে অবাক হয়ে গেল, হেরে যেতে লাগল সবাই।
যম আর সহ্য করতে পারলেন না রাবণের দুঃসাহস। তিনি এবার স্বয়ং যুদ্ধে এলেন তাঁর অব্যর্থ অস্ত্র কালদন্ড হাতে নিয়ে। তিনি তা তাক করলেন রাবণের দিকে। নারদ ভাবলেন, এবার রাবণের সব অত্যাচার শেষ হবে।
কিন্তু যম তাঁর অস্ত্র নিক্ষেপ করতে উদ্যত হয়ে সবিস্ময়ে দেখলেন, সময় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। থেমে গেছে সময় ও জাগতিক চলন। যম আর নারদ দুজনেই হতভম্ব হয়ে গেলেন দেখে যে আদিপিতা ব্রহ্মা তাঁদের সামনে আবির্ভুত এবং তিনিই সময়কে থামিয়ে দিয়েছেন। বিস্মিত হলেও তাঁরা দুজনেই আদিপিতার সামনে নতমস্তকে হলেন। ব্রহ্মা যমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘বৎস, তুমি তোমার অস্ত্র কালদন্ড সংবরণ কর। তা রাবণের দিকে নিক্ষেপ করবে না।’ ব্রহ্মার মিনতিভরা কণ্ঠস্বর শুনে যম অবাক। তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে ব্রহ্মা স্বয়ং এসে তাঁকে তাঁর কাজে বাধা দেবেন, কোনদিন এমন কাণ্ড ঘটেনি। ব্রহ্মই তাঁকে সৃষ্টি করে তাঁর হাতে সময়ের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা তুলে দিয়েছেন, আর এখন সেই আদিপিতা এসে তাঁকে বলছেন যেন তিনি রাবণকে না মারেন। এ কি সত্যি নাকি রাবণ দুরাত্মার কোন ছল ? তাই হবে, ভাবলেন যম এবং তিনি ফিরে তাকালেন তাঁর কালদন্ডের দিকে। তখন ব্রহ্মা এসে তাঁর সামনে দাঁড়ালেন এমনভাবে যাতে যম তাঁর অস্ত্র প্রয়োগ না করতে পারেন। বললেন সবিনয়ে যমকে, ‘না পুত্র, না। তুমি ওই অস্ত্র প্রয়োগ করবে না, অন্তত রাবণের দিকে। একান্তই যদি তা করতে চাও তা আমার ওপর কর। তোমার সেই অধিকার এবং ক্ষমতা দুটোই আছে। তোমার কোন অন্যায় হবে না। কারণ সেক্ষেত্রে জগৎবাসী জানবে যে আদিপিতা নিজে তাঁর প্রাণ দিয়েছেন নিজের বাক্য রাখতে।’
যম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এমনিতেও তিনি বুঝতে পারছিলেন যে আদিপিতা তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করে সময়ের গতি স্তব্ধ করে রেখেছেন। থেমে আছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। এখানে কালদন্ড কার্যকরী হতে পারবে না। কালের চলন স্তম্ভিত থাকলে কালদন্ড প্রয়োগ হবে কী করে ? কালদন্ড তাঁর হাতেই আছে, তিনি তা নিক্ষেপ করতে পারছেন না। সময় আবার তার চলন ফিরে না পেলে কালদন্ড চলবে না। সময়কে চালাবার ক্ষমতা যম তাঁর হাতে পাননি। তা চালু করার ক্ষমতা একমাত্র আদিপিতারই আছে। নারদ তখন ব্রহ্মাকে বললেন, ‘পিতা, আপনি যমকে কেন বাধা দিচ্ছেন ? এই অত্যাচারী রাবণের জীবনকাল শেষ করে দিতে পারে আপনি ছাড়া একমাত্র যম। আপনি পারবেন না, যেহেতু আপনার হাতে কেবল সৃষ্টির অধিকার। ধ্বংসের অধিকার নেই। যমকে তাঁর কাজ করতে দিন। নাহলে রাবণ যে আপনার সৃষ্টি ধ্বংস করতে চলেছে।’
ব্রহ্মা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। সখেদে বললেন, ‘জানি। তবুও আমি নিরুপায়। কালের হঠাৎ প্রয়োগ নয়, স্বাভাবিক চলনেই রাবণ একদিন ঠিক ধ্বংস হবে। কারণ আমি রাবণকে অমর হওয়ার বর দিই নি। কিন্তু আমি তাকে এখনই শেষ করতে পারি না। এভাবে। তাহলে আমি জগৎবাসীর কাছে মিথ্যেবাদী বলে প্রমাণিত হব।’
ব্রহ্মা তখন সবিস্তারে রাবণকে বরদানের কাহিনী শোনালেন। শেষে বললেন,
‘তোমাদের চিন্তা নেই। সময়ের স্বাভাবিক গতিই একদিন রাবণকে থামাতে বাধ্য। কিন্তু এখনই নয়। আমি যে রাবণকে বর দিয়ে বসে আছি— দেবতা, যক্ষ, রক্ষ কেউ তাকে দমন করার ক্ষমতা পাবে না। সে নরবানরের কথা বলতে চায়নি অহংকারের বশে, তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভেবে। ওই নরবানরের হাতেই তার মৃত্যু লেখা আছে। এখন নয়, সময়ে।’
নারদ এবার সব বুঝতে পারলেন। যম কালদন্ড প্রয়োগ করলে দুটো ব্যাপার ঘটতে পারে, রাবণ মরবে বা মরবে না। দুটি ক্ষেত্রেই ব্রহ্মা মিথ্যেবাদী বলে প্রতিষ্ঠিত হবেন। রাবণ মারা গেলে ব্রহ্মার বর মিথ্যে হবে, আবার রাবণ না মরলে কালদন্ড ব্যর্থ হবে। ব্রহ্মা নিজে যমকে কালদন্ড প্রয়োগের অধিকার দিয়েছেন, এক্ষেত্রে কালদন্ড ব্যর্থ হলে আবার ব্রহ্মার বাক্য মিথ্যে হবে। নারদ হতাশায় মাথা নাড়লেন। অবাক হয়ে ভাবলেন, কেন তাঁর পিতা দুরাচার রাবণকে এমন বর দিয়ে এমন অসহায় হয়ে গেছেন এবং অন্যকেও বলছেন তাঁর কথা শুনতে। তিনি তখন নিজেও যমকে তাঁর পিতার কথা শুনতে বললেন। বিরক্ত ও হতাশ যম তাঁর অস্ত্র ফিরিয়ে নিয়ে ব্রহ্মাকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আপনি তাহলে কী করতে বলেন আমাকে ?’
ব্রহ্মা অশ্রুসজল চোখ নিয়ে কাতর কণ্ঠে বললেন যমকে,
‘তুমি অস্ত্র সংবরণ কর আর এখন থেকে অন্যত্র চলে যাও।’ যম রাগ চেপে অবসন্ন গলায় বললেন,
‘আপনি তাহলে আমাকে বলছেন যে এই দুরাত্মা রাবণকে আপনার কথা সত্যি প্রমাণ করার জন্য তাকে না মেরে আমি পালিয়ে যাব ?’ ব্রহ্মা ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলেন। যম আর কিছু না বলে মাথা নাড়তে নাড়তে কালদন্ড হাতে ফিরিয়ে ব্রহ্মা আর নারদ দুজনকেই প্রণাম করে তৎক্ষণাৎ অন্য স্থানে চলে গেলেন। ব্রহ্মা তখন আবার সময়ের গতি ফিরিয়ে দিলেন, জগৎকে আবার সচল করলেন এবং অন্তর্হিত হলেন। স্তম্ভিত বিপর্যস্ত নারদ কেবল সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি দেখলেন, জগৎ আবার সচল হলে রাবণ আর তার বাহিনী আবার যুদ্ধ শুরু করে দিল। এদিকে রাবণ যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল। সে ভাবল, এতক্ষণ ছিলাম কোথায় ? কী ঘটে গেল ? তার মনে পড়ল, নিশ্চল হওয়ার আগের মুহূর্তে সে দেখেছিল যমকে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নামতে। সে কোথায় গেল ? ঠিক এইসময় নারদ ডেকে বললেন রাবণকে,
‘শোন বন্ধু, যম তোমার সঙ্গে যুদ্ধে না পেরে তোমার ভয়ে পালিয়ে গেছে। তুমি যমকে পরাজিত করতে পেরেছ।’
বলে তিনি নিজেও অন্তর্ধান করলেন। আর রাবণ এবং তার বাহিনী সমস্বরে উল্লাস প্রকাশ করতে লাগল। সবাই বলছিল, ‘শমন দমন রাবণ রাজার জয়।’ রাবণের বুক গর্বে ফুলে উঠল। তার অহংকার বেড়ে গেল। জগৎবাসী বলতে লাগল, ‘বাপরে বাপ্, রাবণের কী ক্ষমতা ! সে মৃত্যুকেও জয় করতে পেরেছে।’ ( কৃতজ্ঞতা : ভারতীয় পুরাণ ও রামায়ণ অনুসারে )
অধ্যায় : চার
জীবন অনন্ত কে বলেছে ? কোথায় শিখল মানুষ এভাবে স্বপ্ন দেখতে যাতে সে এমন মোক্ষলাভ করতে পারে ? অনন্তকাল ধরে মানুষের এই যে অনন্তকে অর্জনের লক্ষ্য স্থির করে চলা তাকে তো আজ পর্যন্ত বর্জন করতে পারেনি মানুষ। কেন ? এখানে এই প্রাণের চিহ্নবর্জিত শৈলমালার কৌলিন্যে নিজেকে অন্যভাবে আবিষ্কারের বাসনায় হাজির হওয়ার সময় কিন্তু শৈবাঙ্কনের অন্তরে কিছুমাত্র এমন লক্ষ্য ছিল না। সে নিজেকে এই পরিবেশে সমর্পণ করার সময়েই অগণিত শীলাখন্ডবিধৌত প্রান্তর থেকে উঠে যাওয়া পার্বত্য চূড়ারাজি নীরব ভাষায় তাকে নিজেদের বর্ণ-বৈচিত্রের খেলায় জানিয়েছিল, ‘আমরা নিঃসঙ্গ, নির্বাক।’ আর সেদিন থেকে প্রতিমুহূর্তে তারা তাকে একথাই বারবার জানিয়ে যাচ্ছে। তার পর থেকে সেও তার নির্বাক অন্তরের ভাষায় নিবেদন করে এসেছে, ‘আমিও তোমাদেরই মত একজন।’ কতদিন থাকা হল তার এই অপরূপের আঙ্গিক বিন্যাসে ? খুব একটা কম দিন নয়। তার সমতলের বিক্ষিপ্ত মানসিকতাকে শান্ত করে প্রাণে শান্তি দেখা সহজ ছিল না। সেই অসহজে প্রাণের প্রলেপ আর আদর ক্রমাগত বিলিয়ে তাকে এমন নিরুপদ্রূত করাটা এক বা কয়েকদিনে সম্ভব হত না। তার জন্য যে কদিনের ব্যাপ্তি দরকার ছিল সেই দিনগুলি কেটে গেছে। আর সে এখন তাই স্নিগ্দ্ধ, সমাহিত। রোজই সকালে ঘুম ভাঙার পর রাতের আশ্রয় ছেড়ে খোলা প্রাঙ্গণে বেরিয়ে সে নতুন নতুন অঙ্গবিন্যাসে নতুন নতুন বর্ণনা আর ভাষা খুঁজে পায়। আজও সে তেমনই একটি জীবন্ত আর কলরব মুখরিত দিনের সূচনা দেখতে পাচ্ছে। সে সেখানে পেতে চলেছে এমন এক অধরা আনন্দের সন্ধান যা মূক ও বধির যেকোন অঞ্চলের যেকোন বস্তুকে জীবন্ত করে। তার চোখের সামনে স্পিতি নদীর ধারাপ্রবাহের অজস্র অলিন্দে দাঁড়িয়ে থাকা টিলাগুলির গায়ে সূর্যালোকিত সেই আনন্দ ফুটে উঠছে নানা প্রজাতীয় হাসির প্রকাশে, তাদের মুখাবয়বে আর অঙ্গে অঙ্গে গুচ্ছ গুচ্ছ বর্ণসমারোহ, তাদের অনবরত রঙ-রূপ পাল্টে যাওয়া প্রতিটি ক্ষণে অগণিত দৃষ্টিকোণ ভিত্তিক, তারা এভাবে সারাদিন সূর্যের চলাচলের সাপেক্ষে তার কিরণছটার পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেদের সাজসজ্জা কেবলই বদলাতে থাকে বহুরূপী কোন স্বর্গীয় বিকাশের সামিল হয়ে যেখানে কোনদিন দেবতাত্মারা সৌন্দর্যমুগ্দ্ধ তাদের চলাচলে ব্যস্ত থাকত। দিনের শুরু থেকেই স্পিতি নদীর বয়ে চলা তুলি হাতে উপস্থিত হয়ে গতিপথের গোলকধাঁধায় ও বুকে দাঁড়িয়ে থাকা সার সার পাহাড় চূড়াগুলির গায়ে রঙ মাখাতে মগ্ন হয়েছিল। সূর্য ওঠার অপেক্ষায় ছিল সে এতক্ষণ, সূর্য দেখা দেওয়ার পরে পরেই তার আলোর জোয়ারে রঙের পাত্র ভরাট করে তাতে অদৃশ্য তুলি ডুবিয়ে টিলাগুলির গায়ে নানাবর্ণের চিত্রকলা আঁকায় মেতে উঠেছে আপন খেয়ালে মনের সুখে। সে পরিষ্কার শুনতে পায় সেইসব টিলা আর গতিপথে শুয়ে থাকা শিলারাশিসমূহের কথা বলাবলি জলধারার কলশব্দে,
‘সূর্যকে দেখতে পেলে কি ? আমি তাকে অনুভব করছি উত্তাপে।’
‘আমিও।’
‘কী ঠাণ্ডা হয়েছিল গা সারারাত ধরে ! এখন বেশ আরাম লাগছে।’
‘আমারও। আর আরাম লাগছে বলেই সূর্যের ছোঁয়ায় গায়ে আমার এমন রঙের বাহার। দেখেছ কি ?’
‘তোমাকে কী দেখব ? আমি দেখাচ্ছি আমাকে। দেখ।’
‘আরে, আমার দিকে একটু তাকাও। আমি বুঝতে পেরেছি সূর্যের আলো সাতরঙা। দেখ, আমার গায়ে সেই প্রমাণ।’ ‘আচ্ছা ভাই স্পিতি, তোমার চলায় এতো টান কেন ? আমরা গড়িয়ে যাচ্ছি।’
‘আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ দুটোই তুমি নড়বড়ে করে চলেছ।’
‘আমাদের কি তুমি একটু তিষ্ঠোতে দেবে না কোথাও ? কেবল গড়িয়ে দেবে ?’
‘তোমরা যে কেন গড়াও ! কই, ওরা তো গড়ায় না ? এত আঘাত করছি, ওরা তবু যেমন ছিল যেখানে তেমনই থেকে যাচ্ছে। কোন তো অভিযোগ নেই ওদের।’
‘আরে, ওদের তো ভিত্তি জমির তলায়। শক্ত গাঁথা। আমাদের ভিত বলে কিছু নেই।’
‘অবশ্য ভিত থাকলেও হয় না, আকারও বড় হতে হবে। আসলে তোমাদের ভিত গোড়া থেকেই দুর্বল ছিল বলে ছিটকে গেছ। ছিলে একসময় আমাদেরই অঙ্গের শোভা হয়ে। এখনও দেখনা, তোমাদের মত অনেকেই এমন থেকে গেছে। তারা সূর্যালোকের সঙ্গে কথাও বলছে। সে কথা থাকছে আমাদেরই গায়ে।’
‘তবে তারাও কিছু না কিছু খসে পড়ছে রোজই প্রায় নদীর জলে।’
‘খসে পড়ায় আমাদের কী দোষ ? স্পিতির জল এত ধাক্কা দিচ্ছে কেন ? ছিটকে যাচ্ছি অনবরত।’
‘ধাক্কা না দিয়ে এগোব কী করে ? তাহলে তো আমাকে থেমে যেতে হয়। আমি চলব না ? গান গাইব না ? ছবি আঁকব না জলোচ্ছ্বাসের ? সবাই তো চায় আমাকে সচল-সবাক দেখতে।’
‘তুমি কী গো স্পিতি ? তোমাকে কি থামতে বলছি আমরা ? বলছি, একটু আস্তে চল। আমাদের অত টান দিও না।’ ‘টান হারালে আমার চলা যে আনন্দ হারাবে ! তার বেলা ?’
‘ওদের হাহাকার শুনতে যেও না স্পিতি।ওরা সব চপল বালক-বালিকাবৃন্দ।আমাদের গায়ে লেগে থাকতে পারল না। পড়ে গেল নিজেদের বালখিল্য আবেগের ভারে, আর এখন দোষ দিচ্ছে তোমাকে।’
‘ওরা অস্থিরমতি। ছটফটানি ওদের শিরায় শিরায়। আমাদের গায়ের শোভা বিনষ্ট করে খসে পড়েছে স্বাধীন চলাফেরার বাসনায়। আর এখন ঠোকাঠুকির ভাষায় আর্তনাদ করে মরছে।’
‘ভালো রে ভালো, আমাদেরই সব দোষ ! তোমরা খসিয়ে দিলে গা থেকে গায়ে সূর্যকিরণ সবটা মেখে চিত্র-বিচিত্র হতে। ঠিক হয়েছে, ন্যাড়া পাহাড়ের চুড়ো সব !’
‘ঝগড়া করে মরছ নিজেরা। আমি কেমন চলতে চলতে গান শোনাচ্ছি শুনতেও চাইছ না চুপটি করে।’
‘শুনতে চাইছি বলেই তো গড়াতে চাইছি না। গড়িয়ে দিচ্ছে তো তোমার ওই পাগল ধারা। চুপ থাকার উপায় কোথায়?’
‘কী মুশকিল ! তোমাদের চুপ রাখতে গেলে যে আমাকে থেমে যেতে হয়। আমি থেমে গেলে গান গাইবে কে ? কে ছবি আঁকবে উচ্ছ্বসিত জলোদ্ভাসের ?’
‘ওদের কথা শুনতে কী দায় তোমার ? চল যেমন চলছ তোমার খেয়ালে। তোমার চলার গানে ওদের গড়ানো আর ঠোকাঠুকি বাদ্যঝংকার। শুনতে তো ভালোই লাগছে।’
শিলাখণ্ড, টিলাসমূহ আর স্পিতি নদীর জলধারার কথোপকথন এভাবে চলতেই থাকে। তাদের বাক্যজাল মুখরিত করে তোলে পরিবেশ সূর্যালোকের সম্ভাষণে। সে দাঁড়িয়ে দেখে আর শোনে, মুগ্দ্ধ হতে থাকে বিস্ময়ে। কথা তার হারিয়েই থাকে। মৌখিক উচ্চারণে আসে না তারা, মনের অন্দরে ভাবনার ভঙ্গিতে বিকশিত হয়ে চলে। নিজের সেইসব অনুচ্চারিত বাণী নিজেরই কর্ণকুহরে শ্রবণগোচর হওয়া উপলব্ধিতে আসে, যেমন সে শোনে পাহাড়প্রদেশ বর্ণনাময় করে সাজিয়ে রাখা জড়জগতের প্রাণস্পন্দনহীন বাসিন্দাদের ভাষা। সে এখন তাদেরই দলভুক্ত, তাদের মতই সেও আর মুখে কিছু বলে না। সে বুঝেছে, মানুষের ভাষা এখানে অচল। এখানে সবাই কথা বলে দেবতাদের ভাষায়, আর সে ভাষা নিঃশব্দে বাজে। তবুও তা সবাই বোঝে, কারণ দেবতারা অন্তর্যামী এবং তারা এখানকার বাসিন্দাদেরও অন্তর দিয়ে কথা বলতে শিখিয়েছে। সেও এতদিনে সেভাবেই কথা বলতে ও বুঝতে শিখে গেছে। নাহলে সে বোঝে কী করে এই সকালে স্পিতি নদীর জল, শৈল চূড়াসমূহ, শীলাখন্ডগুলি কিভাবে কী বাক্যবিনিময় করে চলেছে ? আর সে নিজেও নিশ্চুপ কথা শোনায় নিজেকে, ভাবনার ভাষায়। সে ভাবে, ‘এই যে নিষ্প্রাণ সমারোহের ভালোবাসা, আমার প্রাণ যে এই ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হয়ে আটকে থাকতে চাইছে এটাই তো বড় পুরস্কার ও পাথেয়। একে আশ্রয় করে আমি জীবন চালিয়ে যেতে পারি যতদিন চলতে চায় সে। জীবন আর এখন আমার অবহ নয়। এই বেঁচে থাকা আমার কাছে মূল্যবান হয়ে উঠছে। দিনগুলি সব হতে পেরেছে অলংকৃত আর অর্থবহ। কী আশ্চর্য, আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছে বেড়ে যাচ্ছে ! আমি ভাবছি, জীবনকাল আরও দীর্ঘায়িত হলে মন্দ কী ! এটাই কি জীবনের মোহ ? অনন্তকাল এভাবে থেকে যাওয়ার এই আগ্রহই কি অমরত্ব লাভের ইচ্ছে ? অনন্ত জীবনের সন্ধান ? জীবাক্ষ কি এর কথাই বলেছিল আমাকে ? এভাবে জীবনের স্বাদ উপভোগ করার অফুরন্ত সুযোগ করায়ত্তে আনার যা একমাত্র পন্থা ?
তবুও মানুষের ভাষা ভুলে যাওয়ার উপায় থাকে না তার, জীবনযাপনের নানা প্রয়োজনে ও পরিস্থিতিতে বা পরিবেশে তাকে ওই ভাষায় কথা চালাতেই হয়। তার বর্তমান বাসভুমিতে যখন সে থাকে জনমানবহীন তখন সে কথা বলে দেবতাদের নির্বাক ভাষায় স্পিতির জলধারা, সারিবদ্ধ টিলাসমূহ, পাহাড়ি ঢাল, প্রান্তর, সুউন্নত শৈলচূড়া, ঝোড়ো বায়ুপ্রবাহ, দিনের আলো, সূর্য, রাতের আকাশের তারা বা চাঁদ, খণ্ডবিখণ্ড শিলারাশি বা বোল্ডার, শৈত্যঝাপটা, গভীর বা গম্ভীর খাদ, শৈলশিরা ইত্যাদি নিষ্প্রাণ বাসিন্দাদের সঙ্গে। সে এভাবে দ্বৈত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। এতে তার ক্লান্তি নেই, বিষাদও নেই। বরং এভাবেই সে বেঁচে থাকায় খুঁজে পেয়েছে জীবনের আনন্দ।
লোকালয়ে তো তাকে যেতেই হয়, নিছক পরিভ্রমণের উদ্দেশ্য ছাড়াও জীবনধারণের নানা উপকরণ সংগ্রহের তাগিদে। বেঁচে থাকার এই দায়বদ্ধ দিকটাকে সে কেন, পৃথিবীর কোন জীবই অগ্রাহ্য করতে পারে না। মানুষের সমাজের বাধ্যবাধকতা আরও বিরক্তিকর, আহার সংস্থানের মাঝখানে অনিবার্য হয়ে আছে অর্থসংশ্লিষ্ট লেনদেন। পশুপাখিদের সমাজে এই ঝামেলা নেই, কী রহস্যে কে জানে, তবে যেভাবেই হোক বেঁচে থাকার উপযুক্ত রসদ জুটে যায়। সংজ্ঞায়িত জড়জগতের সদস্যদের তারও দরকার নেই। তারা উপস্থিত থাকে স্বভূমিতে কোন বাহ্যিক প্রয়োজনের কথা মাথায় না রেখে। যদি তাদের মত বাঁচা যেত তো জীবন বুঝি এমন ক্লেদাক্ত হয়ে উঠত না।
সে আক্ষেপ অবশ্য তাকে ভুলে যেতে হয়েছিল, ভুলে যাওয়ার জন্য একটু বাস্তবতার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। নাহলে এমন নির্জন বাসভুমিতে দিনের পর দিন এই নিঃসঙ্গ জীবনযাপন সম্ভব হত না। উন্মত্ত জনসমাজ বর্জন করে এখানে স্বেচ্ছানির্বাসিত হওয়ার আগে নিকটবর্তী এক শহরে ব্যাঙ্কের একাউন্ট খুলে বেশ কিছু অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। দূরে যে জনসমাজ ছিল তার প্রাক্তন বাসস্থান সেখানেও ছিল অর্থসঞ্চয়। মোবাইল ফোন বিসর্জন দেওয়ার একটা মুশকিল ছিল ব্যাঙ্কজাতীয় আর্থিক সংস্থাগুলির সঙ্গে লেনদেন। তবে মজার কথা হল এই যে এখানে বাসভূমি বানিয়ে থাকার পর থেকে এতদিনে তার কোন আর্থিক লেনদেনের জন্য কোন ব্যাঙ্কে যেতে হয়নি। যতটুকু টাকাপয়সা সে সঙ্গে করে এনেছিল তাও শেষ হতেই চাইছে না, যতটুকু খরচ হয়েছে সে না চাইলে সেটুকুও হত না। তার দিনযাপনের খাদ্যোপকরণ কিভাবে যেন সংগ্রহ হয়ে যায় সে না চাইলেও। কাছেদূরের গ্রামের মানুষ বা অন্য কোন মাধ্যমের দাক্ষিণ্যে তার নিম্নতম চাহিদাটুকু ঠিক মিটে যায়। এটাই কি প্রকৃতির অজানা রহস্য যা অন্য পশুপাখিদেরও বেঁচে থাকার রসদ জুটিয়ে দেয় ?
যেমন জার্মান পর্যটক গেরহার্ট ও তার সঙ্গীরা তাকে খুঁজে পেয়েছিল। তারা যাওয়ার সময় জোর করেই প্রায় তার জন্য রেখে গেল প্রচুর শুকনো খাবার, ফল-মিষ্টি-নোনতা জাতীয়। পরিমাণে এতটাই যে অনায়াসে মাসখানেকও চলে যেতে পারে, যেহেতু সে স্বল্পাহারী থাকার অভ্যেস ও শিক্ষা গ্রহণ করেছে। এভাবে অন্য পর্যটকরাও তার সঙ্গে দেখা হলে তাকে কিছু দিতে আগ্রহী হয়, সে চায় না, তবুও। দেখে মনে হয় যেন তাকে কিছু দেওয়ার সুযোগ পেলে তারা ধন্য হয়ে যাবে। কেন কে জানে এমন মানসিকতা হয় তাদের ! বোধহয় সেই অজানা প্রাকৃতিক রহস্য। সে বোঝে না, বোঝার চেষ্টাও করে না। তাতে সে দেখে, তার জীবন বিপন্ন হয় না। এতো গেল গ্রীষ্মকালের কয়েক মাসের কথা, তখন উপত্যকার পাহাড়চূড়ো অনাবৃত থাকে, বরফ ঢাকে না তাদের। তাপমাত্রা বারো-তের ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা অসহনীয় নয়। কিন্তু শীতকালে কী হয় ? অথবা গরমকাল বাদ দিয়ে অন্য সময় ? শীতকালে এখানকার তাপমাত্রা হিমাঙ্কের অনেক নিচে নেমে যায়। পাহাড়চূড়াগুলি সবই বরফাবৃত, নদীর জলও জমাট বেঁধে যায় এক সময়। মানুষের পক্ষে তখন আর এই উন্মুক্ত প্রকৃতির বুকে বসবাস সম্ভব হয় না কোনমতেই। প্রান্তরপিপাসু গাদ্দি উপজাতির আধা-যাযাবর যেসব মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে ভেড়া ও ছাগলের পাল নিয়ে আসে এখানে চরাবার জন্য তারা উপত্যকায় বরফপাতের সূচনাতেই সদলবলে নিজেদের বাসস্থানে ফিরে যাওয়ার জন্য যাত্রা করে। তখন প্রকৃত অর্থেই উপত্যকা কেবল জনমানবশূন্য নয়, সম্পূর্ণভাবে প্রাণের চিহ্নবর্জিত হয়ে যায়। সে কী করে ওই সময় ? সেও তখন বাধ্য হয়ে এখানকার কোন না কোন গ্রামে বা জনপদে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আর সে অবাক হয়ে দেখে যে ওই জনপদনিবাসীরা তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে গ্রহণ করে স্বভূমিতে ফিরে আসা প্রবাসী কোন স্বজন হিসেবে। অন্য সময়েও সে যখন এসব লোকালয়ে আসে কোন কারণে তখনও সে এমনই ব্যবহার পায় ওইসব এলাকার বাসিন্দাদের কাছে। তারা সবাই বৌদ্ধ, কিন্তু সে কী তা সে নিজেও জানে না। তবুও কোন সমস্যা হয় না কোন পক্ষে। তাকে সবসময় যেকোন জনপদের সমস্ত মানুষরা বরণ করে নেয় সমাদরে নিজেদের মধ্যে। তারা বোঝে যে সে তাদের মত বৌদ্ধধর্মমতাবলম্বী নয়, এমনকি সে কোন সন্ন্যাসী বা জাদুকরও নয়, তবুও তারা তাকে আপনজনের মত বুকে টেনে নেয়। সবাই তাকে কেন যে মনে করে কোন অসাধারণ মানুষ, কোন দেবদূত বা জ্ঞানীগুণী তা সে নিজেও বোঝে না। শুধু দেখে, তাকে পেলে সবাই নিজেদের ধন্য মনে করে। এও কি সেই অজানা প্রাকৃতিক রহস্য ? সে বিস্ময়াভিভূত হয়ে যায় মানুষের এমন আদর, এমন ভালোবাসা দেখে। অবাক হয়ে ভাবে, মানুষ এভাবে মানুষকে এত ভালোবাসতে পারে। সভ্য সমাজে থাকার সময় কেন তাহলে তার নিজেকে নিঃসঙ্গ একা মনে হত, কেন সে জানত না সেখানে মানুষের মধ্যে এত ভালোবাসা লুকিয়ে আছে ? আর এই নিঃসঙ্গ পৃথিবীতে এসে সে দেখছে, তার চারপাশে অজস্র মানুষের ভিড়, সবাই তার আত্মীয়। এখানে আসার আগে সে ধারণাই করতে পারত না যে পৃথিবীটা সত্যিই সভ্য মানুষের ভালোবাসায় মোড়া, মানুষরা সত্যিই এতটা ভালো হতে পারে, পৃথিবীতে সত্যিই এত এত ভালো মানুষ থাকে।
আর ওই গাদ্দি উপজাতির মেষপালকরা। তাদের বাসস্থান কাংড়া জেলার বড়া ভাঙালে বা চাম্বা জেলার ভারমোরে, এই শেষে উল্লেখিত এলাকার জনপ্রিয় নাম গাদেরণ যা অন্য কথায় বোঝায় গাদ্দিদের বাসভূমি। কথিত আছে যে তাদের স্রষ্টা স্বয়ং দেবাদিদেব শিব। মহাদেব তাঁর দেবকীয় সিংহাসনে বা গদিতে বসে তাদের জন্ম দিয়েছেন বলে তারা গাদ্দি নামে পরিচিত। সে উপকথা সত্যিমিথ্যে কে জানে, কিন্তু স্বভাবে-চরিত্রে সত্যিই তারা সদাশিবের মত অতুলনীয়। কৃষিকাজ তাদের অন্যতম প্রধান জীবিকা হলেও বনে-জঙ্গলে বা প্রান্তরের তৃণভূমিতে ভেড়া-ছাগল চরানো তারা মনে করে তাদের পবিত্র কাজ। স্বয়ং শিব তাদের সৃষ্টি করে এ কাজের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন বলেই তাদের বিশ্বাস। যদিও সভ্যতার অগ্রগতির চাকার চলনে ও পরিস্থিতির চাপে তাদের এই জীবিকা আজ বিপন্ন তবুও অনেকেই নিয়োজিত ওই আদিম দায়িত্বপালনে।
সে যেখানে বাসস্থান বানিয়েছে তার কাছাকাছি প্রান্তরে গ্রীষ্মকালে আসে যে গাদ্দি মানুষগুলি তাদের মধ্যে আছে পবন, বৈজনাথ, ভৈরব এবং আরও কয়েকজন। পুরুষানুক্রমে একেকটি পথ নির্দিষ্ট একেক দলের জন্য, বছরের পর বছর সেই পথেই আসে একই তৃণভূমিতে নির্দিষ্ট দলটি। এই নিয়ে কখনো নিজেদের মধ্যে কোন ঝামেলা বা মতান্তর হয় না তাদের। আসলে গাদ্দিরা হিংসে-বিদ্বেষ কাকে বলে জানেই না। সরকারি তথ্য অনুযায়ী একথা প্রতিষ্ঠিত যে শান্তিপ্রিয় গাদ্দি উপজাতিদের বাসস্থান হওয়ার কারণেই গোটা হিমাচল প্রদেশে অপরাধের হার ভারতে সর্বনিম্ন।
এই তথ্য কতটা খাঁটি তা তার চেয়ে কোনও সমতলের মানুষ বেশি জানে না। সারা গ্রীষ্মকাল সময়টা তার কাটে পবন, কৈলাস, বৈজনাথ, গিরিধারীদের সান্নিধ্যে। তারা চরিত্রে কষ্টসহিষ্ণু হলেও তেমন অর্থবান নয়। জীবন চালানোর দায়ে ভেড়া চরাতে আসে দূর-দূরান্ত থেকে দিনের পর দিন বিপদসঙ্কুল পথ ধরে প্রাণ হাতে নিয়ে। তবুও তাদের প্রাণোচ্ছ্বলতার কোন অভাব হয় না। উপত্যকার প্রান্তরে ভেড়া আর ছাগলের দল নিয়ে এসে আগে তারা তার সঙ্গে দেখা করে, যতদিন থাকে নিয়মিত খোঁজ-খবর নেয় তার। তাকে তারা সযত্নে নিজেদের খাবার রোজদিনই এসে খাইয়ে যায়। দুধ, রুটি, বার্লি ইত্যাদি। সে নিষেধ করলেও শোনে না। ব্যাপারটা নিজেদের এক পবিত্র কাজ বলে ভাবে তারা। সে যদি তাদের দান গ্রহণ করতে শেষপর্যন্ত অসম্মত হয় তো তারা মনোকষ্টে ভোগে এবং সেই আন্তরিকতার ছাপ তাদের মুখে স্পষ্ট প্রকাশও পায়। সে তাই তাদের ফেরায় না, তাদের সম্মান জানাতে তাদের দান সানন্দে গ্রহণ করে। তারা তাতে কৃতার্থ হয়ে যায়, তার সঙ্গে গল্প করে সময় কাটায় আত্মীয়ের মত।
এই নির্জন নীরব উপত্যকার বাসিন্দা হয়ে এতদিনে সে বুঝতে পেরেছে পৃথিবীটা কত বড়, কত উদার। অনুভব করতে পেরেছে, মানুষের পৃথিবী আসলে কী এবং মানুষের জন্য মানুষের কতটা মমত্ববোধ। সে জেনেছে, পৃথিবী মানুষকে কতটা ভালোবাসে।
আর সে উপলব্ধি করতে পেরেছে, ‘জীব দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি,’ এই বিশ্বাসের মর্মার্থ। সে নিশ্চিত, বিশ্বপ্রকৃতি বা দেবতা, যে জগৎকে সৃষ্টি করেছে তাকে রক্ষা করার দায়িত্বও সে নিজের আয়ত্ত্বেই রেখেছে।
অধ্যায় :পাঁচ
কেউ চলেছে এদিকে, কেউ ওদিকে, আবার কেউ কেউ দুই বিপরীতমুখী ধারার উল্লম্ব দুদিকে, অথবা এভাবে তৈরি হওয়া চারটি তলের মিলনবিন্দু ভেদ করে কোণাকুণি নানাদিকে। সবাই এভাবে চলেছে যে যেদিকে পারে। বিভিন্নমুখী এমন নানাবিধ গমন চলছে সমস্ত মানুষের। দূরে কোন এক উচ্চস্থানে অবস্থানরত থেকে মনে হবে উদ্ভ্রান্তের মত সবার চলন, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের গতিপথকে কাটাকুটি করে এগিয়ে যাচ্ছে। কোথায় কেন তার হিসেবে মাথায় না রেখে। অগোছালো, এলোমেলো চলছেই চলছে। মেলাতে এমনি চলমান লোকের ভিড়ে সে হারিয়ে গিয়েছিল ছোটবেলায়।
সে কারো সঙ্গে জুটে একবার এদিকে গেল আবার ওদিকে কিছুটা, তারপর যেকোন দিকে খানিকটা করে। গতিপথ ঘন ঘন পাল্টাতে পাল্টাতে দিগভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল একসময়। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়েই রইল। কোন্ পথটা ঠিক, কেনই বা ঠিক, কোথায় গেলে কী হবে কিছুই তার মাথায় ছিল না। কী করা উচিত তাও বুঝতে পারল না। দাঁড়িয়েই রইল, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জানেও না। সম্বিৎ ফিরল একটা গলা শুনে,
‘তুই কি নতুন ? হারিয়ে গেছিস ?’
সে ফিরে তাকালো। বুদ্ধিদীপ্ত চোখের একটি ছেলে, সারা মুখাবয়ব আর শারীরিক ভাষায় সপ্রতিভতার ছাপ। ঋজু দেহকাঠামো দেখলে মনে হবে সোজা চলতেই অভ্যস্ত। বয়সে তার চেয়ে খানিকটা বড়ই হবে। সে তাকিয়েই রইল, কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। তার কথাও হারিয়ে গিয়েছিল, এমনই হয় সবার প্রথম প্রথম যারা মেলায় হারিয়ে যায়। তারা সবাই নতুন ভাষায় কথা বলতে শেখে মেলায় হারিয়ে যাওয়ার পর, যে ভাষা মেলার অন্যসব লোকেদের বোধগম্য। আসলে মেলার ভাষা আর চরিত্র একেবারেই অন্যরকম, থাকতে থাকতে এখানে শেখে সেসব মানুষজন।
‘আমার নাম কোটিকল্প। তোর মত আমিও মেলাতে হারিয়ে আছি। হারিয়ে গিয়েছিলাম কতদিন আগে নিজেও জানি না। আমারও অবস্থা হয়েছিল হারিয়ে যাওয়ার পর ঠিক তোরই মত। বুঝতে পারছিলাম না কী করব, কোথায় যাব, কোথায় থাকব। থাকতে থাকতে আর সবকিছু দেখতে দেখতে আমি এখন বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছি বলতে পারিস। এই মেলার নাড়ীনক্ষত্র আমার মত কে আর চেনে ? আমার কাজটা আমি নিজেই ঠিক করে নিয়েছি। লোকজনকে দেখি, তাদের আচার-আচরণ, উদ্দেশ্য-বিধেয়, জীবনযাপন। দেখি আর নিজের মস্তিষ্কের গবেষণাগারে বিশ্লেষণ করি। মেলার সামগ্রিক চালচিত্র আর গতিধারা নজরে রাখি, কী বা কেমন হবে বোঝার চেষ্টা চালাই। বোঝাটা খুবই শক্ত যদিও, সবটা সবসময় বোঝাও যায় না, তবু আন্তরিক চেষ্টা থাকলে কিছু অন্তত আন্দাজ পাওয়া কারো পক্ষেই অসম্ভব হয় না। আর তোর মত যারা এখানে হারিয়ে যায় নতুন নতুন, তাদের হাত ধরে কিছুটা পথ এগিয়ে দিই, অন্তত যতক্ষণ না তাদের চোখমুখ খোলে। তারপর দেখি একদিন তারা নিজেরাই আমার হাত ছেড়ে দেয়, তাদের সবারই ডানা গজিয়ে যায়, কেউ আর আমার সঙ্গী হয়ে থাকে না। না থাকুক, আমার তাতে কোন দুঃখ বা কষ্ট হয় না। বরং মনে হয় কেউ ঘাড়ে চেপে ছিল এতদিন, বোঝাটা নামল আর স্বস্তি হল। নতুন যাদের এভাবে দু’দিন পর চোখ খোলে তারা তারপর দেখি এমন হয়ে গেছে যে চিনতেই পারি না, কোনদিন তারা আমারই হাত ধরে এই মেলাতে অসহায়ের মত ঘুরে বেড়াত ভাবতেও তখন অবাক লাগে। এখানে যারা থাকে বা আসে তাদের সবারই চরিত্র একদিন এমন হতে বাধ্য। তোরও হবে, ভাবিস না। বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা ? ছবি তুলে রাখ্ তোর আজ, পনেরো-কুড়ি বছর পর মিলিয়ে দেখিস, কী বিপুল পাল্টে গেছে তোর চেহারা আর চরিত্র। চেহারা পাল্টায় বয়সের সঙ্গে সবাই জানে, চরিত্রও নিঃসন্দেহে, কিন্তু ওই পাল্টে যাওয়া আর আমি যে পাল্টে যাওয়ার কথা বলছি দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা। বোঝাতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়, বোঝাতে পারব কিনা বা তুই কতটা বুঝবি তাও একটা প্রশ্ন। তার চেয়ে ভালো হবে এখানে থাকতে থাকতে নিজেই যদি তা বুঝতে পারিস। ইচ্ছে থাকলে বুঝতে পারবি একশ’বার, সবাই পারেও। দুঃখ কোথায় জানিস, কী আমার পাল্টে গেল বা আমি কী ছিলাম আর কী হলাম এটা যাচাই করে দেখার ইচ্ছেটা করে না কেউ। মেলায় নতুন হারিয়ে যাওয়া অসহায় যাদের হাত ধরে আমি চলতে শেখাই, দু’দিন পর তারা সাবালক হলে তাদের বর্ণবিকাশ অন্যরকম হয়ে যায় যখন যদি তাদের বলতে যাই, ঘুরে দেখো, তুমি কেমন হলে বা দেখার ইচ্ছেটা মনে আনো একবার, তো তারা আমাকে হয়তো চাঁদা তুলে পেটাবে। আমি কাউকে কিছু বলতে যাই, পাগল ! কিচ্ছু বলি না, আমি কেবল দেখি, নিজের মনে ঘুরে বেড়াই, সব উপভোগ করি। আর নতুন যারা হারিয়ে যায় তাদের হাত ধরে চলতে শেখাই যতদিন না পাখনা গজায় তাদের। আয়, তোরও হাতটা ধরি।’
বহুক্ষণ কথা বলে হাত বাড়াল কোটিকল্প। সেও নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল অকূল সমুদ্রে কিছু একটা আশ্রয় হিসেবে পাওয়ার ভরসায়। হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্ত থেকে সে এমনই একটা ভরসা খুঁজে মরছিল। বড় অসহায় বড় একা মনে হচ্ছিল নিজেকে। হাতটা তাই ধরল শক্ত মুঠিতে, আর সঙ্গে সঙ্গে বুকে বল ফিরে পেল। যে নিঃসীম শূন্যতা তাকে ঘিরে রেখেছিল এতক্ষণ সে দেখল তা এখন ভরাট। এই মেলার ভিড়ে সে আর একা সঙ্গীহীন নয়। তার হাত ধরে তাকে নিয়ে এবার এগিয়ে যাবে স্বয়ং এমন একজন যে জানে এই মেলার ঘটনাপ্রবাহ কোন্ দিকে কিভাবে এগোয়। ওই একজন, যার নাম সে জানল কোটিকল্প, তার অভিজ্ঞতার ঝুলি পরিপূর্ণ সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমার প্রক্রিয়ায়। সে কি এখন নিজেকে নিশ্চিন্ত ভাবতে পারে ? কোটিকল্প বলল আবার বলল,
‘এখন থেকে যতদিন তুই আমার হাত ধরে চলবি দেখতে পাবি মেলার লোকজন কিভাবে কী উদ্দেশ্যে চলে। কী চায় এই লোকগুলি, কী ভাবনায় ব্যস্ত রাখে নিজেদের দিনক্ষণ স্পষ্ট হয়ে যাবে সব তোর কাছে। মানুষের কেমন চেহারা, কেমন চরিত্র, কী বৈশিষ্ট্য যত দেখবি তত অবাক হয়ে যাবি। একটি একটি মানুষ মানে একটি একটি পৃথিবী, সবই অন্তর্গত এই পৃথিবী নামক বাসস্থানের মানবসভ্যতায়। কত রহস্য, কত বৈচিত্র্য লুকিয়ে রয়েছে এখানে না দেখলে তোর বিশ্বাসই হবে না। যদি আমার হাত ধরে রাখার ধৈর্য থাকে তো দেখার চোখ পেয়ে যাবি। তখন তুই বুঝবি, যাদের যে পরিচয়ে দেখে যাচ্ছিস দিনরাত তারা আসলে মোটেই তা নয়। সবাই তারা অন্যরকম, কার্যকলাপে ও পরিচয়ে। এই চোখ তোর থেকে যাবে যতদিন আমার সঙ্গে আমার হাত ধরে আমি যেভাবে যেপথে চলছি অনবরত সেভাবে চলাচলের মানসিকতা থাকে তোর। যেদিন আমাকে ভুলে যাবি, আমার হাত ছেড়ে দিবি তোর এই ক্ষমতা চলে যাবে। তুইও তখন হয়ে যাবি মেলার আর দশজন লোকের মত। সবাই যা ভাবে তুইও তা ভাববি, যা করে করবি, যেভাবে চলে চলবি। তোর সঙ্গে অন্য লোকজনের আর কোন পার্থক্য থাকবে না।’
কথাগুলি শোনাচ্ছিল কোটিকল্প হাত ধরে চলতে চলতে। তার চলার পথ একমুখী, থামে না বা পিছন ফিরে তাকায় না। কে চলল না-চলল তার ভ্রূক্ষেপ নেই, সে চলে নিজের ছন্দে নিজের খেয়ালে অবিরাম গতিতে। যে না চলে সে তাকে চলতে বলে না, যে চলে সে তাকে সঙ্গে রাখে, ফেলে এগিয়ে যায় না। চলুক বা না-চলুক সবাই বা সবকিছু তার চলাচলের ওপর নির্ভরশীল, এটা বুঝেও কেউ বোঝে না। তাতে তার চলাচল আটকায় না। সে তার চলার পথে দেখে যায় কে কেমন, জানে সে জগৎ ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় তার পথেই চলমান। কেন চলে সবাই তার সঙ্গে সেটা কি সেও জানে ? এমনকি সে নিজে কেন চলছে তার কোন ব্যাখ্যা বা যুক্তি সে সাজায় না। তার কোন সঙ্গী নেই, তাকে যারা আদর্শ ভেবে মর্যাদা রাখার চেষ্টা করে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও সে তাদের পুরষ্কৃত করে। সে হাতে ধরে দেয় না কাউকে কিছুই, পুরষ্কার যে পাওয়ার সে তবুও তা ঠিক ঠিক পেয়ে যায়।
‘মেলার এই মানুষজন বড়োই বিচিত্র,’ হাত ধরে চলতে চলতে জানাচ্ছিল তাকে কোটিকল্প, ‘দ্যাখ্ না তাদের সাজগোজের ঘটা। গায়ে কতরকম পোশাক-আসাক। দেখতেও কেউ এক নয়, নানাবিধ চেহারা-চরিত্র। আবার দ্যাখ্, প্রত্যেকেই রঙের কারবারি। রকমারি রঙ দিয়ে সাজায় তাদের আজ-কাল-পরশু। তারা কখন হাসে কেন হাসে, কখন কাঁদে কেন কাঁদে বুঝতে গেলে থৈ পাবি না। আমি তাদের দেখি আর ভাবি, কেন এত রঙ মেখে সঙ সাজে সবাই। আমার চলন চলছেই, তারা কি তার খবর রাখে না ? আমার সঙ্গে কেন তারা চলতে পারে না ? কেন আমার হাত ধরতে চায় না ? আমি তো হাত বাড়িয়েই আছি। তারা ধরেও কেন ছেড়ে দেয় ? কেন আমাকে, আমার চলনকে দেখেও দেখতে পায় না ? আমি তো চলি আমার নিয়মে। থামি না, বসে থাকি না, এগিয়ে যাই। সবাই কিন্তু আমাকে চেনে, তবুও না চিনে থাকতে চায়। তারা কেউ মানতে চায় না আমার উপস্থিতি। এ এক আজব বিস্মরণ। কী এক মোহ সবাইকে আচ্ছন্ন করে রাখে ! আমি সবাক হতে জানি না, নীরব থাকি, কিন্তু আমি প্রবলভাবে চলি আর চালাই। মানুষরা যারা মেলাতে আছে তারা সবাই মশগুল আনন্দে। আমি উহ্য হয়ে যাই।’
হাত ধরে তাকে চালাচ্ছিল কোটিকল্প, বলতে বলতে কথাগুলি। সে চুপ করে শুনতে থাকে। কী বলবে বুঝতে পারে না। জনস্রোতের দিকে চোখ থাকে যদিও শুনতে কিছু ভুলে যায় না। সে যেমন কী বলবে বুঝতে পারে না তেমনি কিছু বলার সুযোগও পায় না। অপরপক্ষ তার কথা শোনার অপেক্ষা করে না, আপন খেয়ালে বলতেই থাকে,
‘মেলা কিন্তু চিরকালই জমজমাট। হয়তো এখন যাদের দেখছিস তাদের আর কোনকালে দেখতে না-ও পারিস। দেখবি না কোনদিন, সেটাও কিন্তু জোর দিয়ে বলার উপায় নেই। এমন লোকজনও দেখতে পাবি যারা বরাবর দলবদ্ধ হয়ে থেকে যায়, সেই দলে সব চেনামুখ। তবে তারা অনন্তকাল এভাবে থাকতে পারে না কোনক্রমেই। কোন না কোন একদিন আজ যে মুখগুলি মেলায় আছে তাদের জায়গায় অন্য মুখেরা চলে আসে। ব্যাপারটা এমনই নিঃশব্দ নিয়ম মেনে ঘটে যায় যে কোন একদিন সমস্ত মুখগুলি পাল্টে যাওয়া সত্বেও এতবড় পরিবর্তনটা কেউ টেরই পায় না। মেলার একটি প্রজন্ম এভাবে লোকচক্ষুর সামনে থেকে পুরোপুরি পাল্টে নীরব ছন্দে অন্য প্রজন্মে রূপান্তরিত হয়, হতেই থাকে, লোকজন দেখলেও তা নজরে আনে না। আমি আমার চলাচলের প্রক্রিয়ায় এমন রহস্য দেখেই আসছি, সমস্ত তথ্য আমার গোচরীভূত। মেলায় এত বিচিত্র জনসমাবেশ, এই বিপুল জনসমষ্টির সবাই চলছে মোহাচ্ছন্ন ভূতে পাওয়া অস্তিত্বের মত। অথচ প্রত্যেকেই অতিমাত্রায় সতর্ক, নিজের পাওনাগণ্ডা চুলচেরা হিসেবে বুঝে নিতে ওস্তাদ। এমনই বুদ্ধিমান এই জনরাশির প্রত্যেকটি সদস্য যে তুই তাদের তারা যা বোঝে তার অন্যকিছু বোঝাতে পারবি না। ব্যক্তিস্বার্থ ও ব্যক্তিগত লাভক্ষতি সম্পর্কে কাউকে বোঝানোর কিছুই বাকি আছে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই জনরাশিকে ঠকাবে এমন সাধ্যি করোও নেই। নাহলে এমন সভ্যতা তারা গড়ে তুলতে পারে ? তারাইতো তাই শিল্পবিপ্লব ঘটিয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব এনেছে। এমনকি, জীবনকে কালোত্তীর্ণ করার অসম্ভবকেও হস্তগত করার প্রতিজ্ঞায় অটল থাকার দুঃসাহস সামনে রেখে সৃষ্টিকর্তার সংজ্ঞা ও পরিচয় পাল্টে দিতে চলেছে। এই মেলার ভিড়ে সামিল এমনই সব মানুষরা। তাদের দেখে আপাতদৃষ্টিতে তোর মনে হবে চালচলনে সবাই বিশৃঙ্খল, সবাইকে এক এক করে দেখলে সেটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু এই জনতার সামগ্রিক চেহারাটা শৃঙ্খলাবদ্ধ। এতসব ইতিবাচক বিষয় থাকলেও গোড়ায় কিছু গলদ বর্তমান। মজা কী জানিস, এখানে যেভাবে যারা আছে তারা ভুলে যায় কিভাবে, কোথায়, কেন আছি। তারা ভাবে, যেখানে যেভাবে আছি সেটা সেভাবে আমার চিরকালীন বাসস্থান। তাই তারা সেই স্থানকে সর্বাধিক আরামপ্রদ বানাতে গিয়ে ন্যায়-অন্যায়, ভুলভ্রান্তির কালোত্তীর্ণ প্রচলিত সংজ্ঞা ও ধারণাগুলোকে ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের মত করে নেয়। ব্যক্তিবিশেষের এই সংকট শেষপর্যন্ত আর ব্যক্তিকেন্দ্রিক থাকে না, ব্যক্তিসমষ্টিও তাতে আক্রান্ত হয়ে যায়। সমাজ ও সভ্যতা তখন সামগ্রিকভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়ে, ভ্রান্ত মোহের বশবর্তী চলাচল তখনই দিশা হারিয়ে ফেলে। লক্ষ্য যা ছিল তা যদিওবা একই মনে হয়, সেখানে যাওয়ার পথ ও চলন দেখতে আপাতসহজ লাগলেও কিন্তু ভুল হয়ে যায়।’
একটানা কথা শোনাতেই থাকে কোটিকল্প। তার শুনতে খুব যে বিরক্তি লাগে এমন নয় মোটেই। বরং সে যত শোনে তত বুঝতে শেখে চারপাশ। সে তো হারিয়েই যেতে বসেছিল মেলার মধ্যে জনপ্রবাহে, দৈবাৎ দেখা পেল এমন এক সূত্রধরের যে তাকে ভরসা জোগাল আর হাতটি ধরে এগিয়ে চলার পথ দেখাচ্ছে। সত্যিই সে চিনত না বুঝত না এই বিচিত্র জনস্রোতের চরিত্র, এই বিশেষ জনসমষ্টির মিলন ক্ষেত্রটিকে। যে তাকে এত যত্ন নিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে তার কথা না শোনা তো বোকামি। এই অকূল ভিড়ে সঙ্গীহীন সে তো ছিল এমনই কোন সঙ্গীর আকুল অপেক্ষায়। যখন তেমন কাউকে পেল তাকে কেন অসহ মনে হবে ?
দীর্ঘ সময় চলতে চলতে আর কথা বলতে বলতেও অক্লান্ত কোটিকল্পের হঠাৎ মনে হল, তার শ্রোতাটি প্রথম থেকেই নির্বাক ও নিরুত্তর। তার নিজের তো এমন থাকার কথা, কেবল এগিয়ে চলা ধর্ম যেহেতু। অথচ সে একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে, শ্রোতাটির কোনরকম প্রতিক্রিয়াই নেই। কেন ? সে কি বুঝতে পারছে তার কথা ? আদৌ শুনছে তো ? নাকি তার সমস্ত কথা অশ্রুত থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ? এই সঙ্গত প্রশ্ন মনে জাগায় সে চুপ করল, যদিও চলা থামাল না। একটু সময় চুপ থেকে সে গলার স্বর খানিকটা নামিয়ে প্রশ্ন করল,
‘আচ্ছা, আমি কী বলে যাচ্ছি তুই কি শুনছিস ?’
প্রশ্ন শুনে তার একটু অবাক লাগল। সরাসরি প্রশ্ন যখন কিছু তো এবার বলতেই হয়। এখানেই যত তার দ্বিধাদ্বন্দ, বলতে গিয়ে মুখে কথা ফোটে না। কেন, তা বোঝে না নিজেও।
‘কি রে, কিছু তো একটা বল্। এক তো আমিই বকে যাচ্ছি তখন থেকে। হারিয়ে গেছিস তা তো বুঝলাম। তার বৃত্তান্ত নাহয় পরে বলবি। কিন্তু এত যে কথা বলছি সেসব শুনছিস কিনা সেটা তো জানাবি ? কথাগুলি তোর পছন্দ কি অপছন্দ তা পরের কথা। শুনছিস তো ?’
এবার তো তাকে তাকে কিছু একটা উত্তর দিতেই হয়। তবুও যতক্ষণ মুখে শব্দ উচ্চারণ না করে পারা যায় এমন মনোভাবে আবদ্ধ থাকার বাসনায় সে ঘাড় কাৎ করে বোঝাল যে শুনছে। এভাবে উত্তর দিয়েই তার মনে হল প্রশ্নকর্তা কেবল একটানা চলনশীলই নয়, এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখাতেও উৎসাহী নয়। তার এই নির্বাক উত্তর সে তো দেখতে পেল না। অতএব মুখে কথা না বলে উপায় নেই। তাকে তাই বলতেই হল,
‘হ্যাঁ, শুনছি। বুঝতেও পারছি।’
‘ভালোকথা। এবার তাহলে তুই বরং তোর কথা বলতে পারিস। তোর পরিচয়, তোর হারিয়ে যাওয়া, তোর ইচ্ছে-অনিচ্ছে যা তোর খুশি। আর নয় তো পরেও বলতে পারিস। যাকগে, ছেড়ে দে, পরেই নাহয় বলিস। আমি যে খুব জানতে চাই তাও নয়। কারণ তোর বিবরণ আমার জানা। তবুও বলতে বলছি এজন্য যাতে তুই কিছু বলার সুযোগ পাস্।’
শুনে সে বেশ অবাক হল। কথা বলতে তার কোন দ্বিধাবোধ নেই এখন। সটান এবার প্রশ্ন করল,
‘আমার কথা তুমি জানলে কী করে ?’
‘সবার কথাই জানি আমি। না জেনে উপায় নেই। বলেছি তো তোকে, এখানে চলতে শেখে সবাই আমার হাত ধরে। সূচনা সেই হারিয়ে যাওয়া থেকে। কিভাবে হারায় সবাই দেখছি সবসময়। কারো ক্ষেত্রেই আলাদা কিছু হওয়ার জো নেই। তোর ক্ষেত্রেও হবে কেন ?’
উত্তরটা কি পছন্দসই হল তেমন ? আপাতদৃষ্টিতে তেমন অবাস্তব মনে না হলেও একটু যেন কেমন-কেমন। তবুও মেনে নিতেই হল। তা সত্ত্বেও যা অপছন্দ সেটা জানবার জন্য উপযুক্ত জিজ্ঞাসা খুঁজে বেড়াতে লাগল। এই অবকাশে কোটিকল্প আবার বলল,
‘আমার হাত ধরে চলার একটা মুশকিল আছে। তোকে কেবলই চলতে হবে। থামতে পারবি না, বিশ্রামও পাবি না। কারণ আমি চলতেই থাকি, থেমে যাই না কখনো। একটানা চলনই আমার স্বভাব আমার ধর্ম।’
এমন হয় কেউ ? সে মেলার চরিত্র বা লোকজন কী দেখবে ? তাকে দেখেই কুলিয়ে উঠতে পারছে না। যত দেখছে ততই অবাক হয়ে যাচ্ছে। কেন সে সবার সব তথ্য জানে ? কেন সে কেবলই চলে, কখনো থামে না বা বিশ্রাম নেয় না ? কেন সে মেলার ভিড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ? কেন যে হারায় এখানে তার হাত ধরে সে এগিয়ে নিয়ে যায় ? কেনই বা তার কথা সবাই ভুলে যায় একসময় ? একের পর এক এমন প্রশ্নগুলি মাথার মধ্যে আসতে লাগল ক্রমাগত। মেলার ভিড় দেখে এতক্ষণ সে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল, এবার সে বিস্ময়াভিভূত হল তার কথা ভেবে। এই যে তার হাত ধরেছে, তার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে, তার কথা শুনছে, তাকে তো সে দেখছে না তাকিয়ে ! এবার সে চোখ ফেলল তার দিকে। মনে হল অনেক কালের চেনা কেউ। এমন কেউ যাকে সে দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু কী মুশকিল, কিছুতেই মনে করতে পারল না কিভাবে তার সঙ্গে কবে কোথায় দেখা হয়েছিল। এত চেনা কেন মনে হচ্ছে ? হতভম্বের মত সে প্রশ্ন করল,
‘তুমি কে বল তো ? কোথাও না কোথাও আগে নিশ্চয় দেখেছি।’
তার প্রশ্ন শুনে মৃদু হাসল কোটিকল্প, রহস্যজনক মেজাজে। সাবলীল ভঙ্গিতে জবাব দিল,
‘কোথায় কখন না দেখেছিস ? কেন যে মনে করতে পারছিস না ! তোর সঙ্গে আমার আজন্ম বন্ধুত্ব, আমৃত্যুও বলতে পারিস। ভুলে গেলি কী করে ? অরে ভাই, এটাই তো আমার দুর্ভাগ্য। তোর মত সবাই আমাকে ভুলে যায়। আর তাই হাতটা ছেড়েও দিতে পারে।’
কথাটা কি সত্যি ? সে বুঝে উঠতে পারল না। আবার নিশ্চিতভাবে মিথ্যে বলেও মনে হচ্ছে না, কারণ মুখটা বড়ই চেনা। অন্য আরও প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। তেমনই একটি প্রশ্ন সে এবার মেলে ধরল ,
‘মেলার সমস্ত চরিত্র তুমি জানলে কী করে ? কেবল ঘুরে ঘুরে এতকিছু জানা যায় না। অন্য কোন ব্যাপার অবশ্যই আছে। আছে না কি ?’
‘আছে তো !’ তার গলাতে বিন্দুমাত্র অস্বস্তি নেই, ‘মেলাতে কেবল আমিই ঘুরে বেড়াই না, মেলাও চলে আমার সঙ্গে।ঘোরে সে আমি যেভাবে ঘুরে বেড়াই। আমি চলছি বলেই মেলা জমছে, বা বলতে পারিস, মেলা চলছে।’
‘কিন্তু তুমি কে ?’
আবারও হাসল কোটিকল্প। বলল,
‘উত্তরটা জানিস, তবুও বুঝতে পারছিস না।’
‘না, বুঝতে পারছি না। বলে দিলেই তো পারো।’
‘সাময়িক ভুলে গেছিস, আবার ঠিক মনে পড়বে। নিজেই বুঝতে পারবি। ছেড়ে দে না, আমাকে নিয়ে পড়ে কোন লাভ নেই তোর। বন্ধু বলেই ভাব না, ল্যাঠা চুকে যাবে। হারিয়ে যাওয়া ভুলে যাওয়া কোন বন্ধু। থাকতেই তো পারে। সেসব বাদ দিয়ে এখন বরং মেলার লোকগুলিকেই দেখতে থাক। তারা আমার চেয়ে বেশি চিত্তাকর্ষক। তারা কী চায়, কী করে দেখলে তুই কূল পাবি না। সব একেকটি বিস্ময়ের খনি। তারা কিভাবে চলছে, কেন চলছে দেখতে চেষ্টা কর্, দ্যাখ্, বুঝতে পারিস কিনা। কী তারা বলতে ব্যস্ত তাও দেখার বিষয়। দ্যাখ্ না, একবার এদের দেখা শুরু করলে নেশা ধরে যাবে। তুই আর চোখ ফেরাতে পারবি না। রহস্য ঘনীভূত চরিত্র সব।’
সে তাই এবার মেলার লোকগুলির দিকে পূর্ণচোখ মেলে তাকালো।
অধ্যায় : ছয়
হিমালয় এক অনন্য পর্বতমালা। এখানে জড়িয়ে আছে আধ্যাত্মিকতা। পৃথিবীর দু’টি সেরা ধর্মের পীঠস্থান। এখানকার আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়েছিল বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণে, এখনও তার সেই রেশ বর্তমান। বৌদ্ধ ধর্মের কলরব এই অঞ্চলের রঙবাহার। দুর্গম উপত্যকায় বা পাহাড়ের স্নেহবিধৌত কোলে এই পর্বতমালায় জন্ম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবনের বর্ণাঢ্য সমারোহ, বিকশিত সেইসব জনবসতির মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির রুদ্ররূপ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যুক্ত, তারা জানে দেবতার কী ব্যাখ্যা। ঐশ্বরিক শক্তির উপস্থিতি তাদের জীবনে কিছুমাত্র আশ্চর্য নয়। তারা মনে করে, জীবন মানে লৌকিক আর অলৌকিক বিষয়সমূহের সমাহার। তাদের জীবনযাপনের স্তম্ভ হল বিশ্বাস এবং এই বিশ্বাস দ্বিমুখী, যতটাই অন্তর্মুখী ততটাই আবার বহির্মুখী। আর দৃশ্যমান কোন অবয়বের যেমন ছায়া থাকে, তেমনই এই পার্বত্যাঞ্চলের বাসিন্দাদের উজ্জ্বল জীবনযাপনের একধারে লেগে রয়েছে অনিবার্য কিছুটা অন্ধকারও। তারা তন্ত্র-মন্ত্র-জাদুবিদ্যা ও সমগোত্রীয় আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক ছলাকলাও বেঁচে থাকার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে বিশ্বাস করে। সারল্য যেমন তাদের চরিত্রভূষণ তেমনি রুক্ষ প্রকৃতি তাদের মধ্যে সময়বিশেষে হিংস্রতা ও অন্যান্য মানবিক অপগুণগুলির প্রকাশ ঘটায়। সামগ্রিক বিচারে তবুও হিমালয় তাকে ঘিরে রাখা ধার্মিক ও মানবিক বিকাশ নিয়ে সমতলভূমির তুলনায় একেবারেই অন্য জগৎ যেখানে রয়েছে প্রাণের আরাম আর নির্মল অনুভব।
এখানে কি সত্যিই এক কালে দেবতারা বসবাস করত ? বা এখনও আছে তারা লোকচক্ষুর আড়ালে ? থাকুক অথবা না-থাকুক এখানকার আকাশে-বাতাসে উপলব্ধি করা যায় তাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের নীরব অথচ সপ্রাণ প্রকাশ। তাদের উৎস নাহয় পুরাণ বা লৌকিক উপকথায়, স্বচক্ষে বর্তমান সভ্যতার মানুষ দেখেনি কোনোদিন, কিন্তু বুদ্ধ ও তাঁর বিকাশ এখানে ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ী স্বীকৃত। হিন্দুধর্মের দেবদেবীরা জীবন্ত আছে সেই ধর্মানুসারীদের বিশ্বাসে। রুদ্রদেব শিবের প্রিয়স্থান এই পর্বতমালা এবং স্বর্গভূমি ও গোলোকধাম বোধহয় এই অঞ্চলেরই ভূপৃষ্ঠে নাহলেও আকাশে কোন অবস্থানে বলেই সবার ধারণা। হাজার হাজার বছর ধরে লক্ষ লক্ষ উপাসক সাধু-সন্ন্যাসীরা এখানে অভাবনীয় দুর্গমতার কোলে আত্মগোপন করে তপস্যায় মগ্ন থাকতে অভ্যস্ত এবং এখনও অনেকে সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন। কিসের আকর্ষণে ? কিসের মোহে ? তার অনেকটাই সূত্র পাওয়া যায় হিন্দুধর্মের আকরিক বেদ-উপনিষদ ও অন্যান্য পৌরাণিক মহাকাব্যিক ধর্মগ্রন্থে। সেখানে অনুসন্ধান করলে জানা যাবে, তপস্যা ছিল ঈশ্বরদর্শনের বাসনায়। কিন্তু তারও পিছনে ছিল অন্য লক্ষ্য, ছিল অপার শান্তির সন্ধান। সেই অপার শান্তি কিভাবে পাওয়া যাবে ? যদি পরমব্রহ্মের সন্ধান পাওয়া যায়। তখনই মিলবে অখণ্ড স্বর্গবাস ও অমৃতের সন্ধান। আর যে পাবে অমৃতের সন্ধান সে পাবে অপার আনন্দ ও অনন্ত জীবন। অথবা, এই সমস্ত উদ্দেশ্যগুলি একটু এদিক-ওদিকও হতে পারে। স্বর্গের দেবদেবীরা অমর যেহেতু অমৃত রয়েছে তাদের অধিকারে। তাই অমরত্ব পেতে গেলে অমৃত হস্তগত করা অবশ্যই দরকার, তার জন্য প্রয়োজন স্বর্গের অধিকার এবং সেই বরলাভের জন্যই দেবদেবীর তপস্যা। অথবা, অপার শান্তি ও অপার আনন্দ মিলবে যদি ঘটে মোক্ষলাভ, আর তাই পরমব্রহ্মের সন্ধান অবশ্য প্রয়োজন। তার জন্য দরকার দীর্ঘকালীন তপস্যা ও প্রতীক্ষা যা একজীবনে কোনমতেই পাওয়া সম্ভব নয়। তাই অনন্ত জীবন লাভের আকাঙ্খায় দেবদেবীর আরাধনা। যাই হোক না কেন, অনাদিকাল ধরে তপস্যার কেন্দ্রভূমি এই হিমালয় পর্বতমালার নানা অঞ্চল। ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, বিশ্বাস, সংস্কার ও কুসংস্কার, ইতিহাস সব মিলেমিশে একাকার এই সুবিশাল ভাণ্ডারে।
মৌনী তপস্বী হিমালয়ের আশ্রয়ে এসে নিজেও প্রায় মৌনব্রত নিয়েছে শৈবাঙ্কন। কথা বলতে নিতান্ত বাধ্য হলেই বলে, কেবল শোনে কে কী বলতে চায়, মানুষই কেবল নয়, সমগ্র জীবজগৎ ছাড়া জড়জগতও অবশ্যই। মানুষে মানুষে কথা বলার অভ্যেস ক্রমশ প্রায় স্থগিত হয়ে যাচ্ছিল যখন তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবোত্তর অভিনব কলাকৌশলশাসিত সমাজভূষিত নগরভিত্তিক সভ্যতায় মোবাইল ফোনে তড়িৎগতিসম্পন্ন আঙুলের ডগার দুরন্ত সঞ্চালনে মনের কথা মুখের ভাষা বৈদ্যুতিন পর্দার গায়ে বার্তাবহ প্রকাশব্যবস্থার দৌরাত্মে, সেসময় থেকেই তার অন্তরে ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছিল বাক্যবিনিময়কারী সঙ্গীদের অভাবজনিত ক্ষোভ আর অভিযোগ ও অভিমান। সেখান থেকেই তার কথা না বলার অভ্যেস তৈরি হয়ে আসছিল যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটেছে এখানে এই হিমশীতল পার্বত্য মরুভূমির কোলে বসবাস শুরু করে। ধওলাধর পর্বতমালার অনেক উত্তরে এই স্পিতি অববাহিকা। ডিম্বাকৃতি এই শীতল পাহাড়ি মরু উপত্যকায় জীবনের স্পন্দন কোথায় ? হিমালয়ের বৃষ্টিচ্ছায় ঢালে রয়েছে এই অঞ্চল, সারা বছরে তাই এক ফোঁটাও বৃষ্টি নেই। তাপমাত্রার তীব্র ওঠানামা চলে সবসময়, গ্রীষ্মে কোনোকালে সর্বোচ্চ পনের ডিগ্রি সেলসিয়াস হতেও পারে, অধিকাংশ সময় থাকে শূন্যঙ্কের তলায়। রয়েছে প্রচুর সূর্যকিরণ আর বরফাচ্ছাদন। বাদামি পর্বতগাত্র গড়ে তুলেছে অত্যাশ্চর্য স্বর্গীয় ভূদৃশ্যাবলী, অপার্থিব যে সৌন্দর্য বিশ্বে দুর্লভ ও বিরলপ্রায়। প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহ ছাড়াও আছে প্রবল হওয়ার দাপট, আবহাওয়াতে অত্যুচ্চ এলাকার চরিত্র এবং স্বল্প আর্দ্রতা—- এ সমস্ত কিছু একসঙ্গে মিলে মাটিকে করে তুলেছে শুষ্ক ও জৈব উপাদানবঞ্চিত। এটাও এক মরুভুমি, নাম তাই কোল্ড মাউন্টেন ডেজার্ট। শৈত্যপ্রবাহজনিত প্রবল বায়বীয় গর্জন যেমন তার কানে শিবের রুদ্ররূপ ও ভীমনাদ হয়ে আছড়ে পড়ে, সে তখন শোনে মহেশ্বরের গুরুগম্ভীর স্বরের ভাষণ, যা বর্ণনা করে কেমন তার চরিত্র, তেমনি ঝলমলে সূর্যকিরণ বরফমুকুট সুউচ্চ শৈলচূড়াতে প্রতিফলিত হয়ে ফুটিয়ে তোলে তার বুকের শান্তশীতল ভাষা। সে শোনে সেই অব্যক্ত কণ্ঠস্বর বলছে,
‘এখানে তোমাকে আমারই মত স্থিতধী আর উদার হয়ে যেতে হবে।’
হিমালয়ের সর্বনিম্নাংশ ভারতবর্ষের উত্তরাংশে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে একটানা চলে গেছে শিবালিক পর্বতমালা নামে। এই অঞ্চল নবীন এবং ঘন বনভূমিতে আচ্ছাদিত অত্যুচ্চ চূড়াসমূহের সমাহার যা জীবাশ্মের ভাণ্ডার। তার উত্তরে রয়েছে ধওলাধর পর্বতমালা যেখানেও আছে দুর্ভেদ্য জঙ্গল। এর উত্তর-পশ্চিমে পীর পাঞ্জাল পর্বতমালা জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে। এই দু’টি পর্বতমালা নিয়ে লেসার হিমালয়। তার উত্তরাংশের নাম গ্রেটার হিমালয় আর এখানেই আছে জাঁস্কার পর্বতমালা, স্পিতি উপত্যকা গড়ে উঠেছে যার আশ্রয়ে। গ্রেটার হিমালয় হল একেবারেই উত্তরের অঞ্চল আর এখানে রয়েছে ট্র্যান্স হিমালয় এলাকা যার অন্য নাম তিব্বতীয় হিমালয়। এই তিব্বতীয় বা টিবেটান হিমালয়ের অধিকাংশ অবস্থিত তিব্বতে। এর অন্তর্গত পর্বতমালাগুলি হল জাঁস্কার, লাদাখ, কৈলাশ ও কারাকোরাম। পূর্ব-পশ্চিমে এক হাজার কিলোমিটার এর বিস্তৃতি। তিব্বতীয় হিমালয় ও ট্র্যান্স হিমালয়ের সুপরিচিত নাম টেথিস হিমালয়। এই টেথিস হিমালয় জম্মু ও কাশ্মীর এবং হিমাচল প্রদেশ জুড়ে অবস্থিত, চলে গেছে তিব্বতে। এখানেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে ছিল টেথিস মহাসমুদ্র। তারপর একদিন ভুগর্ভস্থ গাঠনিক থালায় হঠাৎই দেখা দিল মহা আলোড়ন। ইন্ডিয়ান প্লেটের সঙ্গে চায়না প্লেটের সংঘাতে সমুদ্র উধাও হয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উপস্থিত হল হিমালয় পর্বতমালা। টেথিস হিমালয়েরই অন্তর্ভুক্ত জাঁস্কার পর্বতমালা, যা তৈরি করেছে স্পিতি বেসিন বা স্পিতি অববাহিকা।
সন্নিকটে দেবাদিদেবের বাসস্থান কৈলাশ পর্বত, তারই দোসরপ্রতিম জাঁস্কার পর্বতগুচ্ছ। আদিদেবের ধ্যানমগ্নতা পরিবেশের বহিরঙ্গে ও অন্তরে। শৈবাঙ্কন এখানে এসে সেই দৈবী মহিমা আবিষ্কার করতে পেরেছে। তার মনে হয় যে এখানেই কোথাও সুরক্ষিত আছে অমৃতভাণ্ডার, জরাজীর্ণ জীবন যার সংস্পর্শে প্রাণিত পারে। স্বর্গ যে পৃথিবীর কোন এক স্থান এতে আর কোন সন্দেহ নেই। সমতলে থাকার সময় সে জানত না হিমালয়ের পরিচয়। হয়তো স্কুলপাঠ্য ভূগোলের বইতে সে জেনেছিল জাঁস্কার পর্বতমালার কথা, কৈলাশ তো নানাভাবেই সুপরিচিত। সে আরও জানত যে এখানেই স্মরণাতীত কালে ছিল টেথিস মহাসমুদ্র। কিন্তু সে জানত না টেথিস হিমালয়ের জাঁস্কার পর্বতমালার চেহারা ও চরিত্র কেমন। তারই সযত্ন প্রাচীরের ঘেরাটোপে যে জন্ম নিয়েছে অপরূপ স্পিতি উপত্যকা সে কথা জানা ছিল না। আসলে জাঁস্কার পর্বতমালার সুখ্যাতি তার সুউচ্চ সুন্দর শিখরগুচ্ছ ও চিত্ত বিমোহন ভূদৃশ্যাবলীর জন্য। এখনও তা বলতে গেলে অনাবিষ্কৃত থেকে গেছে। আর এখানেই লে-লাদাখ অঞ্চলের তুলনায় সে স্বতন্ত্র, তার জনপ্রিয়তা ও পরিচিতি তেমন নয় বলে। তবে তার আকর্ষণ পর্যটকদের কাছে ক্রমশ বাড়ছে এই অঞ্চলের মনোরম জলবায়ু, বরফাচ্ছাদিত পর্বতশিখর, খরস্রোতা নদীগুলির জন্য।
গ্রেটার হিমালয়ের টেথিস অঞ্চলে একগুচ্ছ পর্বত নিয়ে জাঁস্কার পর্বতমালা উত্তর ভারত থেকে তিব্বতের পশ্চিমাংশ পর্যন্ত ছ’শ চল্লিশ কিলোমিটার প্রসারিত দক্ষিণ-পূর্বে, হিমাচল প্রদেশের কিন্নর উপত্যকায় আছে এর শিল্লা চূড়া আর চাম্বা জেলাতে পাঙ্গি চূড়া। জাঁস্কার পর্বতমালা কিন্নর ও স্পিতি থেকে তিব্বতকে আর পাঙ্গি চাম্বাকে লে-লাদাখ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। হিমাচল প্রদেশের উত্তর-পূর্বাংশ বোঝায় তিব্বত ও ভারতবর্ষের মধ্যবর্তী অংশ, স্পিতি কথাটির মানেই হচ্ছে তাই। পনের হাজার ঊনষাট ফিট উচ্চতাবিশিষ্ট কুঞ্জুম পাস লাদাখ আর স্পিতি উপত্যকার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।
থমসন স্পিতি উপত্যকার চরিত্র জানার জন্য এক বড় অভিযানে গিয়েছিলেন। সে আঠেরোশ’ সালের কথা। সমগ্র উপত্যকার মাটিতে তিনি তিন জাতীয় বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেছিলেন। একটি হল জমাটবাঁধা মিহি কাদামাটি। দ্বিতীয়টি ত্রিকোণাকার পাটাতন, যা পর্বতগাত্র থেকে শিথিল ঢালে নেমে এসেছে নদীর দিকে আর শেষ হয়েছে তীব্র খাড়াই দিয়ে। আর তৃতীয়টি নদীগর্ভের ওপরে চারশ’ থেকে ছ’শ ফিট উচ্চতায় বিপুলাকার গভীর গহ্বর। স্পিতি নদী এই পাটাতনগুলির মধ্যে দিয়ে সুগভীর গিরিসংকট সৃষ্টি করে বয়ে চলেছে। শেষ দুটি বৈশিষ্ট্যের গাঠনিক উপাদান কাদামাটি, নুড়ি পাথর আর বোল্ডার। থমসন অনুমান করেছিলেন, অতীতে এই উপত্যকা ছিল নিশ্চয় কোন বিশালায়তন হ্রদ। কিন্তু তিনি কোন নিশ্চিত ব্যাখ্যা দিতে পারেননি, কিভাবে এই উপত্যকার আবির্ভাব ঘটল তারও কোন উল্লেখ ছিল না তাঁর বিবরণে। এখন ভূবিজ্ঞানীদের গবেষণা প্রমাণ করেছে যে ভূগর্ভস্থ গাঠনিক প্লেটগুলির আলোড়নে ও সংঘর্ষে আদিম যুগে এই অঞ্চলের সমুদ্র সরিয়ে উপত্যকার উদ্ভব ঘটেছে।
এসব তথ্য সবই জানে শৈবাঙ্কন। এখানে আসার পাকাপাকি সিদ্ধান্তে এসে পড়াশুনা করেছে এই উপত্যকা নিয়ে সে অনেকটা সময়, জেনে নিয়েছে অনেক বিবরণ। যেখানে সে জীবনের বাসভূমি বানাবে তার স্বভাব-চরিত্র জানবে না ? তার আগে ঘুরে বেড়িয়েছিল দেশের সম্ভাব্য অনেক জায়গায়। মানুষ আছে বা নেই এমন অনেক স্থানে। আরও অনেক সৌন্দর্য্যমন্ডিত জায়গা তার বাসস্থান হতে পারত। তাদের অনেকেই কিন্তু নির্জন বা স্বল্প জনবিশিষ্ট। দৃষ্টিনন্দন ফুলের উপত্যকা ছিল কিছু পাহাড়ে ঘেরা যেখানে কেবলই উৎসবের আয়োজন সারা বছর। কিন্তু সে চেয়েছে সবসময় অন্যকিছু, একেবারে নির্জন কিছু হবে এমন কোন শর্ত ছিল না তার। আনন্দ থাকবে কি থাকবে না তারও ধার ধারত না সে। তবে এমন কোন স্থানে সে যেতে চায়নি যেখানে থাকবে উৎসবের পরিবেশ বা চপল আনন্দ। তার চাহিদা ছিল গুরুগম্ভীর কোন প্রদেশ, যেখানে আনন্দ বিরাজমান মৌনতামগ্ন প্রশান্তি নিয়ে। তার কারণ কিছুটা ভিন্ন, কেবলমাত্র তথ্যপ্রযুক্তিপোষিত আধুনিকতার ওপর বীতরাগ নয়। এই বীতরাগ তাকে জনকোলাহল থেকে দূরে বসবাসের ইচ্ছে জাগিয়েছিল, অত্যাধুনিক জনসমষ্টি বর্জন করার মনোভাবও এনেছিল তার মধ্যে ঠিক, কিন্তু তাকে একেবারে শুরুতেই ঘরছাড়া করেনি বা এমন শান্ত-সমাহিত গম্ভীর প্রদেশে বাসস্থান বানাবার কথা ভাবায়নি। তাকে ঘরছাড়া করার কারণ ছিল অন্য। তার জীবনের প্রধান শোক। আধুনিক জনসমাজের ওপর বীতরাগ হল তার বিদ্বেষ, শোক নয়। দু’টোই আঘাত যদিও চরিত্রে ভিন্ন। তার জীবনের কী সেই শোক ?
ভারতবর্ষে ইংরেজ আমলের আগে কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্যব্যবস্থা যখন ভাঙ্গনের মুখে তখন লাহুল ও স্পিতি স্বাধীন অস্তিত্ব হয়ে ওঠে। স্পিতিভ্যালির স্থানীয় শাসকদের উপাধি ছিল নোনো। তারা হয় দেশজ কোন বংশের বা লাদাখ অঞ্চলের শক্তিশালী শাসকদের স্পিতিকে দেখাশোনা করার জন্য পাঠানো ব্যক্তিদের উত্তরপুরুষ। দশম শতাব্দীতে স্পিতিকে উপঢৌকন হিসেবে দেওয়া হয় লাদাখের রাজার তিনটি ছেলের মধ্যে একজনের হাতে। তারপর থেকে দীর্ঘকাল স্পিতির ইতিহাস লাদাখের ইতিহাসের সঙ্গে একই ধারায় প্রবাহিত হয়ে এসেছে। স্পিতি স্বায়ত্ত্বশাসন ক্ষমতা ফিরে পায় লাদাখের শাসকরা কালের নিয়মে দুর্বল হয়ে যাওয়ার পর। তখনও স্পিতিকে নিয়মিত মাশুল পাঠাতে হত লাদাখ, চাম্বা ও কুলুতে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে লাদাখ-তিব্বত যুদ্ধের পর স্পিতি সত্যিসত্যিই স্বাধীন হয়ে যায়। কুলু উপত্যকার রাজা মান সিং স্পিতি দখল করে এই অঞ্চলে গা-ছাড়া নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নিয়ন্ত্রণ আবার ফিরে যায় লাদাখের হাতে। লে থেকে গভর্নর হিসেবে এই অঞ্চলের দেখভালের জন্য একজনকে পাঠানো হয়, কিন্তু সে এখানে থাকত কেবল ফসলের মরশুমে। অন্যসময় সে স্থানীয় প্রশাসনের ভার ওয়াজির বা নোনোদের তত্ত্বাবধানে রেখে চলে যেত। দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য বেশ কয়েকটি গ্রাম মিলিয়ে একজন গ্রামপ্রধান বা নেতা বাছাই করা হত। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত স্পিতি থাকে ডোগরা সম্প্রদায়ের অধীনে, তারপর শিখরা পর্যুদস্ত হওয়ার পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। বুশারদের পুরুষানুক্রমিক ওয়াজির বা উজির মনসুখ দাসের তত্ত্বাবধানে রাখা হয় অঞ্চলটিকে। সমগ্র স্পিতি এলাকার জন্য উজিরকে বছরে সাতশ’ টাকা খাজনা হিসেবে দিতে হত ব্রিটিশদের। বছরখানেক পরই স্পিতি সরাসরি কুলুর সহকারী কমিশনারের অধীনে চলে আসে। স্বাধীনতার পর নতুনভাবে লাহুল ও স্পিতি জেলা গঠিত হয় এবং পাঞ্জাব থেকে বিচ্ছিন্ন করে একে জুড়ে দেওয়া হয় হিমাচল প্রদেশ রাজ্যের সঙ্গে।
তার অতীত জীবনকে সে ফিরে দেখে প্রায়ই। বিশেষত কোন নিশ্চুপ রাত অবশ করে রাখে যখন অন্ধকারের আচ্ছাদন। শৈত্যপ্রবাহ থাকে তখনও, বরং আরও প্রবল হয়ে ওঠে তার বিচরণ, আর মহাকাশ নিশ্ছিদ্র করে রাখে তারকারাজির কথোপকথন। সে কান পেতে থাকে তারা কী বলে শোনার আকুল আগ্রহে।যদি তাদের বাক্যালাপে সে তার মায়ের কণ্ঠ শুনতে পায় ! আর সে খোঁজে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ওই তারকাদলের ভিড়ে কোনোটিতে তার মায়ের মুখ দেখা যায় কিনা। সে স্থিরনিশ্চিত এই বিশ্বাসে যে ওখানে অবশ্যই তার মা কোথাও কোন না কোন তারকা হয়ে তাকে দেখছে স্নেহাতুর চোখে। প্রত্যেকটি মানুষ যেহেতু একেকটি স্বাধীন সত্ত্বা এবং যেহেতু তা প্রাণিত থাকে অফুরন্ত চেতনাবোধে, দেহ বিনষ্ট হলেও সেই চেতনা সেই বোধ হারাতে পারে না। এটাই সে মনে করে অমরত্ব, যা কোন মানুষকে তার ক্ষুদ্র জীবনের পরিসরেও অনন্ত করে দেয়। বৈদিক ঋষিরা নাহলে কিসের সন্ধানে নিয়োজিত থাকত হিমালয়ের নির্জন গুহায় বা অরণ্যে দিনের পর দিন জনবর্জিতভাবে ? তারা কি কেউ কখনও তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে আসুরিক অভিপ্রায়ে দৈহিক অমরত্বের বর চাইত ইষ্টদেবতার সম্মুখে ? তারা সেই অমরত্ব, সেই অনন্তের সন্ধানে ব্যস্ত থাকত যা কোন সত্ত্বাকে তার সীমানা দিয়ে ঘেরা সুনির্দিষ্ট জৈব কাঠামোর অতিক্ষুদ্র অবয়বের মধ্যে অমৃত আর অনন্তকে উপলব্ধি করতে শেখায়। সেই অনন্তের সন্ধান যে পায় সে নিজেও জীবন যে সত্যিই অনন্ত তা বুঝতে পারে। সে এই দর্শন সমগ্র প্রাণমন দিয়ে বিশ্বাস করে যেহেতু সে বেদ-উপনিষদ-গীতা এবং অন্যসব সমগোত্রীয় রচনাসমূহ নিবিড় মনোযোগে অন্তরস্থ করে জানতে পেরেছে বৈদিক মুনিঋষিদের ব্যবহার, কার্যকলাপ ও অভিপ্রায়। তাই সে জানে, তার মা-ও হারিয়ে যেতে পারে না। সে তাই রাত্রির অন্ধকারে আকাশ-অলংকৃত তারকাদলের ভিড়ে খোঁজে সেই নির্দিষ্ট তারাটিকে যে তার দিকে তাকিয়ে আছে স্নেহপূর্ণ দৃষ্টিতে। কোন্ তারকাটিতে তেমন স্নেহ ঝরে পড়ছে সে তাকে খোঁজে ক্লান্তিহীন বিরামহীন, কারণ সে জানে ওই তারাটিই তার মা। তার নাগরিক মানুষজন ফেলে এমন এক পাহাড়ি নির্জনতায় চলে আসার এটাও একটা বড় কারণ, যেখানে এলে রাতে আকাশের সমস্ত তারাদের পাওয়া যায়। সভ্য সমাজের কৃত্রিম আলোকমালায় তেমনটি সম্ভব নয়, কারণ সেখানে বহু তারকা মুছে থাকে নাগরিক আলোর অত্যাচারে। নগরকেন্দ্রিক স্থানে তাই সব তারাদের দেখা যায় না। সে তাই এখানে এসেছে সব তারাদের একসঙ্গে আকাশে খুঁজে পাওয়ার বাসনায় যেখানে সে জানে তার মা উপস্থিত, যত দুর্বলই হোক না কেন তার প্রকাশ। সে তাই চেয়েছে এমন একটি নিষ্কলুষ আকাশ যেখানে সে তার মায়ের সন্ধান পাবে।
সে তার বাবাকে হারিয়েছিল অনেক ছোটবেলায়। তার কাছে বাবার স্মৃতি তাই অস্পষ্ট অনেকটাই। পূর্ববঙ্গে ছিল তার পূর্বপুরুষের বাসস্থান। গ্রামে ছিল পিতৃপুরুষের বংশানুক্রমিক সম্পত্তি আর প্রাসাদ। বাবা পরে জেলার মূল শহরের কেন্দ্রস্থলে বিশাল এক বাড়ি তৈরি করেছিল মায়ের কথা ভেবে, কারণ মা শহরের মেয়ে, দাসদাসী পরিবেষ্টিত হয়েও গ্রামের জীবনে অনভ্যস্ত। শহরে এসে সুবিশাল জমি কিনে বাবা বাড়ি বানাবার পর মা তাকে সন্তানস্নেহে সাজিয়েছিল বছরের পর বছর ধরে, বাগান গড়ে আর গাছপালা লাগিয়ে। তারপর দেশভাগ, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনোভাব, বাংলা দ্বিখণ্ডিত। কার কী স্বার্থপূৰ্ণ ঘটল কে জানে, তবে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছাড়া অনিবার্য হয়ে পড়ল। স্বদেশ হয়ে গেল বিদেশ, তারা হয়ে গেল উদ্বাস্তু। শহরের বাড়ি ফেলে দিয়ে প্রায় পালিয়ে আসতে হয়েছিল তাদের, তবুও রক্ষে এটাই যে দেশের বাড়ি আগেই ত্রিপুরাতে এক ভিন্নধর্মী পরিবারের জমিজমার সঙ্গে বিনিময় করা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ত্রিপুরাতে পাহাড়-জঙ্গল-জলাভূমিতে ঘেরা অনুন্নত প্রায় আদিম বাসস্থানে এসে বাবা মানসিকভাবে চূড়ান্ত বিপর্যস্ত হয়ে প্রায় বিছানা নিল আর শেষপর্যন্ত এটাই হল তার বছরখানেকের মধ্যেই মৃত্যুর কারণ। তারপর সে কয়েক দশক ধরে সঙ্গে থেকে দেখেছিল মায়ের সংগ্রাম, শূন্য থেকে তাদের জীবনে মাথা তুলে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার অক্লান্ত একনিষ্ঠতা। তা কি সে ভুলতে পারে ?
সেই ছোটবেলায় মায়ের কোলে চেপে চোরাপথে পাহাড়-জঙ্গল-জলাভূমি ধরে উদ্বাস্তু হিসেবে ভয়তাড়িত জন্তুর মত পালিয়ে ভারতসীমান্তে প্রাণ হাতে করে ঢোকার দৃশ্যাবলী এখনও তার চোখে ভাসে।কয়েক কিলোমিটার নির্জন জলাভূমির হাঁটুজল পার হওয়ার সময় মা একহাতে তাকে কোলে আঁকড়ে অন্যহাতে কাপড় তুলে রেখেছিল হাঁটুর ওপর। গোটা পথ হেঁটে অতিক্রম করতে লেগেছিল হয়তো দু’-তিনদিন। রাতগুলি কেটেছিল গোপন আশ্রয়ে, যারা ছিল পাসিংদার তাদের কোন চেনা ব্যক্তির বাসস্থানে এবং সেই সেই বাড়ির মালিকরাও ছিল গোটা প্রক্রিয়াটির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। অর্থের বিনিময়ে সীমান্ত পার করে দেওয়ার দায়িত্বে যারা ছিল তাদেরই বলা হত পাসিংদার। তারা ভারতে ঢুকেছিল ত্রিপুরা রাজ্যের সোনামুড়া মহকুমা দিয়ে।
এখানে এই জনবর্জিত প্রদেশে বসে সে শোনে নিরাকার দেবতাদের নির্বাক স্বর আর স্পিতিভ্যালির আত্মার সংলাপ। মৌখিক বাক্য বিনিময়েরও সুযোগ হয় তার—- পর্যটক, বৌদ্ধ ভিক্ষু, গ্রামবাসী ও মেষপালকদের সঙ্গে যখন দেখা হয়। ইচ্ছে হলেই সে চলে যায় তাবো, সেখানে আছে দালাই লামার প্রিয়স্থান বৌদ্ধধর্মের অন্যতম মুখ্য গবেষণাকেন্দ্র তাবো মনাস্ট্রি। ওখানকার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সঙ্গে রয়েছে তার প্রীতির সম্পর্ক। কখনো সে চলে যায় সুমদো, ধনকর, গিউ বা আরও দূরে কাজা পেরিয়ে কি মনাস্ট্রি। পিন ভ্যালি জাতীয় অরণ্যেও সে গেছে একাধিক বার। কাছে-দূরের এমন অনেক ছোটবড় গ্রাম ও বৌদ্ধ গুম্ফাতে তার যাতায়াত লেগেই থাকে। গ্রামবাসী ও সন্ন্যাসীদের সঙ্গে মৌখিক বাক্যালাপ তো চলে বছরের প্রায় আট-ন’মাস, কারণ প্রবল শৈত্যপ্রবাহের জন্য উন্মুক্ত অঞ্চলে বসবাস তখন কোনমতেই সম্ভব নয়। তবে যখন সে একেবারেই একা থাকে তখন সে নির্বাক অন্তরের ভাষায় কথা বলে নিরাকার দেবতা ও উপত্যকার প্রাকৃতিক বস্তুসমূহের সঙ্গে। তখনই সে বেশি ভাবে তার ফেলে আসা জীবনের কথা।
শহর জীবনে থাকার সময় অনেকদিন আগে অখ্যাত এক বাঙালি লেখকের একটি গল্প পড়েছিল দৈবক্রমে, গল্পটির নাম ‘মায়ের খোঁজে ‘। সেই লেখক নিজেও ছিল মা-অন্ত প্রাণ। আত্ম্ভাষণ লিখেছিল সে মায়ের মৃত্যুর পর একটানা কয়েক দশক। তার দৈনন্দিন জীবনে রুটিন ছিল ঘুম থেকে উঠে সে অন্তত চার লাইন লিখবেই জীবনীর একাংশ যাতে ‘মা ‘ শব্দটির উল্লেখ থাকবে। হাজার হাজার পাতা সে লিখে রেখেছিল। সেইসব লেখার কিছু অংশ হাতে পেয়ে সে জেনেছিল যে শিশুবয়সে পিতৃহীন তাকে ও তার ভাইবোনদের মানুষ করতে গিয়ে তার মা জীবনপাত করে দিয়েছিল। সেও ভাবত মাকে সুখী করতে সে একদিন বিশ্ববিখ্যাত হবে, মায়ের জন্য অমরাবতী রচনা করবে। কিছুই সে করতে পারেনি। তবে মায়ের জন্যই উচ্চশিক্ষা, চাকরি, শহরের বুকে বাড়ি, এমনকি বিয়ে ও সন্তানলাভ ঘটেছিল। তবুও সে খ্যাতি পেল না লেখা বা অন্যসব কলাচর্চার জন্য। তার মায়ের মৃত্যু হল। তার জীবন থেকে তারপর পনেরটি বছর হারিয়ে গিয়েছিল, শৈবাঙ্কন যেমন বাড়ি ছেড়ে পরিব্রাজক হয়ে স্পিতিভ্যালিতে তার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। সেই লেখক তারপর বিতৃষ্নায় লেখা ও অন্যসব রচনা বর্জন করেছিল, তার জীবনে আর খ্যাতির মোহ ছিল না। তারপর সে লিখতে ভুলে গিয়েছিল। প্রায় কুড়ি বছর পর আবার লিখতে গিয়ে সে দেখল আর লিখতে পারছে না। আপাদমস্তক অবসাদাচ্ছন্ন হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে যেতে আবার একদিন লেখনী সচল হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারল এবং বাকি জীবনে বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখে ফেলেছিল। ইতিমধ্যে জীবনের হারিয়ে যাওয়া প্রায় দু’দশকের একসময় উদাসীন থাকার সুবাদে তার লেখা প্রায় দু’-তিনশ’ গল্প, কয়েকটি উপন্যাস ও কল্পবিজ্ঞান কাহিনী বাড়িতে রাখা কাজের লোক কিলোদরে কাগজওয়ালাকে বিক্রি করে দিয়েছিল। তাই ষাট বছর বয়সের পর আবার লেখার ইচ্ছে ও ক্ষমতা ফিরে যখন পেল তখন তাকে আবার সব নতুনভাবে শুরু করতে হল। প্রথমেই সে লিখল, ‘ইট’স মাই আইল্যান্ড ‘ বলে একটি উপন্যাস ইংরেজি ভাষায়। তারপর আরও এমন সব।
‘মায়ের খোঁজে ‘ গল্পটি কল্পবিজ্ঞানের আর সেটি ওই লেখক লিখেছিল তার মায়ের জীবদ্দশাতেই, নিজের মায়ের জন্য ভালোবাসা থেকে। যদিও সেই গল্পটি পরবর্তী সময়ে কাজের লোক গোপনে কাগজওয়ালাকে বিক্রি করে দিয়েছিল টাকার জন্য, শৈবাঙ্কন তার কথা জেনেছে লেখকের আত্মজীবনী থেকে। গল্পের মূল চরিত্র এক কিশোর বিজ্ঞানী, নাম ক্রোমি। সে থাকে ভীনগ্রহে, পৃথিবী থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে। তার গ্রহে কোন রাজনৈতিক প্রশাসক নেই, জানে না কেউ রাজনীতি কাকে বলে। তাদের গ্রহে সবাই জ্ঞানী ও বিজ্ঞানী এবং তাঁদেরই আয়ত্তে গ্রহ পরিচালনার ভার। গ্রহের বাসিন্দারা সবাই চেহারায় মানুষেরই মত দেখতে এবং কেন তার অকাট্য কারণ দেখিয়েছিল লেখক বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে বিচার করে। গ্রহের উন্নয়ন ঘটেছিল বিকল্প ধারায় যাতে পৃথিবীরও উন্নয়ন ঘটতে পারত। তারা সবাই বস্তুনির্ভর পথে উন্নয়ন ঘটায় নি আর তাই যুদ্ধবিগ্রহ, হিংসে, খুনোখুনি কাকে বলে জানতই না। তাই কোন যুদ্ধাস্ত্র বানায়নি কোনদিন। তবুও তারা সবাই অসম্ভব ক্ষমতাশালী ও প্রত্যেকেই বিকল্প শক্তির অধিকারী, যা কোনোমতেই শারীরিক নয়। তারাও মহাকাশে সন্ধান চালাত অন্য কোন প্রাণিসভ্যতার। সেই সন্ধানে সামিল ছিল ক্রোমিও।তখনও পর্যন্ত তেমন কোন সন্ধান না পেয়ে তারা সবাই হতাশ ছিল। বিকল্প উপায়ে সভ্যতার উন্নয়ন ঘটাবার প্রক্রিয়ায় বিকল্প শক্তির অধিকারী হওয়ার সুবাদে তারা প্রত্যেকেই ছিল অনন্ত জীবনের অধিকারী, তবু মৃত্যু তাদের জন্যও অনিবার্য ছিল। এই কারণেই ক্রোমি যখন ভিনগ্রহী জীবন সন্ধানে ব্যস্ত তখন তার মা একদিন হঠাৎ মারা গেল। ক্রোমি মাকে অসম্ভব ভালোবাসত, আর তাই সে এখন সবকিছু ছেড়েছুড়ে মাকে খুঁজে পাওয়ার বাসনায় মৃত্যুর পর সবাই কোথায় যায় তারই অনুসন্ধানে নিজেকে উৎসর্গ করল। তার গ্রহের জ্ঞানীগুণীরা তাকে আর কী বলেন, তার কাজে কেউ বাধা দিলেন না যেহেতু সবাই জানতেন যে সে অকল্পনীয় প্রতিভার অধিকারী। মাকে খুঁজতে খুঁজতে সে একদিন অসাধ্যসাধন করে ফেলল, সে খুঁজে পেল তাদের গ্রহের অবিকল প্রতিরূপ এক অন্য পৃথিবী। আর অবিশ্বাস্য প্রতিভার সাহায্যে সে একটি আশ্চর্য উপায় আবিষ্কার করল যা দিয়ে ওই বিকল্প প্রথিবীতে যাওয়া যায়। আর সেখানে গিয়ে সে দেখল যে তার মা মৃত্যুর পর অন্য পরিচয়ে হলেও সেখানেই উপস্থিত রয়েছে। ক্রোমি যে বিকল্প পৃথিবীটাকে খুঁজে পেয়েছিল সেটা আসলে আমাদেরই পৃথিবী অন্যরূপে।
বৈকালিক অবসন্নতায় শিলাখণ্ডে উপবিষ্ট শৈবাঙ্কন স্পিতিভ্যালির পাহাড় চূড়াগুলির দিকে উদাসীন চোখ ফেলে ভাবছিল, সেও যদি এই পৃথিবীর বিকল্প তেমন এক পৃথিবীকে খুঁজে পেত যেখানে মৃত্যুর পর তার মা এখন বসবাস করছে ! নেই কি সেই পৃথিবী ?
অধ্যায়: সাত
মেলার মানুষজন বড়োই বিচিত্রদর্শন, বাহ্যিকভাবে তো বটেই অন্তরেও। কোটিকল্প তার হাত ধরে সব দেখিয়ে দিচ্ছিল।
তার তখন বোঝার মত বয়সই হয়নি। কে মানুষ, কে দানব সেটা হয়তো চিনতে পারত যদি তারা স্বমূর্তিতে থাকত। তবে মানুষের মধ্যেওতো চরিত্রে কেউ মানুষ বা দানব হতে পারে ? তাদের আলাদা করে বোঝার বিদ্যে তখনও তার আয়ত্ত্বাধীন হয়নি। মানুষের আবার নানান ইচ্ছে, স্বভাবের নানান প্রকার-প্রকৃতি। সেসব সে ভাবতেই জানত না। সে কী চায় বা কে কী সেসবও তার মাথাব্যথার কারণ ছিল না। সে যা দেখত তা সোজাসুজিই দেখত। দেখার জিনিস তো অনেককিছুই, কোন্ টা ছেড়ে কোন্ টা দেখবে তা বুঝতে হিমশিম খেয়ে যেত প্রথম প্রথম। কী দেখা উচিত বা কী দেখা অনুচিত সেটাও একটা ব্যাপার। তো সেসব নিয়ে তাকে ততটা ব্যতিব্যস্ত হতে হচ্ছিল না। ভাগ্যিস কোটিকল্প তার হাত ধরেছিল।
মেলাতে কেউ গায়ক, কেউ লেখক, কেউ নেতা, কেউ দার্শনিক, কেউ বিজ্ঞানী, কেউ গবেষক কেউ বা অন্যকিছু।কেউ খেলে, কেউ চাকরি করে, কেউ দোকানদার, কেউ রাজা, কেউ প্রজা, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ হাঙ্গামাকারী, কেউ চোর, কেউ ডাকাত, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল, কেউ বিচারক, কেউ প্রশাসক, কেউ সৈন্য, কেউ পুলিশ, কেউ রাজনীতিবিদ ইত্যাদি কত হাজার হাজার পেশায় ব্যস্ত সব মানুষ। এই ভিড়ের মধ্যে কাকে ছেড়ে কাকে দেখা দরকার ? কী পেশার কী মানুষকে ? এসব কি সে একা ঠিক করতে পারত ? পাগল না মাথাখারাপ ! সেই ব্যাপারটা ঠিক করে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল কোটিকল্প।
একদিন সে একজনকে দেখিয়ে তাকে বলল,
‘ওই লোকটাকে দ্যাখ্।’
সে তাকাল। দেখতে পেল একটা ভিড়। মেলার বহুমুখী জনতা একত্র হয়ে যাচ্ছে সেখানে এসে এবং এভাবেই একটা ভিড় তৈরি করেছে, আর সেই জনসমাগম বেড়েই চলেছে। ভিড়ের মধ্যমণি একজন মানুষ এবং তার জন্যই লোকের এমন উন্মাদনা। বর্ণাঢ্য তার উপস্থিতি, দেখেই স্পষ্ট যে জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। সে একজন গায়ক, মেলা পরিদর্শনে তার আগমন। অথবা এমনও হতে পারে যে মেলাতে আসার পর এখানে থাকতে থাকতেই গায়ক হিসেবে তার পরিচিতি। এই যে মেলা, এতো আর এক-দু’দিনের নয়। কবে থেকে চলছে বা কবে সাঙ্গ হবে তা কেউই জানে না। মানুষরা কেবল জানে, মেলাটা যখন চলছে আর চলছে হাজির তো হতেই হবে চাও বা না চাও। যাই হোক, সেই গায়কও যেভাবেই হোক মেলাতে আছে আর তাকে ঘিরেই লোকজনের এমন আয়োজন। কোটিকল্প এই গায়ককেই দেখতে বলল।
দেখল সে, দেখতেই লাগল। দেখে তার বিশেষ কিছুই মনে হল না। কোন একজন বিশ্ববিখ্যাত গায়ক এবং অসম্ভব তার জনপ্রিয়তা, এই যা ! সাধারণ লোকরা তো এমন একজনকে ঘিরে ভিড় বানাবেই, এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে ? তার টাকাপয়সা ? হাজার হাজার কোটি টাকার সে মালিক। তার গাড়ির সংখ্যা গোণার চেষ্টা না করে সেসব দিয়ে বরং অনায়াসে একটা শোরুম খোলা যেতে পারে। বাড়ির সংখ্যা অত না হলেও একদিনে সবগুলি দেখা একেবারেই সম্ভব নয়, কারণ সেক্ষেত্রে কাউকে পৃথিবীর নানা শহরে ঘুরে বেড়াতে হবে। এমনিতে সে বসবাস করে তার এক নিজস্ব দ্বীপে, সেখানে আছে তার রাজপ্রাসাদ আর অগণিত ভক্তজনের আনাগোনা। বহু ভক্ত ওই দ্বীপে তার সম্মতিক্রমে পাকাপাকি ভাবে থাকারও সুযোগ পেয়েছে। তারা তার প্রজা আর সে নিজে ওই দ্বীপের সম্রাট। যাতায়াতের জন্য রয়েছে নিজস্ব জাহাজ, প্লেন বা হেলিকপ্টার। তার ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা দেখে বোধহয় বহু দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাও ঈর্ষান্বিত হবে।
তা এসব আছে তার ভালোকথা, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে ? সে যদি অন্য গ্রহের অন্য কোন প্রাণি হত তাহলেও নাহয় কথা ছিল। পৃথিবীর মানুষ হলেও তাকে দেখে অবাক হওয়া যেত যদি তার ব্রহ্মার মত চারটি মুখ বা শিবের মত পাঁচটি মুখ থাকত। মাথাটাথা না থাকলেও অবাক হওয়ার কারণ ছিল তাকে দেখে যদি সে এযাবৎ অনাবিষ্কৃত কোন প্রজাতির কোন অভিনব আচার-আচরণ-দর্শনের প্রাণি হত। এই লোকটা সেসব কিছুই নয়। সে কেবল গান গায়, সে ট্রেনে বা রাস্তায় ভিখিরিরাও গাইতে পারে। তাতে অবাক হওয়ার কী আছে ? জনপ্রিয়তা ? সেটাও কি অদেখা কোন বস্তু ? পৃথিবীতে বহু লোক জনপ্রিয় হয়েছিল, হচ্ছে, হবে। ধর্মপ্রচারক, জননেতা, খেলোয়াড় ইত্যাদি বহু ব্যক্তি জনপ্রিয় হয় এবং তাদের কোটি কোটি ভক্ত থাকে। জগতে ভক্ত হওয়ার লোকের কোন অভাব নেই, অভাব নেই কীট-পতঙ্গেরও। তাতে বিস্মিত হতে হবে কেন ? লোকটা এত এত ধনসম্পত্তি ও টাকার মালিক ? সেটাও তার মনে হল না আশ্চর্য হওয়ার কোন বিষয় বলে। পৃথিবীতে কেউ আফিং বিক্রি করেও কোটি কোটি টাকার মালিক হয়। অবৈধ পাচারকারীরাও বহু অর্থ ও সম্পদের অধীশ্বর। তেল বিক্রি করে ধনকুবের হয়ে বসে আছে আরব শেখরা। এই লোকটা ধনকুবের হয়েছে তার গলার গান বিক্রি করে। এতে কি সত্যি কোন আশ্চর্য হওয়ার মত উপাদান আছে ?
লোকটাকে অনেক সময় ধরে দেখে এই কথাগুলিই সে বলল। সবশেষে সে প্রশ্ন তুলল,
‘একে দেখে অবাক হবে কেন ?’
কোটিকল্প তার দিকে তাকিয়ে রইল সম্পূর্ণ চোখ মেলে। তারপর বলল,
‘তোকে কি আমি অবাক হতে বলেছি ?’
‘তাহলে দেখতে বললে কেন ?’
তার পাল্টা প্রশ্নের উত্তরে সে জানাল,
‘তোকে দেখতে বলেছি জানার জন্য বোঝার জন্য। তুই মেলাতে এলি কেন ? এখানে যারা আছে তাদের স্বভাব-চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত হবি বলে। এই যে এত জন কোলাহল, এত মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে মেলাতে তারা কী চায় বা কী তাদের উদ্দেশ্য সেটা তো বোঝা দরকার। এমনি এমনি কেউ তো বেকার ঘুরে বেড়াবার জন্য মেলায় আসেনি। প্রত্যেকেই এখানে আসে কিছু না কিছু একটা লক্ষ্য নিয়ে। কিছু না কিছু পেতে চায় আর সেই কারণে সারাজীবন ঘুরে বেড়ায়। মেলাতে এত লোকের ঘোরাঘুরি অনর্থক নয়। সবাই চায় কিছু না কিছু নিজের জন্য কিনতে, কারণ এখানে কেনার মত সমস্ত জিনিসই আছে। তাই এখানে আসা আর যতদিন সম্ভব থেকে যাওয়া। তবে যে যাই কিনতে ইচ্ছে করুক না কেন, তুই দেখবি সবারই ইচ্ছে একটা জায়গায় এসে অভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এটা কেন হয় কিভাবে হয় সেসব জানতে হলে মেলায় উপস্থিত লোকগুলিকে তোর একটানা দেখে যেতে হবে। মুশকিল হল, এই দেখাটা একদিন-দু’দিনের হলে চলবে না। বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মেলাতে যারা যাতায়াত করে বা থাকে তাদের দেখে যেতে হয়। তোর একটা মাত্র জীবনে তুই এত লম্বা সময় পাবি কোথায় ?’
সে নিরুত্তর তাকিয়ে রইল। তার চোখেও অনুচ্চারিত একই প্রশ্ন। একটু থেমে কোটিকল্প তাকে জানাল,
‘তার জন্য আছে একটা বিশেষ উপায়। সেইটা তোকে জানতে হবে। আছে একটা অন্য জগৎ আর অন্য পদ্ধতি। সেই পদ্ধতি মেনে সেই অন্য জগতে যাওয়ার দরজাটা চেনা দরকার। দরজা চিনলেও সব যে হাতের মুঠোয় চলে আসবে তাও নয়। সেই দরজাটা খোলার উপায় জানা চাই। ইচ্ছে হলেই কেউ এসব জেনে নিয়ে সেই জগতে যেতে পারে না। সেটা এক জাদুজগৎ, জাদুবিদ্যাতেই তাকে পাওয়া যায়। আর সেই জাদু জানি জগতে একমাত্র আমি। আমার হাত ধরে থাকতে পারবে যে তাকে আমি চাইলেই সে জগতে নিয়ে যেতে পারি, সেখানে সে তখন যতদিন খুশি থাকার সুযোগ পাবে। সে একটা অন্য পৃথিবী, এই পৃথিবীর নিয়মকানুন সেখানে অচল। আয়, তাহলে তোকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছি। আমি হাত ধরে আছি যখন তোর কোন চিন্তা নেই।’
এবার সে সত্যিই বিস্মিত হতে লাগল। যে হাত ধরে আছে তার এতটাই ক্ষমতা ? সে তো তাকে সাধারণ কেউ একজন ভেবেছিল যে কোন একদিন তার মতই এই মেলাতে হারিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন বুঝল, আসলে তা নয় একদম। সে একজন অসম্ভব ক্ষমতাশালী কেউ। কে ? সে এই প্রথম সম্পূর্ণ চোখ মেলে কোটিকল্পকে দেখতে লাগল। সে কে তা বুঝতে চেষ্টা করল।
বুঝতে পারল না অবশ্য কিছুই। এমন এক সাদামাটা চেহারার একজনের এত ক্ষমতা হয় কি ? ধাপ্পাবাজ কিনা এমন সন্দেহ মাথায় এলো। দেখতে লাগল সে। দেখতে দেখতে তার মনে হল, বোধহয় সে সত্যিই অন্যরকম। আগে সে ভালো করে দেখেনি বলে টের পায়নি। এবার চোখ খুলে মনোযোগ দিয়ে দেখতে গিয়ে অসাধারণ কিছু ব্যাপার-স্যাপার নজরে পড়ল, তার ওই আপাত সাধারণ চেহারার আড়ালে।
সে দেখতে পেল যে কোটিকল্পের চোখগুলি আবর্তনশীল, এদিক থেকে ওদিক বা ওদিক থেকে এদিক। এভাবে কোন মানুষের চোখ কি ঘূর্ণায়মান হয় ? তাকে আরও অবাক হতে হল যখন সে নজর আরেকটু গভীর করে বুঝতে পারল কেবল চোখই নয়, কোটিকল্পের সমস্ত শরীরটাই আবর্তনশীল। তারপর সে বুঝল, চোখ বা দেহই নয়, আসলে তার গোটা অস্তিত্বটাই অস্থির ও চক্রাকারে আবর্তন ঘটিয়েই চলেছে। অথবা অন্য কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, ক্রমাগত আবর্তনশীল উপাদানের অস্থির সমন্বয় তার সমগ্র উপস্থিতি, কোথাও কোন স্থিরতাই নেই। সে দেখল, তার ওই অদ্ভুত অপার্থিব দেহকাঠামোর আবর্তনে একের পর এক অতীত আর বর্তমান আর ভবিষ্যৎ অবিরাম ঘুরেই চলেছে হাত ধরাধরি করে এবং সেখানে হাজির থাকছে ও মিলিয়ে যাচ্ছে অবিশ্বাস্য কতসব জাগতিক পরিকাঠামো। এবার এতক্ষণে সে সত্যিই অবাক হল। এত বিস্মিত সে আর কোনদিনও হয়নি। কিছুটা হতভম্ব গলায় প্রশ্ন করল,
‘তুমি কি জাদুকর ?’
কোটিকল্পের মুখে কি মৃদু হাসি দেখা গেল ? বোঝার উপায় নেই, কারণ সেই হাসিও আবর্তনশীল। তার উত্তর শোনা গেল,
‘বলতে পারিস। জাদুকর না হলে জাদুবিদ্যার জগতে কে প্রবেশাধিকার পায় ? আবার তোকেও নিয়ে যেতে পারছি কিসের ক্ষমতায় ? এবার তুই জিজ্ঞেস করতে পারিস, ওই জাদুজগতে গিয়ে কী লাভ। ওখানে গেলে তোর দৃষ্টিক্ষমতা বেড়ে যাবে। তুই বলতে গেলে, দিব্যদৃষ্টি লাভ করবি আর তাই দিয়ে কোন একজন মানুষের সারাজীবন কেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাকে দেখে যেতে পারবি। কোন একটি মানুষ জন্মের সময় কী ছিল বা কেমন তার বড় হওয়ার প্রক্রিয়া বা কিভাবে ভবিষ্যতের গর্ভে সে বিলীন হয়ে যাবে সবই তুই দেখতে পাবি এক পলকে। শুধু কি তাই ? দেখতে পাবি ওই মানুষটির পিতা ও প্রপিতামহদের বিবরণ এবং অনাগত উত্তরপুরুষদের বৃত্তান্ত। একশ’ বছরের গোটাটাকে তুই দেখতে পারবি হয়তো এক মিনিট বা চাইলে এক সেকেন্ডের পরিসরে। টাইম ট্র্যাভেল বা সময় ভ্রমণ-টোমন নয়, এটা একেবারে অন্য ব্যাপার। বলতে পারিস, বিন্দুতে সিন্ধু পরিদর্শন। কিভাবে ঘটবে ওটা বোঝার দরকার নেই, ঘটলে কী হবে সেটুকুই কেবল দেখবি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকেও ইচ্ছে হলে পেয়ে যাবি নাগালে।’
শুনতে শুনতে তার প্রায় খাবি খাওয়ার মত অবস্থা। নিজেকে কেমন অসহায় বলে মনে হচ্ছিল। বুঝি সে অকুল সমুদ্রে হাবুডুবু খেয়ে যাচ্ছে আর তাকে কোন এক নিয়ন্ত্রণকারী নিজের খেয়ালখুশি মত চালাচ্ছে। তবুও সে যে একেবারেই সব বিস্মরণ হয়ে গেল এমন নয়। তাই সে পাল্টা প্রশ্ন করতে পারল,
‘কিভাবে ঘটল যদি না জানি ঘটলে কী হবে বুঝব কিভাবে ?’
কোটিকল্প উত্তর দিতে বিশেষ দেরি করল না। বুঝিয়ে বলল,
‘এই যে পৃথিবীটাতে তুই আছিস এটা এল কোত্থেকে তুই দেখেছিস না জানিস ? পৃথিবীর কিভাবে জন্ম হল সেটা না জেনেও তোর কি পৃথিবীতে থাকতে বা একে বুঝতে কোনও সমস্যা হচ্ছে ? অবশ্যই হচ্ছে না। হলে তুই নিশ্চিন্তে এখানে আছিস কী করে ? ব্যাপারটা অনেকটা ওইরকম। কোন বস্তুর জন্মকাহিনী না জানলেও বা তার জন্মটা না দেখলেও তাকে বুঝতে অসুবিধে হয় না। যদি হত তাহলে নিজের বাবা-মাকেও তুই চিনতে পারতিস না। এখানেও ঘটনাটা তেমনই। প্রক্রিয়া জেনে কাজ নেই, কী ঘটল সেটুকু জানলেই অনেক।’
মনে হচ্ছিল, বোধহয় সব দ্বিধাদ্বন্দ কেটে গেছে। প্রথম প্রথম সব যতটা দুর্বোধ্য লাগছিল এখন যেন বেশ সরল-সহজ। তার এখন বিশ্বাস হতে শুরু করেছে, কোটিকল্প সত্যিই এক জাদুকর। যদি তাই না হবে তো অত জটিল ব্যাপারটা কিভাবে এতটাই বোধগম্য হয়ে যাবে ? সব তো ঘটাল সে কথা বলে বলে বুঝিয়ে। যে অত সুন্দর বোঝাতে পারে সে জাদুকর নয়তো কী ?
সে দেখল মেলায় সার্কাস আছে। কেন আছে বা থাকলে কী হয় বা হবে সেটুকু জানলেই চলবে, বড়জোর জানা দরকার কী উদ্দেশ্যে আছে। কোত্থেকে এলো কিভাবে এই সার্কাস সেটা জানার দরকার নেই, অন্তত এখন। নাগরদোলা ঘুরছে—- সেখানে কারা ঘুরছে কেন ঘুরছে সেটুকু জানাই উদ্দেশ্য, কিভাবে কোত্থেকে এলো নাগরদোলা আপাতত তা নিয়ে মাথা না ঘামালেও ক্ষতি নেই। মেলায় আছে ম্যাজিশিয়ান, সে ম্যাজিক দেখাচ্ছে। কী কী ম্যাজিক কী কারণে দেখাচ্ছে প্রশ্ন এখানেই। কারা সেই ম্যাজিক দেখছে, দেখে কী ভাবছে বা তাদের কী পরিণাম ঘটছে তাও দেখা যেতে পারে। মেলা তো একটা মিলনস্থল, সেখানে সব জিনিস আর ঘটনাবলীর একত্রীকরণ ঘটে। গোটা জগতের এটা এক অবিকৃত অবিকল সংস্করণ। সেখানে কেন আসে সবাই, কেনই বা থাকে, কী উদ্দেশ্যে জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড একত্রিত করে প্রদর্শনী সাজায় সেসব দেখা আর জানাই মূল আকর্ষণ। যারা মেলা দেখতে আসে, ঘুরে বেড়ায় তাদের চিত্ত বিনোদন ঘটে এভাবেই। ভুলে গেলে চলবে না যে মেলা এক বিনোদন ক্ষেত্র। যে যাই করুক এখানে সেসব করে তার আনন্দবিধান হলেই। নিরানন্দে কে থাকে মেলায় ? যে উদ্দেশ্যে যে যাই করে আনন্দ আর উৎসাহ থাকে বলেই করে। ওই যে চিত্রকর প্রদর্শনীর আয়োজন করে তার ছবি সবাইকে দেখাবার ব্যবস্থা করেছে এখানেই তার আনন্দ। কেন কী উদ্দেশ্যে তা যদিও জানা দরকার তবুও সেই প্রাথমিক বিষয়টা তো দেখতে হবে। বিজ্ঞানী এখানে উপস্থিত তার নানা উদ্ভাবনের মডেল নিয়ে। উৎসাহ আর প্রেরণা না থাকলে আসত না। উদ্দেশ্য তার অনেকরকম, সেখান থেকে বাছাই করে জানা যাবে মূল কী উদ্দেশ্য। মেলাতে এইভাবে কবি আছে, গায়ক আছে, লেখক আছে, ব্যবসায়ী আছে, ডাক্তার আছে, নেতা আছে, উকিল আছে, শিক্ষক আছে, অভিনেতা আছে, রুগী আছে, চোর আছে, শাসক আছে, ডাকাত আছে, শাসিত আছে—- কে নেই ? সবাই থাকতে বাধ্য মেলাতে। না থাকলে মেলা হবে না। সবাই আছে জীবনের নানা প্রয়োজনে। জীবিকা উপার্জন যদিওবা বড় লক্ষ্য, তা আনন্দ বা উৎসাহ বাদ দিয়ে হয় না। তবে আরও একটা বড় লক্ষ্য থাকে সব কিছুর চালিকাশক্তি হয়ে, বলতে গেলে সেটাই আসল লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যটা দেখাবার জন্যই কোটিকল্প তার হাত ধরল, জাদুজগতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিল।
জাদুজগত কোথায় আছে সাধারণ মানুষ না জানলেও তা অবশ্যই আছে। সাধারণ চোখে সাধারণ জগতে থেকে তা বোঝার উপায় নেই। আমাদের এই জগৎ চারটি মাত্রা নির্ভর, তার গোটা কাঠামো গড়ে উঠেছে এই চারটি মূল স্তম্ভকে ভিত্তি করে। মানুষের উপলব্ধির জগৎ পঞ্চমাত্রিক, তার গোটা জগৎ সে দেখে আর বোঝে এই পাঁচটি মূল উপাদানের সম্মিলিত ক্রিয়াকলাপে। জাদুজগতের সীমানা এই চারটি মাত্রা ও পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের বেড়াজালে সীমাবদ্ধ নয়। ওই জগতে অতিরিক্ত অন্য মাত্রার রাজত্ব, চেতনালোক ও অনুভব প্রাণিত অন্য ইন্দ্রিয়ের সরব সক্রিয় উপস্থিতিতে। সেখানেই সময়সিন্ধুকে দেখা যাবে বিন্দুতে। শতাব্দীর সম্পূর্ণ ব্যাপ্তিকালের পুরোটাই দেখা যাবে হয়তো এক ঘন্টায় বা এক মিনিটে বা এক সেকেন্ডে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এই স্বল্প পরিসরের দর্শন ওই একশ’ বছরের কোন বিষয়, কোন ঘটনা বা তার প্রক্রিয়া, কোন বিবরণ বাদ রাখবে না। এ এক অত্যাশ্চর্য উপায় বা কলাকৌশল বা প্রযুক্তি যাকে বস্তুনির্ভর আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করা যায় না, কারণ একেই বলে দিব্যজ্ঞান। পাঁচ হাজার বছরের আধুনিক মানবসভ্যতাকে এভাবেই দেখা সম্ভব সুবিধেমত যেমন খুশি ক্ষুদ্র সময়ের পরিসরে। বলাই বাহুল্য যে পৃথিবীতে প্রাণিজগতের সমগ্র ব্যাপ্তিকাল এবং পৃথিবী গ্রহের জন্ম ও বিবর্তন প্রক্রিয়ায় বর্তমান অবস্থাপ্রাপ্তিকেও দেখা সম্ভব এই উপায়ে। তবে তা নির্ভর করে কতটা দিব্যজ্ঞান কার করায়ত্ত আছে তার ওপর। তাকেই বোধহয় ব্রহ্মজ্ঞানীও বলা হত। যার দিব্যজ্ঞানের পরিধি ব্যাখ্যাতীত সে ইচ্ছে করলে সমগ্র বিশ্বজগতের সৃষ্টি ও বিবর্তন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতে পারে, এমনকি অন্যসব জগতের উপস্থিতি এবং বিবরণও তার আয়ত্তাধীন। কোটিকল্প তেমনই একজন, যদিও তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা কতটা হতে পারে তা জানা নেই। সে জাদুজগতে যেতে জানে, সেখানে যাওয়ার দরজা খোলার চাবিকাঠি আছে তার হাতে, যেখানে কালসিন্ধু বিন্দুতে উপস্থিত হতে পারে। অন্যকথায়, সময়কে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল সে জানে। কিন্তু সময়েরও তো প্রকারভেদ আছে ? কালকে বশীভূত করলে যে মহাকালও বশে থাকবে তা নাও হতে পারে। আবার এমনও জগৎ থাকতে পারে যেখানে কালের কোন ভূমিকাই নেই। দেশকালের ধারণাই অচল। কোন ঘটনাই ঘটে না। সমস্ত চলাচলও অনুপস্থিত। নিশ্চল প্রশান্তি অথবা স্তম্ভিত অপেক্ষা। সেখানে কি কোটিকল্প যেতে পারবে নাকি সেই জগৎ সে চেনে ? তবে এখন সে প্রশ্ন অবান্তর। সে অন্য একটা জাদুজগৎ চেনে এবং যেতে পারে এটাই প্রাসঙ্গিক। সে প্রশ্ন করল,
‘কী, যেতে চাস তো সেই জগতে ? সেখানে গেলে তবেই তুই দেখতে পাবি মেলাতে এইসব লোকজনের প্রকৃত চেহারা। এখানে তুই যাদের যে চেহারায় দেখছিস তারা আসলে অন্য এক চেহারার। প্রত্যেকেই পরিচিত একটা সাধারণ চেহারায়, কারণ তাদের সবারই রয়েছে এক অভিন্ন লক্ষ্য। যাকে দেখছিস গায়ক সে আসলে গায়ক নয়, যে সবার চোখে নায়ক সে আসলে নায়ক নয়, এবং এমনি করেই লেখক, দার্শনিক, চোর-ডাকাত থেকে শুরু করে জ্ঞানী-বিজ্ঞানী-সাধু-ভণ্ড-মূর্খ-নেতা-বিদ্বান-অভিনেতা ইত্যাদি আপাতদৃষ্টিতে যে পরিচয়ে যে আছে সে আসলে সেই পরিচয়ের কেউ না হয়ে অন্য কেউ বা অন্যকিছু। স্বরূপে থাকছে না কেউ, সবাই আছে ছদ্মরূপে। এখানে যাকে তুই গায়ক হিসেবে দেখছিস, দেখে মনে হচ্ছে বুঝি সঙ্গীতচর্চাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য, তার প্রাণ আর গান এক অভিন্ন বিষয়। এই সংগীতসর্বস্ব ব্যক্তি, যাকে দেখে অন্য কিছু মনে হয় না, তারও কিন্তু অন্য একটা চেহারা আছে যেটা তার সুপ্ত অথচ আসল চেহারা। আর সেই গুপ্ত বা সুপ্ত পরিচয়ের মধ্যেই দেখতে পাবি তার প্রকৃত লক্ষ্য। এটা এই পৃথিবীর চলতি চেতনালোকে বসে বুঝতেই পারবি না, দেখবি দূরের কথা। তার জন্য তোকে যেতে হবে সেই জাদুজগতে। আসলে কী জানিস, ওই জাদুজগৎটাই হল প্রকৃত জগৎ। আর এই যে জগৎটাতে তোর বসবাস, অহরহ চলাচল আর ওঠাবসা এটা হল এক মায়াপ্রকল্প, যেখানে সবই সাজানো, সবই ঢেকেঢুকে রাখা, সত্যি গোপন রাখার আপ্রাণ চেষ্টা, নিজের প্রকৃত চেহারা ও চরিত্র লুকিয়ে রাখার প্রাণান্তকর ঘোষণা ও কার্যকলাপ। এখানে কে তুমি তা আমিতো জানিই না, এমনকি তুমি নিজেও জানো না যেমন তোমার কাছে বা আমার কাছে স্পষ্ট বা পরিষ্কার নয় আমার পরিচয়। এ প্রকৃত অর্থেই এক অদ্ভুত ও আশ্চর্য মায়াপ্রকল্প যেখানে মানুষরা ঘুরে বেড়াচ্ছে একাধিক নানা অসত্য চেহারায় প্রকৃত পরিচয় গোপন রেখে ছদ্মবেশে। এই মায়াপ্রকল্পের অধীন এই মানব সভ্যতা, মানুষের বাসযোগ্য এই পৃথিবী। তারই প্রতিরূপ আর প্রতিফলন তোর চোখের সামনে। জানবি, মিথ্যে দিয়ে সাজানো এই প্রতিফলন সর্ব অর্থেই নকল ও মেকি। এখানে যা ঘটমান তা হয়তো পুরাঘটিত বা আদৌ ঘটছেই না, অলীক অথবা কাল্পনিক। তাই যা তোর চোখের সামনে দেখছিস কোনোটারই বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। যা প্রকৃত যা সত্যি তা যদি দেখতে চাস যেতে হবে ওই জাদুজগতে, যেখানে রয়েছে এই কাল্পনিক জগৎ বা মায়াপ্রকল্পের বাস্তব রূপ। যাবি কি ? আমি তোর হাত ধরেই আছি। সেই জগতে যাওয়ার চাবি আমার কাছেই। যেতে চাস নিশ্চয় ?’
তার তো এতক্ষণ মাথার ভিতরটা চক্কর দিয়ে যাচ্ছিল। কী দেখছে যেমন তা দেখছিল না, কী শুনছে তাও বুঝতে পারছিল না। বোঝার বয়স হয়নি তার তখনও সেটাও অবশ্য সত্যিকথা। তবুও তার আপ্রাণ ইচ্ছে ও চেষ্টা ছিল যা শুনছে তা বুঝে নেওয়ার, কারণ সে কোটিকল্প নামের এই সঙ্গীটিকে ততক্ষণে বিশ্বাস করে ফেলেছে। সে হতে পারে জাদুকর, ভেলকি দেখাবার ক্ষমতা হয়তো আছে তার, তবুও তার ওপর আস্থা রাখা চলে। এই সুবিশাল মেলার ভিড়ে সবাই চলছে নিজের নিজের পথে, কেউ কাউকে দেখার প্রয়োজন বোধ করছে না। সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। একমাত্র সে এসে ভরসা দিয়ে তার হাত ধরেছে। নাহলে বিপুল এই জনতার ভিড়ে তার কী হাল হত ? কেউ তো তার দিকে আর ফিরেও তাকায়নি। এই একজনই কেবল তাকে বন্ধুর মত বুকে টেনে নিয়েছে। তাকে নিশ্চয় ভরসা করা যায়। এজন্যই সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল আর মুখে বলল,
‘হ্যাঁ, আমাকে দেখাও সেই জাদুজগৎটা। আমি এই মেলার মানুষগুলির আসল চেহারাটা দেখতে চাই। জানতে চাই কী তাদের আসল ও অভিন্ন উদ্দেশ্য। কী লক্ষ্যে চলছে সবাই নিশির ডাকে।’
মৃদু হাসল কোটিকল্প, হাসি বা সেই হাসির আবর্তন। সেই অপার্থিব কণ্ঠস্বরে অন্তরের মধ্যে অনুরণন তুলল তার বক্তব্য, ‘তাহলে আয়, দেখি এই গায়কটিকেই। দেখা যাক কেন তার এতো গান, এতো সাজ, এতো আয়োজন। সে আসলে কী চায়। সেজন্য তার গোটা জীবনটাকে দেখতে হবে, কেবল বর্তমানটাকেই নয়। ভূতপূর্বজীবনের পাশাপাশি ভবিষ্যৎটাকেও, তার আমৃত্যু জীবনযাপন প্রক্রিয়া। তাহলেই তার প্রকৃত উদ্দেশ্যটা বোঝা যাবে, স্পষ্ট হবে কেন সে বেঁচে আছে। সেসব বুঝতে হলে তোকে আমার সঙ্গে যেতে হবে জাদুজগতে। আয়, এই মায়াপ্রকল্পাধীন পৃথিবী থেকে সেই জাদুজগতের প্রকৃত পৃথিবীটার দরজার সামনে। আয়, দরজাটা খুলি। ভিতরে যাই।’
কোটিকল্প তার হাত ধরে জাদুজগতের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। দরজাটা বন্ধ। সে চাবি নিয়ে তালা খুলল। পাল্লা ঠেলে ঢুকল তাকে নিয়ে সেই অপরূপ জাদুপুরীতে। তার দু’চোখে তখন থৈ-থৈ বিস্ময়।
অধ্যায়: আট
এই শীতল মরুভূমির পার্বত্যাঞ্চলের জলবায়ু চরম ভাবাপন্ন, দুটি ঋতুর প্রকটতাই প্রকাশিত হয়। একটি হল ভারতীয় গ্রীষ্মকাল, যা জুন মাসের মধ্যভাগ থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত স্থায়ী হয়। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে এই যে আগস্ট মাস থেকেই শীতের দাপট শুরু হতে থাকে। তার আগের মাসগুলিতে, অর্থাৎ গ্রীষ্মে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ পনের ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতে শূন্যে নেমে যায়, একথা আগেই বলা হয়েছে। তবুও সেটাই গ্রীষ্মকাল, ইউরোপ মহাদেশের অনেক অনেক দেশের মত। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি বা শেষসময়ে এই পার্বত্য মরুপ্রান্তরের হিমশীতলতায় যুক্ত হয় অন্য বিপদ, স্পিতি নদীর নিম্নধারায় সমতলীয় প্রান্তরে বা আরও পরে এই উপনদী যেখানে গিয়ে মিলেছে শতদ্রুর সঙ্গে সেই কিন্নর জেলাতে প্লাবন ডেকে আনে এবং তাতে অনেক জীবন ও সম্পদহানি ঘটে। তাছাড়া শতদ্রুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলিও বিপর্যস্ত হয়। তবুও এই সময়টাতেই উপত্যকা বাসযোগ্য এবং তখনই মেষপালকরা চলে আসে এখানে, আসে শৈবাঙ্কনও কাছাকাছি কোন না কোন জনবসতির শীতকালীন আশ্রয় ছেড়ে। গ্রীষ্মে বন্যা হয় হিমবাহগুলি বা কাছেপিঠের অন্যান্য দীর্ঘদেহী পার্বত্য চূড়াগুলির বরফ গলতে থাকে বলে, সেই বরফগলা জল স্পিতির নিজস্ব উপনদী বা খালগুলি বয়ে আনে, স্পিতি নিজেও তার উৎস বা দু’পাশের প্রাচীন হিমবাহগলা জলে পুষ্ট হতে থাকে। শীতকালটা বেশ লম্বা হয় এখানে, ব্যাকরণগত ব্যাখ্যায় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। গ্রীষ্মে বৃষ্টি হয়না যেহেতু এটি হিমালয়ের বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে জাঁস্কার পর্বতমালার শেষভাগে অবস্থিত। তবে গ্রীষ্মে বা শীতে দুটি সময়েই এই উপত্যকায় চলে পশ্চিমি ঝঞ্ঝার প্রবল দাপট এবং শীতে প্রচণ্ড তুষারপাতও ঘটে। এ সমস্ত কিছুই এই নদীমাতৃক উপত্যকাটিকে শৈত্য পার্বত্য মরুভুমিতে পরিণত করেছে।
এখানে আসার পর তার একদিন স্পিতি নদীর সঙ্গে কথা বলার সাধ হয়েছিল। মানুষের সঙ্গে আর নদীর সঙ্গে কথা বলার উপায়টি মোটামুটি অভিন্ন হলেও প্রক্রিয়াগত কিছু পার্থক্য আছে। প্রথম বিষয় হল এই যে নদীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা যায় না, তার সঙ্গে টেক্সট করে বা মেসেজ পাঠিয়েও কথা বলার ভাবনা হাস্যকর। বৈদ্যুতিন মাধ্যম বাদ দিয়ে লোকের সঙ্গে কথা বলি যখন সেই গোটা লোকটি সামনে উপস্থিত থাকে, তার গোটাটাকেই দেখা যায়। কেউ কেউ গাছ বা পশুদের সঙ্গে কথা বলে জানি যদিও এ দু’টি বস্তুরই কোন ভাষা নেই। ভাষা থাকে বা না থাকে, কোন বড় গাছের সঙ্গে কথা বলতেও কিছু আটকায় না, কারণ যত লম্বাই হোক না কোন গাছ তার গোটাটাকেই এক জায়গায় স্থির হিসেবে পেতে পারি। কিন্তু বহু গাছে ভরা বিশাল জঙ্গলের সঙ্গে কথা বলা যায় কি ? যায় না, কারণ তার ব্যাপকতা একটা ব্যাপার, পুরো জঙ্গলের সমস্তটা মানুষ কোন এক নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখতে পাবে না। তেমনি ব্যাপার ঘটবে কোন একটি নদীর ক্ষেত্রেও। নদী তো অনেক লম্বা। তার সর্বাঙ্গ গল্প করার সময় কিভাবে গোটাটা সামনে হাজির থাকবে ? তাই নদীর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হলে তার চলার পথ ধরে চলতে হয়। তাহলেই জানা যাবে তার উৎস বা শেষ এবং তার গতিপ্রকৃতি। নদীর সঙ্গে তার গতিপথ ধরে চলতে চলতে যত খুশি গল্প করা যেতেই পারে, তাতে গোটা নদীটাকে চেনা যাবে, জানা যাবে তার স্বভাবচরিত্র ও মনের কথা। সেটি করা যেতে পারে দু’ভাবে, হয় কেউ উৎস থেকে নদীর পার ধরে হেঁটে হেঁটে যেতে পারে তার সমাপ্তি পর্যন্ত আর নয়তো জলযানে চেপে কেউ চলতে পারে নদীর বুক ধরে, তার সঙ্গে গল্প করতে করতে দিনরাত। তবে স্পিতি নদীর ক্ষেত্রে এ দু’টি পদ্ধতির দু’টিই অসম্ভব। শতদ্রুতে মেশার আগে স্পিতি তার উৎস থেকে গোটা উপত্যকা ধরে ও তার বাইরে চলেছে প্রায় একশ’ চল্লিশ কিলোমিটার, যেখানে উপত্যকাটির দৈর্ঘ্য মোটামুটি একশ’ ত্রিশ কিলোমিটার। সমগ্র পরিক্রমায় সে নেমেছে প্রায় ছ’ থেকে সাত হাজার ফিট, প্রতি কিলোমিটারে এই নামা গড়ে প্রায় ষাট ফিট। এই পরিস্থিতিতে নদী এতটাই খরস্রোতা যে নৌপরিবহনের জন্য একেবারেই উপযুক্ত নয়। আর নদীর পার ধরে চলা যাবে না কেন ? তার প্রধান কারণ, উর্দ্ধগতিতে কিছু অঞ্চল বাদ দিলেও এই নদীর দু’পারে রয়েছে খাড়া কঠিন পাহাড়ের গা, শক্ত পাথরের গা প্রবল ধারায় কেটে স্পিতি নিজের চলার পথ করে নিয়েছে সুগভীর গিরিখাত বানিয়ে। নদীর কাছে যাওয়া তাই গোটা পরিক্রমায় অল্প কিছু এলাকা বাদ দিলে অসম্ভব।
তবুও একটা কথা সত্যি। বনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সারা বন ঘুরে বেড়ায় খুব কম লোক, অধিকাংশ মানুষ বনের এক ছোট এলাকায় ভ্রমণ করতে করতে বা বনের কোন এক সীমান্তে তার আয়ত্তাধীন অংশটুকুতে দাঁড়িয়ে গোটা বনের সঙ্গে আড্ডা মারতে পারে, সেখানে আড্ডা আরও জমবে যদি মানুষ পড়ে জেনে নেয় বনটির ভৌগোলিক চরিত্র বা বর্ণনা। নদীর ক্ষেত্রেও এমনটাই করে অধিকাংশ লোক। তারা নদীর নাব্যতার খানিকটা অংশ ঘুরে বেড়ায় গল্প করার প্রক্রিয়ায় আর নয়তো নদীর পারে তার মুখোমুখি বসে কোন এক বা একাধিক অঞ্চলে, তার আগে নদীটির বিবরণ যদি সে গবেষক বা অভিযাত্রীদের লেখা থেকে জেনে নেয় তো আরও উত্তম। এভাবেই নদীর সঙ্গে গল্প করে সাধারণ মানুষ, গোটা নদীর দৈর্ঘ্য হেঁটে বেড়ায় না, সেসব অভিযাত্রীদের কাজ। শৈবাঙ্কনও তার উদ্দেশ্য সফল করার জন্য এমনটাই ভাবল। সে ঠিক করল, তার নাগালে যেসব অঞ্চল পাবে সে স্পিতি নদীর সেসব অঞ্চলে গিয়েই দেখবে নদীকে। আর নদীটির বিবরণ তো তার জানা গবেষকদের কল্যাণে। এই উদ্দেশ্য সামনে নিয়েই সে বেরিয়ে পড়ল একদিন।
কোথায় কোথায় গেল সে ? নদীর উৎস থেকে শতদ্রুতে পতন, এই দু’টি স্থানের মধ্যবর্তী অঞ্চলে লিও গ্রামের কাছে যেখানে তার উর্ধগতি এবং সেখান থেকে এক কিলোমিটার পর্যন্ত প্রান্তরের পথে, যে অঞ্চলে নানান জনবসতির মানুষ নদীর জল নিয়ে তৈরি করেছে কৃষিজমি। তাবো অঞ্চলে তাবো উপনদীর সঙ্গমস্থলে এবং তারও আগে নদী যেখানে যেখানে সমতল ভূমি ধরে বয়ে চলেছে। সমতল হলেও জনশূন্য অনেক অঞ্চল্য যেহেতু চাষযোগ্য নয় জমি।
এখানে দেবতাত্মার সন্ধানে এসে বাসস্থান বানাবার আগে সে এলাকার ভূতত্ত্ব আর ভূগোল জেনে নিয়েছিল। প্রাচীন ভারতে এসবই ছিল দেবতা ও দেবচরিত্র সমান জনতার বিচরণ ক্ষেত্র। কৈলাশ পর্বতমালায় তখন ছিল শিবলোক যেখানে দেবাদিদেব থাকতেন তপস্যামগ্ন, কাছেই ছিল মানস সরোবর। এখন সেই ভারতবর্ষ কল্পকাহিনীর বিষয়বস্তু, শিব কোথায় আছেন কেউ জানে না। কোথায় আছেন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা বা স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখার দেবতা বিষ্ণু তাও জানা নেই করোও। আধুনিক মানুষ মনে করে, এসবই উপকথা।শিবধাম কৈলাশ পর্বতমালা ভারতবর্ষের সীমানার বাইরে। হিমালয়ের অন্তর্ভুক্ত সেই শিবলোক কৈলাশ চির বরফের রাজ্য, প্রাচীন ও স্থায়ী হিমবাহ তার ভিত্তি। কিন্তু এই স্পিতি উপত্যকার মালভুমি থেকে স্থায়ী হিমবাহের রাজত্ত্ব অনেক অনেক দূরে। এখানেও সুউচ্চ পাহাড় চূড়াগুলি শীতকালে আগাগোড়া বরফে ঢেকে যায়, তবে গ্রীষ্মের আগমনে আবার বরফমোচন ঘটে। তাই বছরের কিছু সময় মানুষের পক্ষে এখানে বসবাস কল্পকথা নয়। আর মানুষ কোথায় না থাকে ? চিরস্থায়ী তুষাররাজ্যে এস্কিমোরা সবচেয়ে ভালো উদাহরণ।
প্রকৃতির বুকে নিজের অবস্থানে নিশ্চল থেকেও পাহাড়, পাথর, মালভূমির ঢাল, নদী, গিরিখাত ইত্যাদি বস্তুসমূহ নীরবে কোন ভাষা বোঝায়। একান্ত মনোযোগী যে প্রকৃতিপাঠক তার পক্ষেই এই ভাষার মর্মার্থ উদ্ধার করা সম্ভব। প্রথম প্রথম এখানে থাকা শুরু করার পর শৈবাঙ্কনের কিছুই মাথায় ঢুকত না, সে জানতই না এমন কোন ভাষা আছে কিনা। থাকতে থাকতে এখন তার কাছে কিছুই আর দুর্বোধ্য নয়। সে জানে, প্রতিটি বস্তুর নিজস্ব অবস্থানে ওভাবে থাকার কারণ বা রহস্য। দেখলেই বুঝতে পারে কেন ঢেউখেলানো সমতলীয় মালভূমির বুকে একগুচ্ছ শিলারাশি ওই ভঙ্গিমায় বিছিয়ে আছে, কেন এই একই ভঙ্গিমা তার একটু দূরে বিছিয়ে থাকা শিলারাশির দলবদ্ধতায় নেই, পরিবর্তে সেখানে এক অন্য আয়োজন। প্রাকৃতিক সদস্যরা এভাবে নানারকম অবস্থানগত সজ্জা রচনা করে এবং তা যে বিশেষ এক লিপিমালায় লিখে রাখা মহাকাব্য বা উপন্যাস তা ইদানিং বুঝতে পারে সে। তাই সে যাত্রা করেছিল স্পিতি নদীর সঙ্গে আলাপ জমাতে, শুনতে তার দৈনন্দিন জীবনকাহিনী। তার এই উদ্যোগ অবশ্যই একদিনের ছিল না, তার জন্য গ্রীষ্মকালে প্রায় মাসখানেক সময় দিতে হয়েছিল। দিনেই চলত অভিযান, কখনও রাতের কিছুটা সময়ও চলার ইচ্ছে থেকে যেত আর সে মেনে নিত সেই মনোভাব। চড়াই-উৎরাই পথ, পাকদন্ডী বেয়ে ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে ওপরে বা নেমে এসেছে সমতলে। রাতে চলাচল অবশ্যই বিপজ্জনক অনেক জায়গাতেই। সেসব সে এড়িয়ে যেত। কয়েকবার গাড়িতেও চলেছিল ওই পরিক্রমায়। এই জাতীয় সড়ক পাঁচের একটি উপপথ, নাম জাতীয় সড়ক পাঁচশ’ পাঁচ, পুবে-পশ্চিমে চলে গেছে স্পিতিভ্যালির বুক চিরে। সেই রাস্তার একধারে উঁচু উঁচু আকাশছোঁয়া পাহাড়চূড়া ও তাদের দুর্বিনীত ঢাল এবং অন্যধারে স্পিতি নদী। সেই পথের পুরোটাই যে এমন দৃশ্যপট সাজিয়ে রেখেছে তা নয়। তাবো ভ্রমণকেন্দ্রের আগে থেকে গেছে সে প্রান্তরের বুক ধরে, অবশ্য আগেও রয়েছে স্থানে স্থানে এমনই সমতলের আভাষ। তাদের কিছু এলাকায় জনবসতি রয়েছে, কিছু আবার জনবিহীন প্রদেশ। তেমনিই কোন এক জায়গায় সে স্পিতি নদীর কাছাকাছি এলো। এখানেও নদী অনেকটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেছে নিজেকে। প্রান্তর যদিও বেশ কিছুটা দূরে সরিয়ে রেখেছে উন্নত পাহাড়চূড়োগুলিকে, তবুও সে স্বাভাবিক ঢালে নদীর সঙ্গে মিশতে পারেনি যেমন হয় প্রকৃত সমতলভূমির নিম্নগতিতে। পলিমাটির চত্বর বা সোপান সর্বত্র প্রস্তরীভূত, সেই পাললিক শিলা গতিধারার ফলায় কেটে খাত বানিয়ে চলছে স্পিতি, তাই তার পার এখানেও যথেষ্ট উঁচু এবং পাথুরে। সেখানে পারে যতটা সম্ভব ধারে দাঁড়িয়ে নিচ দিয়ে দ্রুতলয়ে বয়ে চলা স্পিতি নদীর উদ্দেশ্যে সে প্রশ্ন তুলল,
‘আচ্ছা স্পিতি বলতো, তোমার ছোঁয়া পাই কী করে ? তোমার সঙ্গে যে কথা বলার অনেক সাধ আমার। বল স্পিতি, কাছাকাছি না হতে পারলে তা সম্ভব কিভাবে ?’
তখন ভরা গ্রীষ্ম। বেলা চলেছে বিকেলের দিকে। প্রান্তরের রোদ এখনও যথেষ্ট উজ্জ্বল যদিও শীতলতা মাখানো। এই পর্যন্ত বেলায় সেই রোদ গায়ে আরাম এনে দিলেও একটানা দাঁড়িয়ে থাকলে শরীর উত্তপ্ত হয়ে যায়। তবুও সে প্রশ্ন পাঠিয়ে দাঁড়িয়ে রইল নদীর পারে। তার আশা, অবশ্যই নদী উত্তর দেবে। এবং দিলও। চপল ছন্দে প্রকাশিত হল তার ভাষা যা শৈবাঙ্কন বুঝতে পারল অনায়াসে। স্পিতি জানাল,
‘কী করব বলতো ? আমি চলেছি মালভূমির কঠিন পাথর কেটে। যত চলছি ততই খাত গভীর হচ্ছে। আমি তো সমতলের নদী নই। তবে তুমি কথা বলনা, ওখানে ওই উঁচু পাহাড়ি সোপানের ধরে দাঁড়িয়ে, উচ্চতা থেকে। আমি যতই নিচে থাকি না কেন তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারব, উত্তরও দেব, কারণ তুমি আমাকে বন্ধু ভেবেছ।’
শুনে সে আনন্দিত হয়। আবার তাই প্রশ্ন করে,
‘আচ্ছা ভাই, তুমি এই মালভুমি সদৃশ উপত্যকার বুক চলার পথ হিসেবে বেছে নিলে কেন ? কত কষ্ট করে তোমাকে যেতে হচ্ছে। অন্য কোন সহজ অবস্থানেও তো তুমি থাকতে পারতে ?’
শুনে স্পিতি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করল,
‘তুমিই বা এখানে এলে কেন ? জগতে তো আরও সহজ সুন্দর বাসস্থান ছিল ?’
সে একটু হকচকিয়ে গেল প্রশ্ন শুনে। সে ভাবল, সত্যিই তো ! স্পিতি তো তার জন্য ন্যায্য প্রশ্নই তুলেছে। কী বলা যায় ভাবতে ভাবতে সে উত্তর দিল,
‘আসলে আমি মনে করি এখানে থাকলে দেবসান্নিধ্য পাওয়া যায়। এই নীরব উপত্যকা বুকে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে দেবতাদের ভাষা। আমি তা শুনতে পাই, অনুভব করি। আর সোজাকথা, আমি এই উপত্যকাকে ভালবাসি।’
স্পিতি তার বুকে পড়ে থাকা স্খলিত শিলাসমূহের আওয়াজে শোনাল তার ভাষা,
‘আমারও ঠিক এমনটাই মনের কথা। এই উপত্যকাকে আমি ভালবাসি, আর তাই এখান দিয়েই চলছি। এখানে একদিন আমি দেবতাদের আলাপ শুনতে পেতাম, দেখেছিও তাদের জীবনযাপনের আড়ম্বর। এখনও আমার গায়ে শোনা যাবে তাদের ভাষা। তুমি জানোনা, আমার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা অনেক বৌদ্ধমঠ কী ভাবে ? তারা মনে করে, প্রকৃতির মধ্যে রয়েছে যে ধর্মীয় শক্তি তা আমার জল বহন করে এবং তারা তার ছোঁয়া পায় আমার পবিত্র জলে। তুমি এই বিশ্বাসটাকে অমান্য করতে পার না। অভিজ্ঞতার মূল্য নেই ? তুমি তো জান, ধারে ধারে গড়ে উঠেছে যেসব জনপদ তারা সবাই বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত। সেইসব বাসস্থানে বা অন্যত্র রয়েছে বহু বৌদ্ধ মঠ। তাবো, ধনকর, রংরিক, কাজা—- কত নাম করব ? হিমালয়ের এই উপত্যকার গায়ে যত জনবসতি, তার প্রায় সবই গড়ে উঠেছে আমার ধারে। এদের মধ্যে কোন কোনটি হাজার বছরেরও বেশি পুরনো।’
নীরবে চলার ছন্দে মনের ভাষা ব্যক্ত করে স্পিতি। সে শোনে চুপ করে, বোঝে সব। সে আত্মমগ্ন হয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর আবার প্রশ্ন করে নদীকে,
‘আচ্ছা স্পিতি, তোমার গোটা চলার পথে কোথায় তুমি সবচেয়ে সুন্দর ?’
স্পিতি সদামুখর, আত্মমগ্ন থাকলেও নীরব থাকতে জানে না। প্রশ্ন শুনে বালিকাসুলভ চাপল্যে বোধগম্য ভাষায় সে জানাল,
‘সেটা কি আমি বলতে পারি ? বলবোই বা কিভাবে ? আমি কি দেখতে পাই আমাকে ? নানা জনে দেখে তা, দেখে কে কী মনে ভাবে সেসব তাদেরই মতামত। দেখোনা, নিম্নগতিতে আমি চলেছি গভীর গিরিখাত বানিয়ে। পাকদন্ডী বেয়ে রাস্তা সেখানে উঠে গেছে পাহাড়ের মাথায়। পাহাড়চূড়ো ঘুরে ঘুরে ওঠে রাস্তা। বহু নিচে আমি চলতে থাকি আমার মত। কেউ মনে করে, সেটাই সুন্দর। আবার এই যে পাহাড় দূরে সরিয়ে বয়ে চলেছি আমি সমতলীয় নদীর মেজাজে, তুমি শুনতে পাচ্ছ আমার নূপুরনিক্কন, দেখছ আমার জলে সৌররশ্মির ঝিকিমিকি, কারো চোখে বেশি সুন্দর এখানে এই আমি। তবে অনেকেই বলে, কাজা অঞ্চলের কী মনাস্ট্রি থেকে আমার শোভা বেশি নয়নবিমোহন, কাজা ও রংরিক অঞ্চলদুটির মধ্যবর্তী অংশ দেখা যায় সেখানে বহু দূর থেকে। তুমি সেখানে দেখতে পাবে আমার বিশাল অববাহিকা, ছোট-বড় নানা শাখা ও উপশাখা মিলিয়ে বেণীপাকানো, মনে হবে যেন জমাটবাঁধা রয়েছে।’
‘হ্যাঁ, তা আমি দেখেছি।সত্যিই তা অপূর্ব সুন্দর। একবার শীতে আমি কাজার ওই বৌদ্ধমঠে আশ্রয়ও নিয়েছিলাম। দেখতাম তোমাকে রোজই প্রায়।’
‘তবে হ্যাঁ, একথা যদিও জানো তবুও বলছি। শীতে কিন্তু সত্যিই আমার জল জমে যায়। জমাটবাঁধা নদী হয়ে থাকি আমি তখন। গ্রীষ্মেই আমার যত উল্লাস। প্রাচীন সব হিমবাহরা গলে গলে জল আনে আমার জন্য। আমার খাতে অত জল ধরে না প্রায়ই। আমি উপচে উঠি।’
‘তাতে কী বিপদ হয় তুমি সব জানো ?’
‘জানব না কেন ? খুব জানি। নিম্নগতিতে বন্যা আসে, সমভূমিতে থাকা তোমাদের জলবিদ্যুৎপ্রকল্পগুলি বেসামাল হয়ে যায়। দেখ, এই যে উপত্যকা, এ তো পশ্চিম থেকে পুবদিকে প্রসারিত। আমি চলেছি এই উপত্যকার দৈর্ঘ্য বরাবর প্রায়, মোটামুটি উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। হিমালয়ের আদিম ও মূল বিচ্যুতি কারাকোরাম বিচ্যুতির সঙ্গে প্রায় সমরেখায়। এই যে জাতীয় সড়ক, মূল এন এইচ ফাইভের একটি উপশাখা, এও চলেছে আমার প্রবাহের সঙ্গে সমান্তরালে। এখানে এই যে দেখছ আমাকে প্রান্তরের বুকে, এখানে এই উপত্যকা বুঝি সবচেয়ে বেশি চওড়া, অন্তত দু’-তিন কিলোমিটার। বলতে পার, এই অঞ্চলে আমি উর্ধগতি কাটিয়ে নিম্নগতিতে এসে যাচ্ছি। প্রকৃত নিম্নগতি আমার মধ্যে আরও পরে। সেখানে উপত্যকা মাত্র এক-দুশ’ কিলোমিটার চওড়া, আমিও গভীর গিরিখাত ধরে সরুরেখায় চলেছি উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। তার আগে এখানে বা ঊর্ধ্বগতিতে আমি যাচ্ছি পুব থেকে পশ্চিমে, চওড়া বেণীপাকানো ইংরেজি অক্ষর ইউ-আকৃতির উপত্যকা ধরে। তারপর আমার মধ্যে রয়েছে একটি মৃদু সমকোণীয় বাঁক এবং তারপর প্রায় সরলরেখায় উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্বে এগিয়ে গিয়ে সবশেষে হয়েছি উত্তর-দক্ষিণগামী। আমার একটি উপনদী আছে পারাচু নাম। আমার মোট বিধৌত অঞ্চল ন’হাজার ছ’শ ষাট কিলোমিটার যার পঞ্চাশ শতাংশ পারাচু অববাহিকাতে।পারাচু আর আমার অববাহিকা মিলিতভাবে দৈর্ঘ্যে একশ’ পঁচাশি কিলোমিটার। নিম্নগতিতে পারাচুর সঙ্গে মিলনের পরই আমি প্রবাহিত দক্ষিণ থেকে উত্তরদিকে এবং নামগিয়া বা খাব অঞ্চলে গিয়ে ঢুকেছি কিন্নর জেলাতে। সেখান থেকে আরও চোদ্দ কিলোমিটার উজান বেয়ে পড়েছি শেষে শতদ্রু নদীতে পুঃ এলাকায়। এই যে জাতীয় সড়ক চলেছে আমার সঙ্গে এটি পৃথিবীর এক অন্যতম অত্যুচ্চ জনপথ, এর প্রধান অংশ পশ্চিম সীমার গ্রামফু থেকে পূর্ব সীমার খাব পর্যন্ত দু’শ পঁচাত্তর কিলোমিটার লম্বা। শীতকালে ছ’ থেকে ন’মাস এই রাস্তা বরফাবৃত হয়ে বন্ধ থাকে। ভ্রমণশিবির তাবো থেকে চব্বিশ কিলোমিটার দক্ষিণে সুমদো, ওখানেই খাব যেখানে আমি ঢুকেছি কিন্নর জেলাতে।’
বলেই চলছিল স্পিতি। তার কথা থামাবার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। এসব কথা সবই প্রায় জানে সে। তবুও বলতে দিচ্ছিল নদীকে, কারণ তাকে যেন কথায় পেয়েছিল। নিজের কথা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছিল নদী, এক কথা থেকে চলে যাচ্ছিল অন্য কথায়, এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে। অগোছালো ছাপ ছিল কথা বলায়। তবুও বাধা না দিয়ে শুনছিল সে, বাধা পেলে নদী যদি আহত হয় এই ভাবনায়। শেষপর্যন্ত অবশ্য আর চুপ করে থাকা গেল না। কিছু বলার জন্য উসখুস করতে করতে একসময় বলতে বাধ্য হল সে,
‘এসব কথা সবই আমি জানি স্পিতি। তুমি বলছ অত আগ্রহ করে, তাই শুনছি আবার। কিন্তু তুমি যে প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলে সেখান থেকে যে সরে গেছ সেই খেয়াল আছে কি ? তুমি বলতে যাচ্ছিলে তোমার নিম্নগতিতে বন্যার কথা।’
বাধা পেয়ে থামল স্পিতি। চলছিল যেমন চলতে লাগল, কথা বলা কেবল বন্ধ রাখল কিছুটা সময়। বোঝা গেল, সে কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। বলছিল খলবল করে যত তার বুকের কথা উদ্দাম আবেগের বশে, বালিকাসুলভ চপলতায়, রাশ টানা হল তাতে। চুপ করে সে কিছু ভাবছিল। তার প্রতিফলন দেখা গেল নদীর পরবর্তী ভাষায়,
‘ঠিক, আমি একটু বেশিই বলে ফেলছিলাম। খেয়াল ছিল না কী বলছি না বলছি। তুমি বলে ভালোই করলে। তবে কী জানো, যা বলছিলাম এতক্ষণ তা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক এমন নয়।তুমি জানো, সবাই তো জানে না।’
‘সেটাও ঠিক। তোমাকে থামাতে চাইনি, তোমার উচ্ছ্বলতাকে। তবুও কেন বাধা দিলাম জানো ? তুমি বন্ধু বলে। তুমি একতরফা বলে গেলে আড্ডা জমবে কী করে ? আমারও তো কিছু না কিছু বলতে হয়, তাই।’
পৃষ্ঠতলে দুরন্তগতি জলমুকুরে পড়ন্ত রোদ ঠিকরে ছটায় প্রতিফলিত, হাসল স্পিতি। হাসি তার সারা গায়ের চলনে বিচ্ছুরিত, তার দিকে না তাকিয়েও তা বোঝা যায়। হাসতে হাসতেই জানাল সে,
‘কেন আমার জলপ্রবাহ প্লাবন ডেকে আনে সেটা বুঝতে হলে এখানকার ভূপ্রকৃতি তোমাকে জানতে হবে। আমার তো মনে হয় তুমি সেসব অনেকটাই জানো। তবুও শোন। এই যে বন্যার কথা বলছ, এটা কিন্তু প্রাচীন যুগেও হত। এইসব বিপর্যয়ের প্রমাণ এখনও দেখতে পাবে উপত্যকার নানা অঞ্চলে, বিশেষ করে নিম্নগতিতে। উপত্যকার এখানে-ওখানে রয়েছে স্তূপাকৃতি পলির স্তর, পাথর হয়ে গেছে থেকে থেকে। ওগুলি আসলে প্রাচীনকালের হ্রদসমূহের সঞ্চয়। এ দেখেই বোঝা যায় কেন বন্যা হত প্রাচীনকালে। এখনও সেই ধারাই চলছে, পলিমাটির হ্রদ তৈরি হচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে গেলে তো অনেক কথাই বলতে হয়। এত কথা কি একদিনে বলা যাবে ?’
নদী কথা থামিয়ে নীরবে চলতে লাগল। তার উচ্ছ্বল চলাচল ঝংকার তুলছিল তার বুকের বড় বড় বোল্ডার আর শিলাসমূহে। সে দেখছিল তার দামালপনা, নিরুচ্চারিত ভাষা শুনতে শুনতে। নদী থামলে সে বলল,
‘সেসব কথা আমিও কিছু জানি। অবশ্যই তা তোমার চেয়ে কম। তবুও যা জানি তা অনেকের চেয়ে বেশি। আমি জানি যে তোমার অববাহিকা গাঠনিকভাবে এখনও অস্থির। এখানে আছে এখন নিওটেকটোনিক বা নব্যগাঠনিক চঞ্চলতা, কারণ ইন্ডিয়ান প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেট কাছাকাছি হয়েই চলেছে এবং তাদের সংঘাত লেগেই আছে।এই চলন মূল উত্থান বা বিচ্যুতি ব্যবস্থা বরাবর ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়াতে প্রমাণিত, তাতেই এই বিচ্যুতি রেখা বরাবর উর্দ্ধমুখী মাথা তোলা বা পুনর্গঠনের কাজ দেখা যাচ্ছে।’
‘ঠিক বলেছ।’ দুরন্ত ছন্দে চলতে চলতে স্পিতি ভাষা খুঁজে পেল, ‘তাতে কী হচ্ছে শোন।ভূমিকম্প দেখা যাচ্ছে হামেশাই, আর থাকছে ধ্বংসাত্মক ধস বা ভূমিস্খলন। এতে ধ্বংসস্তূপ পাহাড়ের খাড়াই ঢাল বেয়ে উপত্যকার তলদেশে নেমে জমে যাচ্ছে। যেসব হ্রদের কথা বললাম সেসব এভাবেই তৈরি হচ্ছে।ধসের বস্তুসমূহ এইসব হ্রদের খাতে পুরু ও মিহি পলি হিসেবে জমে খাত থেকে হিমবাহ গলা জল উপচে দেয় আর তাতেই বন্যা সৃষ্টি হয় নিম্নগতিতে। আমার হাত নেই এখানে।’
‘সঙ্গে রয়েছে আবহাওয়া জনিত প্রভাব।’ সে কথার পিঠে কথা সাজাল, ‘সেটাও আমার জানা। ঋতুকাল দু’টি, দু’টিই চরম ভাবাপন্ন। এই অস্বাভাবিক ঋতুকালে প্রকট ঋতুগত চাপও সমস্যা তৈরি করে।’
‘এখানেও আমার কিছু করার নেই।বললাম না, সুদূর বা অদূর অতীতেও এমন ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের প্রমাণ রয়েছে স্তূপাকৃতি পলিস্তরে যা প্রাচীন হ্রদের অবশিষ্ট জমাবস্তু হিসেবে উপত্যকার স্থানে স্থানে সংরক্ষিত। গঠনগতভাবে সক্রিয় এই উপত্যকার ভূপৃষ্ঠ আলগা ও অসংহত পলিজনিত ঢাকনার স্তর যা এখানকার জলবায়ু ও ক্রিয়াশীল গাঠনিক শক্তির সামান্য পরিবর্তনে ধ্বংসাত্মক হতে পারে। তেমনটাই হয়েছে শতদ্রুর নিম্নধারায় ফ্ল্যাশ ফ্লাডের কারণে, যেখানে বর্ষাকালে জলস্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত চল্লিশ ফিট উঁচু হয়ে বিপর্যয় ঘটিয়েছে। এখানে এই উপত্যকার বুকেও আমার জলপ্রবাহ সবকিছু ভাসিয়ে দিয়েছে। আমাকে এখন দেখলে কি তোমার মনে হবে আমি এমন কাণ্ড ঘটাতে পারি ?’
উচ্ছ্বল আর চঞ্চল স্পিতির চলাচল, কলহাস্যে মুখরিত তার সারা অঙ্গ, চপলতা প্রকাশিত শুভ্রধবল ফেনিল সরোষ উল্লাসে—- দুরন্ত দুর্নিবার স্রোত যখন বাধাহীন চলমান থাকতে গিয়ে বাধা পায় বুকে জমা বড়-মাঝারি বোল্ডারে, খণ্ডবিখণ্ড ছোটখাট নুড়ি পাথরকে তো মুঠো মুঠো করে গুচ্ছে গুচ্ছে স্রোতপ্রাবল্য ছুঁড়ে ফেলে এদিকে-ওদিকে যেদিকে খুশি, তারা দলবদ্ধভাবে চলন্ত গতিধারার দু’পাশে জমতে জমতে অলংকৃত হতে থাকে। স্পিতি চলে আপন খেয়ালখুশিতে ভ্রূক্ষেপহীন, তাকিয়ে দেখে না কোনোকিছু—- কী শোভা তার চলাচল অঙ্গভূষণ করে তুলল নিজের বা উপত্যকার বুকে সামগ্রিক কী আবেশ কী প্রভাব রচনা করল। স্পিতি সেসব দেখে না, নীরব থাকে, চলে উন্মত্ত প্রবল ধারায় আপন মনে আপন আনন্দে। কিন্তু জানে না কি ? অবশ্যই জানে আর জানে যে তার প্রমাণ পেল সে এখন নদীর সঙ্গে আত্মগত কথোপকথনে। সে ধ্যানস্থ হয়ে উপবিষ্ট স্পিতির উঁচু পাথুরে পারে পড়ন্ত বেলার সৌরসম্ভাষণের আদরে এবং বলে,
‘আমি কিন্তু জানি স্পিতি তুমি এসব বিপর্যয়ের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী নও, লোকে যদিও তোমাকেই হয়তো দায়ী করে। আমি জানি যে উপত্যকার ভূত্বক ভঙ্গুর, চূড়াগুলির খাড়াই ঢাল ও গায়ে জমে থাকা আলগা পলিমাটির বিশাল স্তূপের কারণে বরফ গলার সময় ভূমিক্ষয় প্রবল হয়। শীতকালে সমস্ত পাহাড়চূড়া হয়ে যায় অস্থায়ী হিমবাহ, গ্রীষ্মে তারা গলে যায় পুরোপুরি। খাড়াই নদীর পারে জন্য পাহাড়চূড়ার বরফ ও ভূমির ধস নদীপ্রবাহের চাপ বাড়িয়ে দেয়, আর এসব ধস ভূমিক্ষয় বাড়িয়ে পাঁক জমায় থরে থরে নদীর বুকে। তাতেই নদীর নিম্নগতিতে এবং উপত্যকার বুকে ফ্ল্যাশ ফ্লাড তৈরি করে। ঋতুজনিত চাপ ও অঞ্চলটির কাঠামোগত পুনর্গঠন তাই এভাবে নদীপ্রবাহ বাড়িয়ে দেওয়ার কারণ। অবশ্যই ঋতুজনিত চাপ একটা বড় ব্যাপার স্পিতি, তাতে রয়েছে জলবায়ুর বিশেষ উপাদানগুলি। যেমন হিমায়ন ও অবহিমায়ন এবং গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন বৃষ্টি অথবা তুষারপাত ভূত্বকের ভিত্তীগঠনে মূল কাজ করে আর তাতে নদীজ উপত্যকা বা গোটা উপমহাদেশে ভূমিক্ষয় ঘটে, শুধু এখানেই নয়। সঙ্গে রয়েছে এখানকার এই ভঙ্গুর অঞ্চলের ক্রমাগত উত্থান ও বিকৃতিজনিত অস্থিরতা এবং উপত্যকা গাত্রের স্খলন নিত্যঘটনা হিসেবে। এই উপত্যকার এসব স্পর্শকাতর এলাকাগুলি নিম্নগতিতে যে ভয়ানক ঘটনা ঘটায় তারা ক্রিয়াশীল হয় এমনই সমস্ত ঋতুজনিত বা গঠনাত্মক বিপর্যয়ে, অথচ দোষ চাপায় সবাই সবকিছু না জেনে তোমার ঘাড়ে।’
দীর্ঘসময় ধ্যানস্থ শব্দোচ্চারণের পর নিশ্চুপ হয় সে, আত্মমগ্নতায় কান খাড়া করে রাখে, শোনে স্পিতির আপন ছন্দে আপন বেগে প্রবাহিত হওয়ার সবল ধারার কলহাস্য। নদীও কথা বলে না, কেবল হাসে, কারণ তার সব কথা বলে দিয়েছে তার পাশে উপবিষ্ট ওই তপস্যাতপ্ত পুরুষটি। কিছুটা সময় অপেক্ষা করে নদীকে কিছু বলতে সে প্রশ্ন তোলে,
‘সেসব কথা ছাড় স্পিতি, অন্য প্রসঙ্গে চল। তুমি এই উপত্যকায় আছ দীর্ঘদিন। বললে দেবতাপুরুষদের সংশ্রবও পেয়েছ। চলনে-বলনে যতই তোমার বালিকাসুলভ চপলতা থাকুক না কেন, বয়সে তুমি খুব একটা নবীনা নও। বরং তুমি যথেষ্ট প্রাচীনা এমনটা বলাই ঠিক তোমাকে। তাই যদি হয় তো তুমি নিশ্চয় জানো অনন্ত জীবন বা অমরত্বের ব্যাপারটা কী বোঝায়। আমি প্রশ্নটা রাখলাম তোমার কাছেই এবং এই কারণে যে ব্যাপারটা নিয়ে ইদানীং আমি কিছুটা বিব্রত। তুমি নিশ্চয় জীবাক্ষকে চেন ? তোমারই অববাহিকায় তোমার সান্নিধ্যে থাকা বৌদ্ধ মঠগুলিতে ঘুরে বেড়ায় সেই সর্বজন প্রিয় সন্ন্যাসী। সে এই রহস্য অনুসন্ধানে আত্মনিবেদিত আর আমাকে তার সহচর ও সহযোগী করতে ইচ্ছুক। আমার উত্তরের অপেক্ষায় আছে সে। কিন্তু আমি কী উত্তর দেব ? আমার কোন কৌতূহল নেই, নিজেই কিছু জানিনা এই বিষয়ে। তবুও আমি তাকে বিরূপ করতে চাই না, তার সখ্যতা আমারও এই নির্বান্ধব মরুপ্রদেশে প্রয়োজন। তাই প্রশ্নটা রাখলাম তোমার কাছেই। সত্যিই তুমি কিছু জানো কি অনন্ত জীবন প্রসঙ্গে ?’
প্রশ্নটি জানিয়ে সে চুপ করল। স্পিতি চঞ্চল শব্দে হাসে। নূপুরনিক্কনধ্বনিতে বলে,
‘কিছু তো নিশ্চয় জানি, কারণ ওই অমর দেবতাদের সান্নিধ্যে আমি ছিলাম এবং এখনও আছি। তবে সেসব কথা কি এখানে এই একাসনে বসেই তুমি শুনবে ? তাহলে তো দিনের পর দিন তোমাকে একসনেই এভাবে বসে থাকতে হয়। আমাকে আরও জানা আরও চেনা দরকার তার আগে। এই একটি জায়গায় বসে সেটা কিন্তু সম্ভব হবে না। সেটা আর তোমাকে কী বলব, তুমি নিজেও সেটা জানো।’
‘জানি তো। তাই কী করব তোমার কাছেই জানতে চাইছি।’
‘চল তাহলে আমার সঙ্গে, আমার গতিধারার সঙ্গে। আমার ছোঁওয়া সবসময় পাবে না, দুর্গম হবে তা তো আগেই বলাবলি হয়েছে। যেখানে যেখানে পারবে আমার কাছাকাছি হতে তাই যথেষ্ট, যতটা যেতে পারবে তাতেও হবে। চল আমার সঙ্গমে, সেই খাবে অথবা লিও গ্রামে, চল কুঞ্জুম পাহাড়ে আমার উৎসের কাছাকাছি। আমার সঙ্গে চলতে চলতে আমাকে আরও জানতে পারবে, কথা বলতে বলতে উত্তর পাবে আরও অনেক রহস্যের। সেখানে অনন্ত জীবনের রহস্য থাকলেও থাকতে পারে। এস, আমার সঙ্গে চলতে শুরু করে দাও এইবেলা।’
নদী ভাষা থামাল, কেবল কলহাস্যে মুখরিত থাকল। শৈবাঙ্কন ধ্যান ভেঙ্গে চোখ খুলল।
অধ্যায়: নয়
জাদুজগতের বন্ধ দরজাটা খুলল কোটিকল্প। তার দুই বিস্মিত চোখের সামনে ঘটল ঘটনাটা। খোলা দরজা দিয়ে সে ঢুকল এসে অন্য এক আশ্চর্য পৃথিবীতে। ঢুকে সে আরও আশ্চর্য হয়ে গেল। সে দেখল, সে ওই একই মেলার প্রাঙ্গণে থেকে গেছে। সেই একই জনতা, একই পসরা, একই ভিড়। তাহলে কী আর পার্থক্য থাকল ? তাহলে এটা অন্য জগৎ হবে কোন্ আক্কেলে ? এত বক্তৃতা দিয়ে এত আয়োজন করে দরজা-টরজা খুলে তাকে একই মেলায় রেখে দেওয়ার কোন যুক্তি আছে ? সে দেখেছিল স্পষ্ট একটা বন্ধ দরজা। মেলাপ্রাঙ্গণের মধ্যস্থলে এক বিভাজিকার গায়ে। তারা ছিল এধারে। ওধারে কী ছিল জানত না সে। ছিল সবই চোখের অন্তরালে। তারপর সে ক্রমশ বুঝতে পেরেছিল যে সমগ্র মেলাপ্রাঙ্গণই ঘেরা ছিল ওই বিভাজিকার রুদ্ধ ঘেরাটোপে। ব্যাপারটা সে আগে লক্ষই করেনি। এতক্ষণ ভেবেছিল যে মেলাপ্রাঙ্গণ উন্মুক্ত চতুর্দিকে। এবার বুঝল, মোটেই তা নয়, তার চারটি ধারই ঘেরা। আরও দেখতে গিয়ে সে আরও অবাক হল। কেবল ধারগুলিই নয়, মাথার ওপরটাও আচ্ছাদিত। ওরে হরিবোল, পরে সে আবিষ্কার করে হতভম্ব হয়ে গেল। পায়ের তলাতেও পুরু দেয়ালের ঢাকনাওলা ভিত্তি। তার মানে, মেলাপ্রাঙ্গণের সবদিক ঘেরা আচ্ছাদনে। অর্থাৎ এই মেলাপ্রাঙ্গণে উপস্থিত সমস্ত বিচরণশীল জনতা আসলে এক আবদ্ধ জগতের বাসিন্দা। আরও সাদা কথায়, সবাই এক বদ্ধ খাঁচায় ঘোরাফেরা করা মানব সম্প্রদায়। কোন এক চিড়িয়াখানায় থেকে যাওয়া আবদ্ধ প্রাণিকুলের হম্বিতম্বি। অথবা বলা যেতে পারে, গোটাটাই কোন এক তথাকথিত মুক্তমঞ্চে ব্যাপক প্রদর্শনীর আয়োজন যা আসলে খোলা আকাশের তলায় হলেও কোন না কোন প্রান্তে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা কোন ক্যাম্পাসের অন্তর্ভুক্ত আর ওই খোলা আকাশটাও এক বিভ্রম ছাড়া কিছুই নয়, কারণ সীমানা তার রচিত বায়ুমণ্ডলের অদৃশ্য প্রাচীর দিয়ে যার বাইরে যাওয়ার বা বেঁচে থাকার কোনও উপায় নেই। সে এতসব বেড়াজালের আবদ্ধ বন্দিদশা আগে কেন বুঝতে পারেনি ঈশ্বর জানে। চোখ তো তার এখন যেমন সর্বদা তেমনই ছিল। তবুও কিছুই দেখতে পায়নি। তখন সে বুঝল, মানুষ সমুদয় তথ্য কেবল চোখেই দেখে না, অন্যসকল ইন্দ্রিয়সমূহের সাহচর্যে উপল্বদ্ধিও করে। দেখাটা সম্পূর্ণ হয় বোধের সমন্বয়ে। মানুষের এই বোধবুদ্ধির জগৎটাই ঘুমিয়ে থাকে সারাজীবন তারই অগোচরে। তাই সে অনেক কিছুই দেখে না, বুঝতে পারে না জীবনভর। তারও হেন্ দোষ ঘটেছিল এখন পর্যন্ত। তাই সে এতদিন বুঝতেই পারেনি যে মেলাপ্রাঙ্গণ বস্তুত একটি সবদিকেই বদ্ধ খাঁচা। প্রত্যক্ষ দেয়ালগুলি অদৃশ্য ছিল চোখের সামনে।
সর্বদিকের বদ্ধ খাঁচায় দরজা ছিল কেবল কোন একটি দেয়ালেই। নাকি সমগ্র দেয়ালে একাধিক ? কী দেখেছে আর দেখেনি তা তার নিজেরই খেয়াল নেই। নাহলে দেয়ালগুলি চোখ এড়িয়ে গেল কী করে ? এমনিভাবে তাহলে দরজাগুলিও কি দেখা হয়নি ? কেবলমাত্র একটি দরজাই হয়তো চোখে পড়েছিল। হতেও পারে। বিচিত্র কিছুই নয়। একটিমাত্রই বন্ধ দরজা তার নজরে পড়েছিল, যার সামনে সে দাঁড়িয়েছিল। অন্য আর কোনদিকে ফিরেও তাকায়নি, তাই অন্য দেয়ালগুলিতে বন্ধ দরজা আছে কিনা সে তাকিয়েও দেখেনি। যে দরজার মুখে তাকে দাঁড় করানো হয়েছিল সে কেবল সেটাকেই বন্ধ বলে দেখেছিল, অন্য দেয়ালগুলিতে কী আছে কী নেই দেখেনি বারেক। কেবল ওই একটি দরজার গায়েই দেখেছিল তালা ঝুলতে, সেটারই চাবি ছিল কোটিকল্পের হাতে আর সে সেই দরজাটাকেই খুলেছিল। দরজা খুলে পাওয়া গেল সেই বিভাজিকার অন্য ধার, যা আসলে মেলাপ্রাঙ্গণের বহিঃস্থল। সেটাকেই মনে হল জাদুজগৎ যেখানে মেলাপ্রাঙ্গণ থেকে তাকে নিয়ে খোলা দরজা দিয়ে ঢোকা হয়েছিল। তখন মনে হচ্ছিল বুঝি তা অদ্ভুত কোন বিশ্ব, ঢুকে কিন্তু চমক ভাঙল পরে বুঝল বিস্ময়ের কিছুই নেই। সেটা আসলে মেলাপ্রাঙ্গণেরই অন্য আরেক প্রতিরূপ। তেমনই জমজমাট, তেমনই লোকের ভিড়। তখন তার মনে হল, এখানে এসে কী এমন পরমার্থ লাভ ঘটল। সে প্রভূত হতাশ চিত্তে তখন সেই প্রশ্নটারই উদ্গীরণ ঘটাল নিচের মত করে,
‘এ কী অর্থে জাদুজগৎ ? এতো দেখছি সেই মেলাটাতেই থেকে গেলাম ?’
কোটিকল্প তাকে আবার দেখল। দেখতে দেখতে জানতে চাইল,
‘জাদুজগৎ মানে তুই কী ভেবেছিলিস ? গল্পকাহিনিতে পড়া রূপকথার জগৎ ?’
‘তেমন না হলেও এমন একটা দেশ যেখানে বাস্তব এমন প্রখর নয়। এখানে তো দেখছি সেই রুক্ষকঠিন মেলাটাই হাজির রয়েছে। এখানে জাদু কোথায় ? তুমি যাকে বলেছ মায়াপ্রকল্প, সেটাকেই তো দেখছি। জাদু কি ওই মায়াতেই ? তাহলে মূল মেলাটা কী দোষ করল ? জাদু তো সেখানেও আছে !’
তার সমস্ত জিজ্ঞাসা মনোযোগ দিয়ে শুনে কোটিকল্প উত্তর দিল,
‘যাক, মনে যে তোর প্রশ্ন জেগেছে সেটাই অনেক। প্রশ্ন না থাকলে মানুষ কিছু শেখে না। শোন্, বলছি, তোর আরও দেখার দরকার আছে। কোথায় এসেছিস বুঝতে পারছিস না এখনও। এটা যেখান থেকে এলি সেই মেলার মাঠ নয় একদমই। এটা এক অন্য জায়গা। এর চরিত্র একেবারেই অন্যরকম। তোর চোখ ধাতস্থ নয় বলে ধরতেই পারছিস না।’
শুনে তার চেতনা ফিরল। মেলার ওই আবদ্ধ খাঁচার বাইরে গিয়ে আবার এক জনসমাবেশ দেখেই সে ভেবে নিয়েছিল যে সেই একই মেলার মাঠে আছে। সত্যিই জাদুজগৎ শুনে সে একটা কল্পলোকের পরিবেশ দেখার আশায় ছিল। পরিবর্তে একই জনসমাগম, একই পসরারাজি দেখে এখানে কিছু অন্য আয়োজন থাকতে পারে একথা মাথায় আসেনি। প্রথম দর্শনেই অভাবনীয় কোন চমকের মুখোমুখি হবে এমন ভাবনায় থেকেই তার আশাভঙ্গ ঘটেছিল। তাই কী কেমন কিভাবে কোথায় আছে কিছুই আর ধৈর্য ধরে দেখতে যায়নি। মানুষ এমনই করে, এটাই তার চরিত্র। কোনকিছু দেখে না সময় নিয়ে, অপেক্ষা করতে জানে না। সবসময় সে তাড়ায় থাকে, কী যেন তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আসলে জন্মের পরপরই পরিবার, সমাজ, সভ্যতা তার মাথায় একথা গেথে দেয় যে জীবন বড়ই ছোট। যা করার তা করতে হবে দ্রুত। ‘সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়’—- এই সারকথা সে দেখতে দেখতে বড় হয় বলে জীবনটা তাড়াহুড়ো করে কাটায়। অর্থাৎ ওই সারকথার নেতিবাচক দিকটা মূলধন করে জীবনে, ইতিবাচক দিকটা দেখেও দেখে না। এ বড়ই আক্ষেপের কথা যে জগৎ সবসময় সমস্ত বিষয়ের নেতিবাচক প্রভাবে বেশি প্রভাবিত। শুভ আর অশুভের দ্বন্দে সর্বদা শুভকে পশ্চাদগামী হতে দেখা যায়, অশুভের দাপটে ঝংকৃত সভ্যতা। কেন যে এই প্রভাবের বাড়াবাড়ি কেউ জানে না। এভাবেই সভ্যতার চলন হয়ে গেল বর্তমান পথে, বিকল্প কোন পথ যদি বা ছিল তা ধৈর্য ধরে দেখার চেষ্টাও করল না।
আসলে দিগদর্শক সঠিক থাকা চাই। উপযুক্ত পথপ্রদর্শক পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার। সামনে সবসময় এগিয়ে যাওয়ার অন্তত দু’টি পথ থাকে। সবাই বিভ্রান্ত হয় সেই সন্ধিস্থলে এসে। কোন্পথটা নেওয়া সঠিক কেউ না দেখলে আপাতদৃষ্টিতে যে পথ সহজ মনে হবে সেটাই মানুষ বেছে নেয়। তাতে পরে কী হবে তা নিয়ে এখন কেউ মাথা ঘামায় না। শয়তানের বুদ্ধি যেমন, ‘আগে সুখ করে নেওয়া যাক, দুঃখের কথা পরে ভাবা যাবে।’ বিবেক থাকে প্রতিটি মানুষেরই, কারো সবল কারো দুর্বল, কিন্তু সে আজকাল সর্বক্ষেত্রেই উপেক্ষিত পথপ্রদর্শক। এমন পরিস্থিতিতে কী আর করা যাবে ? নিয়তিনির্ভর হওয়া ব্যতীত উপায় নেই। চলুক সভ্যতা তার পথে, মদমত্ত গৌরবে ভ্রূক্ষেপহীন। বিবেক থাকুক ঘুমন্ত নিষ্ক্রিয়। সভ্যতা মানুষকে দাম্ভিক আর অহংকারী বানিয়েছে, এখানেই যত মুশকিল। সে যদি বিনীত হত তাহলে নিজের অসহায়ত্ব দেখতে পেত। দেখত প্রতি পদে পদে সে অসহায় পার্থিব, প্রাকৃতিক ও মহাজাগতিক শক্তি ও দুর্ঘটনার মুখে। সে বিপন্ন তারই আরোপিত বিধিনিষেধ, সংস্কার এবং তারই দম্ভ ও শক্তির কাছে। যদি এই জ্ঞানচক্ষু এই দিব্যদৃষ্টি পেত সে তখন তাকে পথ দেখাবার সুযোগ থাকত বিবেকের। নেই বলেই বিবেক তার পেশা ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সৌভাগ্যক্রমে মেলাপ্রাঙ্গণে সে হারিয়ে গিয়ে নিজেকে আগাগোড়া অসহায় বলে ভাবতে পেরেছিল, আর তাই তার গাইডের প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে মানতে কোন আপত্তি দেখাবার কথা ভাবেনি কোনদিন। মেলায় তো সকলেই হারিয়ে যায়, কোটিকল্প সবার জন্যই তার হাতটা বাড়িয়ে রাখে। ধরে না তো সবাই। কেউ বা ধরলেও ধরে রাখে কিছুদিন। নিজেকে ‘সাবালক হয়েছি’ ভেবেই ছেড়ে দেয়। যে হাতটা ধরে রাখে আজীবন, তার বিবেক সক্রিয় থাকে। জীবন ও জগৎকে দেখার তৃতীয় নয়ন তার ক্ষেত্রেই উন্মোচিত হতে পারে কোন একদিন। এটাও কিন্তু একটা লোভ। যে হাত ধরে রাখতে চাইবে সারাজীবন তার মনে এই লোভ থাকা চলবে না। সে হবে সরল শিশুর মত, রামকৃষ্ঞায়িত হবে তার মনোভাব। জাগতিক কোন মোহ, দুঃখকষ্ট, সাধ-আল্হাদ সবই সে শোষিত ও সমাহিত দেখবে কালিরূপিণী অসীম তমসাচ্ছন্ন মহাজাগতিক অন্ধমায়ায়। তাহলেই কোটিকল্প তার হাত ধরে তাকে পৌঁছে দিতে পারবে জাদুজগতে, যে জগতে গিয়ে সে খুঁজে পাবে নিজের আপন মনোরম আবাস যেখান থেকে দেখতে পাবে তার প্রাক্তন বাসস্থান মেলার মাঠ মায়াপ্রকল্পটির জনসমাগম ও তাদের অযৌক্তিক, হাস্যকর ও অবাস্তব যত কাণ্ডকারখানা। সে তখন বুঝবে কেন এই জনতার ভিড়ের মধ্যে দিয়ে উলঙ্গ চলে যেতে পেরেছিলেন শুকদেব।
প্রথমে সে তাই নিজের উত্তেজনা প্রশমিত রাখতে পারেনি অন্যজগৎ শুনে, সে ভেবেছিল সেটা বোধহয় স্বর্গ না হোক কোন রূপকথার দেশ হবেই হবে। এখন সে পরামর্শ অনুযায়ী নিজেকে শান্ত করল। তার ভিতরের অস্থিরতা সে নিজেকে বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করে দিতে পারল। সে ভাবল, সত্যি নিজে বেশি বুঝতে গিয়ে অনেক কিছু হারাবে। সবাই তাই করে, কেউ ধৈর্য রাখতে জানে না শেষপর্যন্ত। নিজেকে পথপ্রদর্শকের হাতে রেখে শান্তি পায় না। সে তখন সব নিজের বুদ্ধি-বিবেচনার ভিত্তিতে বিচার করতে যায়। নিজেকে সাবালক আর সবজান্তা ভাবতে শেখে। সেভাবেই চলতে চায় বাকি জীবন, স্বাধীনচেতা মনোভাব তার কখনো কারো অধীনস্থ ভাবতে দেয় না। আর কী করবে অন্য কেউ যদি সে নিজেই নিজের চলাচল ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার নেয় ? দু’ নৌকায় পা দিয়ে চলা মুশকিল বলেই কোটিকল্প তার হাতটা ছেড়ে দেয়। সে তখন নিজেই নিজের চালক বা অধিকর্তা হয়ে যায়। যে হাতটা ছাড়ল সে আর কোনদিনও সেই হাতটা ধরতে পারে না। জীবন কাটে এভাবেই। তারপর মৃত্যুর আগের মুহূর্তে সে আবার নিজেকে ফিরে দেখতে যায় যেমন দেখেছিল প্রথমদিন। শেষ সময়ে তাই অনেকে বোঝে কী ভুল করে গেছে সারাজীবন। তখন কিন্তু সে উপায়হীন। শোকগ্রস্ত অবস্থায় হাহাকার সঙ্গী করে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে কোটিকল্প সেসময় তাকে দেখে হতাশ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। তারও কিছু করার থাকে না যেহেতু সে নিজের নিয়ম কোন অবস্থাতেই নিজে ভাঙ্গে না।
পরামর্শ মেনে সে তাই এবার স্থিতধী হয়ে মেলাপ্রাঙ্গণের বাইরের এই জগৎটাকে দেখার চেষ্টা করে। ক্রমশ সে আসল মেলাটার সঙ্গে এই নতুন মেলাটার অনেক পার্থক্য খুঁজে পায়। সে বুঝল, দেখতে এ জগৎটা এক মনে হলেও সেটা কিন্তু নয় একেবারেই। এটা সেই মূল মেলাটার প্রতিচ্ছবি বা প্রতিরূপ। কে যে কার প্রতিরূপ বুঝতে তার গোলমাল পাকিয়ে যায়। পরামর্শ অনুযায়ী সে তখন ভাবে, এই নতুন জগৎটারই প্রতিরূপ হবে ওই মেলার মাঠ, যাকে বলা হয়েছিল আসলে ওটা এক মায়াপ্রকল্প। আসলটা এই অন্য জগৎ, থাকে সেটা মেলাপ্রাঙ্গণের আবদ্ধ খাঁচাটার বাইরে।
সে তখন বোঝে, এই অন্য মেলাটাতে মানুষ আর পসরারাজি থাকলেও তা চরিত্রে অনেকটাই মায়াপ্রকল্পাধীন মেলার তুলনায় ভিন্ন। এই মেলাতে যারা আছে তারা কেউ ছুটছেও না কাজকর্মও করছে না। সবাই নিশ্চল অবস্থাতে আছে, মেলাপ্রাঙ্গণটা পর্যন্ত। এটা দেখে সে এবার সত্যিসত্যিই অবাক হল। তাকে দেখিয়ে না দিলে সে নিজে এই ব্যাপারটা বুঝতেই পারত না সারাজীবন। সেও তখন অন্য আর সবার মতোই ভেসে যেত গড্ডালিকা প্রবাহে আর তারও হাতটা একসময় ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াত কোটিকল্প। যেমন করে সে অন্যদের বেলায়। সে ভাবল, ভাগ্যিস সে হাতটা ছেড়ে দেওয়ার ঔদ্ধত্ব দেখায়নি। তাই সে এমন অনেককিছু দেখার সুযোগ পাচ্ছে যেটা অন্যরা পায় না।
সে তখন পূর্ণচোখ মেলে তাকিয়ে দেখল এই নতুন নিশ্চল মেলাটাকে। কোটিকল্প বলল,
‘দ্যাখ্, এই নতুন মেলা বা জাদুজগৎ, যাই বলিস না কেন, এটার নিয়ম সম্পূর্ণ আমি নিজের হাতে চালাই প্রত্যক্ষভাবে।আমি চলতে বললে এটা সচল হয়, আমি না চাইলে এটা নিশ্চল অবস্থাতেই পড়ে থাকে। এই মেলাটাকে আমি নিজের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে রেখেছি বলেই এটা আসল মেলা। তুই যে মেলাটা থেকে এলি সেটা চলে নিজের ভরবেগে, আড়ালে থাকি আমি। আসলে এই মেলাটার কিছু না কিছু বাছাই করে ওই মেলাটা চলছে, তাই ওটা মায়াপ্রকল্প।’
বলেই কোটিকল্প হাত তুলল। সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল নতুন মেলাটা চলতে শুরু করেছে। সেখানে প্রচণ্ড ব্যস্ততা আর প্রচুর কাজকর্ম দেখা গেল। আবার সে হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল। আবার সব নিশ্চল পড়ে রইল।
‘এবার দ্যাখ্ কী করি।’
সে আবার হাত তুলল। মুহূর্তের মধ্যে ভোজবাজি ঘটে গেল। নতুন মেলা থেকে সমস্ত লোকজন, তাদের কাজকর্ম ও পসরারাজি উধাও নিমেষের মধ্যে। কেবল থাকল একজন, সে ওই গায়ক। আর কেউ নয়।
‘এই মেলাটাতে তুই কাউকে দেখতে পাচ্ছিস না আমি সরিয়ে দিয়েছি তাই। কেবল গায়ককেই রেখেছি, কারণ তুই তার গোটা জীবনটা দেখবি বলে। সে কিন্তু বুঝতে পারবে না তার সঙ্গী কেউ নেই। সে সবাইকে তার চারপাশে দেখতে পাচ্ছে তার নিজস্ব মেলার মাঠে, যেখান থেকে তুই এলি। আসলে এই নতুন মেলাটাতে তুই যা দেখছিস তার সবই আমার পরিকল্পনা। এখান থেকে কী আর কিভাবে যাবে ওই মায়াপ্রকল্প বা মেলার মাঠে তা আমিই ঠিক করি। তাই এই জাদুজগৎটা আমি চালাই সম্পূর্ণ নিজের হাতে। এখানেই আমি ঠিক করি কোন্ বিষয় বা ব্যক্তি যাবে ওখানে এবং কী তার বর্তমান ও অতীত বা ভবিষ্যৎ। সবাই ওখানে ভাবে সে চলছে তার স্বাধীন ইচ্ছেমত। আসলে এই বিভ্রম একেবারেই ঠিক নয়। আমি তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী যেভাবে ভাবাই তারা ঠিক সেভাবেই ভাবে। এটাকে তুই তাই বলতে পারিস ওটার ব্লু প্রিন্ট। দু’টো মেলা তাই কোন অবস্থাতেই এক নয় একেবারেই।’
বাপরে, সে ভাবল। ভিতরে ভিতরে যে এত সে বুঝতেই পারত না কস্মিনকালেও। এখন সে বিশ্বাস করল, কোটিকল্প আসলে সত্যিই এক জাদুকর। তার মত বড় জাদুকর সত্যিই আর কেউ নেই এই জগতে। সে একটা দু’টো নয়, একাধিক জগতের নিয়ন্তা হয়ে বসে আছে। তাকে দেখে প্রথম দর্শনে কে ভাবতে পারবে যে এত দায়িত্ব তার হাতে। নানা জগতের পরিকল্পনা আর পরিচালনা সে করে, যদি সে না চালায় সব থেমে যায়। সে চললে জগৎ চলে, সে থামলে জগৎ থামে। তার জঠরে জগৎসমূহের ইতিহাস, ভূগোল, বর্ণনা, বর্তমান, ভবিষ্যৎ আর পরিকাঠামো। জগতের প্রতিটি বস্তুর হিসেব-নিকেশ তারই নখদর্পনে, তাকে ভিত্তি করেই চলাচল আর ঘটনাসমূহের ঘটনা হয়ে ওঠা। জাদুজগতের অধীশ্বর সে এবং অন্য জগৎগুলিও তারই আয়ত্তাধীন। সে-ই সর্বত্র শেষকথা।
‘এবার নিশ্চয় তুই বুঝতে পারছিস যে জাদুজগৎটা তোর ওই মেলাপ্রাঙ্গণ নয় যেখান থেকে তোকে এখানে নিয়ে এলাম দরজা খুলে এবং যেটাকে আমি বলছি মায়াপ্রকল্প ?’
তার জন্য প্রশ্নটা রাখল কোটিকল্প, উত্তর শোনার উদ্দেশ্যে নয় যদিও সে তবু ঘাড় কাৎ করল। সেটা খুব একটা নজরে না এনেই কোটিকল্প তাকে বোঝাতে লাগল,
‘এই যে জাদুজগৎ, এটা আমার কারখানা অথবা খেলাঘরও বলতে পারিস। জগৎটা যখন তৈরি হয়েছে তাকে তো চলতে হবে ? বসে থাকার জন্য তো কিছু থাকা উচিত হবে না। তুমি যদি থাকলেই কোন না কোন দেহধারণ করে, সে তুমি জীবই হও আর জড়ই হও, তোমার চলন-বলন থাকতেই হবে। আমার এই জাদুজগৎটাতে বসে আমি কী কী বস্তু কেন কিভাবে বানাবো, কোথায় কিভাবে কেন রাখব, কী কেন কেমন হবে তাদের চলন-বলন সেসব পরিকল্পনা করি এবং সেই পরিকল্পনার বাস্তব রূপদান ঘটাই। জাদুজগতের কারখানায় বস্তুসমূহ বানিয়ে রাখি পরিকল্পনামাফিক, তাদের কার্যকলাপের ব্লু প্রিন্ট ও ডিটেল নকশা কষে মজুত করে রেখে দিই। তারপর পছন্দ অনুযায়ী তাদের প্রেরণ করি বহির্জগৎটার যেখানে যেমন দরকার হয়। তাদেরই কিছু চলে যায় তোদের ওই পৃথিবী ও সভ্যতার মায়াপ্রকল্পে।’
শুনতে শুনতে তার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। কেমন একটা পাগল-পাগল ভাব হতে লাগল। যথেষ্ট ঘাবড়ে গিয়ে সে নিজেকে বুঝিয়ে শক্ত করল, এত দ্রুত পাগল হলে চলবে না। জীবনে পাগল হওয়ার আরও বড় সুযোগ আসবে, তখন ভেবে দেখা যাবে নাহয়। আপাতত সে পাগল হবে না কোনক্রমেই। তাই সে প্রশ্ন তুলল,
‘বাপরে, তুমি কি ভগবান ?’
কোটিকল্প হাসল, সেই আবর্তনশীল হাসিসদৃশ ঘূর্ণি। অন্তর্ভেদী অথচ বিবশ স্বরক্ষেপণে জানাল,
‘তুই যদি তাই ভাবিস আমার আপত্তি নেই। তবে আমি ঠিক ভগবান নই। যতই জাদুজগৎটা থাকুক না কেন আমার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আমি কিন্তু মাঠে নেমে নিজের হাতে করি না কোনকিছুই। আমাকে নির্ভর করে সব হয়ে যায়। এখানেই আমার সঙ্গে ভগবানের মৌলিক পার্থক্য। ভগবান সব নিজে করেন, আমাকেও দরকারে চালান। ভগবান বলতে এমনই এক অস্তিত্ব বা চেতনাশক্তি রয়েছে তোদের ধারণাতে।’
সে চুপ করে সব শুনল, কথা বলল না। কী বুঝল সে নিজেও জানে না, তবে কিছু তো একটা বুঝল ঠিকই। আর নিজেকে নিজেই বার্তা পাঠাল সবকিছু বোধগম্য হয়েছে বলে। সে সমস্ত অন্তরাত্মা একত্র করে ভাবল, বোঝার আর কিছু বাকি নেই। তখন কোটিকল্প আবার বলল,
‘আয়, এবার ওই গায়কটাকেই দেখি আমরা। এখানে তুই গায়ক মানুষটার ভুত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সবই জানতে পারবি। দেখতে পাবি তার জন্ম-জন্মান্তর পর্যন্ত। শুনবি তার অন্তরের কথা—- তার বাসনা, তার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য এবং পরিকল্পনা। দেখবি তার কার্যকলাপের অনুপুঙ্খ বিবরণ, কী কেন কেমন কোথায় ইত্যাদি সমস্তকিছু। সঙ্গে থাকবে তার অন্যান্য জীব ও জড়ের সঙ্গে আচার-আচরণ, অবশ্যই অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সমস্তরকম মেলামেশা। তার সমস্ত কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য জানতে হলে তার অন্তরঙ্গ আলাপের দ্বারস্থ হতে হবে। সেটা কিভাবে সম্ভব? চিন্তা নেই, আমরা তার সমস্ত অন্তরঙ্গ আলাপ জাদুদণ্ডের অঙ্গুলিহেলনে দেখতে পাব। সে সেসব উচ্চারণ করবে তার কোন একাকিত্ব অবকাশের দুর্বলতায় নিজের সঙ্গে অথবা প্রকাশ করবে কোন আপন মনে করা সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে। আমরা সবাইকে পেয়ে যাব জাদুজগতে যেভাবে পেতে চাই, চিন্তা নেই।’
বলতে বলতে কোটিকল্প তার হাত তুলল। সে এবার এতক্ষণে বুঝল, ওই হাতটাই আসলে জাদুদণ্ড যার মৃদু নড়াচড়ায় সমস্ত কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। এবং তেমনই কাণ্ড ঘটল এবারও। সে দেখল, ওই গায়ক সচল হল ও তার পাশে এল এক সঙ্গিনী। দুজনেরই পোশাক-আশাক বহুমূল্য রত্নখচিত। নিঃসন্দেহে খুবই দামি, কোটি কোটি টাকা হবেই হবে। আর তারা উপস্থিত প্রাসাদোপম অট্টালিকার রমণীয় এক প্রকোষ্ঠে, যেখানে তারা উপবিষ্ট রাজকীয় আসবাবের আরামে এবং সম্মুখে অতীব সুস্বাদু পানীয় ও দুর্লভ খাদ্যবস্তু। সেই গায়কের হাতে যদিও তার অতি প্রিয় বাদ্যযন্ত্র যাকে সে ভাবে নিজস্ব দেহের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তার ওষ্ঠাগ্রের মুখোমুখি ধরা রয়েছে লোভনীয় পানীয়ের স্বচ্ছ সুদৃশ্য গ্লাস সেই সঙ্গিনীর হাতে। সে তাতে মৃদু চুমুক দিয়ে তার হাতের তারযন্ত্রে অঙ্গুলি সঞ্চালনে অস্পষ্ট আন্দোলন তুলতে তুলতে বলছিল,
‘মাজেনা, আমার অমর হওয়া দরকার। আমার এই কণ্ঠ, এই সঙ্গীতের স্বার্থে। আমি কিভাবে মৃত্যুকে পরাস্ত করব, বলতে পার কি ?’
তার সঙ্গিনী মাজেনা মধুর হাস্যে তাকে বোঝাল,
‘তুমি যে গান গেয়েছ তাতেই তুমি অমর হয়ে গেছ। তোমার সঙ্গীত তোমাকে ইতিমধ্যেই অমর করে দিয়েছে। তুমি তোমার ভক্তদের উন্মাদনা দেখ। পৃথিবীর কে না তোমাকে চেনে ? অমর হওয়ার কী বাকি আছে আর তোমার ? পৃথিবী না থাকলেও তুমি থেকে যাবে।’
গায়ক এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নয়। সে বলে,
‘কিন্তু আমি আমার দৈহিক সত্ত্বাকে অবিনাশী দেখতে চাই। আমার সৃষ্টির মধ্যে অমর হয়ে থাকা তো পরোক্ষভাবে বাঁচা। আমার এই শরীরের মধ্যে যে আমি সে অমর হবে কিভাবে ?’
‘সেটা কি সম্ভব ? নয় নিশ্চয়। এক হতে পারে যদি তোমার সন্তানের জন্ম দিই আমি বা অন্য কেউ। তোমার সন্তানের মধ্যে তুমি তখন বেঁচে থাকবে।’
‘এটাও একটা ধারণা। আমি নিজে কিন্তু থাকছি না।’
‘ওটা বোধহয় সম্ভব নয়। শরীরগতভাবে তুমি থেকে যাবে চিরকাল এটা ভাবা যায় না। হতে পারে তোমার জীবনকাল বেড়ে গেল, দীর্ঘজীবন পেলে তুমি। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে পার।’
‘আমার ক্লোন করে রাখা যায় না মাজেনা ? আমার ক্লোন বডির মধ্যে আমি তো অমর হয়ে থাকতে পারি ?’
‘ব্যাপারটা আমি ঠিক জানি না। তুমি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলতে পার।’
এখানেই কোটিকল্প হাত তুলল আবার। জাদুদণ্ডের কারিকুরিতে জাদুজগৎ থেমে গেল। গায়ক থাকল তার সেই সুরম্য প্রাসাদে নিশ্চল হয়ে। তার সঙ্গিনী উধাও। বাক্যহীন স্তম্ভিত জাদুজগতে সেই গায়ক ছাড়া কেবল তাদের দু’জনের উপস্থিতি। এই যে দৃশ্যপট বসে দেখল এতক্ষণ তার যে কী উদ্দেশ্য সেটা তো মাথায় ঢুকল না কিছুই। ওই গায়কের মনোগত বাসনা জেনে তার কী লাভ হল ? ধনকুবের ও খ্যাতনামা ব্যক্তিদের এমন কোটি মনোবাঞ্ছা থাকতেই পারে। এমন বিখ্যাত ব্যক্তিরা তো ভাবে জগৎ তাদের করতলগত। ভাবলে ক্ষতি কী ? সম্পদ ও যশ রয়েছে যাদের, শখ বিচিত্র ও বহুমুখী যদি না হয় তো দোষ কোথায় ? সাফল্য তাদের হাতে, তারা যা খুশি পেতেই পারে। তার মনের প্রশ্ন বা অসন্তুষ্টি মেটাতে উত্তর এল,
‘তুই তো বুঝতে পারলি না কেন দেখলাম গায়কের এই অন্তরঙ্গ আলাপ ? এতে তার জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য বোঝা যাচ্ছে। সে কী চায় ? বলবি, চাইতেই পারে। আসলে এই চাওয়াটাই সমস্ত ব্যাপার। এটাই তার মৌলিক চাহিদা। এতেই চালিত হয় সে।’
তার শুনে বেশ অবাক লাগল। প্রশ্ন তুলল,
‘চাইলেই পেয়ে যাবে ? থাক না তার যশ বা অর্থ। তাতে কি কেউ অমর হয় ?’
‘সে অন্তত তাই ভাবে। আর কে কী ভাবে পরে দেখবি। এই গায়ক ভাবে, তার সম্পদ তাকে অমর বানাবার জন্য যথেষ্ট। দ্যাখ্, সে তার জন্য কী করে।’
পরবর্তী অঙ্গুলিহেলনে স্তব্ধ পুরীতে আবার শুরু হল চলাচল। গায়ক সচল হতে এবার এসে হাজির হল অন্য আরও কয়েকজন ব্যক্তি। সেই সুরম্য প্রাসাদ নয় এখন, বোঝা যাচ্ছে খুবই উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন অত্যাধুনিক কোন এক চেম্বার, সেখানে ঝাঁ চকচকে দীর্ঘ টেবিলে মধ্যমণি হয়ে বসে সেই গায়ক আর তাকে ঘিরে রেখেছে যে ব্যক্তিবর্গ তারা নামী চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও চিকিৎসক। তারা সবাই গম্ভীর, কারণ এক প্রবল সংকট যার উত্তর চিকিৎসাশাস্ত্রে নেই আজ পর্যন্ত। এই গায়ক অমর হতে চায়, তার সত্ত্বাকে নিয়ে শারীরিকভাবে।
‘আধুনিক বিজ্ঞান য়্যান্টি-এজিং বিষয়টা সম্পর্কে কিছু জানে। তাতে দেখা গেছে জীবনযাপন প্রক্রিয়ায় কঠোর নিয়মানুবর্তী হলে এবং তার সঙ্গে বাইরে থেকে কিছু বিধান প্রয়োগ করলে জীবনকাল বেড়ে যায়, এই পর্যন্ত। এখানে নির্দিষ্ট খাদ্যাভ্যাসও দীর্ঘকাল অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা প্রয়োজন। তাতে সুস্থও থাকা যায়। তারুণ্য কতটা থাকবে সন্দেহ আছে।’
চিন্তিতভাবে বলল একজন। গায়কের ব্যক্তিগত চিকিৎসক বলল,
‘তারুণ্য বজায় রাখার জন্য অনবদ্য উপায় সার্জারি। তাতে ব্যক্তির চেহারা সতেজ-সুস্থ দেখাবে সবসময়। আর তাতে রিস্কও প্রায় নেইই।’
‘তা ঠিক। তবে শরীরের ভিতরে ধকল কিন্তু যাবে অনেকটাই।’
অন্যজন মতপ্রকাশ করল। ব্যক্তিগত চিকিৎসক বলল,
‘আমি ভাবছি শরীরের অভ্যন্তরস্থ ধকল সামলাবারও উপযুক্ত পদ্ধতি হাতেই আছে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির নবীকরণটা নিয়ে ভাবলে কেমন হয় ? এখন তো বিজ্ঞান কিডনি, লিভার, ফুসফুস, হার্ট সবই প্রতিস্থাপন করতে পারছে। সেগুলি ক্ষয় পেতে পেতে নিঃশেষ হয়ে গেলেই তো মৃত্যু হয় মানুষের। যদি সেসব নতুন বসানো যায় ?’
প্রথমজন জানাল,
‘যাই হোক, সেসব কিন্তু আসল বা মূল প্রত্যঙ্গগুলির মত কর্মক্ষম হয় না। তাছাড়া এসব প্রতিস্থাপন কতটা সংকটমুক্ত তাতেও সন্দেহ আছে।’
ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রতিবাদের সুরে জানাল,
‘আপনার এত হতাশ ও নেতিবাচক মতামত না দিলেও হবে। আমার হাতে যা তথ্য আছে তাতে আমি দেখেছি, বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রতিস্থাপন দীর্ঘকাল কোন গ্রহীতাকে সুষ্ঠ ও স্বাভাবিক রাখে। অবশ্য তা নির্ভর করে এ কাজ কোথায় কারা করবে তার ওপর। এই যে তালিকা, দেখুন।’
বলেই সে পড়তে লাগল কোথায় কত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়েছে একশ’ শতাংশ সাফল্যের সঙ্গে। সবাই শুনল তার বিবরণ। এবার প্রথম কথা বলল সেই গায়ক,
‘আমি শুনেছি ভারতীয়, আমি বোঝাচ্ছি এশিয়া মহাদেশের ভারতবর্ষকে, রেড ইন্ডিয়ানদের নয়। শুনেছি ভারতবর্ষে সাধু-সন্ন্যাসীরা অমরত্ব পেতে পারত। শুনেছি সেখানে এখনও হিমালয় পর্বতমালার কোথাও অমরত্বের অনুশীলন চলে এবং শুনেছি যে তিব্বতেও নাকি প্রচলিত আছে এমন ধারণা, বিশেষ করে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মধ্যে ?’
সবাই শুনল তার কথা। এবার তৃতীয় একজন বলল,
‘ওটা একটা বিশ্বাস মাত্র। তাতে কোন বাস্তবতা নেই। অন্তত চিকিৎসাবিজ্ঞান তাকে স্বীকৃতি দেয় না।’
‘কিন্তু শুনেছি হিমালয়ে তপস্যারত সাধুরা শ’য়ে শ’য়ে বছর বেঁচে থাকে ?’
গায়কের জিজ্ঞাসার উত্তরে দ্বিতীয়জন জানাল,
‘ওটার কোন প্রমাণ নেই। যারা এমন দাবি করে তাদের অনেকেই চিকিৎসকদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। দেখা গেছে, তারা ঠগ ও প্রতারক।’
‘তাহলে ভারতীয় যোগীদের সম্পর্কে এসব রটনা মিথ্যে ?’
হতাশ গলায় প্রশ্ন তুলল গায়ক, দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। তৃতীয়জন বলল,
‘একশ’ শতাংশ। সমস্ত বৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীন রটনা মাত্র।’
তবুও গায়ক হাল ছাড়ল না। সে প্রশ্ন করল,
‘কিন্তু বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ব্যাপারটা ? তাদের হাতে তো দীর্ঘজীবন রয়েছে শুনেছি ?’
‘সেটাও সন্দেহাতীত নয়। স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ কতদিন বেঁচেছেন ? তাঁর ভক্তকুলও কেউ তেমন দীর্ঘায়ু নয়। তেমন রেকর্ড নেইও। সবচেয়ে বড়কথা, বৌদ্ধধর্মের ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে জন্মান্তরবাদের ওপর। বৌদ্ধদের বিশ্বাস, কোন ব্যক্তি অমর হয় জন্ম-জন্মান্তরে। একটিমাত্র জীবনে অমর হতে পারে না কেউ।’
দ্বিতীয়জন উত্তর দিল। সমস্তটা পরিবেশ জুড়ে হতাশাজনক দীর্ঘশ্বাস। ব্যক্তিগত চিকিৎসক আবার আশার সঞ্চার ঘটাল,
‘তাহলে আমরা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপরই ভরসা রাখতে পারি। তারুণ্য বজায় রাখবে সার্জারি। আর ক্ষয় যাওয়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অটুট রাখবে প্রতিস্থাপন। এখনই তার প্রয়োজন নেই, আসলগুলি যতদিন কর্মক্ষম আছে। তবে আমাদের তৈরি থাকতে হবে। তার জন্য সর্বোত্তম অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দাতাদের হাতে মজুত রাখা সবচেয়ে ভাল উপায়। আপনাদের কী মত ?’
এখানে সবাই আর সহমত না হয়ে কী করে ? তাদের মতামত প্রদানের ক্ষমতাও তো কিনে নেওয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে।
তারপর একটি দাতাব্যাঙ্ক তৈরি করা হল। বেছে নেওয়া হল এমনসব মানুষকে যাদের প্রত্যেকে কিছু না কিছু নিখুঁত ও সক্ষম অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মালিক। কারো কিডনি, কারো ফুসফুস, কারো লিভার, কারো রক্ত, কারো হৃদপিণ্ড ইত্যাদি। তাদের সবাইকে মাসমাইনে দিয়ে কিনে রাখা হল যাতে তারা প্রয়োজনে তাদের বিশেষ প্রত্যঙ্গ দান করবে সেই গায়কের নিজস্ব ক্ষয়ে যাওয়া ও অক্ষম প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনে। এবার সে নিশ্চিন্ত হল কিছুটা হলেও, কারণ তাকে বোঝানো হল যে এভাবে যদি সে আরও পঞ্চাশ-একশ’ বছর বেঁচে থাকতে পারে তো ততদিনে চিকিৎসাবিজ্ঞান সত্যিসত্যিই জীবন অনন্ত রাখার কোন মোক্ষম উপায় হাতে পেয়ে যাবে।
হাত তুলল কোটিকল্প। নিশ্চল করে দিল জাদুজগৎকে। বলল,
‘দেখলি তো ওই গায়কের কাণ্ড ? তার অমরত্ব লাভের উপায় ?’
‘তাতে কি সে তার চাহিদা পূরণ করতে পারল ?’
তার প্রশ্ন শুনে হাসল কোটিকল্প, ঘূর্ণায়মান হাসি। সে আবার হাত তুলল। একই বিন্দুস্থিত থেকে এগিয়ে গেল বেশ কিছু বছর। দেখা গেল, সেই গায়ক শায়িত অন্তিম শয্যায়। তার তারুণ্যদানের প্রক্রিয়াকালীন অস্ত্রোপচারের পর পরই। তার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দাতাদের ব্যাঙ্ক থেকে গেল যেমনকে তেমনই। লোকগুলি চাকরি হারালো। কোন কাজেই লাগল না কিছু।
এটাই তাহলে জাদুজগতের ভাষ্য, সে ভাবল। এখানে দেখা যাবে, মানুষ চাইবে এমনকিছু পেতে যেখানে তার নিজেরই কোন হাত নেই। কিন্তু এতো খ্যাতিমান আর বিত্তশালী লোকদের চাহিদা। সাধারণ মানুষের চাহিদা নিশ্চয় এমন হতে পারে না ? ভেবে সে সান্ত্বনা খুঁজতে চাইল। সাধারণ মানুষ তার ক্ষমতার বাইরে গিয়ে এতো উচ্চাকাঙ্খা দেখায় না। তাদের সীমিত চাহিদা সীমিত সামর্থ অনুযায়ী। সাধারণ মানুষকেও নিশ্চয় দেখা যাবে জাদুজগতে, কারণ মেলাতে সবই তো সাদাসাপটা মানুষের ভিড়। এই মানুষরা জাদুজগতে গিয়ে কেমন দেখতে হবে সেটা জানার বড় আগ্রহ হল তার। অন্তত সে ভাবল, মেলার আর পাঁচটা অসাধারণ মানুষেরও এমন উদ্ভট বাসনা থাকতে পারে না, যতই মায়াপ্রকল্পে থাকুক না কেন সবাই। সে এখন সেটাই জানতে চায়, মেলায় থাকা অন্য লোকদের চাহিদা কী বা কেমন। বললও তাই,
‘আমি সাধারণ লোকদের জীবনযাপন প্রক্রিয়া দেখতে চাই।’
অধ্যায়: দশ
তারা একবার তাকে বলেছিল,
‘চল আমাদের সঙ্গে আমাদের গ্রামে, বড়া ভাঙ্গালে। ওখানে নাহয় শীতকালটা থেকেই এলে। আর যদি অতদিন না থাকতে চাও তো তোমাকে আমরা পৌঁছে দেব মানালি বা কুলুতে, চাইলে বির বা ধরমশালাতে আমাদের দায়িত্বে। ওখানে গেলে তুমি বাস পেয়ে যাবে তোমার এখানে আসার। অবশ্য ওই শীতকালে তুমি এখানে আসতেও পারবে না, কারণ এখানে তখন ভয়ানক দুর্যোগের জন্য যাতায়াত বন্ধ থাকবে। তোমাকে থেকে যেতে হবে মানালি বা ধরমশালা বা অন্য কোথাও। সেটা একটা সমস্যা বটে। তার চেয়ে আমাদের সঙ্গেই থেকে যাবে গোটা শীতকালটা। তোমাকে পেলে আমাদের ভালই লাগবে। যদি দু’দিন থেকে ভাল না লাগে তোমার শীতের আগে-আগে সব বন্ধ না হতেই চলে যেতে পারবে। আমরা আবার এখানে চলে আসব এপ্রিল-মে মাসে। চাইলে আসবে আমাদের সঙ্গেই। চল না একবার।’
বড়া ভাঙ্গাল কাংড়া জেলার বৈজনাথ তহশিলে এক প্রত্যন্ত গ্রাম যেখানে আধুনিক যাতায়াত ব্যবস্থা নেই, ট্রেক করে যেতে হয়। প্রখর গ্রীষ্মে তাপমাত্রা কুড়ি ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি, আর্দ্রতা ষাট শতাংশের মত। মনোরম আবহাওয়া তখন। বৃষ্টি হয় প্রায়ই। উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠের তুলনায় তিন থেকে সাত হাজার ফিট বেশি। বড়া ভাঙ্গাল শব্দটির মধ্যে রয়েছে ‘ভাঙ্গ’ শব্দ, যা আসলে শিবের প্রিয় নেশাদ্রব্য। কাংড়া জেলার ধরমশালা, পালামপুর, বৈজনাথে থাকে গাদ্দি উপজাতির লোকরা। চাম্বা জেলার ভারমার ছাড়াও জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যেও থাকে একদল। কৈলাশ পর্বত উচ্চতায় আঠেরো হাজার পাঁচশ’ ফিট। এই পর্বতের চারপাশের অঞ্চলেই তাদের বসবাস দুর্গম এলাকার গ্রামগুলিতে। পীর পাঞ্জাল ও ধওলাধর পার্বত্যাঞ্চলের মধ্যবর্তী প্রতিকূল পরিবেশে ইরাবতী ও চন্দ্রভাগা নদীযুগলে ঘেরা এলাকায় তারা থাকে, শীতে প্রবল বরফপাত সভ্য দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে তাদের। ঘন ও নিবিড় জঙ্গলের প্রাবল্যে ছাওয়া গ্রামগুলি। তাদের নিজস্ব ভাষার নামও গাদ্দি এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা ব্যবহার করে এখনও তাংক্রি লিপি, যদিও আধুনিক প্রজন্ম সেসব ভুলে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে হিন্দি ভাষার জালে। সংস্কৃতে গাব্দিকা বলে একটি উপজাতীয় অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া যায় পাণিনির বিখ্যাত অষ্টধ্যায়ো গ্রন্থে। তারাই এখন গাদ্দি উপজাতি।
সে প্রস্তাবটা শুনে ভাবল, গাদ্দিদের সঙ্গে তাদের গ্রামে গিয়ে থেকে আসা যেতেই পারে। তার দিনযাপনের চাহিদা নিম্নতম, কোন অসুবিধেই হবে না তাদের গ্রামে কয়েকমাস থেকে গেলে। সে শুনেছে, তারা তাদের গ্রাম থেকে গ্রীষ্মের শুরুতে যে পথ ধরে এখানে আসে তা যথেষ্ট দুর্গম হলেও উত্তেজনায় ঠাসা। পথ চলে পাহাড়ের ঢালে ঢালে সরু ভাঙাচোরা ধার ধরে, খাদের গা ঘেঁষে। খানিক অসতর্কতা জীবন নিয়ে নিতে পারে। একের পর এক খরস্রোতা জলধারা পেরিয়ে যেতে হয়, তারা হয় ঝরনা নয় নালা অথবা সরু পাহাড়ি নদী। গোটা পরিক্রমার পথ প্রায় জনশূন্য, প্রকৃতির নিজস্ব কোল ধরে এগিয়ে চলা, গিরিশৃঙ্গের গা ঘুরে ঘুরে অথবা পাকদণ্ডী বেয়ে। দিনের পর দিন চলা, রাতে বিশ্রাম। এখান থেকে যেতে বেশ কয়েকটি গিরিসংকট বা পাস্ পেরিয়ে যেতে হয়। গাদ্দিদের সঙ্গে আলোচনায় সে জেনেছিল পথের বিবরণ। তার মনে হয়েছিল, ওই দুর্গম পাহাড়ি পথ কষ্টদায়ক হলেও উন্মাদনায় ভরপুর।
সে রাজি হয়ে গেল, তাদের আন্তরিকতা দেখে। এমন প্রাণিত নিমন্ত্রণ কি অগ্রাহ্য করা যায় ? খানিকটা কুণ্ঠা থাকলেও তা দমন করে সে জানাল তার সিদ্ধান্ত। পবন আর ভৈরব দুই ভাই। তাদের বাড়ি বড়া ভাঙ্গালের গ্রামে। শীতকাল বিদায় নিলে গ্রীষ্মের সূচনায় তারা গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে ভেড়ার পাল নিয়ে। শুধু ভেড়াই নয়, সঙ্গে থাকে বেশ কিছু ছাগলও। আর থাকে এই বিশাল দলের রক্ষী হিসেবে কুকুর। প্রধান জীবিকা তাদের কৃষি হলেও ভেড়া চরানো হচ্ছে প্রথাগত ও পবিত্র জীবিকা। এই কাজে যুক্ত ছিল তাদের পিতা-পিতামহ ও পূর্বপুরুষ। একটি নির্দিষ্ট পথ ধরে প্রত্যেক বছর আসে তারা এই নির্দিষ্ট অঞ্চলে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এটাই বর্তনদারি অধিকার। আর সেই অধিকার তারা মনে করে জঙ্গলের জমির ওপরও আছে তাদের, যাকে কেড়ে নিয়েছে সরকার। ক্ষোভ খানিকটা আছে ঠিকই তার জন্য, তবুও তারা সদাপ্রসন্ন।
শীত প্রায় দোরগোড়ায়। এখনই এই উপত্যকা ছেড়ে যাওয়ার উপযুক্ত সময়। আর এক-দু’দিনও দেরি করলে ঘরে ফেরার পথ বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে, শৈত্য ঝঞ্ঝা শুরু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। পবন বড়, ভৈরব ছোট। গাদ্দি মেষপালকরা এমনই জোড় বেঁধে বেরিয়ে পড়ে ঘর ছেড়ে। দু’-ভাই ছাড়া পিতা-পুত্র জুটিও হতে পারে। আবার ভাড়াটে সঙ্গী নিয়েও আসে কেউ কেউ। যাই হোক, শীতকাল শুরু হওয়ার মুখোমুখি এইসব প্রান্তরবাসীরা তাদের ভেড়ার পাল নিয়ে ফিরে যায় ঘরে, তুষারপাত ঘটার আগে আগেই।
ভৈরব এসে বিকেলে তাকে জানিয়ে গেল যে পরদিন সকাল-সকাল যাত্রা শুরু হবে তাদের। যেন সেও তার সঙ্গে যা নেওয়ার নিয়ে তৈরি হয়ে থাকে। তখন বিকেলের গা থেকে রং চলে গিয়েছিল। সন্ধে আসার মুখে প্রকৃতি কেমন ধূসরবর্ণ হয়ে ওঠে। একটি ছোট পাথরের ওপর সে বসেছিল। একটু পরই অন্ধকার আচ্ছন্ন করে দেবে গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গিরিশৃঙ্গগুলির সারিবদ্ধতাকে। আকাশের তীব্র নীল তন্দ্রালু হতে হতে লক্ষ তারার কথা বলার প্রাবল্যে হারিয়ে যাবে। যুগ-যুগান্ত আগে যে দেবতারা এখানে ঘুরে বেড়াত তাদের কথা এখনও হাওয়ার শব্দে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তা সে অনুভব করে। ভৈরব এই একটু আগেও ছিল। কথা বলছিল তার সঙ্গে। জানাচ্ছিল তার ও তার বড় ভাই পবনের তরফ থেকে তাদের কৃতজ্ঞতা, যেহেতু সে তাদের সঙ্গে যেতে রাজি হয়েছে। তার বড়োই অবাক লাগে। এদের সঙ্গে কোন জন্মেই তার চেনা ছিল না। অথচ এত অল্পদিনেই এত আপন হয়ে পড়ল তারা কোন্ কৌশলে ? আড়ালে বসে খেলছে কোন্ অদৃশ্য কারিগর কেজানে ? তার দেখা পাওয়া যায় না ঠিকই, তার খেলা অনুভব করা যায়। সে কথা বলায় মানুষ আর প্রাণিদের, কথা বলায় পাহাড়-পর্বত-নদী-পাথরকে। এই কথা বলা যে বুঝতে চায় বোঝে, যার আগ্রহ নেই সে মনে করে সে ছাড়া আর কেউ কথা বলতে জানে না।
তার জিনিসপত্র ? দু’টি গিরিশিরার মধ্যবর্তী বড় বড় পাথরের অন্তরালে যে গুহায় তার নৈশ আশ্রয় সে খুঁজে নিয়েছে সেখানে আছে অবশ্য কিছু একান্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। সে ভাবল, আর বসে না থেকে বরং সেসব ভরে নেওয়া যাক ঝোলাতে। এমনিতেও আর কয়েকদিনের মধ্যেই তাকে এই গুহাগৃহ ছেড়ে চলে যেতে হবে কোনও গ্রামে বা মঠে, যেখানে শীতকালটা কাটানো যাবে। এবার নাহয় হলোই বা অন্যরকম অভিজ্ঞতা। চলে যাওয়া যাক বড়া ভাঙ্গালে তার এই গাদ্দি বন্ধুদের গ্রামে। পাথরের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। পায়ে পায়ে গিয়ে হাজির হল গুহার মুখে। পাথরের আড়াল কাটিয়ে এঁকেবেঁকে ঢুকল গুহার ভিতর। অন্ধকার জাঁকিয়ে বসেছে সর্বত্র। সে অবশ্য অভ্যস্ত, রাতের অন্ধকারকে পছন্দই করে। সেখানে সে দেখতে পায় লুকিয়ে থাকা নানান সম্ভাবনার বীজকে। হাওয়ার অদৃশ্য চলাচলে শোনা যায় দৈববাণীর ফিসফিসানি। আর থাকে আকাশভর্তি তারারা, মনে হয় তারা এত কাছাকাছি যে হাত বাড়ালেই ছোঁওয়া যাবে। তারা নিজেরা নিজেরা আলাপচারিতায় মগ্ন থাকে। সেও তাদের সঙ্গে অন্তরের ভাষায় আলাপ করে নিঃশব্দে। তাদের সাড়া স্পষ্ট সে শুনতে পায়। তবে এখন সে গুহায় গিয়ে একটা মোম জ্বালাল। তার একমাত্র ঝোলাটির মধ্যে ভরে নিল যা যা সম্বল—- বাড়তি পোশাক, মোম-দেশলাই, কিছু শুকনো খাবার ইত্যাদি। সব গুছিয়ে নিতে দশ মিনিটও লাগল না। তারপর সে মোম নেভাল। আবার গুহা ছেড়ে বেরিয়ে এল খোলা প্রকৃতির বুকে।
পরদিন খুব ভোরে যাত্রা শুরুর তোড়জোড়। সে তার আগেই চলে গিয়েছিল পবন আর ভৈরবদের ডেরায়। গিয়ে দেখে, ভেড়াদের তৈরি করছে দু’ভাই মিলে। কুকুরগুলি ছুটে ছুটে সাহায্য করছে তাদের কাজে। যেসব ভেড়ারা তখনও ঘুমিয়ে তাদের কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে ঠেলে তুলল কুকুরেরা এবং যারা এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল তাদের বাধ্য করল সারিবদ্ধ হতে। এভাবে সমস্ত ভেড়া আর ছাগলেরা মিলে একটি লম্বা সারি তৈরি হল। সে যেতে দু’ভাই এগিয়ে এসে অভিনন্দন জানাল তাকে এবং বলল যে আজ অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হবে। লক্ষ্য দিনে দিনেই হামতা গিরিপথে পৌঁছে যাওয়া। ভেড়ার দলকে তৈরি করার পর প্রাতঃরাশ সেরে নিল সবাই মিলে। তেমন কিছু আহামরি নয় খাদ্যোপকরণ, সাধারণ বার্লিচূর্ণ মাত্র। তাই খেল তিনজনে। আর সে তার ঝোলা থেকে কিছু শুকনো ফল বার করল সবার জন্য। তারপর যাত্রা শুরু। তখনও সূর্যের দেখা নেই। আবছা দেখাচ্ছে চারপাশ। হুইসেল বেজে উঠল ভোরের নিস্তব্ধতা খান খান করে। এবার ভেড়ার দল নিয়ে কেবলই এগিয়ে যাওয়া। যেতে যেতে কথাও হচ্ছিল। পবন বলল,
‘কত পুরুষ ধরে আমরা এখানে আসছি সে হিসেবে নেই আমাদেরও। শুনেছি অনেক আগে আমাদের পূর্বপুরুষ তিব্বতেও চলে যেত। এখন আর ওখানে যাওয়ার উপায় নেই, কারণ তিব্বত এখন বিদেশ।’
কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলা। সূর্য ওঠার আগে পর্যন্ত ঠাণ্ডার প্রকোপ যথেষ্ট ছিল। গায়ে চাদর জড়িয়ে নিয়েছিল তারা। ভেড়ার দল যাতে চলার পথে বিশৃঙ্খলা না সৃষ্টি করে কুকুরের দল সেই পাহারায় ছিল। দুপুরে পাহাড়শৃঙ্গে ঘেরা এক চাতালে বসে আবার খেয়ে নেওয়া এবং বিশ্রাম। খাবার মানে সেই বার্লিচূর্ণ আর তার ঝোলা থেকে বার করা শুকনো মিষ্টি। খেতে বেশি সময় নেওয়া হল না। আবার চলা শুরু। পবন বলছিল,
‘আমাদের ছেলেরা আর এই পেশাতে থাকতে চায় না।’
তার হতাশ গলায় আক্ষেপের সুর। সে কারণটা জানতে চাইল। উত্তরে পবন জানাল,
‘আসলে কী জান, আমাদের ছেলেরাও শহরে গিয়ে সেখানকার চাকচিক্য দেখে ওইরকম শহুরে জীবনকেই পছন্দ করছে। তারা আর ভেড়ার পাল নিয়ে প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতে চায় না। তারা চায়, পড়াশুনা শিখে চাকরি করবে। সবাই অন্য সব পেশায় চলে যাচ্ছে। কেউ হচ্ছে গাইড, কেউ টিচার, কেউ লেবার এমনই সব। শহুরে হাওয়া ঢুকেছে গ্রামেও। আমাদের পুরোনো দিনগুলি হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামে এসে গেছে কথা বলা যন্ত্র, ওই যাকে বলে মোবাইল।’
তার গলায় কি দুঃখের আভাষ ? বোধহয় সে মেনে নিতে পারছিল না গ্রামে আধুনিকতার প্রবেশ, পিতৃ-পিতামহের সযত্নলালিত জীবনযাপনের নিয়ম তাতে হারিয়ে যাচ্ছে। তার ভাই ভৈরব বলল,
‘সরকারও চায় না আমাদের এই পেশা থাকুক। জঙ্গল ছিল আমাদের, সরকার এসে তা কেড়ে নিয়েছে। সরকারি লোক বলে দেয় আমরা কোন্ পথ ধরে যাব, আমাদের চালু পথ বন্ধ করে দিচ্ছে। কোন্ ঘাসজমিতে যাব, গিয়ে কতদিন থাকব তাও ঠিক করে দেয়। বনদপ্তর আবার প্রত্যেক ভেড়া ও ছাগলের জন্য ট্যাক্স নেয়। আবার ওই যে একদল লোক হয়েছে, যারা পরিবেশবিদ, তারা বলে আমাদের জন্য পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। সেই সুদিন আর নেই তাই এখন। ছেলেরা তাই অন্যকিছু করতে চায়।’
তাদের সুখদুঃখের আলাপের সঙ্গে সে একাত্ম হয়ে যায়, তাদের আক্ষেপ সে নিজের মনে করে। এই অঞ্চলের ইতিহাস থেকে সে জানে যে ব্রিটিশ রাজত্বে আঠেরোশ’ পঁয়ষট্টি সালে চালু হয়েছিল ইন্ডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্ট যে আইনবলে কাংড়া জেলার জমিবন্টন ঠিক হয় এবং সংরক্ষিত বনভূমির কথা ঘোষণা করে বিদেশী সরকার ভূমিপুত্রদের জানিয়ে দেয় যে সরকারই বনাঞ্চল, জমিজমা, নদীনালা, পাহাড়-পর্বতের প্রকৃত মালিক। কোন ঈশ্বর বা প্রাকৃতিক শক্তি অথবা কোন মানবপ্রজাতি কিংবা উপজাতির পিতৃপুরুষ কোনকালে এ সমস্ত কিছুর অধিকারী ছিল না বলে তাদের উত্তরপুরুষেরও এসবে কোন নিজস্ব অধিকার নেই। পৃথিবীর একেকটি দেশ একেকটি ভৌগোলিক সীমারেখা দিয়ে নির্ধারিত এবং সেই দেশের সরকার সেই সীমানাস্থিত সমস্তকিছুর একচ্ছত্র অধিকারী, বাসিন্দাদেরও অবশ্যই। যদি তুমি যে দেশের সীমানায় বসবাস কর তার বিধিনিয়ম না মান তাহলে তুমি দেশদ্রোহী বলে বিবেচিত হতে পার। তুমি কে, কী ছিল তোমার অতীত আধুনিক সভ্যতা তা গ্রাহ্য করে না। যে যুগের যা নিয়ম তাই তোমাকে মানতে হবে এবং এখানে কেউ ভূমিপুত্র নয় ও কেউ কোন অঞ্চলের মালিক হতে পারে না উত্তরাধিকার সূত্রে। গাদ্দিরা ভাবত, এলাকার সমস্ত বনাঞ্চল ও চারণভূমি স্বয়ং দেবাদিদেব শিব তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন।এখন তারা ব্যাপার দেখে বোকা বনে গেল। শিব কোথায়, সরকার তো মনে হচ্ছে তাদের পালনকর্তা। এটা মানতে তাদের কষ্ট হলেও না মেনে উপায় ছিল না। মানুষ যত সভ্য হতে থাকে তত তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়, স্বাভাবিক নিয়ম, প্রাচীন প্রথাসমূহ সভ্যসমাজে চলতে দেওয়া যায় না। তাহলে তো আদিমানৰ গোষ্ঠীর নরমাংস ভোজনকেও মেনে নিতে হয় ! নিয়মের বেড়াজাল ও আইনকানুন যত বেশি চালু হবে ততই জগৎ বুঝতে পারবে যে সভ্যতা এগিয়ে চলছে। সেসব আইন কারা বৃদ্ধাঙ্গুষ্টি দেখাবার কৌশল বা ক্ষমতা করায়ত্ত করতে পারছে কি পারছে না তার নিরিখে সভ্যতার অগ্রগমন যাচাই করা অনুচিত। মোটকথা হল, ওই আইনবলে এটাই গাদ্দিদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে এখন থেকে কর্তৃপক্ষ ঠিক করে দেবে কে কোন্ চারণভূমিতে যাবে এবং কোন্ কোন্ অঞ্চলে বা কোন্ কোন্ পথ ধরে। বনাঞ্চল বা চারণভূমির ওপর আর তাদের বর্তনদারি অধিকার বা প্রথাগত দখল রইল না। দেশ স্বাধীন হল। দেশে প্রতিষ্ঠিত হল দেশীয় সরকার। কাংড়া জেলা চলে এল দেবতাদের নিজস্ব চারণভূমি হিমাচল প্রদেশের অধীনে প্রাক্তন পাঞ্জাবের অধিকার থেকে। গাদ্দিরা কী আশা করল, কী পেল ? উনিশশ’ বাহাত্তর সালে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে আবার এক আইন জারি হয়ে ভেড়াদের পাল কতবড় হতে পারবে সেই আকার জানিয়ে দেওয়া হল আর বলা হল, যেহেতু সরকারের মালিকানাধীন চারণভূমি তারা ব্যবহার করছে তাই প্রতিটি ভেড়া ও প্রতিটি ছাগলপিছু তাদের কর দিতে হবে সরকারকে এবং প্রত্যেকটি দলকে দেওয়া হবে সরকারের তরফ থেকে পারমিট বা অনুমতিপত্র যা প্রতিবছর পুনর্নবীকরণ না করলে তার সেই পথ বা চারণভূমি সরকার ইচ্ছে হলে অন্যকে দিয়ে দিতে পারে। বিদেশি শাসকদের জারি করা আইন তো তারা চলে যাওয়ার পরও বহাল রইল, উপরন্তু গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে এল এই নতুন আইন যাতে ভেড়া চড়িয়ে যে স্বল্প আয় হয় তারও হিস্যা দাবি করল সরকার। তার চেয়েও বড় কথা, এই নতুন আইন গাদ্দিদের মধ্যে লোভী হওয়ার এবং বিভেদ সৃষ্টি করার বীজ গুপ্তভাবে সুকৌশলে বুনে দিল, তাদের সামনে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটাবার সম্ভাবনা সৃষ্টি করল যা তারা এতদিন জানত না। মানুষ যতই ভাল হোক, যতই আদিম উপজাতিরা নিজস্ব নিয়মে সৎ ও বিশ্বাসী থাকতে চেষ্টা করুক না কেন সরকার যদি তাদের অসৎ হওয়ার ইন্ধন জোগায়, সভ্য দুনিয়া যদি বিষপানে প্রলুব্ধ করে নতুন প্রজন্মকে নতুন প্রযুক্তির ওপরদেখানো মোহে তারা আর কতকাল খাঁটি থাকবে ? থাকে না কেউ চিরকাল। একটু চোখকান খোলা রাখলেই সবাই দেখতে পাবে কোন পার্বত্য শহর যা সভ্য মানুষের আনাগোনা শিখেছে জীবনের আধুনিক চালচলনে তারা আর কতটা সৎ আছে। হাতের কাছেই এমন জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত অনেক দেখা যাবে। এই নতুন আইনের চক্রজালে পড়ে কোন গাদ্দি মেষপালকের মনে হতেই পারে যে তার বন্ধু অন্য মেষপালকের পথ ও চারণভূমি বেশি লোভনীয় এবং সরকারের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় রয়েছেই তার বন্ধু বিপদগ্রস্ত হলে আর সে তার পাশে না দাঁড়ালে তার অধিকার সে নিজের দখলে পেতে পারে। তবুও গাদ্দিরা ওই প্রলোভনে এখনও পর্যন্ত প্রভাবিত হয়নি। সরকারের কাজেকর্মে তাদের পিতৃপুরুষ লালিত বিশ্বাসভঙ্গের পরও তাদের মধ্যে আছে কেবল দুঃখ আর আক্ষেপ, রাগ নেই। তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না নিজস্ব রাজ্য বা স্বায়ত্ত্বশাসনের কথা। এই দৃষ্টান্ত একটাই নয়, দশকের পর দশক ধরে সারা বিশ্ব দেখেছে এবং দেখছে এমনই কিছু উগ্রপন্থীদের রাগ আর হিংসে স্বভূমির দাবিতে। সেসব গাদ্দিরা জানেও না দেখতে যায়ও না। কিন্তু তাদের নতুন প্রজন্ম ? যারা শহরের সংস্পর্শে আসছে অন্যপেশার নেশায়, যারা শিক্ষার অন্তরালে বিষপান করে চলেছে ? যারা আন্তর্জালিক প্রযুক্তি আর কথা বলা যন্ত্রের ভোজবাজিতে মুগ্ধ হচ্ছে ? আসলে জানার পরিধি যত বাড়বে ততই বেশি সমস্যা সৃষ্টি হয়। এটা সভ্যতার নিয়ম। তবুও গাদ্দিরা এখনও পর্যন্ত নিজেদের সেই নিয়ম থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছে এটাই বড় সৌভাগ্যের কথা। কতদিন পারবে, সেই নেতিবাচক চিন্তা ভুলে গিয়ে বরং ইতিবাচক বিষয়টাই দেখা যাক। সভ্য মানুষ তাদের অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের বনাঞ্চল ও চারণভূমি থেকে উৎখাত করার পরও সেই সভ্য পৃথিবীর প্রতিনিধিস্বরূপ যে ট্রেকার বা পর্বতারোহীরা তাদের ভূখণ্ডে যায় তারা সবাইকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানায় এবং তাদের সাধ্যমত খাবার না খাইয়ে ছাড়ে না, এতটাই অতিথিপরায়ণ তারা। আসলে একটু আগে কলুষিত যেসব পার্বত্য শহরের প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হল তা শুধু সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে যে জগতে চিরকালই চোরের মায়ের বড় গলা। যেসব উগ্রপন্থী অধিবাসীরা কোন অঞ্চলকে যখন তাদের স্বভূমি বলে দাবি করে তখন তারা কি দেখে তারা মূলত ছিল কোথায় বা কিভাবে সেখানে তারা এসেছিল ? অথবা তারা তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অন্য কাউকে তাদের স্বভূমি থেকে উৎখাত করছে কিনা। কেবল তারাই নয়, এ জবাব দিক তারাও যারা তাদের পক্ষে জনমত তৈরি করে। সারা পৃথিবীকে তাহলে বলতে হবে বলতে হবে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলি থেকে রেড ইন্ডিয়ানরা গেল কোথায় বা কেন। এবং একই প্রশ্ন থাকবে আফ্রিকার সাভানা ঘিরে রাখা দেশগুলির কাছে, মাসাই অথবা বুশম্যানদের কী হল। আসলে গায়ের জোর যারা দেখায় তারা একটা কথা জানে না বা জানতে চায় না যে জগতে সবাই উড়ে এসে জুড়ে বসা। গাদ্দিদের প্রাক্তন পুরুষদের অধিকারেও হাত দিয়েছে উড়ে এসে জুড়ে বসা সভ্য মানুষ।
পবন, ভৈরব ও তাদের ভেড়ার পালের সঙ্গে সে চলছিল রুক্ষ, শুষ্ক স্পিতি ভূখণ্ডের গায়ে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এক রহস্যময় পথরেখা ধরে। খোলা আকাশের বিশুদ্ধ নীল এবং ধারে ধারে পাহাড়ের খাদ বা শৃঙ্গদেশের গা আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বা ঝুলন্ত পাথরের গুহাসদৃশ টানেলে হাওয়ার চলাফেরায় কী কথা কানাকানি চলছিল তা আর এখন বোঝার উপায় নেই, যেহেতু তার সামনে এখন পার্থিব কণ্ঠগুলি সজীব ও সক্রিয়। সে প্রকৃতির গোপন কথা শোনে যখন নিঃসঙ্গ থাকে, যখন অন্য আওয়াজের সংস্পর্শ পায় না। এখন তার কানে থাকছে নানারকম সাংসারিক আলাপ, এমন পরিস্থিতিতে নীরব দেবতাদের অথবা প্রকৃতির কণ্ঠ শোনার পরিবেশ থাকে না। তবে সনাতন শাস্ত্রীয় বাণী অন্তরস্থ করে সে জানে যে কোন শব্দই অগ্রাহ্য করার নয়, কারণ সমস্ত শব্দই মহাজাগতিক আদিতম বিস্ফোরণে জাত, যেখানে রয়েছে অনন্ত ব্রহ্মরূপ শব্দসসমূহের মূল নিনাদ বা প্রতিধ্বনি। তাই সে উপভোগ করছে পার্বত্য ঢালের সংকীর্ণ পথ ধরে চলমান ভেড়ার দলের সম্মিলিত খুরের আওয়াজ, তাদের ঘন ঘন ব্যা-ব্যা ডাক আর গলায় বাঁধা ঘন্টাগুলির টুং-টাং ধ্বনি। আর তাদের পাহারায় থাকা লোমশ গা-ওয়ালা কুকুরগুলির ঘেউ-ঘেউ স্বর এবং নানা কারণে পবন বা ভৈরবের বাজানো হুইসেলের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। চলার পথ কতটা মনোরম হতে পারে সে তা সমগ্র অন্তর দিয়ে বুঝল যখন সকালবেলা তারা পেরিয়ে যাচ্ছিল হামতা গিরিপথ। ঈশ্বর কী যত্নে কী পরম মমতায় সাজিয়ে রেখেছে তার পার্থিব উদ্যান। হামতা গিরিদ্বার ঘিরে রেখেছে দূরে দূরে স্থায়ী বরফে ঢাকা হিমশৈল, শিশু সূর্যের জন্ম নেওয়া সেখানে ঘোষিত হচ্ছে আগুনরঙা গনগনে আভায়। যাওয়ার পথে এক জায়গায় প্রশস্ত বালির চত্বর বালু কা ঘেরা নাম, আর পার হতে হল উচ্ছ্বসিত শুভ্রধবল হিমশৈলজাত পার্বত্য নালা, বোল্ডারে বোল্ডারে ধাক্কা খেতে খেতে চলেছে যাদের হিমশীতল জলধারা তীব্রবেগে। গিরিদ্বারের ওপর রীতিমত এক বালির সমুদ্র, মরুভুমি বলেই ভ্রম হয়। তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার পথরেখা চেনে পবনরা, কেবল তারাই জানে। পাহাড়শৃঙ্গের শায়িত ঢালের গা মনে হয় সবুজাভ এবং প্রস্তরাকীর্ণ সরু উপত্যকার পথে পথে কালচে লাল ঝুঁটিওয়ালা বুনো পার্বত্য ফুলের শোভা চতুর্দিকে। চোদ্দ হাজার ফিট উচ্চতায় গিরিদ্বার দু’টি ভিন্ন জগতের মধ্যে দেয়াল তুলে রেখেছে। একধার তার নগ্ন পাহাড়গাত্র নিয়ে শীতল পার্বত্য মরুভুমি স্পিতি উপত্যকা এবং অন্যধারে রয়েছে সবুজ কুলু উপত্যকা, যেখানে আছে আপেল উদ্যান, দেওদার ও ওক, বার্চ ইত্যাদি গাছের জঙ্গল। ওই কুলু উপত্যকাই পবন ও তার পালের লক্ষ্য। গিরিপথ ধরে শুষ্ক স্পিতি উপত্যকা ছাড়িয়ে তারা সবুজ কুলুভ্যালি যাওয়ার পথে দেখে গেল চন্দ্রতাল লেকের শোভা, নগ্ন ও মৌন রক্তাভবর্ণ হলদেটে ধূসর তরঙ্গায়িত পাহাড়ের ঢাল দিয়ে ঘিরে রাখা নীলবর্ণ জলের গোলাকার বৃত্ত। দেবকন্যারা কি এখানে জলবিহার করে এখনও, ভাবল সে। হামতা গিরিদ্বারের ওপাশে পথরেখা চলে গেছে সবুজ সংকীর্ণ প্রান্তর ধরে, দু’পাশ ছাওয়া সবুজ পাহাড়ি ঢালে। সেই সবুজ জনশূন্য পার্বত্য প্রান্তরের আপন কোলে দেখা গেল মুক্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে বুনো ঘোড়া ও পনিদের দল। এই অপরূপ দৃশ্য আর কোথায় পাওয়া যাবে ?
রাতে উপত্যকার বুকে খোলা আকাশের তারাদের তলায় তাঁবু খাটিয়ে নিল তারা। তাঁবুর সামনে আগুনের কুণ্ড জ্বালিয়ে রাখল। ভেড়া এবং তাদের পাহারায় সারারাত সজাগ থাকবে প্রহরী কুকুরগুলি, তাদেরও দেখে মনে হচ্ছিল কতকালের চেনা, বুঝিবা অন্য কোন চেহারার দেবদূত। আগুনের কুণ্ডের পাশে বসে তিনজন। ছাগল দুইয়ে দুধ নিয়ে আসে ভৈরব। বার্লি দিয়ে রুটি বানানো হয়, দুধ আর রুটি খায় তারা। খেতে খেতে গল্প তাদের। পবন বলে,
‘সরকার আমাদের কথা ভাবতেও পারে। কেউ তো ভাবে না। বনদপ্তরের খাকি পোশাক পরা সরকারি গার্ডরা এইসব বনে-প্রান্তরে আমাদের ওপর চোখ রাঙ্গায়। আবার ভেড়ার পাল নিয়ে যেতে হয় মাঝেমধ্যেই সরকারের বানানো পাকা রাস্তা ধরে। সেখানে গাড়ির ড্রাইভাররা বিরক্ত হয় তাদের থেমে যেতে হয় বলে। পর্যটকরা ভাবে, এখানে এসব জংলী আপদগুলি আসে কেন ! খাকি পরা ট্রাফিক পুলিশরা চোখ রাঙ্গায়। আমরা কোথায় যাই বলতো ? তাই ছেলেরা আর এই পেশায় থাকতে চাইছে না। আবার দেখ, ভেড়ার গা থেকে যে উল পাই, যে মাংস পাই, ছাগলরা যে চামরা দেয় তা ভাল দামে বেচার কোন জায়গা নেই। আমরা বাধ্য হই কম দামে স্থানীয় বাজারের ব্যবসায়ী আর দালালদের কাছে তা বেঁচে দিতে। এই তো আমাদের অবস্থা।’
সে নিঃশব্দে শোনে তাদের দুঃখের কথা। কোন শব্দ উচ্চারণ করে না। শোনে নিঃস্তব্ধ রাতের অন্ধ ঢাল, নির্জন ও সংকীর্ণ উপত্যকার গা আর এক আকাশ ভর্তি তারকার দল। হিম হাওয়া খেলা করে যেতে যেতে বুঝিবা একটু চুপ করে থেমে শোনে, কুকুরগুলি কখনো কোন অপার্থিব শিহরণ উপলব্ধি করে সাড়া দিয়ে ওঠে নিজেদের অজান্তে, ‘ভৌ-ভৌ’। জ্বল জ্বল জ্বলতে থাকা শুকনো কাঠের আগুনে আধিভৌতিক দেখায় নিজেদেরই অবয়ব। এক স্বপ্নাচ্ছন্ন মায়াবী রাতের অবিশ্বাস্য প্রহরে তারা গল্প করে। ভৈরব জানায়,
‘আমাদের পূর্বপুরুষ নিজেদের ধর্ম, ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্য রক্ষার তাগিদে পালিয়ে এসেছিল এই পাহাড়ি জঙ্গলে সমতল থেকে। তখন সরকার কোথায় ? আমাদের অনেকেই আবার ভাবে তাদের পূর্বপুরুষ ছিল আলেকজান্ডারের সৈন্যবাহিনীতে।’
সে বোঝাতে চায় গ্রিক সাম্রাজ্যপিপাসু সম্রাট আলেকজান্ডারকে। সমতলে যখন ছিল তখন যেমন এখনও তেমনি তাদের মধ্যে রয়ে গেছে জাতপাত। তারা সেই প্রাচীন সংস্কৃতি এখনও লালন করে। তারা কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ ক্ষত্রিয়, কেউ রাজপূত ভাট ব্রাহ্মণ, যেখান থেকে এসেছে ভট্টাচার্যরা। পুরোনো এইসব প্রথা ও গৌরব আর কতদিন বজায় থাকবে ?
এই অবিশ্বাস্য পরিবেশে এই রাতকে মনে হয় অলৌকিক, বুঝিবা অন্য কোন গ্রহে উপস্থিত তারা সবাই গল্পে মত্ত। রাতের বুকে ঘুরে বেড়ায় অমানুষিক ইশারা, রাত কথা বলে সেই ভাষায়। তা বোঝা যেত রাত কী বলে যদি সে সঙ্গীহীন হত আর রাতকে পেত সঙ্গী হিসেবে। স্পিতি উপত্যকায় আসার পর প্রথম প্রথম রাত্রির নিঃসঙ্গ নির্জন পরিবেশ তাকে পাগল করে দিত, রাত্রির অন্ধকার নামার কথা ভাবলে তার বুক ভয়ে কেঁপে উঠত। আসলে তা ছিল দীর্ঘদিনের অভ্যেসের ফল, মানুষের সঙ্গ তৈরি করেছিল এই অভ্যেস। নিঃসঙ্গ থাকতে থাকতে মানুষ একদিন নিঃসঙ্গতাকেই সঙ্গী করে নেয়। একা থাকা তখন আর অসহায় মনে হয় না। আজ তো একদণ্ড মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ল্যাপটপ, সমাজমাধ্যমের সাহচর্য না থাকলে জীবন অবহ লাগে। আদিম মানুষ তাহলে কিভাবে কাটাত তার সারাদিন, যখন সে সমাজ তো দূরের কথা, রচনা করতে শেখেনি পরিবারও ? এখানে এতদিন নিঃসঙ্গ থাকতে থাকতে সে ইদানীং সেই পুরোনো অভ্যেস ভুলে গেছে। এখন সে আর রাতকে ভয় পায় না, বরং কখন রাত আসবে তার অপেক্ষাতেই থাকে, কারণ রাত্রি অনেক রহস্যে মোড়া, অনেক তার গোপনীয়তা, কল্পনাকে দিনের চেয়ে রাতেই বেশি প্রশ্রয় দেওয়া যায়। আর রাতের আকাশ ভরে রাখে অন্যান্য সব সুদূর অকল্পনীয় জগতের আন্দাজ, তারকাদলের গায়ে অনুমান করা সম্ভব যাদের বিবরণ।
খাওয়া শেষ করে আগুনের উষ্ণতা নিতে নিতে তারা গল্প করে আর কল্কেতে করে হুকো টানে ভৈরব। সেই তামাকে কিছু পরিমাণ গাঁজাও থাকে। তবে এমন একটু গাঁজা খাওয়া তাদের বিশ্বাসে পাপকাজ নয়, যেহেতু গাঁজা ও ভাঙ্গ পছন্দ করে স্বয়ং শিব। এই যে কৈলাশ পর্বতের পাদদেশে বেষ্টন করে তাদের বাসস্থান রচনা করেছিল পূর্বপুরুষরা, সে তো শিবেরই গ্রীষ্মকালীন প্রিয় বাসস্থান। তারা ভাবে শিব তুষ্ট থাকলেই জগৎ তুষ্ট, শিব রুষ্ট হলে দেখা যায় প্রকৃতির রুদ্ররূপ। আর শিবকে সন্তুষ্ট রাখতে তারা তাকে গাঁজা ভোগ দেয় এবং সেই প্রসাদ নিজেরাও পান করে। এই অর্থে গাঁজা খাওয়া তাই তাদের কাছে পবিত্র কাজ আর তাকেও তারা হুকো এগিয়ে দেয় গাঁজা খাওয়ার জন্য। সে যদিও তাদের কোন আবদার অমান্য করে না, তবুও হুকো খেতে পারে না, গাঁজা খাওয়াতে তার প্রবল আপত্তি বলে। তারা অবশ্য তাকে বিশেষ জোরাজুরি করে না এই ব্যাপারে, কারণ তারা জানে সে তাদের খুবই কাছের মানুষ, বন্ধু। আর তারও কিছু ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ থাকতেই পারে।
আগুন ক্রমশ কমে আসতে থাকে। তা আর বিশেষ বাড়তে দেওয়ার তাড়া থাকে না যেহেতু কুকুরগুলি জেগে থাকবে পাহারায়। এবার তারা তাঁবুতে ঢোকে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য, পরদিন আবার ভোরে শুরু হবে যাত্রা। শহরগুলিতে এখন হয়তো সন্ধে, কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে যেন মধ্যরাত। তাঁবুতে ঢুকে তারা মাদুরের ওপর শুয়ে পরে চাদর গায়ে জড়িয়ে। রাত্রি নিঃশব্দ হতে থাকে।
হঠাৎই কুকুরগুলি বড় বেশি ডাকাডাকি শুরু করে। তাদের ঘুম ভেঙ্গে যায় এত হাঁকডাকে। তারা বোঝে, কিছু একটা ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছে। তাই কুকুরগুলি এত চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে। তারা তিনজনেই একসঙ্গে বেরিয়ে আসে তাঁবু থেকে। তখনও আগুনের অবশেষ ধিকি ধিকি জ্বলছিল। কুকুররা কাছেই এসে ডাকছে, যেন তাদের কিছু একটা বলতে চায়। তারা বাইরে এলে কুকুরগুলি হাবভাবে বোঝায় তাদের সঙ্গে যেতে। খানিকটা দূর যাওয়ার পর যা আবিষ্কৃত হল তাতে সে বেশ অবাক। দেখা গেল, কয়েকটি ছাগল কিসের যন্ত্রণায় যেন ছটফট করছে। সে কিছুই বুঝতে না পারলেও পবন আর ভৈরবের অভিজ্ঞ চোখ সব বুঝে নিতে এতটুকুও সময় নিল না। একটু তাড়া দেখা গেল তাদের মধ্যে, আলোর ব্যবস্থা করা হল তৎক্ষণাৎ। ভৈরবের কথা থেকে সে জানতে পারল যে ছাগলগুলির প্রসববেদনা দেখা দিয়েছে। দুই ভাই ধাত্রী হিসেবে কাজ করল, সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। কুকুরগুলি এখন শান্ত হয়ে ঘুরছে বা শুয়ে আছে। তারা তাদের দায়িত্ত্ব পালন করে পরিতৃপ্ত। প্রসব হওয়া বাচ্চাগুলিকে পরিচ্ছন্ন করে কম্বলে জড়িয়ে রাখল ভৈরব। মোট ন’টি ছাগল বাচ্চা দিল একসঙ্গে। সব গুছিয়ে-টুছিয়ে শুতে শুতে খানিকটা দেরিই হয়ে গেল। শুতে যাওয়ার আগে পবন তার ভাইকে জানাল,
‘কাল খুব বেশি যাওয়া চলবে না। সদ্য মা হওয়া ছাগলগুলি বেশি হাঁটলে তাদের দুধ শুকিয়ে যাবে। বাচ্চাগুলি তখন দুধ না পেয়ে মারা যাবে। তাতে খুবই ক্ষতি হবে।’
অতএব ঠিক হল, পরদিন আর বেশি পথ অতিক্রম না করে বরং ভাল ঘাসজমি খুঁজে ছাগল আর ভেড়াগুলিকে খাওয়ানো হবে। বিশ্রামও হবে তাদের। আগে ঠিক করা ছিল যে দু’-তিনদিনের মধ্যেই কুলু পেরিয়ে গাদ্দিদের গমনপথ দুপ্পু চলে যেতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব কালিহানি গিরিদ্বার পার হওয়া হবে মূল লক্ষ্য। যেকোন দিন তুষারপাত শুরু হতে পারে। তাতে বিপদের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। এখন সেই সিদ্ধান্ত একটু ঝুঁকি থাকলেও একটু পাল্টানো প্রয়োজন মনে হল, ছাগল মায়েদের কথা ভেবে। আসলে মানুষ এভাবেই শুরু করেছিল পৃথিবীর বুকে চলাচল,পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। প্রকৃতি ও জীবজন্তুরা বুঝবে আমাকে, আমি বুঝব তাদের। এই পারস্পরিক সহযোগিতা না থাকলে পৃথিবী এমন পৃথিবী হয়ে উঠত না, বুধ বা বৃহস্পতি অথবা নেপচুনের পরিবেশও এখানে থাকতে পারত। মানুষই প্রথম প্রাণি বোধহয় এই পার্থিব জগতে যার মধ্যে এই সহমর্মিতা জীবন্ত ছিল একদিন যে কেউই এখানে আমার শত্রু নয়, বসুধৈব কুটুম্বকম। এই সহমর্মিতা জলাঞ্জলি হল এমন অত্যাধুনিক মানুষের আগমনে যারা ভাবতে শুরু করেছে, তারাও বিশ্বগঠন করতে পারে। কী এক তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব করায়ত্ত করল তারা যা তাদের মদমত্ত করে তুলেছে এবং তারা আক্ষরিক ভাবেই এমন অহংকারে ব্যতিব্যস্ত যে ভাবে তারাই আসলে ঈশ্বর। যখন কেউ নিজেকে ভগবান ভাবতে থাকে সে হয়ে যায় লঙ্কাধিপতি রাবণ, তার পিতৃপুরুষ তার অপরাধে পরিণত হয় রাক্ষসে অথবা দানবে।
পরদিন কাকভোরে ওঠা হল না অন্যদিনের মত। সদ্য প্রসব করা ছাগল মায়েদের কথা ভেবে, তাদের বিশ্রাম দেওয়ার জন্য। সকাল একটু গড়িয়ে যাওয়ার পর শুরু হল যাত্রা। সবুজ উপত্যকার গা ধরে। দু’দিকে পাহাড়ের সারিবদ্ধতা এবং খানিকটা পরে পাশে পড়ল এক ঘন জঙ্গল। জঙ্গলে ওক, দেওদার, সিলভার বার্চ ইত্যাদি গাছের ভিড়। সেই জঙ্গল এড়িয়ে চলল তাদের ক্যারাভান, তাদের নিজস্ব পথরেখা তারাই চেনে। উৎরাই ধরে নেমে যাচ্ছিল পথ খুবই আলতো ঢালে, নেমে যে যাচ্ছে বোঝার কোন উপায় ছিল না। মনে হচ্ছিল যেন সংকীর্ণ উপত্যকার সমতল সবুজ বিছানা ধরে যাচ্ছে তারা। চতুর্দিকে ফুলের মেলা। লালচে আবার শুভ্র খয়েরি থোকা থোকা ফুল অথবা মোরগঝুটির মত দণ্ডবিশিষ্ট এবং আরও নানা চেহারার নানান রঙের ফুল ছেয়ে রেখেছে সমস্ত উপত্যকা যতদূর চোখ যায়। এই কাননকে কে সাজাল এমন যত্নে, ভাবছিল সে। বাতাস মুখরিত ছিল সেইসব বুনো পাহাড়ি নাম নাজানা হাজার প্রজাতির পুষ্পরাজির প্রসন্ন সৌরভে। এমন বাগান কেন কে কী উদ্দেশ্যে সাজিয়ে রেখেছে এমন দুর্গম অঞ্চলে যেখানে কোন মানুষ আসে কদাচিৎ ? সে একা থাকলে এই প্রশ্ন রাখত এই আশ্চর্য ফুলবাগানের কাছে, ফুলেদের কাছে এবং সে জানে সে উত্তরও পেত। এখন সেই উপায় নেই বলে সে নিজেই উত্তরটা খুঁজে নিল। আসলে সমগ্র বিশ্বজগৎ তো বটেই, এই অতি ক্ষুদ্র পৃথিবীও সাজিয়ে রেখেছে কোন বিশ্বনিয়ন্তা তার সৃষ্টিসুখে। সেই বিশ্বপিতার নিজস্ব উদ্যান এখানে সুসজ্জিত তার আপন হাতে আপন খেয়ালে আপন আনন্দে। মানুষ তা দেখল কি না দেখল তাতে বয়েই গেল তার। সে তার সৃষ্টিকর্মের জন্য একদল স্বার্থান্বেষী মদমত্ত জনতার কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চায়নি, তেমন কোন ইচ্ছেও নেই তার। থাকলে সে এই উদ্যান সাজিয়ে রাখত কোন মেট্রো সিটির বুকে, অত্যাধুনিক মানুষের কাছে পিঠ চাপড়ানি আর প্রশংসা পাওয়ার জন্য। সে তা করেনি, সে তার সৃষ্টির সৌন্দর্য্য রেখে দিয়েছে তার অন্তরের গহনে। যদি কারো আন্তরিক ইচ্ছে থাকে তাহলে সে তা উপভোগ করতেই পারে। সে লোক হতে পারে কোটিতে গুটিক, তাতে তার ভ্রূক্ষেপ নেই, কারণ সে জানে জগতে প্রকৃত গুণী মুষ্টিমেয় কয়েকজনই হয়, আপামর জনতা নয়। তাই তার দরকার নেই আপামর জনতার তারিফ বা জনপ্রিয়তা। তাই সে উদ্যান রচনা করে সভ্য মানুষের মেকি কৃত্রিম জনপদের অনেক দূরে। অনেক দূরেই সে সাজিয়ে রাখে জঙ্গল, মরুভুমি, পাহাড়-পর্বত-হিমশৈল বা উপত্যকা। সেসব নাগরিক মানুষের কাছে সহজলভ্য নয়। যে জীবন বাজি রাখবে এবং কষ্টসহিষ্ণু হতে পারবে তারই অধিকার আছে এসব সম্পদ উপভোগ করার। এবং এই নিয়মেই চলে প্রকৃত স্রষ্টা, সে জনপ্রিয়তার কথা ভেবে বা আপামর জনতার প্রশংসাবাণী পেয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে উপন্যাস লেখে না, সুর বা গান রচনা করে না, বা কবিতা লেখে না। সে সৃষ্টি করে নিজের প্রাণের আনন্দ প্রকাশ করার তাড়নায়। খ্যাতি বা অর্থপ্রাপ্তির প্রলোভনে নয়। তার সৃষ্টি কেউ দেখল কি না দেখল তার বড় বয়েই গেল ! সে নিজেই দেখেছে নিজেই আনন্দ পেয়েছে। যে দেখল না সে সেই সৃষ্টিসুখের উল্লাস থেকে নিজেই নিজেকে বঞ্চিত করল। তাতে স্রষ্টার কোন ক্ষতি হল না।
মোটেই তেমন তাড়াহুড়ো নয়, চলছিল তাদের দলবদ্ধ চলন খুবই মন্দগতিতে। তাতে হয়তো পরে কিছুটা বিপদেই পড়তে হবে, কারণ কালিহানি গিরিসংকট এখনও অনেকটাই দূরে, তুষারবৃষ্টি শুরু হতে পারে যেকোন সময়। হলে বড়োই বিপজ্জনক হয়ে যাবে কালিহানি গিরিদ্বার। ভেড়ার দল নিয়ে তা পেরিয়ে যাওয়ার সময় যে কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে ওই বরফের রাজত্বে। তাতে পুরো দলই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। এমন দুর্ঘটনা ঘটে না যে তা নয়। সভ্যমানুষ তার খবর রাখে না বিশেষ। তা জানে কেবল তারাই। একবার থামসার গিরিদ্বারে এমন দুর্ঘটনায় হারিয়ে গিয়েছিল তিনজন গাদ্দি মেষপালক ও তাদের আশিটি ভেড়ার দল। তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সৌভাগ্যক্রমে থামসার পাস্ তাদের পার হতে হবে না। কালিহানি পাস্ পার হলেই বড়া ভাঙ্গাল যেখানে তাদের গ্রাম। থামসার পাস্ পেরিয়ে যেতে হয় ছোটা ভাঙ্গাল। সেটাও গাদ্দিদের অন্য একটি গ্রাম। তবে এতেও আত্মতুষ্টির কোন জায়গা নেই, কারণ কালিহানি পাস্ তুলনায় থামসার পাসের চেয়ে বেশি উঁচু ও মোটেই কম বিপজ্জনক নয়। হাজার সতর্কতা সত্ত্বেও কিছু দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে এবং ঘটেও। তবুও ছাগল মায়েদের কথা ভাবতেই হবে। ভাবার কোন উপায় থাকত না যদি তাদের গ্রামে যেতে দু’টো পাস্ই পেরোতে হত, এই যা সান্ত্বনার কথা।
পবন আর ভৈরবদের সঙ্গে যেতে যেতে তার মনে হচ্ছিল, আসলে এই সরল সাদাসিধে গাদ্দিরাই স্বাভাবিক মানুষ, জগৎজোড়া অস্বাভাবিক মানুষের ভিড়ে, তারা নির্ভিক যোদ্ধা যেহেতু তারা চেনে প্রকৃতিকে, তারা জানে কী প্রকৃতির নিয়মকানুন। এই জানাটা পৃথিবীর যে কোনও অতিজ্ঞানী অহংকারী প্রাজ্ঞ মানুষের তুলনায় অনেক বেশি বরণীয়। এই জ্ঞানকেই ভূষণ করেছিল বলে আদিমানব থেকে তার বংশধররা এমন এক সভ্যতা সৃজন করতে পেরেছে। এখন আত্মগর্বী মানুষ সেই পূর্বপুরুষদের কথা ভুলে গেছে। ভুলে গেছে তাদের জ্ঞান। থামল তারা চলার পথে যেখানে উপত্যকায় রয়েছে লম্বা ঘাসের বন। ইতিমধ্যে পথ পরিক্রমায় দু’দিন কাটতে চলেছে। পবন ঘাসগুলি পরীক্ষা করে দেখছিল। জিজ্ঞেস করতে তার ভাই ভৈরব জানাল যা তা হল সব ঘাস ভেড়া বা ছাগলদের খাওয়ার উপযুক্ত হয় না। কিছু ঘাস বিষাক্ত হতে পারে। সেই ঘাস চিনে নেওয়া জরুরী। বয়স্ক ভেড়াগুলি চেনে, কিন্তু কমবয়সী ভেড়ারা না চিনে খেয়ে ফেলতে পারে। তাতে মৃত্যু অনিবার্য। এভাবে মাঝেমধ্যেই দু’-চারটি ভেড়ার মৃত্যু হয় বিষঘাস খাওয়ার জন্য। ভুল করে বয়স্ক ভেড়ারাও খেয়ে ফেলতে পারে সেসব খিদের তাড়নায়। তাই নিরাপদ ঘাস চিনে নিয়ে তাদের খেতে দেওয়া হয় যেটা তারা দেখে অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারে যে-তৃণভূমিতে ভেড়াদের খাওয়ার জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে তার ঘাস পুষ্টিকর কিনা। তাহলে আর বিপদ ঘটবে না। সেটাই করছিল পবন আর ভৈরব সতর্কতার সঙ্গে।
ভেড়া আর ছাগলরা তৃণভূমিতে ঘুরে মনের আনন্দে তাদের খাবার খাচ্ছিল। তারা তিনজনেও বসল এক সুবিশাল বোল্ডারের ছায়ায়। দুপুর হতে চলেছে। সূর্য মধ্যগগনে প্রায়। প্রকৃতির কোলে এই উদার তৃণভূমির একপাশে সবুজ পাহাড়ের গা, রয়েছে তার পাশে প্রস্তরাকীর্ণ জঙ্গলে ভরা খাদ, অন্য পাশে তৃণভূমি শেষ হয়েছে অদূরে ঘন গাছের জঙ্গলে। পাহাড়ের গায়েও গাছপালার ভিড় রয়েছে। সে ভাবছিল, এবার তারা কোন্ দিক ধরে চলবে। জঙ্গল শুরু হওয়ার মুখেও রয়েছে আরও সতেজ সবুজ তৃণভূমি। উপত্যকার সেদিকে দেখা যাচ্ছিল বরফাবৃত শৃঙ্গ। অনেকটা সমতল সেদিকে যাওয়ার পথ। ভৈরব তাকে বরফাবৃত পাহাড়ের গা দেখিয়ে জানাল যে ওটাই হল কালিহানি পাস্, সমতল তৃণভূমি গিয়ে শেষ হয়েছে যেখানে তার চেয়ে বড়জোর দু’-তিন ঘন্টার পথ হবে। সে ভাবল, ওই পথেই নিশ্চয় চলবে তারা। তাহলে আর চিন্তার কারণ কী ? আজই তো পেরিয়ে যাওয়া যাবে গিরিসঙ্কট ? কিন্তু পবন জানাল যে ওই সহজ পথে যাবে না তারা। তারা চলবে পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে এবং এই পর্বতগাত্রের ওপরেই রয়েছে প্রায় এগারো হাজার ফিট উচ্চতায় গাদ্দিদের নিজস্ব পথ দুপ্পু। দল যাবে ওই পথেই। কিন্তু এই সহজ পথ নয় কেন ? ওখানেও যেতে যেতে আছে আরও সতেজ তৃণভূমি যেখানে ভেড়ারা আরও খাবার পেত, এখনই চড়াইয়ের কষ্ট ভোগ করতে হত না। পবন জানাল, ওই সহজ পথ আসলে বিষম বিপদে ভরা। ওখানকার তৃণভূমিতে রয়েছে জোঁকেদের রাজত্ব। সেখান দিয়ে যাওয়া একদমই উচিত হবে না, আর পথও শেষদিকে কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল। তাই সহজ পথ ছেড়ে কষ্টসাধ্য পথ ধরেই এগোতে হবে। ওই জোঁকের রাজত্ব যদিওবা মানুষের পক্ষে পার হওয়া সম্ভব, ভেড়াদের বিপদ হতে পারে। সে শুনে বুঝল, এটাই হল জীবনের নিয়ম। যে সহজে তোমাকে ধরা দিচ্ছে তাতে সন্দেহ আছে। তুমি কষ্ট আর শ্রম দিয়ে খেটে যা অর্জন করবে সেটাই হবে জীবনের মূলধন। তবে এই পথের পরেও কালিহানি গিরিদ্বারের যত কাছাকাছি যাওয়া যাবে তত বরফগলা জলে পথ কর্দমাক্ত হয়ে উঠবে এবং জোঁকেরাও থাকবে। তবে খুব বেশি নয়, তার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া যাবে। ভেড়া আর ছাগলদের খাওয়ার সময়ে তারা নিজেরাও দুপুরের খাবার খেয়ে নিল, কুকুরদেরও খাওয়াল। তারপর সদলবলে পাকদণ্ডী বেয়ে সরু পথরেখা অনুসরণ করে চলল তারা দুপ্পুর দিকে। কাছাকাছি অনামা প্রান্তর জুড়ে অপূর্ব ভূদৃশ্য সাজিয়ে রেখেছে অদ্ভুত গঠনের বিভিন্ন আকৃতির বোল্ডার। তখন বিকেল ঘনিয়ে এসেছে। পবন জানাল যে রাতটা তারা এখানেই কাটাবে। হাতের নাগালেই তো গিরিদ্বার, এখনই তাতে চড়তে শুরু করলে মন্দ কী, ভাবল সে। বললও তার ভাবনার কথা। শুনে ভৈরব জানাল যে রাতে বা বিকেলে ওই গিরিদ্বার পেরোনোর ভাবনা পাগলামি। এমনকি বিকেলের পর বরফাবৃত পাহাড়ের গা বেয়ে ওখানে ওঠার ভাবনাও ঠিক নয়। বরফে ঢাকা গিরিসংকট পেরোলে পার হতে হবে দুপুর নাগাদ, কাল তা হওয়ার সম্ভাবনা যে নেই তা নয়। তার আগে ভাবতে হবে যে প্রায় পনের হাজার আটশ’ ফিট উচ্চতার গিরিদ্বারের মাথায় ওঠা দুপুরের মধ্যে সম্ভব কিনা। গাদ্দিরা পারবে, তাদের ভেড়ারাও পারবে না তা নয়। সে জানাল,
‘আমিও পারব।’
আগে হলে এতটা আত্মবিশ্বাস থাকত না তার গলায়, যখন সে শহরের বাসিন্দা ছিল।কিন্তু স্পিতি উপত্যকায় থাকা তাকে অনেককিছু শিখিয়েছে। তার কথা শুনে পবন ও ভৈরব সেটা অমূলক ভাবল না। পবন বলল,
‘তুমি পারবে জানি। তোমার সেই ক্ষমতা আছে। কিন্তু সদ্য মা হওয়া মা ছাগলগুলির কথা ভাবছি। তবে তারা এখন নিশ্চয় পারবে। তিন দিন আগে তো মা হয়েছে। আর পশু মায়েদের সক্ষম হতে বেশি সময় নেয় না মানুষ মায়েদের মত। প্রকৃতির নিয়ম।’
প্রকৃতির নিয়ম তো অবশ্যই, সে ভাবল। মানুষ মায়েরাও বোধহয় আদিতে এমনই ছিল, তাদের জন্যও এমনই প্রকৃতির সত্যি ছিল একদিন। যত নগরায়ন ও শিল্পায়ন ঘটল ততই মানুষ মায়েদের জন্য আর প্রকৃতির একই নিয়ম বহাল থাকল না। মানুষ মায়েরা চলে গেল ক্রমশ প্রকৃতির নিয়মের বাইরে, এবং আরও চলে যাচ্ছে ক্রমশ। মানুষের ক্ষেত্রে এখন শুধু চালু নাগরিক নিয়ম। প্রকৃতি হাতের বাইরে, অনেক দূরে।
দুপ্পু যেতে মানালি থেকে দিন তিনেক লাগে, সেটাই প্রায় লেগেছে। ছাগল মায়েদের বিশ্রামে রাখার পরও। আর এই ক’দিনে মায়েরা এবং বাচ্চাগুলিও বেশ সবল হয়ে গেছে। প্রথমে জন্মানোর পরদিন সদ্যপ্রসব হওয়া ছাগল শাবকদের চটের থলিতে মুড়ে সঙ্গে থাকা ঘোড়াদের পেটের সঙ্গে বেঁধে যাত্রা করতে হয়েছিল, সেরকম চটের থলি এমন প্রয়োজনের জন্য ছিল তাদের কাছে। এই সুদীর্ঘ ক্যারাভানের সঙ্গে ঘোড়াও ছিল দু’-তিনটে বাহন হিসেবে। কিছু কিছু স্থান এতটাই দুরতিক্রম্য ও দুর্গম যে ঘোড়ার পিঠে চাপতেই হয়। কুকুরদের মত ঘোড়াও তাই গাদ্দি প্রান্তরবাসীদের দীর্ঘ যাত্রাপথের অপরিহার্য সঙ্গী। সেই ঘোড়াদের পেটের তলাতেই চটের থলেতে বাঁধা ছিল সদ্যপ্রসূত বাচ্চাগুলি। এখন তারা ভালোই চলতে-ফিরতে পারছে নিজেদের পায়ে। অতএব কাল ভোরবেলা উঠে দেখতে হবে কতটা কী সম্ভব।
সন্ধে থেকেই আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন।কালিহানি পাস্ বিকেলের পর ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেল। কে আকাশ আর কে পাহাড় বোঝার উপায় ছিল না। পবনের মুখে একটা কথা শুনে সে নিশ্চিন্ত হল যে ইতিমধ্যেই তারা দশ থেকে এগারো হাজার ফিট উচ্চতা উঠে এসেছে গতদিন এবং আজ মিলিয়ে। কালকে থেকে পথ আরও পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত হবে। এখন ঠাণ্ডা ও দুর্যোগের হাত থেকে রেহাই পেতে তারা আশ্রয় নিয়েছে বিশাল একটি বোল্ডারের আড়ালে। মেঘেরা সবাই আকাশের গায়ে নিচু স্তর দিয়ে যাওয়ার সময় কালিহানি গিরিদ্বারের গায়ে ধাক্কা খেয়ে যাচ্ছিল। বিকেলের আগেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে চারপাশে। কালিহানি গিরিদ্বারে আকাশের বৃষ্টিমেঘেরা চলার পথে বাধা পেয়ে থেমে যায় ও যখন-তখন বৃষ্টি নামায়। সেটা বৃষ্টি অথবা তুষারপাত। কালিহানির তলদেশ ও বেয়ে ওঠার পথ তাই সদাসর্বদা কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল। একটু তবুও আশ্রয় নেওয়ার ভাল স্থান এইসব বিপুলায়তন বিসদৃশ বোল্ডারে ছাওয়া ভূখণ্ড, বিসদৃশ বোল্ডারগুলিকে এখন মনে হচ্ছিল ঈশ্বরের বানিয়ে রাখা প্রাকৃতিক গৃহ। সন্ধে হওয়ার আগেই কালিহানির গায়ে লেগে থাকা কৃষ্ণাভ ঘন বৃষ্টিমেঘের আচ্ছাদনে তলদেশ অন্ধকার হয়ে এল এবং সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল বৃষ্টি। তাই দেখে পবনের খুব দুশ্চিন্তা। ভৈরবও তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। পাথুরে আচ্ছাদনের আড়ালে বসে বৃষ্টির হাত থেকে তারা রক্ষা পেলেও সঙ্গীদের উদ্বেগ ও দুর্ভাবনার ভাগীদার হতে হচ্ছিল তাকেও।পবন অসহায় গলায় যা বলছিল তা থেকে সে বুঝতে পারল যে ভেড়ারা তিন ইঞ্চির বেশি পুরু নরম বরফ ধরে যেতে পারে না, পা আটকে যায়। যাওয়ার পথে গিরিদ্বারের ওপর জমে থাকা বিস্তৃত বরফপ্রান্তরে বৃষ্টির জন্য যে নতুন বরফ জমবে তা হবে নরম এবং তাতে যেতে যেতে পা ডুবে যাবে। তিন ইঞ্চির বেশি পা ডুবে গেলে ভেড়ার দল আর এগোতে পারবে না এবং এভাবে এগিয়ে যাওয়াও হবে ভয়ঙ্কর কারণ নরম বরফে ঢেকে থাকা অঞ্চলে যদি খাদ থাকে তো সবাই মিলে অতলে তলিয়ে যাবে আর জীবন্ত সমাধি ঘটবে সবার। বৃষ্টি তাই বড়োই দুশ্চিন্তার কারণ।
সন্ধে লাগার মুখে বৃষ্টি শুরু হল। ঝিরঝিরে ধারায় গোড়ার দিকে শুরু হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে চলল কিছুক্ষণ, খানিক থেমে বা খানিক নেমে। ঘন্টাখানেক এমনই খেয়ালখুশি বজায় রাখার পর আরেকটু গাঢ় মেজাজে এবং বিরামহীন। তারা তিনজনেই ছিল সেই বিশাল বোল্ডারের খাঁজকাটা অভ্যন্তরে, গুহাসদৃশ আশ্রয়ে। তবুও বৃষ্টির ছাট ভিজিয়ে দিচ্ছিল, তাছাড়া সেই বোল্ডারটির পৃষ্ঠতলের বর্ষণজল গড়িয়ে অবিশ্রাম জলবিন্দু ধারা হয়ে চলে আসছিল ভিতরেও। সেসব জলবিন্দু আসলে জমাট বরফপাত হয়েই নামছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল হিমশীতল স্পর্শে। পবন আর ভৈরবের গা ঢাকা ছিল হাতে বোনা পশমি শালে যা জলে ভেজে না। বৃষ্টি চলল সারারাত, ক্ষান্তি দিল ভোরবেলায়।
রাতে তারা কেউ প্রায় ঘুমোলোই না। ঘুমোবার উপায়ও ছিল না, যেহেতু মেঝের বাটিসদৃশ পাথরের পাটাতনে আচ্ছাদন বেয়ে নামা জলবিন্দুরা জমে জমে পায়ের পাতা ডুবিয়ে দিয়েছিল, আর সঙ্গী ছিল উৎকণ্ঠা। যদি গিরিদ্বারের বরফপ্রান্তরে নরম বরফ পুরু হয়ে জমে যায় তো ভেড়ার পাল তা ডিঙিয়ে যাবে কী করে ? এখানে অপেক্ষা করাও যাবে না কাল, পিছিয়ে যাওয়ারও উপায় নেই। বড়া ভাঙ্গাল যাওয়ার এই একটিমাত্র পথই আছে, আর পথ রয়েছে উল্টোদিকের ছোটা ভাঙ্গাল থেকে থামসার গিরিদ্বার ধরে। ওই পথে যেতে গেলে পুরো রাজ্যটির উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত চক্রাকারে ঘুরতে হবে, কয়েকশ’ কিলোমিটার হবেই তা এবং যে পথ কেউ কল্পনাও করে না কোনদিন।
ভোরের আলো তখনও অস্পষ্ট প্রায়, বৃষ্টি বিদেয় হলেও আকাশ একেবারে মেঘমুক্ত নয়। পবনরা বোল্ডারের আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে এলো। গিরিদ্বার এখান থেকে আরও চার-পাঁচ হাজার ফিট ওপরে। মুখ তুলে দেখে কিছু বোঝা এখনও দুষ্কর। কিছুটা পরামর্শ করল দু’ভাই মিলে, তারপর যা থাকে কপালে করে উঠে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিল। এমন সিদ্ধান্ত নিতেই হত। ওপরে যাওয়ার পথ পাথুরে শিরা বার করা হলেও বরফ জমে গেছে এবং বরফগলা জলীয় ধারা নামছিল তখনও চুঁইয়ে চুঁইয়ে। তাতে পথ হয়ে আছে পিচ্ছিল এবং বরফে আর কাদায় মাখামাখি। সাবধানে উঠছিল তারা দল নিয়ে যদিও প্রতি ইঞ্চি চড়াই ভাঙ্গতে এতটাই পরিশ্রম হচ্ছিল যে গাদ্দিদের মত অভিজ্ঞ আর কষ্টসহিষ্ণু দু’ভাইকেও কাহিল দেখাচ্ছিল। এই কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যেও গায়ে বুঝিবা ঘাম ঝরছিল। পবন সাবধান করে বলল,
‘বরফের চাঙ্গরে পা দেওয়ার আগে সাবধান, ঠেলে দেখে নিও আলগা কিনা। আমাদের আগে কাল-পরশুও অনেক দল গেছে এখান দিয়ে। তাদের ছাপ আছে ভেড়াদের পড়ে থাকা মলমূত্রে। রাতের বৃষ্টিতে তা মুছে যায়নি পুরোপুরি। সেই মলমূত্রের চিহ্ন দিয়ে যে রেখা সেটা দেখে নিয়ে ওই রেখা ধরেই এগোও। তাহলে তুমি হঠাৎ ডুবে গিয়ে হারিয়ে যাবে না। এসব বরফে ঢাকা পথে এটাই চলার নিয়ম।’
কথাগুলি মূলত তাকেই উদ্দেশ্য করে বলা, কারণ তার ভাই ভৈরব জানে এসব। তবে তাকেও আবার দাদা হিসেবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হতেই পারে, সে যদি ভুলে গিয়ে থাকে এই সম্ভাবনায়। অন্তত চার থেকে পাঁচ ঘন্টা সময় লাগল কালিহানি পাসের মাথায় উঠে আসতে। এবার টানা বরফের প্রান্তর। ওটাই বিপজ্জনক প্রদেশ। পবনের আশঙ্কা সত্যি বলে প্রমাণিত হল। পুরু বরফ জমে গেছে রাতের বরফবৃষ্টিতে। এই বরফ সদ্য তৈরি হয়েছে এবং চরিত্রে নরম। ওপরে যে আস্তরণ জমেছে তা তিন ইঞ্চির কম হবে না কোনমতেই। দিনে যদি রোদ ওঠে কিছুটা গলে যেতে পারে, কিন্তু আশা তার খুবই কম। পবন পরীক্ষা করে দেখে বুঝল যে কষ্ট করে হলেও প্রান্তরটা পেরিয়ে যাওয়া যেতে পারে। ভয় একটাই, নরম বরফে মৃত্যুফাঁদ হয়ে কোন খাদ লুকিয়ে আছে কিনা। অতএব পবন প্রান্তরের এধারে ভেড়ার পাল নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল আর ভৈরব নেমে গেল প্রান্তরে। হাতের লম্বা লাঠি দিয়ে বরফের আস্তরণ ঠুকে ঠুকে এধার থেকে ওধার পর্যন্ত পরীক্ষা করে দেখল পেরোনোর সম্ভাব্য চলনপথ কেমন হতে পারে। সেও কাজটাতে অংশ নিতে চেয়েছিল, কিন্তু পবন তাকে নিরস্ত করল। তার এসব পথে চলার কোন অভিজ্ঞতা নেই। তাকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া যায় না। বেশ কয়েক ঘন্টায় পরীক্ষাপর্ব প্রাথমিকভাবে সাঙ্গ করে খুব সন্তর্পণে যাত্রা শুরু হল। দুপুর পার হতে চলেছে ততক্ষণে। উদ্বেগ আর উত্তেজনায় কিছু আর খাওয়া হয়নি এতক্ষণ। খাওয়ার অবকাশও ছিল না। প্রতিটি মিনিটই অমূল্য। আকাশ এখনও মেঘাচ্ছন্ন আর সেইসব কৃষ্ণকায় হালকা মেঘ গুচ্ছাকারে গিরিদ্বারের ওপর দিয়ে আলস্যে গড়িয়ে চলেছে মন্থরগতিতে, বা বলা যায় জমে আছে। তাতে চারপাশটা দেখাও যাচ্ছে না স্পষ্টভাবে। আবারও বৃষ্টি নেমে যেতে পারে যেকোন সময়। তাতে বিপদ আরও বেড়ে যাবে। তাই খাওয়ার কথা ভাবা এখন বিলাসিতার সামিল। মেঘাচ্ছন্ন অস্বচ্ছ বৃক্ষহীন এবং গিরিদ্বারের বরফাচ্ছাদিত ঢাল ধরে চলছিল তারা তাদের দল নিয়ে এবং প্রতিটি পদক্ষেপ মেপে মেপে, নরম ফাঁকা বরফের স্তর দলটির ভারবহনে কতটা সক্ষম হতে পারে সেই সন্দেহ মাথায় রেখে। পবনদের ভেড়ার দলও সুশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ আর এটাও একটা বড় নিশ্চিন্ত থাকার বিষয় ছিল। ঘন্টা চারেকের অক্লান্ত চেষ্টায় কালিহানি গ্লেসিয়ার পেরিয়ে সবুজ প্রান্তরের কাছাকাছি নেমে আসা সম্ভব হল। এবার বড়া ভাঙ্গাল আর বেশি দূর নয়, কারণ পিচ্ছিল নিম্নগামী পথেও গিরিশিরার ধার ঘেঁষে পাশে খাদ রেখে নামতে যাওয়ার সময় এতটুকু অসতর্ক হওয়া মানেই গড়িয়ে খাদে পড়ে অতলগামী হওয়া বিচিত্র নয়। পথ মোটেই সোজা নেমে যেতে পারেনি। ভাঁজে ভাঁজে এঁকেবেঁকে নেমেছে পাহাড়ি খাদের সমাবেশ একপাশে আবার অন্যপাশে খাঁজকাটা পাথুরে দেয়ালের বাহারি সজ্জায় ভূষিত হয়ে। খানিকটা পরই দেবী কি মারহী দিয়ে গেছে ওই পথের ওঠানামা গ্রামের দিকে। তার আগে রয়েছে চৌরাশি ধর বলে একটি-দু’টি নয়, চুরাশিটি শৈলচূড়া। বড়া ভাঙ্গাল অনেকটা গামলার মত আকৃতিবিশিষ্ট, ধওলাধর পর্বতশ্রেণীর একপাশে তার অবস্থান, মূলত তিনটি সুউচ্চ পর্বতমালার পাদদেশ হিসেবে এবং এটি একেবারেই দুর্গম। স্থায়ী হিমশৈল তার চতুর্দিকে প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে, তাদের গা থেকে প্রবল জলধারা খরস্রোতা হয়ে নেমে এসেছে একের পর এক, আর সবগুলো সমবেত হয়ে গড়ে তোলে যে প্রধান জলধারা তাকেই সবাই চেনে ইরাবতী নদী নামে, যার প্রবাহ যাত্রা শুরু করেছে এই বড়া ভাঙ্গালের অন্তর থেকেই। ছোটা ভাঙ্গাল থেকে থামসার পাস্ অতিক্রম করে যেমন বড়া ভাঙ্গালের দেখা মিলবে তেমনি উল্টোদিকে দুপ্পু থেকে কালিহানি পাস্ পেরিয়ে তবেই এখানে আসা যাবে এবং একটু আগে গাদ্দিরাও এসেছে ওই শেষ পথটি ধরেই। তার অর্থ এই হল যে বড়া ভাঙ্গালকে দু’দিক থেকে ধওলাধর পর্বতমালার বিখ্যাত দু’টি সুউচ্চ গিরিদ্বার কালিহানি ও থামসার প্রায় স্যান্ডউইচ বানিয়ে রেখেছে। স্বীকৃত বা সুগম্য কোন পথই নেই, আর চারদিকে আকাশমস্তকে ঠেকানো পাহাড়চূড়া ও খরস্রোতা জলধারা নিয়ে বড়া ভাঙ্গাল এক এমন দুর্গ যা সুরক্ষিত সভ্যজগতের আমুদে আর হুজুগে মানুষগুলির লোকদেখানো বেড়াতে যাওয়ার উৎসব থেকে, ওই কলুষিত ভিড় বা প্লাবন এখানে প্রবেশাধিকার পাবে না তাদের মর্জিমাফিক। তাই গ্রামের নিষ্পাপ সাদাসিধে মানুষগুলি তাদের পিতৃপুরুষের প্রথানুসারী হয়েই থাকতে পারবে আরও অনেকদিন। এভাবেই প্রকৃতির আপন সন্তানেরা তাদের মূল চরিত্র বজায় রাখতে পারবে যতদিন সভ্যতা ততদিন নিরাপদ, পৃথিবীর নিজস্ব প্রাণের উৎসগুলি তাদের স্বকীয় স্বভাবে থাকুক জগৎজুড়ে যত বেশি সম্ভব এটাই হোক মানবিক আত্মার একান্ত কামনা। বড়া ভাঙ্গালে এলে দেখা যাবে কোনদিক থেকে কোন সর্বগামী সড়কপথ উঠে যায়নি কোনদিকে, পরিবর্তে অনেক অনেক সরু সরু পথরেখা চলে গেছে চারদিকের পাহাড়ি দেয়ালগুলির গা বেয়ে এঁকেবেঁকে, এগুলি আসলে একেকটি গাদ্দি মেষপালক দলের একেকটি নিজস্ব পথরেখা, বংশানুক্রমিকভাবে অলিখিত নিয়মে একেকটি পথ নির্দিষ্ট একেক দলের জন্য, এই নিয়ে তাদের মধ্যে কখনও কোন সমস্যা হয় না যেসব আমাদের নাগরিক জীবনে দেখতে আমরা অভ্যস্ত। বড়া ভাঙ্গালের চারপাশে সুউচ্চ পাথুরে দেয়াল দিয়ে ঘেরা সুরক্ষিত গাদ্দি উপজাতির মানুষেরা তাদের পিতৃপিতামহের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রথাসমূহ আন্তরিক মমতায় বুকে লালন করে তাদের দুর্গে জীবন কাটাচ্ছে সভ্য সমাজের কলুষিত ছোঁয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করে। তাদের সম্পদ নেই, শান্তি আছে, আধুনিক প্রযুক্তি নেই, প্রাণ আছে। নাগরিক সভ্যতায় জীবনকে যান্ত্রিক বানিয়ে দিয়েছে যেভাবে তারা সেসব জানে না বলেই তাদের জীবনে রসের ভাণ্ডার পরিপূর্ণ নানা রসের সুষম বন্টনে এখনও পর্যন্ত যেমন ছিল সৃষ্টির সূচনায়।
এই গ্রাম গাদ্দি উপজাতীয় সম্প্রদায়ের আদিতম বাসস্থান, সমতলভূমি থেকে যখন তারা কয়েক শতাব্দী আগে চলে এসেছিল হিমালয়ের কোলে। এখানে বর্তমানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়েছে আর আছে একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। বাড়িগুলি কাঠের কাঠামো, গায়ে লেপা গোবর, স্থানে স্থানে কাঠামো জোড়া হয়েছে ইটের বা ঘাসের স্তর সাজিয়ে। পর্বতারোহীরা বা ট্রেকাররা গেলে গ্রামবাসীরা তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় হাসিমুখে, কারণ তাদের কাছে অতিথিরা নারায়ণ। তারা অতিথিদের সেবাযত্নে কোন ত্রুটি রাখে না, তাদের খুশি করতে হাজির থাকে সর্বসময়। খেতে দেয় শুকনো মিষ্টি, শুকনো মাংস, আপেল ও ফলমূল, ঘোল, খাঁটি দুধ, রাজমা ও অন্যান্য শস্য। উপহার দেয় তাদের তৈরি হস্তজাত দ্রব্য। এই আপ্যায়নে প্রকাশ পায় না তাদের জীবনসংগ্রামের দুঃখকষ্ট বা কী বঞ্চনা ও ঔদাসীন্যের শিকার হতে হয় তাদেরকে প্রতি পদে পদে। দুপুর-রাতের খাবার ও আশ্রয় স্বচ্ছন্দে পাওয়া যাবে তাদের কাছে চাইলেই। তাদের সেবা গ্রহণ করলে তারা কৃতার্থ হবে, কেউ তা ফিরিয়ে দিলে তারা ক্ষোভ জানাবে। এটাই রীতি।
তাকে এখানে তাদের গ্রামে নিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছিল পবন আর ভৈরব খুবই কুণ্ঠার সঙ্গে, সসংকোচে। সারা পথ আগলে রেখেছিল তাকে পরম যত্নে। তার দিকে তাদের সতর্ক দৃষ্টি ছিল সবসময়। গ্রামে ঢোকার পর তাকে ঘিরে লোকের ভিড় দেখে সে অবাক হয়ে গেল। সবারই মুখেচোখে কী আত্মীয়তার প্রকাশ, কতটা সম্ভ্রম। পবন আর ভৈরব সবার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল এতটাই গর্বের সঙ্গে যে মনে হচ্ছিল বুঝি তারা তাদের সঙ্গী করে আনতে পেরেছে কোন স্বর্গের দেবতাকে বা পৃথিবীর কোন মান্যগণ্য বিখ্যাত ব্যক্তিকে। দু’ভাইয়ের কাছে তার পরিচয় জানতে পেরে প্রত্যেকে আসছিল কেবল তাকে একপলক দেখে যাওয়ার জন্য, যেন তার দেখা পেলে তারা ধন্য হয়ে যাবে। অনেকে যা বলতে শুরু করল তখনই যে শুনে সে আক্ষরিক অর্থেই বাক্যহারা হয়ে থাকল। তারা বলতে লাগল যে পবন আর ভৈরব খুবই পুণ্যবান ও ভাগ্যবান তাই এমন ব্যক্তি তাদের বন্ধু হয়েছে, এমন ব্যক্তি ওদের সঙ্গে এসে ওদের আতিথ্য গ্রহণ করতে রাজি হয়েছে। প্রত্যেকেই তাকে নিজের কাছে রাখার ইচ্ছে প্রকাশ করছিল।
ইরাবতী নদীর জন্মস্থলে কালিহানি আর থামসার গিরিদ্বারের কোলে দুর্গম বড়া ভাঙ্গাল উপত্যকার গ্রামে তখন পড়ন্ত বেলার আমেজ। শৈত্যপ্রবাহ আগতপ্রায় দরজায়। সন্ধে নামার অপেক্ষা ওই দুই মহান গিরিদ্বারের মাথায়। এখানে এই শেষ বেলাতে এই আন্তরিক শৈব উপাসক গাদ্দি উপজাতির মানুষদের ভিড়ে তাদের হৃদয়ের উত্তাপ প্রত্যক্ষ করতে করতে সে ভাবল, হিমালয় মহান, তাই তার কোলের এই সন্তানেরাও মহান। মহানের সংস্পর্শে মহানেরাই থাকে। এরা সবাই সত্যিই বুঝিবা দেবলোকের বাসিন্দা।
অধ্যায়: এগারো
তাকে আবার মেলার মাঠেই ফিরিয়ে আনা হল। তাকে হাত ধরে নিয়ে এলো সেই কোটিকল্প। বলল,
‘জাদুজগৎটা রইল হাতের কাছেই। ইচ্ছে হলেই যখন খুশি তুই যেতে পারবি সেখানে। আমি যখন সঙ্গে আছি তোর চিন্তা নেই। তুই বরং মায়াপ্রকল্প বিশ্বটাতেই থাক আপাতত। দ্যাখ্ সেখানে মানুষজন কী করছে। তাদের সেসব কাজকর্মের পিছনে কী উদ্দেশ্য গোপন আছে সেটা বুঝতে গেলে তোকে আবার জাদুজগতে যেতে হবে। তুই বলবি, তোকে আমি নিয়ে যাব। জগতের মানুষজনকে দ্যাখ্, কার সম্পর্কে তোর জানার ইচ্ছে হয় বলিস। তবে তোকে বলে রাখছি, এই যে মায়াপ্রকল্পে কাজেকর্মে ব্যস্ত জগৎবাসী তাদের সমুদয় কাজকর্মের একটাই আসল উদ্দেশ্য। কেউ প্রত্যক্ষভাবে ছুটছে তার পিছনে, কারো মধ্যে সেই উদ্দেশ্য রয়েছে প্রচ্ছন্নভাবে। যেভাবেই থাকুক না কেন, জগৎ বা জগৎবাসী পরিচালিত সেই মহা উদ্দেশ্য চরিতার্থে। তোর মনে হতেই পারে, কেউ তো মুখে বলছে না সেই মহা উদ্দেশ্যের কথা। সবাই মুখে বা প্রকাশ্যে তাদের কাজেকর্মে দেখাচ্ছে কী প্রবল তাদের মধ্যে সমস্ত পার্থিব ধনসম্পদ, সুখস্বাচ্ছন্দ্য, খ্যাতিযশ, প্রভাব-প্রতিপত্তির চাহিদা। কথা হল, মানুষের এইসব মৌখিক চাহিদার পিছনেই লুক্কায়িত সেই মূল উদ্দেশ্য—- তার কথা স্পষ্টভাবে মায়াপ্রকল্পাধীন এইসব জনসম্প্রদায়ও কি ছাই বোঝে ? তারা নিজেরাই ওয়াকিবহাল নয় কেন তারা অর্থের পিছনে ছুটছে, কেন তাদের যেকোন প্রকারে সৎপথে বা অসৎপথে প্রচুর প্রচুর অর্থ হাতে পাওয়া চাই। তার জন্য কেন তাকে তার শৈশব, কৈশোর, যৌবন অথবা সমস্ত জীবনের সমস্ত স্বাভাবিকতাকে বাজি রেখে অথবা বর্জন করে দিবসরাত পাঠ্যপুস্তকে নিমগ্ন থেকে স্নানখাওয়া ভুলে বেড়ানো ভুলে সামাজিকতা ভুলে বিনোদন ভুলে যাবতীয় আনন্দ ভুলে কাষ্ঠকঠিন প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়ে সামিল হতে হবে কোন সুযোগ হস্তগত করার অভিপ্রায়ে কাম্য তালিকাভুক্ত হতে; যাতে সে আরও কঠিন বাস্তবতাকে অর্জন করতে সক্ষম হয়, যাতে সে তার ভবিষ্যতের আমৃত্যু জীবনটাকে বিকিয়ে দিতে পারে কোন প্যাকেজের অধীনস্থ করে যেখানে তার সাধ-আল্হাদ-অদৃষ্ট অথবা ললাটলিখন ঘোষিত হবে কোন নির্মম নিষ্ঠুর নিষ্পেষণের মুহূর্মুহু কষাঘাতে, সেখানে যে আর সে যেমন জন্ম নিয়েছিল যে আনন্দবারি সিঞ্চনে যে অমৃতলোকে থাকার জন্য তাকে আর কোনদিনই হাতের নাগালে পাবে না। কেন এই জীবন যে তার অধিকারী সে কি তা কোনদিনও জানতে পারে ? কোন্ মোহে বা কী উদ্দেশ্যে ? সেই আসল উদ্দেশ্যটা সে দেখতে পায় না কোনদিন, না দেখেই ছুটে মরে মায়াপ্রকল্পের এইসব দৃশ্য মায়াগুলির অদম্য নেশায় অপ্রতিরোধ্য হাতছানিতে। তাকে অন্যকিছু বোঝাতে যাওয়া নিষ্ফল হবে, বুঝবে না, এতই সে মায়াতে আচ্ছন্ন। সে এইসব মায়াগুলিকে বর্জিত থাকাকে বিফলতা বলে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, মায়াগুলিই তার কাছে বাস্তবতা। বিকল্প যেসব মহামুক্তির ধারণা তোকে বোঝালাম তাকে বলতে গেলে সে বলবে বাতুলতা, সে কৃপাদৃষ্টিতে তাকিয়ে তোকে ভাববে তুই আজব জীব। তোকে করুণা করবে, হেসে উড়িয়ে দেবে তোর কথা এবং তোকে বর্জন করবে তুই কাজের জগতে এক কল্পনাবিলাসী অসফল আপদ বলে। এ তো হল একটা মাত্র উদাহরণ।’
বলতে বলতে থামল কোটিকল্প। একটামাত্র উদাহরণের বহর দেখেই তার ততক্ষণে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। বর্ণনা আপাতত সাঙ্গ হওয়াতে সে কিঞ্চিৎ আরাম পেল। কী শুনল তা ভেবে বুঝতে চেষ্টা করল। কথাগুলি সমস্ত যে তার আদ্যোপান্ত স্মরণে ছিল এমন নয়, তবে অন্তরস্থ হয়েছিল ভাবার্থ বিষয়। সে চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করতে পারছিল সেই অদ্ভুত মানুষটিকে যে তার শৈশব থেকে সমস্ত জীবন উৎসর্গ করল এক লোভনীয় অথবা বরণীয় কেরিয়ার বানাতে যার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছে প্রতিবেশীরা, যাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করছে নিজেদের পুত্রকন্যার কাছে, যার কৃতিত্বে গর্বিত এবং অহংকৃত সেই ব্যক্তিটির জন্মদাতা ও জন্মদাত্রী পিতামাতা, আর যে নিজে ওইরূপ প্রবল কেরিয়ারের দৌলতে কোন গগনচুম্বী সংস্থায় কর্মপ্রাপ্ত হল বিপুল অর্থোপার্জনের চুক্তিতে যার ভিত্তিতে সে বাড়ি-গাড়ি ইত্যাদি সমস্ত সাংসারিক সুখ ও বিলাসদ্রব্যগুলিকে অবহেলায় করায়ত্ত করতে পারবে, জাগতিক সমস্ত বিনোদন ও কাম্য বিষয়সমূহকে পেতে পারবে ইচ্ছেমত হাতের মুঠোয়, তেমন এক সফল ব্যক্তি এ সমস্ত কিছু কেন করছে কী উদ্দেশ্যে সেই মূল প্রশ্নটা অবগত না থেকেই এ আবার কী কথা ? সে এসব কথা বিশ্বাস করতে পারল না। মেলাপ্রাঙ্গনে সে তার চোখের সামনে উদাহরণে উপস্থাপিত সেই ব্যক্তিটিকে দেখতেও পেল। খুব যে খুঁজতে হল তাকে এমন নয়। বেশি খুঁজতে হবেই বা কেন ? এমন ব্যক্তি ডুমুরের ফুল হতে পারে না। ভুরি ভুরি রয়েছে হাতের কাছে। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি। তারা সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে মেলার আর সমস্ত লোকের দলে। নানা কর্মে নানা পেশায় নিয়োজিত তারা। ভবিষ্যতে যারা তাদের দলভুক্ত হতে চলেছে সেই কেরিয়ার তৈরি করার সাধনায় নিমগ্ন মানুষগুলোও রয়েছে মেলার ভিড়ে। গুণে শেষ করা যাবে না তাদের সংখ্যা, সবাইকে দেখতে গেলে পাগল হয়ে যেতে হবে, জীবন কেটে যাবে কেবল ভিড় দেখেই। এইসব মানুষগুলি সদাব্যস্ত তাদের কাজে, মেলার ভিড়েই সামিল হয়ে আছে যদিও তাদের দিকেই কেবল নজর ফেললে মনে হবে যেন তারা ভিড়ে থেকেও নেই, চলছে একদম আলাদা পথে নিজেদের মত নিজেদের নিয়মে। তা এমন কাকে দেখেই না মনে হয় ? মেলার ভিড়টাকে চট করে দেখলে প্রথমে যে কোন দর্শনার্থীর মনে হতেই পারে একটা অগোছালো ব্যাপার, চলছে হুড়ুম-হুম লণ্ডভণ্ড জনতা। সবাই চলছে যে যেদিকে পারে, একের গতিপথ অন্যে কাটাকুটি করে, কোথাও কোন চলনে বা বলনে ছিরিছাঁদ নেই তিলমাত্র। প্রথম দর্শনে তারও এমনটাই মনে হয়েছিল। পরে সে এখানে থাকতে থাকতে বুঝেছে, দিনের পর দিন দেখে দেখে বুঝেছে, মেলাটা আসলে প্রথম দেখে সে যেমন ভেবেছিল তেমন নয় কোনক্রমেই। এখানে চলছে লোকজন ভুতগ্রস্ত হয়ে নয়, তাদের উদ্দেশ্য-বিধেয় সমস্তকিছুই জলাঞ্জলি দিয়ে নয়। চলছে নানা চরিত্রের জনতা নানা দিকে নানামুখে যদিও তবু প্রত্যেকটি চরিত্রের জনতার চলন অন্য চরিত্রের জনতার চলন থেকে আলাদা করা যায়। একেক দল জনতার চলন একেক ধর্মের, সেই ধর্ম প্রথমে বুঝতে হবে নিবিড় মনোযোগ দিয়ে, দেখে নিতে হবে তার বৈশিষ্ট্যসমূহ যত্ন সহকারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তবেই কেউ পরিশেষে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হবে যার সারমর্ম হল এই যে মেলার ভিড় মোটেই এলোমেলো নয়। ভিড়ের সামগ্রিক চলন আসলে বহুধাবিভক্ত অগণিত ধারাসমূহের আপন আপন চলনচরিত্রের এক মিশ্র ফল। এই মিশ্রণ একসঙ্গে পাকানো থাকে বলে প্রথম দর্শনে তালেগোলে হরিবোল লাগে। যথোপযুক্ত নিষ্ঠা দিয়ে সেই জটপাকানো মোটা দড়ি স্বরূপ ভিড় থেকে একেকটি সূত্রকে আলাদা করে চেনাও সম্ভব এবং সেই কর্মটি যে কাঙ্খিত অধ্যবসায় দিয়ে করতে সমর্থ হবে সে বুঝবে মেলার ভিড়ের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। সে তখন জানতে পারবে যে এই প্রতিটি সূত্র আসলে একটি নির্দিষ্ট চরিত্র বা শ্রেণিকে নির্দেশ করছে যেমন একটি উদাহরণ উপস্থাপিত হয়েছে অল্প আগে। এই নির্দিষ্ট সূত্রটি ভিড়সদৃশ মোটা দড়িগুচ্ছে পাকানো অবস্থায় থাকা সত্বেও তার স্বরূপ সহজেই উন্মোচন করা যায় যদি সূত্রটি দৃষ্টিগোচর হয়। এই সূত্র যেহেতু নির্দিষ্ট তার প্রকৃতি অজ্ঞাত থাকতে পারে কোন্ যুক্তিসাপেক্ষে ? যদিনা প্রকৃতি অনির্দিষ্ট হয় তার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য অপরিষ্কার থাকতে পারে না। সূত্রটি যখন মূল জট থেকে আলাদা করে চেনা যাচ্ছে তখন সেই সূত্রের গতিপথ ও প্রান্তবিন্দুগুলি জানা কী এমন কষ্টসাধ্য কাজ যে মূল উদ্দেশ্য অজ্ঞাত থাকবে ? সূত্রানুযায়ী চলছে যে জনতা সে জানবে না সূত্রের প্রান্তবিন্দুসমূহ ? একথা সে যুক্তি দিয়ে বিশ্বাস করতে নারাজ। আর নিজের সেই অবিশ্বাস সে তুলে ধরল প্রশ্নের আকারে,
‘এরা সবাই জানে না তাদের আসল উদ্দেশ্য ? ওই কেরিয়ার যেটা এত যত্নে এত নিষ্ঠায় গড়ে তুলল সেটা তাদের আসল উদ্দেশ্য নয় ? যাকে অবলম্বন করে তারা জীবনকে এমন সাফল্যে ভূষিত করল সেটা তাদের আসল উদ্দেশ্য হবে না কোন্ যুক্তিতে ? আমি তাদের অন্য কোন আসল উদ্দেশ্য থাকতে পারে এমনকিছু দেখছি না।’
কোটিকল্প বিনা বাধায় শুনল তার প্রশ্ন। সে থামলে পর শান্ত ভঙ্গিতে জানাল,
‘তোর মত তারাও ভাবে ওটাই তাদের আসল উদ্দেশ্য। কিন্তু এই জনতার পিছনে প্রচ্ছন্ন থাকে অন্য একটা বিষয়, যেটা মূল চালিকাশক্তি। সেটাই তার আসল উদ্দেশ্য যাকে কেউ বুঝতে পারে না এবং যে তার সমস্ত কাজকর্মের জন্য প্রেরণা জাগিয়ে রাখে অফুরন্ত।’
‘সেটা কী ?’
‘সেটা দেখবি গিয়ে জাদুজগতে। কিন্তু তার আগে একটা প্রশ্নের উত্তর দে। এই যাকে তুই সাফল্য বলছিস যে সেটা পেল তার তাতে কী লাভ ?’
‘লাভ নয় মানে ?’ সে বেশ অবাক হয়ে ভাবল, যে প্রশ্ন তাকে করল তার পথপ্রদর্শক তাতে মনে হচ্ছে যেন এত কিছু জানা সত্ত্বেও বোকার মত হয়ে গেল তা আর তাই সে যোগ করল, ‘এটাই তো সে পেতে চেয়েছিল। এই শীর্ষবিন্দুতে আরোহণ। সেই আরোহণটা যখন ঘটল তার মত লাভবান আর কে ? আমি যা হতে চেয়েছিলাম তা পেলাম, সেই সারাজীবনের অভাবনীয় আকাঙ্খা পূরণ আমার লাভ নয় ? শীর্ষবিন্দুকে পাওয়া ?’
তার যুক্তিগুলিকে শুনল সে কোন ব্যাঘাত না ঘটিয়ে।তাকে বলতে দিল যত সে বলতে চায়। শুনল শেষপর্যন্ত। সে বলা শেষ করলে পর সুস্থির ভঙ্গিতে জানতে চাইল,
‘কোন মানুষের ক্ষেত্রে শীর্ষবিন্দু বলে কিছু আছে কি ?’
একটু থমকে গেল সে প্রশ্নটা শুনে। খানিকটা ভাবল। উত্তর সাজাল,
‘হবে না কেন ? কেউ হয়তো সারাজীবন ধরে চেয়েছিল একদিন সে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবে। হতে পারল কোনদিন। ওটাই তার শীর্ষবিন্দু।’
উত্তর পেয়ে সে থেমে যাবে ভাবা গিয়েছিল। বাস্তবে তা হল না। কী যে সে ভাবছে বোঝা মুশকিল। থৈ পাওয়া যাচ্ছিল না। আবার সে প্রশ্ন তুলল,
‘তাতে কি সে থেমে যাবে ? পুরো শান্তি কি মিলল তার ?’
‘অবশ্যই মিলবে। সে তো সব পেয়ে গেল। আর কী বেশি পেতে পারে ? এত বড় উচ্চপদ পায় যেজন, যে তাকে ভাবে তার তুলনায় জীবনের সেরা প্রাপ্তি হিসেবে, যদি সে পেতে পারে সেটা কোনক্রমে কেন তৃপ্ত হবে না ?’
‘হয় কি ?’
তার অনবরত প্রশ্ন এসেই যাচ্ছিল একের পিঠে আরেক। এই প্রশ্ন করা কি থামবে না আর, ভাবছিল সে। তারও নেশা ধরে গিয়েছিল, হার মানা চলবে না। দেখা যাক কত প্রশ্ন করার ক্ষমতা থাকতে পারে তার। কোথাও না কোথাও তাকে থামতে হবেই। সে না থামা পর্যন্ত তাকেও থামলে চলবে না। সে তাই যুক্তি দেখাল,
‘একশ’বার হবে। প্রত্যেকটি মানুষের কোথাও না কোথাও গিয়ে চরম পরিতৃপ্তি লাভ ঘটে। ঘটতে বাধ্য। মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সীমানা থাকবেই। তারপরে সে আর দূরে যাবে না।’
শুনে সে না ভেবেই প্রশ্ন তুলল,
‘তাহলে তার অনন্ত চাহিদার কী হবে ?’
এবার সে বিভ্রান্ত হল। এই প্রশ্নটা সে শুনবে বলে ভাবতেই পারে নি। এটার কথা মাথাতেই ছিল না। সত্যিই তো মানুষের চাহিদার কোন সীমা-পরিসীমা নেই। সেখানে তো এটা সত্যিকথা। যেহেতু মানুষের রয়েছে অন্তহীন চাহিদা কোন প্রাপ্তিই তো তাকে তৃপ্তি দিতে পারবে না। তাহলে দাঁড়ালো কী ? দাঁড়ালো এই যে তার জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন ঘটল এবং সে বুঝতে পারল, তার দিগদর্শক কোন বাক্যই তার মর্মার্থ না বুঝে বলছে না। সে তার ধারেকাছেও আসতে পারবে না। তার তুলনায় সে জন্মের ঘন্টাখানেক পরের শিশু। তার আর কিছু বলার থাকল না, শ্রোতা হয়ে থাকা ছাড়া। তাকে নিরুত্তর দেখে কোটিকল্প বোঝাতে লাগল,
‘আসলে এই অনন্ত চাহিদাই কোন মানুষের জন্য মূল ও শেষকথা। কোন প্রাপ্তিই তাকে শান্তি দিতে পারবে না, তাকে থামতে দেবে না। কোন শীর্ষপদই তার কাছে চূড়ান্ত বলে মনে হবে না কোনদিন। তার উচ্চাকাঙ্খা বাড়তেই থাকবে। একটা উদ্দেশ্যপূরণ তার কাছে আরও বড় উদ্দেশ্যপূরণ লক্ষ্য হিসেবে নিয়ে আসবে। এভাবে যদি একের পর এক তার উদ্দেশ্যপূরণ ঘটতেই থাকে তাহলে শেষপর্যন্ত একসময় সে গিয়ে পৌঁছবে তার আসল উদ্দেশ্যপূরণের প্রসঙ্গে, যা এতদূর পর্যন্ত সুপ্ত ছিল তার মধ্যে, তার কাছে অজানা ছিল। সে এবার সেটা চিনবে, তাকে সে পেতে চাইবে। এভাবেই একদিন জানা যাবে কোন্ অজানা উদ্দেশ্য এতদিন তার মধ্যে সুপ্ত থেকে তাকে অফুরন্ত প্রেরণা জুগিয়ে এত কাজ করিয়েছে তাকে দিয়ে, তাকে এতদূর টেনে এনেছে।’
কোটিকল্প থামল। সে বেশ হতবাক সব শুনে। অভিভূত গলায় প্রশ্ন জানাল,
‘সেটা কী ?’
‘সেটা তুই দেখতে পাবি জাদুজগতে গিয়ে। তবে তোকে এটাও জানাচ্ছি যে ওই মূল উদ্দেশ্যপূরণও কিন্তু থামতে দেবে না কাউকে। সেটাকে যদি সে করায়ত্ত করতে পারেও তখন তার লক্ষ্য হবে আরও বড় কিছু। সেটা কী আমারও জানা নেই। হতে পারে তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম। তার আগে তুই মেলার অন্য মানুষগুলিকে দেখে নে। আমি তো মোটে একটি উদাহরণ দেখলাম তোকে এতক্ষণ। অন্য সমস্ত উদাহরণও আছে। সেগুলিও তো বুঝে নেওয়া দরকার। চল্, দেখি।’
দেখার প্রসঙ্গ তুলতেই সে হুড়মুড় করে বলে উঠল,
‘আমাকে এবার সাধারণ স্বাভাবিক লোকজন দেখাও। এসব বড় বড় মানুষজনের বড় বড় চাহিদা আর কাজকর্ম দেখলে এ পর্যন্ত।সাধারণ মানুষ দেখাও।’
কোটিকল্প অবাক হওয়ার ভঙ্গি দেখিয়ে বলল,
‘আমি দেখাব কী রে, সব তো তোর চোখের সামনেই আছে। তুই নিজের ইচ্ছেমত যাকে খুশি দেখে নে। তাকে বুঝতে না পারলে বলবি, বুঝিয়ে দেব। তবে জানবি, এই যে একটি কেরিয়ারসর্বস্ব মানুষের উদাহরণ দিলাম এ কিন্তু একজন সাধারণ মানুষই, তুই যেসব ছাপোষা লোকদের কথা বলতে চাইছিস তার সঙ্গে এই ব্যক্তির কোন তফাৎ নেই। বরং জানবি, আরও সাধারণ মানুষেরও আসল উদ্দেশ্য এই একটাই যা রয়েছে অন্যদেরও এবং সেটা বোঝা আরও জটিল যেহেতু তারা নিজেদের কোন লক্ষ্যই প্রকাশ করতে শেখেনি। তোর ধারণামত এই ছাপোষা মানুষগুলিকে দেখে তোর মনে হবে তারা বুঝি বেঁচে আছে কেবলই বেঁচে থাকতে হয় বলে, তারা কেউ দশটা-পাঁচটা অফিস করে, দোকান চালায়, দালালি করে, নানারকম উঞ্ছবৃত্তি করে কেউবা সংসার প্রতিপালনের জন্য, কেউ শ্রমিক, কেউ খাতা লেখে, কেউ গাইড, কেউ শিক্ষক, কেউ উকিল, কেউ গাড়ি চালায়, কেউ মাল বয়, কেউ চাষী, কেউ মাছ বা সবজি বিক্রি করে এমনই কত্তো কিসিমের কাজকর্ম করে জীবন কাটায়। তারা সকালে বাজার করে, সারাদিন নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে, সন্ধেবেলা পাড়ার ক্লাবে বা চায়ের দোকানে আড্ডা মারে, সঙ্গীদের নিয়ে তাস খেলে বা নেশা করে, বাড়িতে ছেলে-মেয়ে-বউয়ের কাছে হম্বিতম্বি করে বা ভিজে বেড়াল হয়ে তাদের হম্বিতম্বি সহ্য করে, রাজাউজির মারে চেনামহলে।এই তো ? এদের তুই দেখতে চাইছিস ? দ্যাখ্ না যত খুশি, এদের দেখলে তুই আরও ভড়কে যাবি যেহেতু এরা বাঁচতে গেলে কাউকে যে কিছু প্রাথমিক উদ্দেশ্য সামনে রেখে চলতে হয় সেটাও ভেবে দেখে না কোনোদিন। তুই জিজ্ঞেস করলে বলবে, লক্ষ্য আবার কী, বেঁচে আছি বলেই বেঁচে থাকছি, খাচ্ছি-দাচ্ছি, হেঁটেচলে বেড়াচ্ছি। এর আবার কোন উদ্দেশ্য-বিধেয় থাকতে হবে নাকি ? এরা সবাই আজ দিনটার জন্যই বাঁচে, কাল আসবে ভাবেই না। আরও সাদা কথায়, এরা যে মুহূর্তে বেঁচে থাকছে সে মুহূর্তটাকেই চেনে, অন্যসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। এরা সবাই মুহূর্তেকের জীব, এদের মধ্যে যদি তুই বেঁচে থাকার আসল উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে যাস তো আরও খাবি খেতে হবে। এরা সবাই উদ্দেশ্যবিহীন, এলোমেলো জীবনাচরণে। কিন্তু জানবি, এদের মধ্যেও অন্তরদেবতা ঘুমিয়ে থাকলেও মনে তার সুপ্ত বা গুপ্ত রয়েছে সেই একই উদ্দেশ্যে যাতে চালিত গোটা জীবসমাজ।’
‘সেটা কি জানতে হবে জাদুজগতে গিয়েই ?’
প্রশ্ন করলে যে উত্তর পেয়েছে এযাবৎ সেটা তার জানা বলে নিজেই সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে দিল কাম্য প্রশ্নে। উত্তর পেল,
‘অবশ্যই। মায়াপ্রকল্পে সবই তো মায়াচ্ছন্ন, আসল-নকল বুঝবি কী করে ? তোর এখানে দেখা সাঙ্গ করে নে, তারপর এদের আসল উদ্দেশ্যটা দেখবি জাদুজগতে গেলে।’
তো সে এইসব সাধারণ বা ছাপোষা মানুষগুলির জীবন পরিক্রমা দেখতে গেল। তারাও সবাই মিলেমিশে জগাখিঁচুড়ি পাকিয়ে রয়েছে মেলার ভিড়ে। মোটা গুচ্ছদড়ির মধ্যে তারাও সবাই পাকিয়ে রয়েছে নানারকম নানারঙা সূত্র হয়ে। তবে তাদের সুতোর রঙ বিবর্ণ—- চটে যাওয়া হলদে বা লাল বা সবুজ এইরকম। হোঁচট খেতে খেতে চলছে তারা, গমনপথ মসৃণ নয়, ওঠা-নামায় ভরপুর, কোথাও বা বিচ্ছিন্ন, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট। চলনে নেই কোন ছিরিছাঁদ বা জাঁকজমক, নেই কোন ঠমক বা গমক। অতীব সাদামাটা বলতে যা বোঝায়, কোন চমকের লেশমাত্র নেই। তারা সবাই মুখ বুজে চলেছে, দেখলে মনে হবে কেউ চালিয়ে দিয়েছে বলেই চলছে। বড়োই মুখচোরা চলন, কোন ভাষাই নেই চলাচলে। সে দেখে বুঝল, এদের মধ্যে আসল উদ্দেশ্য কী এই চলনের তার প্রকাশ ঘটা তো দূরস্থান, আদৌ কোন ইচ্ছে-অনিচ্ছে আছে কিনা সেটাও আঁচ করা মুশকিল। এরা কোন স্বপ্ন দেখতে জানে কিনা সন্দেহ, স্বপ্ন দেখা যেতে পারে জীবনে বুঝিবা সেটাও শোনেনি কোনদিন। এরা যে বেঁচে আছে, সংসারধর্ম পালন করছে সেটাও বোঝার উপায় নেই এত নীরব এরা। কী লাভ এদের দেখে, এরা তো সব জীবন্ত শবদেহ সমান, ভাবল সে। নিজের কথা জানাতে এমনভাবে অক্ষম কোন মানুষ যে দেখলে মনে হবে বুঝি ভাষার ব্যবহার শেখেনি কেউ। এরা কথা বলতেই জানে না, উদ্দেশ্য-বিধেয়র হদিশ অবশ্যই জানবে না। বলল তাই,
‘এদের দেখার কোন মানে হয় না। এরা সব অপোগণ্ডের দল। এদের স্বকীয়তা বা স্বাধীনতা বলে নেই কিছুই। এরা একেবারেই মানুষ নয়, এই সাধারণ জনতা। সব কীটপতঙ্গের দল।’
‘কিন্তু এদেরও কণ্ঠস্বর আছে। সম্মিলিত কণ্ঠস্বর, তা বড়োই সবল ও প্রবল। ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজের ইচ্ছের কথা প্রচার করে না ঠিক, সেই অর্থে আসল উদ্দেশ্যটার প্রকাশ বড়োই জটিল পন্থায়। তবে একটা কথা ঠিক, এরা প্রকার-প্রকরণে বড়োই সরল। ‘
কোটিকল্প বোঝাবার চেষ্টা করল। সে বিরক্তি ঢালল তার কথায়,
‘সেই সরলতা দিয়ে আমার কী হবে ? কী জীবনের বা চলাচলের আসল উদ্দেশ্য তা কি এদের পিটিয়ে মেরে ফেললেও এরা বলতে পারবে ?’
‘এত হেলাফেলা করবি না,’ গলায় গাম্ভীর্য দিগদর্শকের, ‘এরা, এই সাধারণ মানুষরা জগৎকে বোঝে তাদের মত করে, তাদের চোখ দিয়ে দেখে। আমার তো মনে হয়, কী জীবনধারণের আসল উদ্দেশ্য তা এরা বোঝে সর্বাধিক, নিজেদের মত করে।জগৎকে আসলে এরাই চালায়।এরা চললেই চলে জগৎ, নইলে অচল।’
‘তুমি দু’রকম কথা বলছ,’ সে প্রতিবাদের গলা তুলল, ‘একটু আগে তুমিই বলেছ যে এদের জীবনযাপন জটিলতায় ঢাকা আর তাই আসল উদ্দেশ্য এদের দেখে বোঝা বেশি কঠিন। আবার এখন বলছ উল্টোটা।’
‘তুই আমার কথা ভুলভাবে বলছিস,’ কোটিকল্প সংশোধন করে দিল, ‘আমি একবারও বলিনি যে এদের জীবনযাপনে জটিলতা আছে। বরং বলেছি উল্টোটা। বলেছি যে এদের জীবনযাপনে আছে এতটাই সারল্য যে কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সামনে রেখে চলতে জানে না এরা এবং যেহেতু এদের চলনে কোন লক্ষ্য দেখতে পাবি না তাই আসল উদ্দেশ্য কী হতে পারে তার সদ্ধান জানা আরও জটিল হয়ে যাবে। কিন্তু তোকে এই সত্যিকথাটা জানাচ্ছি যে এই সাদামাটা মানুষগুলি জীবনের আসল উদ্দেশ্যটা বোঝে সবচেয়ে ভালো এবং সবচেয়ে সরলসাদা কথায়। তোকে বলেছি প্রতি পদে পদে ওই আসল উদ্দেশ্যটা জানতে হলে জাদুজগতে যেতে হবে, বলেছি তো ? সেটা ওইসব বড় বড় চাহিদাসম্পন্ন লোকগুলির জন্য বেশি দরকার। তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলবে বড় বড় স্বপ্নের কথা, বড় বড় লক্ষ্যের কথা, আসল উদ্দেশ্যটা বলতেই পারবে না। কিন্তু এইসব সাধারণ মানুষগুলি ? আসল উদ্দেশ্যটা কী জানতে চাইলে এদের নিয়ে জাদুজগতে যেতে হবে না, এখানে এই মেলাতেই যদি বুদ্ধি করে সরলসাদা প্রশ্ন করতে পারিস বিচক্ষণতার সঙ্গে ওরা এক কথায় বলে দেবে উত্তরটা। কোন ধানাই-পানাই করবে না। তোর তো দেখছি কিছু বলার আছে মনে হচ্ছে দেখে।’
‘আছেই তো। তুমিই বা তাহলে জাদুজগতে নিয়ে গিয়ে উত্তরটা জানাতে এত ধানাই-পানাই করছ কেন ?’ অভিযোগের গলা তার, ‘কেনই বা ধানাই-পানাই করছিলে এদের দেখতে চাইছিলাম বলে ? আমি তো গোড়া থেকেই এদেরকে দেখতে চাইছিলাম। তুমিই আমাকে সাড়া দিচ্ছিলে না।’
কোটিকল্প হেসে ফেলল। এবার তত ঘূর্ণি নেই হাসিতে। বলল,
‘তাহলে শোন্, বলছি, না বলে আর উপায় নেই এখন। তুই এতদিনে সাবালক হয়েছিস বুঝতে পারছি। এদিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, এত ভনিতা তাই। তুই আর এখন খাবি খাওয়ার অবস্থাতে নেই, চোখকান খুলে গেছে। রেগে হয়তো আগুন হয়ে যাবি, তবুও বলতে হবে রহস্যটা। জাদুজগৎটা আসলে একটা ভড়ংবাজি, না এনে উপায় ছিল না বলে আনতে হয়েছিল। লোকেরা সব জাদুর মোড়কে দেখতে ভালোবাসে। তারা ভাবতেই পারবে না সব উত্তর রয়েছে স্বাভাবিকতায়, চোখের ওপর। জটিল যাদের জীবনপ্রণালী তাদের কথা জাদুজগতে গিয়েই জানা যাবে। সরল লোকরা জাদুটাদুর ধার ধারে না, এক কথায় জানিয়ে দিতে পারে জীবনের গূঢ় রহস্য। কিন্তু জটিল লোকগুলিকেও তো বুঝতে হবে ? তারা সব জগতের দর্শন-বিজ্ঞান রচনা করে। সাধারণ মানুষ তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। তাদের কথা বেশি বেশি না জানলে মনে হতেই পারে জগতের আসল বিষয় জানা হল না। যাদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয় জগতের সাধারণের চলন ও কণ্ঠস্বর, সেই অসাধারণ ও প্রকৃত অর্থে জটিল লোকদের কথা প্রতিফলিত হয় একমাত্র ওই জাদুজগতেই। তাই তার আমদানি। সাধারণ মানুষকে বুঝতে পারবি মেলার মাঠে বসেই, জিজ্ঞেস করলে স্পষ্ট বলে দেবে অন্তরের কথা, কোন রাখঢাক থাকবে না। মুশকিল হল, তাদের অত সাদামাটা কথা বিশ্বাস করতে পারবে না কেউ। লোকেরা চায় অলংকার, বাগাড়ম্বর। তাই এই জাদুজগৎ। কিন্তু যদি আস্থা রাখতে পারিস তো এখানে এই মেলার মাঠে বসেই সাধারণ মানুষকে প্রশ্ন করে জেনে যেতে পারিস কী সব মানুষের জীবনযাপনের আসল উদ্দেশ্য। উপযুক্ত প্রশ্ন করলে তারা তোকে এককথায় বলে দেবে তা। সহজে জেনে যেতে পারবি অত জটিল প্রশ্নের উত্তর।’
শুনে সে কিছুটা সময় চুপ করে কিছু ভাবল। তারপর ক্ষীণ অভিযোগের গলায় বলল,
‘আমি প্রথম থেকেই চাইছিলাম অসহ্জ লোকগুলিকে না দেখতে। সহজে জেনে যেতে পারি প্রশ্নের উত্তর যাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের এড়িয়ে চলার তো কোন যুক্তি নেই।’
‘জানিস না একটা সারসত্য যে জগৎ চলে জটিল পথেই ? বিজ্ঞানের সোজা কথাটি তুই দেখতে পাবি, বুঝে নেওয়ার রাস্তাটা বড়োই জটিল। দার্শনিকরা জীবনের সরলতম বিষয়টি বোঝাবে তোমাকে অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়াতে। সহজকে সহজভাবে পেতে জগতের বড়োই অনীহা। তুমি জটিল পথে চলে তবেই জানতে পারবে জগতের সব নিয়ম সরল, কারণ যত জটিল হবে প্রক্রিয়া তত সুন্দর হবে সরলের প্রকাশ।’
থামল কোটিকল্প। সে আবার গম্ভীর হয়ে ভাবতে লাগল। তারপর কিছুটা আবদার গলায় ফুটিয়ে তুলল আগ্রহের সুরে,
‘তাহলে এইসব সাধারণ মানুষকে আমি কী প্রশ্ন করব বলে দাও যাতে তারা সহজ ভাষায় বলে দেবে সমগ্র মানবজাতির অথবা জীবকুলের মূল উদ্দেশ্য কী।’
উত্তর দিতে গিয়ে দিগদর্শক একটু বিরতি নিল এবং বলল,
‘তুই তাদের কাছে যা, গিয়ে একেবারে প্রাথমিক প্রশ্নটা করবি, সেটা হবে তেমন কাজ সম্পর্কে যা প্রত্যেকটি লোককে অবশ্যই করতে হয়।’
‘সেই প্রাথমিক প্রশ্নটা কী ?’
‘বললাম তো, যে কাজটা জীবমাত্রেরই করতে হয় সেইটা নিয়ে যে প্রশ্ন। তুই ভেবে দ্যাখ্, কী না করে উপায় নেই মানুষের বা জীবকুলের। ভেবে বল্ না।’
সে ভাবল একটু সময়। প্রশ্নের আকারে জানতে চাইল,
‘সবাইকে খেতে হয়, পরতে হয়, এসবই তো না করে উপায় নেই ?’
‘ঠিক, তবে খাদ্যগ্রহণটা এক্কেবারে প্রাথমিক। তুই গিয়ে প্রশ্ন কর্, খাও কেন তোমরা, খাওয়ার কী দরকার। তারপর প্রশ্ন করতে পারিস, বিয়ে করে কেন সংসার তৈরি করতে যাচ্ছ, কী লাভ সংসার বানাবার। প্রশ্ন করে দ্যাখ্, সাধারণ লোক কী বলে। অসাধারণ লোক বলবে যা শুনে থৈ পাবি না। সাধারণ লোক দেবে সোজা উত্তর।’
সে নিজের মনে বক্তব্য বিষয় নিয়ে খানিকটা নাড়াচাড়া করতে লাগল। সে ভাবল, কেউ যদি তাকে এই প্রশ্নগুলি জিজ্ঞেস করত সে নিজে কী উত্তর দিত। নিজের উত্তরটা নিয়ে এদিক-ওদিক-নানাদিক ভেবে নিল। তার চোখের সামনেই মেলার জনস্রোত চলমান। এখানে সবাইকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল স্পষ্ট যে এদের মধ্যে নেই কোন অসাধারণ মানুষ, তারা রয়েছে অবশ্যই ভিড়ের মোটা দড়িগুচ্ছের কোন সরু সরু পাকানো সুতোয়। আপাতত তাদের প্রকাশ একেবারেই প্রাধান্য পাচ্ছে না। সে ভাবল, হতে পারে এটা তার দিগদর্শকের কোন কৌশল। সে দাবি মেনে তার সামনে থেকে ওইসব অসাধারণ বিখ্যাত মানুষগুলিকে সরিয়ে রেখেছে, তারা উহ্য হয়ে আছে চলমান মেলাপ্রাঙ্গণের ভিড়ের প্রসঙ্গ থেকে। এই ভিড়ে যারা রয়েছে তারা সবাই জনগণ, তারা সমস্তই সে যেমন বোঝে তেমন ছাপোষা মানুষের ভিড় যারা একা কোনকিছু ঠিক করে না, কোন তত্ত্ব তৈরি করে না, কোন দার্শনিক মতামত দেয় না, সমাজকে সংস্কার করতে চায় না, রাজনৈতিক নেতা হওয়ার দৌড়ে নেই, বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্ন দেখে না লিখে বা গান গেয়ে বা খেলাধূলা করে বা অন্য কোন উপায়ে, তাদের জীবনে কোন উচ্চাকাঙ্খা নেই, আছে যা তাকে স্বাভাবিক রাস্তায় জীবনযাপনের প্রক্রিয়া বলা যেতে পারে। তাদের কণ্ঠ জনগণের কণ্ঠ, তাদের কোন একক সর্বজনগ্রাহ্য কণ্ঠ থাকে না, তারা কথা বলে সম্মিলিত ভাবে, কিন্তু তাদের সেই সম্মিলিত গর্জন সমাজ ও সভ্যতাকে কাঁপিয়ে দিতে পারে, চালিত করতে পারে। এই জনতার ভিড়ে এবং তাদের একটানা চলনে সে শুনতে পাচ্ছিল সেই জনগণের কণ্ঠের না থামা গুঞ্জন। সে এবার স্থিরনিশ্চিত হল যে তার জন্যই কেবল এই জনতার ভিড়কে সামনে রাখা হয়েছে কোন অজানা কারসাজিতে। যদি সে গিয়ে ওই জনগণের ভিড় থেকে কোন এক বা দু’জনকে তার প্রস্নগুলি করে তারা কী উত্তর দেবে ? সে নিজে কী উত্তর দিত ? সে কথাটাই জানাল সে,
‘আমি তো ভাবছি আমাকে কেউ আমি কেন রোজ খাচ্ছি এই প্রশ্নটা করলে বলতাম খাওয়া দরকার তাই খাচ্ছি।’
‘যদি এই উত্তর হয় তো উত্তরদাতাকে তোর পরের প্রশ্নটা করতে হবে, খাওয়ার দরকার হচ্ছে কেন।’
‘সে বলতে পারে, দরকার-টরকার বুঝি না, খিদে পাচ্ছে ইচ্ছে হচ্ছে তাই খাচ্ছি।’
‘সেক্ষেত্রে তোকে পরের পর প্রশ্ন করে যেতে হবে যতক্ষণ না সে আসল উত্তরটা দেয়।’
‘সেটা বুঝবো কী করে ?’
তার গলায় অসহায় সুর। দিগদর্শক বোঝাল,
‘বুঝতে পারবি ঠিক একসময় কোন্ টা আসল উত্তর, সেটা স্পষ্ট বোঝাবে খাওয়ার প্রাথমিক উদ্দেশ্যটা। ততক্ষণ তাকে প্রশ্ন করতে থাকবি তোর মত করে যাতে সে শেষপর্যন্ত তুই যেটা শুনতে চাইছিস সেটা বলে। যদি তুই যা বললি সেটাই হয় তার উত্তর তো তোকে পরের প্রশ্ন করতে হবে, খিদে পেলে দিনের পর দিন যদি না খাও তো কী হবে।’
‘সে বলতে পারে, বা রে, তাহলে কাজকর্ম করব কী করে।’
‘তাহলে তোর প্রশ্ন হবে, কাজকর্ম করার জন্য কর্মক্ষম থাকার কারণেই খাচ্ছ, খাওয়ার আর কোন উদ্দেশ্য নেই কি।’
‘সে বলতে পারে, বা রে, দিনের পর দিন না খেয়ে থাকলে তো না খেয়েই মরে যাব।’
তার কথা শেষ হতে না হতেই কোটিকল্প তাকে প্রায় থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ব্যস, তোর জায়গাতে তুই পৌঁছে গেলি। এটাই আসল উত্তর, কিছুটা পরোক্ষভাবে হলেও। প্রত্যক্ষভাবে উত্তরটা জানতে হলে তোকে আরেকটা প্রশ্ন করলেও ক্ষতি নেই। তুই এবার তাকে প্রত্যক্ষভাবে এই প্রশ্নটা করতে পারিস, তুমি বললে না খেয়ে থাকলে একসময় তুমি মরে যাবে, তার মানে তোমার খাওয়ার মূল উদ্দেশ্য বেঁচে থাকা। যদি এই প্রশ্নটা হয় তাহলে উত্তরটা কী হবে ? মনে কর্, তুই শুনলি প্রশ্নটা। কী উত্তর দিবি ?’
একটু ভাবল সে। ভেবে সতর্ক গলায় জানাল,
‘আমি হলে বলব, হ্যাঁ।’
কোটিকল্প বেশ সপ্রতিভ গলায় ও ভঙ্গিতে বলল,
‘তুই কেন, এই একই উত্তর দেবে সমস্ত লোক। শোন্, অধিকাংশ লোক প্রথম প্রশ্নটার উত্তরেই এই কথাটা বলে দেবে। তুমি কেন খাচ্ছ, প্রশ্নটা করলেই কেউ অত ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে উত্তর না দিয়ে বলে দেবে, খাচ্ছি বেঁচে থাকব বলে। প্রশ্ন করে দ্যাখ্ না প্রত্যেকটি লোককে, দশজনের মধ্যে আটজনই সোজাসুজি এই কথাটাই বলবে। ইচ্ছে হলে প্রশ্ন করে দ্যাখ্ লোকের পর লোককে ধরে। দ্যাখ্ না পরীক্ষাটা করে।’
সে কিছুটা অনুপ্রাণিত হল লোককে ধরে ধরে প্রশ্ন করার জন্য। সবাই তো যাচ্ছিল তার সামনে দিয়ে, ভিড়ের সাধারণ জনতা। নানারকম চেহারা, বেশভূষা, হাঁটাচলা প্রত্যেকের। কোটি কোটি লোক তারা, কিন্তু একটি লোকের থেকে অন্যজন কোন না কোন দিক থেকে আলাদা অবশ্যই, এমনকি যদি কোন লোকের কেউ যমজ তাকেও তার অন্যটির থেকে কোন না কোনভাবে দু’রকম ভাবা যাচ্ছে। স্রোতের এই লোকসমূহকে ধরে ধরে প্রশ্ন করা যেতে পারে, করাটা বেশ উৎসাহোদ্দীপক কাজও বটে, কিন্তু করাটাতে একটাই তার আপত্তি মনে মনে, সে এতোই কমবয়সী বালকসদৃশ চেহারার যে সে প্রশ্ন করতে গেলে লোকেরা তাকে পাত্তাই দেবে না হয়তো। ভাববে, এই বালকটির কথায় কান দেওয়ার কোন মানেই হয় না, হেসে উড়িয়ে দেবে তাকে সবাই। তার এই ভয়টা সে এবার প্রকাশ করল,
‘আমি এতটাই বালক, চেহারাতেও বটে, লোককে কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে কেউ শুনবেই না।’
তার ভয়টা শুনে দিগদর্শক চট করে উত্তর দিল না। তার কপালাকৃতি চেহারাচিত্রণে ভাঁজসদৃশ প্রকাশ দেখা গেল এবং চিন্তিত শোনাল গলা,
‘সেটা একটা কথা বটে। তুই ঠিকঠাকই ভেবেছিস। আসলে বড়দের দুনিয়ার সমস্যা এখানেই, তারা ছোটদের কাজকর্ম, কথাবার্তা ছেলেমানুষী বলে সত্যিই হেসে উড়িয়ে দেয়। বড়োরা ছোটদের সঙ্গে কথা বলে সবসময় অন্যরকম গলায়, অন্য ভঙ্গিতে, অন্য ভাষায়। এতে যে কতটা তাদের চেহারাবিকৃতি ঘটে তারা ছাই নিজেরাও কি সেটা বোঝে ? বুঝলে এমন কৃত্রিম আচরণ করত না। ছোটরা যে তাতে বিরক্ত হয় তারা বোঝে না। লোকগুলো আসলে যেমন ছোটদের সঙ্গে কথা বলার সময় তেমনই স্বাভাবিক থাকতে পারে, তাতে ছোটদের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যাবে এবং ছোটরা তাদের নিজের বন্ধু ও প্রিয় বলে মনে করবে। কিন্তু বড়দের দুনিয়ার মানুষগুলির কেন যে এই দুর্বুদ্ধি কেজানে, কেন যে তারা ভাবে ছোটদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাদের মত হতে হবে এবং নিজেকে সঙ সাজাতে হবে সেটা ওই মাথামোটা বড় বড় ধারি ধারি লোকগুলি নিজেরাই কখনো ভেবে দেখার মত সুবুদ্ধির নাগাল পায় না। এখানেই যত সমস্যা। আসলে কী জানিস, বড়দের দুনিয়ায় বাস করে যেসব মানুষ তারা জীবনের স্বাদ ভুলে যায়, বেশি বেশি বুঝতে বুঝতে জীবন তাদের কাছে তিক্ত। এসব লোকেরা বড় হওয়ার প্রক্রিয়াতে সহজ-স্বাভাবিক দুনিয়াটাকে হারিয়ে ফেলে এবং বেশি বুঝতে গিয়ে নিজেদের স্বার্থপর মর্কট বানিয়ে ফেলে। বড় হওয়াটা তুই জানবি এবং পরে নিজেও টের পাবি যে জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি বা অভিশাপ। বড় হলে তুই তোর এই সহজ-সরল পৃথিবীটাকে হারিয়ে ফেলবি। ক্রমাগত চাপে ভুগতে ভুগতে তুই ভুলে যাবি স্বপ্ন দেখার কথা, ছোট বয়সের কাজকর্ম তোরও মনে হবে ছেলেমানুষী। কিন্তু কী বল্ তো, এই ছেলেমানুষী দৃষ্টিভঙ্গিটা হারিয়ে যায় বলেই বড়দের জীবন এত জটিলতায় ভরে যায়। তারা আর কোনদিন নিঃস্বার্থ, স্বাভাবিক থাকার কথা ভাবতে পারে না, ভাবাটাকে মনে করে বোকামি। বাকি জীবনে এই মানুষটি তার সেই অমূল্য হারিয়ে ফেলা জীবনটাকে আর কোনদিনও ফিরে পায় না, শেষপর্যন্ত মৃত্যু হয় তার অতীব দুঃখজনক পরিস্থিতিতে। তখন সে এক জটিল, স্বার্থপর, হিংসুটে, বিশ্বনিন্দুক, বিতৃষ্ণ ও সবার অপ্রিয় দুর্জন বৃদ্ধ। কেউ আর তাকে পছন্দ করে না, ভালোও বাসে না, সেও কাউকে ভালোবাসতে পারে না। তার চোখে ও মনে তখন কেবলই সন্দেহ আর কেবলই ঘৃণা। সে পরিণত হয় এক চূড়ান্ত অমানুষে।’
কথাগুলি বলতে বলতে থামল তার পথপ্রদর্শক। সে যত শুনছিল তার মধ্যে হতাশা বাসা বাঁধছিল। তাহলে কী হবে ? সে তো এখনও বুঝতে পারল না কী মানুষের আসল উদ্দেশ্য ? সে সবেমাত্র জেনেছে যে প্রশ্নোত্তর প্রক্রিয়াতে সেই অভীষ্ট জানাটার জায়গায় পৌঁছনো গেছে, জানাটা পুরো হয়নি এখনও। সেটা জানতে হলে মাঠে নেমে তার এই জায়গাটা যে সঠিক সেটা যাচাই করে নিতে হবে। কিন্তু তার মাঠে নামার তো এটাই বড় বাধা, সে তো বালক, বড়রা তার সঙ্গে কথা বলবে কেন ? দেখা গেল যে তার দিগদর্শকও এই প্রশ্নটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে এবং জানিয়েছে যে তার মত একজনের সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্ক লোকরা এত গুরুগম্ভীর আলোচনায় যাবে না। অতএব আর কী ? সে যখন পুরোপুরি হতাশ হতে চলেছে তখন কোটিকল্প তাকে সাত্বনা দিয়ে জানাল,
‘ভাবিস না। ব্যবস্থা সব আমার হাতে। তুই ভেবে মরছিস কেন ? বড়োরা যাতে তোর সঙ্গে কথা বলে সেই উপায় করছি। তোকে তাদের মত বড় বানিয়ে দিলেই তো হয়ে যায়। ওটা আমি যখন-তখন করতে পারি।একটু এগিয়ে-পিছিয়ে দেওয়ার ব্যাপার। আরে, ওই এগিয়ে-পিছিয়ে দেওয়ার কাজটাই তো করি আমি। ওটা আমার পেশাও বলতে পারিস। এত নিখুঁত ভাবে কাজটা করি যে মানুষ বুঝতেই পারে না কিভাবে তার জীবন কেটে যায়। কেটে গেলে তখন বোঝে, কেটে গেল। তারপর আসে তার শেষদিন। আর সে বোঝে পৃথিবীর বুকে তার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে, সারাটা জীবন সে কিভাবে শেষ করে দিল বাউণ্ডুলে ও বেহিসেবী হয়ে। সে তখন আমার হাতে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়, যেটা করা তার আগেই উচিত ছিল। আমিই বা তখন কী করি বল্ তো তাকে নিয়ে ? সে তখন বোঝা আমার নিয়মে। আমি আর যাই করি জানিস, নিজের নিয়ম ভাঙ্গি না। আমি কেবল এগিয়ে যাই এখন থেকে। আমি অতীতে ফিরে যেতে জানি না। এই মরণাপন্ন লোকটির হাত ধরলে আমাকে পিছিয়ে যেতে হয়। সেটা নিয়মবিরুদ্ধ। তবে তোর জন্য আমি সবকিছু করতে পারি, কারণ তুই আমাকে বুঝেছিস, আমার হাত ধরেছিস, আমাকে তোর আশ্রয় বলে ভেবেছিস। তোর ক্ষেত্রে দরকার হলে আমি পিছিয়েও যেতে পারব নিজের নিয়ম অক্ষুণ্ন রেখে। তবুও দ্যাখ্, তোকে আমি পিছিয়ে নিয়ে যাব বলে ভাবছি না, কারণ ওটা আমার নিয়ম বহিৰ্ভূত কাজ। আমি নিজেও সেটা করি না। যদিও তোকে পিছিয়ে নিয়ে যাওয়ার দরকার হলে তাই যাব, কারণ তোর বয়সে আবার সমস্ত জীবন অতীতে পিছিয়ে গিয়ে শুরু করা সম্ভব। যদি পিছিয়ে যাসও তুই, কেবল তুইই পিছিয়ে যাবি, বাকি জগৎ যেমন চলছে সম্মুখের দিকে তেমনই চলতে থাকবে।’
অনেকটা সময় কথা বলে থামল কোটিকল্প। সে জিজ্ঞেস করল,
‘তাহলে কী করবে তুমি এখন আমাকে নিয়ে ?’
‘তোর বয়সটা বাড়িয়ে কেবল তোকেই বড় বানিয়ে দেব। অন্তত কুড়ি-পঁচিশ বছর এগিয়ে যাবে তোর বয়স। দেখতে বড় হয়ে যাবি। সেটা ভবিষ্যতের গর্ভে। তার জন্য তোকে আবার জাদুজগতে নিয়ে যাব। সেখানে এই মানুষগুলিও থাকবে। ভবিষ্যৎ থেকে পিছিয়ে তখনকার তুই এসে যাবি বর্তমানে ওই জাদুজগতে এবং সেখানে এই মানুষগুলিকে ধরে ধরে উত্তর জেনে নিবি। তারপর তোর বয়স আবার বর্তমানে এনে দেব জাদুজগতের কাঠামোতে।’
কোটিকল্প কথা থামাল। তারপর তার হাত ধরে নিয়ে গেল জাদুজগতে। সেখানে গিয়ে তার জন্য হাত তুলল। ব্যাপারটা যা ঘটল অনেকটা ভোজবাজি বলে মনে হল তার। কী ঘটল সে নিজেও বুঝতে পারল না। কেবল দেখল, সে হঠাৎ অনেকটা বড় হয়ে গেছে, অনেককিছু আগের চেয়ে অনেক ভালো বুঝতে পারছে। সে আসলে পঁচিশ বছর পরের সে হয়ে বসে আছে। এখন সে অনেক বেশি প্রাজ্ঞ, তার জ্ঞানচক্ষু অনেকটা প্রসারিত এবং তার মধ্যে কী একটা হাহাকার সবসময়। সে বুঝল, এটাই তবে বড় হওয়ার হাহাকার যেটার কথা শুনল সে এইমাত্র। তবে হ্যাঁ, এখন সে মানুষগুলিকে ধরে ধরে প্রশ্ন করতে পারে। তার কথা শুনবে সবাই।
অধ্যায়: বারো
স্পিতি নদীতে তরঙ্গ নেই, কেবলই স্রোত। সেই নিম্নগামী স্রোতের বিপরীতে তার উৎসস্থলের দিকে যাত্রায় তাবো আর সুমদো অঞ্চলের মাঝামাঝি গিউ গ্রামের কাছাকাছি নদীকে পেল সে নিজের পাশে। গিউ গ্রাম তাবো থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে, ভারত-চীন সীমানা থেকে যা মাত্র কয়েক কিলোমিটার এবং জাতীয় সড়ক থেকে অনেকটা ভিতরে গিয়ে এর অবস্থান একেবারেই দুর্গম বন্য এলাকায় যেখানে পাহাড়ি জংলি ফুলের মেলা হেসে অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত পাথুরে চড়াই ও খাদের পাশ ডিঙিয়ে বুনো পথ ধরে আসা পরিশ্রান্ত পথিককে। চারদিকে দূরে দূরে সমুদ্রতল থেকে দশ হাজার ফিট উচ্চতায় পাহাড়ের ঢালে ও কোলে আশ্রিত এই মনোরম বাসভূমিকে ঘিরে রেখেছে স্থায়ী বরফে ঢাকা অপরূপ সব গিরিচূড়া, সবাই হিমশৈল তারা। স্পিতি অববাহিকার নদী গ্রামকে পাশে রেখেছে পরম যত্নে। অধিবাসীদের পাথুরে ঘরগুলির পাথুরে দেয়ালে সাদা চুণকাম, ছাদগুলি যেমন-তেমন আচ্ছাদন যেহেতু বৃষ্টি নেই। এই গ্রামে এসে স্পিতি নদীকে হাতের কাছে পেয়ে মৃদু সম্ভাষণে সে জিজ্ঞেস করেছিল,
‘অনন্ত জীবনের রহস্যটা কী, জানো যদি বলতো আমাকে।’
স্পিতি পাথরের দলবদ্ধতায় সাড়া তুলে বয়ে যাচ্ছিল প্রবল ছন্দে। জলে তার প্রবল প্রগলভতার উদ্দামতা। পাশে উপবিষ্ট ধ্যানস্থ তার অন্তরে শোনা গেল নদীর কণ্ঠস্বর, নীরবে,
‘অনন্ত জীবন তোমার সামনেই উপস্থিত, কেবল তোমাকে দেখে নিতে হবে, বুঝে নিতে হবে। তোমার সামনে তাকিয়ে দেখ, যতদূর চোখ যায় তার বাইরেও জগৎ রয়েছে, যত তুমি এগিয়ে যাবে সেই না দেখা জগৎটার পরিধি ক্রমশ বাড়তে থাকবে, যত এগোবে তত বাড়তেই থাকবে, না দেখা জগৎটাকে তত তুমি জানতে পারবে, তোমার জ্ঞানের পরিধিও বেড়ে যাবে। তবুও তুমি জগতের শেষ দেখতে পাবে না, তোমাকে কেবল এগিয়ে যেতেই হবে, যত নতুনকে দেখছ তাদের স্বাদ ও মর্মার্থ উপলব্ধি করতে করতে পরম নিষ্ঠায়। ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে চলবে না। কেবল এগিয়ে যেতে যেতে একসময় অনন্তকে অনুমান করতে পারবে, তখন তোমার ক্ষুদ্র জীবনকালেই পেয়ে যাবে অনন্ত জীবনের ব্যাপ্তি। মূলকথা হল, অনন্তকে উপলব্ধি করা আর সেটা সম্ভব সমস্ত জীবন ধরে এগিয়ে চলার প্রক্রিয়াতেই। তাই বলা হয়েছিল, চরৈবেতি। সেটা ভুলে যাওনি নিশ্চয় ?’
তার প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্ন ছিল, সেসব সে তুলে রাখল ভবিষ্যতের জন্য তখনকার মত, কারণ গ্রাম্য অধিবাসীদের কয়েকজন এসে গিয়েছিল তাকে আপ্যায়নের জন্য। তারা তাকে চেনে, জানে যেহেতু সে আগেও এসেছিল এখানে। এখানকার তিন ছাদওয়ালা বৌদ্ধ গুম্ফার পিছনে রয়েছে পাহাড়ের গা, সেখানে কিন্তু আছে জঙ্গুলে পরিবেশ। হিমশীতল হাওয়া ছুটে আসছিল দূরের বরফে ঢাকা পাহাড়চূড়াগুলি থেকে, স্নিগ্দ্ধ প্রশান্তি বিলিয়ে দিচ্ছিল অঞ্চল জুড়ে। অনেকদিন আগে একটি বরফ চিতাবাঘের আগমন গ্রামে আতঙ্ক এনেছিল, বনদপ্তর আসরে নেমে তাকে শেষপর্যন্ত সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। গ্রামের মূল আকর্ষণ বৌদ্ধ মঠের পবিত্র আধারে সংরক্ষিত প্রায় ছ’শ বছরের পুরোনো তিব্বতের বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘ তেঞ্জিন-এর মমিকৃত দেহ যা বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক পর্যন্ত অন্যত্র একটি সমাধির অভ্যন্তরে ছিল। ওই সময়ে প্রবল ভূমিকম্পে সেই সমাধি ভেঙ্গে গেলে উদ্ধারকাজে আসা ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশ বা আই টি বি পি বাহিনী এই দুর্মূল্য সম্পদটিকে পেয়ে ওপরে তুলে মঠের ওই পবিত্র আধারে স্থাপন করে। তারপর এই মমি চুরি হয়ে যায়, হয়তো তাকে সীমান্ত পার করে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ছিল চোরের, সরকারের তৎপরতায় সেই দুষ্কর্ম রুখে মমিটিকে যথাস্থানে রাখা হয় আবার। সেই মমি সে দেখেছে, পবিত্র আধারে উপবিষ্ট অবস্থায় রয়েছে সে, তার চুল ও দেহত্বক এখনও একই রকম নিখুঁত রয়ে গেছে।
গিউ গ্রাম থেকে নদীর সঙ্গে চলতে চলতে সে হাজির হয়েছিল কাজা শহর পেরিয়ে কুঞ্জুম পাহাড়ে। ওই অঞ্চলে সে নিয়মিত ঘোরাঘুরি করে হেন স্থান নেই যেখানে যায়নি। মোটরপথ আছে এমন সর্বোচ্চ গ্রাম কমিক এবং কিবের ছাড়াও সে হিকিম আর লোসার গ্রামগুলিতেও গেছে একাধিকবার। একবার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী জীবাক্ষ থেকেছিল তার সঙ্গে। তার ব্যাখ্যা অনুযায়ী এলাকার এইসব দুর্গম গ্রামগুলিতে ঘুরে ঘুরে সে অনন্ত জীবনকে বুঝতে পারছিল। হিকিম আর লাঙ্গজা গ্রামেও সে গিয়েছিল। কাজা থেকে সর্বোচ্চ মোটরপথ থাকা গ্রাম কমিক যাওয়ার দু’টি উপায়ের একটি হল লাঙ্গজা এবং অন্যটি হিকিম ধরে যাওয়া। দু’টি পথেই গেছে সে একাধিকবার। লাঙ্গজা গ্রামের অন্য একটি বিখ্যাত নাম হল জীবাশ্ম গ্রাম, কারণ এখানে অ্যামোনাইট নামে জীবাশ্ম পাওয়া যায় গ্রামের যত্রতত্র। কেউ কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়লে মাটির সঙ্গে উঠে আসবে চক্রাকার শঙ্কু আকৃতির জীবাশ্ম যারা সমুদ্রের গভীর তলের বাসিন্দা। সেইসব জীবাশ্ম রাখা হয়েছে স্থানীয় ভাষায় ‘চৌদুয়া’ বলে একটি কেন্দ্রে যার অর্থ হল জীবাশ্ম। গ্রাম দেখতে ইদানীং পর্যটকরা আসছে প্রায়ই, তাদের জন্য ছোট ছেলেমেয়েরা থেকে বড়োরা পর্যন্ত বসে থাকে দোকানের পসরা সাজিয়ে, পঞ্চাশ-একশ’ টাকায় নানান জীবাশ্ম স্মারক হিসেবে কিনে নেয় বহিরাগতরা, সেটা তাদের আয়। যদিও এখান থেকে এভাবে ফসিল কিনে বাইরে নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ, কারণ এভাবে নিতে নিতে সমস্ত জীবাশ্ম একদিন ফুরিয়ে যাবে, সেটা পুরাতাত্ত্বিকদের জন্য সুখকর হবে না, তেমনি গ্রামেরও প্রাচীন সংগ্রহশালার বিপদ ঘটবে। সেকথা কে আর ভাবে ! আসলে কুড়ি কোটি বছর আগে এখানে ছিল টেথিস মহাসমুদ্র। এখন তা দেখে কল্পনা করা যায় না। পাঁচ কোটি বছর আগে ভূগর্ভস্থ গাঠনিক প্লেটগুলির সংঘর্ষে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল হিমালয়, টেথিস সমুদ্র হারিয়ে গেল, বিশাল সমুদ্র পরিণত হল হিমালয় পর্বতমালায়, যার একাংশ এই স্পিতি উপত্যকা। সমুদ্রের তলায় যে ছিল সব তার প্রমাণ উপত্যকা জুড়ে প্রাপ্ত জীবাশ্মের নিদর্শন, যাদের চূড়ান্ত আধিক্য দেখা গেছে লাঙ্গজা গ্রামে। সর্বমোট প্রায় দেড়শ’ লোকও নেই গ্রামে, আছে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশটি বাড়ি বড়জোর। প্রত্যেকটি বাড়ি তৈরি কাদা, ইট আর কাঠ দিয়ে তিব্বতীয় নকশা মেনে। দেয়ালে হোয়াইটওয়াশ, জানলায় লাল বর্ডার দেওয়া নীল রঙ। প্রত্যেক বাড়িতে আছে বড় একটি রান্নাঘর, সেখানে সবসময় জ্বলছে আগুনের কুণ্ড, তার পাশে বসে তারা আদা-চা বা মিন্ট টি বা বার্লি চা খেতে খেতে গল্পগুজব করে। রান্নাঘর আসলে বসার ঘরও বটে। বাড়িতে একটি ঘর থাকে গৃহপালিত পশুদের জন্য। থাকে সেখানে চমরী গাই ও ভেড়া। বাদামি পাহাড়ের দেয়াল দিয়ে ঘেরা গ্রামটিতে এলাকার অন্যান্য গ্রামের মত দু’টি অংশ আছে, লাঙ্গজা ইয়ংমা বা নিম্ন লাঙ্গজা এবং লাঙ্গজা গোঙমা বা উচ্চ লাঙ্গজা। নিম্নভূমিতে বাদামি পাহাড়গাত্র এবং বরফসাদা চূড়াগুলির পটভূমিকায় রয়েছে সবুজ ফসলজমি, দেখলে মনে হবে ঈশ্বর স্বয়ং এখানে থাকেন। গ্রামের লোকরাও তেমনই ভাবে। ল্যাং নামে গ্রামের উচ্চাংশে যে মন্দির অবস্থিত তারা মনে করে ওই মন্দির উপত্যকার সমস্ত দেবদেবীদের বাসস্থান। গ্রীষ্মে তারা জমি চাষ করে ফসল ফলায়। আগে কেবল আলু চাষ হত, এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বার্লি, মটরশুঁটি ও অন্যান্য সবজি। বার্লি দিয়ে রুটি বানায় তারা, দুগ্দ্ধজাত খাবারদ্রব্যও তৈরি করে। চাউ চাউ কাং নিলডা পাহাড়চূড়া বরফে ঢাকা, কুড়ি হাজার ফিট উঁচু ওই পাহাড়চূড়ার ছায়ায় সবুজ ফসলজমি অপরূপ দৃশ্য, চড়ে বেড়াচ্ছে জমির আশেপাশে ইয়াক বা চমরী গাই ও ভেড়া। কাজা থেকে প্রায় উনিশ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি দেয়ালে ঘেরা এই গ্রামে ঢোকার প্রায় এক কিলোমিটার আগে থেকেই দেখা যাবে গ্রামের উর্ধাংশে স্থাপিত বিশাল সোনালি বর্ণ বুদ্ধমূর্তি যা এই গ্রামের গৌরব। এই নির্জন পাহাড়ি গ্রামে ঢোকার মুখে ওই সুবিশাল বুদ্ধমূর্তি সবাইকে অভিভূত করে। চাউ চাউ কাং নিলডা মানে হচ্ছে বরফে ঢাকা সূর্য ও ভোরের রাজকন্যা, ওই পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরণার জলে তারা কৃষিকাজ করে। শীতকালে প্রবল বরফপাত ঘটলে ঝরণার জলপ্রবাহ গ্রীষ্মে বেড়ে যায় ও ফসলজমি ভালো জল পায়, ফসলও ভালো হয়। শীতকালের জন্য ফসল, খাবারদাবার মজুত করে রাখে তারা সমস্ত গ্রীষ্মকাল জুড়ে এবং গোটা শীতকাল ঘরে বসেই কাটায়, কোন কাজকর্ম থাকে না। গ্রাম ওইসময় বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মাইনাস কুড়ি ডিগ্রি তাপমাত্রা তখন, পুরু বরফে ঢেকে যায় চারপাশ। সকালে উঠে তখন তাদের দু’টো কাজ, কোদাল ও বেলচা দিয়ে বাড়ির দরজা-জানলা ও উঠোন থেকে বরফ পরিষ্কার করা এবং তারপর গৃহপালিত পশুগুলিকে খাওয়া-দাওয়া করানো ও যত্ন নেওয়া। আর কোন কাজ নেই তাদের সারাদিন। এভাবেই জীবনযাপন করে আসছে বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে লাঙ্গজা গ্রামের মানুষজন যাদের মূল জীবিকা এখন কৃষিকাজ। আর হালে যুক্ত হয়েছে ভ্রমণসংক্রান্ত আয়। পর্যটকরা আসছে বলে গ্রামে। যদি আরও প্রাচীন যুগে যাওয়া যায় তো দেখা যাবে গ্রামের মানুষ ঘরে বসে মৃৎপাত্র তৈরির কাজে ব্যস্ত যাকে বলা হয় জামাশিল্প। এখানকার হলদে ও কালো কাদামাটি দিয়ে তৈরি সেসব মৃৎপাত্র বেশ বিখ্যাত ছিল একসময়, বংশ পরম্পরায় চলত সে কাজ। উপত্যকার অন্যান্য গ্রামে সেসব অপূর্ব মৃৎপাত্রের ছিল প্রবল চাহিদা। এখন স্টিল ও অন্য ধাতব পাত্র এসে তাকে হটিয়ে দিয়েছে, গ্রামে অল্প কয়েকজন লোক কেবল আছে এই প্রাচীন পেশায়। ভালো কার্পেট, পোশাক ও মাদুর বানাতেও পটু তারা। তবে হাতের কাজও এখন বিলুপ্ত প্রায়।
গ্রামের আরেকটি অবিস্মরণীয় মুকুট হল চাউ চাউ কাং নিলডা চূড়া, যার রাজকীয় উপস্থিতি এ গ্রামে যে আসবে তাকেই মুগ্দ্ধ করে দেবে। সে অনন্ত জীবনের স্বাদ অনুভব করে বিশ্বনিয়ন্তার এইসব প্রাকৃতিক গৌরবগুলির দর্শন পেতে পেতে। কিছু কিছু মানবিক কর্মকাণ্ডও তাকে বিস্মিত করে। যেমন, পাহাড়চূড়া ঘুরে ঘুরে চলা বা অতল খাদের পাশে পাহাড়ের গা কেটে বা ঝুলন্ত পাহাড়ি গুহাকৃতি পরিসরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া এই আশ্চর্য জাতীয় সড়ক। সে এখানে মানুষের দুর্দান্ত মনোভাবের পরিচয় পায়, যেমন সে আবার তার সন্ধান পায় যখন হাজার বছর পুরোনো বৌদ্ধ গুম্ফাগুলি দেখে। তার বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা থাকে না তখন। এমনই বিস্মিত সে হয়েছিল আবার কাজা থেকে লোসার গ্রামে যাওয়ার পথে, চিচাম ব্রিজ দেখে। তখনও পর্যন্ত এশিয়ার সর্বোচ্চ এই ব্রিজটি কিবের গ্রামকে চিচাম গ্রামের সঙ্গে যুক্ত করেছে এবং মানুষের তৈরি এক অক্ষয় কীর্তি। তেরো হাজার পাঁচশ’ ছিয়ানব্বই ফিট উচ্চতা এই সেতুর, এর ওপর দাঁড়িয়ে নিচে তাকালে বুক কেঁপে উঠবে গভীরতা দেখে, মনে হবে সত্যিই ক্ষুদ্র জীবনের পরিসরে ঘটছে অনন্তকে দর্শন এবং এই দর্শনই জীবনকে অনন্ত করে তুলছে। হাজার ফিট নিচে গিরিখাত ধরে বয়ে যাচ্ছে ক্ষীণতনু সাম্বালাম্বা নালা, কী অপরূপ ভয়াল রুদ্ররূপ প্রকাশ করে। এখান থেকে এগিয়ে গেলে কাছেই লোসার গ্রাম।
এই গ্রামে এসে সে চাউ চাউ কাং নিলডা চূড়ার পাদদেশে পাহাড়ি দেয়ালের আশ্রয়ে শিলাখণ্ডের আসনে বসেছিল একটু নিচে উপত্যকার সবুজ ফসলজমির মুখোমুখি। স্পিতি নদী এই গ্রাম থেকে অনেকটা দূরে, অনেক গিরিশিরার ওপাশে সংকীর্ণ এক গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নিজের পথ খুঁজে নিয়ে। লাঙ্গজা গ্রামের মনোরম পরিবেশ তার মন ভালো করে দিয়েছিল। সেই বিপুলায়তন বুদ্ধমূর্তিকে এখান থেকে দেখা যায় না, তবে দেখা যায় গ্রামের সাদা সাদা বাড়িঘর, আনত ঢালের অনেকটা ওপর থেকে নিম্নাংশের সমতলীয় ভূখণ্ড পর্যন্ত। এখানে কুড়ি কোটি বছর আগে মেসোজোইক যুগে দাপিয়ে বেড়াত আদিম টেথিস মহাসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালা, সেই তরঙ্গমালাকে কোন্ অদৃশ্য জাদুকর স্থাণু করে দিয়েছে, তরঙ্গমালা এখনও বর্তমান তবে তাতে কোন চলাচল নেই, নিশ্চল পার্বত্য চূড়া হয়ে সুসজ্জিত হাত ধরাধরি করে বরফমুকুট মাথায় চাপিয়ে। কার জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় উত্তাল মহাসমুদ্র হয়ে যায় মহাপর্বত ? তার মনের এই প্রশ্ন কে শুনবে, কে শুনে উত্তর দেবে ? সেই অনন্ত অস্তিত্বের কি নাগাল পাওয়া সম্ভব এক জীবনে ? তাই কি তাকে জানার জন্য অনন্ত জীবনের আকাঙ্খা ? কিন্তু সে জানে না অনন্ত জীবন মানে কতদিনের জীবনকাল। তারাওতো একটা হিসেব থাকতে হবে ? অমরত্বের পিপাসা ছিল বা আছে যাদের, যারা বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে বলছে অদূর ভবষ্যতেই তারা মানুষকে দীর্ঘজীবন দান করতে পারবে, তারা কেউ কি জানে এই অমরত্ব বা এই দীর্ঘজীবন ঠিক কতোটা সময়কে বোঝায় ? দু’শ’-তিনশ’ বছর, নাকি হাজার বছর, নাকি লক্ষ বছর, নাকি কোটি কোটি বছর ? অমরত্ব বা দীর্ঘজীবন বলতে যদি এক কোটি বছরকে বোঝায় তো অতদিন সত্যিই কোন জীবদেহ টিকতে পারবে ? টিকে যদিওবা থাকে সে কী করবে ? গোটা আধুনিক মানবসভ্যতার আয়ুও আজ পর্যন্ত দশ হাজার বছর নয়। তার মধ্যেই কত কাণ্ড ঘটে গেল। কত যুদ্ধবিগ্রহ, কত উত্থান-পতন, কত আবিষ্কার, কত বিপ্লব, কত উন্নয়ন। একটা অমর মানুষ এই সমস্ত বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আজ পর্যন্ত বেঁচে আছে ভাবা যায় ? কোটি কোটি বছর আগে জন্ম নেওয়া কোন মানুষ বা জীব একদিন দেখেছিল এখানে টেথিস মহাসমুদ্র, দেখেছিল হিমালয়ের জন্ম সেটা কি অতিকল্পনা নয় ? তাহলে অমরত্ব বলতে কী বোঝায় ? অনন্ত জীবনের আসল অর্থ কোথায় ? সর্বসাধারণের প্রচলিত ধারণা, অমরত্ব মানে লক্ষ লক্ষ বা কোটি কোটি বছর বেঁচে থাকা, এমন ব্যাপারটাকে তার কাছে অযৌক্তিক বলে মনে হল। অনন্ত জীবন মানে কত বছর টিকে থাকা তার তো একটা ধারণা থাকা দরকার ? স্পষ্ট কোন ধারণাই নেই করোও মধ্যে। তাহলে অনন্ত জীবন মানে দৈহিক পরমায়ু ব্যাপারটা একেবারেই উদ্ভট, ভ্রান্ত। মুখে আসে তাই মানুষ বলে যায়, বস্তুনির্ভর বিজ্ঞানও অন্ধভাবে এই ধারণাকে আশ্রয় করে চলছে, কিন্তু এমন ভাবনা একেবারেই অর্থহীন। অনন্ত জীবন মানে অন্যকিছু, যা কখনোই নির্দিষ্ট কোন সময়কালকে বোঝাতে পারে না। সেটা সময়ের হিসেব অনুযায়ী নয়। সময়কালের উর্ধে কোন বিষয়, সময়-কাল নিরপেক্ষ, এক আদি ও অন্তহীন বিচরণশীলতা বা স্থিতি যা আধুনিক মানুষের বা বিজ্ঞানের জানার পরিধির মধ্যেও নেই। সেটা এক সম্পূর্ণ অন্য বিষয় যা আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। সেটা কী ? সে তার উত্তর জানবে কী করে ? জানে না তা কোন মানুষ। সে যে বিশ্বকে দেখছে বুঝছে জানছে তা তো এখন পর্যন্ত মানুষের অধীত বিষয়কে ভিত্তি করেই। যার উত্তর কোন মানুষের জানা নেই, সে তা জানবে নিজের দক্ষতায় এতবড় জ্ঞান সে অর্জন করতে পারেনি। কোনদিন কি পারবে ? তার নিজেকে খুব অসহায় মনে হল। সে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।
কিছুটা সময় পাহাড়ি দেয়ালের ছায়ায় বসে এইসব ভাবনায় আক্রান্ত থাকতে থাকতে তার মনে হল, চারদিকটা ঘুরেফিরে দেখা যাক, এভাবে এক জায়গায় স্থিত হয়ে যাওয়া মনে নানা বিষণ্ণতা জাগিয়ে তোলে। সে উঠে দাঁড়াল, হেঁটে হেঁটে গ্রামের উচ্চাংশে উঠে গেল পাহাড়ের দেয়াল বেয়ে বেয়ে। হাজির হল গিয়ে সেই বিশালকায় বুদ্ধমূর্তির পাদদেশে। পদ্মাসনে আসীন ঋজুদেহী সেই মূর্তির বাঁ হাত কোলের ওপর এক নীল পাত্র ধরে রেখেছে, ডান হাত সরাসরি উপবিষ্ট পায়ের হাঁটুর ওপর প্রসারিত। সোনালি কারুকাজ করা বর্গাকার সুবিশাল পুরু শ্বেতশুভ্র পাটাতনের ওপর ধ্যানগম্ভীর সেই মূর্তি অবস্থিত, সেই বেদি স্থাপিত আবার চৌকোণা আরেকটি সুউচ্চ স্তম্ভের ওপর, সেই স্তম্ভের গায়ে নানা মূর্তি আঁকা আর নানা চিত্রকলা। সর্বোচ্চ বর্গাকার পাটাতনটির ওপর আবার আরেকটি গোলাকৃতি স্তম্ভ, তার ওপর বুদ্ধদেব। সেই মূর্তির পাদদেশে সে বসে রইল নিজেও ধ্যানস্থ হয়ে, আবার চোখ খুলে দেখছিল সেই বিপুলায়তন স্থাপত্যের অপরূপ গাম্ভীর্য। এই নির্জন শৈলমালার শিখরে অবস্থিত এই বুদ্ধমূর্তি তাকে আপ্লুত নির্বাক করে দিয়েছিল।
সন্ধে নামে এখানে খুব দ্রুত। তাকে গ্রামের বাড়িঘরের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করতে দেখে বিকেলবেলায় কয়েকটি বাড়ির মালিক রাতের জন্য তাদের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করতে বলল। আন্তরিকতা ছিল তাদের আমন্ত্রণে, সবাই তো বুদ্ধকেই তাদের দেবতা বলে মানে , তাই তারা অতিথিপরায়ণ ও বন্ধুবৎসল। অবশ্য তারা স্পিতি উপত্যকার অধিকাংশ গ্রামের মত বজ্রযান ধারার নয়, তাদের ধারাটির নাম সংকায়াপা। কাছাকাছি তিব্বতের কিছু অঞ্চলে এই ধারা প্রচলিত থাকায় তারাও তাতে প্রভাবিত। সে একজন গ্রামবাসীর আতিথ্য গ্রহণে রাজি হয়ে তার বাড়িতে গেল। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন উঠোন, একটু দূরে গোশালায় রয়েছে তার কয়েকটি ইয়াক ও কিছু ভেড়া। তার একটু কাছাকাছি চার দেয়ালে ঘেরা একটি বাথরুম। খাদ্যশস্য বা খাবার ইত্যাদি উপকরণ সঞ্চয় করে রাখার জন্য একটি ঘরও নির্দিষ্ট ছিল মজুতভাণ্ডার হিসেবে। বাড়ির দেয়াল যথারীতি কাদা-ইট ও কাঠ দিয়ে গড়া কাঠামো, গায়ে হোয়াইটওয়াশ। এতে দরজা বন্ধ করে ঘরে থাকলে ঠাণ্ডার প্রকোপ শীতকালেও তেমন কাবু করে না যখন বাইরে চলতে থাকে প্রবল শৈত্যঝড় ও বরফবর্ষণ। সেসময় কিন্তু তাপমাত্রা হিমাংকের অনেক নিচে নেমে যায়।
রাতে আগুনের কুণ্ড অঙ্গিথার সামনে বসে রান্নাঘরে তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল বাড়ির লোকজন। লোক বলতে বাড়ির মালিক, তার বৃদ্ধা মা, তার বউ ও দু’টি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। তার বেশভূষা দেখলে তাকে সবাই বিশ্বপর্যটক বা সাধুসন্নেসি ভাবতে বাধ্য। তাকে দেখলে সবাই কী কারণে মনে করে সে মহাজ্ঞানী কোন মহাপুরুষ তা সে নিজেও জানে না। তার চেহারায় কী যে আছে কে জানে, বাচ্চারা তাকে নিজেদের খুব আপনজন বলে ভাবে। এখানেও গৃহমালিকের ছোট ছোট দু’টি বাচ্চা এসে তার কাছে বসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে যা বলল তার মানে হল, গল্প শোনাও আমাদের। এই গ্রামবাসী ও তার পরিবারের নিস্তরঙ্গ জীবনযাত্রায় তার মত একজনের একরাত থাকা মানে বিরাট এক ঘটনা, একটা বড় বিনোদন বা আমোদ। সে বাচ্চাদু’টিকে তার কোলের কাছে টেনে এনে সাদরে তাদের কপালে চুমু খায়, তাদের শোনায় স্পিতি ভ্যালিতে তার জীবনযাপনের গল্প, স্পিতি নদীর চলনপথ ধরে নদীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে তার পথ পরিক্রমা, পাহাড়-পর্বত বা প্রান্তর বা শিলারাশি বা রাতের আকাশভর্তি তারকাদের সঙ্গে তার কথোপকথন, আর উপত্যকায় অদৃশ্য কোন দৈবশক্তির অস্তিত্ব সম্পর্কে তার উপলব্ধি। সে সরল-সহজ ভাষায় সব ব্যাখ্যা করে, বাচ্চাগুলি মন্ত্রমুগ্দ্ধ হয়ে শোনে, শোনে গৃহকর্তা নিজে ও তার বৃদ্ধা মা। তার বউ তার জন্য বার্লি চা নিয়ে আসে একবার, আবার দেয় অদা চা। রাতে তাকে খাওয়ায় তারা ভাত, ডাল, রাজমা ও একটি মিশ্র সবজি। চা খাওয়ার সময় গৃহকর্ত্রী তাকে বার্লি দিয়ে বানানো লাড্ডু খেতে দিয়েছিল। আর এখন খাওয়ার পর গৃহকর্তা তাকে জিজ্ঞেস করল বার্লি থেকে বানানো মদ সে খাবে কিনা ঠাণ্ডার প্রকোপ কাটাতে যা দরকার। সে সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করল। এমনই ছিল তার বিনীত প্রত্যাখ্যান যে গৃহস্বামী তাতে ক্ষুণ্ন হল না, বরং নিজে তার মত একজন জ্ঞানী সন্ন্যাসীসদৃশ মানুষকে এমন প্রস্তাব দেওয়ার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করল। পরদিন সে যখন বিদায় নিচ্ছে তখন বাচ্চাদু’টি তাকে বলল আবার আসতে, গৃহকর্তা নিজেও তাই বলল। তারও যেন মন একটু বিষণ্ণ হয়ে গেল, সে ভাবল যে চোদ্দ হাজার পাঁচশ’ ফিট উচ্চতায় পাহাড়ের শিখরে অবস্থিত এই লাঙ্গজা গ্রামে বুঝি সে স্বজনসঙ্গ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
সকালেই সে লাঙ্গজা গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে আসে। তার যাত্রাপথ এখন কাজা শহরের দিকে, দূরত্ব প্রায় আঠেরো কিলোমিটার। সে ঠিক করে সেইদিনটা সে কাজাতেই কাটাবে, অথবা আরও খানিকটা গিয়ে রংরিক পৌঁছে যাবে যা খুব বেশি হলে সাত-আট কিলোমিটার। কাজার কাছাকাছি স্পিতি নদী জাতীয় সড়কের বাঁ ধার থেকে ডানদিকে প্রবাহিত প্রায় সমান্তরালে। যদিও নদীখাত গভীর তবুও তা মূল রাস্তা থেকে খুব একটা দূরে নয়, স্থানে স্থানেই দু’-আড়াই হাজার ফিট মাত্র। তার মানে নদীকে পাশে নিয়েই চলতে পারবে সে, জানতে পারবে তার মতিগতি। তার লক্ষ্য কুঞ্জুম পাহাড়, যেখান থেকে জন্ম নিয়েছে স্পিতি নদী। কিন্তু কাজা থেকে তার দূরত্ব কম করেও সত্তর-পঁচাত্তর কিলোমিটার। গোটা পথ হেঁটে যেতে তার হয়তো দু’ থেকে তিনদিন লেগে যেতে পারে, পথে কিছু না কিছু জনপদ পেয়ে যাবেই সে। রাত কাটাবে সেইসব স্থানে। অবশ্য কোন পর্যটকের যানবাহনেও সে ভাগ্য সহায় হলে চড়ে বসতে পারে। তবে সেই ইচ্ছে তার নিজেরই নেই। সে চায় নদীকে পাশে নিয়ে চলতে চলতে তার সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যেতে। এই যাত্রায় কুঞ্জুম পাসের কাছাকাছি জনপদ হল লোসার গ্রাম। সেখানে এক রাত থাকার ইচ্ছে আছে তার। যাই হোক, বিশেষ ভাবিত নয় সে কোন বিষয়েই। সে এখন চলেছে চলার পথে সাজিয়ে রাখা ঈশ্বরের মনোরম বাগান দেখতে দেখতে। অবিশ্রাম হেঁটে যাওয়ার অভ্যেস আছে তার এবং সে দেখেছে তার যাত্রাপথে দিনের শেষ বেলায় সে কোন না কোন জনপদ ঠিক পেয়ে যায়। যে গ্রামেই সে যাক না কেন এই উপত্যকায় কেউ তাকে আতিথ্যদানে অসম্মত হওয়া তো দূরের কথা, সে বলার আগে নিজেরাই তাকে যেচে এসে অতিথি হতে বলে। প্রকৃতির এও যে কী বিচিত্র খেলা সে বোঝে না, কেন এই সরল-সাদামাটা গ্রামগুলির বাসিন্দারা তাকে এমন আপন মনে করে তা এক বিস্ময় তার কাছে। আর পর্যটকদের যানবাহনেও সে ঠিক দরকারে জায়গা পেয়ে যায়। সে জানে, কুঞ্জুম গিরিদ্বার যাওয়ার পথে কোন পর্যটকের গাড়ি সে চাইলেই তাকে তুলে নেবে। সবই তার নিজের ইচ্ছের আওতায়। দেখা যাক কী হয়। তবে তার চূড়ান্ত লক্ষ্য, কুঞ্জুম গিরিদ্বার যা কুঞ্জুম পাহাড়ের পূর্বাংশে। সে জানে, স্পিতি নদীর সূচনা হয়েছে এই কুঞ্জুম পাহাড় থেকেই, যা গিরিদ্বারের খুব একটা দূরে নয়। কুঞ্জুম পর্বতমালার ঢাল থেকে কুঞ্জুম লা তোগপো এবং কাবজিমা ও পিংলাঙ্গ ঝরনা দু’টির মিলনস্থল থেকে জন্ম নিয়েছে নদীটি, তারপর উপত্যকার লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছে বরফগলা জলে পুষ্ট হয়ে, দু’ধারের মালভুমি থেকে নানা উপনদীর বন্ধনে জড়িয়ে জড়িয়ে, তাদের আনা বরফগলা জলের ধারাস্রোত হয়ে।
কাজাতে পৌঁছে গেল সে দুপুরের আগেই। সেখান থেকে ব্রিজ পেরিয়ে সে আবার চলা শুরু করে। আর খানিকটা গেলেই রংরিক। সেখানে ইচ্ছে হলে থাকবে বা আরও এগিয়ে যাবে। এখন নদী তার ডান ধারে, প্রায় নাগালের মধ্যেই। এখানে সড়কপথ ওপরে বেয়ে উঠছে না তেমন, চলেছে নিম্ন উপত্যকার গা ধরে পাহাড়চূড়াগুলির তলদেশের প্রশস্ত ভিতের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে আঁকাবাঁকা হয়ে। কোথাও পাহাড়গাত্রের ছায়ায় আচ্ছাদিত শীতল, কোথাও বা নরম রোদের ছোঁয়ায় প্রাণিত। সে চলে আপনমনে এই প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলতে বলতে। ঈশ্বর বা প্রকৃতি যেই হোক, সে তার সুবিশাল থালায় সাজিয়ে রেখেছে পরম যত্নে এইসব পাহাড়, ঝরনা, উপত্যকা, মালভূমির গা দিয়ে সাজানো অপরূপ নৈবেদ্য। সে এই নৈবেদ্যের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে আত্মহারা হয়ে চলেছে। তার সমস্ত মনে এক স্বর্গীয় আনন্দ। সে যত চলে তত দেখে পথ চলেছে তার শেষ না দেখিয়ে, তার শুরু কোথায় তাও দেখা যাবে না এখান থেকে, সেই অর্থে পথও অন্তহীন অনন্ত যেহেতু সে লম্বা পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার শুরু বা শেষ দেখতে পাবে না। আর এইযে উপত্যকার দু’ধারে পাহাড়ের চূড়াগুলি দেখা যাচ্ছে একের পর এক, দেখে মনে হচ্ছে তাদেরও কোন শুরু বা শেষ নেই। মাথার ওপর ওই যে ঘোরতর বিশুদ্ধ নীলবর্ণ আকাশ সুশোভিত খণ্ড খণ্ড শ্বেতশুভ্র মেঘের নীরব চলাচলে বা দাঁড়িয়ে থাকায় তারও তো কোন আদি বা অন্ত পাওয়া যাবে না। তার মনে হতে থাকে, ক্ষুদ্র জীবনের পরিসরে সে প্রকৃতির সাজিয়ে রাখা থালার নৈবেদ্যে অনেকগুলি অনন্তের উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছে। এতসব মহিমামণ্ডিত অনন্তকে উপলব্ধি করাই বোধহয় অনন্ত জীবন। আসলে অনন্ত জীবন কোন মানুষ পেতে পারে না। মানুষ তার ক্ষুদ্র জীবনে যেসব প্রভূত অনন্ত বিষয়সমূহের সন্ধান পায় সেসবের সমাহারই তাকে অনন্ত জীবন দেয়। তার মনে পড়ে জীবাক্ষর কথা। এত জ্ঞানী হয়েও সে অনন্ত জীবনের সঠিক অর্থ বুঝতে পারেনি। অনন্ত জীবন বলতে সে বুঝেছে ব্যক্তির জীবনে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকা। সেই দীর্ঘকাল কতটা সময়ের ব্যাপ্তি তা কি সে বলতে পারবে ? কতকাল একজন মানুষ বেঁচে থাকলে তাকে অনন্ত জীবনের অধিকারী হয়েছে বলা যাবে ?
আপনমনে আত্মবিস্মৃত হয়ে পথ চলতে চলতে সে খেয়াল করে না একটা শক্তপোক্ত এস ইউ ভি গাড়ি এসে কখন থেমে যায় তার পাশে। এমনিতে এই সময়টায় আজকাল দেশি-বিদেশি পর্যটকরা দলে দলে আসতে থাকে উপত্যকায়। এতকাল এই উপত্যকার দুর্গমতা বেশি পর্যটককে এখানে আসার উৎসাহ দিত না। এখন জাতীয় সড়ক হয়ে যাওয়ায় দুর্গমতা অনেক কেটে গেছে, জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে বহির্বিশ্বে। এটা একটা বিপদও বটে। বেশি লোক আসা মানেই উপত্যকার স্বর্গীয় সভার ওপর অত্যাচার, হাজার বছরের পুরোনো গ্রামগুলিতে এসে ঢুকবে সমতলীয় মানুষের কলুষিত আচার-আচরণ। জীবনযাপন প্রণালী পাল্টে যাবে মানুষগুলির। সমতলের মানুষ চলে তাদের নিয়মে, এই অঞ্চলের নিয়মকানুন তারা মেনে চলবে না। এই উপত্যকার মানুষগুলির জীবনে লোভ ও উচ্চাকাঙ্খা এসে হানা দেবে। তাদের সংস্কৃতি আর বজায় থাকবে না। তাদের ঐতিহ্য তারা হারিয়ে ফেলবে। আধুনিক নগরসভ্যতার বিষাক্ত প্রভাব যদি এখানে আসতে থাকে অহরহ তাহলে সত্যিই সর্বনাশ। দেবতাদের বিচরণক্ষেত্র স্পিতি ভ্যালিতে একদিন হয়তো গড়ে উঠবে কলকারখানা। সেই অশুভ কার্যকলাপ হতে থাকে যদি এখানে তো বড়োই আতঙ্কের কথা।
তার পাশ দিয়ে একটি-দু’টি পর্যটকের গাড়ি যাতায়াত করছিল মাঝেমধ্যেই। সে পাশে সরে গিয়ে পথ ছেড়ে দিচ্ছিল। এখন এই গাড়িটি এসে দাঁড়িয়ে পড়ায় তার আত্মমগ্নতা ভাঙ্গল। সে একটু অবাক হল। কী উদ্দেশ্যে গাড়িটি থামল তার পাশে ? সে দাঁড়িয়ে দেখছিল ব্যাপারটা, কৌতূহল ছিল তার মধ্যে। থেমে যাওয়া গাড়ির দরজা খুলে যে ব্যক্তি বেরিয়ে এলো তাকে দেখে সে অবাক হয়ে গেল। সে ভাবেনি আবার এভাবে এই ব্যক্তিটির সঙ্গে দেখা হবে তার কোনদিন। সে জার্মান পর্যটক গেরহার্ট। গত বছর এমনই সময়ে স্পিতি ভ্যালিতে তার তখনকার বাসস্থানের কাছে দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে। এতো তাড়াতাড়ি আবার সে আসবে এখানে, আবার তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে এভাবে চলার পথে এটা ভাবাও বিস্ময়কর। সে আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নির্বাক। গেরহার্ট তার কাছে এসে হাত বাড়াল মুখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে,
‘এখানে এভাবে তোমাকে পেয়ে যাব আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। গতবছর যেখানে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেখানে তোমাকে অনেক খুঁজেও দেখতে পাইনি। ভেবেছিলাম তুমি অন্য কোথাও চলে গেছ। তখন মেষপালকদের সঙ্গে দেখা হল। তারা জানাল যে তুমি ওখানেই থাকো, তবে ক’দিনের জন্য কোথাও বেরিয়ে পড়েছ ঘুরতে। কোথায় গেছ তারা বলতে পারল না। আমার বেশ মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল। দেখ, ঠিক দেখা হয়ে গেল তোমার সঙ্গে।’
গেরহার্টের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা সে অগ্রাহ্য করে যুক্তকরে তাকে নমস্কার জানাল। গেরহার্টও তার মত উপায়ে তার উদ্দেশ্যে প্রতিনমস্কার জানিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি এখানে হেঁটে হেঁটে কোথায় চলেছ ?’
‘কুঞ্জুম পাস্।’
সংক্ষেপে উত্তর দিল সে। গেরহার্ট উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
‘আরে আমরাও তো ওখানেই যাচ্ছি। চল তুমি আমাদের সঙ্গে, আমাদের গাড়িতে।’
সে এই আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করার কারণ দেখল না। তাতে অবশ্য তার পরিকল্পনা অনেকটাই পাল্টে যাবে। তা হোক, তার গেরহার্টের সঙ্গ অপছন্দ হয় না। লোকটাও তাকে খুব মর্যাদা দেয়, বন্ধু হতে চায়। বিমুখ করতে নেই কাউকে। সে গিয়ে গেরহার্টের গাড়িতে চেপে বসল। মাঝখানের আসনে সে আর গেরহার্ট পাশাপাশি। ছিল সেখানে আরেক ব্যক্তি। এবার গেরহার্টের সঙ্গী আরও চারজন, সবাই পুরুষ। সে জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি কি প্রত্যেক বছরই এখানে আসো ?’
‘আরে না। গতবছর কী কাণ্ড হল বলছি শোন। আমরা তো হিসেবে-টিসেব করে গেলাম, গিয়ে দেখি কুঞ্জুম পাস্ তখনও খোলা হয়নি। বরফ জমে আছে ওখানে, সেসব তখনও সরাতে পারা যায়নি। ওদিকে ল্যান্ডস্লাইড হয়ে কুঞ্জুম পাসের পর বাটাল পর্যন্ত রাস্তা আটকে আছে। কবে সেসব সরিয়ে রাস্তা খোলা যাবে কেউ বলতে পারল না। আমাদের সমস্ত প্ল্যানটা মাঠে মারা গেল। চন্দ্রতাল লেকে যাওয়া হল না। আমরা লোসার পর্যন্ত গিয়ে আবার যে পথে এসেছিলাম সে পথেই ফিরে গেলাম। ফেরার পথে তোমাকে খোঁজ করে দেখা পাইনি, তুমি অন্য কোথাও চলে গিয়েছিলে। তাই এবার আসা, অসম্পূর্ণ ভ্রমণটা সম্পূর্ণ করতে। তাছাড়া তোমার সঙ্গে দেখা করারও একটা ইচ্ছে ছিল। দেখ, ইচ্ছেটা ঠিক পূরণ হল। আসলে দেখেছি, মানুষ যদি অন্তর দিয়ে কিছু পেতে চায় তাহলে সেটা যেভাবেই হোক পায়। এর পিছনে কি কোন রহস্য আছে ? আমি ঠিক জানি না।’
গেরহার্টের এই স্বভাবটার জন্যই তাকে প্রথমবার দেখে খারাপ লাগেনি এবং এবারও তার সঙ্গ পেয়ে সে খুশিই হয়েছে। সে অন্য আর দশজন বিদেশির মত উন্নাসিক ও অপদার্থ নয়। আসলে সে উচ্চশিক্ষিত গবেষক অধ্যাপক। শিক্ষার একটা মূল্য আছে। আর যে দশটা বিদেশির সঙ্গে আমাদের দেখা হয় তাদের বেশির ভাগই অল্পশিক্ষিত এবং তাদের অনেকের সঙ্গই বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না।
গাড়ি চলছিল বাঁক খাওয়া পথ ধরে শৃঙ্গগুলির তলদেশ ঘুরে ঘুরে। হালকা ঢাল ছিল বা ছিল না। এমনিতে পথ অনেকটা নেমেই গিয়েছিল, তবে খানিকটা পরই উঠতে লাগল। গেরহার্ট প্রশ্ন করল,
‘তুমি কি কুঞ্জুম পাস্ দেখতে যাচ্ছ ?’
‘না। কুঞ্জুম পাস্ আমি আগেও দেখেছি কয়েকবার। আমি আসলে যাচ্ছিলাম স্পিতি নদীর সঙ্গে সঙ্গে। তার উৎস থেকে যাত্রা শুরু করে সঙ্গম পর্যন্ত। তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না, তোমাকে কী করে বোঝাব জানি না, আমি স্পিতির সঙ্গে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলাম। তার সঙ্গে চলছিল আমার প্রাণের আলাপ।’
কথাগুলি বলতে গিয়ে তার গলায় খানিকটা কুণ্ঠা ছিল, কারণ কেউ যে নদীর সঙ্গে কথোপকথন চালাতে পারে একথা বুঝতেই পারবে না সাধারণ মানুষ। তারা ভাববে লোকটা বদ্ধ উন্মাদ। নদী কি মানুষ যে তার একটা ভাষা আছে ? যার ভাষা নেই সে কথা বলবে কী করে ? কিন্তু এই উপত্যকায় বসবাসের কল্যাণে সে জানে, মানুষ বা জীবজন্তু কেন, প্রকৃতির প্রতিটি বস্তুরই রয়েছে নিজেকে প্রকাশ করার তাগিদ, আর তা দেখা যায় তাদের স্থির অবস্থানে বা গতিশীলতায়। সেটাই তাদের প্রকাশিত ভাষা, একে ধৈর্য ধরে বুঝে নিতে হয়। যে যত বেশি বুঝতে পারবে তার জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে। এভাবে প্রকৃতির ও পৃথিবীর বুকে আছে অনন্ত বস্তুসমূহ। তারা সতত নিজেকে ব্যক্ত করার জন্য অপেক্ষারত। তাদের এই ব্যগ্রতাকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করাই হল মানব মস্তিষ্কের প্রধান কাজ। যে ব্যক্তি এই অনন্ত বস্তুগুলির নীরব প্রকাশের ভাষা বুঝতে পারবে তার কাছেও জীবন অনন্ত হবে। জীবাক্ষ এই গূঢ় তত্ত্বটা বুঝতে পারেনি অত জ্ঞানী বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়েও। সে যে পথে এগোচ্ছে তা সঠিক নয়, আধুনিক মানুষেরই মত মনোবিকার, যারা ভাবে মরদেহ দীর্ঘকাল টিকিয়ে রাখাই অনন্ত জীবনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া। তারা ভাবে, যদি আমার অস্তিত্ব না থাকল তাহলে আমার কী থাকল ? সময়ের চলন তো থামাতে জানে না কেউ। যদি সময় না দাঁড়ায় তো জীবনও দাঁড়াতে পারবে না, অনিবার্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলবেই। এই ধ্বংসকে রোধ করার উপায় হস্তগত হলেই মরদেহ এবং তার মধ্যে বাস করা মানুষের নিজস্ব স্বত্ত্বাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। সেই লক্ষ্যে চলেছে বর্তমান কালের জীববিজ্ঞানী, গবেষক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। কিন্তু তারা কি ভাবে অনন্তকাল মানে কতটা সময় ? তাদের লক্ষ্য আশি পেরিয়ে একশ’ বা বড়জোর দেড়শ’ বছর পরমায়ু বাড়িয়ে দেওয়া। সাধারণ মানুষেরও এই একই ভাবনা। জীবাক্ষও এই সর্বসাধারণের দানবিক বা আসুরিক ভাবনা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি। তার অত জ্ঞান কী কাজে লাগল ? তার সঙ্গে যখন তার আবার দেখা হয়েছিল তখন কথায় কথায় বলেছিল যে প্রকৃতির জয়ধ্বজা নীরবে উড়িয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদস্বরূপ যেসব নির্বাক বস্তুসমূহ তাদের সঙ্গে বাক্য বিনিময়ের উপায় সে জানে, তখন সেই জ্ঞানী ভিক্ষুর চোখেও দেখেছিল অদ্ভুত দৃষ্টি। সে পর্যন্ত তার ব্যবহারে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে এসব প্রকৃতিস্থ মানুষের কথা নয়, এবং সে বলেছিল যে যদি সে এরকম ভাবনা করে তো তার মধ্যে বাসা বেঁধেছে মানসিক রোগ, আর সেটা সারাবার উপযুক্ত উপায় হচ্ছে সদাসর্বদা ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকা। সে আর কথা বাড়াতে চায়নি এই বিষয়ে বলে তাকে বলেনি যে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকলেই তার কাছে চলে আসে পাহাড়-উপত্যকা-নদীর নির্বাক কলরব, সে তখন তাদের আলাদা আলাদা কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, কান দিয়ে নয়, অন্তর আর আত্মা দিয়ে। জীবাক্ষ যখন বিশ্বাস করেনি এই জার্মান লোকটি কি বিশ্বাস করবে ? কথাটা বলে তাই সে মনে মনে যখন গূঢ়তত্ত্ব এভাবে হঠাৎ প্রকাশ করে দেওয়ার জন্য নিজেকে তিরস্কার করছে তখন তাকে অবাক করে দিয়ে গেরহার্ট বলল,
‘বিশ্বাস করব না কেন ? আমি জানি, নদীর সঙ্গে কথা বলা যায়। অন্তত তাকে দিয়ে তার ভাষায় কথা বলানো মোটেই অস্বাভাবিক কাজ নয়। যদি তাই না হবে তাহলে ভূবিজ্ঞানীরা কোন নদীর আদ্যোপান্ত জানতে পারে কিভাবে তার মধ্যে অভিযান চালিয়ে ? নদীর সঙ্গে কথা বলা যায়, তার জন্য ভূবিজ্ঞানীও হতে হবে না, থাকতে হবে যে মানুষ কথা বলবে তার উপযুক্ত জ্ঞান ও মনোভাব।’
গেরহার্ট কথা থামিয়ে এস ইউ ভি-তে পিছনের আসনে বসে থাকা ব্যক্তিবর্গকে দেখিয়ে বলল,
‘এই যে মানুষগুলিকে দেখছ এবার আমার সঙ্গে এরা কেউ আগের স্পিতিভ্যালি ভ্রমণে ছিল না। তখন যারা ছিল তারা কেবলই পর্যটক, এসেছিল আমার সঙ্গী হয়ে কোল্ড ডেজার্ট মাউন্টেনকে কেবলই উপভোগ করার জন্য। দার্শনিক বা জ্ঞানপ্রাপ্ত ব্যক্তির চোখ দিয়ে নয়, কেবলই পর্যটকের চোখ দিয়ে। তাই তাদের সঙ্গে গোটা ট্রিপটাতেই কিছু না কিছু খিটিমিটি লেগেই থাকত। তাদের কেবলই আক্ষেপ ছিল, কুঞ্জুম পাস্ ধরে গিয়ে চন্দ্রতাল দেখে মানালি পর্যন্ত যাওয়ার পথটিকে দেখা হল না বলে। তারা জানো, এর সমস্ত দায় আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিল ? স্পিতিভ্যালির এই অপার্থিব সৌন্দর্য্য দেখেও তারা খুশি হয়নি, তাদের কেবলই আপসোস ছিল আবার স্পিতিভ্যালির রুক্ষ-শুষ্ক পথ ধরে যাওয়ার জন্য। তারা কেউ একবারও বলেনি যে এই উপত্যকাকে দু’-দু’বার দেখা সৌভাগ্যের ব্যাপার, আমি নিজে তো দশবার দেখেও একে আবার দেখতে চাইব। তাই এবারের ট্রিপে যারা আমার সঙ্গে রয়েছে তারা কেবলই দেখার জন্য আসেনি, এসেছে দেখে তাকে অন্তরস্থ করার জন্য। এদের কেউ আমার ছাত্র বা গবেষক, কেউ বা আমার সহকর্মী, সারা পৃথিবীর বিখ্যাত বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্রের সঙ্গে সবাই যুক্ত। এরা কেউ নিজে বিজ্ঞানী বা দার্শনিক। আমরা কেবল স্পিতি ভ্যালি দেখতেই এসেছি।এখান থেকে মানালি বা শিমলা যাওয়া আমাদের লক্ষ্য নয়। সে তো সাধারণ বেড়াতে আসা লোকরা করে, এক ট্রিপে যতটা পারা যায় দ্রষ্টব্য স্থান কভার করে নেওয়া, জন্মে আর সেখানে যাবে কিনা সন্দেহ। আমরা একদমই তেমন নই। আমাদের দ্রষ্টব্য স্থান কেবলই স্পিতি ভ্যালি। আমাদের কেবলই আকর্ষণ স্পিতিভ্যালিকে বারবার দেখা, যতবার খুশি।’
গেরহার্ট আবার কথা বলা থামাল, তারপর পিছনের আসনে বসে থাকা এক ব্যক্তিকে দেখিয়ে বলল,
‘এই যে দেখছ, এর নাম সাইমন। মার্কিন মুলুকে এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী।’
সে তাকাল সাইমনের দিকে। পঞ্চাশোর্ধ এক ব্যক্তি, বোধহয় মিশ্ররক্ত গায়ে। সে তাকাতে সাইমন অমায়িক হাসল, তার দেখানো পদ্ধতিতে যুক্তকর করল। মুখে কিছু বলল না। গেরহার্টই কথা বলে চলল,
‘ওর জীবনের অভিজ্ঞতা শুনবে ? ও জাগতিক ও মহাজাগতিক বস্তুসমূহের বার্তা পায়, আর পায় বেশ বিচিত্র উপায়ে, স্বপ্নে। কতকিছু, কত বার্তা সে জেনেছে এভাবে ভাবতে পার ? সাইমন বল না। শোনাও ওকে তোমার সেসব বিচিত্র বার্তাবহ ঘটনাগুলির কথা।’
গেরহার্ট তাকালে সাইমন মৃদুভাষ্যে জানালো,
‘তুমিই বল না। তুমি তো সব জানো। আমার চেয়ে ভালো বলতে পারবে।’
‘একবার কী হয়েছিল, শোন।’ গেরহার্ট শোনাতে লাগল, ‘সাইমন সারা রাত তার বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাগারে কাজ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে তার আগে গবেষণা করছিল সৌরজগতের অ্যাস্টরয়েড বেল্ট নিয়ে। ঘুমের মধ্যে সে কী স্বপ্ন দেখল কল্পনা করতে পার ? সে দেখল, ওই বেল্টের একটি মাঝারি আকৃতির গ্রহাণু, যার পুরোটা দেখতে কোন মানুষের মুখমণ্ডলের মত, সে তাকে স্বপ্নে বলছে, আমি আসছি তোমাদের ছুঁয়ে যেতে। তার পরদিনই বিজ্ঞানীরা জানতে পারল, অ্যাস্টরয়েড বেল্টের একটি গ্রহাণু কোনক্রমে তাদের কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। যদিও দেখা গেল যে বায়ুমণ্ডলে ঢুকে মাটিতে নামার আগেই প্রবল ঘর্ষণে তার অধিকাংশটা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, তবুও কিছুটা তো এসে ভূপৃষ্ঠে আঘাত করবে। কোন জনবহুল শহরে পড়লেই সর্বনাশ। ব্যাপারটা কেবল বিজ্ঞানীরাই জানত, সাংবাদিকদের জানানো হয়নি, বিশ্বজনতা ব্যাপারটা জানলে ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে বলে। এখন পৃথিবীর অনেক জনবর্জিত এলাকা সভ্যতার অগ্রগতিতে এবং জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার জন্য জনপদ হয়ে গেছে। তবুও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে ভূপৃষ্ঠের স্থলভূমির অধিকাংশ এলাকা এখনও জনবর্জিত আছে। বিজ্ঞানীরা গ্রহাণুটির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দেখতে পেল যে কোন জনপদে পড়ার সম্ভাবনা আশি শতাংশও নেই। সাইমনও ছিল তাদের দলে। স্বপ্নটি দেখার পাঁচদিনের মাথায় দক্ষিণ আমেরিকার এক জনবর্জিত এলাকায় রাতে গ্রহাণুটির অবশিষ্ট অংশ এসে আঘাত করল। সাইমনের সঙ্গে আমি গিয়েছিলাম পরে ওই জায়গাটাতে। যা দেখেছিলাম তা সত্যিই শিউরে ওঠার মত ব্যাপার। গ্রহাণুটির আঘাতে ওই জায়গাটাতে একটা বিশাল গর্ত হয়ে গিয়েছিল এবং সেই গর্তের চারপাশে কয়েক কিলোমিটার ব্যাসযুক্ত ভূত্বক ছিন্নভিন্ন অবস্থায় ছিল, আর এলাকাটার আধ কিলোমিটার ব্যাসার্ধে ভূপৃষ্ঠের মাটির গা পুড়ে কালোবর্ণ দেখাচ্ছিল। বিশাল এক পারমাণবিক বোমাও এতটা প্রভাব ফেলতে পারে না। যদি ওই গ্রহাণু জনপদে এসে পড়ত তো কী হত ভাব ?’
গেরহার্ট কথা থামাল। গাড়িতে যারা বসে ছিল তারা কেউ আর কিছু বলছিল না। তার মুখেও কোন কথা ছিল না, ভাবছিল সাইমনের অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা। একটি গ্রহাণু যদি বার্তা পাঠাতে পারে এভাবে, মানুষের জানা মনস্তত্ব তার হিসেব দিতে মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। গেরহার্ট আবার বলতে লাগল,
‘নদীর সঙ্গে কথা বলা মানুষের পুরোনো অভ্যেস। পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতাই নদীমাতৃক। নদীর কণ্ঠস্বর মানুষের প্রাণে বাজে। যারা শোনার তারা শোনে, তারা বোঝে। মানুষ কথা বলে মুখে, তার সেই মুখের ভাষা বোঝে মানুষই। অন্য প্রাণিরাও সেই ভাষায় সাড়া দেয়। কিন্তু সেই ভাষায় কথা বলা যায় না সর্বক্ষেত্রে। প্রয়োজন সেসব ক্ষেত্রে অন্তরের ভাষা। তুমি যখন নদীর সঙ্গে কথা বলতে পার ব্যাপারটা নিশ্চয় জানো। নদীর কণ্ঠ বাজবে তোমার অন্তরে। আবার তোমার কথাও নদীকে শোনাবে অন্তর দিয়েই। এটা এক বিচিত্র উপলব্ধি, যে বোঝে সেই বোঝে, অন্য কেউ নয়। কিন্তু আমার একটু কৌতূহল হচ্ছে। জানিনা তুমি উত্তর দেবে কিনা। তুমি এভাবে চলতে চলতে স্পিতিনদীর সঙ্গে কোন বিশেষ প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছিলে কি ? যদি হয় কী সেটা ?’
অন্যক্ষেত্রে সে জানাত না। কিন্তু গেরহার্টের কথা তার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। সে তাই বিনা দ্বিধায় বলল,
‘আমি নদীর সঙ্গে কথা বলছিলাম অনন্ত জীবন নিয়ে।’
‘ওটা আমারও জিজ্ঞাসা। আমার গবেষণার বিষয়।’
তার কথার জবাবে গেরহার্ট কথা বলতে বিন্দুমাত্র দেরি করল না।
অধ্যায়: তেরো
এক মেলাপ্রাঙ্গণ থেকে অন্য মেলাপ্রাঙ্গণ।
দু’টিই জনতার ভিড়ে উবুথুবু। দু’ জায়গাতেই পসরা সাজিয়ে বসেছে বিক্রেতারা ক্রেতার অপেক্ষায়। আবার ক্রেতারাও সতত বিচরণশীল এখানে-ওখানে কাঙ্খিত বিক্রেতার অন্বেষণে। চলমান জীবনের প্রতিচ্ছবি দু’ জায়গাতেই, কেবল এক মাঠ থেকে অন্য মাঠে যাতায়াতের জন্য রয়েছে অদৃশ্য দরজা, সেই দরজা তালা লাগানো, চাবি থাকে দিগদর্শকের কাছে। তাকে যে চিনতে পারে এবং নিজেকে সমর্পণ করতে পারে তার হাতে সে দু’টি মাঠেই অবাধ বিচরণের সুযোগ পায়। একটি মাঠে মোহগ্রস্ত মানবকুল চলেছে জীবনের অনিবার্য আকর্ষণে, জানেনা কী উদ্দেশ্য-বিধেয়। সেখানে চলা মানেই জীবন এবং জীবন মানেই জৈবনিক সাধ-আল্হাদের অমোঘ টান। বংশ পরম্পরায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলছে মানুষ কোন এক প্রচ্ছন্ন মায়ার বশবর্তী হয়ে, সেখানেই মায়াপ্রকল্প বিরাজমান এবং কেউ তা বুঝতে পারে না। অন্য মাঠ জাদুজগৎ, সেখানে প্রতিভাত চলন-বলনের ভাবার্থ যদিও তা যারা থাকে তাদের বোধগম্য হয় না। জীবনযাপনের মর্মার্থ সেখানে স্পষ্ট হতে পারে তার কাছেই যে পথপ্রদর্শকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে জানে।
মায়াপ্রকল্পের অধীনস্থ মেলার মাঠ থেকে তাকে এবার নিয়ে আসা হল জাদুজগতের অধীনস্থ মেলার মাঠে। সেখানে সময় থেমে ছিল, স্থির ছিল চলমান জনতার মিছিল। যে মুহূর্তে যে অবস্থায় মূল মেলার মাঠ থেকে সে এলো সেই অবস্থাতেই দণ্ডায়মান ছিল জাদুজগৎ। হয়তো কেউ এক পা বাড়িয়েছিল চলাচলের প্রক্রিয়াতে সে ঠিক তেমনই থেকে গেল এই জাদুজগতের আবহে, সমস্ত ঘটমান কার্যাবলী দাঁড়িয়ে রইল এমনই সমান ও সুষম নিয়মের আবর্তে। মূল মেলার মাঠে, যা মায়াপ্রকল্পের আওতায় সেখানে জীবন যেমন চলছিল তেমনই চলতে লাগল, কোন থেমে যাওয়া বা পিছিয়ে যাওয়া বা এগিয়ে যাওয়া ঘটল না। সেখানে জীবন চলছিল বরাবরের নিয়ম মেনে, নিয়মের কোন ব্যতিক্রম দেখা গেল না কোথাও। নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটল কেবল জাদুজগতে। সেখানে তার বয়স এগিয়ে গেল, সে হয়ে গেল পূর্ণবয়স্ক আর মেলাপ্রাঙ্গণের জনজীবন থেমে রইল সময়ের এক সুনির্দিষ্ট বিন্দুতে। অদৃশ্য দরজার তালা খুলে তারা এসে ঢুকল যেখানে যে সময়ে। কোটিকল্প তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল,
‘এবার এই মানুষগুলি এখানে চলতে থাকবে। আমি এদের চালিয়ে দেব। এখানে যেসব ঘটনা ঘটতে থাকবে এখন থেকে সেসব কিন্তু ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে মূল মেলার মাঠে। সেই হিসেবে আমরা সবসময় পিছিয়ে থাকব, কিন্তু যা যা ঘটনা ঘটে গেছে মায়াপ্রকল্পের মাঠে সেগুলি হুবুহু আবার ঘটতে থাকবে এখানে, কোথাও একচুল হেরফের ঘটবে না কেবল তোর পরিণত হওয়ার ব্যাপারটা ছাড়া। তোকে যেহেতু চলতি সময় থেকে এগিয়ে দিতে হল তাই জাদুজগতে একই মেলার মাঠ থেমে গেল। ব্যাপারটা কেবল জাদুজগতেই সম্ভব, এখানে সমস্ত নিয়ম হেরফের করা যায়। কিন্তু মূল মেলার মাঠে নিয়মের কোন হেরফের ঘটানো চলবে না। ওখানে মানুষ যাকে জানে স্বাভাবিক জাগতিক নিয়ম হিসেবে তাকে তেমনই রেখে দিতে হবে। একথা তোকে আগেও বলেছি। মূল যে মেলার মাঠ সেখানে জগৎ ও জীবন চলমান অবস্থায় থেকে যায় সর্বক্ষণ, বর্তমান কেবলই এগিয়ে যেতে থাকে ভবিষ্যতের দিকে। বর্তমান কখনো স্থির দাঁড়িয়ে যায় না, ফিরে যায় না অতীতে বা ভবিষ্যৎ হাজির হয় না বর্তমানে। সময় সতত বিচরণশীল একমুখী চলনে যাতে ধারাবাহিকতার নিয়মে কোনোমতেই ব্যাঘাত না ঘটে। জগতের সেটাই স্বাভাবিক নিয়ম, যদি সেই নিয়ম একচুল এদিক-ওদিক হয় তো পুরো জাগতিক কাঠামোটাই বিপর্যস্ত হয়ে যাবে। সব নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে কেবল এই জাদুজগতে, কারণ এটা এক অন্য মাত্রা দিয়ে গড়া। আবার এখান থেকেই চতুর্মাত্রিক সেই মূল মেলার মাঠ কিভাবে পরিচালিত হবে তার পরিকল্পনা তৈরি হয়। এখানে তোকে আমি ভবিষ্যতে এগিয়ে নিয়ে গেলাম, আবার ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাব। একটা কথা জেনে রাখবি, যদিও জানলে তুই অবাক হয়ে যাবি তবুও তোকে বলতেই হবে, সেটা হল এই যে তোকে নিয়ে আমি জাদুজগতে এলাম এটা কিন্তু তোর এক বিকল্প সত্ত্বা। তোর অন্য একটি সত্ত্বা কিন্তু মূল জগতে অথবা মায়াপ্রকল্প অধীনস্থ মেলার মাঠে থেকেই গেছে। তুই সেটা বুঝতেও পারছিস না, কিন্তু সে চলছে ওখানে তার নিজের মত স্বাভাবিক জগতের নিয়মে। এটাও ওই ধারাবাহিকতার নিয়ম বজায় রাখার জন্যই যাতে তোর গোটা জীবন থেকে এখানে যতক্ষণ থাকবি সেই সময়কালটা বিলুপ্ত না হয়ে যায়। ওখানে তোর প্রতিভূ হয়ে যে আছে সে জানেও না যে তুই আছিস এখানে, তার ওখানকার চেতনা থেকে গেছে তার মধ্যে ওখানকারই নিয়মে। এই কাণ্ড ঘটছে এখানে আর যে সমস্ত মানুষ দেখছিস তাদের সবার ক্ষেত্রেই। সবাই জাদুজগতে উপস্থিত বিকল্প সত্ত্বা হিসেবে। অর্থাৎ সবারই রয়েছে দ্বৈত সত্ত্বা। ধারাবাহিকতার নিয়ম অগ্রাহ্য না করার জন্যই এরকম ব্যবস্থা অনিবার্য।’
তার মাথার মধ্যে সমস্ত কিছু তালগোল পাকিয়ে যেতে বসেছিল। কার না ভাবলে অবাক লাগে যে সে একই ব্যক্তি দু’জন হয়ে উপস্থিত রয়েছে দু’ জায়গাতে ? ব্যাপারটা আজগুবি মনে হলেও সে ইদানীং অবিশ্বাস করতে পারছে না। এ যাবৎকাল যেসব কীর্তিকাণ্ড সে চাক্ষুষ করেছে তার ভিত্তিতে কোনোকিছুকেই তার অবাস্তব বা অবিশ্বাস্য বলে মাথায় আসে না। জাদুজগৎটাকে সে তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে আর সেটা তো অবিকল সে যেখানে থাকে সেই মূল মেলাপ্রাঙ্গণের আদলেই হুবুহু গঠিত এবং সেটা চলমান থাকে তার পথপ্রদর্শকের অঙ্গুলিহেলনে। মায়াপ্রকল্প অথবা মূল মেলার মাঠ এবং এই জাদুজগৎ, দু’টি যে দুই আলাদা জায়গা তাতে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যদিও তার দিগদর্শক বলেছে যে জাদুজগৎটা আসলে একটা ভড়ংবাজি। কিন্তু এটা তো খুবই সত্যিকথা যে এই ভড়ংবাজি দিয়েই রচিত হয়ে চলেছে গোটা জাগতিক পরিকল্পনা যেখানে দেখা যাচ্ছে তাকে এবং সমসাময়িক জনতা ও ঘটনাবলীকে মূল মেলার মাঠে যেটা আসলে অন্যকথায় এক মায়াপ্রকল্প। যদি তাই হয় তো এই ভড়ংবাজিটাই প্রকৃত জায়গা যেখান থেকে পরিচালিত হয় গোটা জগৎ। এটা কি তাহলে বিশ্বপিতার রন্ধনশালা যেখানে নির্মিত হয় নানান সুখাদ্য নানান জাগতিক কাঠামো হিসেবে ? অথবা বিশ্বনিয়ন্তার কারখানা হল এই ভড়ংবাজি কিংবা জাদুজগৎ যেখানে সে তার শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় দেয়। যাই হোক না কেন, সে বুঝে গেছে, সাদামাটা যে জগৎটা ভেসে বেড়াচ্ছে চোখের সামনে সেখানে আছে এমনসব বিস্ময় যাদের প্রত্যক্ষ করার প্রস্তুতি হিসেবে ক্রমাগত বিস্মিত না হয়ে থাকাই যুক্তিযুক্ত, বরং এমন মানসিক গঠন মজবুত রাখা উচিত যাতে সবকিছুকেই গ্রহণযোগ্য বলে ভাবা যায়। তাই সমস্ত বর্ণনা এতক্ষণ ধরে শুনেও সে নিরুত্তর থাকল, পরবর্তী কী কথা তাকে শুনতে হয় তার অপেক্ষায়। তবে এতক্ষণের বর্ণনার পর যে বিরতি দেখা গেল তারপর অন্য কোন প্রসঙ্গ উত্থাপনের আগে সে দেখতে পেল জাদুজগতে উপস্থিত জনসম্প্রদায়ের গতিশীলতা, সেই পূর্বোক্ত জাদুহস্তের মৃদু সঞ্চালনে। পরক্ষণেই সে শুনতে পেল দৈববাণীর মত তার জন্য প্রদত্ত নির্দেশ,
‘এবার তুই লোকজনকে ধরে ধরে যে প্রশ্ন করে যেতে চাস করে যা। কেউ তোকে উত্তর না দিতে চাইবে না। আর সঙ্গে থাকছি আমিও। দেখবি সবাই মনে করবে আমরা কোন এক অমূল্য বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে চলেছি যার জন্য সাড়া দেওয়া প্রত্যেকেরই পবিত্র দায়িত্ব। ভাবিস না, এগিয়ে যা। তোর সামনে যারা রয়েছে তারা সবাই সাধারণ জনতা, ছাপোষা মানুষ মাত্র।’
কথাটা যে সত্যি তা সে তার চারপাশে থাকা ভিড়ের মানুষগুলিকে দেখেই বুঝল। এরা প্রত্যেকেই ভিড়ের মধ্যে রয়েছে, রয়েছে উহ্য হয়ে। কারোর দিকেই কেউ তাকাচ্ছে না বিশেষ নজর দিয়ে, কারোর মধ্যেই নেই বিশেষ বর্ণ বা বৈচিত্র্য। এই সাধারণ মানুষগুলি সত্যিই সাধারণ, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তারা দোকান চালায়, অফিস করে, নানারকম ধান্দায় নিযুক্ত সংসার প্রতিপালনের নিমিত্ত। তাদের কেউই গায়ে অসাধারণত্বের তকমা ধারণ করে রাখেনি। এই সাধারণ জনতার নানাজনকে ধরল সে বা তারা দু’জনেই অভীষ্ট প্রশ্ন করে উত্তর পাওয়ার লক্ষ্যে। তারা কেউ বা খাচ্ছিল, কাজের অবকাশে বিশ্রাম নিচ্ছিল। এক এক করে লোককে ধরে ধরে সে একটাই প্রশ্ন রাখল সবার জন্য,
‘খিদে পাচ্ছে বলে তো খায় সবাই, তুমিও খাও। কিন্তু খেতে হবে কেন ?’
সবাই প্রশ্নটাকে শুনল মনোযোগ দিয়ে এবং উত্তরও দিল ভেবেচিন্তে। বোঝা গেল কেউ ব্যাপারটাকে হাল্কা করে নিল না। অধিকাংশ লোকের কাছ থেকে উত্তরটা পাওয়া গেল দু’রকম। একদল বলল,
‘বেঁচে থাকার জন্য।’
অন্যদল একই উত্তর দিল একটু ঘুরিয়ে,
‘না খেলে বেঁচে থাকা যাবে না,’ অথবা, ‘না খেলে মরে যেতে হবে।’
মুষ্টিমেয় কয়েকজন একটু অন্য উত্তর দিলেও শেষপর্যন্ত বেঁচে থাকার প্রসঙ্গেই ফিরে এলো। প্রশ্ন করা হল বহু মানুষকে এবং উত্তর পাওয়া গেল একটাই। সে বলল,
‘তাহলে তুই কী দেখতে পেলি ? বেঁচে থাকাটাই মানুষের মূল উদ্দেশ্য। সবাই ছুটছে এই বেঁচে থাকাটাকেই মূল লক্ষ্য করে। যাবতীয় কার্যকলাপ এই উদ্দেশ্য কেন্দ্র করেই এবং এটাই প্রাথমিক ও মৌলিক লক্ষ্য।’
কিন্তু তার মনে তখন অনেক প্রশ্ন। সে সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
‘বেঁচে থাকতে গেলে মানুষকে আর কত কাজ করতে হয় ? কত অর্থ উপার্জন প্রয়োজন ? এতো এতো কাজকর্ম মানুষের কেবল বেঁচে থাকার জন্য ? এতো এতো সম্পদের মোহ, এতো এতো বিলাস, আমোদ-প্রমোদ, নাম-যশ, এতো এতো সব বাড়ি-গাড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি পাওয়ার পিছনে ছুটে মরা কেবল বেঁচে থাকার জন্য ?’
‘অবশ্যই,’ সে জানাতে থাকল, ‘এগুলি সবই বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াকে স্বাচ্ছন্দ্যে ভরে দেওয়ার জন্য। কত আরামপ্রদ করা যায় বেঁচে থাকাটাকে। সবই সেই একমেবদ্বিতীয়ম বেঁচে থাকার আনুষঙ্গিক ও প্রাসঙ্গিক।’
‘কিন্তু কেবল বেঁচে থাকাটা মানুষের একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। অনেকেই কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে বা আদর্শের জন্য হেলায় জীবন দিয়ে দেয়। বেঁচে থাকা তার কাছে তখন তুচ্ছ।’
‘সেটা ব্যতিক্রম। কিন্তু সেখানেও জানবি অন্যভাবে বেঁচে থাকার প্রশ্ন জড়িত। ওই যে বললি, নামযশ, সেটা চায় কেন মানুষ ? নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই। এখানেই রয়েছে আরও বড় লক্ষ্যের কথা। বেঁচে থাকাটা একেবারেই প্রাথমিক লক্ষ্য। কিন্তু এটাও বলতে পারিস আসল উদ্দেশ্য নয়। সেটা আরও বড়, তার ব্যাপ্তি নিছক বেঁচে থাকা কেন্দ্রিক নয়। বেঁচে তো থাকতে চায় সবাই, সেটাই তো প্রথম লক্ষ্য। তোর প্রশ্নের জবাবে সবাই বললও সেটা। জীবমাত্রের মূল উদ্দেশ্য এই বেঁচে থাকা। জগৎ পরিচালিত এই মূল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই। তার জন্যই মানুষের এতো কাজকর্ম, এতো সংগ্রাম, এতো পড়াশুনা, এতো খাটাখাটুনি, ছলচাতুরি, হম্বিতম্বি সব। কেবল বেঁচে থাকার জন্য। জন্মের পর থেকে যত সে বড় হতে থাকে তার ভিতরে গেঁথে যায় এই ইচ্ছে। যে কোনও প্রকারে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমি বেঁচে থাকলেই আমার অস্তিত্বের প্রকাশ ও বিকাশ ঘটবে। বেঁচে থাকাটাই আমার একমাত্র কাজ, যেভাবে পারি।’
সমস্তকিছুর এমন সহজ-সরল ব্যাখ্যা তার পছন্দ হচ্ছিল না। সে অনেক বড় কোন বিষয় জানার আশা করেছিল। এটা কি সত্যি তেমন কোন অজানা বিষয় হল ? এই তুচ্ছ ব্যাপারটাকে জানার জন্য এতো কাঠখড় পোড়ানোর কোন মানেই ছিল না। নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করতে সে বলল,
‘আসলে জীবমাত্রেই বেঁচে থাকতে চায়, এটা জানার জন্য এতো পরিশ্রমের কোন দরকার ছিল না। এটা সবাই জানে। এতো জটিলভাবে বিষয়টাকে জানতে গেলাম কেন ?’
‘এই কারণে যে জানলেও ব্যাপারটাকে সবাই ভুলে থাকে। মানুষের হাজারটা লক্ষ্য, হাজারটা চাহিদা। বাড়ি চাই, গাড়ি চাই, ক্ষমতা চাই, শ্রেষ্ঠত্ব চাই, ধনসম্পদ চাই, সাফল্য চাই, উচ্চপদ চাই, নেতৃত্ব চাই, যশ চাই ইত্যাদি কত কী। কিন্তু কেন চাই কে ভাবে ? চেয়ে না পেলেই যত অশান্তি। পেলে কী হবে, কী কাজে লাগবে ? আমি ফকির হয়েও থাকতে পারি, রাজা হলেও আপত্তি নেই। যা খুশি হই না কেন কী কারণে কিছু হওয়ার আকাঙ্খা আমার ? কে ভাবে সেই কথা ? কেবল চাহিদার লম্বা তালিকা বানাতেই থাকে। কিন্তু উদ্দেশ্য একটাই, বেঁচে থাকা। কেবলই বেঁচে থাকা। ব্যস।’
‘সেটা কেউ না জেনেই এতো কাণ্ড ঘটিয়ে বেড়াচ্ছে ?’
‘তা তো তুই নিজেই দেখতে পাচ্ছিস। তার জন্যই তো উত্তরটা অনুসন্ধান করতে গিয়ে এতো জটিল প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হল। তার জন্য তুই আবার রেগেও গেলি। কিন্তু কী করা যায় বল্ তো ? কেউ তো সাদা কথায় নিজেকে প্রকাশ করে না, বলে না কী তার উদ্দেশ্যবিধেয়। সে নিজেও কি জানে ? জানলেও কাউকে জানাবে না। সবাইকে ভুল বোঝাবে আর বিভ্রান্ত করবে। কেন তুমি পড়াশুনা করছ ? উত্তরে বলবে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য, উচ্চপদ পাওয়ার জন্য, সমাজের সেবা করার জন্য। সোজাসুজি কেউ বলবে না যে বেঁচে থাকার জন্য বা নিজেকে বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াতে সামিল করার লক্ষ্যে। কেন তুমি নেতা হতে চাইছ, কেন তোমার ক্ষমতা দখলের মোহ ? উত্তরে বলবে, মন্ত্রী হওয়ার জন্য বা রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার জন্য যাতে দেশের উন্নতি ঘটাতে পারি, জনগণের মঙ্গল ঘটাতে পারি। সত্যিকথাটা বলবে না কেউ যে এটাই আমার বেঁচে থাকার প্রকরণ। এভাবে যাকেই তুই প্রশ্ন করবি কেন তুমি তোমার কাজটা করছ, সে তোকে কিছু না কিছু একটা অন্য উত্তর দেবে যা পুরোটাই বিভ্রান্তিকর, কেউ বলবে না যে সে তার কাজটা করছে নিছক বেঁচে থাকার অভিপ্রায়ে। কেন তুমি ব্যবসা করছ, কেন শিল্পস্থাপন করছ, কেন গান গাইছ, কেন লিখছ, কেন খেলছ, কেন ইত্যাদি ইত্যাদি যা প্রশ্নই করিস না কেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সে তোকে বড় বড় উদ্দেশ্যের কথা বলবে যার পুরোটাই মেকি এবং সাজানোগোজানো। সোজা উত্তরটা দেবে না কেউ তোকে, বলবে না, যে কাজটা আমি করছি সেটাই আমার বেঁচে থাকা। তাই এই জানা উত্তরটা জানতে আমাদের যেতে হল এমন ঘুরপথে। মানুষ যা করে পৃথিবীতে সব নিজের টিকে থাকার জন্য, নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এটাই সোজা উত্তর। আর কোন দ্বিতীয় উদ্দেশ্য নেই। যতই গালভরা মহৎ উদ্দেশ্যের কথা জাহির করুক না কেন কেউ নিজের নানাবিধ বিচিত্র কাজের সপক্ষে জানবি সেসবই গালগল্প। বেঁচে থাকাটাই হল সবার একমাত্র উদ্দেশ্য।’
কথাগুলি শুনে সে ভাবতে লাগল। মানুষের যত প্রকারের আয়োজন কেবল তার বেঁচে থাকার জন্য ? এই যে বিজ্ঞানীর উদ্ভাবন, আবিষ্কারকের আবিষ্কার, দেশনায়কের দেশ শাসন, সমাজসংস্কার, বিদ্রোহ, বিপ্লব, যুদ্ধবিগ্রহ, নানাবিধ প্রতিষ্ঠা অর্জন ইত্যাদি সবই বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে ? সে ভেবে ভেবে বুঝল, নয় বা কেন। বেঁচে থাকার জন্যই তো মানুষ চিকিৎসা করায় যাতে সে সুস্থ থাকতে পারে, সুস্থ থাকলেই সে বেঁচে থাকবে। বেঁচে থাকাকে কত আরামদায়ক করা যায় তার জন্যই মানুষ নানা অধরাকে হস্তগত করার প্রচেষ্টায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে দিবসরাত। তার সমস্ত সাজসজ্জা বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যেই নিবেদিত। সভ্যতা এগিয়ে চলেছে, সমাজ পরিচালিত হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার মূল উদ্দেশ্য সামনে রেখেই। যদি না মানুষ বেঁচে থাকে তাহলে কোন কাজের কোন মূল্য থাকবে কি ? অথচ এই সাদা কথাটা কেন মানুষ সোজাভাবে প্রকাশ করে না ? কেন সোজাকথা সোজাভাবে বলায় তার অত অনীহা ? তার একটা কারণ হতে পারে, সে নিজেও জানে না এই প্রাথমিক ইচ্ছেটার কথা। না জেনেই ছুটে মরছে হাজারটা ভ্রান্ত উদ্দেশ্যের বশবর্তী হয়ে। বা এমনও হতে পারে যে সে জেনেও না জানার ভাণ করছে। কোন্ বিষয়টা সঠিক বুঝতে পারছিল না সে নিজেই। তাই প্রশ্ন করল,
‘এই সারসত্যটা কেন মানুষ প্রকাশ করতে চাইছে না ?’
‘তার জন্য মানুষকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। আসলে জন্মের পর বেঁচে থাকাটা এমনই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় দাঁড়িয়ে গেছে যে কেউ আর তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে না। তাকে বহুবিধ কাজকর্ম এবং উদ্দেশ্য ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। তার সামনে একের পর এক এসে হাজির হতে থাকে রঙবেরঙের লক্ষ্যসমূহ। তাদের সামনে পড়ে সারাজীবন তাকে নাজেহাল হয়ে যেতে হয়। সে ভাবে, ওই লক্ষ্যগুলি পূরণ করা আমার আসল কাজ। সভ্যতা যত এগিয়ে যায় চাহিদার পরিধিও ততই বাড়তে থাকে। সেইসব চাহিদা তার সামনে হাজির হতে থাকে আর সে ভাবে আমাকে সব পেতে হবে। জীবন তার ভরে যেতে থাকে সীমাহীন অভাবের মোহে। এখানে আর সে ভাবতে পারে না বা ভাবার অবকাশ পায় না যে বেঁচে থাকাটাই জীবনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। সেটা তখন সুপ্ত হয়ে যায়, থাকে অবচেতন মনে। তার সমগ্র চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে নানা জাতীয় প্রাপ্তির প্রত্যক্ষ বাসনা। তার তাড়না তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সে নিজের মূল উদ্দেশ্যবিধেয়র কথা ভুলে যায়, ভুলে থাকে। জীবন কেটে যায় কোন্ ফাঁকে বোঝাই হয় না।’
মেলার মানুষজনকে দেখছিল সে। সবাই ক্লান্তিহীন চলাচলে ব্যস্ত হয়ে রয়েছে। এই চলাচল ঘোষণা করছে তার বেঁচে থাকা, চলাচল থেমে গেলেই সে মুছে যাবে, হারিয়ে যাবে, তার কাজকর্মই জানিয়ে দিচ্ছে যে সে বেঁচে আছে। যদি মানুষ কাজকর্ম বন্ধ করে বসে যায় তো তার কোন প্রাসঙ্গিকতা থাকে না, সে তখন বেঁচেও মরে থাকে। শুনে সে প্রশ্ন করল,
‘বেঁচে থাকাটা যে মূল উদ্দেশ্য সেটা মুখে ঘোষণা করে না যদিও লোকজন সেটা নিশ্চয় প্রকাশ পায় তার এই অবিরাম চলাচলে ? সেটাই তো তুমি বলতে চাইছ ?’
‘অবশ্যই। জীবন মানেই চলাচল, বেঁচে থাকা মানেও তাই। চলাচল মানেই কাজ, আর মানুষের যেকোন কাজ বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াতে অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন কাজ ভালোবাসে, সেই কাজটা যদি সে করতে পারে তাহলে সেটা সে করে জীবনকে ভালোবাসে বলেই, বেঁচে থাকার উৎসাহ তাকে পরিচালিত করে বলে। বহু মানুষ রয়েছে যাদের এমনসব কাজ করতে হয় যেসব তারা একদমই করতে ভালোবাসে না, দায়ে পড়ে করতে হয়। কিসের দায় ? জীবনধারণের দায়, বেঁচে থাকার মোহ বা উৎসাহ। এই উৎসাহ যার না থাকে সে জীবন্ত অবস্থাতেই মৃত হয়ে যায়, মেলার মানুষজনের চলাচলে সামিল হতে পারে না। এসব মানুষকেও তুই খুঁজে পাবি এই ভিড়ে যারা জীবনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। তারাও উপস্থিত ভিড়ের মধ্যে, যদিও জনতার অবিশ্রাম চলাচলের অংশ হিসেবে নেই তারা। জানবি, ভিড়ের মানুষগুলির কার্যকলাপই জানায় যে তারা বেঁচে থাকার মূল লক্ষ্যে পরিচালিত, সেসব কাজ পছন্দের হোক অথবা অপছন্দের। কর্মহীন ব্যক্তি একমাত্র ব্যতিক্রম, সে বেঁচে থাকার মূল উদ্দেশ্যে পরিচালিত নয়। সে ভিড়ে থেকেও ভিড়ে নেই। তাকে নিয়ে সমাজ বা সভ্যতা মাথা ঘামায় না। জনতার ভিড়ে থেকেও সে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে থাকে। দেখতেই তো পাচ্ছিস, মেলার ভিড়ে যারা চলমান তারা সবাই বর্তমানেই বিচরণশীল, যেসব মানুষ অতীত হয়ে গেছে তারা কেউ নেই, যেহেতু মেলার ভিড় মৃত সমস্ত মানুষদের সামিল করতে জানে না অবিরাম চলাচলে। থাকে না এখানে ভবিষ্যতের মানুষরাও। মেলার ভিড়ে কেবল বর্তমানের মানুষগুলির কাজকর্ম ও চলাফেরা প্রতিফলিত, কারণ বেঁচে থাকা ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবেই বর্তমান কেন্দ্রিক। মানুষের বেঁচে থাকাটা অতীতও নয় ভবিষ্যতও নয়, একেবারেই বর্তমান। আর তাই মেলার ভিড়ে যেসব মানুষের চলাচল দেখতে পাচ্ছিস তারা সবাই বর্তমানেরই বাসিন্দা। যে জীবনের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলল, বেঁচে থাকা যার জন্য অর্থহীন সে অতীত হয়ে যায় বলে মেলার ভিড়ে থেকেও নেই। তাদের নিয়ে ভিড়ের চলাচল যেমন ভাবে না আমরাও তাদের ভুলেই থাকব। ভিড়ের সামগ্রিক চলাচলে মুখ্য হয়ে আছে সেই জনতা যাদের মূল উদ্দেশ্য বেঁচে থাকা, তাদের সমস্ত কার্যকলাপ কেবলই বেঁচে থাকার আনন্দে ও উৎসাহে পরিচালিত।’
দিগদর্শকের সুদীর্ঘ বক্তব্য সে বিনা বাক্যব্যয়ে শুনে গেল। প্রতিবাদ করার মত কিছুই তার মাথায় এলো না। চলমান জনতার দিকে সে তাকিয়ে রইল নির্বাক, দেখতে লাগল তাদের বহুধা বিভক্ত যাতায়াত আর নানাবিধ কার্যকলাপ। তাদের চলাচল বৈচিত্র্যমণ্ডিত, কার্যকলাপও তাই। প্রত্যেকটি মানুষ প্রত্যেকের তুলনায় ভিন্ন, যদিও তাদের কাজ সমশ্রেণির হতেও পারে, যদিও তাদের চলাচলও হতে পারে সমধারায়। যতই বৈচিত্র্য থাকুক না কেন, সবাই চলেছে একই উদ্দেশ্য সামনে রেখে। প্রত্যেকেই সমাজের অঙ্গীভূত অবস্থায় সভ্যতার এগিয়ে চলার সঙ্গে সামিল এবং সংসার প্রতিপালনের জন্য ব্যস্ত বা ব্যতিব্যস্ত। তাদের কাউকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তাদের জীবনের এত এত পসরার আয়োজন কেবলমাত্র বেঁচে থাকার জন্য। তাদের প্রত্যেকের সামনেই হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ উদ্দেশ্য এবং তারা সবাই সেইসব আপাততগ্রাহ্য উদ্দেশ্যগুলি পূরণের জন্যই জীবনপণ করে এগিয়ে চলেছে। কেউ চাইছে ক্ষমতার শীর্ষে যেতে, কেউ চাইছে পড়াশোনায় এক নম্বর হতে, কেউ ব্যস্ত শিল্প স্থাপনে বা বাণিজ্যে সফল হতে, কেউ চায় নামী শিল্পী বা লেখক বা গায়ক হবে, কারো উদ্দেশ্য কোন প্রতিষ্ঠানের অভীষ্ট পদ, কেউ চাইছে খেলায় সাফল্য, কেউ চাইছে লোক ঠকাতে ইত্যাদি কত যে উদ্দেশ্যে পরিচালিত চলমান জনতা তা বলে শেষ করা যায় না। এই ভিড়ে রাজনীতিক, বিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক, ছাত্র, শিক্ষক, অভিনেতা, সমাজবিদ থেকে শুরু করে কে নেই ? সবাই নিজের নিজের আপাতদৃষ্ট উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে এবং কেউ একথা মাথায় রাখছে না যে তার একমাত্র মূল উদ্দেশ্য হলো বেঁচে থাকা। তার সমস্ত ব্যাপারটাকে সত্যিই এবার খুব তাজ্জব বলে মনে হলো। সে জানতে চাইল,
‘বেঁচে থাকা যে মূল উদ্দেশ্য ওটা ভাবতে বাধা কোথায় বা কেন ?’
‘বাধা এখানেই যে ওই ভাবনাটা ক্লান্তিকর ও বিরক্তিকর। যদি মানুষ ওই মূল ভাবনাটাকে আসল লক্ষ্য বলে ভাবে তো তার কাজকর্মের এত উৎসাহ আর থাকবে না। আপাতদৃষ্ট উৎসাহগুলি অনেক বেশি আকর্ষণীয় বলে মানুষ সেসব নিয়েই ভাবে এবং ব্যস্ত থাকে। যদি মানুষ জানে যে বেঁচে থাকাটাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য অথবা সেটাকেই সে মুখ্য বলে ধরে নেয় তো সেটা তার জন্য হয়ে যাবে বড়ই ঘ্যানঘেনে বিষয় এবং কাজেকর্মে তার আর তেমন উৎসাহই থাকবে না। সে জানবে, যেমন-তেমন ভাবে বেঁচে থাকলেই যদি হয়ে যায় তো সেটুকুই করি, আমার অত অনন্ত চাহিদা রেখে কী আর হবে ? সবই তো মূল্যহীন। কেউ কি এমন ভাবে ? তাহলে তার কাছে বেঁচে থাকাটাই আকর্ষণ হারাবে। তাই মানুষ মনে রাখে না, বেঁচে থাকাটাই তার জন্য প্রাথমিক উদ্দেশ্য। তার সামনে তাই এত হাজার হাজার উদ্দেশ্যের পসরা। সেসবের আকর্ষণই তাকে কাজ করায়, বেঁচে থাকার ব্যাপারটা থাকে অবচেতন মনে। প্রকাশ্য থাকে না করোও কাছেই।’
‘এবার বুঝলাম, কেন সে বেঁচে থাকা তার মূল উদ্দেশ্য সেটা বলে না।’
সে বেশ সোৎসাহে বলল। উত্তরে জানালো দিগদর্শক,
‘হ্যাঁ, সেটা অবশ্যই একটা বড় কারণ। তবে জানবি যে এই প্রাথমিক বা মূল উদ্দেশ্যটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকাও একটা প্রধান বিষয়। বেঁচে থাকা জীবনের মূল লক্ষ্য সেটা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে ভুলেই থাকে মানুষ। ভুলে না থাকলে কী বিপদ তা তো জানালাম তোকে। আর সবচেয়ে বড়কথা, ভুলে থাকলে কোন ক্ষতি হয় না মানুষের, তার চলাচল বা কাজকর্ম কিছুই থেমে থাকে না। বরং যেমন তোকে জানালাম, এই নির্মম সত্যিকথাটা জানলেই মানুষ থেমে যেতে পারে। তাই সে না চাইলেও তাকে জাগতিক নিয়ম বা বিশ্বনিয়ন্তা বিষয়টা ভুলিয়ে রাখে। সমস্ত জীবন মানুষ এভাবে বিষয়টাকে ভুলে থেকেই কাটিয়ে দেয়।’
‘তাহলে এই বিষয়টাই মানুষের মূল ও একমাত্র চালিকাশক্তি ?’
‘একদম তাই।’
‘এটাই তার মূল ও একমাত্র উদ্দেশ্য জীবনের ?’
এবার তার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে থেমে গেল পথপ্রদর্শক। খানিকটা বিরতি নিয়ে সে বলল,
‘এখানে একটা কিন্তু আছে। তোকে থামতে হবে এই জায়গাটাতে। জীবনের সমস্ত কাজকর্ম ও চলাচলের মূল চালিকাশক্তি হলেও বেঁচে থাকাটাকেই তুই কিন্তু জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বলতে পারিস না। খেয়াল করে দ্যাখ্, আমি বারবার এটাকে মূল বা প্রাথমিক উদ্দেশ্য বলেছি। কেন জানিস, এর চেয়েও বড় একটা উদ্দেশ্য রয়ে গেছে। সেটাই হলো শেষ ও সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য। সেটা মানুষের অন্তরের আরও সুপ্ত বা গুপ্ত বাসনা। সেটা আরও অজ্ঞাত তার কাছে। আমি কিছুক্ষণ আগে তার উল্লেখ করেছিলাম কোন এক প্রসঙ্গে। মনে পড়ে কি ?’
তার মনে পড়লো ঠিকই। এই কথোপকথনের গোড়ার দিকে উঠেছিল প্রসঙ্গটা। সে যখন বলেছিল, মানুষ চায় খ্যাতি ও নামযশ, তখন সেই প্রসঙ্গে সে বলেছিল, এই নামযশ কী উদ্দেশ্যে চায় মানুষ। এবং সেখানেই সে বলেছিল যে তার পিছনে আরও একটা বড় উদ্দেশ্য রয়েছে যা ব্যাপ্তিতে আরও ব্যাপক। সেই প্রসঙ্গ তখন তখনই চাপা পড়ে গিয়েছিল অন্য বিষয়ের মোড়কে, সেও সব ভুলে গিয়েছিল। এবার তার মনে পড়লো বিষয়টা। তাহলে বেঁচে থাকাটাই মানুষের একমাত্র উদ্দেশ্য নয় ? এটাকে একমাত্র উদ্দেশ্য ভেবে সে এতক্ষণ বেশ নিশ্চিন্ত ছিল। এখন বুঝলো, তা নয়। সে এখন জানল, অন্যরকম। বেঁচে থাকাটা মানুষের প্রাথমিক লক্ষ্য মাত্র। তার চেয়েও বড় একটা লক্ষ্য রয়ে গেছে তার। সেটা চূড়ান্ত এবং তাকে কেন্দ্র করে মানুষের চলাফেরা। আবার তা নাকি আরও অজ্ঞাত, আরও রহস্যে ঘেরা তার পরিচয়। সে আরও বিভ্রান্ত হতে লাগলো। বুঝতে পারল না এইসব উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের এখানেই সমাপ্তি কিনা। যদিও তাকে বলা হলো যে এটাই চূড়ান্ত উদ্দেশ্য, তবুও সে ভয় পেতে লাগলো আবার না নতুন কোন উদ্দেশ্যের আবির্ভাব ঘটে। সে খানিকটা ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করল,
‘সেই চূড়ান্ত উদ্দেশ্যটা কী ?’
‘বলছি,’ পথপ্রদর্শক জানাতে লাগলো, ‘তার আগে জেনে রাখ্ যে তোর বয়স যেমন এগিয়ে আছে আপাতত তেমনই থেকে যাচ্ছে। জাদুজগতের কাঠামোতেই তুই থেকে যাচ্ছিস যেহেতু আবার প্রয়োজন হতে পারে লোকজনকে ধরে ধরে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার। মূল মেলার মাঠে যাবি যখন তোকে আবার স্বাভাবিক করে দেব। বলেছি তো, ওখানে তোর এক প্রতিভূ বর্তমান আছে এখনও। এখান থেকে যাবি যখন ওখানে তুই তার সঙ্গে মিশে যাবি। কোন অসুবিধেই হবে না। এখন যেমন থাকছিস তেমনই চলতে থাক। খেয়াল রাখিস, তুই বড় হয়েই আছিস।’
সেটা তাকে না বললেও হত, কারণ সে যে বড় হয়ে আছে তা সমস্ত অস্তিত্ব দিয়েই উপলব্ধি করতে পারছিল। বড় কি ছোট, সেই অনুভূতি নিশ্চয় সবার মধ্যেই থাকতে বাধ্য। কিন্তু সে বিষয় নিয়ে তার মাথাব্যথা ছিল না। তার যেটা মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা হল মানুষের কোন্ বস্তুটা চূড়ান্ত লক্ষ্য। সেই প্রশ্নটাই সে করল আবার,
‘আমাকে বল, মানুষের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য কী ?’
ধীরস্থির ভঙ্গিতে কোটিকল্প জানালো,
‘তুই জেনেছিস, মানুষের প্রাথমিক বা মূল উদ্দেশ্য হলো বেঁচে থাকা। এবার পরবর্তী প্রশ্ন এবং এটাই চূড়ান্ত।
কতদিন ?’
অধ্যায়: চোদ্দ
তাদের গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছিল স্পিতি নদীর চলন যেদিকে তার উল্টোমুখে। এই অঞ্চল নদীর ঊর্ধ্বগতির আওতায়, জাতীয় সড়ক পাঁচশ’ পাঁচের ডান দিক ধরে চলেছে প্রায় সমান্তরালে। কাজা থেকে নদী চলে গেছে রাস্তার ডানধারে, ব্রিজ পেরোতে হয় সেখানে। রাস্তা পিচ ঢালা হলেও ভাঙাচোরা, ক্রমাগত ধ্বস নেমে আর ভঙ্গুরতার জন্য।
‘তুমি স্পিতি নদীর সঙ্গে গল্প করতে করতে এসেছ এতটা পথ। নদীর সঙ্গে কী গল্প হল তোমার যদি বল জানার খুব ইচ্ছে।’
গেরহার্ট আগ্রহ প্রকাশ করল। তারও গবেষণার বিষয় অনন্ত জীবন নিয়ে জানার পর থেকে সে-ও বেশ উৎসাহিত হয়েছে। নদীর গল্প তাই তাকে জানাবার কোন অনিচ্ছে হলো না তার।
নদীর গল্প শোনাতে গেলে বলতে হয় সমগ্র শীতল পার্বত্য মরুভূমির কথা যার গোটাটাই স্পিতি অববাহিকা, যেখানে নদী রচনা করেছে হিমবাহ গলা জলে পুষ্ট উপত্যকা। নদীর গল্প মানে এই গোটা পথ পরিক্রমা। কুঞ্জুম লা থেকে বেরিয়ে নদী চলেছে বিনুনি পাকিয়ে, তারপর তার গতিপথ বহু বাঁকসম্পন্ন, গভীর খাদ ধরে এগিয়ে গেছে একসময়। তার নিম্নভূমি পাথুরে হ্রদের সঞ্চয়জাত পদার্থে পরিপূর্ণ, উচ্চগতিতে নদীজাত চত্বরের গা লক্ষণীয়, ধ্বংসস্তূপের গচ্ছিত বা জমা বস্তুসমষ্টির অবশিষ্টাংশে ভরা। উপত্যকার পর্বতগাত্রের দেয়ালেও দেখা যায় নদীজাত ভূমিধসের জমাবস্তু। নিম্নগতিতেই নদীপ্রবাহে বাঁকের আধিক্য যেখানে পাথরশয্যা কেটে গভীর গিরিখাদ বানিয়ে সে প্রবাহিত ক্ষীণ ধারায়। নদীর দু’ধারে বহু উপনদী ও নালা মূল নদীতে যুক্ত হয়েছে সমকোণে যা নদীর গতিপথে গাঠনিক নিয়ন্ত্রণের নির্দেশক এবং এটাই জানায় যে নব্যগাঠনিক ক্রিয়াকলাপ চলছে এখনও এই অস্থির উপত্যকার প্রাঙ্গণ জুড়ে। ভূমিধস বা ভূমিকম্প তারই প্রমাণ।
‘নদী তোমাকে অনন্ত জীবন সম্পর্কে কী জানিয়েছে ?’
গেরহার্টের প্রশ্নের উত্তরে সে বলল,
‘নদী বলেছে অনন্ত জীবন মানে হল কেবলই এগিয়ে যাওয়া।’
‘ওটাই আসল কথা, কারণ এগিয়ে যাওয়ার কোন অন্ত নেই। যে কোন বিষয়কে কেন্দ্র করেই এগিয়ে চলা যায় যত খুশি।’
নদীর গল্প বলতে বোঝায় নদী-অববাহিকা, নদী-উপত্যকার পরিচয়। স্পিতি শুষ্ক পাথুরে মালভূমি ধরে এগিয়ে চলেছে, নদী বরাবর বিশাল সমস্ত পাথরের খন্ডাকার শঙ্কু আকৃতির গঠন, পাললিক শিলা দিয়ে গড়া বড় বড় পাখা, গভীর গিরিখাত, ঝুলন্ত পাথরের আচ্ছাদন, জীবাশ্মের ভান্ডার এবং এ সমস্তই উপত্যকার মূল বৈশিষ্ট্য। প্রশস্ত চত্বর জুড়ে ভূবৈচিত্র্যে পলি জমে পাথর হয়ে পাখনা মেলা, নদীজাত অবশেষ থেকে গঠিত হ্রদের খাত। পাললিক নিদর্শন জলে পরিবর্তন ঘটায় দ্রবীভূত হয়ে। নদী ও সংশ্লিষ্ট এলাকার নব্যগাঠনিক সক্রিয়তা বোঝা যায় বৃষ্টিপাত সম্পর্কিত জলবিজ্ঞানে। এসব তার গল্পের অংশবিশেষ। নদীজাত চত্বরের নানাস্তরে দেখা যায় হ্রদজাত জমাবস্তুর অবশেষ যাতে আছে হালকা বর্ণের পলিমাটি, পলিসমৃদ্ধ ও ধূসর কাদাযুক্ত সমান্তরাল স্তরসমূহ যা এক চরিত্র থেকে অন্য চরিত্রে পাল্টে যেতে থাকে।
নদীকে সে দেখেছে তার এইসব সামগ্রিকতাকে নিয়ে, নদীর শয্যা বিচ্যুতিজাত ও ভাঁজযুক্ত যেখানে ওইসব সমান্তরাল স্তরের কোন কোন অংশে রয়েছে ভূকম্পজনিত বিকৃতি। রয়েছে বালির বাঁধ ছদ্মবেশী পিণ্ড বা ডেলা হয়ে। প্রাকৃতিক ও পাললিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নদীর অববাহিকা চার পর্যায়ের।প্রশস্ত উপত্যকা জুড়ে বেণীপাকানো নদীখাত একটি ধরন। কুঞ্জুম লা থেকে বেরিয়ে অন্য উপনদীদের যুক্ত করে তৈরি এই অঞ্চল দু’ থেকে তিন কিলোমিটার চওড়া। চুলের বিনুনি সদৃশ তার গঠন এখানে এবং রয়েছে পাথুরে হ্রদের অবশেষ। দ্বিতীয় ধরনটি নিম্নগতিতে দেখা যায় যেখানে নদী খাত বাঁকে বাঁকে বয়ে চলেছে সংকীর্ণ গিরিখাত ধরে। অন্য ধরন দু’টির একটি হচ্ছে প্রাচীন হ্রদজাত প্রস্তুরীভূত পলি বা পাললিক শিলা এবং অন্যটি নদীজাত জমা অবশেষ। উপত্যকার পাহাড়ি দেয়ালে নিম্নগতিতে দেখা যাবে মিহি পলিজ ঢাকনা আর দিগন্ত জুড়ে বিছিয়ে থাকা বোল্ডার। পলির স্তর চার ফিট পর্যন্ত পুরু এবং নদীখাত থেকে ষাট-সত্তর ফিট ওপরেও রয়েছে। পলিশয্যাতে আছে প্রশস্ত পার্শ্বীয় ও উল্লম্ব বিস্তার। পাহাড়ি দেয়ালের গা থেকে খসে পড়া শিলাখণ্ড ও ধ্বংসস্তূপ জমে রয়েছে স্থানে স্থানে। কাজা অঞ্চলে উপত্যকা বেশি চওড়া, তারপর যত এগিয়ে গেছে ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হয়ে চলেছে।
পোহ্ থেকে চলনের পর খাব অঞ্চলে নিজেকে শতদ্রুর বুকে সমর্পণের আগে পর্যন্ত নদী উপত্যকা দশ-বিশ ফিটও চওড়া নয় অঞ্চলবিশেষে। ঝুলন্ত খাত বাঁকে ভরা, ভূমিধসের কারণে ধ্বংসস্তূপ জমে রয়েছে স্থানে স্থানে। এখানেই নদীর নিম্নগতি। পাড়ে রয়েছে স্তরযুক্ত ঢাকনা যার ওপর অন্তত বারো ফিট হ্রদসৃষ্ট কাদার জমাট বস্তু। সুমদো এলাকা পর্যন্ত অত্যন্ত সংকীর্ণ উপত্যকায় নদী চলেছে পাথর কেটে খরস্রোতে। নব্যগাঠনিক অস্থিরতার প্রমাণ রয়েছে অববাহিকার সর্বাংশে যা সামগ্রিকভাবে হেলানো। এই সমস্ত চরিত্র নিয়েই রচিত হয়েছে নদীর গল্প।
অনন্ত প্রবাহ নদীর, কুঞ্জুম লা থেকে জন্ম নিয়ে চিরস্থায়ী হিমবাহের কল্যাণে সে পেয়েছে অফুরন্ত জল। এখানে তার যে কাহিনী উপত্যকা জুড়ে বর্ণিত হয়ে চলেছে চলনে-বলনে তাতেও দেখা যায় অনন্ত জীবনেরই স্রোত, হাজার হাজার বছরের পুরনো সমস্ত জনপদে আর বৌদ্ধ গুম্ফাতে। সেই অর্থে গৌতম বুদ্ধ গত হলেও তাঁর ধর্মমত অমর হয়ে রয়েছে এবং থাকবে। অনন্ত জীবনকে এই ধার্মিক আবহের প্রেক্ষিতেও উপলব্ধি করা যায়, যার ঘোষণা আপন প্রবাহের আঙ্গিকে জানিয়ে চলেছে স্পিতি নদী হাজার হাজার বছর ধরেই। এর পরেও অনন্ত জীবনকে না বোঝার কোন কারণ থাকতে পারে না, বোঝে না সেজন যে মোহাচ্ছন্ন থেকে দানবিক মনোভাবাপন্ন। এগিয়ে চলার যেমন কোন অন্ত নেই, অবিশ্রাম জলপ্রবাহেরও অন্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। মানুষের ইচ্ছের মতোই সমস্ত কিছু অনন্ত যাত্রায় সামিল। সীমায়িত পরিসরেও অন্তহীন। গ্রীষ্মকালে জলপ্রবাহ বেড়ে যায় নদীর, হিমবাহগুলি উত্তাপে গলে জল ঢালে যত পারে, অন্য সময় প্রবাহ ক্ষীণ এবং শীতে জমাট বেঁধে যায়। বৃষ্টিচ্ছায় শুকনো শীতল মরু পর্বতকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে স্পিতি সযত্নে যুগ যুগ ধরে। কুঞ্জম রেঞ্জ থেকে বেরিয়ে শতদ্রুতে গা ঢালার আগে পর্যন্ত দু’ধারে বহু উপনদী এসে তাকে আরো প্রাণবন্ত করে রেখেছে। পিন ভ্যালি থেকে সমস্ত জল বয়ে এনে পিন উপনদী তার সঙ্গে সমকৌণিকভাবে মিলেছে ডানধারে।সেই একই ধারে অন্য আরও উপনদীগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিওমো, গিয়ুন্ডি, রাহটাং, উলাহ্, লুংজা, পোমোগ্র্যাঙ, মামড্যাং ইত্যাদি। বামধারেও রয়েছে এমনই অনেক উপনদী। এদের নাম থামার, হানসে, থুমনা, তাগতিং, থুরপা, লুমোয়া, সিলা, কাজা, লিংতি, পোহ্, তাবো, কারাতি, গিমদো, পারেচু প্রমূখ। মালভূমির বুকে কঠিন পাথর কেটে এইসব উপনদী বয়ে আনছে অবিরাম ধারায় হিমবাহ গলা জল। এত জল বইতে গিয়ে স্পিতির কূল ছাপিয়ে যায়, সে আরও খরস্রোতা হয়ে ওঠে। এত তীব্র জলপ্রবাহ তাই নদীর বুকে কোন জৈবকণা জমতে দেয় না, শিলারাশিও উৎক্ষিপ্ত হয়ে যেতে থাকে, তলদেশে তাই কেবল কঠিন পাথরের শয্যা। প্রচণ্ড খরস্রোত বলে জৈবকণা তো বটেই অন্য কোন বস্তুও জমে থাকে না নদীর বুকে। নদীর জলে তাই মাছ বা অন্য জলজ প্রাণি থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবুও কিছু প্রজাতির মাছ পরিযায়ী হয়ে উজিয়ে আসে নিম্নধারা থেকে বিশেষত বর্ষাকালে বংশবিস্তারের জন্য। এদের মধ্যে প্রধান হল স্নো ট্রাউট মাছ। উপত্যকায় জেলে সম্প্রদায়ের কেউ না থাকলেও বাইরে থেকে আসা ক্ষণস্থায়ী শ্রমিকের দল বঁড়শি বা জাল ফেলে সেসব মাছ ধরে খায়।
এ সমস্ত কিছুই হল স্পিতি নদীর গল্প যাকে সে দিনের পর দিন ধরে দেখেছে উপত্যকায় থাকার সুবাদে।এই গল্প দেখারও কোন অন্ত নেই, শুরু হয়তো আছে এই অর্থে যেদিন থেকে দেখার সূত্রপাত। মোটকথা এই যে নদী তার গল্প অন্তহীন ধারায় শুনিয়ে চলেছে সতত সঞ্চরণশীল থেকে। হয়তো শীতকালে বুকের জল জমাট বেঁধে বরফ হয়ে যাওয়ার কারণে প্রবাহের গল্প থেমে থাকে কিছুকাল, কিন্তু নদী যেহেতু বিলুপ্ত হয় না তার গল্পও বজায় থাকে অন্য আঙ্গিকে। দু’ধারে ক্ষণস্থায়ী হিমবাহ জন্ম নিয়ে বানিয়ে দেয় অন্য গল্প। থাকে প্রবল শৈত্যপ্রবাহ আর বরফপাত। সেই অপরূপ রূপকথাও কম আকর্ষণীয় নয় যদিও সাধারণ মানুষেরা তখন আর আসে না সেখানে ওইরকম রূপ উপভোগ করার টানে।
পর্যটকদের গাড়ি এগিয়ে চলছিল জাতীয় সড়ক ধরে কুঞ্জুম গিরিদ্বার অভিমুখে। নামেই অবশ্য জাতীয় সড়ক, ক্রমাগত ধস নেমে আর ভূখণ্ডের ভঙ্গুর চরিত্রের কারণে তাকে নিজস্ব চরিত্র বজায় রাখতে দেয় না। যদিও রাস্তা মেরামত করার কাজ চলতেই থাকে নিরলসভাবে। সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক হল যে আজই কুঞ্জুম গিরিদ্বারে যাওয়ার দরকার নেই, কারণ যেতে যেতে বিকেল হয়ে যেতেও পারে। এদিক থেকে রাস্তা যতটা মন্থরভাবে খাড়াই হয়েছে লাহুলের দিকটাতে মোটেই তেমন নয়। বাত্তাল পর্যন্ত ন’ কিলোমিটার রাস্তা হঠাৎ নেমে গেছে অনেকটাই যেখানে আছে পনেরোটি কঠিন বাঁক। সে পথে বিকেলের পর না যাওয়াই ভালো, বিশেষত অনবরত জলধারা বয়ে চলেছে স্থানে স্থানে রাস্তার ওপর দিয়ে। পাগলা ঝোড়া বলে একটি প্রবাহ তো বলতে গেলে নদীর মতোই প্রবল এবং দুপুরের পর থেকে জলপ্রবাহ ভয়ানক আকার ধারণ করে। সবাই মিলে তাই ঠিক করল যে আজ রাতটা লোসার গ্রামে থেকে কাল ভোর ভোর রওনা দিয়ে গিরিদ্বারে পৌঁছনোই যুক্তিযুক্ত হবে।
চলতি পথে তার সঙ্গে গেরহার্টের কথাবার্তা হচ্ছিল অনন্ত জীবন নিয়ে। সে জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি কি বিশ্বাস কর মানুষ অনন্ত জীবনের অধিকারী হতে পারে ?’
‘নিশ্চয় পারে।’ জার্মান পর্যটক জানাতে লাগল, ‘আমার গবেষণার সূত্রে আমি বলতে পারি, প্রত্যেকটি মানুষই অনন্ত জীবন পেয়ে থাকে। তোমাদের দর্শনে তাই বলা হয়, মানুষ অমৃতস্য পুত্রা। অমৃতের অধিকার রয়েছে মানুষেরই হাতে, তুমি তা কাজে লাগাতে পারো কিনা সেটা তোমার ব্যাপার।’
‘অনন্ত জীবন অন্যকথায় অমরত্বকে বোঝায়। তার কি কোন সময়সীমা আছে ? বিজ্ঞান আর দর্শন দেখেছি ভিন্ন কথা বলে।’
‘ভিন্ন নয়, দু’টোরই বক্তব্য এক। বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে যেমন দর্শন হয় না, তেমনি দর্শন ছাড়াও বিজ্ঞান অচল। প্রশ্ন হল কোন্ দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুমি বিজ্ঞানকে বিচার করছ বা দেখতে চাইছ। তুমি যে ভিন্ন বক্তব্যের কথা বলছ সেটা দেখতে পাবে যদি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করতে চাও। তাহলে অমরত্বের সংজ্ঞা পাবে একেবারেই অন্যরকম। তাতে অমরত্ব মানে সময়ের সাপেক্ষে তোমার চলাচল থেমে যাওয়া, মানুষের স্বাভাবিক বৃদ্ধি সেখানে একই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে থাকবে, তুমি কোনোদিনও বার্ধক্যে উপনীত হবে না। ইচ্ছে অনুযায়ী তোমার অবস্থান হবে চিরশৈশবে বা চিরযুবা হিসেবে।’
‘সময় এগিয়ে যাবে অথচ আমি থেমে থাকব জীবনের এক বিন্দুতে। এটা কতটা বাস্তব বা গ্রহণযোগ্য ? প্রকৃতির কোথাও এই নিয়ম চলে বলে তুমি জানো কি ?’
‘জানিনা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোন অস্তিত্ব সময় নিরপেক্ষ হয়ে থাকতে পারে কতদিন আমার ধারণায় নেই। শুনেছি এমন ঘটনা ব্ল্যাক হোলগুলিতে হলেও হতে পারে। কিন্তু সে তো অন্য মাত্রাধীন ঘটনা।’
‘অন্য মাত্রাধীন কোন বিশ্ব আছে কিনা বা থাকলেও সেখানে কী ঘটছে তা জানার কোন আগ্রহ নেই আমার।’
‘সুযোগও নেই। মাল্টিভার্স তত্ত্ব একটা ধারণামাত্র।’
পিছন থেকে জানাল সাইমন। সে বলল,
‘ঠিক। আমি যা দেখছি তা সবই আমার চলতি বিশ্বের সাপেক্ষে। আমি যে অমরত্বের কথা ভাবছি তাও এই বিশ্বকে ভিত্তি করেই। এখানে কোন বস্তুর জীবনকাল সময়ের সাপেক্ষে বিচার না করে উপায় নেই। কতকাল কোন বস্তু টিকে থাকলে তাকে তার অমরত্ব বলা যেতে পারে, এই প্রশ্নটাই বিবেচ্য।’
‘এ বড়োই জটিল প্রশ্ন। এর কোন উত্তর আমার জানা নেই। তবে আমি বুঝি, অমরত্ব মানে জীবনকাল দীর্ঘায়িত হবে ভাবনাটা পাগলামি। অমরত্ব বল বা অনন্ত জীবন, তা তোমার যতটা জীবনকাল সেই পরিসরের মধ্যেই তুমি আয়ত্তে পেতে পার। আমি জানি, অনন্ত জীবন মানে জীবনের অনন্ত বিকাশ ও অনন্ত প্রকাশ। কোন এক মানুষ তার দশ বছরের জীবনকালে যা করতে পারে অন্য অনেকেই হয়তো তাদের পঞ্চাশ বা একশ’ বছরের জীবনকালেও তার এক শতাংশ করতে পারে না। সেই অর্থে অনন্ত জীবনকে তুমি মানুষের জীবনে প্রাপ্ত সাফল্যকে দিয়েও বিচার করতে পার। যে জীবনে যত সফল সে তত অনন্তকে মুঠোয় পাবে যত ক্ষুদ্র হোকনা কেন তার জীবনকাল। সাফল্য ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন মানুষকে অমর করে রাখে। অবশ্য তারও সময়সীমা নির্দিষ্ট হতে বাধ্য। মনে কর, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মানুষ তাঁকে আজও মনে রেখেছে, মনে রাখবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও। কিন্তু যদি মানুষের সভ্যতা কোন কারণে বিলুপ্ত হয়ে যায় আর হারিয়ে যায় মানুষের সব নিশানা তো ভিঞ্চির নামও কি মুছে যাবে না ?’
‘তার মানে যতই দীর্ঘ হোক জীবনকাল, অমরত্বের সীমানা থাকতে বাধ্য। আর মানুষের সভ্যতায় মানুষ অমর হতে পারবে যদি সভ্যতা টিকে থাকে।’
‘সেটাই প্রথম কথা। আমি তাই অনন্ত জীবনকে অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে থাকি। তোমাকে তার কথা বলতে পারি। হয়তো তুমিও একমত হবে। জীবনকে তুমি ভাবতে পার ঘটনার সাপেক্ষে। প্রত্যেক মানুষের জীবন হল অজস্র ঘটনার সমাহার। তার কোন অন্ত নেই। গোটা জীবনকে দেখার দরকার নেই, জীবনের এক ক্ষুদ্র সময়কে দেখ। ধর, এক মিনিট। কোন মানুষ তার জীবনের কোন এক মিনিট সময়ে অনন্ত ঘটনা ঘটতে দেখে, জ্ঞাত বা অজ্ঞাতভাবে। সারা পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি মানুষ, তাদের প্রত্যেকের জীবনে কোন এক মিনিটে ঘটে কোটি কোটি ঘটনা। তাহলে কোন একজন মানুষ সেই মিনিটে সেইসব কোটি কোটি ঘটনাকে সরাসরি প্রত্যক্ষ না করতে পারলেও পরোক্ষভাবে তাদের সঙ্গে যুক্ত থাকতে বাধ্য যেহেতু প্রত্যেকটি মানুষই সমাজের বা এই অখণ্ড ঘটনামাধ্যমের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেই অর্থে প্রতিটি মানুষের জীবনে জড়িয়ে থাকছে অনন্ত ঘটনা, প্রতি মিনিটে। গোটা জীবনকে ভেবে দেখ তাহলে, ঘটনা কত পরিমাণে অনন্ত হয়ে যায় প্রত্যেকের জীবনে। সেইসব ঘটনা দিয়ে সাজাও তোমার জীবন, তুমি অনন্তকে পেয়ে যাবে হাতের নাগালে। মানুষ এই অর্থে অনন্ত জীবনের অধিকারী বলে আমি মনে করি। জীবনের এক ক্ষুদ্র পরিসরে এভাবে যে অনন্তের সন্ধান পেলাম আমি তা আমার জীবনকে অনাদি কালের আয়তনে পৌঁছে দেবে অবশ্যই। আমি অনাদিকাল বেঁচে থাকব না ঠিক, কিন্তু যে অনন্ত ঘটনা আমার জীবনকালে ঘটবে আমার জন্য, সেসব অনন্ত ঘটনার সঙ্গে আমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে যেতে থাকব, তারা আমাকে অনন্ত জীবন দিয়ে দেবে। আমার ক্ষুদ্র পরিসরের জীবনে এভাবেই দেখা যাবে অনন্তের বিকাশ ও প্রকাশ। আমার ধারণায় এটাই হল অনন্ত জীবনের যথার্থ ব্যাখ্যা।’
এই ব্যাখ্যা মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা তার নজরে এলো না। প্রকৃতই প্রত্যেকের জীবন গঠিত অনন্ত ঘটনাসমূহের সমন্বয়ে। জীবনের পরিসর যেটুকুই হোক না কেন সেখানেই অনন্তের সন্ধান পাওয়া সম্ভব। এভাবে অনন্তকে উপলব্ধি করতে পারে যেজন তার কাছে জীবন অনন্ত অবশ্যই। আমি হাজার হাজার বছর বেঁচে না থাকলেও কোটি কোটি ঘটনা ঘটে গেল আমার যে জীবনে তাকে অনন্ত বলে কেন ভাবব না আমি ? তার মনে হল, গেরহার্টের এই ব্যাখ্যা খুবই যুক্তিযুক্ত। আর একটু আগে সাফল্যের সাপেক্ষে অনন্ত জীবনের যে ব্যাখ্যা দিয়েছিল সে তাকেও গ্রহণযোগ্য বলেই মনে হল। জীবনকে তুমি কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছ সেখানেই রয়েছে তুমি অনন্ত জীবন পেলে কি পেলে না তার জবাব। তোমার বয়স না বেড়ে গেলে অথবা স্বাভাবিক বৃদ্ধি না থেমে গেলেও তুমি অনন্ত জীবনকে করায়ত্ত করতে পারবে যদি তুমি খুঁজে পাও জীবনের অনন্ত বিকাশকে বা অনন্ত প্রকাশকে। তার মনে হল, এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী জীবন অনন্ত হতে পারে আরও বহু বহু বিষয়ের সাপেক্ষে। তাদের মধ্যে অবশ্যই একটি হবে অনন্ত চাহিদা। প্রত্যেকের জীবনেই রয়েছে এই বিষয় এবং পূর্ণ হোক বা অপূর্ণ থাকুক, জীবনের সমস্ত চাহিদাসমূহের ভিত্তিতে বিচার করলেও অনন্তকে দেখতে পাবে যে কেউ তার জীবনে। এছাড়াও মানুষের জীবন গঠিত অনন্ত কাজকর্ম, অনন্ত আবেগ, অনন্ত মেলামেশা, অনন্ত জ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের সমন্বয়ে। এই সমস্ত বিষয়ের ভিত্তিতেও জীবনকে অনন্ত বলে ভাবা যেতেই পারে যত ক্ষুদ্র হোক না কেন জীবনকাল। তাছাড়াও আছে প্রতিটি মানুষের জন্যই অন্যান্য মানুষ ও বস্তু বা বিষয়সমূহের সঙ্গে অনন্ত সম্পর্ক। এর ভিত্তিতেও বলা যেতে পারে যে একজন মানুষ অনন্ত জীবনের অধিকারী। অনন্ত জীবনের ধারণাতে যে এতো বৈচিত্র্য রয়েছে সে এতদিন একা ভেবে বুঝতে পারেনি। সেদিক থেকে গেরহার্টের সঙ্গে এই যে দেখা সেটা সত্যি উপকারে লাগল।
লোসার গ্রামে যেতে যেতে বিকেল হয়ে এলো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই অঞ্চলটির উচ্চতা প্রায় তেরো হাজার ফিট। এখান থেকে কুঞ্জুম পাসের দূরত্ব পনের থেকে আঠেরো কিলোমিটারের মধ্যে এবং এই দূরত্ব উঠে গেছে আরও প্রায় দু’হাজার ফিট ক্রমান্বয়ে। গ্রামে ঢোকার মুখে লোসার এবং পিনো ঝরনাদু’টি মিলিত হয়েছে, ওপর দিয়ে রয়েছে ব্রিজ। রাত্রিটা তারা সেখানেই কাটাল। সঙ্গে তাদের খাবার-দাবার ছিল যথেষ্টই, তবে খাবারের দোকান পেয়ে গেল তারা। পরদিন সকাল-সকাল উঠেই যাত্রা শুরু হল কুঞ্জুম গিরিদ্বার অভিমুখে। পথ ক্রমশ উঠে যাচ্ছিল ঘুরে ঘুরে। ধূ-ধূ মরুপ্রান্তরের মধ্যে দিয়ে পথ, ডানধারে ছিল স্পিতির একটি উপনদী। গতিবেগ তেমন ছিল না গাড়ির, তবুও কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই কুঞ্জুম গিরিদ্বারে পৌঁছে গেল তারা। এখানে রাস্তা বলে নেই কিছু তেমন, অনেকটা প্রায় মেঠো পথের মত অবস্থা, তাও আবার ভাঙাচোরা। বরফের চাঙড় পড়ে আছে স্থানে স্থানে। তিব্বতীয় বৌদ্ধ পতাকা সারি সারি ঝুলছে গিরিদ্বারে সর্বত্র রঙিন শোভা হয়ে। আর রয়েছে সেখানে কুঞ্জুম মাতার মন্দির, দেবী দুর্গারই এক বিশেষ রূপ। তাদের গাড়ির ড্রাইভার মায়ের মন্দিরে গিয়ে পুজো দিল, কারণ এই দুর্গম পথের যাত্রায় মায়ের আশীর্বাদ অবশ্য কাম্য। গিরিদ্বার উচ্চতায় চোদ্দ হাজার ন’শ একত্রিশ ফিট। তার তুলনায় বড়া ভাঙ্গাল যেতে সে যে কালিহানি পাস্ পেরিয়েছিল তা আরও বেশি উঁচু। সেই কালিহানি পাস্ উচ্চতায় ছিল পনের হাজার সাতশ’ আটচল্লিশ ফিট। তবুও কুঞ্জুম গিরিদ্বারের শোভা ও বৈচিত্র্য কোন অংশেই কম নয়। তার একদিকে রয়েছে স্পিতি উপত্যকার শুষ্ক রুক্ষ পরিবেশ এবং অন্যদিকে লাহুল অঞ্চল। সেদিকে দেখা যাচ্ছিল বিশাল বিশাল হিমবাহগুলিকে। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম হিমবাহ বড়া সিগ্রি ছাড়াও ছিল চন্দ্রভাগা হিমবাহের জৌলুষ। যেদিকে চোখ যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল বুঝি এ পৃথিবীর বাইরে কোন পরিবেশ।
গিরিদ্বার পেরিয়ে গাড়ি চলল লাহুলের দিকে। পনেরোটি চুলের কাঁটা সদৃশ তীক্ষ্ণ বাঁক পেরিয়ে ন’ কিলোমিটার যাওয়ার পর বাত্তাল। সেখানে চন্দ্রভাগা নদীর ব্রিজ পার হয়ে গ্রামফু পর্যন্ত চলে গেছে রাস্তা। একের পর এক ঝরনা চলেছে রাস্তার ওপর দিয়ে। পাগলা ঝোড়া পড়ল একসময়। তার উত্তাল জলস্রোতে সাঁতার কেটেই পার হতে হল গাড়িকে। যথেষ্ট উঁচু চেসিস হওয়ার জন্য আটকে গেল না গাড়ি। তাদের লক্ষ্য এবার চন্দ্র লেক বা চন্দ্রতাল।
চন্দ্রতাল সে আগেও দেখে গেছে, বাদামি পাহাড়ের দেয়াল দিয়ে ঘেরা বর্তুলাকার স্বচ্ছ নীল জলের নীরব সরোবর, সবাই ভাবে এখনও গভীর রাতে দেবকন্যা আর পরীদের দল এখানে জলবিহার করতে চলে আসে। সে যাই হোক, সরোবরের শোভা মনোমুগদ্ধকর। চারপাশ ঘুরে পর্যটকের দল দেখল ওই হ্রদ, ছবি তুলে নিল নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। তাদের কাছে নিশ্চুপ গম্ভীর পাহাড়ের বর্ণমাধুর্য দিয়ে ঘেরা এই হ্রদের অবস্থান দৃষ্টিনন্দন উপস্থিতি। নানা ভাঁজে উঠে গেছে পাথুরে পাহাড়ের দেয়ালগুলি, তৈরি করেছে ঢেউখেলানো পাষাণের সোপান ও সংকীর্ণ চত্বর। দেয়ালের খাঁজে খাঁজে জমিয়ে তুলেছে রহস্যময় আলিঙ্গন।
‘এখন থেকে আমরা কিন্তু আর এগিয়ে যাচ্ছি না। ফিরে যাব ফেলে আসা রাস্তা ধরে। সবাই নিশ্চয় রাজি ?’
সে ভাবল, যদি সবাই রাজি না হয় তো তাকে কোথায় ছেড়ে দেবে পর্যটকরা। তার অবশ্য আপত্তি নেই কোনকিছুতেই। যদিবা এখানেও ছেড়ে দেয় তাকে তো সে এখান থাকে হেঁটেই চলে যাবে কুঞ্জুম গিরিদ্বারে, খুব বেশি হলে যা চল্লিশ কিলোমিটার হবে। দু’দিনও লাগবে না তার। সেখান থেকে কাজা যেতে তার লাগবে আরও দু’দিন। পথে পেয়ে যেতে পারে অন্য পর্যটকের গাড়িও। সে না চাইলেও তাকে কেউ না কেউ যেচে তুলে নিতে চায় তাদের সঙ্গে। না নিলেও তার ক্ষতি নেই, কারণ এই রুক্ষ ভূখণ্ড ধরে সে যেতে থাকবে স্পিতি নদীকে পাশে নিয়ে, তার সঙ্গে গল্প করতে করতে। পথে সে পেয়ে যাবে নানান জনপদ, দশ-বিশ কিলোমিটারের মধ্যে। রাতের আশ্রয় মিলবে সেখানেই। কিন্তু তাকে আর বেশি ভাবতে না দিয়ে আগে বলা কথার রেশ ধরে গেরহার্ট যোগ করল,
‘যদি আমরা এখান থেকে ফিরে না গিয়ে এগিয়ে যেতে চাই তো আমার মনে হয় খানিকটা পিছিয়ে যেতেই হবে, কারণ ওকে কাজাতে রেখে আসা আমাদের কর্তব্য।’
সে জানাল যে তার দরকার নেই। তার মনোভাব স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেও সে কথা মানল না কেউ। দলের অন্য একজন বলল,
‘আমরা তো আগেই ঠিক করেছিলাম যে এখান থেকে আবার ফিরে যাব। সেই সিদ্ধান্ত পাল্টাবার কারণ কোথায় ?’
‘সেজন্য আমরা আসার পথে তাবো ঘুরে দেখিনি, যেহেতু ফেরার পথে দেখব বলে ঠিক করেছিলাম।’
অন্য এক সদস্য মতামত জানাল। সাইমন বলল,
‘ তাছাড়া আমরা পিন ভ্যালি জাতীয় উদ্যানও দেখিনি, যাইনি ধনকর গ্রামে।’
‘শোন, আমাদের হাতে কিন্তু সময় খুব কম। আমরা কাজা, কিবের, লাঙ্গজা, হিক্কিম থেকে শুরু করে অনেক জায়গা দেখে অনেকটা সময় শেষ করে ফেলেছি। দেখেছি কি মনাস্ট্রি ও কিবের জাতীয় উদ্যানও। স্পিতি ভ্যালিতে কি মনাস্ট্রি আর তাবো গুম্ফা, এ দুটিই প্রধান বৌদ্ধ পীঠ। পিন ভ্যালি ন্যাশানাল পার্ক এবং তার পাশে পিন নদীর ধারে মাড ভিলেজও অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থান। আর বাকি থাকল ধনকর গুম্ফা। কিন্তু সবক’টি আমরা এবার কিছুতেই দেখার সময় পাব না। ধনকরে থাকতে হবে অন্তত একরাত, পিন ভ্যালি আর মাড ভিলেজে দু’রাত, এতো দিন তো আমাদের হাতে নেই। তাবোতেও থাকা উচিত একরাত। আর এক করা যায়, একদিনেই পিন ভ্যালি আর ধনকর ছুঁয়ে আসা যায়, কিন্তু তাবোতে একরাত থাকতেই হবে যদি সব দেখতে চাও। কী করবে বল ?’
গুঞ্জন তুলে পরামর্শ করতে লাগল বাকি সদস্যরা। সে চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল সব। এদের সঙ্গ তার বেশ ভালোই লাগছিল এই কারণে যে দলের সবাই মার্জিত ও ভদ্র। দীর্ঘ আলোচনার পর একজন মুখপাত্র হিসেবে বলল,
‘দেখ, পিন ভ্যালি দেখার ইচ্ছে আমাদের যথেষ্ট। শুনেছি কুড়ি হাজার ফিট এই আলপাইন অরণ্যের সর্বোচ্চ উচ্চতা, রয়েছে দুর্লভ প্রজাতির নানান প্রাণি। তবুও আমরা ভাবছি এটাকেই বরং বাদ দেওয়া যায়, কারণ আলপাইন অরণ্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। আর ধনকর গুম্ফার তুলনায় তাবো অনেক বেশি আকর্ষণীয় যেহেতু তাবোকে বলা হয় দ্বিতীয় অজন্তা, বৌদ্ধ সংস্কৃতির অন্যতম সেরা পীঠস্থান। তাই আমরা ঠিক করলাম যে তাবোকেই দেখব।’
কিন্তু সেদিন তাবো যাওয়া হল না। ফেরার পথে কুঞ্জুম যেতে লেগে গেল অনেকটা সময়, সেখানে আবার থাকা হল কিছুক্ষণ। তারপর রওনা দিয়ে কাজা যেতে যেতে প্রায় বিকেল। তাবোতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল দুপুরের মধ্যে। তা না হওয়ার কারণে সে রাত কাজাতেই থেকে গেল সবাই। ঠিক হল, পরদিন সকাল-সকাল তাবোর উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া যাবে।
অধ্যায় : পনেরো
জাদুজগতের মেলার মাঠে জনতা চলমানই ছিল, যদিও তার কথা অনুযায়ী এই চলাচল মূল মেলার মাঠ থেকে পিছিয়ে রয়েছে কিছুটা, তাতে কোন ইতরবিশেষ পরিলক্ষিত হওয়ার কথা নয়। হয়তো মূল মেলার মাঠে আরও কিছু নতুন মানুষের আগমন ঘটেছে শিশু অবস্থাতে, কিছু লোক ধরাধাম বর্জন করেছে মৃত্যুর অমোঘ বিধানে, কোন নতুন সংযোজন ঘটেছে শিল্প ও সমাজের কাঠামোতে, কারো কর্মপ্রাপ্তি ঘটেছে, কোন দেশের রাজনৈতিক আবহে চ্যুতি-বিচ্যুতি হয়ে গেছে, বহু আকাঙ্খা মিটেছে অনেকের, অশান্তির আগমন দেখা দিয়েছে নানা জীবনে ও ক্ষেত্রবিশেষে—- তবে সেসব কিছুই ঘোরতর কোন বিপর্যয় আনতে পারেনি স্বাভাবিক চলমান জনস্রোতে। আসলে মায়াপ্রকল্পাধীন মেলার মাঠ এগিয়ে যায়নি ঘন্টাখানেক সময়ও, একঘন্টা পিছিয়ে থেকে জাদুপ্রকল্পে চলমান যে জনসমুদ্র তাকে পৃথক বলে বেশি ভাবার কারণ থাকতে পারে না। এখানকার মেলার মাঠ তার কাছে তার জন্য তেমনই ঘটমান বর্তমানেই স্থিত অবস্থায় চলমান বলেই প্রত্যক্ষ করছিল সে।
জাগতিক কাঠামোতে তেমন কোন বিপুল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হল না যদিওবা তার মানসিক কাঠামোতে সে বিপর্যয়ের সন্ধান পেল। যে জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হতে হল তাকে নতুন করে তার প্রত্যাশা করেনি কোনক্রমেও। বেঁচে থাকাটা আসল লক্ষ্য, একমাত্র বলেই ধরে নেওয়াতে তার কোন আপত্তির হেতু সে খুঁজে পায়নি। খেয়াল রাখেনি এই চাতুরীটাকে যে দিগদর্শক ক্রমান্বয়ে সেটাকে প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে বলে এসেছে বরাবর। এখন সে তাই জেনে খাবি খেয়ে গেল যে ওটা হচ্ছে জীবনের প্রয়োজনীয় শর্ত, যথেষ্ট নয়, আরও বড় শর্ত রয়েছে তার জন্য। সেটাকেই কোটিকল্প তার সামনে উপস্থাপিত করেছে অনিবার্য প্রশ্নস্বরূপ, যে প্রশ্নের সম্মুখে সে নির্বাক হয়ে গেছে। মানুষের সাদামাটা জীবনধারণের অথবা জীবনযাপনের পশ্চাতে যে এতো এতো প্রশ্ন লুক্কায়িত থাকতে পারে মেলার মাঠে হারিয়ে থাকার প্রাক্কালে বা পরবর্তীকালে সে কিছুমাত্র অবহিত ছিল না। কেউ কি থাকতে পারে ? চলমান জনতা সমুদয়কে দেখে তা অনুমান করার কোন উপক্রমই নেই। এই ভিড়ে সামিল বহু গবেষক, বহু চিন্তাবিদ, বহু দার্শনিক, বহু ত্রিকালজ্ঞ জ্ঞানী নারীপুরুষের সমারোহ। তারাও কেউ ভাবে না অন্তর্নিহিত এ সমস্ত গুহ্য তত্ত্বসমূহ। নিশ্চয় জানে, যেহেতু জ্ঞান কোন ব্যক্তিবিশেষের আয়ত্তাধীন ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। তাহলে সমস্ত তথ্য অবগত হয়েও কেন সে স